১৯. সাজিশকারদের খিলাফ কার্‌রবাই

সাজিশকারদের খিলাফ কার্‌রবাই

সুবাহ হতেই মোলাকাত হল হোমড়া চোমড়াদের। সবার তখন একটাই সওয়াল, কাল ক্যা হুয়া? কোনও খবর? কিন্তু কারও কাছেই কোনও জবাব নেই। অজানাই থেকে গেল কীসের থেকে এই তহলকার (tahalka) শুরু। সাহেব লোগ এবার একশো চল্লিশ ধাপ সিঁড়ি ভেঙে গোলাঘরের চুড়োয় উঠলেন। তারপর দূরবিন দিয়ে জরিপ করলেন চারপাশ। কোশিশ, কীসের থেকে এসবের শুরু তা জানা। তাঁদের সব কায়দাকানুনই বেকার হল। মিলল না কোনও হদিশ। সব কিছুই তখন ঠিকঠাক। পরে সৈয়দ বাকুর এসে হুজুরদের সামনে এলান করল, একটা উট নাকি ঢোল আর বাজি পটকার আওয়াজে হকচকিয়ে যায়। তারপর বেতাল হয়ে ছুট দেয় জুলুসের ভিতর। ডাইনে-বাঁয়ে গুঁতিয়ে দেয় যাকে পারে তাকে। লোকজন এত ঘাবড়ে গিয়েছিল যে আওয়াজ ওঠে ডাকু! ডাকু! তাতে বাকিরাও শামিল হয়েছিল।

তখনও খবর মেলেনি আফিমের কারখানায় যে ফৌজ তাদের হেপাজত করতে গিয়েছিল তাদের কী হল আর সরকারি গুদামখানাতেই বা কেমন অবস্থা? এক জেরহুকুমিকে সরেজমিনে পাঠান হল। গুদামে পৌঁছে সে তো তাজ্জব। দেখল সবাই খোশমেজাজে আছে। একজনকে দেখে সে হাঁক পাড়ল, “হ্যালো ক্যাপ্টেন স্নুকস, ক্যা হাল হ্যায়?” স্নুকস জবাব দিল, “সব ঠিক হ্যায়! বহুত আরাম সে রাত গুজরা। আরও কয়েকটা রাত এইরকম আয়েশ করতে পারলে খারাপ হয় না। রাতভর মুরগি ঝলসানো হয়েছে। সঙ্গে দারু আর বিলিয়ার্ড। কী ফুর্তি! কী ফুর্তি!”

সাজিশকারদের বিচার তখনও বাকি। আম আদমি ইন্তেজার করছে কী হয়, কী হয়। তাদের খোয়াহিশ এমন কঠোর সাজা হবে যা সারা হিন্দুস্তানে একটা নজির খাড়া করবে। আদালতের কর্মচারীদের কাছ থেকে যে খবর মিলেছিল তাতে সাবুদ নম্বর এক হল, মুনশি মুফসিদের কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত চিঠি। এই চিঠির দস্তখতকারীরা ছিল, মুনশি রাহত আলি, সৈয়দ গব্বর উদ্দিন আর খাজা সাহেব। চিঠির বয়ান মোতাবেক বলা হচ্ছে, “তুমনে বহুত আচ্ছা কাম কিয়া, আয়েন্দা বহুত ইনাম মিলেগা।” চিঠি থেকে আরও জানা যায় তার হাতে নাকি কাজের ওয়াস্তে কয়েক লাখ টাকা মজুদ করা হয়েছিল। নম্বর দুই হল, কয়েকজন দেশি জম্মতদারের একরারনামা। তারা কবুল করে মুনশি নাকি তাদের নানা কায়দায় টোপ দেয়। সাবুদ নম্বর তিন, খোদ মুনশি মুফসিদের জবানবন্দি। তার বয়ান মোতাবেক সে ছিল রাহত আলি আর গব্বর উদ্দিনের হাতের খেলনা। হামেশাই তাদের মোলাকাত হত আর চলত সাজিশ। মুনশির মতে এরা দু’জনই হচ্ছে নেপালের রাজা আর আশপাশের রোয়াবি জমিদারদের আসল মুরুব্বি।

