সারারাত ফুটপাথ
রাত সাড়ে আটটা। ভিড়ে ঠাসা বারদুয়ারির দোতলা। সিগারেট-বিড়ির ধোঁয়া, চাট আর অ্যালকোহলের পাঁচমিশেলি গন্ধে ভারী হয়ে আছে ঘরটা। পচা ঘেমো ভ্যাপসাটে গরম। সার সার ফাটা ফাটা পুরনো লম্বাটে কাঠের টেবিল। টেবিলের ওপর শালপাতায় বিটনুন মাখা ছাল ছাড়ানো বাতাবিলেবু আর চানা মিক্সচারের ধ্বংসাবশেষের পাশে সেই সন্ধে সাড়ে ছটা থেকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা বাংলার পাঁইট। তলায় ইঞ্চিটাক গভীর মদিরার তলানি। ‘এবার উঠতে হবে’ হাঁক পেড়ে ঘুরে যাচ্ছে কর্মচারীরা। অতএব গেলাসে ঢেলে জল মিশিয়ে একচুমুকে তলানিটুকু শেষ করা। হাল্কা টাল খেয়ে উঠে দাঁড়ানো টেবিল ছেড়ে। কর্পোরেশনের কেরানি, শেয়ার মার্কেটের খুচরো দালাল, হাফচিটিংবাজ ফোতো বাবু, ফ্রাস্টেটেড কবি, মেঝেয় বসে শুধু বিটনুন দিয়ে চাট করা রিকশাওয়ালা সবাই যে যার আস্তানায় ফিরতে ব্যস্ত। একতলায় নামবার সিঁড়িটার মুখে বেজায় জটলা। সবাই একসাথে নামতে চায়। ফলে হই হল্লা, ঠ্যালাঠেলি, খেস্তাখেস্তি… ঠেলেঠুলে নেমে আসা একতলায়। কাউন্টারে বোতল ফেরত দেবার ভিড়। পাঁইট ফেরত দিয়ে পাওয়া দু টাকার নোট আর এক টাকার কয়েন। ডিপোজিট মানি। বাইরে বেরোনোর গেটের মুখেই সামনে টেবিলটায় উপুড় হয়ে পড়ে থাকা বউমরা হারুদা। বছর ষাটেক। বাড়ি তালতলায়। রফি সাহেবের ডাই-হার্ড ফ্যান। একটু চড়ে গেলেই করুণ গলায়, ‘শুকনো ফুলের মালার মতো’ এই অবধি গেয়েই ঠকাস করে মাথা ঠুকে পড়ে যান টেবিলে। পরের কথাগুলো কমপ্লিট করতে শুনিনি কোনও দিন। এই মুহূর্তে মিডলস্ট্যাম্প ছিটকে ক্লিন বোল্ড আউট। কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিচ্ছে বুধো। বারদুয়ারির অল পারপাস জব পারসোনেল। খদ্দেরদের চাট-গুটখা-সিগারেট এনে দেয়। আপাতত বেশ খানিকটা বিরক্ত চোখমুখের চেহারা। সেটা ফুটেও বেরোচ্ছে গলায়, ‘ও হারুদা, কী হল কী? দোকান বন্ধ হবে… ওঠো না। ধুর বাঁড়া! এইসব মাতালমারানি শুঢঢাদের নিয়ে হয়েছে যত শালা ঝামেলা…’
অতঃপর হে মহামহিম পাঠককুল, আপাতত এইসব অবিস্মরণীয় এবং মনোমুগ্ধকর দৃশ্যপট আর বাক্যবন্ধকে পিছনে সরিয়ে রেখে আসুন, ফুটপাতে নামা যাক। ডাইনে ঘুরেই বারদুয়ারির হলুদ দেওয়ালের গায়ে ল্যাম্পপোস্টের ফিকে আলোয় ফুটপাতে মিশির ভাইয়ের লিট্টি বিপণি। সম্বল বলতে একটা ছোট মাটির উনুন। উনুনের ওপর লোহার তাওয়া। পাশে বড় বড় দুটো বাটিতে আটা মাখা আর কাঁচা লঙ্কার কুচি মেশানো ছাতুর পুর। কাঠের বেলন-চাকি। ছোট ছোট করে লেচি বেলে নিয়ে মাঝখানে একটু ছাতুর পুর। গোল গোল করে পাকিয়ে সেঁকে নেয় উনুনের আঁচে। সঙ্গে মাখা মাখা সেদ্ধ আলুর চোখা আর রসুন কাঁচালঙ্কার চাটনি। শীতকালে সস্তাগন্ডার বাজারে আলুর সঙ্গে বেগুন আর টমাটোও থাকে। চাটনিতে যোগ হয় ধনে পাতা, কালেভদ্রে পুদিনা। বারদুয়ারি থেকে বেরিয়ে মিশির ভাইয়ের দুটো লিট্টি। ইংরেজিতে যাকে বলে গিয়ে — মাস্ট। উল্টোফুটেই হামিদ চাচার পুরনো বই আর ম্যাগাজিনের দোকান। বাপের আমলের। শুনেছি এই দোকান থেকেই নাকি খুঁজে খুঁজে পুরনো ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক কিনতেন বিভূতিভূষণ। গোগ্রাসে গিলতেন সংখ্যাগুলো। জীবনে কোনওদিন আফ্রিকা যাননি। শুধুমাত্র পড়েই লিখে ফেলেছিলেন আস্ত একখানা ‘চাঁদের পাহাড়’। ‘আমি জীবনে অনেকবার আফ্রিকা গেছি। হয়তো আরও যাব। কিন্তু হাজারবার গিয়েও আমার পক্ষে একটা চাঁদের পাহাড় লেখা সম্ভব নয় ।’ বলেছিলেন খ্যাতনামা সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ। ঠিক একই ভাবে এই দোকানেই ছেঁড়াফাটা, ডাঁই করে রাখা স্টারডাস্ট, ফিল্মফেয়ার, ডেবনিয়ার আর স্পোর্টসউইকের পাঁজা ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাই একদিন ১৯৭০-এর ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ডায়ান ফসি সংখ্যাটা পেয়ে গেছিল এই অধম প্রতিবেদকও। ডায়ান ফসি। বছর পঁচিশের উজ্জ্বল তরুণী। জীববিজ্ঞানের গবেষক আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে। ধনী দেশে গবেষণা করে সুখে স্বাচ্ছন্দ্যেই কাটিয়ে দিতে পারতেন বাকি জীবনটা। তা না করে চলে গেলেন কঙ্গো রেইন ফরেস্টের গহিন অরণ্যে। সেখানকার বিলুপ্তপ্রায় মাউন্টেন গোরিলাদের বাঁচানোর জন্য। বহু কায়েমি স্বার্থে ঘা পড়ল। শেষমেশ খুন হয়ে গেলেন চোরাশিকারিদের হাতে। সংখ্যাটা আজও যত্ন করে বাঁধানো আছে বইয়ের তাকে।
এই দেখুন, লিখতে বসলাম ফুটপাথ নিয়ে, এসে পড়লেন বিভূতিভূষণ, বুদ্ধদেব গুহ, ডায়ান ফাসি। উঁকি মেরে গেল চাঁদের পাহাড়, কঙ্গোর রেইন ফরেস্ট। কী মুশকিল! যাক গে, এসব স্মৃতির কচকচানি হটিয়ে চলুন হাঁটা লাগানো যাক দক্ষিণমুখো। ডানফুটে লোহালক্কর, পার্টস আর বাঁ ফুটে সস্তা লুঙ্গি, ফতুয়া, পাঞ্জাবি-পাজামার ছোট ছোট দোকানগুলো পেরিয়ে জানবাজার মোড়। ফটো বাঁধাইয়ের স্টল, ফলপট্টি, সুপুরিপট্টি, মুদিখানা আর পাখির খাবারের দোকানগুলো শেষ হলেই সিদ্ধেশ্বরী আশ্রম। কলকাতায় আদি বাঙ্গালি খানার হাতে গোনা শেষ কয়েকটি হোটেলের মধ্যে একটি। রানি রাসমণির বাড়ির গায়ে। মাছের মুড়োর মুগডাল, মুড়িঘণ্ট, ঝুরো ঝুরো আলুভাজা, শুক্তো, পাকাপোনার কালিয়া, গরমের সময় শেষ পাতে তিন ফালি করে কাটা সুপক্ক হিমসাগর আম। খেয়ে বেরনোর পর মনে হবে, স্বর্গ যদি কোথাও থাকে, তা এখানেই। ফারাক শুধু কাশ্মীরের জায়গায় জানবাজার।
রাত সাড়ে ন’টা। হোটেল বন্ধ হওয়ার মুখে মুখে তড়িঘড়ি খেতে ঢুকছেন রোজকার বাঁধা খদ্দেররা। আপাতত নিজের ঢোকার কোনও প্রশ্নই নেই। তাই ফের টাপলা খেতে খেতে হাঁটা শুরু সামনে ফ্রি স্কুল স্ট্রিট ধরে। ফায়ার ব্রিগেডের গায়ে হবনার। শাটার বন্ধ হচ্ছে দ্রুত। শো-কেসে সাজানো গিটার, কি-বোর্ড, সিন্থেসাইজার, জ্যাজড্রাম আর সেই বিশাল স্যাক্সোফোন। জীবনে ছেলেবেলায় রথের মেলায় কেনা ভেঁপু বাঁশি ছাড়া আর কোনও কিছুতে ফুঁ দিয়ে দেখিনি কোনও দিন। কিন্তু রাতে কতবার যে স্বপ্ন দেখেছি, চোখের সামনে হাট হয়ে খুলে যাচ্ছে হবনারের শো-কেস। তিসরি মঞ্জিলের শাম্মি কাপুরের মতো দু’পা ফাঁক করে স্টেজের ওপর দাঁড়িয়ে আমি… গলায় রফি সাহেব… ইয়ে দুনিয়া উসিকি, জমানা উসিকা… হাতের মুঠোয় ধরা স্যাক্সোয় সেই সাপ খেলানো সুর… হবনারের উল্টোফুটে সার সার ইংলিশ পেপার ব্যাক আর পুরনো রেকর্ডের দোকান। যতবার চোখে পড়ে ততবারই হড়কা বানের মতো বুকের মধ্যে লাফ দিয়ে নামা একঝাঁক স্মৃতি… এখান থেকেই দরদাম করে কিনে ফেলা কত সেকেন্ড হ্যান্ড লং প্লেয়িং রেকর্ড আর পেপারব্যাক… লুই আর্মস্ট্রং, বিং ক্রসবি, নীল ডায়মন্ড, ভেঞ্চারস, উডি গাথারি, কেনি জি, বিটলস্… হেমিংওয়ের ‘ফর হুম দ্য বেল টোলস’ আর জ্যাক লন্ডনের ‘হোয়াইট ফ্যাং’… তারপর গুটি গুটি পায়ে দল বেঁধে ঢুকে পড়া সদর স্ট্রিটে। সেটা সত্তরের শেষ ভাগ। ছেঁড়া জামাকাপড়, জটপড়া চুল আর বাউলঝোলা কাঁধে হিপিরা তখনও পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি শহর থেকে। ইতিউতি বসে থাকা ফুটপাতে এখানে ওখানে… একই কল্কেয় গাঁজায় টান রিক্সাওয়ালার সঙ্গে… ছিলিম থেকে লাফ দিয়ে ওঠা আগুনের হল্কা… শহরের বুকে লালন খ্যাপার আখড়া যেন। শিকাগো থেকে সদর স্ট্রিট… সুর মিলে মিশে একাকার কলকাতায়। তখন সদর স্ট্রিট শাসন করত কাইয়ুম। বেঁটে খাটো চেহারা। লুঙ্গির গেঁজে চরসের পুরিয়া। সদ্য আমদানি হয়েছে কলকাতায়। চটচটে পিচের ড্যালার মতো ছোট্ট একটা গুলি। আগুনে সেঁকে নিয়ে গুঁড়িয়ে চালান করে দেয়া সিগারেটের রিফারে অথবা কল্কেয়। বাকিটা রূপকথা। সব স্বপ্নই যেখানে জীবন্ত… ঝিমঝিম অতীত আর স্বপ্নের চটকাটা কাটিয়ে আবার ফিরে আসা বাস্তবের জমিতে। এসে দাঁড়িয়ে পড়া ফ্রি স্কুল স্ট্রিট আর মার্কুইস স্ট্রিটের মোড়ে। হাতের ডানদিকে ছিল যমুনা সিনেমা। ছিল মানে এখন আর নেই। মাল্টিপ্লেক্স, সিডি, ডিভিডি, পেনড্রাইভ আর ডাউনলোডের যৌথ গুঁতোয় অনেকদিন হল পাততাড়ি গুটিয়েছে শহর থেকে। এখানেই সিঙ্গল স্ক্রিনে দেখা স্টিফেন স্পিলবার্গের ‘জস’, জোসেফ লেভিনের ‘সোলজার ব্লু… অবিস্মরণীয় সব ছায়াছবি। এখন সেখানে একটা হোটেল জাতীয় কিছু। ঝকঝকে কংক্রিটের খাঁচা। কোনও জানলা নেই (অন্তত চোখে পড়ছে না)। খোপে খোপে শুধু এসি মেশিন। দেখলেই দম আটকে আসে কীরকম একটা। এই রে! আবার সেই স্মৃতির চক্করে। তবে বেশ বুঝতে পারছি, এরকমটাই চলবে আজ সারারাত। অতীত আর বর্তমানের মধ্যে অবাধ বিচরণ। বারবার। কিন্তু সারারাত কেন? উত্তরটা তো ভারী সোজা। বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না যে। পেত্নীজলার চোরাপাঁকে কুহকিনী আলেয়ার মতো আমায় টানছে রাত কলকাতার ফুটপাত।
রাত সাড়ে দশটা। সামান্য এগোতেই ‘হাউ হুয়া’। কলকাতায় সবচেয়ে পুরনো চিনে রেস্তোঁরাগুলোর মধ্যে অন্যতম। একমাত্র এখানেই পাওয়া যেত সেই দুই অমৃত পদ। চিমনি ডাক স্যুপ আর রোস্টেড পিপিং ডাক। যমুনার মতো হাউ হুয়াও অতীত এখন। ঠিক একই ভাবে অতীত মোড়ের উল্টোদিকে খালিকুঠিটা। খালিকুঠি। গোপন মধুচক্র। হলুদ রঙের দেওয়াল আর সবুজ রঙের দরজা জানালা। এ অঞ্চলের প্রত্যেকটা বাড়ির ওটাই সিম্বল। দালালদের সহায়তা ছাড়া ঢোকা যেত না ওইসব বাড়িগুলোয়। সন্ধে হলেই লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে খালিকুঠির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ত দালালরা। রসিক খদ্দের বুঝলেই লেগে যেত পিছনে ‘কলেজ গার্ল স্যর… একদম কচি চিজ…।’ সেসব পাট চুকেবুকে গেছে অনেকদিন। প্রত্যেকটা খালিকুঠিই এখন কলকাতায় শপিং আর ট্রিটমেন্ট করতে আসা বাংলাদেশিদের থাকার হোটেল। সাময়িক মাথা গোঁজার আস্তানা। খালিকুঠির উল্টোফুটে সস্তা মুসলমান ঢুলিয়া হোটেল। যাক। এটা অন্তত উঠে যায়নি এখনও। এত রাতেও হোটেলের সামনে লম্বাটে চৌকোনা মাটির উনুনে সেঁকা হচ্ছে শিক কাবাব। অবশ্যই বিফ। মুচমুচে পরতওয়ালা, ডালডায় ভাজা পরোটার মধ্যে ভরে এক টুকরো কাগজে মুড়ে দেওয়া। সামান্য ঝিরিঝিরি করে কাটা পেঁয়াজ আর কাগজের ফাঁকে গোঁজা একটা কাঁচা লঙ্কা। সসফস জাতীয় এক্সট্রা কোনও চালিয়াতি নেই। দাম ? মাত্র বারো টাকা। ভাবা যায়! গোমাংসে আপত্তি না থাকলে ট্রাই করে দেখতে পারেন। স্বাদে বালিগঞ্জ গড়িয়াহাটের অভিজাত রোল বিপণিগুলোকে বলে বলে দশ গোল মারবে যে-কোনওদিন। কিনে খেতে খেতে ফের হাঁটা পার্ক স্ট্রিটের দিকে। পাঁইটের নেশাটা ফিকে হয়ে আসছে একটু একটু করে। কুছ পরোয়া নেহি। অন্য নেশা লেগে গেছে এতক্ষণে। রাত কলকাতার ফুটপাত হপিংয়ের নেশা।
রোল আর টাল দুটোই একসঙ্গে খেতে খেতে পার্ক স্ট্রিটের মোড়। হাতের বাঁদিকে ‘স্কাই রুম’। একসময় কলকাতায় সেরা বিদেশি খাবারের ঠিকানা। এদের দেবভোগ্য এক্লেয়ার স্যুপ। ষাটের দশকে দুনিয়া কাঁপানো অভিনেতা মার্লন ব্রান্ডো কলকাতায় এলে এখানেই তাঁকে খাওয়াতে এনেছিলেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়। সেই স্কাই রুমও এখন অতীতের তালিকায়। টিকে আছে ‘অলিপাব’ আর ‘মোকাম্বো’। সুরা আর বিফস্টেকের জন্য নাম শহর জোড়া। রাস্তার ঝলমলে আলো, বাচ্চা বাচ্চা বেলুনওয়ালা ছেলে মেয়ে, ছেঁড়া ফ্রক আর জামা, সিগন্যালে গাড়ি থামলেই দৌড়ে যাচ্ছে। স্ট্রবেরি আর ফুলের পসরা নিয়ে রোগা রোগা চেহারার নারীপুরুষ। আইসক্রিমের গাড়ি ম্যাগাজিনের স্টল, বাড়তি ভাড়ার প্যাসেঞ্জারের জন্য অপেক্ষমাণ ট্যাক্সি ড্রাইভার, ফ্লুরিজের বিশাল কাচ, পার্ক হোটেলের গায়ে ছোট দোকানটায় বরফের ওপর রাখা পান, পাশে তাকে সার দিয়ে সাজানো দেশি-বিদেশি সিগারেটের প্যাকেট, অক্সফোর্ড বুক স্টোর, এসব ঠিকই আছে, কিন্তু হারিয়ে গেছে ব্লু ফক্স। মাথার ওপর নীল নিয়নের সেই মুখ ঘোরানো শেয়াল। সেখানে এখন ভাজা মুরগির দোকান না কী একটা হয়েছে যেন। নেই পিপিং-ও। পুরনো কলকাতায় চাইনিজ কুইজিনের আরেক সেরা ঠিকানা। পার্ক হোটেলের গায়ে ট্রিংকাস। ট্রিংকাস আর ব্লু ফক্স। সত্তর-আশির দশকে এখানেই গাইতেন পাম ক্রেন, ঊষা আয়ার (উত্থুপ হননি তখনও)। গিটার, স্যাক্সো, পিয়ানো অ্যাকোর্ডিয়ান আর জ্যাজড্রামে ঝড় তুলতেন মণিদা (মহীনের ঘোড়ার গৌতম চাটুজ্যে), লু হিল্ট, ডোনাল্ড বিশ্বাস, আরিফভাই, নন্দন বাগচী… সরস্বতীর পুত্রকন্যা সব।
একুশ টাকার একটা গুরু কিম্বা গোল্ডেন বিয়ারের বোতল নিয়ে বসে পড়া টেবিলে। তারপর ভেসে যাওয়া সুরসাগরে… এর মধ্যে মণিদা। হাতের সেই অলৌকিক গিটার নিয়ে বেশ কিছুদিন হল পাড়ি জমিয়েছেন অন্য এক গন্ধর্বলোকে। বৃদ্ধ হয়েছেন লু হিল্ট। আরিফভাই ছেলের কাছে, বেঙ্গালুরু। টালিগঞ্জ সিমেট্রিতে চিরশান্তিতে শুয়ে রয়েছেন ডোনাল্ড। পাম ক্রেন সব ছেড়েছুড়ে অস্ট্রেলিয়া, অনেকদিন হল। ঊষাও সেলিব্রিটি হয়েছেন বহুকাল। পার্ক স্ট্রিটের বার ফ্লোরে এখন শুধু চটুল হিন্দি আর রিমিক্স গান। সব সুরতাল একসাথে ঠেসে দেয়া সিন্থেসাইজার আর অক্টোপ্যাডের জগঝম্প। গলায় সুরের স নেই। শুধু ঠিকঠাক ট্র্যাকে ফেলে গেয়ে দিলেই হল। ভাবতে ভাবতেই ভারী হয়ে যাচ্ছে মনটা। পার্ক স্ট্রিটকে পিছনে ফেলে ডানদিকে ঘুরতেই চৌরঙ্গি রোড। বিশাল চওড়া রাস্তার মাথা ঢেকে গেছে ফ্লাইওভারে। মেট্রোয় ঢোকার সুড়ঙ্গ পথ থেকে মিউজিয়াম অবধি টানা আধো অন্ধকার গা ছমছম পরিবেশ একটা। বাবার কাছে শুনেছিলাম, সন্ধের পর এখানেই কোথাও মাথা নুইয়ে মুখ লুকিয়ে ভিক্ষে করতেন সাধনা বোস। পঞ্চাশ দশকের বিখ্যাত অভিনেত্রী। আলিবাবা ছবির প্রযোজক—অভিনেতা মধু বোসের স্ত্রী। স্বামীর মৃত্যুর পর বিপুল ধনসম্পত্তি সব খুইয়ে রাস্তায় এসে নেমেছিলেন এই বৃদ্ধা। কাছ দিয়ে কেউ গেলে মৃদু করুণ গলায় ভিক্ষে চাইতেন ইংরিজিতে— ভেরি পুওর লেডি… প্লিজ হেল্প মি সামথিং স্যর… মিউজিয়ামের পাশ দিয়ে যেতে যেতেই মানসপটে ভেসে ওঠা আরেকটা দৃশ্য। আশির দশকের গোড়ার কথা। রাস্তার আলো আরও অনেক কমজোরি ছিল তখন। প্রায়ান্ধকার ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকতেন দুই বিগতযৌবনা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান স্বৈরিণী। মুখে সস্তা লিপস্টিক আর ফেস পাউডারের চড়া প্রলেপ। বয়স ঢাকার ব্যর্থ করুণ প্রচেষ্টা। পাশ দিয়ে গেলেই মিঠে গলায় ডাক, ‘কাম ডিয়ার, কাম উইথ মি, আই প্রমিস ইউ আ ভেরি নাইস টাইম।’ এখন তাদের জায়গা নিয়েছে মালা। হাইট টেনেটুনে চার ফুট দুই কি তিন। দৈর্ঘ্যে প্রস্থে প্রায় সমান। গাট্টাগোট্টা চেহারা। শাড়ি ঠেলে বেরনো উদ্ধত এক জোড়া বুক। গালে আড়াআড়ি একটা ক্ষুরের দাগ (কোনও বেয়ারা খদ্দেরের কাজ বোধহয়)। মুখে চটুল হাসি। একসময় দ্বি-পেশার পশারিণী ছিল। দুপুর বারোটা থেকে রাত নটা অবধি গ্লোব সিনেমার ব্ল্যাকার। ন’টার পর ফুটপাতে যৌনকর্মী। সাউন্ড অফ মিউজিক, বর্ন ফ্রি-কে সঙ্গে নিয়ে কবেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে গ্লোব। তারপর থেকে সন্ধে হলেই ফুটপাতে দাঁড়িয়ে পরে মালা। পথচলতি কেউ রাজি হলেই ফুট টপকে সোজা মেট্রো রেলের পাঁচিল আর গাছগাছালির আড়ালে। রেট ইজ ভেরি রিজনেবল। খদ্দের বুঝে মোটামুটি পঞ্চাশ থেকে আশি টাকার মধ্যে। আলগোছে এসবই দেখতে দেখতে আর ভাবতে ভাবতে এসে পড়া মিউজিয়ামের গেটে। রাতের বেলা যতবারই এই বিশাল দরজার সামনে দিয়ে গেছি, ততবারই একটা অদ্ভুতুড়ে গা-ছমছমে অনুভূতি হয়েছে। অনেকটা ওপরে উঠে যাওয়া চওড়া পাথরের সিঁড়ি। সামনে আলো জ্বললেও নির্জন ভেতরটা। এই বুঝি কফিন ছেড়ে উঠে বেরিয়ে এল ফারাওয়ের মমি বা প্রাগৈতিহাসিক ডায়নোসোরের কঙ্কাল! তড়িঘড়ি জায়গাটা পেরিয়ে এসে সামনে গলির মোড়ে। মিউজিয়ামের শেষ। রাত সাড়ে এগারোটা। হকাররা উধাও। বন্ধ ফুটপাতের চা দোকানগুলো। মিউজিয়ামের রেলিং আর দেওয়াল ঘেঁষে পলিথিনের চাদর বিছিয়ে লাইন দিয়ে ফুটপাতে শুয়ে থাকা সার সার বাস্তুহারা পরিবার। চার ইটের উনুনে ভাত তরকারি চড়িয়েছে কেউ কেউ। মুরগির ছাঁট আর গিলেমেটের মনকাড়া ভাপ উঠছে। ওরই মাঝখানে এককোণে গোল হয়ে বসা পাতাখোর পকেটমারের দল। নোংরা শতচ্ছিন্ন জামাকাপড়। অপুষ্ট ক্ষয়া ক্ষয়া চেহারা। ঝিম খাওয়া চোখ। কাঁপা কাঁপা হাতে ভাগবাটোয়ারা চলছে। পাঁচঠো কালা তাকিয়া (মানিব্যাগ), তিনঠো ‘বাচ্চা’ (মোবাইল),… একঠো ছল্লি (সোনার হার)… কুল মিলাকে… দিনান্তের হিসেব। জড়ানো গলার স্বর আরও জড়িয়ে যাচ্ছে বাতাসে। এসব একপাশে ফেলে রেখে দ্রুত পেরিয়ে যাওয়া লিন্ডসের মোড়, টাইগার সিনেমা, থুড়ি শপিং মল পেরিয়ে ফিরপো আর গ্র্যান্ডের ঝুলবারান্দা… দূরে ভিক্টোরিয়া হাউসের ঘড়ি সময় বলছে প্রায় বারোটা। সারাদিন পশারিদের হাঁকডাক আর পথচারীদের ভিড়ে বেজায় সরগরম থাকা জায়গাটা বলতে গেলে প্রায় শুনশান এখন। ইতিউতি ঘুরঘুর করা কয়েকজন কলগার্ল। সামনে এসে দাঁড়ানো প্রাইভেট কার আর ট্যাক্সির অপেক্ষায়। জায়গা আর দরদামে পটলেই দরজা খুলে সোজা সেঁধিয়ে যাওয়া গাড়ির পেটে… ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে ধর্মতলার মোড়। মেট্রো সিনেমা। ফের স্মৃতির লাবডুব মনের মধ্যে। সেই মেট্রো। সিঁড়ি থেকে দোতলা অবধি মোড়া লাল কার্পেটে… দেওয়ালে গ্রেগরি পেক, স্টুয়ার্ট গ্র্যাঞ্জার, অড্রে হেপবার্ন, মেরিলিন মনরো…। দোতলায় উঠেই সামনে লম্বা বার লাউঞ্জ। স্পিকারে টুং টাং পিয়ানোর সুর। দরজার সামনে দাঁড়ানো গেটকিপার দেবুদা। ছ’ফুট সাত কি আট ইঞ্চি। দৈত্যাকৃতি চেহারা। বেয়ারা কোনও দর্শক বেগরবাঁই করলেই ঘাড় চেপে ধরে সোজা হলের বাইরে। পঞ্চাশের দশকে জিঘাংসা নামে একটি থ্রিলার সিনেমায় খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয়ও করেছিলেন। হলের মধ্যে ঠান্ডা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের আরাম। ডানলোপিলোর গদি আঁটা সিট। গোড়ালি অবধি ডুবে যাওয়া পুরু কার্পেট। শো ‘চালু’ হবার আগে পর্দায় ভেসে ওঠা মেট্রো গোল্ডউইন মায়ারের গোলাকৃতি লোগো। মাঝখানে কেশর ফোলানো সিংহের রাজকীয় গর্জন… সেসব ধুয়েমুছে সাফ কবেই। বহুদিন হল বন্ধ হয়ে পড়ে আছে মেট্রো। মনে আছে হলের সামনে মেট্রো লেখা মিনারাকৃতি চুড়োটার অনুকরণে কানের দুল বানাতেন তখনকার দিনের মা-কাকিমারা, ভাবলেই ভারী হয়ে আসে মনটা।
রাত সাড়ে বারোটা। অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি ফুটপাতে। হাত বিশেক দূরে ধর্মতলার মোড়ে দাঁড়ানো শেয়ার ট্যাক্সি। ইতিমধ্যেই পাঁচজন বসে রয়েছেন। হাঁটতে ইচ্ছে করছে না আর। ‘কোথায় যাবেন দাদা?’ ‘ডানলপ’, ‘আমাকে একটু বিডন স্ট্রিটে নামিয়ে দেবেন?’ শোনামাত্র একটা ফিচেল শেয়ালমার্কা হাসি ড্রাইভারের ঠোঁটের কোণে। ‘ভাড়া কিন্তু ওই একই পড়বে।’ ‘ঠিক আছে।’ বলে দরজা খুলে ঠাসাঠাসি করে সেঁটে যাওয়া চালক সহ জনাচারেক সহযাত্রীর সঙ্গে।
রাত একটা বাজতে পাঁচ। সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ আর বিডন স্ট্রিটের মোড়। সোনাগাছি। মোড় থেকে প্রায় শোভাবাজার অবধি ফুটপাতে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়ের দল । সস্তা টাইট জিন্স, টপ আর স্ন্যাক্স। জালি সেন্টের গন্ধ। উৎকট মেকআপ। খাদ্য প্রচুর কিন্তু খাদকের সংখ্যা কম। যার ফলে একটা কাস্টমার নিয়ে শেয়াল কুকুরের কামড়াকামড়ি। টলতে টলতে এগিয়ে এল এক মাতাল খদ্দের। হাত ধরে টানল মেয়েদের একজন। ‘চল না’। ‘কিতনা?’ জড়ানো গলায় প্রশ্ন করল খদ্দের। ‘বেশি না, এক গজ (একশো টাকা)’ ‘পচাশ রুপিয়া এক্সট্রা দেঙ্গে, লেকিন কন্ডোম নেহি লেঙ্গে।’ তাতেই রাজি মেয়েটি। ‘ঠিক আছে চল’, বলে কাস্টমারকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকে গেল পাশের গলিতে। ফিরে এল আধঘণ্টা বাদে। ‘কন্ডোম ছাড়া কাস্টমার বসালি মাগি? এরপর এডে (এইডস) মরবি যে,’ বলল পাশে দাঁড়ানো আরেকজন। জবাবে ঝাঁঝিয়ে উঠল মেয়েটি। ‘চাপ্ তো ঢেমনি! সোয়ামির কারখানা বন্ধ পাঁচ বছর হল। ঘরে বুড়ি শাশুড়িকে নিয়ে পাঁচ পাঁচখানা পেট… কাল তো খেয়ে বাঁচি। পরে না হয় রোগে মরব।’ কীরকম বুঝছেন পাঠক? এসব সাব অলটার্ন ছোটলোকি পাঁচপ্যাঁচালি থেকে চোখ সরিয়ে একটু অন্যদিকে তাকানো যাক। উল্টোফুটে দর্জিপাড়া। মাঝখানে শুধু সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ। কিন্তু আকাশপাতাল ফারাক। ওপারের কোনও ছাপই নেই এপারে। ছাতুবাবু-লাটুবাবুদের বাড়ি, বাজার। পুরনো বনেদি পাড়া… মনে আছে এখানেই থাকত চিকিদা। দর্জিপাড়ার মিত্তিরবাড়ির ছেলে। প্রেসিডেন্সির উজ্জ্বল নক্ষত্র সাতের দশকে। হাতে গিটার আর ঠোঁটে পিট সিগার, জন লেনন… কলেজ ক্যাম্পাস আর কফি হাউস মাতিয়ে রাখত সবসময়। লকাপে গলায় চুরুটের ছ্যাঁকা দিয়ে মালা এঁকে দিয়েছিল অ্যান্টি নক্সালাইট স্কোয়াডের সহৃদয় এক গোয়েন্দা অফিসার। চিকিদা বহুদিন হল বিদেশে। দর্জিপাড়া কিন্তু রয়ে গেছে স্বমহিমায়। ফ্ল্যাট সভ্যতার দাপট নেই। সেই পুরনো পুরনো লাল ইটের বাড়ি। ফুটের ধারে ঘোলা গঙ্গাজলের কল। সন্ধে হলে কুলপি মালাই আর বেলফুলওয়ালার ডাক। তেলেভাজার দোকান… এই মুহূর্তে ঘুমন্ত সবাই। ঘুমোও দর্জিপাড়া। তোমাকে পেছনে ফেলে এবার সোজা নিমতলা ঘাটমুখো। চার রাস্তার মোড়ে ট্রাম লাইন। ডানফুটে বটতলা আর চিৎপুর যাত্রাপাড়া। বাঁ ফুটে নতুন বাজার আর কোম্পানি বাগান। পোশাকি নাম রবীন্দ্রকানন। পার্কের গায়ে শিবশক্তি সিদ্ধি আর ঠান্ডাইয়ের দোকান। রাস্তা জুড়ে যাত্রাপালার অসংখ্য ব্যানার আর পোস্টার। ‘রোগা স্বামীর দারোগা বউ’,… ‘শাশুড়ি দারোয়ান বউমা চেয়ারম্যান’… গ্লোসাইন লেটারহেড আর নায়ক নায়িকার ছবি… এসব দেখতে দেখতে সিধে নিমতলা ঘাট।
রাত দেড়টা। ভীষণ ভাবে জেগে রয়েছে নিমতলা। উল্টোদিকে খোলা খাবারের দোকানগুলো। ভুবন-বিখ্যাত ঘিয়ের লিট্টি। আর গোলাপজল-জাফরান দিয়ে বানানো পুরু সর ভাসা পোয়াপাত্তি চা। গোটা দুয়েক বডি পুড়ছে। বাকি চারটে ওয়েটিং লিস্টে ইলেক্ট্রিক চুল্লির সামনে। ইতিউতি জটলা পাকানো শ্মশানবন্ধু, আত্মীয়স্বজন… গেঁজেল, পাগল, ভবঘুরে… খ্যাড়খ্যাড়ে গলায় মন্ত্র পড়ছে হাফ মাতাল পুরোহিত। মুখে ভকভকে চোলাইয়ের গন্ধ… একটু দূরে পাড়ে বাঁধা নৌকো, মাঝগঙ্গায় দোল খাওয়া বয়া… এসব দেখতে দেখতে ওপারে ফর্সা হয়ে আসছে আকাশ। কমলা রঙের জার্সি গায়ে রোজকার নিত্যনৈমিত্তিক ওয়ান ডে ম্যাচ খেলতে তৈরি হচ্ছেন সূয্যিমামা। সারা রাত ফুটপাত পর্বেরও ইতি ঘটে যাচ্ছে আপাতত। বাকি রয়ে গেল অনেক অনেক রাত, অনেক ফুটপাত আর একই সঙ্গে অনেকখানি কলকাতা। সময় অবসরে সে সব শোনানো যাবে অন্য আরেকদিন।