১৯. সলিটন
প্রায় দেড়শ বছর আগে জন স্কট রাসেল নামে একজন ইঞ্জিনিয়ার এডিনবার্গে একটা খালের নৌকার একটা ডিজাইন নিয়ে পরীক্ষা করছিলেন। সরু খালের ভেতর দিয়ে নৌকাটাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে দুটি ঘোড় টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ করে দড়িটা ছিঁড়ে গেল। নৌকাটা সাথে সাথে থেমে গেল কিন্তু তখন অত্যন্ত বিচিত্র একটা ব্যাপার ঘটল। নৌকার সামনে জমে থাকা জলরাশি থেকে অত্যন্ত বিচিত্র ধরনের একটা ঢেউ প্রচণ্ড বেগে সামনের দিকে ছুটে যেতে থাকে।
এটাকে ঢেউ বলা ঠিক নয় কারণ ঢেউ উপরে উঠে আর নিচে নামে কিন্তু এখানে কোনো কিছু নিচে নামছে না। খানিকটা পানি উঁচু হয়ে সামনের দিকে ছুটে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, পানির ঢেউয়ের বেগ কত হতে পারে সেটা সম্পর্কে সবারই একটা ধারণা আছে। পুকুরে ঢিল মারলে ঢেউটা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে, সেটাই হচ্ছে ঢেউয়ের বেগ কিন্তু এখানে উঁচু হয়ে থাকা জলরাশি ছুটে যাচ্ছে ঘণ্টায় প্রায় দশ মাইল বেগে। বিস্মিত এবং কৌতূহলী ইঞ্জিনিয়ার স্কট রাসেল একটা ঘোড়ায় চড়ে সেই বিচিত্র ঢেউয়ের পিছু পিছু ছুটে চললেন এবং তার জীবনের সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয়টা আবিষ্কার করলেন। একটা ঢেউ যখন ছুটে যেতে থাকে তখন ছুটে যেতে যেতে সেটা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে। বিজ্ঞানে এর একটা গালভরা নাম আছে ডিসপার্সান, কিন্তু এই বিচিত্র ঢেউটির কোনো ডিসপার্মান নেই। এটা যে রূপ নিয়ে তৈরি হয়েছিল হুবহু সেই রূপ নিয়ে ছুটে যেতে থাকল, এটা ছড়িয়ে গেল না, ভেঙে গেল না কিংবা থেমে গেল না। বিস্মিত স্কট রাসেল মাইল দুয়েক এর পিছনে ছুটে গেলেন কিন্তু আঁকাবাকা খালের তীর দিয়ে বেশি দূর ছুটে যেতে পারলেন না। হতবাক ইঞ্জিনিয়ার স্কট রাসেল এর কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পেলেন না–কিন্তু একজন খাঁটি বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের যেটা করা উচিত সেটাই করলেন। বাসার পেছনে ত্রিশ ফুট লম্বা পানির একটা চৌবাচ্চা তৈরি করে সেটা নিয়ে গবেষণা শুরু করে দিলেন। তিনি এটার নাম দিলেন সলিটারি ওয়েভ বা একাকী তরঙ্গ। তার গবেষণার ফলাফল জার্নালে প্রকাশ করলেন এবং বিজ্ঞানে যা হয় তাই হলো, কেউ সেটাকে কোনো গুরুত্ব দিল না। স্কট রাসেলকে বিজ্ঞানী মহল মনে রাখল তার অন্য কাজের জন্যে একাকী তরঙ্গের জন্য নয়।
তারপর একশ’ বিশ বছর কেটে গেল, 1960-এর দশকে বিজ্ঞানীদের হাতে শক্তিশালী কম্পিউটার এসেছে, তারা সেটা দিয়ে নন-লিনিয়ার মাধ্যমে তরঙ্গের প্রবাহ নিয়ে গবেষণা শুরু করেছেন এবং হঠাৎ করে তারা আবার নূতন করে স্কট রাসেলের একাকী তরঙ্গকে আবিষ্কার করলেন, এর নাম দেয়া হলো সলিটন এবং বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করলেন আমাদের চারপাশের জগতের সবকিছুতে ছড়িয়ে আছে সলিটন। তরল পদার্থের প্রবাহ থেকে আলোকবিদ্যা, প্লাজমা থেকে শক ওয়েভ, টর্নেডো থেকে বৃহস্পতি গ্রহের লাল দাগ, বস্তু জগতের কণা থেকে প্রোটিনের সংবেদনশীলতা, সুনামী থেকে টেলি যোগাযোগসোজা কথায় এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে সলিটন নেই। বলা যেতে পারে বর্তমানে বিজ্ঞানের জগতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোর একটা হচ্ছে সলিটন।
সলিটনের গতি প্রকৃতি বোঝার জন্যে আমাদের কিছু পারশিয়াল ডিফারেন্সিয়াল ইকুয়েশান সমাধান করতে হয়, আমরা সেই পথে এগুব না। ব্যাপারটা কেমন করে ঘটে সেটা তরঙ্গের স্বাভাবিক নিয়ম থেকে বোঝার চেষ্টা করব। আমাদের খুব পরিচিত তরঙ্গ হচ্ছে আলো এবং সেই আলো থেকে তৈরি রংধনু সবাই দেখেছে। বৃষ্টি হবার পর হঠাৎ করে যদি রোদ ওঠে তাহলে আমি সবসময় বাইরে ছুটে যাই রংধনু দেখার জন্যে এবং অবধারিতভাবে রংধনু দেখতে পাই। তখন আকাশে পানির বিন্দুগুলো থাকে এবং সূর্যের আলো সেই পানির ভেতর প্রতিফলিত হয়ে বের হয়ে আসার সময় তার রংগুলোতে ভাগ হয়ে যায় (19.3 নং ছবি)। আলোর ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গ দৈর্ঘ্যকে আমরা আসলে ভিন্ন ভিন্ন রং হিসেবে দেখি। তাই আমরা মোটামুটি বৈজ্ঞানিক ভাষা ব্যবহার করে বলতে পারি আলোর প্রতিসরাঙ্ক নির্ভর করে তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের উপরে, তাই একটা মাধ্যমের ভেতর দিয়ে যাবার সময় কোন আলো কতটুকু বেঁকে যাবে সেটা নির্ভর করে তার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কত। আলোর এই বাঁকা হয়ে যাবার কারণে আমরা রংধনু দেখি, প্রিজমে রং ভাগ হয়ে যেতে দেখি। কিন্তু সেটা না করে আমরা যদি একটা আলোকে একটা মাধ্যমের ভেতর দিয়ে সোজা সামনের দিকে যেতে দিই তাহলে কী দেখব?
যেহেতু একেক রঙের আলোর জন্যে প্রতিসরাঙ্কের মান একেক রকম তাই আমরা দেখব একেকটি রং একেক গতিতে যাচ্ছে। শুরুতে সবগুলো রং একই সাথে থাকলেও এটা প্রতিসরিত হয়ে সূর্যের আলো তার রংগুলোতে আসলে আলাদা হয়ে যাবে, যেই আলোর সংকেতটা ছিল সরু সেটা ছড়িয়ে পড়বে। এটা হচ্ছে তরঙ্গের ধর্ম এবং সব তরঙ্গে আমরা এটা হতে দেখি (19.4 নং ছবি)। সলিটনে এটা ঘটে না তাই বিজ্ঞানীরা এত অবাক হয়েছিলেন। যে কারণে সেটা ঘটে না সেটাও কম চমকপ্রদ নয়।
আমরা বলেছি আলোর প্রতিসরাঙ্ক নির্ভর করে তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের উপর। ঠিক সে রকম আলোর প্রতিসরাঙ্ক তরঙ্গের বিস্তারের উপরেও নির্ভর করে। তবে তরঙ্গের এই বৈশিষ্ট্যটি খুব ক্ষুদ্র, তাই সাধারণ হিসেবে এটাকে বিবেচনা করা হতো না। সলিটনের বেলাতে হঠাৎ সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়, বিজ্ঞানীরা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করলেন যে যদি খুব শক্তিশালী একটা তরঙ্গ তৈরি করা যায় তাহলে সেটা প্রতিসরাঙ্কের পরিবর্তন করতে পারে। সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য একদিকে প্রতিসরাঙ্কের পরিবর্তন করে, তরঙ্গের বিস্তার প্রতিসরাঙ্কের পরিবর্তন করে অন্যদিকে, এবং পুরো ব্যাপারটা এমনভাবে ঘটা সম্ভব একটা পরিবর্তনকে অন্য পরিবর্তন কাটাকাটি করে ফেলে। যার ফলে আমরা দেখতে পাই আসলে কোনো পরিবর্তন হয় নি, তাই যে তরঙ্গটুকু খানিক দূর যেতে যেতেই ভেঙে যাবার কথা, ছড়িয়ে পড়ার কথা আমরা সেই তরঙ্গকে যেতে দেখি অনির্দিষ্টকাল পুরোপুরি অবিকৃতভাবে। কম্পিউটারে সেই বিষয়টি খুঁজে পেয়ে বিজ্ঞানীরা হঠাৎ করে বুঝতে পালেন শতাধিক বছর আগে ইঞ্জিনিয়ার স্কট রাসেল ঠিক এই ধরনের একটা তরঙ্গের কথা বলেছিলেন, যে তরঙ্গটিকে একশ’ বছরের বেশি কেউ গুরুত্ব দিয়ে নেয় নি।
এখন অবস্থা পাল্টে গেছে, সলিটনকে সবাই গুরুত্ব দিয়ে নেয়। শুধু যে গুরুত্ব দিয়ে নেয় তা নয়, এখন সলিটন হচ্ছে সবচেয়ে বড় ফ্যাশন, সবকিছুকে চেষ্টা করা হয় সলিটনকে দিয়ে ব্যাখ্যা করতে। কিছুদিন আগে একটা ভয়ঙ্কর সুনামী এসে আঘাত করেছিল, মনে করা হয় সেটাও বুঝি এক ধরনের সলিটন (তবে সলিটনের তরঙ্গ ওপর-নিচ করতে পারার কথা নয়। সুনামীতে ওপর-নিচ হয়, সুনামী আঘাত করার পূর্ব মুহূর্তে সমুদ্রের পানি নিচে নেমে গিয়েছিল।)। বৃহস্পতি গ্রহে যে বিশাল লাল রঙের একটা বৃত্তাকার অংশ আছে সেটাকেও মনে করা হয় সলিটন!
সলিটন যদিও একটা তরঙ্গের মতো কিন্তু এর মাঝে একটা বস্তু কণার ভাব আছে। একটা সলিটন আরেকটা সলিটনের সাথে ধাক্কা লাগতে পারে এবং সবচেয়ে মজার ব্যাপার একটা সলিটন অন্য একটা সলিটনের ভেতর দিয়ে একেবারে অবিকৃত অবস্থায় চলে যেতে পারে। সলিটনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে যেটার বিস্তার (উচ্চতা) যত বেশি সেটার গতিবেগ তত বেশি। তাই যদি দুটো সলিটন একদিকে যেতে থাকে তাহলে যেটার উচ্চতা বেশি সেটা দ্রুত গিয়ে অন্যটার উপর দিয়ে চলে যেতে পারে। একটা যখন আরেকটার ঠিক উপরে থাকবে তখন তরঙ্গের উচ্চতা হওয়া উচিত দুটি তরঙ্গের যোগফলের সমান কিন্তু সলিটনের বেলায় সেটি সত্যি নয়, সম্মিলিত তরঙ্গের উচ্চতা হয় কম (19.5 নং ছবি)। এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে বলা হয় নন-লিনিয়ার সলিটনের বেলায় যেটা সবচেয়ে বেশি জরুরি।
কেউ যেন মনে না করে সেই দেড়শত বৎসর আগে এডিনবার্গে স্কট রাসেল পানির উপর একটা সলিটন দেখেছিলেন, তারপর আর কেউ কোনো সলিটন দেখে নি, সবাই কম্পিউটারে হিসেব করে সলিটনের নিয়ম-কানুন খুঁজে বের করছে। সলিটনের একটা খুব বড় ব্যবহার হয় ফাইবার অপটিক্সে যখন ডিজিটাল সিগনালকে সলিটন হিসেবে ফাইবারের ভেতর দিয়ে বিশাল দূরত্বে পাঠিয়ে দেয়া হয়। 1973 সালে বেল ল্যাবরেটরিতে এই বিষয়টা প্রথমে কল্পনা করা হয়েছিল। 1998 সালে ফ্রান্স টেলিকম সলিটন ব্যবহার করে 1 টেবিট (অর্থাৎ দশ হাজার কোটি বিট) পাঠাতে সক্ষম হয়েছিল। 2001 সালে আলগেটি টেলিকম ইউরোপে প্রথম সলিটন ব্যবহার করে সত্যিকারের টেলি কমিউনিকেশান্সের সূচনা করেছে।
বলা যেতে পারে এটি মাত্র শুরু। সলিটনের শেষ কী দিয়ে হবে সেটি এখন শুধু কল্পনা। স্কট রাসেল বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই খুব খুশি হতেন।