খাজা সাহেব, রাহত আলি আর গব্বর উদ্দিন সাফ ইনকার করল এই নালিশ। উলটে তারা জানাল, মুনশি বলে কারও সঙ্গে তাদের পহেচানই ছিল না। মুনশির কাছ থেকে যে সব চিঠি বাজেয়াপ্ত করা হয় তাতে তাদের দস্তখত নাকি জালসাজি। তারা চাইল এই মামলায় যেন আদালত সরাসরি দখল আন্দাজি করে, বিশেষত চিঠিগুলোই যেখানে নালিশের আসল বুনিয়াদ। তাদের বেইজ্জত করতেই দুশমনরা এই জালসাজির কারবার খুলেছে আর সেগুলো দাখিল করেছে আদালতের সামনে সাবুদ বলে। তারা জোরদার হাঁক-পুকার শুরু করল। তাদের মতো বেগুনাহদের নাকি জবরদস্তি উঠিয়ে আনা হয়েছে আর শুধু তাই নয় গারদে বন্দি রাখা হয়েছে সাজা পাওয়া গুনাহগারদের মতো। জোশিলা নওজওয়ান ম্যাজিস্ট্রেট খুব জোরদার কার্‌রবাই চালালেন যেমনটা তার উমরের যে কেউ হলেই করত।

বাজারে এই নিয়ে খোলাখুলি বহস শুরু হল। নানা আদমির নানা বিচার। তবে বেশির ভাগেরই মনে হয়েছিল যারা এখন ফরিয়াদ চাইছে তারাই আসল গুনাহগার। বেশক তাদের সাজিশে হাত ছিল। এদের ভিতর যারা আরও মাতব্বর তারা বলতে শুরু করল, উচিত ছিল মুনশি মুফসিদকে দিয়ে গুনাহগারদের শনাক্ত করানো। তা হলেই সবকটাকে তোপের মুখে বেঁধে উড়িয়ে দেওয়া যেত। এমনটা করলে তবেই না হিন্দুস্তানে একটা নজির খাড়া হয় যেমন শাহ সুজা আফগানিস্তানে করেছেন। এ কথাও আবার শোনা গেল মুনশি মুফসিদকে নাকি পঁচিশ হাজার রুপিয়া কবুল করা হয়েছে যাতে সে গুনাহগারদের শনাক্ত করতে ইনকার করে। কলকাতা থেকে কোনও জবরদস্ত হুঁশিয়ার আর চালাক সাহেব নাকি আসছেন। তিনি ফরিয়াদিদের তরফে আদালতে সওয়াল করবেন। তখন এমন সব কায়দায় ইস্তেমাল হবে যাতে আদালতে সাহেবান আলিসানদের শোচ বিচার পাল্টে যায়। আমি শুধু তাজ্জব হয়ে ভাবতাম কী করে এই কয়েদিরা বাইরে যোগাযোগ করে। গোলাঘরের মতো ইঁটের পাঁচিল ঘেরা এলাকায় তাদের কয়েদ করা হয়েছে। সবসময় পাহারায় মজুদ সিপাহি। আমার খুব ইচ্ছে হল এই পরদা ফাঁস করি। দপ্তরের মাতব্বরদের সঙ্গে খুব খাতির জমালাম। তারপর ধীরে ধীরে ফাঁস হল পরদা। ধরা যাক কোনও কয়েদিকে পাহারা দেয় সঙিন উঁচানো সিপাহি। কয়েদিকে তো রুটি খাওয়ার ইজাজত দিতেই হয়। এখানেই হচ্ছে কায়দা। রিশবত মেলে খানা পাকানেওয়ালার। ছোট কোনও চিঠি ভরে দেওয়া হবে চাপাটির ভিতর বা চাপাটির থালায় লেখা থাকবে কোনও সন্দেশ। পড়ে নিয়ে সেটা মুছে ফেলবে কয়েদি। চিঠি লেখা হবে ইশারায়। যেমন, আল্লা মেহেরবান! রোটি মে হ্যায় তুমহারা দিলাশান! বা, খুশ রহ দোস্ত! যো লিখা হ্যায় সো লিখা হ্যায়।

