শেষ কথা
তারপর অনেকদিন পার হয়ে গেছে। অনেকদিন। অনেক অনেকদিন। না, আমি রাশেদকে ভুলি নি। কখনো ভুলব না। আমি কথা দিয়েছিলাম তাকে ভুলব না— কথা না দিলেও ভুলতাম না। রাশেদের মত একজনকে কি এত সহজে ভোলা যায়?
আমার যখন খুব মন খারাপ হয় তখন আমি রাশেদের সাথে কথা বলি। চোখ বন্ধ করলেই রাশেদ আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। আমি বড় হয়ে গেছি। কিন্তু রাশেদ বড় হয়নি। এইটুকু ছোটই আছে। রাশেদ যখন আমার সামনে এসে দাঁড়ায় তখন আমিও তার মত ছোট হয়ে যাই। আমি বলি, এই রাশেদ।
কি হল?
কেমন আছিস তুই?
ভাল।
তোর চুলের এই অবস্থা কেন? মনে হয় পাখির বাসা!
রাশেদ হেসে তার আঙুল দিয়ে চুলগুলি ঠিক করার চেষ্টা করে, কোন লাভ হয় না। আরো বেশি এলোমেলো হয়ে যায়! আমি বললাম, শফিক ভাইয়ের বিয়ে, জানিস?
জানি।
তুই কেমন করে জানিস?
রাশেদ দুলে দুলে হাসে, আমি সব জানি। সব খবর আসে আমার কাছে!
কাকে বিয়ে করছেন জানিস?
হিঃ হিঃ হিঃ! কাকে আবার, অরু আপাকে!
হ্যাঁ, আমি মাথা নেড়ে বললাম, আমি যখন ছোট ছিলাম তখন সব সময় অরু আপা কিভাবে আমাকে জ্বালাতন করত। জানিস?
জানি।
বলত আমাকে বিয়ে করবে!
রাশেদ আবার হিঃ হিঃ করে হেসে বলে, এখন গিয়ে জিজ্ঞেস করিস না কেন? হিঃ। হিঃ হিঃ —
রাশেদ জানিস অরু আপা আমাকে কি বলেছে?
কি?
বলেছে বিয়ের পর তাদের যখন বাচ্চা হবে। যদি ছেলে হয় নাম রাখবে রাশেদ। রাশেদ হাসান।
সত্যি? রাশেদ হঠাৎ খুব খুশি হয়ে উঠে, আবার জিজ্ঞেস করে, সত্যি?
হ্যাঁ, সত্যি। আমি ভেবেছিলাম। আমিও তাই করব।
কি করব?
আমি যখন বড় হব, আমার যখন বিয়ে হবে, বাচ্চা হবে। আমার ছেলের নাম রাখব রাশেদ। কি বলিস?
রাশেদ মিটমিট হেসে বলল, তুই আর একটা কাজ কর।
কি কাজ?
তোর বাচ্চার নাম রেখে দিস লাড্ডু।
তারপর রাশেদ হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে থাকে।
একটু পর আবার আমি তাকে ডাকলাম, এই রাশেদ।
কি? তোকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস কবি? কি?
তোকে- তোকে যখন গুলী করছিল, তোর কি ব্যথা লেগেছিল?
রাশেদ তখন কেমন জানি চুপ করে যায়। কেমন জানি দুঃখী-দুঃখী লাগতে থাকে তাকে। মাথা নিচু করে বলল, হ্যাঁ।
অনেক ব্যথা লেগেছিল, অনেক?
রাশেদ আবার মাথা নাড়ে। তারপর আস্তে আস্তে বলে, ব্যথা থেকে বড় কি জিনিস জানিস?
কি?
ঠিক যখন বুঝতে পারলাম মরে যাব সে সময়টা। আমার সামনে রাজাকারগুলি দাঁড়িয়ে আছে রাইফেল তুলে, পিছনে আজরফ আলী, একজন আজরফ আলীকে বলল, হুজুরা ছেড়ে দেন, এইটুকু বাচ্চা। অজরাফ আলী চিৎকার করে বলল, সাপের বাচ্চা বড় হয়ে সাপই হয়। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কলমা পড় – তখন হঠাৎ আমার বুকের ভিতরে যে ফাঁকা-ফাঁকা লাগতে থাকে সেই অনুভূতিটা। মনে হয়, আহা! এই যে পৃথিবী, আকাশ-বাতাস, নদী, গাছ-পালা আর আমি দেখব না। কোনদিন দেখব না। কোনোদিন–
রাশেদ, আমি ধরা গলায় বললাম, আর বলিস না রে। বড় কষ্ট লাগছে।
ঠিক আছে বলব না। রাশেদ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কিন্তু আর যেন কখনো এরকম না হয়, কখনো যেন না হয়।
পূর্ব আমি আস্তে আস্তে বলি, না, হবে না।
রাশেদ তখন আস্তে আস্তে হেঁটে চলে যেতে থাকে। আমার থেকে মুখ আড়াল করে রেখেছে। কিন্তু আমি জানি তার চোখে পানি। অভিমানের পানি। এই পৃথিবীর উপর অভিমান। পৃথিবীর মানুষের উপর অভিমান।
রাশেদ, তুই কাঁদিস না প্লীজ।
Mon kapiye deoa kichu golpo jegulur mddhe eti ekti