১৯. সরিৎশেখরকে জানলার কাছে বসিয়ে

উনিশ

সরিৎশেখরকে জানলার কাছে বসিয়ে দিল অনিমেষ। রিজার্ভেশন পাওয়ার কোনও উপায় নেই, কুলিকে একটা টাকা দিয়ে জায়গা কিনতে হল। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে সরিৎশেখরের দিকে তাকাতেই অনিমেষের বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল। সেই বিকেলটার কথা মনে হচ্ছিল। তার প্রথম কলকাতায় আসার বিকেল। সেদিন সে ছিল কামরায় আর সরিৎশেখর প্ল্যাটফর্মে। এবার সরিৎশেখরকে দেখার পর থেকেই কে যেন বুকের মধ্যে বসে বারংবার জানিয়ে যাচ্ছে, এই শেষবার। এরপর আর বৃদ্ধের দেখা পাবে না অনিমেষ। একটা বিরাট গাছ একটু একটু করে শুকিয়ে একটা ছোট শেকড়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাওয়ার তেজ বাড়লেই ঢলে পড়বে যেন। কিছু করার নেই, শুধু চোখ চেয়ে দেখা। এই যে সে স্টেশনে এসেছে এটাও পছন্দ ছিল না সরিৎশেখরের। তাঁর জন্যে অনেক সময় নষ্ট করেছে অনিমেষ, আর নয়। কিন্তু সে কথায় কান দেয়নি। রাস্তায় কিছু খাবেন না জেনেও মিষ্টি দিয়েছে সঙ্গে। পিসিমাকে দাদুর প্রকৃত অবস্থা জানিয়ে একটা চিঠি দিতে হবে।

নির্বিকার মুখে বসে ছিলেন সরিৎশেখর। হঠাৎ কাছে ডাকলেন ইশারায়। চারদিকে যাত্রীদের ব্যস্ততা, কুলির হাঁকাহাঁকি, ইঞ্জিনের আওয়াজ— অনিমেষ জানলার গা ঘেঁষে দাঁড়াল। দাদুর মুখটাকে একদম অচেনা দেখাচ্ছে এখন। অনিমেষ বলল, ‘কিছু বলবেন?’

ঘাড় নাড়লেন বৃদ্ধ। তারপর বললেন, ‘তোমার মায়ের কোনও চিহ্ন তোমার কাছে আছে?’

চমকে উঠল অনিমেষ, ‘মা?’

‘হুঁ। তোমার স্বর্গত মায়ের কথা বলছি।’

সেই ছবিটার কথা মনে পড়ল। ছবিটা কোথায়? মায়ের সেই জ্বলজ্বলে চোখের ছবি যেটা বাবার ঘরে টাঙানো থাকত।

সরিৎশেখর অনিমেষের মুখের দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘খুব ছেলেমানুষ ছিলে তুমি তিনি যখন চলে গেলেন। তবু তোমার কি তাঁকে মনে পড়ে?’

চোখ বন্ধ করলেই টকটকে লাল জ্বলন্ত চিতা। আগুন তখনও গ্রাস করেনি শরীর। দুটো পা আর হাঁটু-ছোঁয়া চুল তখনও চিতার বাইরে। রক্তের দাগ শুকিয়ে যাওয়া কালো দুটো হাত সে চোখের সামনে ধরে আছে— পরিষ্কার দেখতে পেল। কিন্তু এখন, এই মুহূর্তের আগে মাকে তো তেমন করে মনে পড়েনি তার। এমনকী মাধবীলতাকে দেখার সময় মনে হয়েছিল মা এরকমই দেখতে ছিল। এই ছবিটা তো চোখের সামনে আসেনি। সে ছবিটাও তো এখন মনে পড়ছে। মৃত্যুর রাতে মা তাকে বলেছিল, আমি যদি না-থাকি তুই একা একা আকাশের দিকে তাকিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলিস, আমি ঠিক শুনতে পাব। অনি, আমি তোকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারব না রে।

দু’চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। অনিমেষ চেষ্টা করে নিজেকে ঠিক করল। কলকাতায় আসার পর ওসব কথা মনেই পড়ে না। মা ক্রমশ ধূসর হয়ে একসময় হারিয়ে গেছে কখন। আজ দাদু এভাবে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জিজ্ঞাসা না-করলে হয়তো-সে মুখে বলল, ‘হ্যাঁ পড়ে। কিন্তু একথা জিজ্ঞাসা করছেন কেন?’