যাই হোক, বিচার শুরু হয়ে গেল কোনও আজব রকমের কমিশন তৈরি হওয়ার আগেই। মহামান্য আদালতের সামনে জড়ো করা হল ফরিয়াদিদের আর ঠোকাঠুকি বেধে গেল মুনশি মুফসিদের সঙ্গে। সে বয়ান করতে লাগল, হামেশাই রাহত আলি আর গব্বর উদ্দিন শাহের সঙ্গে তার মোলাকাত হত। কিন্তু কয়েদিদের তো এখন আর গুনাহগার বলা যাচ্ছে না তা হলে কী হবে? কোম্পানি বাহাদুর যাকে আমরা বলতাম বুড্ডি ঔরত খুব ভয় খেয়ে গেল। বড়া সাহেব কাউন্সিলের কাছে লম্বা লম্বা রিপোর্ট পেশ করতে লাগলেন। সিয়াসতের হেপাজত বেসামাল হতে বসেছে। গ্রেফতার হয়েছে মুলুকের বেশ কিছু ওজনদার আদমি যাদের ভিতর আছে দারোগাদের বেমিসাল সৈয়দ বাকুরও। সে আবার সাহেব লোকদের নিমক পরওয়াদা (nimak purwardah)। সবাই তাকে বহুত ইজ্জত করে। এমনকী লর্ড সাহেব কা মিসেরও সে খুবই মনপসন্দ আদমি। দেখা যাচ্ছে সেই বাকুরও এই সাজিশের জোটে শামিল।

একজন খুব আসরদার সাহেব, বহুত বড়া আদমি এই সাজিশকারদের হয়ে সুপারিশ করলেন। এর থেকেও ভয়ানক হচ্ছে ভোঁতা হয়ে যাওয়া সৈয়দ বাকুরকে পুরোপুরি কব্জা করা। সে যে ভাড়ুয়াদের সর্দার এই সুযোগটাই সাহেব কাজে লাগালেন। কয়েকজন সাহেবান আলিসানের মেজাজ ঠান্ডা করতে চুপিচুপি পেশ করা হল খুবসুরত আর সুরেলা কোয়েলিয়াদের। ইরাদা তাদের ধুন শুনে যাতে জুড়িয়ে যায় সাহেবদের কান। নতিজা, ঠোস সবুদ না মেলায় রেহাই মিলে গেল কয়েদিদের।

সমজদারেরা বলল, কয়েদিদের রেহাই মেলা তো একটা মুলকি চাল। এই মামলায় আর কিছু হওয়ার ছিল না। কয়েদিদের বেশি সওয়াল-জবাব করলে সাফ জাহির হত যে কোম্পানি যাদের আশকারা দেয় সেই জমিদার আর সর্দাররাই চাইছিল হুকুমত পাল্টাতে। পুলিশের দারোগা হোক বা জঙ্গি পল্টনের সিপাহি কাউকেই নিমকের ওয়াফাদার বলা যায় না। কোম্পানি বাইজ্জত মৌলভি রাহত আলি বা তারই মতো আরও সব লোকেদের হাতে বিচার আর মাশুল বন্দোবস্তের ভার ছেড়ে দেয়। তবুও তারা চেয়েছিল কোম্পানির রাজ খতম করতে। এখন বলতে হবে শুরুতেই যে সাজিশ রুখে দেওয়া গেছে আর শনাক্ত করা গেছে কারা শামিল সেটাই জরুরত সে জাদা। সারা দুনিয়া জানুক কোম্পানি তার ফৌজের ইমানদারিতে বেশক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *