১৯. সফদর (কাল : ১৯২২ খৃষ্টাব্দে)

সফদর (কাল : ১৯২২ খৃষ্টাব্দে)

ছোটো সুন্দর বাংলো। বিশাল প্রাঙ্গণের এক ধারে লাল এবং গোলাপী রঙের বড় বড়। ফুল ফুটেছে। একদিকে ব্যাডমিন্টন খেলার ছোট লন। লনের সযত্ন-লালিত সবুজ ঘাসগুলোর ওপর হেঁটে বেড়ানোও এক আনন্দের বস্তু। তৃতীয় দিকে এক লতামণ্ডপ এবং চতুর্থ দিকে বাংলোর পেছনে খোলা বারান্দা, সন্ধ্যার সময় সফদর প্রায়ই সেখানে বসতেন।

বাংলোর বাইরের দেয়ালের প্রাচীর বেয়ে সবুজ লতা উঠেছে। সফদর সাহেব অক্সফোর্ডে এমনি এক লতামণ্ডিত গৃহ দেখেছিলেন, নিজের বাংলোর প্রাঙ্গণে মনোরমভাবেই এগুলোকে লাগিয়েছেন।

এ ছাড়া তাঁর দুটো মোটর গ্যারেজও রয়েছে। সফদর জঙ্গ-এর সব কিছুতেই হুবহু ইংরেজি ঢঙ। আধা ডজন চাকর-বাকর তীর-ইংরেজ অফিসারের চাকরীদের মতোই তাদের সব আদব-কায়দা। কোমরে লালপট্টি, আঁটো করে বাঁধা পাগড়িতে নিজ সাহেবের নাম-চিত্র (মনোগ্রাম)। খাওয়ার ব্যাপারে বিলিতি খানাই ছিল সফদর সাহেবের সবচেয়ে প্রিয় এবং খানসামাও সে জন্য রাখা হয়েছিল তিনজন।

সফদর তো সাহেব ছিলেনই, সাকিনাকেও চাকর-বাকর মেমসাহেব বলে ডাকত। সাকিনা ধনুকের মতো বাঁকা ভ্রুর অতিরিক্ত লোমরাজি কামিয়ে ফেলে আরও সূক্ষ্ণ করে নিয়েছিলেন এবং কলপ দিয়ে সেই বঙ্কিম ভ্রূ হয়েছে আরও সুন্দর। পনের মিনিট অন্তর লিপস্টিকে ঠোঁট রাঙানো তাঁর অভ্যাস–তবে বিলিতি মেয়েদের পরিচ্ছদ কখনই পছন্দ করতেন না সাকিনা।

গত বছর স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে সফদর সাহেব বিলেত যান। তাঁর ইচ্ছা ছিল যে, সাকিনাও স্কার্ট-পেটিকেট। পরেন। সাকিনা কিন্তু এতে রাজী হননি। আর বিলেতের নর-নারীরা। সাকিনার সৌন্দর্যের সঙ্গে তাঁর বেশভুষারও যে রকম তারিফ করেছিল, তাকে সফদরের অম্লার কোনো আফসোশ ছিল না। স্বামী-স্ত্রী দুজনের গায়ের রঙই এত পরিষ্কার যে, ইউরোপে সবাই তাঁদের ইতালীয়ান মনে করত।

১৯২১-এর শীতকাল। উত্তর ভারতের সমস্ত শহরের মতো লক্ষ্ণৌতেও শীতকালটাই সবচেয়ে সুন্দর। সফদর সাহেব আজ কাছারী থেকে ফিরেই বাংলোর পিছনের বারান্দায় বেতের চেয়ারে এসে বসেছেন। তাঁর মুখমণ্ডল আজ অপেক্ষাকৃত গভীর। সামনের ছোট টেবিলের ওপর তাঁর নোটবুক এবং আরও দু-তিনখানা বই রয়েছে। পাশে তিনখানা খালি চেয়ার। সফদারের পরনে কড়া ইস্ত্রী করা প্রথম শ্রেণীর ইংরেজি সুট। তাঁর গোফদাড়ি-বিহীন। মুখের এই সময়কার চেহারা দেখলেই বোঝা যায় সাহেব আজ কোনো গরুগম্ভীর চিন্তায় মগ্ন। এই সময় চাকর-বাকরেরা খুব কমই আসত মনিবের সামনে। এমনিতে সফদর সাহেব মোটেই রাগী নন তবে চাকর-বাকরেরা ধরে রেখেছিল যে, এ রকম সময় সাহেব একলা থাকতেই ভালোবাসেন।

সন্ধ্যে হয়ে এসেছে কিন্তু সফদর ঐ একই আসনে বসে রয়েছেন। একজন চাকর টেবিল ল্যাম্প এনে রাখল সামনে। বাংলোর দিক থেকে কার যেন আসার শব্দ পেলেন। সফদর। চাকরকে জিজ্ঞেস করতে সে বলল, ‘মাস্টার শঙ্কর সিংহ ফিরে যাচ্ছেন।’

দৌড়ে গিয়ে মাস্টারজীকে ডেকে আনবার আদেশ দিলেন সফদর।

মাস্টার শঙ্কর সিংহের বয়স এই ত্রিশ-বত্রিশ, কিন্তু ইতিমধ্যেই বার্ধক্যের ছাপা পড়ে গেছে। তাঁর চেহারায়। তাঁর গলাবন্ধ কালো কোট, পায়জামা, মাথায় গোল ফেল্ট-টুপি, ঠোঁটের ওপর ঝুলে-পড়া ঘন কালো গোফে তারুণ্যের কোনো চিহ্নই নেই। যদিও তাঁর উজ্জ্বল চোখের দৃষ্টিতে প্রতিভা ফুটে ওঠে।

মাস্টারজী পৌঁছাতেই সফদর উঠে তাঁর হাত ধরলেন এবং চেয়ারে বসিয়ে বললেন, ‘শঙ্কর, দেখা না করেই ফিরে যাচ্ছিলে?’

‘ক্ষমা কর ভাই সাহেব, ভেবেছিলাম তুমি কোনো কাজে ডুবে রয়েছ।‘

‘মোকদ্দমার দলিলপত্রে একেবারে ড়ুবে থাকলেও আমার কাছে তোমার জন্য দু’মিনিট সময় সর্বদাই থাকে, আর আজ তো কোনো দলিলপত্রও নেই!’

শঙ্কর সিংহের প্রতি সফন্দরের নিবিড় স্নেহ ছিল, অপর কাউকে তিনি তার চেয়ে বড় বন্ধু বলে মনে করতেন না। সৈয়দপুর স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে লক্ষ্মৌতে বি. এ. পাশ করা পর্যন্ত দুজনেই মেধাবী ছাত্র ছিলেন। পরীক্ষায় কখনও কেউ দু’চার নম্বর বেশী পেতেন, কখনও বা কম। কিন্তু যোগ্যতার এই প্রতিদ্বন্দিতার ফলে তাঁদের মধ্যে কখনও ঝগড়া বা মনোমালিন্য হয়নি। একটি ব্যাপারে দু’জনের বন্ধুত্বকে নিবিড় করে তুলতে। সাহায্য করেছিল-তাঁরা দু’জনেই ছিলেন গৌতম-রাজপুত বংশের সন্তান। একজনের পরিবার আজ হিন্দু আর অন্যজন মুসলমান কিন্তু দশ পুরুষ আগে এই দুটো পরিবার শুধু যে হিন্দু ছিল তাই নয়, উপরন্তু দুটো বংশই পূৰ্বজে গিয়ে মিলে যেত। বিশেষ বিশেষ কারণে সংঘটিত পরিবারিক মিলন-সভাগুলোতে এখনও দুই পরিবারের লোককে একত্রিত হতে দেখা যেত।

সফদর পিতার একমাত্র পুত্র। একজন ভাই-এর অভাব তাই খুবই অনুভব করতেন তিনি। আর সেই অভাব পূরণ করেছিলেন শঙ্কর, কিন্তু এ সব তো বাইরের ব্যাপার। এগুলো ছাড়াও শঙ্করের মধ্যে এমন গুণ ছিল, যার জন্য পাকা সাহেব সফদর সাদাসিধে শঙ্করের প্রতি এতটা স্নেহপরায়ণ এবং শ্রদ্ধাবান। শঙ্কর ছিলেন অত্যন্ত নম্র প্রকৃতির কিন্তু খোসামোদ করতে জানতেন না। ফলে, প্রথম শ্রেণীতে এম.এ.পাশ করেও আজও তিনি সরকারী স্কুলের। সামান্য শিক্ষকই। তিনি যদি সামান্য একটু ইঙ্গিত করতেন। তবে আপরে তাঁর জন্য সুপারিশ করতে পারত এবং তাতে তিনি কোনো হাইস্কুলের হেডমাস্টার হয়ে যেতেন। কিন্তু তাঁকে দেখে মনে হয়, সারাজীবন সহকারী শিক্ষক হয়েই তিনি থাকতে চান। হ্যাঁ একবার অবশ্য বন্ধুর সাহায্য নিয়ে-ছিলেন-লক্ষীের বাইরে যখন বদলী করা হয়েছিল তাঁকে। বিনয়ের সঙ্গে আত্মসম্মান বোধও শঙ্কর সিংহের মধ্যে ছিল প্রবল, যাক অত্যন্ত সম্ভ্রম করে চলতেন। সফদর সাহেব। তাদের বারো বছর বয়সের বন্ধুত্ব আজ বিশ বছর পরেও ঠিক তেমনি আছে।

এ-কথা সে কথা করে দুটো চারটি কথাবার্তার পরই সোনালী ধান-রঙের শাড়ি এবং লাল ব্লাউজ পরিহিতা সাকিনা এসে হাজির হলেন।

শঙ্কর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, নমস্কার বৌদি!

মৃদু হেসে নমস্কার’ বলে জবাব দিলেন বৌদি। ধনী ‘স্যার’-এর গ্রাজুয়েট দুহিতা সাকিনা কোনো দিনই পর্দার আড়ালে থাকেননি, কাজেই শঙ্কর সিংহের সামনে আসা বা না-আসার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু সফন্দরের সঙ্গে শঙ্করকে নিঃসঙ্কোচে, কথাবার্তা বলতে। দেখলেই বিয়ের পর প্রথম মাস ছয়েক পর্যন্ত ত্ৰু কুঁচকে থাকত সাকিনার। পরিশেষে সফদরের কাছে তাঁকে স্বীকার করতে হয়েছে যে, শঙ্কর বাস্তবিকই স্নেহ-সম্মানের পাত্র। বর্তমানে তো শঙ্করের সঙ্গে সাকিনার খাঁটি দেওর-বৌদির সম্পর্ক। সাকিনা নিজেকে স্বেচ্ছায়ই সন্তানহীন করে রেখেছিলেন, কিন্তু মাঝে-মাঝে তিনি শঙ্করের শিশুপুত্রকে কাছে এনে রাখতেন।

এ দিকে গত ছ’বছর থেকে শঙ্কর বুঝতে পারছিলেন যে তাঁর ওপর ভগবান শঙ্করের কৃপা অসীম। তাঁর ঘরে দু’বছরের কম বয়সের কোনো না কোনো শিশু সব সময়েই রয়ে। যাচ্ছে বিগত ছ’বছরে।

গত এক সপ্তাহ ধরে সফদরের অস্বাভাবিক গভীৰ্য সাকিনাকে চিন্তিত করে তুলেছিল। আজকে শঙ্করকে দেখে বড়ই খুশী হলেন। কেননা তিনি জানতেন যে, সাহেবের মনের ভার লাঘব করতে একমাত্র শঙ্করের সাহায্য প্রয়োজকন, তাঁর দিকে তাকিয়ে সাকিনা বললেন, ‘ঠাকুরপো, তোমার তাড়া নেই তো? বৌদির হাতের চকোলেট পুডিং কেমন লাগবে?’

সফদর, ‘এ আজ জিজ্ঞেস করবার দরকার কি?’

সাকিনা, ‘আমি জেনে নিতে চাই ঠাকুরপো কখন যাবেন। তাঁর চলে যাবার তো কোনো ঠিক নেই!’

শঙ্কর, ‘এমন কথা বল না বৌদি! কখনো তোমার হুকুম অমান্য করেছি?’

সাকিনা, ‘কিন্তু হুকুম শোনার আগে সরে পড়া সেও তো এক অপরাধ।’

শঙ্কর, ‘আচ্ছা তাহলে খাবার এবং পুডিং খেয়ে যেতে হবে তোমাকে।’

তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলেন সাকিনা। সফদর এবং শঙ্করের বাক্যালাপও ক্রমশ গুরুতর–বিষয়ে প্রবেশ করল। সফদর বললেন, ‘সম্পূর্ণ নতুন এক বৈপ্লবিক যুগে আমরা প্রবেশ করেছি। শঙ্কর। আমার মতে ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দের পর এই প্রথম সমগ্ৰ ভারতভূমির ভিতসুদ্ধ টলমল করে উঠেছে।’

‘সাম্প্রতিক রাজনৈতিক আন্দোলনের কথা বলতে চাইছ?’

’রাজনৈতিক আন্দোলন কথাটা অত্যন্ত সাধারণ, শঙ্কর। ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দে কংগ্রেস যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, যখন সেটা ইংরেজ আই-সি-এস সাহেবদের অবসর বিনোদনের প্রতিষ্ঠান ছিল, তখনও কংগ্রেসের বড়দিন-উৎসবের বক্তৃতা এবং সুরাপানকে ‘আন্দোলন’ আখ্যাই দেওয়া হত। তুমিও যদি তাকে আন্দোলন বলতে চাও তো আমি বলব, আন্দোলনের যুগ থেকে আমরা এখন বিপ্লবের যুগে প্রবিষ্ট হয়েছি।’

‘যেহেতু গান্ধীজি তিলক-স্বরাজ ফাণ্ডের জন্য এক কোটি টাকা তুলেছেন এবং ২ স্বরাজের দাবী নিয়ে খুব হৈ-চৈ শুরু করেছেন-এই জন্যে?’

‘কোনো এক বিশেষ ব্যক্তি বিপ্লব অথবা বিপ্লবী আন্দোলনের আধার হতে পারে না শঙ্কর। যে বিরাট পরিবর্তন বিপ্লব বয়ে আনে, তাও এক-আধা ডজন মহাপুরুষের সামর্থের বাইরে। আজকের এই আন্দোলনের মূল কারণ যখন আমি বিশ্লেষণ করি, তখন এই সিদ্ধান্তেই আমাকে পৌঁছাতে হয়। তুমি তো জানো শঙ্কর, ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দের স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতা ছিল পদচ্যুত সামনবতপ্রভুরা, কিন্তু সে যুদ্ধ চলেছিল সাধারণ লোকেরই প্রাণের বিনিময়ে। আমাদের দুর্বলতার জন্য আমরা সফল হতে পারিনি সে যুদ্ধে, পরাজিতদের ওপর কঠোর প্রতিশোধ নিল ইংরেজরা। সে যাক, আমি বলতে চাই যে, ১৮৫৭ সালের পরে এই প্রথম দেশের সমগ্র জনসাধারণকে স্বাধীনতার যুদ্ধে একতাবদ্ধ করা হয়েছে। ভারতীয় ইতিহাসের একজন কৃতী ছাত্র হয়ে তুমিই বল, এমন আর একটিও আন্দোলনের কথা কি তোমার জানা আছে, যাতে জনগণ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে?’

‘ভাই সফদর, নাগপুর কংগ্রেস (১৯২০ খৃঃ) এবং কলকাতা কংগ্রেস শেষ হয়ে গেছে। গ্রামে গ্রামে যে উত্তেজনার কথা তুমি বলছি, তা আমিও নিজের চোখেই দেখেছি এবং তাকে অভূতপূর্ব বলেই স্বীকার করি। কিন্তু প্ৰচণ্ড এই ঝড়ের পর, এই লক্ষ্মৌতেই বহুবার বিদেশী কাপড়ের স্তুপ পোড়ানোর পরও যা তোমার মনে বিশেষ কোনো রেখাপাত করেনি। সেই ব্যাপারেই আজ তুমি এমনভাবে কথা বলছি যেন এক আসন্ন বিপ্লবের সঙ্গে তুমি ভীষণভাবে জড়িত।’

‘তোমার কথা ঠিকই শঙ্কর। সত্যিই এই বিপ্লবের ঢেউ যেন দেহ থেকে আমার পাদুটোকে ভেঙে ফেলতে চাইছে। কিন্তু এই বিপ্লব-তরঙ্গকে ছোট রকমের এক স্থানীয় ঘটনা বলে আমি মনে করি না। বরং এ এক বিরাট গণ অত্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত হয়েই উঠেছে। সমস্ত যুগেই সবচেয়ে বড় বিপ্লবী শক্তি জনগণকে আশ্রয় করেই প্রকট হয়ে ওঠে।’

‘১৮৫৭ খৃষ্টাব্দ থেকে আরম্ভ করলে ভাই, মস্ত বড় জল ছড়িয়ে বসছ যে!’

‘ও কথা কেন, আমার বক্তব্য শুনবে কি শঙ্কর?’

‘ব’ল, আমি শুনিব। বৌদি পুডিং তৈরি করছেন, আর কোল রবিবার। শুধু কেউ গিয়ে বাড়িতে খবর দিয়ে এলেই হল যে, শঙ্কর এই লক্ষ্মৌতে বেঁচেই আছে এবং তার বৌদির হাতের পুডিং খেয়ে নাক ডাকাচ্ছে। ব্যসূ তারপর সারারাত ধরে নিশ্চিন্ত হয়ে তোমার কথা। শুনতে পারব আমি।’

‘শঙ্কর শুধু আমিই নই, ভারতের বাইরে সমস্ত জায়গায় রাজনীতির ছাত্ররা স্বীকার করে যে গত শতাব্দী এবং বর্তমান শতাব্দীতে ইংলণ্ডের রাজনীতিতে সকল পরিবর্তনই আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত, এবং নিয়ন্ত্রিত হয়েছে পৃথিবীর অপরাপর রাজশক্তির গতিবিধি দ্বারা। আর এই সব পরিস্থিতির কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এর-মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক কারণ। ১৮৫৭-র ঢেউ চলে যাবার পর আমাদের দেশ ঘুমিয়ে পড়েছিল একেবারে। অর্থাৎ আমাদের গতি তখন এত শ্লথ যে, তাকে ঐ ঘুমিয়ে-পড়া আখ্যাই দিতে হয়, কিন্তু অন্যান্য দেশে বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়ে গেল। এক হাজার বছর আগে রোমান সাম্রাজ্যের পতনের সময় থেকে খণ্ড-বিখণ্ডিত ইটালী ১৮৬০ খৃষ্টাব্দে (২রা এপ্রিল) একটি যুক্তরাষ্ট্রে পরিণত হল, এবং ম্যাজিনী গ্যারিবাড়ীর মতো মহান আদর্শ আমাদের উপহার দিল। রোমান সাম্রাজ্যকে বিধ্বস্ত করতে সমর্থ হলেও যে জার্মান জাতি নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারেনি, ১৮৬৬ খৃষ্টাব্দে তারা আংশিকভাবে এবং ফ্রান্স বিজয়ের পর ১৮৭০-এ (১৮ই জানুয়ারি) প্রায় সম্পূর্ণভাবে গ্রুশিয়ার নেতৃত্বে একটি যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ১৮৬৬ খৃষ্টাব্দের এই সব পরিবর্তন পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরাট পরিবর্তন। এরপর, ফ্রান্সের বিশাল শক্তিকে ১৮৭০ খৃষ্টাব্দে পরাস্ত করে প্যারিস এবং ভার্সাই-এর ওপরেও জার্মানী তার ধ্বজা ওড়াতে পেরেছিল, যার ফলে ইংলণ্ড এবং রাশিয়া। ভীত হয়ে বার্লিনের ওপর লক্ষ্য রাখতে লাগল। এটা তো হল বৈদেশিক শক্তিতে ভীতির ব্যাপার। কিন্তু এর চেয়েও বড় ভয় তাদের হল প্যারীর শ্রমিক রাজ্য প্যারী—কমুনকে দেখে-দোসরা এপ্রিল থেকে যে দেড় মাসের কিছু বেশি টিকে ছিল এবং প্রমাণ করে দিয়েছিল, শুধু জমিদার পুঁজিপতিরাই নয়, শ্রমিকরাও রাজ্যশাসন করতে সক্ষম।’

‘তুমি কি মনে কর ভারতের রাজনৈতিক ঘটনাবলীও এ সবের সঙ্গে জড়িত?’

‘রাজনৈতিক ঘটনাই শুধু নয়, আমাদের ইংরেজ শাসকবৃন্দের ভারত-সম্পর্কিত নীতি নির্ধারণেও এর প্রভাব বিদ্যমান। ইউরোপে জার্মানীর মতো এক দুর্জয় শক্তির উদ্ভব হতেই ফ্রান্স আর ইংলন্ডের প্রতিদ্বন্দ্ব রইল না। কারণ জার্মানী থেকেই এখন তার যত বিপদের আশঙ্কা। মৃত প্যারী-কমুন এবং ১৮৭২ খৃষ্টাব্দে অষ্ট্রিয়া বাদে জার্মানীর সকল রাষ্ট্রের মিলিত এক জীবন্ত যুক্তরাষ্ট্র আমাদের রাজতান্ত্রিক শাসকবৃন্দের চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল—এ! কথা আর বলার দরকার হয় না। একই সঙ্গে এই সময় আরও পরিবর্তন ঘটল। ১৮৭০ খৃষ্টাব্দে ইংলণ্ড সামান্য ব্যবসায়ী থেকে পুঁজিপতিতে রূপান্তরিত হল। কাঁচামাল কেনা থেকে আরম্ভ করে উৎপাদিত পণ্য বাজারে ছাড়া পর্যন্ত সকল পর্যয়েই মুনাফা-শিকারের একচেটিয়া ব্যবস্থা পাকা হয়ে গেল। ব্যবসাতে শুধু কারিগরদের কাছ থেকে মাল খরিদ করে এদিক-সেদিকে বেচে লাভ হয়। কিন্তু পুঁজিবাদে প্রতিটি পদক্ষেপেই লাভ। তুলা কিনতে গিয়ে লাভ, পরিষ্কার করিয়ে বস্তা-বন্দী করাতে লাভ, রেলে এবং জাহাজে চাপিয়ে নিয়ে যেতে পারলে লাভ, ম্যানূচেস্টারের মিলে সুতো-কাটা এবং কাপড় বোনায় লাভ, আবার তৈরি কাপড় জাহাজে করে ফিরিয়ে আনতে, জাহাজ কোম্পানী থেকে লাভ, রেলের লাভ—এই সমগ্র মুনাফার তুলনা করে কারিগরের হাতে বোনা মাল বিক্রি করা ব্যবসায়ীদের। লাভের সঙ্গে!’

‘হ্যাঁ ব্যবসা থেকে পুঁজিবাদে লাভ তো নিশ্চয়ই বেশি।’

‘১৮৭১ খৃষ্টাব্দে যখন ভার্সাইতে বিজয়ী জার্মানী গ্রুশিয়ার রাজা প্রথম ইউলিয়ামকে সমগ্র জার্মানীর কাইজার (সম্রাট) বলে ঘোষণা করল, তার পরের বছর (১৮৭২) ফোঁপে ওঠা ইংরেজ পুঁজিপতিরা টোরি প্রধানমন্ত্রী ডিস্‌রেইলীর মারফৎ সাম্রাজ্যবাদ ঘোষণা করল। এই ঘোষণা শুধু নতুন শব্দ নয়–খুবই সুচতুর তার লক্ষ্য এবং অভিসন্ধি। কল কারখানাও এত বেড়ে উঠেছিল যে, তার জন্য সুরক্ষিত বাজারের প্রয়োজন ছিল। এমন বাজার, যেখানে জার্মানী এবং ফ্রান্সের তৈরি মালের সঙ্গে প্রতিযোগিতার ভয় নেই। অর্থাৎ যে-সব বাজারের ইজারাদারী সম্পূর্ণ নিজের হাতের মুঠোয় থাকবে। এরই সঙ্গে সঙ্গে পুঁজি ও এতটা ফোঁপে উঠেছিল যে, তাকে মুনাফা-মৃগয়ায় খাটাবার জন্যও প্রয়োজন হল সংরক্ষিত স্থানের। আর এই সব কার্যসিদ্ধি অপর দেশকে সম্পূর্ণরূপে নিজের হাতের মুঠোয় আনতে পারলেই হতে পারে। ডিস্‌রেইলীর অভিধানে এই সবই ছিল সাম্রাজ্যবাদ শব্দের অর্থ। ভারতবর্ষে এই দুই বিষয়েই সুবিধা ছিল, আর ইউরোপ থেকে ভারতে আসবার সবচেয়ে সস্তা এবং সহজ পথ ছিল সুয়েজ খাল-১৮৬৯ খৃষ্টাব্দে যার খননকার্য শেষ হয়েছিল। ১৮৭৫ খৃষ্টাব্দে মিশরের কাছ থেকে ১,৭৭,০০০ শেয়ার চল্লিশ লক্ষ পাউণ্ড দিয়ে টেলিগ্রামে কিনে নিল ডিসরোইলী সাম্রাজ্য-বিস্তারে এটা হল তার দ্বিতীয় পদক্ষেপ। তারপর ১৮৭৭–এর ১লা জানুয়ারি দিল্লীতে দরবার বসিয়ে রাণী ভিক্টোরিয়াকে সম্রাজ্ঞী রূপে ঘোষণা করে ডিস্‌রেইলী সাম্রাজ্যবাদকে এত দূর এগিয়ে নিয়ে গেল যে, উদারনৈতিক দলের গ্র্যাডক্টোন প্রধানমন্ত্রী হয়েও ডিস্‌রেইলীর নীতি পরিবর্তন করতে সমর্থ হল না।’

‘আমরা এখনও ছাত্রদের পড়াই যে, মহারাণী ভিক্টেরিয়া ভারতসম্রাজী-কাইজার-ই–হিন্দ উপাধি ধারণ করে ভারতবর্ষকেই ধন্য করেছেন।’

‘ছ’বছর আগে প্রশিয়ার রাজাও এই কাইজার উপাধি ধারণ করেছিল। রোমান সম্রাজ্যের পতনের সময় থেকে পরিত্যক্ত শব্দের মূল্য হঠাৎ কেমন বেড়ে উঠল!’

‘রোমান শব্দ ‘কাইজার’কে শুধু ভারতবর্ষেই ব্যবহার করা আর ইংরেজিতে তার জায়গায় ‘এমূপ্রেসূ ব্যবহার করা-এর ভেতর আবার রহস্য নেই তো কোনো?’

‘থাকতে পারে! যাইহোক, ১৮৭১ খৃষ্টাব্দে আমরা সাম্রাজ্যবাদী যুগে প্রবিষ্ট হয়েছি। প্রথমে এল ইংলণ্ড। পরাজিত প্রজাতান্ত্রিক ফ্রান্স নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে ১৮৮১ খৃষ্টাব্দে তুসিনের (আফ্রিকা) ওপর অধিকার কায়েম করে সাম্রাজ্যবাদের পথ ধরল। আর নতুন ফ্যাক্টরী এবং পুঁজিপতিদের দ্বারা সমৃদ্ধ জার্মানীও ১৮৮৪ খৃষ্টাব্দে উপনিবেশের দাবী উত্থাপন করে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় তৎপর হল।’

‘কিন্তু ভারতে ইংরেজের নীতি পরিবর্তনের সঙ্গে এগুলোর কি সম্বন্ধ?’

‘নিত্য-নতুন আবিষ্কৃত যন্ত্র, ক্রমবর্ধমান কল-কারখানা এবং সেগুলি থেকে উৎপাদিত পুঁজির জন্য মৃগয়াক্ষেত্রের ব্যবস্থা একটা করতেই হবে। ১৮৭৪-৮০ খৃষ্টাব্দের ভিতর ডিস্‌রেইলী মন্ত্রীসভা সেটা সম্পাদন করে ফেলল। ১৮৮০-৯০ খৃষ্টাব্দের উদারনৈতিক গ্লাডক্টোন সরকারও ডিস্‌রেইলীর পথ থেকে পশ্চাদপসরণ করতে সমর্থ হল না। পুঁজির নগ্ন সাম্রাজ্যবাদী দানবতাকে কিছুটা ভদ্রবেশ পরাবার প্রয়োজন ছিল, যাতে জনসাধারণ সতর্ক হয়ে উঠতে না পারে। এই জন্যই ডিস্‌রেইলী ‘ভারত সম্রাজ্ঞীর অভিনয়ের অবতারণা। করেছিল। এরপর প্রয়োজন হল। উদারনৈতিকদের আরও কিছুটা উদারতা দেখানো। এই উদারতা নেমে এল আয়ার্ল্যাণ্ডের ‘হোম রুল’ রূপে। কিন্তু আয়ল্যাণ্ডের প্রশ্ন আজও অমীমাংসিত। ভারতীয়রা ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দে নিজেদের কংগ্রেসকে দীড় করাল। কংগ্রেস বস্তুত ব্রিটিশ উদারনৈতিক দলের ধর্মপুত্র রূপেই জন্মলাভ করল এবং এক যুগ পর্যন্ত আপন ধর্ম পুত্রকে ব্রিটিশরা সস্নেহে রক্ষা করল। কিন্তু ১৮৯৫ থেকে ১৯০৫ পর্যন্ত ব্রিটেনে পুনরায় টোরি সরকার প্রতিষ্ঠিত হল, তারা এলগিন এবং কার্জনের মতো সুযোগ্য সন্তান ভারতবর্ষে পাঠাল সাম্রাজ্যবাদের ভিত সুদৃঢ় করতে। কিন্তু ফল হল উল্টো।’

‘তুমি কি লাল লাজপৎ রায়, বাল গঙ্গাধর তিলক আর বিপিনচন্দ্ৰ পাল—এঁদের কথাই বলতে চাইছ?’

‘এই লাল, বাল, পাল-এঁরা ছিলেন বহির্বিশ্বের ঘটনাবলীর প্রতীক। রাশিয়াকে পরাভূত করে (ফেব্রুয়ারি, ১৯০৪) জাপান নিজেকে বৃহৎ শক্তিসমূহের পর্যায়ভুক্ত করে। ফলে কংগ্রেসের অস্পষ্ট বক্তৃতার জড়তা ভেদ করে ভারতীয় যুবকদের সামনে এগিয়ে যাবার প্রেরণা জোগায়। অর্ধশতাব্দী পর ভারতীয়গণ নিজেদের জন্য মরতে শিখল, এ বিষয়ে। আয়ার্ল্যাণ্ড এবং রাশিয়ার শহীদদের উদাহরণেও অনুপ্রাণিত হলাম আমরা। কাজেই বর্তমান ঘটনাবলীর কারণগুলির অনুসন্ধান শুধু ভারতবর্ষের ভেতর থেকে করতে গেলে ভুল হবে না কি?’

‘নিশ্চয়ই, দুনিয়ার সকল জায়গাই যে পরস্পর সম্বন্ধ যুক্ত।’

‘কোনো বিপ্লবী আন্দোলনের শক্তি নির্ভর করে দুটো বিষয়ের ওপর। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি তথা আন্তর্জাতিক দৃষ্টান্তসমূহ থেকে কতটা প্রেরণা লাভ করল এবং সে দেশের সবচেয়ে সংগ্রামী শ্রেণী কতটা পরিমাণে অংশগ্রহণ করল। প্রথম উৎসের উদাহরণ আমি দিয়েছি। দ্বিতীয় উৎস হল, মজুর-কৃষক জনগণ। বিপ্লবী-যুদ্ধ সেই চালাতে পারে-হারাবার মতো যাদের কিছু নেই। সাকিনার অধীর-সুধা, এই বাংলো এবং গাঁয়ে পৈতৃক জমিদারী হারাবার ভয় যাদের আছে বিপ্লবের সৈনিক সে হতে পারে না। এই জন্যই বলছিলাম যে, সর্বহারা জনতাই শুধু বিপ্লবের বাহন হতে পারে।’

‘এ বিষয়ে আমি তোমার সঙ্গে একমত।’

‘তাহলে জনতার অন্তরে যে উত্তেজনা আজ রয়েছে তাকে উপলব্ধি কর, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি থেকে কতটা প্রেরণা পাওয়া যাচ্ছে সে সম্বন্ধেও চিন্তা করে দেখ। গত মহাযুদ্ধ গোটা পৃথিবীতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে গেছে! সে যুদ্ধ ছিল সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধপুঁজি এবং উৎপাদিত পণ্যের সুরক্ষিত বাজার দখলে রাখবার বা বলপূর্বক অধিকার করতে যাবার পরিণাম। জার্মানীর ক্রমবর্ধমান উৎপাদনের সুরক্ষিত বাজারের জন্যে নতুন উপনিবেশ প্রয়োজন ছিল, কিন্তু পৃথিবী বণ্টন করা হয়েছিল আগে থাকতেই। তাই যুদ্ধ করেই উপনিবেশ ছিনিয়ে নেবার প্রয়োজন হল, আর উপনিবেশগুলির মালিক ইংল্যাণ্ড এবং ফ্রান্সের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধিল জার্মানীর। যুদ্ধে জার্মানী হেরে গেল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সাম্রাজ্যবাদের স্বপ্ন চুরমার করে দেবার জন্য অপর এক শত্রু জন্মলাভ করল-যার নাম সাম্যবাদ। সাম্যবাদের শাসনাধীনে উৎপাদন মুনাফাশিকারের যন্ত্র নয়, পরন্তু মানব সমাজকে সুখী এবং সমৃদ্ধ করে তোেলবার উপাদান। যন্ত্রের ক্রমোন্নতি সাধিত হয়, কলকারখানা প্রসার লাভ করে, পণ্য উৎপাদন বেড়ে যায় এবং তার জন্য প্রয়োজন হয় অতিরিক্ত বাজারের। আবার ঐ সব পণ্য ক্রয় করার জন্য অর্থেরও প্রয়োজন হয় যার জন্য ক্রেতার পুরো মজুরী লাভের সুযোগ থাকা উচিত। ক্রেতার আর্থিক সঙ্গতি যত কম থাকবে, পণ্যও সেই পরিমাণে অবিক্রীত পড়ে থাকবে বাজারে বা গুদামে। পণ্য উৎপাদন কমিয়ে দিলে কারখানা বহুলাংশে বন্ধ হয়ে যাবেই, মজুরেরা বেকার হয়ে পড়বে, মাল খরিদ করবার মতো পয়সাও তাদের হাতে থাকবে না। লোকে তখন মাল খরিদ করবে কি করে, কি করে কারখানাই বা চালু থাকবে। সাম্যবাদ বলে, মুনাফার বাসনা ত্যাগ কর। নিজ রাষ্ট্র বা সমগ্র পৃথিবীকে একক পরিবার বিবেচনা করে তার জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদন কর, প্ৰত্যেকের কাছ থেকে তার সামর্থ্যানুযায়ী শ্ৰম আদায় কর, প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার জীবন ধারণের উপযোগী আবশ্যকীয় সামগ্ৰী দাও। অবশ্য যতক্ষণ পর্যন্ত সকলের প্রয়োজন মেটাবার মতো কল-কারখানা এবং কারিগর সৃষ্টি না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত শ্রমের পরিমাণ অনুযায়ী পারিশ্রমিক দাও। আর এই ব্যবস্থা একমাত্র তখনই সম্ভব যখন ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে কিছু থাকবে. না, কারখানা এবং সমগ্র উৎপাদন যন্ত্রের ওপর থেকেই ব্যক্তির একচেটিয়া অধিকার বিলুপ্ত হয়ে যাবে।’

‘এ রকম কল্পনা সত্যই সুন্দর।’

‘এখন এ শুধু কল্পনা নয় শঙ্কর, পৃথিবীর এক ষষ্ঠাংশ। রাশিয়ায় ১৯১৭ খৃষ্টাব্দে ৭ই নভেম্বর সাম্যবাদী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। পুঁজিবাদী দুনিয়া অবশ্য আজও মানবতার এই একমাত্র আশা-ভরসার স্থলকে নির্মূল করতে চাইছে কিন্তু সোভিয়েত সরকার প্রথম অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে গেছে, অবশ্য হাঙ্গেরীতে মাত্র। ছ’মাস পরে (মার্চ-আগষ্ট, ১৯১৮) ফ্রান্স এবং আমেরিকার পুঁজিপতিগণের সাহায্যে এই সোভিয়েত শাসনকে নিশ্চিহ্ন করে। ফেলা হয়েছিল। সোভিয়েত রাশিয়ায় মজুর-কৃষক রাজের অস্তিত্ব সমগ্র দুনিয়ার সামনে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্বরূপ, আর এই সোভিয়েত শাসন কায়েম করেছে যে বিরাট শক্তি তা সমস্ত দেশেই কাজ করে চলেছে। যুদ্ধ থেমে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই ইংরেজরা রাউলাটবিল পাশ করবার জন্য এত তাড়াহুড়া করেছিল। কেন?–এই বিশ্ববিপ্লবী শক্তিকে দমন করার জন্য। যদি ঐ বিপ্লবী শক্তি পৃথিবীকে রূপান্তরিত করবার জন্য দেশে তার বীজ বপন না করত, তাহলে ইংরেজরা রাউলাট বিল পাশ করত না আর গান্ধীও তার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতেন। না। সেই সঙ্গে ১৮৫৭-র পর থেকে চাপা পড়ে থাকা আগুন সারা দেশে জ্বলে উঠত না। এই জন্যই আমি বলছি, আমরা এক বিপ্লবী যুগে এসে পড়েছি।’

‘তাহলে তোমার মতো গান্ধী বিপ্লবী—নেতা? কিন্তু যে গান্ধী গোখেলের মতো উদারনৈতিক নেতাকে নিজের গুরু বলে মনে করেন, তিনি কি করে বিপ্লবী নেতা হতে পারেন সফফু ভাই?’

‘গান্ধীর আদর্শ এবং সমস্ত কাজকে আমি বিপ্লবধর্ম মনে করি না, শঙ্কর। বিপ্লবী শক্তির ভিত্তি সাধারণ মানুষকে তিনি যে সংগ্রামে আহবান করেছেন। আমি শুধু তাঁর সেই কাজটুকুকেই বিপ্লবধর্ম বলে মনে করি। তাঁর ধর্মের দোহাই-বিশেষ করে খিলাফৎ আন্দোলন সম্পর্কে তাঁর মনোভাবকে আমি বরং সরাসরি বিপ্লব-বিরোধী চাল বলেই মনে করি। কল-কারখানার যুগ ছেড়ে তাঁর অতীতে ফিরে যাবার প্রচেষ্টাকে আমি প্রতিবিপ্লবী বিচ্যুতি মনে করি। আর তাঁর স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দেবার সিদ্ধান্তকেও আমি ঐ একই পর্যায়ে ফেলি।’

‘তোমার মঙ্গল হোক সফফু ভাই। তুমি যখন গান্ধীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠেছিলে আমার তো শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছিল তখন। আমি ভাবছিলাম, তুমিও আবার স্কুলকলেজগুলোকে শয়তানের আখড়া বলে বসবে!’

‘শিক্ষা-প্ৰণালী দোষযুক্ত হতে পারে শঙ্কর, কিন্তু আজকের স্কুল-কলেজে বসে বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচয় ঘটে আমাদের। বিজ্ঞানকে বাদ দিয়ে আজ মানুষ বাঁচতে পারে না। আমাদের স্বাধীনতা যখনই আসুক না কেন, বিজ্ঞানের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে যাবেই। মানুষের ক্রমবর্ধমান ভবিষ্যৎ-সমৃদ্ধি বিজ্ঞানের ওপরই নির্ভরশীল-তাই বিজ্ঞানকে ছেড়ে অতীতের পথে পা বাড়ানো আত্মহত্যারই সামিল। স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দিয়ে চরকাতাঁতের স্কুল প্রতিষ্ঠা করার অর্থ দেশকে সম্পূর্ণ রূপে অন্ধকার যুগে নিয়ে যাবার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে বিপ্লবী সেনাদলে ভর্তি হওয়ার জন্য ছাত্রদের আহ্বান করা মোটেই অন্যায় নয়-এটা অন্তত তুমি স্বীকার করবে। শঙ্কর।’

‘নিশ্চয়। আর অন্যান্য বয়কটগুলোর বিষয়ে কি বল তুমি?’

‘আদালত বয়কট? সেটা কিন্তু ঠিকই। তার সাহায্যে আমরা বিদেশী আমাদের ক্ষমতার পরিধি এবং তীব্ৰ অসন্তোষের কথা জানাতে পারি। আর বিলিতি জিনিস বর্জন করা তো বিলিতি ব্যবসায়ীদের গালে এক প্রচণ্ড থাপ্পড় মারার সামিল। তাছাড়া এতে আমাদের স্বদেশী শিল্প প্রসারের প্রেরণাও মিলবে।’

‘আমি দেখতে পাচ্ছি ভাই সফফু বহু দূর পর্যন্ত এগিয়ে গেছ তুমি।’

‘এখনও যাইনি। কিন্তু আমি যেতে চাই।’

‘যেতে চাও?’

‘তুমি আগে বল আমরা এক বিপ্লবী যুগের ভিতর দিয়ে চলেছি কিনা?’

‘তোমাকে আমিই তো কতবার এ প্রশ্ন করেছি সফফু ভাই। রুশ-বিপ্লবের কথা শুনেই আমি খুঁজে-খুঁজে সাম্যবাদী-সাহিত্য পড়তে লাগলাম এবং নিজেদের সমস্যাগুলো সাম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে বিচার করতে শুরু করলাম। এতদিন পর্যন্ত আমি শুধু এই সন্দেহের মধ্যে ছিলাম যে, গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন এই মহানু উদ্দেশ্যের পরিপূরক কিনা। কিন্তু তুমি যখন বিপ্লবী জনতার দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে, অমনি আমার সন্দেহ দূর হয়ে গেল। গান্ধীকে আমি বিপ্লবের যোগ্য নায়ক বলে মনে করি না সফফু ভাই-তোমার কাছে খোলাখুলিই বলছি। কিন্তু জনতার শক্তির ওপরে আমি বিশ্বাস রাখি। ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দে। ; পদচ্যুত সামন্তগণ চর্বি, কার্তুজ আর ধর্ম বিপদগ্ৰস্ত-এই ধুয়া তুলে জনতার এক শক্তিশালী অংশকে দলে টেনে ছিল, কিন্তু আজ রুটির দাবীতেই সমগ্ৰ জনতা আন্দোলনের মাঝে এসে পড়েছে। আমার মনে হয় গণমনে উত্তেজনার এই কারণ যথার্থ, বিপ্লবের ধ্বনিটা খাঁটিইএবং গান্ধী যদি নিজের আসল ভূমিকায় অবতীর্ণ হন তবুও বিপ্লবের গতি ফেরাতে সক্ষম হবেন না। তিনি!’

‘আমি ঠিক করছি যে বিপ্লবী সেনাদলে ভর্তি হব, হব অসহযোগী।’

‘এত তাড়াতাড়ি!’।

‘তাড়াতাড়ি করলে তো অনেক আগেই লড়াইয়ের ময়দানে নেমে পড়তাম। অনেক বিচার-বিবেচনার পর আজ তোমার সঙ্গে আলোচনা করে আমি আমার সিদ্ধান্তের কথা প্রকাশ করেছি।’

সফদর যখন গম্ভীর স্বরে এই কথাগুলো বলছিলেন, শঙ্করের দৃষ্টি তখন কিছুটা দূরে সরে গিয়েছিল। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে সফদর আবার বললেন, ‘তুমি হয়ত ভাবছ, তোমার বৌদির অধর-রাগের কথা, তার রেশমী শাড়ির মখমলের পাড়টির কথা, অথবা এই বাংলা এবং তার খানসামাদের কথা! সাকিনার ওপর অবশ্য কোনো সিদ্ধান্ত জোর করে চাপিয়ে দেব না, তার ইচ্ছামতো সে জীবনযাপন করুক। তার জন্যে তার নিজের সম্পত্তি, এবং এই বাংলা রয়েছে। কিন্তু এখন থেকে আমার কাছে এসবের আর কোনো আকর্ষণই নেই।’

‘তোমার এবং বৌদির কথাই শুধু ভাবছি না। আমি ভাবছি আমার নিজের সম্বন্ধেও। আমার চলার পথে যে মানসিক বাধা ছিল সেটা দূর হয়ে গেছে। চল আমরা দুই ভাই এক সঙ্গেই বিপ্লবের আবর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ি।’

বিস্ফারিত দৃষ্টি মেলে সফ্‌দর বললেন, ‘অক্সফোর্ডে থাকাকালীন তোমার সম্বন্ধেই আমার ভয় ছিল শঙ্কর। এবারে তো আমি হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চে গিয়ে দাঁড়াব!’

সার্কিনা এসে খেতে ডাকলে দুই বন্ধুর বৈঠক শেষ হল।

 

২.

এই রাত থেকে সফদরকে কিছুটা প্ৰফুল্ল দেখতে পেলেন সাকিনা। তিনি ভাবলেন যে, এটা হয়ত শঙ্করের সঙ্গে গল্প-গুজবের ফল। সফদরের কাছে সব চেয়ে মুস্কিলের ব্যাপার হল নিজের সিদ্ধান্তের কথা সাকিনাকে জানানো। এমনিতে সফদরও আদর-আহ্লাদের মাঝে লালিত হয়েছে। কিন্তু তা হলেও তিনি ছিলেন গায়ের লোক। নগ্ন দারিদ্র্যাকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে তাঁর নিজের ওপর বিশ্বাস জন্মেছে যে, যে-পরীক্ষায় তিনি অবতীর্ণ হতে যাচ্ছেন, তাতে নিশ্চয়ই উত্তীর্ণ হবেন। কিন্তু সাকিনার কথা স্বতন্ত্র। তাঁর। সম্বন্ধে এ কথাই বলা যেতে পারে যে, পা দিয়ে কখনও কঠিন মাটি স্পর্শ করেননি। তিনি। রবিবারেও তাই সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারলেন না। সফদর। সোমবার কোর্টে যখন নিকট বন্ধুদেরও তাঁর সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়ে গেল, তখন সাকিনাকে সব কথা জানানোর প্রয়োজন আরও প্রবলভাবে অনুভব করলেন তিনি।

সে রাতে তিনি লক্ষ্মেীর সর্বশ্রেষ্ঠ শ্যাম্পেন আনালেন। সাকিনা ভাবলেন, আজ কোনো’ বন্ধু আসবেন বুঝি! কিন্তু খাওয়ার পর যখন বেয়ারাকে শ্যাম্পেন খুলে আনার আদেশ সফদর দিলেন তখন সার্কিনার কিছুটা কৌতূহল হল। সাকিনার ঠোঁটে শ্যাম্পেনের গ্লাস তুলে ধরে সফ্‌দর বললেন, ‘সাকিনা, প্রিয়তমা, আমার কাছে এটাই তোমার শেষ প্রসাদ হয়ে দাঁড়াবে।’

‘তুমি মদ ছেড়ে দিচ্ছ?’