‘হঠাৎ তাকে মনে পড়ল, তোমার মুখ দেখে—। অনিমেষ, জীবন বড় জটিল। নিজেকে ঠিকঠাক রাখা খুব মুশকিল। তাই একটা অবলম্বন দরকার হয় এগিয়ে যাওয়ার জন্যে, তোমার মা তোমাকে ঘিরে কত স্বপ্ন দেখতেন। আজ তিনি নেই। তাঁর কথা ভেবে চোখের জল ফেলা কোনও কাজের কথা নয়। কিন্তু দু’দিন তোমায় আমি দেখলাম। যাই করো, শুধু মনে রেখো কেউ একজন তোমায় লক্ষ করে যাচ্ছে। তাই কখনও অসৎ হয়ো না।’

অনিমেষ জানলায় হাত রেখেছিল। পলকেই সে টের পেল হাতের তলায় জানলা নড়ছে। তারপর একটু একটু করে এগিয়ে যেতে লাগল সেটা। একটার পর একটা কামরা অনিমেষকে অতিক্রম করে গেল। সরিৎশেখরের মুখটা অনেক মুখের আড়ালে হারিয়ে গেল। স্টেশন ছাড়ার সময় কেন যে সবাই সতৃষ্ণ চোখে প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকিয়ে থাকে। ট্রেনটা সম্পূর্ণ বেরিয়ে না-যাওয়া অবধি অনিমেষ নড়ল না।

এখন অফিসের সময়। শিয়ালদা স্টেশনের বাইরে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল অনিমেষ। পিলপিল করে মানুষজন ছুটে যাচ্ছে সার্কুলার রোডের দিকে। ঘনঘন লোকাল ট্রেনগুলো শহরতলি থেকে মানুষ বয়ে এনে ছেড়ে দিচ্ছে কলকাতায়। প্রত্যেকে এত ব্যস্ত যে কারও পেছনে তাকানোর সময় নেই। অনিমেষ দেখল মানুষের চেহারা মোটামুটি একই। যেহেতু এদের প্রয়োজন অভিন্ন তাই ভঙ্গিতেও ফারাক নেই। হঠাৎ তাকালে সেই ছবিটার কথা মনে পড়ে যায়। ঝড়ের আভাস পেয়ে যেভাবে নানান চারপেয়ে জন্তুরা পাগলের মতো ছুটে যায় আশ্রয়ের জন্য ধুলোর বন্যা বইয়ে, ঠিক তেমনি। তাড়াহুড়ো এমন যে, কেউ কাউকে সামান্য সৌজন্য দেখাচ্ছে না। আবার এই মানুষই পৃথকভাবে, একা থাকলে অত্যন্ত ভদ্র শিষ্টাচারসম্পন্ন হবে। কী করে মানুষের এতগুলো মুখ হয়! এদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সরিৎশেখরের কথাটা মনে পড়ল। এই যে লোকগুলো ঘুম থেকে উঠেই ভাত খেয়ে ট্রেনে চাপে, শিয়ালদায় নেমে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে অফিস যায় বাদুড় ঝুলে, সারাদিন খবরের কাগজ পড়ে, পরচর্চা করে এবং কিছু কাজ করে কাটিয়ে দেয়, আবার বিকেলে শেয়ালদা থেকে বাজার নিয়ে ট্রেনবন্দি হয়ে রাত দশটায় বাড়ি ফেরে— তারা কী ধরনের মানুষ? বেঁচে থাকার জন্য প্রতিটি সংসারের আয়-যন্ত্র; রাত্রে সন্তান উৎপাদন এবং দিনে পরচর্চা এখন রক্তে মিশে গেছে। এরা কেউ নিজেকে কি ভারতবাসী বলে মনে করে? এই দেশ আমার, এরকম বোধ কখনও কি তাদের চিন্তিত করে? একমাত্র সমালোচনা ছাড়া এরা রাজনীতির ধারেকাছে ঘেঁষে না। যারা তাদের পাইয়ে দেয় সেই রাজনৈতিক দলগুলোকে এরা সমর্থন করে। আদর্শের বালাই নেই। তা হলে, এই যে মানুষের ভারতবর্ষ সে কতটা উন্নতি করবে? হাত-পা-মাথা বিহীন একটা জন্তুর মতো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে দেশটা। এবং তার জন্যে কারও বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। কমিউনিস্ট পার্টি এদের কথা কীভাবে চিন্তা করে অনিমেষ জানে না। পার্টির প্রথম সারির নেতাদের সঙ্গে তার আলাপ নেই। কমিউনিস্ট পার্টি সর্বহারার পার্টি। কিন্তু এইসব মানুষ কিছুই হারাতে রাজি নয়। ওর মনে হল এইরকম দরকচা মারা মানুষগুলোকে কখনওই কমিউনিজমে বিশ্বাসী করানো যাবে না। একটা বড় আঘাত— সে যুদ্ধই হোক কিংবা শাসনযন্ত্রের দুর্বার পীড়নই হোক— যা ব্যক্তিগত ঘেরাটোপগুলোকে ছত্রাকার করবে, তা না-এলে মানুষে মানুষে জানাশোনা হবে না।

স্টেশনের বাইরে এসে অনিমেষের খেয়াল হল গতকাল খবরের কাগজ পড়েনি। সরিৎশেখরকে নিয়ে সে এমন ব্যস্ত ছিল যে কোনওদিকে তাকাবার সময় পায়নি। হ্যারিসন রোডের দেওয়ালে টাঙানো একটা বামপন্থী কাগজের সামনে সে দাঁড়াল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর পুলিশি হামলার তীব্র নিন্দা করেছেন নেতারা। ভিয়েতনামে আমেরিকা বিষাক্ত বোমা ব্যবহার করছে। রাশিয়ায় পৌঁছে ভারতীয় ডেলিগেটরা লেনিনের সমাধিতে মালা দিয়েছেন। কেমন যেন সব সাজানো সাজানো ব্যাপার, অনিমেষ তৃপ্তি পেল না। আজ অবধি কোনও কমিউনিস্ট নেতা বললেন না, ভারতবর্ষ আমাদের দেশ। এই দেশের জন্যেই এখানে কমিউনিজম প্রয়োজন। প্রতিটি মানুষকে দেশকে ভালবেসে সংগ্রামী হতে হবে। সবসময় বিদেশের কথা বলে একটা অস্পষ্ট ধোঁয়াটে বৈপ্লবিক আবহাওয়া তৈরি করা হয়। কী লাভ কে জানে। তা ছাড়া এতগুলো বছর নেতারা কাজ করলেন কিন্তু ক’পা এগিয়েছেন তা তাঁরাই জানেন। এখনও শহরের মানুষকে কমিউনিজম সম্পর্কে আগ্রহী করা সম্ভব হয়নি। গ্রামে তো আরও দূর অস্ত। ভারতবর্ষের অনেক প্রদেশ তো কমিউনিজম বলতে বিদেশি কিছু বোঝে। তা হলে? এদিকে কংগ্রেসিরা তিল তিল করে অবক্ষয়ের দিকে এগোচ্ছে কিন্তু সে সুযোগ নেবার কোনও বাসনা বাম নেতাদের নেই। কংগ্রেসিদের অবস্থা যদুবংশের মুষলপর্বের মতন। এটাই তো প্রকৃত সময়। মাঝে মাঝে খুব রাগ হয় অনিমেষের। কিন্তু সেই যে দামি কথা, সীমাবদ্ধ ক্ষমতার মধ্যেই তোমাকে কাজ করতে হবে; মন চায় না তবু মেনে নিতে হয়।

অনিমেষ ভেবেছিল হস্টেলে ফিরে স্নান-খাওয়া সেরে কলেজে যাবে। কিন্তু মির্জাপুরের কাছাকাছি এসে ভাবল একবার ইউনিভার্সিটিটা ঘুরেই যাই। এখন সাড়ে দশটা বাজে। বারোটার আগে ক্লাস আরম্ভ হবে না। স্বচ্ছন্দে হস্টেল থেকে তৈরি হয়ে আসা যেত। কিন্তু এক কাপ চা খাওয়ার ইচ্ছা তীব্র হল। রাখালদার ক্যান্টিনে এখনও আট পয়সার চা পাওয়া যায়। লনে ঢুকতেই দেখল চারধারে পোস্টার। ছাত্র ধর্মঘট। পুলিশি অত্যাচারের প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। যদিও সে গতকাল খবরের কাগজ পড়েনি তবু কেউ তো এ-কথা বলেনি! তমালদের মুখেও তো শোনা যেত তা হলে।

এখনও ছেলেমেয়েরা কেউ আসেনি। অনিমেষ ক্যান্টিনে ঢুকে দেখল কয়েকজন ভাত খাচ্ছে, কোনার দিকে ছোট্ট একটা জটলা। ওরা যে ছাত্র পরিষদের ছেলে বুঝতে অসুবিধে হল না। অনিমেষকে দেখতে পেয়েই ওদের গলার আওয়াজ নীচে নেমে এল। একজনকে চিনতে পারল সে। শচীন। নীলার বন্ধু। একদিন কফিহাউসে এই ছেলেটির সঙ্গে তার অনেক কথা হয়েছিল। বেশ ভদ্র ছেলে। অনিমেষ রাখালদাকে একটা চায়ের কথা বলে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে হাসল। ওর এই চিনতে পারার ভঙ্গিটায় শচীন অবাক হল। অনিমেষ গলা তুলে বলল, ‘ভাল আছেন?’

গায়ে পড়ে কথা বলা ওর অভ্যেস নয় কিন্তু মনে হচ্ছিল ছেলেটি কোনও কারণে আড়ষ্ট হয়ে আছে। ব্যাপারটা জানার জন্য কৌতূহল হচ্ছিল।

শচীন এবার উঠে এল। সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কিছু বলছেন?’

অনিমেষ দেখল শচীনের বলার ভঙ্গিতে একটা শীতলতা আছে। তবু সে আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘অনেকদিন দেখিনি, খবর কী সব?’

‘কী খবর চান?’

‘অনেকদিন নীলাকে দেখিনি। কেমন আছে ও?’ অনিমেষের মনে হল নীলার কথা বললে শচীন সহজ হবে।

শচীনের কপালে ভাঁজ পড়ল। অনিমেষকে খুঁটিয়ে দেখে বলল, ‘আপনি কিছু জানেন না?’

‘কী ব্যাপার, কী হয়েছে?’ অনিমেষ অবাক হল।

‘ওদের বাড়িতে যাননি এর মধ্যে?’

‘না, বেশ কিছুদিন আমার যোগাযোগ হয়নি।’

‘তা হলে নিজে গিয়েই জেনে আসুন। আজ তো আপনারা ধর্মঘট ডেকেছেন, চলে যান আজকেই। কাছেই তো।’ শচীন এমন ভঙ্গি করল যেন তার কথা শেষ হয়ে গেছে, এবার ফিরে যাওয়া যেতে পারে।

অনিমেষ বলল, ‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনার কি সব কথা খুলে বলতে অসুবিধে আছে?’

এই সময় ছেলেটা চা দিয়ে যেতে সে ইশারায় শচীনকে এক কাপ দিতে বলল।

শচীন আপত্তি জানিয়ে বলল, ‘আপনি গতকাল বিকেলে জানতেন যে আজ ধর্মঘট করা হবে! আপনিও তো একজন ছাত্র-প্রতিনিধি!’

অনিমেষ এরকম প্রশ্ন আশা করেনি। ও বুঝতে পারল শচীন এই ধর্মঘটকে কেন্দ্র করেই তার সম্পর্কে এক বিরূপ ধারণা নিয়ে কথা বলছে। অনিমেষ উত্তর দিল, ‘আমি গতকাল অনুপস্থিত ছিলাম। থাকলে নিশ্চয়ই জানতে পারতাম। সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই সর্বসম্মত।’

‘মিথ্যে কথা। আমাদের খবর, কালকেও আপনাদের পরিকল্পনা ছিল না ধর্মঘট করার। পুলিশ যাদের অ্যারেস্ট করেছে তারা কেউ ছাত্র নয়। কিন্তু গত রাত্রে পার্টির নির্দেশে বিমান নিজে এই ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে।’

কথাটা শুনে চমকে গেল না অনিমেষ। এটা হতেই পারে। সাধারণ সম্পাদককে যদি পার্টি নির্দেশ দেয় তবে নিশ্চয়ই সে মান্য করবে। এতে অন্যায়টা কীসের। সে বলল, ‘এটা তো আমাদের ভেতরের ব্যাপার, আপনারা মাথা ঘামাচ্ছেন কেন?’

‘মাথা ঘামাচ্ছি কারণ আপনারা নিজের ইচ্ছেমতন সমস্ত ছাত্রছাত্রীকে কিছু করতে বাধ্য করতে পারেন না। পুলিশের সঙ্গে এনকাউন্টার আপনারাই করেছিলেন। ওদের খুঁচিয়ে দিয়ে ইউনিভার্সিটিতে এসে লুকিয়েছেন যাতে আমরাও জড়িয়ে পড়ি। বাইরের গুন্ডা দিয়ে ট্রাম পুড়িয়েছেন নিজের বীরত্ব প্রমাণ করতে। কী ইস্যু নিয়ে এত কাণ্ড হল? সাধারণ ছাত্রের সঙ্গে কী সম্পর্ক? গতকাল কেরলে তিনজন কমিউনিস্ট পুলিশের গুলিতে মারা গেছে অতএব আজ এখানে ধর্মঘট করো। অথচ সে-কথা আপনারা বলছেন না ধর্মঘটের কারণ দেখাতে। কিন্তু ছেলেমেয়েরা বহুদূর থেকে কষ্টের পয়সা খরচ করে এখানে এসে দেখবে ক্লাস হচ্ছে না— এই হয়রানি এবং অপচয় কেন করালেন? আর সবশেষে একটা কথা, নিজের নাক কেটে কি অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করা যায়? এক দিনের ধর্মঘট করা মানে একটা দিনের পড়াশুনো নষ্ট করা। এতে আপনাদের কী রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে?’

‘আমি এ ব্যাপারে আপনার সঙ্গে আলোচনা করতে ইচ্ছুক নই। আপনার যদি আপত্তি থাকে তা হলে আপনি ধর্মঘটে যোগ দেবেন না। ব্যস।’ অনিমেষ চায়ের দাম দিল।

‘সে তো একশো বার। আপনারা যা ইচ্ছে করবেন আর আমরা তা মুখ বুজে সহ্য করব এটা ভাববেন না। আমরা ধর্মঘটের প্রতিবাদ করব। আমরা ছাত্রদের বলব ক্লাস করতে।’

শচীন কথা শেষ করামাত্রই অনিমেষ ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে এল। কী পরিস্থিতিতে বিমানদা আজকের ধর্মঘট ডেকেছে সে জানে না কিন্তু সেদিন যে পুলিশ বাড়াবাড়ি করেছিল সেটা তো সত্যি।

ইউনিয়ন রুম জমজমাট। কার্যনির্বাহক কমিটির সবাই এসে গেছে। অনিমেষকে দরজায় দেখে সুদীপ চুরুট নামাল, ‘এই যে অনিমেষবাবু, আসুন।’

কথাটায় ব্যঙ্গ মেশানো, অনিমেষ অবাক হল। এভাবে কথা বলার কী কারণ আছে তা বুঝতে পারল না সে।

একটা চেয়ার টেনে বসতেই বিমান বলল, ‘কাল কী হয়েছিল তোমার?’

অনিমেষ বলল, ‘একটা পারিবারিক কাজে জড়িয়ে গিয়েছিলাম।’

বিমান বলল, ‘যাই হোক না কেন, একবার তোমার ঘুরে যাওয়া উচিত ছিল। পার্টির কাজ করতে গেলে ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলোকে এতটা গুরুত্ব দেওয়া চলবে না অনিমেষ। তা ছাড়া তোমার কাছ থেকে আমরা তেমন কোনও কাজও পাই না।’

সুদীপ বেঁকানো গলায় বলল, ‘দেখে তো মনে হচ্ছে স্নান-খাওয়া করোনি। তা এখন এখানে আসতে পরামর্শ দিল কে?’

এবার বিরক্তি চাপতে পারল না অনিমেষ, ‘আমি কি এসে অন্যায় করেছি?’

বিমান বলল, ‘তুমি হস্টেলে ছিলে না সকালে, খবর পেলে কী করে?’

অনিমেষ বলল, ‘আমাকে খবর দেওয়া হয়েছিল?’

‘হ্যাঁ। কিন্তু তোমাকে পাওয়া যায়নি।’

‘আমি স্টেশনে গিয়েছিলাম। ফেরার পথে কোনও কিছু না-ভেবেই এখানে এসেছি।’

‘আর এসেই সোজা ছাত্র পরিষদের সঙ্গে আলোচনায় বসে গেলে!’ সুদীপ বলল।

এবার অনিমেষ উঠে দাঁড়াল, ‘আপনারা কী বলতে চাইছেন খুলে বলুন!’

বিমান একটা হাত উপরে তুলে বলল, ‘উত্তেজিত হওয়ার মতো কিছু হয়নি। বসো।’ তারপর অন্য সবার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কমরেডস, আমাদের অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে। আপনাদের কাছে আমার আবেদন যে, এ সময়ে কোনওরকম আচরণ করবেন না যাতে পার্টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার জন্য এক সক্রিয় ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেছে। আমরা যেন কেউ সেই ফাঁদে পা না-দিই। আমাদের ছাত্র সংগঠনগুলো পার্টির এক একটা হাতের মতো। অতএব এই সংগঠনের গুরুত্ব অনেক। পুলিশ, কংগ্রেস সরকারের পুলিশ প্রকাশ্যে জঘন্য অত্যাচার করে ছাত্র সমাজকে কলুষিত করেছে। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ করেছি। এই প্রতিবাদের প্রকাশ আজকের ছাত্র ধর্মঘট। আমরা জানি সাধারণ ছাত্ররা আমাদের পাশে আছেন। যদি কেউ বিরোধিতা করতে চান সেই দালালদের আমরা বাধা দেব। গতকাল কেরলে পুলিশ তিন জন কমরেডকে হত্যা করেছে। এই সুযোগে আমরা তার প্রতিবাদ করব। আপনাদের কারও কিছু বলার আছে?’ বিমানের দৃষ্টি সবার মুখের ওপর বুলিয়ে এসে অনিমেষের ওপর স্থির হল। উত্তেজিত হলে মানুষের নার্ভ বিক্ষত হয়।

বিমানের বক্তৃতা অনিমেষের কানে অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল মাঝে মাঝে। তার সম্পর্কে অবিশ্বাস এদের মধ্যে এসেছে, এই বোধ তাকে নিঃসঙ্গ করছিল। বিমান জিজ্ঞাসা করল, ‘অনিমেষ, কিছু বলবে?’

সচেতন হল অনিমেষ। ঘাড় নেড়ে না বলে বসে পড়ল। বিমান বলল, ‘কোনও কোনও ব্যাপারে সবাই একমত নাও হতে পারে কিন্তু প্রতি ব্যাপার নিয়ে যদি আমরা সমালোচনা করি তা হলে কোনও কাজই শেষ হবে না। যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকের কর্তব্য হল হুকুম পালন করা। তাতে যদি মৃত্যুও হয় তবু তাই সই। কারণ আজকের মৃত্যু আগামীকালের পক্ষে আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়াবেই। আপনাদের কাছে আমার আবেদন, আমাদের আন্দোলন সফল করতে প্রত্যেকে সক্রিয় ভূমিকা নিন।’

বিমান বসে পড়তেই সুদীপ উঠে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে সবাইকে দেখল। তারপর অত্যন্ত গুরুগম্ভীর গলায় বলল, ‘কমরেডস, আমি খবর পেয়েছি আজকের ধর্মঘট বানচাল করতে বুর্জোয়া শাসন ব্যবস্থা বদ্ধপরিকর। তাদের লালিত ছাত্রসংস্থা এর মদত দেবে। দুঃখের কথা, কিছু প্রতিবিপ্লবী বিপথগামী বন্ধু এদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। আমরা এর মোকাবিলা করব। আপনারা অন্যান্য কমরেডদের নিয়ে ইউনিভার্সিটির প্রতিটি গেটে বিক্ষোভ সমাবেশ করুন। কেউ যদি জোর করে ঢুকতে যায় তা হলে আমরাও চুপ করে বসে থাকব না।’

কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে সবাই এক একটা গেটে চলে গেল। ইউনিভার্সিটির অফিস খোলা, অধ্যাপকদের আসতে বাধা দেওয়া হবে না।

অনিমেষকে ডাকল বিমান, ‘তুমি একটু আমার সঙ্গে এসো।’

একটু ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে বিমান জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার কী হয়েছে?’

‘কিছুই হয়নি।’

‘তুমি কি পার্টির প্রতি ভরসা হারাচ্ছ?’

‘এ-কথা কে বলল?’

‘আমাদের কানে এসেছে তুমি এরকম কথাবার্তা বলো।’

‘না, আমি কখনও বলিনি।’ অনিমেষ ভাবতেই পারছিল না তার মনের কথা এরা টের পাচ্ছে কী করে। সে তো কারও সঙ্গে আলোচনা করেনি।

‘কাল রাত্রে তুমি কী করছিলে?’

‘মানে?’

‘অনিমেষ, বি ইজি। কাল রাত্রে তুমি হাতিবাগানে কী করছিলে?’

এবার অনিমেষ শক্ত হল। ওরা কি সুবাসদার সঙ্গে তার দেখা হওয়া নিয়ে এসব বলছে? কিন্তু সুবাসদা তার পরিচিত, দেখা তো হতেই পারে।

সে বলল, ‘ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে বেরিয়ে সুবাসদার সঙ্গে দেখা, আমরা চা খেলাম, গল্প করলাম।’

‘কী গল্প?’

‘এটা একদম ব্যক্তিগত প্রশ্ন নয়?’

‘গুড। তুমি সহজ হতে পারছ না অনিমেষ। মনের মধ্যে ময়লা থাকলেই মানুষ গুটিয়ে যায়। তবু জিজ্ঞাসা করছি, কী কথা হয়েছিল?’

‘অনেক দিনের আলাপ। দেখা হল দীর্ঘ ব্যবধানে। এরকম ক্ষেত্রে যেরকম কথা হতে পারে আর কী। আপনার সঙ্গে দেখা হয়নি সুবাসদার?’

‘না। সে দেখা করবে না। সুবাসকে পার্টি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে এ-খবরটা তো তুমি শুনেছ ওরই কাছ থেকে। কেউ শাস্তি পেলে তার ব্রেন অনেক কিছু বানিয়ে নেয়। সুবাস তোমাকে প্রকাশ্যে রেস্টুরেন্টে যেসব কথা বলেছে তা অনেকেই শুনেছে। এসব কথা ওকে বলতে দিয়ে তুমি ভাল করোনি। ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি করার চেষ্টার জন্যে দল ওকে তাড়িয়েছে। এরকম মানুষের সঙ্গে কোনওরকম সংশ্রব না-রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। আমার কথা বুঝতে পেরেছ?’

বিমানের শেষ কথাগুলো যে সতর্কীকরণ তা বুঝতে অসুবিধে হল না অনিমেষের। এ নিয়ে অনেক তর্ক করা যেতে পারে কিন্তু অনিমেষ নিস্পৃহ থাকল। সুবাসকে ওর ভাল লাগে। সুবাস যে কথাগুলো বলেছে তা অযৌক্তিক বলে মোটেই মনে হয়নি। ও বুঝতে পারছিল এ ব্যাপারে যা কিছু সিদ্ধান্ত তা নিজেই নিতে হবে। এবং সেটা যতক্ষণ না নিতে পারছে ততক্ষণ বেফাঁস কথা বলা বোকামি হবে।

মেইন গেটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে অনিমেষ ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছিল। গতকাল ওই রেস্টুরেন্টে এমন কোনও পরিচিত মুখ ছিল না যে সুবাসের সঙ্গে তার আলোচনা এদের জানাতে পারে। তা হলে জানল কী করে? সুবাস যদি দল থেকে বিতাড়িত হয় তা হলে নিশ্চয়ই এদের বলবে না। ব্যাপারটা রহস্যময় অথচ কোনও সূত্র খুঁজে পেল না সে। অনিমেষ বুঝল, রাজনীতি করতে গেলে তাকে সতর্ক হয়ে পা ফেলতে হবে।

অনিমেষরা স্লোগান দিচ্ছিল। এখন দু’-একজন করে ছাত্রছাত্রী আসতে শুরু করেছে। ইউনিয়নের যারা যারা সমর্থক তারা ওদের সঙ্গে মিশে যাওয়ায় দলটাকে ভারী দেখাচ্ছিল। যারা কোনও দলে নেই তারা দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা বুঝতে চাইছিল। ইউনিভার্সিটির সবকটা গেটেই এই ধরনের বিক্ষোভ চলছে। ফলে ওদের ডিঙিয়ে কেউ ভেতরে ঢুকতে পারছে না। পাশের দেওয়ালে পোস্টার সাঁটা হয়েছে, পুলিশের বর্বর নির্যাতনের প্রতিবাদে আজ ছাত্র ধর্মঘট। এ-কথাটাই বিভিন্ন স্লোগানের মাধ্যমে অনিমেষরা বলছিল। কলেজ স্ট্রিটে এখন অফিস টাইমের ভিড়। ট্রাম-বাস থেকে লোকজন মুখ বের করে দেখছে ওদের। স্লোগান থামিয়ে একটু আগে বিমান বক্তৃতা দিয়ে গেল একটা টুলের ওপর দাঁড়িয়ে। জ্বালাময়ী ভাষণ এবং সমগ্র ছাত্র সমাজের অপমান হিসেবে সে ঘটনাকে ধিক্কার জানাল।

ক্রমশ কলেজ স্ট্রিটে ভিড় জমছে। ছেলেমেয়েরা ফুটপাত উপচে রাস্তায় নেমে ওদের দেখছে। ট্রাম বাসগুলো একসময় দাঁড়িয়ে গেল ভিড়ের জন্যে। এতক্ষণ কেউ ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেনি। এমনকী কোনও অধ্যাপক বা অফিসকর্মীকেও আসতে দেখেনি অনিমেষ। ওর মনে হল, এইরকম ধর্মঘট ডাকায় ছাত্রছাত্রীরা বেশ আনন্দিতই হয়েছে। মুফতে একটা ছুটি পাওয়া গেল, বেশ চুটিয়ে আড্ডা মারা যাবে— ছুটির মেজাজ এখন ওদের। কী জন্যে ধর্মঘট, কেন সেটা করা হচ্ছে এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনও দরকার কেউ বোধ করছে না। স্লোগান উঠছে ঢেউয়ের মতো, হঠাৎ শুনলে প্রতিটি শব্দ আলাদা করে কেউ বুঝতে পারবে না। অনিমেষের মনে হচ্ছিল, পুরো ব্যাপারটাই কেমন যেন সাজানো অথবা চাপানো, কারও মনের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই। যেন একটা ফর্মুলাকে অনুসরণ করে যাওয়া, সেটা যে কখন বাসি অকেজো হয়ে গেছে তার খোঁজ কেউ রাখে না।

অনিমেষের খিদে পাচ্ছিল। হস্টেলে ভাত ঢাকা আছে কিন্তু এখন যদি সে হাতিবাগানে গিয়ে খেয়ে আসতে চায় তা হলে সেটা দৃষ্টিকটু হবে। স্নান না-করে সে একটা দিনও থাকতে পারে না, সে না-হয় আজ না-করল। পকেটে এমন পয়সা নেই যে চট করে রাখালদার ক্যান্টিন থেকে খেয়ে আসবে। দাদুর জন্যে আচমকা যে খরচ হয়ে গেল তা সামলে এই মাসের বাকি ক’টা দিন কেমনভাবে চালাবে বুঝতে পারছিল না অনিমেষ। খিদের কথা মনে হতেই এই চিন্তাটা এল।

ঠিক এই সময় প্রেসিডেন্সি কলেজের দিকে স্লোগান উঠল। ‘চিনা দালাল নিপাত যাক। বেআইনি ধর্মঘট মানছি না, মানব না। গুন্ডাদের আন্দোলনে ছাত্ররা থাকছে না থাকবে না।’ একজন একটু এগিয়ে দেখে এসে বলল, ‘বড়জোর কুড়িজন ওদের দলে। চিন্তার কিছু নেই।’

ও-পক্ষের স্লোগান কানে আসামাত্রই এ-পক্ষের গলা উত্তাল হল। ওদিকের আওয়াজ যত এগিয়ে আসতে লাগল তত টেনশন বাড়ছে। ক্রমশ অনিমেষ ওদের দেখতে পেল। মুকুলেশ সামনে, শচীনও আছে। প্রত্যেকের হাতে বইখাতা, যেন ক্লাস করতে আসছে। দু’পক্ষের চিৎকারে কান পাতা দায়, ইউনিভার্সিটির কার্নিশে বসা একটা চিল ভয় পেয়ে ডানা ঝাপটে উড়ে গেল আচমকা।

গেটের কাছাকাছি ওরা আসতে পারল না। অনিমেষরা অনেকখানি জায়গা দখল করে রেখেছে। মুকুলেশ নিজের দলকে চুপ করিয়ে ওদের দিকে মুখ করে গলা তুলে বলল, ‘আমরা এই ধর্মঘট মানছি না। আমাদের ভেতরে যেতে দিন।’

বোধহয় এইরকম অনুরোধের জন্য এরা প্রস্তুত ছিল না। স্লোগান থেমে গেল হঠাৎই, সবাই চুপচাপ, কেউ উত্তর দিল না।

মুকুলেশ আবার বলল, ‘যাঁরা ধর্মঘট করবেন তাঁরা যাবেন না, কিন্তু সেটা সবার ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার অধিকার আপনাদের নেই।’

বিমান বা সুদীপ এই গেটে নেই এখন। অনিমেষ চট করে টুলে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, ‘এটা ইউনিয়নের সিদ্ধান্ত, ছাত্রদের তা মানতে হবে।’

মুকুলেশ বলল, ‘ইউনিয়নের নয়, আপনাদের পার্টির সিদ্ধান্ত, সেটা মানতে আমরা বাধ্য নই। আপনারা সরে যান, আমরা ভেতরে ঢুকব।’

ঠিত তখনই হইচই বেধে গেল। মুকুলেশের দলের দুটো স্বাস্থ্যবান ছেলে এদের সরিয়ে জোর করে ভেতরে ঢুকতে গেল। এরা তাদের থামাতে হাতাহাতি বেধে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই কলেজ স্ট্রিট যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়ে গেল। ছেলেমেয়েরা, যারা এতক্ষণ নাটক দেখছিল তারা ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাতে শুরু করল। দেখা গেল সেই দুটো ছেলে রীতিমতো প্রহৃত হয়ে মির্জাপুরের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। মুকুলেশরা উধাও। একটি ছেলেও ঢুকতে পারেনি। সবকটা গেটই অনিমেষদের দখলে। ফুটপাতের দোকানদাররা মালপত্র নিয়ে পালাচ্ছে। পরিস্থিতি সামলে নিয়ে অনিমেষরা স্লোগান দিচ্ছিল জোর গলায়। খবর পেয়ে বিমান সুদীপ ছুটে এসেছে। প্রচণ্ড উত্তেজনায় সবাই কাঁপছে। ঠিক সেইসময় গেটের মুখে বোমা পড়ল। মাটিতে পড়েই যে শব্দ হল তাতে হকচকিয়ে গেল তারা। ধোঁয়ায় চারধার ঢেকে যাচ্ছে। পরপর কয়েকটা। কলেজ স্কোয়ারের দিক থেকে বোমাগুলো আসছে। আত্মরক্ষার জন্যে সবাই গেট ছেড়ে ভেতরে ঢুকে গেল।

বোমা ছোড়ামাত্রই অনিমেষের মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। সে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এসে লক্ষ করতে লাগল কোন দিক থেকে বোমাগুলো আসছে। এখন কলেজ স্ট্রিট খাঁ-খাঁ করছে। ট্রামগুলো পিছু হটছে। পুলিশ ভ্যানের আওয়াজ পেল সে। অনিমেষের মনে হল কেউ একজন কলেজ স্কোয়ারের গেটের আড়ালে লুকিয়ে আছে। ছেলেটাকে ধরার উদ্দেশ্যে অনিমেষ রাস্তা পার হতেই আরও কয়েকটা বোমা তার মাথা টপকে ও-পাশের ফুটপাতে গিয়ে সশব্দে ফাটল। ছেলেটি তাকে কাছে আসতে দেখে গেটের আশ্রয় ছেড়ে প্রাণপণে ভেতরে দৌড়ে গেল। অনিমেষ পিছু ধাওয়া করতে চেয়ে বুঝতে পারল তার পক্ষে সম্ভব নয় ওকে ধরা, জোরে পা ফেললেই থাই টনটন করছে।

গেটের ওপাশে আবার স্লোগান উঠছে। বিমান চিৎকার করে ওকে ফিরে আসতে বলল। ফুটপাত ছেড়ে সে যখন সবে রাস্তায় পা দিয়েছে ঠিক তখনই আচম্বিতে একটা কালো ভ্যান তার পাশে এসে ব্রেক কষল। অনিমেষ কিছু বোঝার আগেই দু’-তিনটি পুলিশ ওর দু’হাত ধরে টানতে টানতে ভ্যানের পেছনে তুলে দিল। ঘটনাটার আকস্মিকতায় অনিমেষ এমন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল যে কোনও কথা বলতে পারছিল না। সে শুনল সার্জেন্ট বলছে, ‘আর কেউ আছে?’

‘নেহি স্যার, সব অন্দর মে।’

‘অয়্যারলেসে খবর দাও, একটা হুলিগান অ্যারেস্টেড।’

তারপর যান্ত্রিক কিছু কথাবার্তার মধ্যে অনিমেষ চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনারা আমাকে অ্যারেস্ট করছেন কেন? কী করেছি আমি?’ কেউ উত্তর দিল না। পুলিশভ্যানটা তেমনি স্থির হয়ে আছে অথচ অনিমেষের বেরুবার পথ বন্ধ।

এই সময় অনিমেষের কানে এল গেট থেকে নতুন স্লোগান উঠছে, ‘পুলিশ তুমি নিপাত যাও। কমরেড অনিমেষ লাল সেলাম লাল সেলাম।’

সার্জেন্টটা খড়কে দিয়ে দাঁত খুঁটতে খুঁটতে বলল, ‘সেলাম আবার লাল হয় কী করে মোশাই?’

দাঁতে দাঁত চেপে অনিমেষ বলল, ‘শা-লা!’

পুলিশভ্যানটা সঙ্গে সঙ্গে চলতে শুরু করল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *