এই একটি দিন। শুধু একটি দিনের জন্যই দেবু, কেবল দেবুই দেখিল—শিবকালীপুরের অদ্ভুত এক রূপ। শুধু রূপ নয়, তাহার স্পর্শ তাহার স্বাদ সবই একটি দিনের জন্য দেবুর কাছে মধুময় হইয়া দেখা দিল। পরের দিন হইতে কিন্তু আবার সেই পুরনো শিবকালীপুর। সেই দীনতাহীনতা, হিংসায় জর্জর মানুষ, দারিদ্র্য-দুঃখ-রোগপ্ৰপীড়িত গ্রাম। কালও গ্রামখানির গাছপালাপাতা-ফল-ফুলের মধ্যে যে অভিনব মাধুর্য দেবুর চোখে পড়িয়াছিল, নাবি আমের মুকুলের গন্ধে সে যে তৃপ্তি অনুভব করিয়াছিল, আজ তাহার কিছুই সে অনুভব করি না।
আপনার দাওয়ায় বসিয়া সে ভাবিতেছিল অনেক কথা—এলোমেলো বিচ্ছিন্ন ধারায়। প্রথমেই মনে হইল গ্রামখানার সর্বাঙ্গে যেন ধুলা লাগিয়াছে! পথ কয়টায় এক-পা গভীর হইয়া ধূলা জমিয়াছে। ডোবার পুকুরের জল মরিয়া আসিয়াছে, অল্প জলে পানাগুলা পচিতে আরম্ভ করিয়াছে। গ্রামে জলের অভাব দেখা দিল। গরু বাছুর গাছপালা লইয়া জলের জন্য বৈশাখজ্যৈষ্ঠে আর কষ্টের সীমা-পরিসীমা থাকিবে না। বাড়িতে অনেকগুলি গাছ হইয়াছে, দৈনিক জলের প্রয়োজন হইবে।
আর গাছ লাগাইয়াই বা ফল কি? তাহার বাড়ির যে কুমড়ার লতাটি প্রাচীর ভরিয়া উঠিয়াছে, সেই গাছটায় কয়টা কুমড়া ধরিয়াছিল, তাহার মধ্যে তিনটা কুমড়া কাল রাত্রে কে ছিঁড়িয়া লইয়া গিয়াছে। তাহার বাড়ির রাখাল ছোঁড়াটা গাছটা পুঁতিয়াছিল-সে তারস্বরে চিৎকার করিয়া গালি দিতেছে অজ্ঞাতনামা চোরকে।
ছোঁড়া আবার মাহিনা-কাপড়ের জন্য ব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছে। বিলুরও কাপড় ছিঁড়িয়াছে। নিজেরও চাই। যেমন করে পর কাপড় চৈতে হবে কানি-কথাটা মিথ্যে নয়। কিন্তু কি করিবে? পোস্ট আপিসে সঞ্চয়ের টাকাগুলির আর কিছু অবশিষ্ট নাই।
চিন্তাটা ছিন্ন হইয়া গেল। কোথায় যেন একঘেয়ে চিৎকার উঠিতেছে। কোথায় কাহারা উচ্চ-কর্কশকণ্ঠে যেন গালিগালাজ করিতেছে, কাহাদেরও ঝগড়া বাঁধিয়াছে; সম্ভবত একটা কণ্ঠস্বর রাঙাদিদির! বুড়ির আবার কাহার সঙ্গে কি হইলঃ বিলুকেই সে প্রশ্ন করিল, রাঙাদিদি কার সঙ্গে লাগল বল তো?
বিলু হাসিয়া বলিল লাগে নি কারু সঙ্গে। বুড়ি গাল দিচ্ছে নিজের বাপকে আর দেবতাকে। আজকাল রোজ সকালে উঠে দেয়। বুড়ো হয়েছে, একা কাজকর্ম করতে কষ্ট হয়, সকালে উঠে তাই রোজ ওই গাল দেবে। বাপকে গাল দেয়—বাশ-বুকো রাক্কোস, জমিজেরাতগুলো সব নিজে পেটে পুরে গিয়েছে, আর দেবতাকে গাল দেয় চোখ-খেগো, কানা হও তুমি।
দেবু হাসিল; তারপর বলিল—কিন্তু আরও একজন যে গাল দিচ্ছে। কাসার আওয়াজের মত অল্পবয়সী গলা!
–ও পদ্ম, কামার-বউ!
–অনিরুদ্ধের বউ?
–হ্যাঁ। বোধহয় আমাদের ভাসুরপো–মানে শ্রীহরিকে গাল দিচ্ছে। মধ্যে মধ্যে অমন দেয়। আজও দিচ্ছে বোধহয়। মাঝখানে তো পাগলের মত হয়ে গিয়েছিল। এখন একটুকু ভাল। ওদিকে কর্মকার তো একরকম কাজের বার হয়ে গেল। এক একদিন মদ খেয়ে যা করে। একটা লোহার ডাণ্ডা হাতে করে বেড়ায়, আর চেঁচায়—খুন করেঙ্গা। যার-তার বাড়িতে খায়।
—মানে দুর্গার বাড়িতে তো?
–হ্যাঁ!
–ছি! ছিঃ ছি! দুর্গার ওই দোষটা গেল না। ওই এক দোষেই ওর সব গুণ নষ্ট হয়েছে।
বিলু বলিল–মদ খেয়ে মাতাল হয়ে খেতে দে খেতে দে করে হাঙ্গামা করলে দুর্গা আর কি করবে বল? অবিশ্যি কিছুদিন দুর্গার ঘরে রাত কাটাত কর্মকার। কিন্তু আজকাল দুর্গা তো রাত্রে ঘরে ঢুকতে দেয় না। কামার তবু পড়ে থাকে ওদের উঠানে, কোনোদিন বাগানে, কোনোদিন রাস্তায়, কোনোদিন অন্য কোথাও।
–হ্যাঁ, আজকাল অনিরুদ্ধের তো পয়সা-কড়ি নাই। দুর্গা আর–
–না-না-না, তা বোলো না। দুর্গা কোনোদিনই পয়সা নেয় নাই কর্মকারের কাছে। ও-ই বরং দুটাকা চার টাকা করে দিয়েছে মধ্যে মধ্যে। আমার হাতে দিয়ে বলেছে—বিলু-দিদি, তুমি কামার-বউকে দিয়ো, আমি দিলে তো নেবে না!
–ছিঃ! তুমি ওইসব জঘন্য ব্যাপারের মধ্যে গিয়েছিলে?
বিলু কিছুক্ষণ নতমুখে থাকিয়া বলিল—কি করব বল, কামার-বউ তখন ক্ষ্যাপার মত হাঁড়ি চড়ে না। খেতে পায় না। পদ্মও না, কর্মকারও না। আমার হাতেও কিছুই ছিল না যে দোব। একদিন দুর্গা এসে অনেক কাকুতি-মিনতি করে বললে। কি করব বল!
—হুঁ। দেবুর একটা কথা মনে পড়িল। নজরবন্দির জন্য অনিরুদ্ধের ঘর দুর্গাই তো দারোগাকে বলে ভাড়া করিয়ে দিয়েছে শুনলাম।
তা সে অনেক পরের কথা। একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল হ্যাঁ, নজরবন্দি ছেলেটি বড় ভাল, বাপু। কামার-বউকে মা বলে। গায়ের ছেলেরাও ওর কাছে ভিড় জমিয়ে বসে থাকে।
—বস তুমি। আমি আসি একবার যতীনবাবুর সঙ্গেই দেখা করে।
পথে চণ্ডীমণ্ডপ হইতে ডাকিল শ্ৰীহরি। সেখানেও চারপাশে একটি ছোটখাটো ভিড় জমিয়া রহিয়াছে। দেবু অনুমানে বুঝিল, খাজনা আদায়ের পর্ব চলিতেছে। চৈত্র মাসের বারই-তেরই, ইংরাজি আটাশে মার্চ সরকার-দপ্তরে রাজস্ব দাখিলের শেষ দিন। তা ছাড়া চৈত্র-কিস্তি, আখেরি।
দেবু বলিল–ওবেলা আসব ভাইপো।
শ্ৰীহরি বলিল—সঁচ মিনিট। গ্রামের ব্যাপারটা দেখে যাও। যেন অরাজক হয়েছে।
দেবু উঠিয়া আসিল। দেখিল বৈরাগীদের নেলো অর্থাৎ নলিন হাত জোড় করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। ও-পাশে তাহার মা কাঁদিতেছে।
শ্ৰীহরি বলিলই দেখ, ছোঁড়ার কাও দেখ। আঙুল দিয়া সে দেখাইয়া দিল চণ্ডীমণ্ডপের চুনকাম-করা একটি থাম। সেই চুনকাম-করা থামের সাদা জমির উপর কয়লা দিয়া অ্যাঁকা এক বিচিত্র ছবি। মা-কালীর এক মূর্তি।
দেবু নেলোকে জিজ্ঞাসা করিলা রে, তুই এঁকেছিস?
নেলো ঘাড় নাড়িয়া সায় দিয়া উত্তর দিল—হ্যাঁ।
—চুনকাম-করা চণ্ডীমণ্ডপের উপর কি করেছে একবার দেখ দেখি?
–পট এঁকেছেন।
ইহার পর নেলোকেই সে বলিল—চুনকামের খরচা দে, দিয়ে উঠে যা!
দেবু তখনও ছবিখানি দেখিতেছিল—বেশ অ্যাঁকিয়াছিল নেলো। তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলকার কাছে অ্যাঁকতে শিখলি তুই?
নেলো রুদ্ধস্বরে কোনোমতে উত্তর দিল—আপুনি আপুনি, আজ্ঞে।
–নিজে নিজে শিখেছিস?
শ্ৰীহরি এই প্রশ্নের উত্তর দিল–হ্যাঁ, হ্যাঁ। ছোঁড়ার ওই কাজ হয়েছে, বুঝলে কিনা! লোকের দেওয়ালে, সিমেন্টের উঠানে, এমনকি বড় বড় গাছের গায়ে পর্যন্ত কয়লা দিয়ে ছবি অ্যাঁকবে। তারপর ওই নজরবন্দি ছোকরা ওর মাথা খেল! অনিরুদ্ধের বাইরের ঘরে ছোকরা থাকে, দেখো না একবার তার দেওয়ালটা একেবারে চিত্ৰি-বিচিত্রে ভর্তি। এখন চণ্ডীমণ্ডপের উপর লেগেছে। কাল দুপুরবেলায় কাজটি করেছে।
দেবু হাসিয়া বলিল—নেলো অন্যায় করেছে বটে, কিন্তু এঁকেছে ভাল, কালীমূর্তিটি খাসা হয়েছে।
–নমস্কার, ঘোষমশায়! ওদিকের সিঁড়ি দিয়া পথ হইতে উঠিয়া আসিল ডেটিনিউ যতীন। দেবুকে দেখিয়া সে বলিল এই যে আপনিও রয়েছেন দেখছি! আপনার ওখানেই যাচ্ছিলাম।
—আমিও যাচ্ছিলাম আপনার কাছেই।
–দাঁড়ান, কাজটা সেরে নি। ঘোষমশায়, ওই মাথাট য় কলি ফেরাতে কত খরচ হবে?
শ্ৰীহরি বলিলখরচ সামান্য কিছু হবে বৈকি। কিন্তু কথা তো তা নয়, কথা হচ্ছে নেলোকে শাসন করা।
হাসিয়া যতীন বলিল—আমি দুজনকে জিজ্ঞেস করলাম, তারা বললেন—চুন চার আনা, একটা রাজমিস্ত্রির আরোজের মজুরি চার আনা, একটা মজুরের আধরোজ দু আনা। মোট এই দশ আনা, কেমন?
–হ্যাঁ। তবে পাটও কিছু লাগবে পোচড়ার জন্যে।
—বেশ, সেও ধরুন দু আনা। এই বার আনা। একটি টাকা বাহির করিয়া যতীন শ্রীহরির সম্মুখে নামাইয়া দিয়া বলিলবাকিটা আমায় পাঠিয়ে দেবেন।
সে উঠিয়া পড়িল। দেবুও সঙ্গে সঙ্গে উঠিল। যতীন হাসিয়া বলিল-আমার ওখানেই আসুন, দেবুবাবু। নলিনের অ্যাঁকা অনেক ছবি আছে, দেখবেন। এস নলিন—এস।
শ্ৰীহরি ডাকিল—খুড়ো, একটা কথা!
দেবু ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল–বল।
–একটু এধারে এস বাবা। সব কথা কি সবার সামনে বলা চলে?
শ্ৰীহরি হাসিল। ষষ্ঠীতলার কাছে নির্জনে আসিয়া শ্ৰীহরি বলিলগতবার চোত-কিস্তি থেকেই তোমার খাজনা বাকি রয়েছে, খুড়ো। এবার সমবৎসর। কিস্তির আগেই একটা ব্যবস্থা কোরো বাবা।
দেবুর মুখ মুহুর্তে অপ্রসন্ন হইয়া উঠিল! গতকালের কথা তাহার মনে পড়িল! বোধ হইল, শ্ৰীহরি তাহাকে শাসাইতেছে। সে সংযত স্বরে বলিল-আচ্ছা, দেব। কিস্তির মধ্যেই দোব।
***
উনিশ শো চব্বিশ খ্রিস্টাব্দে বিশেষ ক্ষমতাবলে ইংরেজ সরকারের প্রণয়ন করা আইন আটক-আইন। নানা গণ্ডিবন্ধনে আবদ্ধ করিয়া বিশেষ থানার নিকটবর্তী পল্লীতে রাজনৈতিক অপরাধ-সন্দেহে বাঙালি তরুণদের আটক রাখার ব্যবস্থা হইয়াছিল। বাংলা সরকারের সেই আটক-আইনের বন্দি যতীন। যতীনের বয়স বেশি নয়, সতের-আঠার বৎসরের কিশোর, যৌবনে সবে পদার্পণ করিয়াছে। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ রঙ, রুক্ষ বড় বড় চুল, ছিপছিপে লম্বা, সর্বাঙ্গে একটি কমনীয় লাবণ্য; চোখ দুটি ঝকঝকে, চশমার আবরণের মধ্যে সে দুটিকে আরও আশ্চর্য দেখায়।
অনিরুদ্ধের বাহিরের ঘরের বারান্দায় একখানা তক্তপোশ পাতিয়া সেইখানে যতীন আসর করিয়া বসে। গ্রামের ছেলের দল তো এইখানেই পড়িয়া থাকে। বয়স্কেরাও সকলেই আসে তারা নাপিত, গিরিশ ছুতার, গাঁজাখোর গদাই পাল, বৃদ্ধ দ্বারকা চৌধুরীও আসেন। সন্ধ্যার পর দোকান বন্ধ করিয়া বৃন্দাবন দত্তও আসে; মজুর খাঁটিয়া কোনোরূপে বাঁচিয়া আছে তারিণী পাল—সেও আসিয়া চুপ করিয়া বসিয়া থাকে। কোনো কোনো দিন শ্রীহরিও পথে যাইতেআসিতে এক-আধবার বসে। বাউরিপাড়া-বায়েনপাড়ার লোকেরাও আসে। গ্রাম্যবধূ ও ঝিউড়ি মেয়েগুলি দূর হইতে তাহাকে দেখে। বুড়ি রাঙাদিদি মধ্যে মধ্যে যতীনের সঙ্গে কথা বলে। কোনোদিন নাড়ু, কোনোদিন কলা, কোনোদিন অন্য কিছু দিয়া সে যতীনকে দেখিয়া আপন মনেই পঁচালির একটি কলি আবৃত্তি করে–
অঙ্কুর পাষাণ হিয়া, সোনার গোপালে নিয়া
শূন্য কৈল যশোদার কোল।
যতীনও মধ্যে মধ্যে আপনার মনে গুনগুন করিয়া আবৃত্তি করে–রবীন্দ্রনাথের কবিতা।
দুইটা লাইন এই পল্লীর মধ্যে তাহার অন্তরীণ জীবনে অহরহ গুঞ্জন করিয়া ফেরে–
সব ঠাঁই মোর ঘর আছে…
ঘরে ঘরে আছে পরমাত্মীয়…
সমগ্র বাংলাদেশ যেন এই পল্লীটির ক্ষুদ্র আয়তনের মধ্যে রূপায়িত হইয়া ধরা দিয়াছে তাহার কাছে। এখানে পদার্পণমাত্র গ্রামখানি এক মুহুর্তে তাহার আপন ঘরে পরিণত হইয়া উঠিয়াছে। এখানকার প্রতিটি মানুষ তাহার ঘনিষ্ঠতম প্রিয়জন, পরমাত্মীয়। কেমন করিয়া যে এমন হইল—এ সত্য তাহার কাছে এক পরমাশ্চর্য। শহরের ছেলে সে, কলিকাতায় তাহার বাড়ি। জীবনে পল্লীগ্রাম এমন করিয়া কখনও দেখে নাই। আটক-আইনে গ্রেপ্তার হইয়া প্রথমে কিছুদিন ছিল জেলে। তারপর কিছুদিন ছিল বিভিন্ন জেলার সদরে মহকুমা শহরে। এই মহকুমা শহরগুলি অদ্ভুত। সেখানে পল্লীর আভাস কিছু আছে, কিছু কিছু মাঠঘাট আছে, কৃষি এখনও সেখানকার জীবিকার একটা মুখ্য বা গৌণ অংশ; ক্ষুদ্ৰ ক্ষুদ্ৰ সমাজও আছে। ঠিক সমাজ নয়–দল। সমাজ ভাঙিয়া শিক্ষা, সম্মান ও অর্থবলের পার্থক্য লইয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে পরিণত হইয়াছে। সঙ্কীর্ণ, আত্মকেন্দ্রিক, পরস্পরের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ। সেখানে পল্লীর আভাস তৈলচিত্রের রঙের প্রলেপ অবলুপ্ত কাপড়ের আভাসের মতই—অস্পষ্ট ইঙ্গিতে আছে। স্পষ্ট প্রভাব নাই প্রকাশ নাই।
তাই একেবারে খাঁটি পল্লীগ্রামে অন্তরীণ হইবার আদেশে সে অজানা আশঙ্কায় বিচলিত হইয়াছিল। কিন্তু প্রত্যক্ষ পরিচয় লাভে সে আশ্বস্ত হইয়াছে। সর্বত্র একটি পরমাশ্চর্য স্নেহস্পর্শ অনুভব করিয়াছে। অবশ্য এখানকার দীনতা, হীনতা, কদর্যতাও তাহার চোখ এড়ায় নাই। অশিক্ষা তো প্রত্যক্ষভাবে প্রকটিত। কিন্তু তবু ভাল লাগিয়াছে। এখানে মানুষ অশিক্ষিত অথচ শিক্ষার প্রভাবশূন্য অমানুষ নয়। অশিক্ষার দৈন্যে ইহারা সঙ্কুচিত, কুশিক্ষা বা অশিক্ষার ব্যর্থতার দম্ভে দাম্ভিক নয়। শিক্ষা এখানকার লোকের না থাক, একটা প্রাচীন জীর্ণ সংস্কৃতি আজও আছে, অবশ্য মুমূর্ষর মতই কোনোমতে টিকিয়া আছে। কিন্তু তাহারও একটা আন্তরিকতা আছে।
শহরকে সে ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে। ওইখানেই তো চলিয়াছে মানুষের জয়যাত্রা। কিন্তু সে—মফস্বলের ওই উকিল-মোক্কার-আমলাসর্বস্ব, কতকগুলা পান-বিড়ি-মনিহারী দোকানদার, ক্ষুদ্ৰ চালের কলওয়ালা, তামাকের আড়ওয়ালা ও কাপড়ওয়ালাদের দলপ্রধান ছোট শহর নয়। সে শহরের ঊর্ধ্বলোকে শত শত কলকারখানার চিমনি উদ্যত হইয়া আছে তপস্বীর উর্ধ্ববাহুর। মত। অবিশ্বাস্য অপরিমেয় তাহাদের শক্তি। বন্দি দানবের মত যন্ত্রশক্তির মধ্য দিয়া সে শক্তির ক্ৰিয়া চলিতেছে। উৎপাদন করিতেছে বিপুল সম্পদ-সম্ভার। কিন্তু তবু মরণোখ পল্লীকে তাহার ভাল লাগিয়াছে। বিগত যুগের মুমূর্ষ প্রাচীন, যাহার সঙ্গে নব যুগের পার্থক্য অনেক,-সেই মুমূর্ষ প্রাচীনের সকরুণ বিদায় সম্ভাষণ যেমন নবীনকে অভিভূত করে, তেমনি এই মরণোন্মুখ প্রাচীন সংস্কৃতির আপ্যায়নও তাহার কাছে বড় সকরুণ ও মধুর বলিয়া মনে হইতেছে।
অনিরুদ্ধের বারান্দায় পাতা তক্তপোশের উপর যতীন দেবুকে বসাইল—বসুন। আপনার সঙ্গে আলাপ করার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে আছি।
দেবু হাসিয়া বলিল—কাল তো বললেন—আলাপ হয়ে গিয়েছে।
–তা সত্যি। এইবার আলোচনা হবে। দাঁড়ান, তার আগে একটু চা হোক। বলিয়া সে অনিরুদ্ধের বাড়ির ভিতরের দরজায় দাঁড়াইয়া ডাকিল মা-মণি!
মা-মণি তাহার পদ্ম। মা-মণিটি তার জীবনে বিষামূতের সংমিশ্রণে গড়া এক অপূর্ব। সম্পদ। তাহার বিষের জ্বালা—অমৃতের মাধুর্য এত তীব্ৰ যে, তাহা সহ্য করিতে যতীন হাঁপাইয়া ওঠে। তাহার সঙ্গে পদ্মের বয়সের পার্থক্যও বেশি নয়, বোধহয় পাঁচ-সাত বৎসরের। তবু সে তার মা-মণি। এক এক সময়ে যতীনের মনে পড়ে তাহার ছেলেবেলার কথা। খেলাঘরে তাহার দিদি সাজিত মা, সে সাজিত ছেলে। প্রাপ্তবয়সে সেই খেলার যেন পুনরাবৃত্তি ঘটিতেছে। সে যখন এখানে আসে তখন পদ্ম প্রায় অর্ধোন্মাদ। মধ্যে মধ্যে মূৰ্ছারোগে চেতনা হারাইয়া উঠানে, ধূলামাটিতে অসংবৃত অবস্থায় পড়িয়া থাকিত। অনিরুদ্ধ তাহার পূর্ব হইতেই বাউণ্ডুলে, ভবঘুরে, বাড়িতে থাকিত না। যতীনকেই অধিকাংশ সময় চোখেমুখে জল দিতে হইত। তখন হইতেই যতীন ডাকে মা বলিয়া। মা ছাড়া আর কোনো সম্বোধন সে খুঁজিয়া পায় নাই। সেই মা। সম্বোধনের উত্তরেই পদ্ম একদিন প্রকৃতিস্থ হইয়া তাহাকে ডাকিল ছেলে বলিয়া। সেই হইতেই এই খেলাঘর পাতা হইয়াছে। পদ্ম এখন অনেকটা সুস্থ, অহরহ ছেলেকে লইয়াই ব্যস্ত। অনিরুদ্ধের ভাবনা সে যেন ভাবেই না। কৃচিৎ কখনও আসিলে তাহাকে যত্নও বিশেষ করে না।
বাড়ির ভিতর তখন কলরব চলিতেছে। একপাল ছেলে হুটোপাটি ছুটোছুটি করিয়া বেড়াইতেছিল। পদ্ম একজনের চোখ গামছায় বাঁধিয়া বলিতেছিল—ভাত করে কি?
—টগ্-বগ্! ছেলেটি উত্তর দিল।
–মাছ করে কি?
–ছ্যাঁক-ছোঁক।
–হাঁটে বিকোয় কি?
–আদা।
–তবে ধরে আন, তোর রাঙা রাঙা দাদা।
কানামাছি খেলা চলিতেছে। যতীনের কাছে ছেলের দল আসে। যতীন না থাকিলে তাহারা পদ্মকে লইয়া পড়ে। পদ্মও যতীনের অনুপস্থিতিতে ছেলেদের খেলার মধ্যে বুড়ি সাজিয়া বসে।
যতীন আবার ডাকিল মা-মণি!
পদ্ম উঠিয়া পড়িল,-কি? চাদ-চাওয়া ছেলের আমার আবার কি হুকুম শুনি?
–চায়ের জল গরম আর একবার।
–হবে না। মানুষ কতবার চা খায়?
–দেবু ঘোষ মশায় এসেছেন। চা খাওয়াতে হবে না?
–পণ্ডিত?
–হ্যাঁ।
পদ্ম এক হাতে ঘোমটা টানিয়া দিলচাপা গলায় বলিল—দি।
যতীন হাসিয়া বলিলপণ্ডিত বাইরে! ঘোমটা দিচ্ছ কাকে দেখে?
–ওই দেখ, তাই তো!
ঘোমটা সরাইয়া দিয়া পদ্ম অপ্রস্তুতের মত একটু হাসিল।
বাহিরে আসিয়া যতীন দেবুকে বলিল—আপনার নামে একটা ভিপি আনতে দেব আমি।
দেবু একটু বিব্রত বোধ করিল।বেনামীতে ভি-পি, কিসের ভি-পি?
–হ্যাঁ, খানকয়েক ছবির বই, একটা রঙতুলির বাক্স। আমাদের নলিনের জন্য। পুলিশের মারফত আনানোর অনেক হাঙ্গামা। নলিন ছবি অ্যাঁকতে শিখুক। ওর হাত ভাল।
—তা বেশ। কিন্তু তার চেয়ে, নলিন, তুই পটুয়াদের কাছে শেখ না কেন? প্রতিমা গড়তে শেখ, রঙ করতে শেখ।
নলিন ছেলেটা অদ্ভুত লাজুক, দুই-চারিটি অতি সংক্ষিপ্ত কথায় কথা শেষ করে সে। সে। মাটির দিকে চাহিয়া বলিলপটুয়ারা শেখায় না। বলে পয়সা লাগবে।
যতীন বলিল-পয়সা আমি দেব, তুমি শেখ।
—দু টাকা ফি-মাসে লাগবে।
দেবু বলিল-আচ্ছা, সে আমি বলে দেব দ্বিজপদ পটুয়াকে। পরশু যাব আমি মহাগ্রামে। আমার সঙ্গে যাবি।
নলিন ঘাড় নাড়িয়া সায় দিল—বেশ।
কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল-পয়সা দেবেন বলেছিলেন।
যতীন একটি সিকি তাহার হাতে দিয়া বলিলতা হলে পণ্ডিতমশায়ের সঙ্গে যাবে তুমি, বুঝলে?
নলিন আবার ঘাড় নাড়িয়া সায় দিয়া নীরবেই উঠিয়া চলিয়া গেল।
যতীন বলিল-এইবার আপনার সঙ্গে আলোচনা আরম্ভ করব। অনেককে জিজ্ঞেস করছি, কেউ উত্তর দিতে পারে নি। অন্তত সন্তোষজনক মনে হয় নি আমার।
—কি বলুন?
–আপনাদের ওই চণ্ডীমণ্ডপটি। ওটি কার?
–সাধারণের।
–তবে যে বলে জমিদার মালিক?
—মালিক নয়। জমিদার দেবোত্তরের সেবাইত বলে তিনিই চণ্ডীমণ্ডপের রক্ষণাবেক্ষণ করেন।
–রক্ষণাবেক্ষণও তো, আমি যতদূর শুনেছি, গ্রামের লোকেই করে।
–হ্যাঁ, তা করে। কিন্তু তবু ওই রকম হয়ে আসছে আর কি! ওটা জমিদারের সম্মান। তা ছাড়া শূদ্রের গ্রাম, জমিদার ব্রাহ্মণ, তিনিই সেবায়েত হয়ে আছেন। আর ধরুন, গ্রামের মধ্যে ঝগড়াঝাটি হয়, দলাদলি হয়। এই কারণেই জমিদারকেই দেবোত্তরের মালিক স্বীকার করে আসা হয়েছে। কিন্তু অধিকার গ্রামের লোকেরই।
—তবে প্রজা-সমিতির মিটিং করতে বাধা দিলে কেন জমিদার-পক্ষ?
–বাধা দিয়েছে!
–হ্যাঁ, মিটিং করতে দেয় নি।
দেবু কিছুক্ষণ ভাবিয়া বলিল—বোধহয় প্রজা-সমিতি জমিদারের বিরোধী বলে দেয় নাই। তা ছাড়া ওটা তো আর ধর্মকর্ম নয়!
–প্রজা-সমিতি প্রজার মঙ্গলের জন্য। প্রজার মঙ্গল মানে জমিদারের সঙ্গে বিরোধ নয়। কোনো কোনো বিষয়ে বিরোধ আসে বটে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে নয়। আর চণ্ডীমণ্ডপ তো প্রজারাই করেছে, জমিদার করে দেয় নি। জায়গাটা শুধু জমিদারের। সে তো পথের জায়গাও জমিদারের। তা বলে প্রজা-সমিতির শোভাযাত্রা চলতে পারে না সে পথে? আর ধর্মকর্ম ছাড়া যদি অধিকার না থাকে, তবে জমিদারের খাজনা আদায়ই বা হয় কি করে ওখানে? দারোগাহাকিম এলেই বা মজলিস হয় কেন?
দেবু আশ্চর্য হইয়া গেল। ইহার মধ্যে ছেলেটি এত সংবাদ লইয়াছে।
সঙ্গে সঙ্গে তাহার মনে একটা সংশয় জাগিয়া উঠিল। চণ্ডীমণ্ডপের স্বত্বাধিকার সত্যই সমস্যার বিষয়। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া সে বলিল-আজ কথাটার উত্তর দিতে পারলাম না আপনাকে।
ভিতরে খুট খুট করিয়া কড়া নাড়ার শব্দ হইল। যতীন বুঝিলমা-মণি ডাকিতেছে। সে বলিল—আমি আর উঠতে পারছি না; তুমিই দিয়ে যাও মা-মণি।
পদ্মের বিরক্তির আর সীমা রহিল না। ছেলেটা যেন কি!
দেবু হাসিয়া কহিল—আমাকে লজ্জা করছে নাকি, মিতেনী?
ইহার পর আর বাহির না হইয়া উপায় রহিল না। দীর্ঘ অবগুণ্ঠনে আপনাকে আবৃত করিয়া পদ্ম দুই কাপ চা নামাইয়া দিয়া চলিয়া গেল।
যতীন বলিলতা ছাড়া লোকজন যারাই ওখানে যান, গোমস্তা শ্ৰীহরিবাবু তাদেরই সাবধান করেন—এ করবে না, ও করবে না! লোকে মেনে নেয়। দুর্বল নিরীহ মানুষ তারা বোঝে না। টাকা দিয়ে শ্ৰীহরি ঘোষ মেঝে বাধিয়ে দিয়েছেন বলে সাধারণের অধিকার নিশ্চয়ই বিক্রি হয়ে যায় নি।
দেবু অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল উপায় কি বলুনঃ শ্ৰীহরি ধনী। সে এখন সমস্ত গ্রামেরই শাসনকর্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জমিদার পর্যন্ত তার হাতে গোমস্তাগিরি ছেড়ে দিয়েছেন পত্তন-বিলির মত শর্ত! করবেন কি বলুন?
যতীন হাসিয়া বলিল—আমি তো কিছু করব না, আমার করবার কথাও নয়। করতে হবে আপনাকে, দেবুবাবু। নইলে উদ্গ্রীব হয়ে আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম কেন?
দেবু স্থিরদৃষ্টিতে যতীনের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। যতীনও চুপ করিয়া বসিয়া রহিল, সম্মুখের দিকে চাহিয়া। সহসা কে ডাকিল বাবু!
কে? যতীন ও দেবু দুজনেই ফিরিয়া দেখিল—ভিতরের দরজায় দাঁড়াইয়া ডাকিতেছে দুর্গা।
দেবু হাসিয়া বলিল-দুৰ্গা!
–হ্যাঁ।
–কি খবর?
কামার-বউ জিজ্ঞেস করছে, উনান ধরিয়ে দেবে কি না। রান্নাবান্না—
যতীন বলিল–হ্যাঁ। তা উনান ধরাতে বল না কেন!
—কি রান্না করবেন?
–যা হয় করতে বল।
সবিস্ময়ে দুর্গা বলিল—করতে বলব কাকে?
–মা-মণিকে বল। না হয়—তুমিই দুটো চড়িয়ে দাও।
দুর্গা মুখে কাপড় চাপা দিয়া হাসিয়া বলিল, আপনি একটুকুন ক্ষ্যাপা বটেন বাবু!
—কেন দোষ কি? যে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়, সে যে জাতই হোক তার হাতে খেতে দোষ নাই। জিজ্ঞেস কর পণ্ডিতমশাইকে।
–হ্যাঁ, পণ্ডিতমশায়?
দেবু হাসিয়া বলিল—জেলখানায় আমাদের যে রান্না করত সে ছিল হাড়ি। যতীনের মুখের দিকে চাহিয়া বলিল নামটি ছিল বিচিত্র গান্ধারী হাড়ি।
যতীন বলিল—দ্ৰৌপদী হলেই ভাল হত। চলুন, চান করতে যাব নদীতে। সে জামাটা খুলিয়া ফেলিয়া গামছা টানিয়া লইল।
***
দেবু মনে মনে স্থির করিয়াছিল—আর সে পাঁচের হাঙ্গামায় যাইবে না। জেল হইতেই সেই সঙ্কল্প করিয়াই আসিয়াছিল। কিন্তু যতীন ছেলেটি তাহার সব সঙ্কল্প ওলটপালট করিয়া দিতে বসিয়াছে।
বাড়ি হইতে তেল মাখিয়া গামছা লইয়া যতীনের সহিত নীরবে সে পথ চলিতেছিল। চণ্ডীমণ্ডপের নিকটে আসিয়াই দেখা হইল বৃদ্ধ দ্বারকা চৌধুরীর সঙ্গে। লাঠি হাতে টুকটুক করিয়া বৃদ্ধ চণ্ডীমণ্ডপ হইতেই নামিয়া আসিলেন। বৃদ্ধ যতীনের দিকে চাহিয়া বলিলেনচানে চলেছেন বুঝি?
যতীন হাসিয়া উত্তর দিল–হ্যাঁ।
আপনি তো তেল মাখেন না শুনি?
–আজ্ঞে না।
–তবে পেনাম। ঈষৎ হেঁট হইয়া বৃদ্ধ নমস্কার করিলেন।
যতীন একেবারে শশব্যস্ত হইয়া বলিলনা-না। ও কি? আপনাকে কতবার বারণ করেছি আমি। বয়সে আমি আপনার চেয়ে
কথার মাঝখানেই চৌধুরী মিষ্টি হাসিয়া বলিলেন—শালগ্রামের ছোট বড় নাই বাবা! আপনি ব্ৰাহ্মণ।
–না-না। ওসব আপনাদের সেকালে চলত, সেকাল চলে গেছে।
হাসিটি চৌধুরীর ঠোঁটের ডগায় লাগিয়াই থাকে। হাসিয়া তিনি বলিলেন—এখনকার কাল নতুন বটে বাবা। সেকালের কিছু আর রইল না। কিন্তু আমরা জনকতক যে (সকালের মানুষ অকালের মতন পড়ে রয়েছি একালে; বিপদ যে সেইখানে!
বৃদ্ধের কথা কয়টি যতীনের বড় ভাল লাগিল, বলিল—সেকালের গল্প বলুন আপনাদের!
–গল্প? হ্যাঁ, তা সেকালের কথা একালে গল্প বৈকি। আবার ওপারে গিয়ে যখন কর্তাদের সঙ্গে দেখা হবে, তখন একালে যা দেখে যাচ্ছি বললে, সেও তাদের কাছে গল্পের মত মনে হবে। সেকালে আমরা গাই বিয়োলে দুধ বিক্রেতাম, মাছ ধরালে মাছ বিলেতাম, ফল পাড়লে ফল বিলোতাম, ক্রিয়াকর্মে বাসন বিলোতাম, পথের ধারে আম-কাঁঠালের বাগান করতাম, সরোবর দিঘি কাটাতাম, গরু-ব্রাহ্মণকে প্রণাম করতাম, দেবতা প্রতিষ্ঠে করতাম, মহাপুরুষেরা ঈশ্বর দর্শন করতেন—সে আজ আপনাদের কাছে গল্প গো! আর আজকে আকাশে উড়োজাহাজ, জলের তলায় ড়ুবোজাহাজ, বেতারের খবর আসা, টাকায় আট সের চাল, হরেক রকম নতুন ব্যামো, দেবকীর্তি লোপ,-এও সেকালের লোকের কাছে গল্প।
–আপনি দিঘি কাটিয়েছেন চৌধুরীমশায়?
—আমার কপাল, ভাঙা-ভাগ্যি, বাবা! তবে আমার আমলে বাবা কাটিয়েছেন—তখন আমি ছোট, মনে আছে। এক এক ঝুড়ি মাটি দশ গণ্ডা কড়ি। একজন লোক কড়ি নিয়ে বসে থাকত ঝুড়ি গুনে গুনে কড়ি দিত; বিকেলে সেই কড়ি নিয়ে পয়সা দিত।
–আধ পয়সা ঝুড়ি বলুন।
–হ্যাঁ।…হাসিয়া চৌধুরী বলিলেন আমাদের কথা তো আপনারা তব বুঝতে পারেন। গো, আমরা যে আপনাদের কথা বুঝতেই পারি না! আচ্ছা বাবা, এত যে সব স্বদেশী হাঙ্গামা, বোমা-পিস্তল করছেন—এসব কেন করছেন? ইংরেজ রাজত্বকে তো আমরা চিরকাল রামরাজত্ব বলে এসেছি।
এক মুহূর্তে যতীনের চোখ দুইটা টর্চের আলোকের মত জ্বলিয়া উঠিল এক প্রদীপ্ত দীপ্তিতে। পরমুহূর্তেই কিন্তু সে দীপ্তি নিভিয়া গেল। হাসিয়া বলিলবোমা-পিস্তল আমি দেখি নি। তবে হাঙ্গামা হচ্ছে কেন জানেন? হাঙ্গামা হচ্ছে ওই দিঘি সরোবর কাটানো আপনাদের কালকে ওরা নষ্ট করেছে বলে।
বৃদ্ধ কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন—বুঝতে ঠিক পারলাম না। হ্যাঁ গো পণ্ডিত, আপনি এমন চুপচাপ যে?
চিন্তাকুলভাবেই হাসিয়া দেবু বলিল—এমনি।
আবার কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া বৃদ্ধ দেবুকে বলিলেন আপনার কাছে আসব একবার ও-বেলায়!
–আমার কাছে!
–হ্যাঁ, কথা আছে। আপনি ছাড়া আর বলবই বা কাকে?
—অসুবিধে না হয় তো এখুনি বলুন না! আবার আসবেন কষ্ট করে? দেবু উৎকণ্ঠিত হইয়াই প্রশ্ন করিল।
যতীন বলিল—আমি বরং একটু এগিয়ে চলি।
—না-না-না। বৃদ্ধ বলিলেন বেলা হয়েছে বলেই বলছিলাম। বুড়ো বয়সে আমার আবার লুকোবার কথা আছে নাকি? চৌধুরী হাসিয়া উঠিলেন—আপনি বোধহয় শুনেছেন, পণ্ডিত?
—কি বলুন তো?
–গাজনের কথা!
–না, কিছু শুনি নি তো!
–গাজনের ভক্তরা বলছে এবার তারা শিব তুলবে না।
–শিব তুলবে না কেন?
—ও, আপনি তো গতবার ছিলেন না। গতবার থেকেই সূত্রপাত। গেলবারে ঠিক এই গাজনের সময়েই সেটেলমেন্টের খানাপুরীতে শিবের জমি হারিয়ে গেল।
–হারিয়ে গেল!
—জমিদারের নায়েব-গোমস্তা বের করতে পারলে না। বের করবে কি, পুরোহিতের জমি নিজেরাই বন্দোবস্ত করেছে মাল বলে। তা ছাড়া শিবের পুজোর খরচা জিম্ম ছিল মুকুন্দ মণ্ডলের কাছে। শিবোত্তর জমি ভোগ করত ওরা। এখন মুকুন্দের বাবা সে জমি কখন বেচে দিয়ে গিয়েছে। মাল বলে। জমিদারও খাজনাখারিজ ফি গুনে নিয়ে দেবোত্তর মাল স্বীকার করেছে। মুকুন্দ এতসব জানত না, সে বরাবর শিবের খরচ যুগিয়েই আসছিল। এখন গতবার জরিপের সময়। যখন দেখলে শিবোত্তর জমিই নাই তখন সে বললে জমিই যখন নাই, তখন খরচও আমি দেব না। গতবার কোনো রকমে চাঁদা করে পুজো হয়েছে। এবার ভক্তরা বলছে, ওরকম যেচেমেগে পুজোতে আমরা নাই। তাই একবার শ্ৰীহরির কাছে এসেছিলাম-পুজোর কি হবে তাই জানতে। এখনও বেঁচে আছি—বেঁচে থাকতেই গাজন বন্ধ হবে বাবা।
—শ্ৰীহরি কি বললে?
–জমিদারের পত্র দেখালেন, তিনি খরচ দেবেন না। পুজো বন্ধ হয় হোক।
–হুঁ।
চৌধুরী বলিলেন—গতবার থেকে পাতু ঢাক বাজায় নাই, পাতু জমি ছেড়ে দিয়েছে। বায়েন অবশ্য হবে। অনিরুদ্ধ বলি করে নাই। বলে, একটা পঁঠার ঠ্যাং নিয়ে ও আমি করতে পারব। না। শেষে ও-ই খোঁড়াঠাকুর বলি করলে। এবার সে বলেছে—বলি করতে হলে দক্ষিণে চাই। নানান রকমের গোল লেগেছে পণ্ডিত। এসবের মীমাংসা তো পথে হয় না। তাই বলছিলাম–ও-বেলায় আসব।
দেবু হাঁপাইয়া উঠিতেছিল, সে বলিল—এর আর আমি কি করব চৌধুরীমশায়?
—এ কথা আপনার উপযুক্ত হল না, পণ্ডিত। আপনার মত লোক যদি না করে, তবে কে। করবে?
দেবু স্তব্ধ হইয়া গেল।
চৌধুরী কালীপুরের পথে বিদায় লইল। দেবু ও যতীন মাঠ অতিক্ৰম করিয়া গিয়া নামিল ময়ূরাক্ষীর গর্ভে। দেবু নীরবেই স্নান করিল, নীরবেই গ্রাম পর্যন্ত ফিরিল। যতীন দুই-চারটা কথা বলিয়া উত্তর না পাইয়া গুনগুন করিয়া কবিতা আবৃত্তি করিল।
তৃণে পুলকিত যে মাটির ধরা লুটায় আমার সামনে
সে আমায় ডাকে এমন করিয়া কেন যে কব তা কেমনে।
মনে হয় যেন সে ধূলির তলে
যুগে যুগে আমি ছিনু তৃণে জলে …
****
বাসায় ফিরিয়া যতীনের সে এক বিপদ। পদ্ম মূৰ্ছিত হইয়া জলে-কাদায় উঠানের উপর পড়িয়া আছে। মাথার কাছে বসিয়া কেবল দুর্গা বাতাস করিতেছে। তাহারও সর্বাঙ্গে জল-কাদা লাগিয়াছে। ও-ঘরের দাওয়ায় বসিয়া আছে মাতাল অনিরুদ্ধ। মাথাটা বুকের উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে, আপন মনেই বিড়বিড় করিয়া সে বকিতেছে। রান্নাবান্নার কোনো চিহ্নই নাই।
দুর্গা বলিল—আপনারা চলে গেলেন, কামার-বউ একেবারে ক্ষ্যাপার মতন হয়ে আমাকে বললে—বেরো, বেরো তুই আমার বাড়ি থেকে, বেরো। আমার সঙ্গে দু-চারটে কথা কাটাকাটি হয়ে গেল। আমি মশায়, বাড়ি যাব বলে যেই এখান থেকে বেরিয়েছি, আর শব্দ হল দড়াম। করে। পিছন ফিরে দেখি এই অবস্থা। ছুটে এসে জল দিয়ে বাতাস করে কিছুই হল না। খানিক পরে হঠাৎ কম্মকার এল। এসে, ওই দেখুন না, খানিকটা চেঁচামেচি করে ওই বসেছে এইবার মুখ জড়ে পড়বে।
দেবু অনিরুদ্ধকে ঠেলা দিয়া ডাকিল—অনিরুদ্ধ।
একটা গৰ্জন করিয়া অনিরুদ্ধ চোখ মেলিয়া চাহিল—এ্যাও!
কিন্তু দেবুকে চিনিয়া সে সবিস্ময়ে বলিল–ও, পণ্ডিত!
–হ্যাঁ, শুনছ?
–আলবৎ একশো বার শুনব, হাজার বার শুনব!
পরক্ষণেই সে হু-হু করিয়া কাঁদিয়া উঠিল—আমার অদেষ্ট দেখ পণ্ডিত! তুমি বন্ধুনোক, ভাল নোক, গায়ের সেরা নোক, পাতঃস্মরণীয় নোক তুমি—দেখ আমার শাস্তি। পথের ফকির আমি। আর ওই দেখ পদ্মের অবস্থা।
–জগনকে ডেকে আন অনিরুদ্ধ। ডাক্তার ডাক।
অতি কাতরস্বরে অনিরুদ্ধ বলিল ডাক্তার কি করবে, ভাই? এ ওই ছিরে শালার কাজ। আমার গুপ্তি কই? আমার গুপ্তি? খুন করব শালাকে। আর ওই দুগাকে। ওই পদ্মকে। দুগ্গা। আমাকে বাড়ি ঢুকতে দেয় না পণ্ডিত। আমার সঙ্গে ভাল করে কথা কয় না।
তারপর সে আরম্ভ করিল অশ্লীল গালিগালাজ। দুৰ্গা নতশির হইয়া নীরবে বসিয়া রহিল।
দেবু বলিল—যতীনবাবু আসুন, আমার ওখানেই দুটো খাবেন। আমরা গিয়ে বরং জগনকে ডেকে দেবখন।
দেবু ও যতীন চলিয়া যাইতেই অনিরুদ্ধ আবার আরম্ভ করিল—আর ওই নজরবন্দি ছোঁড়াকে কাটব। ওকেই আগে কাটব। ও-ব্যাটাই আমার ঘরের–
দুর্গা এবার ফোস করিয়া উঠিল—দেখ কৰ্ম্মকার, ভাল হবে না বলছি।
অনিরুদ্ধ চৌকাঠের উপর নিষ্ঠুরভাবে মাথা ঠুকিতে আরম্ভ করিলওই নে, ওই নে! দুর্গা বারণ পর্যন্ত করিল না।