শ্রীলেখার সঙ্গে যে সূর্যর মেলামেশা বারণ হয়ে গেছে, সেটা বুঝতেই সূর্যর দিন সাতেক লেগে গেল। সে অধিকাংশ সময়েই নিজেকে নিয়ে মশগুল থাকে। কিংবা বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ায়। হঠাৎ হঠাৎ তার শ্রীলেখার কথা মনে পড়ে।
স্নান করে এসে সূর্য চিরুনি পাচ্ছে না। খানিকটা এদিক-ওদিক খোঁজাখুঁজি করেই সে বিরক্ত হয়ে গেল। তখন মনে পড়ল শ্রীলেখার কথা। দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে হাঁক দিল, শ্রীলেখা–!
কোনও সাড়া নেই। দুপুরবেলা সারা বাড়ি নিস্তব্ধ। নীচ তলায় কাঠের মিস্তিরি শুধু ঘ্যাস ঘ্যাস করে র্যাদা চালাচ্ছে।
ছাদের সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল বাদল। হাতে ঘুড়ি-লাটাই। রোদ্দুরে মুখ-চোখ লাল।
সূর্য বলল, এই বাদল, তোর বড়দিকে ডাক তো!
বাদল এখন কথার অবাধ্য হতে শুরু করেছে। সে এখন সেই বয়সে এসে পৌঁছেছে, যখন একলা একা কথা বলে বেশ সময় কেটে যায়। দেওয়ালের জলের দাগে সে দেখতে পায় কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের দৃশ্য, বাঁখারির তির-ধনুক নিয়ে সে সেই দেওয়ালের পাশে অর্জুন হয়ে দাঁড়ায়। একতলার নোনাধরা থামটাকে সে হিরণ্যকশিপু মনে করে কোমরের বেল্ট খুলে চাবুক মারে। সিঁড়ির রেলিংয়ে উঠে সরসর করে নামতে নামতে সে পঙ্ক্ষীরাজ ঘোড়া চালিয়ে উড়ে যায় মায়াবতী রাজকন্যার দেশে। শিগগিরই সে কোনও জাহাজে আলু-পেঁয়াজের খোসা ছাড়াবার চাকরি নিয়ে নিরুদ্দেশ যাত্রায় যাবে। তারপর একদিন কর্নেল সুরেশ বিশ্বাস হয়ে ফিরে আসবে। ডক্টর লিভিংস্টোনের মতন সেও আফ্রিকার জঙ্গলে….।
সূর্যর কথা শুনে সে হালকা ভাবে ছড়িয়ে দিল, বড়দি, তোমায় ডাকছে–এ-এ-এ! তারপর তরতর করে নেমে গেল একতলায়। তার এখন অনেক কাজ।
সূর্য একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল দরজার সামনে। আবার ডাকল, শ্রীলেখা! এবারও কোনও সাড়া নেই। তার ভুরু কুঁচকে গেল। শ্রীলেখাকে তো ডাকতে হয় না, তার দরকারের সময় শ্রীলেখাকে সব সময়েই কাছে কাছে পেয়েছে। কিছু যে একটা গোলমাল হয়েছে সূর্য তাও বুঝল না, সে আরও বেশি রেগে যেতে লাগল।
ঘর ছেড়ে সূর্য এগিয়ে গেল বারান্দা দিয়ে, অন্য প্রান্তে শ্রীলেখাদের ঘরের দিকে। ধুতিটা ভাজ করে লুঙ্গির মতন পরা, খালি গা, মাথার ভিজে চুলগুলো কপালে এসে পড়েছে।
বাড়িতে বয়স্ক পুরুষরা কেউ উপস্থিত নেই, দুপুরের আহারের আগে মেয়েরা এক জায়গায় বসে বিশ্রম্ভালাপ করছে। বাদলের মা, তার জ্যাঠাইমা, শ্রীলেখা, সান্ত্বনা। সান্ত্বনা টেনে টেনে আঁচড়ে দিচ্ছে তার মায়ের চুল। শ্রীলেখার হাতে সেলাইয়ের সরঞ্জাম। কী। কথা নিয়ে যেন বেশ হাসাহাসি হচ্ছিল, দরজার কাছে সূর্যকে দেখে সবাই হঠাৎ একসঙ্গে থেমে গেল।
সূর্য ডাকল, শ্রীলেখা, শোন!
শ্রীলেখা কোনও উত্তর না দিয়ে তার মায়ের দিকে তাকাল। শ্রীলেখার মা বললেন, সূর্য, তোমার চান হয়ে গেছে? তুমি আগে খেয়ে নেবে নাকি?
সূর্য বলল, একটু পরে।
শ্রীলেখার মা তখন শ্রীলেখা আর সান্ত্বনার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই, তোরা চান করতে গেলি না! যা, যা! কত বেলা হয়ে গেল।
শ্রীলেখা সেলাইয়ের জিনিসপত্তর রেখে আস্তে আস্তে উঠে পঁাড়াল। আলনা থেকে নিতে গেল টাটকা শাড়ি-সায়া।
সূর্য আবার ডাকল, এই শ্রীলেখা।
শ্রীলেখা উত্তর দিল না, ফিরেও তাকাল না।
সূর্য তখন ঢুকে এল ঘরের মধ্যে। ঘরের অন্য কারওর মুখের ভাব-ভঙ্গি লক্ষ করার অবকাশ তার নেই। শ্রীলেখার হাত চেপে ধরে সূর্য নিষ্ঠুরের মতন বলল, তখন থেকে ডাকছি, শুনতে পাচ্ছিস না?
শ্রীলেখা অন্য দিকে তাকিয়েই আস্তে আস্তে বলল, কী বলবে, বলো না।
আমার ঘরে চল।
আমি এখন চান করতে যাব!
দু’ মিনিট পরে গেলে কী হয়?
সূর্য প্রায় হিড়হিড় করেই টানতে টানতে নিয়ে গেল শ্রীলেখাকে। ঘরের অন্য সবাই। প্রায় এক মিনিট নীরবে বসে রইলেন। দুই মা চোখাচোখি করলেন কয়েক বার। সান্ত্বনা আস্তে আস্তে উঠে গেল।
শ্রীলেখার মায়ের মুখে স্পষ্ট একটা বিষাদের রেখা। সূর্যর প্রতি তাঁর মনে বেশ খানিকটা দুর্বলতা ছিল। তাঁর নিজের পুত্রসন্তান নেই। গোড়া থেকেই এই অদ্ভুত স্বভাবের বালকটির প্রতি স্নেহের টান ছিল তাঁর। কিন্তু মাতৃস্নেহের স্বাদ সূর্য কখনও পায়নি বলে সে ও-সব তোয়াক্কাও করে না। এ বাড়িতে দুই মামিমা যখন তাকে আদরযত্ন করেছে, সে মনে করেছে, এ-সবই সামাজিক নিয়ম, স্বাভাবিকভাবেই তার প্রাপ্য। স্নেহ নিম্নগামী, সহজে তাতে ভাটা পড়ে না–সূর্যর দু’-একটা রূঢ় ব্যবহার সত্ত্বেও শ্রীলেখার মা তাকে স্নেহচ্ছায়া দিতে চেয়েছেন।
সূর্য ও শ্রীলেখাকে জড়িয়ে কানাঘুষো শুরু হবার পর তিনি প্রথম প্রথম এটাকে প্রবল ভাবে অস্বীকার করেছেন। প্রশ্রয়ের সুরে বলেছেন, ওরা তো ছেলেমানুষ, ওরা কি এসব কিছু বোঝে? সূর্য শ্রীলেখাকে যখন-তখন ডাকে, শ্রীলেখা সূর্যর ঘরেই দিনরাত পড়ে থাকে–এসবেও তিনি কোনও দোষ দেখতে পাননি। পিঠোপিঠি বয়সের ভাইবোন, ওদের মধ্যে যেমন ঝগড়াও বেশি হয়, ভাবও বেশি হয়।
কেউ যখন মনে করিয়ে দিয়েছে যে, সূর্য শ্রীলেখার আপন পিসতুতো ভাই নয়, এই সম্পর্কের মধ্যে অনেক গোলমাল আছে–তখনও তিনি বলেছেন, আহা, ওরা তো সে-সব জানে না। ওরা তো ভাইবোন বলেই জানে?
একদিন তার চোখে পড়েছিল, সূর্য শ্রীলেখাকে পাঁজাকোলে করে তুলে ধরেছে, শূন্যে ছুঁড়ে দেবার ভয় দেখাচ্ছে–আর শ্রীলেখা পড়ে যাব, পড়ে যাব বলে হাত-পা ছুড়ছে। সুর্য তাকে মাটিতে নামিয়ে দেওয়ার বদলে আরও কাছে এনে নিজের মুখটা ডুবিয়ে দিলে শ্রীলেখার বুকে।
এই ঘটনা ঘটেছিল একতলা ও দোতলার মাঝখানে সিঁড়িতে। একতলা থেকে উঠতে গিয়েও শ্রীলেখার মা থমকে দাঁড়িয়ে ছিলেন। দেখিনি দেখিনি ভাব করে চলে গিয়েছিলেন অন্যদিকে। মনকে বুঝিয়ে ছিলেন, ওরা তো অবোধ, ওরা তো বুঝেসুঝে কিছু করছে না। পাপ মনে করলেই পাপ। ব্যাপারটার মধ্যে গোপনীয়তার বিন্দুমাত্র চেষ্টা ছিল না বলেই তাতে পাপের স্পর্শ লাগেনি। তিনি ভেবেছিলেন, চোখে আঙুল দিয়ে ওদের এখন বুঝিয়ে দেওয়াটাই খারাপ হবে। দুদিন বাদে মেয়েটার বিয়ে হয়ে চলে যাবে অন্যের বাড়িতে–।
মা হয়েও তিনি মেয়েকে কখনও শাসন করেননি। আভাসে ইঙ্গিতে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন, শ্রীলেখাকে সব সময় অন্য কাজে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করেছেন। নিজের মেয়ে সম্পর্কে তার ভয় ছিল না, তার ভয় ছিল অন্যের নিন্দার। বিশেষ করে তার ছোট জা, অর্থাৎ বাদলের মা, বেশ নীতিবাগিশ! এমনিতে শ্রীলেখার মায়ের বেশ ঝগড়া করার অভ্যেস আছে, কিন্তু বাদলের মা এই প্রসঙ্গ তুললে যে তার ঝগড়া করারও মুখ থাকবে না!
শ্রীলেখার সঙ্গে সূর্যর মেলামেশা বন্ধ হয়েছিল প্রিয়রঞ্জনের হুকুমে। তাঁর চোখে কী পড়েছিল কে জানে, রাত্তিরবেলা তার স্ত্রীকে অত্যন্ত কড়া গলায় বলেছিলেন, তোমার। মেয়ে দিন দিন ধিঙ্গি হচ্ছে, তুমি দেখতে পাও না? সুয্যির সঙ্গে সব সময় ওর অত কী? বিয়ের যুগ্যি মেয়ে, পাঁচজন পাঁচ কথা বললে তোমার ভালো লাগবে? ও-ছেলেকে আমার মোটেই পছন্দ হয় না! ধরন-ধারণটাই অদ্ভুত!
সুপ্রভা তখন সূর্যর পক্ষ সমর্থন করেই বলেছিলেন, সূর্যর ব্যবহার তো চমৎকার, কোনও দিন মুখ তুলে কথাটি বলে না পর্যন্ত।
ওসব ওর শয়তানি! অজাত কুজাতকে কেউ কখনও বিশ্বাস করে?
সুপ্রভা তবু প্রতিবাদ করে বললেন, নিজের মেয়েকে ঘরে আটকে রাখতে চাও, রাখো, তা বলে সূর্যর দোষ দিয়ো না! ও কী জানে, কী বোঝে? মা-হারা ছেলে
এক একজন নারীর এ রকম বদ্ধমূল বিশ্বাস থাকে যে পুরুষ-ছেলেরা কখনও কোনও দোষ করে না। দোষ করলেও তা তাদের স্পর্শ করে না। যারা কষ্ট করে লেখাপড়া শেখে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে টাকা রোজগার করে সংসার চালায় তাদের কি এইসব ছোটখাটো দোষ ধরলে হয়!
প্রিয়রঞ্জন সাফ হুকুম দিয়ে রাখলেন, খুকিকে যেন কক্ষনও আর ওর সঙ্গে কথা বলতে না দেখি। এই আমি বলে দিলাম–।
সুপ্রভা বলেছিলেন, এক বাড়িতে থেকে কি আর একেবারে কথা না বলে থাকতে পারে? তুমি বরং তাড়াতাড়ি মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করো। বয়সও তো যোলো হয়ে গেল। আর দেরি করলে লোকে বলবে কী? এরপর কি আর পাত্তর পাওয়া যাবে!
সূর্য শ্রীলেখার হাত ধরে টেনে নিয়ে যাবার পর বাদলের মা হিমানী বললেন, দিদি, তুমি বারণ করলে না?
সুপ্রভা উত্তর না দিয়ে একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, কী আর বলব! ও ছেলে কি কারওর কথা শুনবে? তোরা যাই বলিস, ছেলেটার ষোলো না সতেরো বছর বয়স হয়েছে বটে, কিন্তু মনে মনে ও একেবারে শিশু!
হিমানী ঈষৎ কূটনৈতিক ভাবে বললেন, যাই বলো, ওর মতিগতি সুবিধের নয়। আমি তো আমার মেয়ের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করতে বারণ করে দিয়েছি!
সুপ্রভা বললেন, আমার মেয়ে আর ক’দিনই বা আছে! পাইকপাড়ার এক পাত্তর পক্ষ মোটামুটি রাজিই হয়ে গেছে। সোনা চাইছে তিরিশ ভরি, নগদ আড়াই হাজারের কম না–
সূর্য শ্রীলেখাকে নিজের ঘরে নিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, আমার চিরুনি কোথায়?
শ্রীলেখা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ঝাঁঝালো ভাবে উত্তর দিল, আমি তার কী জানি?
সূর্য চোখ গরম করে বলল, চিরুনি না থাকলে আমি চুল আঁচড়াব কী করে? খুঁজে দেখ!
শ্রীলেখা একটু খুঁজতেই আলমারির তলা থেকে পেয়ে গেল চিরুনিটা। কোনও কথা বলে সেটা বাড়িয়ে দিল সূর্যর দিকে। সূর্য সেটা নিল না, একদৃষ্টে শ্রীলেখার দিকে তাকিয়ে রইল। সে ধরেই নিয়েছিল, শ্রীলেখা তার চুল আঁচড়ে দেবে!
শ্রীলেখা সূর্যর চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, নাও!
সূর্য চিরুনিটা নিয়েই আয়নার দিকে মুখ ফেরাল। পাথরের মূর্তির মতন মুখ। চুল সুবিন্যস্ত করেও সে আয়নার সামনে থেকে সরে এল না।
শ্রীলেখা জিজ্ঞেস করল, আমি যেতে পারি?
হ্যাঁ, যেতে পারো। তার আগে আমার জিনিসটা দিয়ে যাও!
কোন জিনিসটা?
যেটা তোমার কাছে রাখা আছে!
শ্রীলেখার মুখখানা বিবর্ণ হয়ে গেল। নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করেও পারল না। ছুটে এসে সূর্যর বুকে গুমগুম করে কিল মেরে বলতে লাগল, তুমি কী! তুমি কিছু বোঝে না কেন! কেন বুঝতে পারো না!
সূর্য দেখল শ্রীলেখা কঁদছে। এতক্ষণ বাদে সূর্যর মুখে হাসি ফুটল। হাসবার সময় তার চোখদুটো জ্বলজ্বল করে। থুতনিতে আঙুল দিয়ে সে তুলে ধরল শ্রীলেখার ঘাম ও কান্নায় ভেজা মুখ। সূর্য শুধু ঘাম ও কান্নাই দেখল, দেখল না ভয়, দ্বিধা, অনুরাগ ও ব্রীড়ায় মেশা এক অদ্ভুত বর্ণ ছড়িয়ে আসে সেই মুখে।
স্নানের আগে চুল খুলেছে শ্রীলেখা। আঁচল আলুথালু। ব্রেসিয়ার তখনও তেমন চালু হয়নি বলে ব্লাউজের নীচে একটা কাপড়ের ফালি দিয়ে তার বুক বাঁধা। সেই বন্ধন থেকেও উপচে উঠেছে তার নতুন স্তন। সূর্যর চোখ গেল সেদিকে। হেঁটে ঝরনা পার হবার সময় মানুষ যেমন হঠাৎ রুপালি মাছ দেখতে পায় কিংবা রাস্তায় হঠাৎ কুড়িয়ে পায় সোনার আংটি, সূর্যর চোখে সেই ধরনের বিস্ময়। কোনও দ্বিধা না করে সে এক হাতে কোমর জড়িয়ে অন্য হাত রাখল শ্রীলেখার বুকে।
শ্রীলেখা চকিতে দরজার দিকে তাকিয়ে ছিটকে সরে এল। তীব্র চাপা গলায় বলল, কী হচ্ছে কী? তুমি–
সদা-গম্ভীর সূর্যর হাসিমাখা মুখখানা এখন সত্যিই শিশুর মতন। জ্ঞানোন্মেষের আগে শিশু যেমন আগুনে হাত দেয়, সেই ভাবে সূর্য এগিয়ে শ্রীলেখাকে আবার ধরল। কোনও রকম বাধা পাবার আগেই সে একটানে ছিঁড়ে ফেললে শ্রীলেখার বুকের জামা। বলল, আমি তোমার সবটা দেখব!
শ্রীলেখার মুখ থেকে সমস্ত রক্ত অন্তৰ্হিত। হাত দু’খানা বুকের কাছে জড়ো করে সে যেন মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছে, তার আর কথা বলারও ক্ষমতা নেই। ঘন ঘন শুধু তাকাচ্ছে সে দরজা ও জানলার দিকে। এদিকে কেউ এলে জানলা দিয়ে প্রথমে দেখা যাবে।
অরণ্যপ্রাণীর মতন সূর্য শ্রীলেখার কাঁধ ও বুকের কাছে মুখ এনে গন্ধ শুকতে লাগল। সে এখন খুবই উৎফুল্ল। তার বিমর্ষ গম্ভীর ভাবটি কোথায় মিলিয়ে গেছে। এখন একটা দারুণ খেলা পেয়ে গেছে সে।
একটুক্ষণের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিয়ে শ্রীলেখা দূরে সরে গেল। আঁচলটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, আমি আর তোমার সঙ্গে কোনও দিন কথা বলব, না! তুমি এ রকম?
অবিকল দেড়-দু’বছরের বাচ্চার মতন হি হি করে হেসে সূর্য বলল, কেন, কী করেছি? আমি তো শুধু সবটা দেখতে চেয়েছি!
শ্রীলেখা আর কোনও কথা না বলে চলে যাচ্ছিল, সূর্য দরজা আটকে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল, কেন, কী হয়েছে কী? আমারও তো খালি গা!
আমি তোমার সঙ্গে আর একটাও কথা বলতে চাই না।
সূর্য একটুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, হাসি মুছে গেল মুখ থেকে, আবার ভুরু কুঁচকে গেল। কোনও ব্যাপার সে পুরোপুরি বুঝতে পারলেই এ রকম হয়। দরজা ছেড়ে দিয়ে বলল, শোন, আমি এক্ষুনি খেয়ে নিয়ে বেরোব। আমার জিনিসটা আমাকে দিয়ে যা!
শ্রীলেখা সূর্যর পাশ দিয়ে গলে গিয়ে দরজার বাইরে দাঁড়াল। তারপর জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবে? জিনিসটা দিয়ে কী হবে?
দরকার আছে। শিগগির নিয়ে আয়।
ওটা আমি দেব না।
হরকুমারের নির্দেশ ছিল, রিভলবারটা সূর্যর নিজের কাছে রাখা চলবে না। যে-কোনও সময় পুলিশ তাকে সার্চ করতে পারে যদি হরকুমারের সঙ্গে তার যোগাযোগের সন্ধান পায়। সেই জন্যই বিশ্বস্ত কারওর কাছে জমা রাখার কথা। এ-পর্যন্ত শ্রীলেখাই ছিল সূর্যর কাছে একমাত্র বিশ্বস্ত আপনজন।
রিভলবারটা রাখার সময় শ্রীলেখা ভয় পেয়েছিল, নিজের জন্য নয়, সূর্যর জন্য। এ-ধরনের সাংঘাতিক জিনিস নিয়ে সূর্য নাড়াচাড়া করে–একথা সে ভাবতেই পারেনি। ওইটুকু বয়সের অভিজ্ঞতায় সে বুঝেছে, এসব জিনিস যাদের কাছে থাকে তাদের নিজেদের প্রাণই যে-কোনও সময় বিপন্ন হতে পারে। নিরস্ত্র লোকেরাও বিপদে পড়তে পারে কিন্তু তার চেয়েও বেশি প্রাণের ঝুঁকি থাকে সশস্ত্র মানুষের। শ্রীলেখা তখনই ঠিক করেছিল, সূর্যকে ওটা কখনও ফেরত দেবে না।
সূর্য এক ধমক দিয়ে বলল, যা এক্ষুনি, নিয়ে আয়!
শ্রীলেখা স্থির ভাবে উত্তর দিল, ওটা আমার কাছে নেই। আমি ফেলে দিয়েছি।
সূর্য আর দ্বিরুক্তি করল না, খপ করে শ্রীলেখার টুটি চেপে ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, কী? কোথায় ফেলে দিয়েছিস?
শ্রীলেখা এবার ভয় পেল না। আবার দরজা পেরিয়ে ঘরে ঢুকল। সূর্যর গায়ের সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দিয়ে বলল, মারবে আমাকে? মারো! আমি দেব না!
ছেঁড়া জামা ও আঁচল ভেদ করে ফুটে উঠেছে শ্রীলেখার নবোদ্ভিন্ন বুক, তার সুকুমারী শরীরখানি এখন সূর্যের আয়ত্তের মধ্যে। কিন্তু সূর্যর আর সেদিকে মনোযোগ নেই। দারুণ উৎকণ্ঠিত ভাবে সে বলল, আমাকে একটু বাদেই যেতে হবে। শ্রীলেখা, কী করছিস কী ছেলেমানুষি?
কোথায় যাবে?
যেখানেই যাই না কেন—
আমাকে বলবেনা! আমি যদি ওটা না দিই, তুমি কী করতে পারো? চাচামেচি করবে? সূর্য এটুকু অন্তত বোঝে, চঁচামেচি করে কোনও সুবিধে হবে না। ওই জিনিসটার কথা সবাইকে জানানোর প্রশ্নই ওঠে না। সূর্য যেন একটা ফাঁদে পড়েছে–এই রকম অসহায় বোধ করল। এর আগে তার একবারও মনে হয়নি, শ্রীলেখার কাছ থেকে রিভলবারটা আদায় করা এত কঠিন হবে। এ-পর্যন্ত শ্রীলেখাকে সে যা হুকুম করেছে, সবই শুনেছে। হঠাৎ তার ব্যবহার একেবারে অন্য রকম। কিন্তু খানিকটা বাদেই তাকে তৈরি হয়ে যেতে হবে হাওড়া স্টেশনে-সে যদি যেতে না পারে, তাকে কাপুরুষ বলবে সবাই! হরকুমারের আত্মা তাকে অভিশাপ দেবে না?
সূর্য দাতে দাঁত ঘষে বলল, না দিলে তোকে মেরে ফেলব!
মেরে ফ্যালো, তা হলেও ওটা পাবে না!
শ্রীলেখার চুল মুঠো করে ধরে সূর্য বলল, তুই আমাকে চিনিস না! আমি সত্যিই মেরে ফেলতে পারি!
শ্রীলেখা বলল, তুমি ওটা নিয়ে অন্য কারোকে মারতে যাবে তো? তার বদলে আমাকেই মারো।
সূর্য কখনও যা করে না, নরম হয়ে অনুনয় করে বলল, শ্রীলেখা, প্লিজ! গিভ মি ব্যাক মাই গান। এটা ছেলেখেলা না!
সূর্যদা, তুমি কেন মরতে চাইছ?
আমি মরব কেন? মরা অত সহজ নয়!
কিন্তু এতে তোমার কোনও বিপদ নেই?
কিছু না! আমার কিছু হবে না। আমি ঠিক ফিরে আসব।
আমি যদি তোমার ওটা না দিই? সূর্য শ্রীলেখার চুল ছেড়ে দিল। আলনার কাছে জামা পরবার জন্য গিয়ে অত্যন্ত শক্ত গলায় বলল, তা হলে আমি এক্ষুনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি। আর কোনও দিন ফিরব না। আমাকে তোরা আর কখনও দেখতে পাবি না!