‘হ্যাঁ প্রিয়তমে, আরও অনেক কিছুই ছাড়ছি, কিন্তু তোমাকে নয়। এখন থেকে তুমিই। হবে আমার সুরা।’ এই কথার পর সাকিনার কাতর চেহারা লক্ষ্য করে সফদর বললেন, ‘সাকিনা আমার কাছে এস, আমরা শ্যাস্পেন পান করি এখন। আরও অনেক আলোচনাই রয়েছে আমাদের।’

সুরাপানে সাকিনার কোনোই ভাবান্তর হল না, যদিও সফদর ওমর-খৈয়াম থেকে অনেকটাই আবৃত্তি করে গেলেন। চাকর-বাকরেরা বিদায় নেবার পর সাকিনা যখন স্বামীর কাছে এসে অমঙ্গল আশঙ্কায় অভিভূত হয়ে শুয়ে পড়লেন, তখন নিজের কথা বলতে আরম্ভ করলেন সফদর–

‘সাকিনা, আমি এক গুরুতর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যদিও প্রথমেই আমি স্বীকার করছি যে, এমন একটা সিদ্ধান্ত নেবার সময় তোমাকেও কিছু বলবার সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল আমার। কিন্তু এই অপরাধ আমি কেন করেছি, আমার পরবর্তী কথাগুলো থেকেই সেটা বুঝতে পারবে, তুমি। সংক্ষেপে আমার সিদ্ধান্তের মূল কথা হল-আমি এখন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সৈনিক হতে চলেছি।’

কথাগুলো সাকিনার হৃদয়ে এসে যেন বজ্ৰঘাত করল, আর এজন্য মুখে কিছুই বলতে পারলেন না। তিনি। তাঁকে চুপ করে থাকতে দেখে সফদর আবার বললেন, ‘কিন্তু সাকিনা, তোমাকে আমি সুখস্বাচ্ছন্দ্যের ভিতর লালিত-পালিত হতে দেখেছি, কাজেই এ কৃচ্ছ্রসাধনের মাঝে তোমাকে টেনে আনতে চাই না।’

সাকিনার মনে হল যেন আর একবার নতুন করে আঘাত লাগল তাঁর ক্ষতস্থানে-এ আঘাত যেন প্রথম আঘাতকেও ভুলিয়ে দিল। আঘাতের পর আঘাতে আত্ম-সম্মান জেগে উঠল সাকিনার, তিনি বলে উঠলেন, প্রিয়তম তুমি কি সত্যিই আমাকে এতটা আরামপ্রিয় বলে মনে কর যে, তোমাকে কষ্ট সইতে দেখেই আমি পালঙ্কের ওপর বসে থাকতে চাইব? শোন সফদার, যদি প্ৰাণ দিয়ে আমি তোমাকে ভালোবেসে থাকি, তবে সে ভালোবাসা আমাকে তোমার সঙ্গে যে-কোনোখানে যাবার শক্তি জোগাবে। অধর-রাগ অনেক ব্যবহার করেছি। আমি, বহু সময় নিজেকে নিঃশেষ করে দিয়েছি শুধু সাজ পোশাকেই, কঠোর জীবনের সঙ্গে পরিচিত হতে কোনোদিনই চেষ্টা করিনি। আমি-এ সব সত্যি। কিন্তু তা হলেও তুমিই আমার সব সফদর। আমি চিরদিনই তোমার সঙ্গে থাকব। আর আমার বর্তমান জীবনের পথ প্রদর্শন যেমন তুমিই করেছিলে তেমনি আগামী জীবনেও তুমিই আবার আমার পথপ্রদর্শক হবে।’

সফদর কিন্তু এতটা আশা করেননি! যদিও তিনি জানতেন যে, সাকিনা অত্যন্ত দৃঢ়চেতা মেয়ে। সফদর আবার বলতে লাগলেন, ‘নতুন মোকদ্দমা নেওয়া আমি বন্ধ করে দিয়েছি। পুরনোগুলো অন্যের কাছে সোপর্দ করে দিচ্ছি। আশা করছি এই সপ্তাহের মধ্যেই আদালতের কাজ থেকে ছুটি পেয়ে যাব। আরও একটা খবর শুনবে সাকিনা? শঙ্করও আমার সঙ্গে আন্দোলনে ঝাঁপ দিচ্ছে। শঙ্কর একটি রত্ন বুঝলে সাকিনা! আমার সঙ্গে পৃথিবীর শেষ প্রান্তে এগিয়ে যেতে সে প্রস্তুত।’

‘শঙ্করের ত্যাগ কিন্তু তোমার চেয়েও বড় সফদর।’

‘আত্মত্যাগের জীবনই সে বরণ করে নিয়েছিল সাকিনা। এ পথ থেকে কোনোদিনই সরেনি সে। তা’না হলে খুবই বড় উঁকিল সে হতে পারত, অথবা নিজের চাকরীতেও যথেষ্ট উন্নতি করতে পারত।’

‘তার দুটি ছেলে যখন মারা যায়, তখন খুব কেঁদেছিলাম। আমি, কিন্তু এখন বুঝতে পারছি যে, চারটি থেকে দুটি বোঝা কমে যাওয়ায় ভালোই হয়েছে!’

‘আচ্ছা শঙ্করের এই সিদ্ধান্তকে চম্পা কিভাবে গ্ৰহণ করবে সাকিনা?’

‘চোখ বুজে মেনে নেবে সে। স্বামীকে কি করে ভালোবাসতে হয় সেই তো আমায় শিখিয়েছে সফদর!’

‘ভবিষ্যতের থাকা-খাওয়ার জন্য কিছু ব্যবস্থা আমাদের করে রাখতে হবে।’

‘এ সম্বন্ধে ভাববার অবকাশ পেলাম কই? তুমিই বল না কি করা যায়?’

‘আমাদের গায়ের শরীফন এবং মঙ্গলকে রেখে বাকি চাকরীদের দু’মাসের মাইনে দিয়ে বিদায় করে দিতে হবে। দু’খানা মোটরগাড়িই বেচে দেব।’

‘ভালোই হবে।’ ‘দু’একটি খাট আর কয়েকটা চেয়ার বাদে ঘরের সমস্ত আসবাবপত্র বিলিয়ে অথবা নীলাম করে দিতে হবে। লাটুস রোডে মাসীর যে বাড়ি পেয়েছি, সেখানেই থাকব গিয়ে, আর এই বাংলা ভাড়া দিয়ে দেব।’

‘খুব চমৎকার ব্যবস্থা।’

‘আমার আর তো কিছুই মনে পড়ছে না!’

‘আর আমার কাপড়-চোপড়-আমার বিলিতি পোশাক পরিচ্ছদগুলো?’

‘গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিচ্ছি। তাই ওসবের কথা বলছ? আমি কিন্তু ওসব পোড়ানোর পক্ষপাতী নই, বিশেষ করে সারা দেশেই যখন প্রচুর বিলাতী জমা কাপড় পোড়ানো হচ্ছে। তবে আমার নিজের জন্যে খদ্দরের পায়জামা-পাঞ্জাবী পর্শুর মধ্যে তৈরি হয়ে আসবে।’

‘তুমি বড্ড স্বার্থপর সফদর!’

‘খদ্দরের মোটা আর ভারী শাড়ি পরবে সাকিনা?’

‘তোমার সঙ্গে সব অবস্থাতেই আমি মানিয়ে চলতে পারব।’

‘দেখি তাহলে কি করা যায়। খুব ভালো হত। যদি ঐ সব জামা-কাপড় নীলামে বিক্ৰী করে দিয়ে সেই টাকায় গরীবদের জন্য কাপড় কিনে দিতে পারতাম।’

 

৩.

সফদরের মতো উদীয়মান ব্যারিস্টারের এই মহান ত্যাগের কথা চতুর্দিকে আলোচিত হতে লাগল। যদিও সফদর শঙ্করকেই প্রশংসার যোগ্যতর পাত্র বলে মনে করতেন। সারা অক্টোবর এবং নভেম্বর জুড়ে সফদর জনসাধারণের মধ্যে প্রচার চালাবার সুযোগ পেলেন। কখনও কখনও সাকিনা বা শঙ্কর তাঁর সঙ্গে থাকতেন। গ্রামের দিকে তাঁর মনোযোগ বেশি, কারণ গ্রামের কৃষক-মজুরের ওপর যতটা তাঁর আস্থা ছিল লেখাপড়া-জানা শহরের লোকের ওপর ততটা ছিল না। কিন্তু এক সপ্তাহের ভেতরই তিনি বুঝতে পারলেন যে, তাঁর উচ্চশ্রেণীর উর্দু গ্রামের এক-চতুর্থাংশ লোকও বুঝতে পারছে না। শঙ্কর কিন্তু প্ৰথম থেকেই গ্ৰাম্য ভাষায় বক্তৃতা আরম্ভ করেছিলেন। তাঁর সাফল্য দেখে সফদরও ওই ভাবে বক্তৃতা দেওয়া ঠিক করলেন। প্রথমে তাঁর কথাবার্তায় পুঁথিগত শব্দই বেশি থাকত কিন্তু শঙ্করের। সাহায্যে এবং নিজের পরিশ্রমে দু’মাস যেতে না যেতেই ভুলে যাওয়া বহু শব্দ এবং সেই সঙ্গে নতুন নতুন সর্বজন-বোধ্য শব্দ তিনি রপ্ত করে ফেললেন।

ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে (১৯২১ খৃঃ) বহু রাজনৈতিক কৰ্মীসহ সফদর এবং শঙ্কর এক বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে ফৈজাবাদ জেলে প্রেরিত হলেন। চম্পা এবং সাকিনা গ্রেপ্তার এড়িয়ে কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন।

জেলে গিয়ে, এক ঘণ্টা নিয়মিত চরকা কাটতেন। সফদর। যারা তাঁর গান্ধী-বিরোধী রাজনৈতিক মতবাদের কথা জানত, তারা কটাক্ষ করত। সফদর কৈফিয়ৎ দিতেন, ‘বিলিতি কাপড় বয়কট করাকে আমি একটা রাজনৈতিক হাতিয়ার বলে মনে করি; সেই সঙ্গে এও আমি জানি যে, আমাদের দেশে এখনও পর্যাপ্ত কাপড় তৈরি হয় না, তাই কাপড় আমাদের তৈরি করতে হবে। তবে দেশের কারখানাগুলি যখন পর্যাপ্ত বস্ত্ৰ উৎপাদন করবে, তখন আর চরকা কাটার পক্ষপাতী থাকব না আমি।’

জেলের ভেতর অলসভাবে বসে থাকা লোকের সংখ্যাই ছিল বেশি। এই সমস্ত লোকেরা গান্ধীজির এক বছরে স্বরাজ আনার কথায় আস্থাবান হয়ে বসেছিল। তারা মনে করত, জেলে আসাতেই তাদের কাজ শেষ হয়ে গেছে। গান্ধীবাদী আদর্শে বিশ্বাসীদের মধ্যে তখন পর্যন্ত ভণ্ডামী, ধাপ্লাবাজী আর লোক-ঠকানো কমীিদের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। কাজেই বন্দীদের মধ্যে সাচ্চা দেশভক্তের সংখ্যাই ছিল বেশি। সফদর এবং শঙ্করের আক্ষেপ হত রাজনৈতিক জ্ঞান বাড়ানোর দিকে এদের দৃষ্টি নেই বলে। এদের অনেকে রামায়ণ, গীতা বা কোরান পাঠ করত, মালা হাতে নাম জপত, অনেকে শুধু তাস পাশা খেলেই সময় অতিবাহিত করত। একদিন গান্ধীবাদী রাজনীতি দিগগজ পণ্ডিত বিনায়কপ্ৰসাদের সঙ্গে দেখা করলেন সফদর এবং শঙ্কর। বিনায়কপ্ৰসাদ বললেন, ‘রাজনীতি ক্ষেত্রে অহিংসার প্রয়োগ গান্ধীজির এক মহান আবিষ্কার এবং অমোঘ অস্ত্র।’

‘আমাদের বর্তমান অবস্থায় এটা উপযোগী হতে পারে, কিন্তু অহিংসা কোনো অমোঘ অস্ত্ৰই নয়। পৃথিবীতে যত অহিংস পশু আছে তারাই অপরের শিকার হয়।’

‘পশুকুলে না হতে পারে, কিন্তু মানুষের মধ্যে অহিংসা এক অদ্ভুত শক্তির সঞ্চার করে।’

‘নতুন আবিষ্কারের ক্ষেত্রে কোনো নজির থাকে না।’

‘এটা নতুন আবিষ্কার নয়।’ শঙ্কর বলে উঠলেন, ‘বুদ্ধ, মহাবীরের মতো বহু ধর্মোপদেশক এই অহিংস নীতির ওপর জোর দিয়ে গেছেন।’

‘কিন্তু রাজনীতির ক্ষেত্রে নয়।’

সফদর, ‘রাজনীতির ক্ষেত্রে এর উপযোগিতা যে কিছুটা বেড়ে গেছে তা এই জন্যেই যে, মানবতা আজ কিছুটা উচ্চস্তরে উঠেছে। সংবাদপত্রগুলিতে নিরস্ত্রদের ওপর গুলি চালাবার খবর পড়ে আজ সবাই তার নিন্দা করে। জালিয়ানওয়ালাবাগে। গুলি চালিয়ে ইংরেজরা এর প্রত্যক্ষ পরিচয় পেয়েছে।’

‘তাহলে কি বলতে চান, অহিংসাত্মক-অসহযোগ স্বরাজ প্রতিষ্ঠার জন্য যথেষ্ট নয়?’

‘প্ৰথমে আপনি বলুন, স্বরাজের সংজ্ঞা কি?’

‘আপনিও তো স্বাধীনতার সংগ্রামে নেমেছেন, আপনিই বলুন না!’

‘আমি মনে করি স্বরাজ মানে মেহনতকারীর রাজত্ব-শুধুই মেহনতকারীর।’

‘তাহলে আপনার স্বরাজে মন-প্ৰাণ দিয়ে, অৰ্থ দিয়ে সাহায্য করা, কষ্ট করে রাবরণ করা-শিক্ষিত পুঁজিপতি এবং জমিদারদের কোনো অধিকার থাকবে না?’

‘এ তে আপনিই দেখেছেন-পুঁজিপতি এবং জমিদারেরা সালিশী-সভা বসাতেই ফুরসৎ পায় না। ওরা জেলে আসতে যাবে কোন দুঃখো! আর যদি কেউ.এসেও থাকে। তবে শ্রমজীবীদের স্বার্থের সঙ্গে তার স্বার্থকে আলাদা করে দেখা কখনই উচিত নয়।’

শঙ্কর এবং সফদর সর্বদাই বই পড়তেন, এবং দেশের আর্থিক সামাজিক সমস্ত সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতেন। প্রথম দিকে তাঁদের কথা অন্যান্যরা খুব কমই শুনত। কিন্তু ৩১ ডিসেম্বর (১৯২১ খৃষ্টাব্দ) মধ্যরাত্রি পার হয়ে যাবার পরও যখন জেলের ফটক খুলল না, তখন তারা নিরাশ হয়ে পড়ল। যখন আতঙ্কিত, উত্তেজিত জনতা কর্তৃক চৌরীচৌরায় কয়েকজন পুলিশের লোকের হত্যার খবর শুনে গান্ধীজি সত্যাগ্ৰহ বন্ধ করে দিলেন তখন বহু লোকই নতুনভাবে চিন্তা করতে লাগল এবং তাদের মধ্যে থেকে কিছু লোক এগিয়ে এসে সফদর এবং শঙ্করের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হল যে, বিপ্লবী শক্তির একমত উৎস জনসাধারণ–গান্ধীজির মস্তিষ্ক নয়। জনসাধারণের এই শক্তিকে অবিশ্বাস করে গান্ধী নিজেকে বিপ্লব-বিরোধী বলে প্রমাণ করে দিয়েছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *