১৯. রিসিভারটা যেন কানের ওপর সেটে ছিল

উনিশ

রিসিভারটা যেন কানের ওপর সেঁটে ছিল। সম্বিত ফিরতেই সেটাকে সরিয়ে নিয়ে কিছুটা নরম গলায় ভার্গিস বললেন, ‘হ্যলো!’ এক দুই তিন সেকেন্ড যেতে না যেতে ভার্গিস বুঝতে পারলেন লাইনটা ডেড হয়ে গেছে। ‘আমি আত্মসমর্পণ করছি এবং সেটা বন্ধুভাবেই হোক’। ধীরে ধীরে রিসিভারটা নামিয়ে রেখে দু’হাতে মুখ ঢাকলেন ভার্গিস। গলাটা সত্যি আকাশলালের তো। কোনও রকম কথা বলার সুযোগ না দিয়ে একটানা বলে লাইন কেটে দিল লোকটা। বোধহয় অনুমান করেছিল, কোত্থেকে টেলিফোন করা হচ্ছে তা তিনি ধরতে চাইবেন। বুদ্ধিমান, কিন্তু ওইটুকু সময়ই তাঁর লোকের কাছে যথেষ্ট।

এই সময় আবার টেলিফোন বাজল। ডেস্কের সার্জেন্ট জানাচ্ছে আট নম্বর রাস্তার একটি নির্জন টেলিফোন বুথ থেকে ফোনটা করা হয়েছিল এবং সেখানে ইতিমধ্যেই পুলিশ পৌঁছে গিয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেখানে একটি সস্তার টেপরেকর্ডার ছাড়া কাউকে পাওয়া যায়নি। ভার্গিস গর্জে উঠলেন, ‘টেপরেকর্ডার?’

সার্জেন্ট মিউমিউ গলায় বলল, ‘হ্যাঁ স্যার। সেটা নিয়ে আসা হচ্ছে।’

রিসিভারটা দড়াম করে রেখে দিলেন ভার্গিস। তার মানে তিনি আকাশলালের রেকর্ড করা কথা শুনেছেন। ওঃ, কি আহাম্মক। একবারও খেয়াল করেননি রেকর্ড বলেই কোনও বাড়তি সংলাপ বলেনি লোকটা। আর এর একমাত্র কারণ আকাশলাল তাঁর চেয়ে বুদ্ধিমান। নিজে না এসে রেকর্ড করা গলা পাঠিয়েছে। এমন কি টেপরেকর্ডার ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে ওর লোক দাঁড়িয়ে থাকেনি।

লোকটার আস্পর্ধা এত যে তাঁকে ভার্গিস এবং তুমি বলে গেছে। আর বলার ধরনে প্রভুত্ব পরিষ্কার। সে যা বলবে ভার্গিসকে যেন তা শুনতে হবে। অসম্ভব! দাঁতে দাঁত ঘষলেন ভার্গিস। একটা ক্রিমিন্যাল, দেশদ্রোহীকে তিনি তাঁর সঙ্গে ও ভাষায় কথা বলতে দিতে পারেন না। আলোচনা করতে চায়। কিসের আলোচনা? কয়েক বছর ধরে যে লোকটা তাঁর ঘুম কেড়ে নিয়েছে যাকে না ধরতে পারলে তাঁর চেয়ার আজ বিকেলে থাকবে না, তার সঙ্গে আলোচনার প্রশ্নই ওঠে না। বেলা বারোটায় মেলার মাঠে ওর জন্যে অপেক্ষা করতে হুকুম করেছেন উনি। আস্পর্ধা!

এই সময় একজন অফিসার টেপরেকর্ডারটা নিয়ে ভার্গিসের ঘরে ঢুকলেন। সস্তা জিনিস। অবহেলায় আঙুল তুলে তিনি রেখে দিতে বললেন টেবিলে। অফিসার বেরিয়ে যেতে ঈষৎ ঝুঁকে বোতামটা টিপতে কোনও আওয়াজ হল না। ফিতেটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে আবার বোতাম টেপার কিছুক্ষণ বাদে গলা শোনা গেল, ‘ভার্গিস। আমি তোমার সঙ্গে আলোচনা করতে চাই। আজ ঠিক বারোটার সময় মেলার মাঠের মাঝখানে আমার জন্যে তুমি অপেক্ষা করবে’। থাপ্পড় মেরে যন্ত্রটাকে বন্ধ করে লাফিয়ে উঠলেন ভার্গিস, ইডিয়ট। নিজেকে একটা আস্ত ইডিয়ট বলে মনে হচ্ছিল তাঁর। লোকটা স্বেচ্ছায় ধরা দিতে চাইছে আর তিনি কি সব উল্টোপাল্টা ভাবছেন। ওর নিশ্চয়ই আর কোনও উপায় নেই, কোনও রাস্তা নেই তাই ধরা দিতে বাধ্য হচ্ছে। যাই হোক না কেন ধরা দিলে তিনি নিজে হাতকড়া পরাবেন। আর এই জন্যে এখন যত ইচ্ছে তাঁর নাম ধরে ডাকুক অথবা তুমি বলুক কি এসে যায়। আরামের নিঃশ্বাস ছাড়লেন ভার্গিস। তাঁর হাত চলে গেল টেলিফোনের দিকে। মিনিস্টারকে খবরটা জানানো দরকার। সমস্ত দুশ্চিন্তার আজ অবসান হচ্ছে, চিতাকে জালে পুরছেন তিনি আজ বারোটায়। কিন্তু তার পরেই অন্য ভাবনা মাথায় এল। যদি লোকটা শেষ মুহূর্তে মত পাল্টায়। যদি মেলার মাঠে না আসে। বেইজ্জত হয়ে যাবেন তিনি আরও একবার। আগে থেকে গান না গেয়ে ধরার পরেই কথা বলা ভাল। কিন্তু এত জায়গা থাকতে মেলার মাঠের মাঝখানে কেন? ননসেন্স! ওই হাজার হাজার মানুষের ভিড়ের মধ্যে পুলিশের কাছে ধরা দিলে ওর সম্মান থাকবে? ওসব না করে সোজা এই হেডকোয়ার্টাসে চলে আসতে পারত। অথবা কোনও নির্জন জায়গায় তাঁকে যেতে বললেও চলত। নিজে আসবে অস্ত্রহীন হয়ে অথচ সঙ্গীদের সঙ্গে বন্দুক থাকবে। ওকে গুলি করলে তেনারা তাঁকে গুলি করবেন! করাচ্ছি! নিজে যদি না যান মেলার মাঠে? ভেবে নিজেই আপত্তি করলেন। ভার্গিস ইজ নট এ কাওয়ার্ড। তিনি যাবেন। গুলিও করবেন না। ধরার পর কয়েকদিন রেখে ইলেকট্রিক চেয়ারে বসিয়ে সুইচ টিপে দেবেন।

প্রসন্ন মুখে চুরুট ধরাতে গিয়েও থমকে গেলেন ভার্গিস। হোয়াই ইন মেলার মাঠ? নিজের মানসম্মানের কথা না ভেবে জায়গাটাকে বেছে নিল কেন লোকটা? পাবলিক খেপাবার ধান্দা নাকি? কেউ কেউ বলে জনতা লোকটাকে ভালবাসে। বাসতেই পারে। আজ ওরা যাকে ভালবাসে কাল তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে দেরিও করে না। ও নিয়ে ভাবনা নেই। কিন্তু আজ আকাশলালকে দেখতে পেলে জনতা নিশ্চয়ই উদ্বেল হয়ে উঠবে। এত লোককে নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষমতা তাঁর পুলিশের নেই। সেক্ষেত্রে গুলি চালাতে হবে। গুলি চললে জনতা ভয় পেতে পারে আবার বিপরীত ফলও হতে পারে। ভার্গিসের মনে হল কোণঠাসা হয়ে পড়ায় আকাশলাল এই চালটা চেলেছে। সে জনতাকে একসঙ্গে হাতের কাছে পেয়ে তাদের পুলিশের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিতে চায়।

এখন মেলার মাঠ লোকারণ্য। জোর করে তার সবটা খালি করে দেওয়া অসম্ভব। অথচ সংঘর্ষ বাধলে গুলি চালাতে হবে। ভার্গিস উঠে দাঁড়ালেন। তারপর সমস্ত অ্যাসিস্টেন্ট কমিশনারদের জরুরি তলব করলেন।

মিনিট পনেরোর মধ্যে অ্যাসিস্টেন্ট কমিশনাররা তাঁর টেবিলের উল্টোদিকে চলে এল। এদের সঙ্গে সোমও আসত, আজ তার শরীর মর্গে। লোকগুলোর মুখ গম্ভীর। ভার্গিস গলা পরিষ্কার করলেন অল্প কেশে, ‘প্রথমে আমি আমাদের সহকর্মী সোমের জন্যে দুঃখপ্রকাশ করছি। আপনারা কেউ এ ব্যাপারে কথা বলবেন?’

কেউ সাড়াশব্দ করল না। ভার্গিস বললেন, ‘হ্যাঁ, আপনারা জানেন ওপর মহল থেকে আমার ওপর প্রচণ্ড চাপ আসছে আকাশলালকে গ্রেপ্তার করার জন্যে। যে কোনও কারণেই হোক সেটা এখনও পর্যন্ত করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু আমার কাছে যে খবর আছে তাতে তাকে আজ আমরা ধরতে পারি।’ ভার্গিস দেখলেন প্রত্যেকের মুখে কৌতূহল ফুটে উঠল।

ভার্গিসের পেছনের দেওয়ালে এই শহরের ম্যাপ টাঙানো ছিল। তিনি উঠে সেই মাপের সামনে দাঁড়ালেন, ‘আজ আমাদের উৎসবের দিন। লক্ষের ওপর মানুষ আজ এই শহরে জড়ো হয়েছে। উৎসব হয় শহরের এই জায়গাটায় যাকে মেলার মাঠ বলা হয়ে থাকে।’ ভার্গিস তাঁর মোটা আঙুল ম্যাপের একটি জায়গায় রাখলেন, ‘এই মাঠে পঞ্চাশ হাজার মানুষ স্বচ্ছন্দে ধরে যায়। মাঠটিতে ঢোকার রাস্তা চারটে। চারটেই চওড়া। একটি রাস্তা, এটা, আমরা নো এনট্রি করে রেখেছি। আমাদের বাহিনী এবং ভি আই পিরা ছাড়া কেউ ওই রাস্তায় যাবে না। বাকি তিনটে রাস্তায় হাঁটা যাবে না মানুষের ভিড়ে। এখন মেলার মাঠ থেকে কেউ যদি ওই তিন রাস্তা দিয়ে পালাতে চায় তাকে প্রতি পায়ে বাধা পেতে হবে। জোরে বা দ্রুত যেতে পারবে না। আপনাদের তিনজন এই তিনটি পথ নজরে রাখবেন। আমি কাউকে পালাতে দিতে রাজি নই।’ ভার্গিস হাত তুললেন, ‘কোনও প্রশ্ন আছে?’

প্রবীণ একজন অ্যাসিস্টেন্ট কমিশনার, যাঁর কোনও দিন প্রমোশন পাওয়ার সুযোগ নেই, উঠে দাঁড়ালেন, ‘ওই তিনটে রাস্তা পালাবার জন্যে ব্যবহার করতে হলে প্রথমে মাঠে ঢুকতে হবে। ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারছি না।’

‘না বোঝার তো কিছু নেই। মাঠে ওরা ঢুকবে। আকাশলাল এবং তার সঙ্গীরা। আর ওদের ঢোকার সময়ে আমরা কোনও বাধা দেব না। কিন্তু পালাবার সময় দেব।’ ভার্গিস যেন খুব সরল ব্যাপার বুঝিয়ে দিলেন।

দ্বিতীয় অ্যাসিস্টেন্ট কমিশনার উঠে দাঁড়ালেন, ‘ওরা মাঠে আসবে কেন?’

‘হ্যাঁ। এটা ভাল প্রশ্ন। সাহস বেড়ে গেলে মানুষের মাথা খারাপ হয়ে যায়। আমার কাছে খবর আছে আকাশলাল মাঠে আসবে।’ টেলিফোনের কথা বেমালুম চেপে গেলেন ভার্গিস। এদের বললে মিনিস্টারকেও জানাতে হয়।

‘কিন্তু অত মানুষের ভিড়ে তাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব?’

‘সম্ভব। আমি এমন একটা টোপ দিয়েছি যাতে সে কাছে আসবে। সে এলেও তার সঙ্গীরা আসবে না। তারা থাকবে জনতার সঙ্গে মিশে। আমি তাদের পালাতে দিতে চাই না। আন্ডারস্ট্যান্ড? আর যদি আকাশলাল না আসে তো কি করা যাবে। এটা একটা চান্স। হ্যাঁ, মাঠের এ জায়গাটা এখনই ঘিরে ফেলা দরকার যাতে জনতার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। ঘেরা জায়গা থেকে একটা পথ যাবে ওই নো-এনট্রি করা রাস্তায়। এক ঘণ্টার মধ্যে কাজটা শেষ করে আমাকে রিপোর্ট দিন। ও-কে।’ কাঁধ ঝাঁকালেন ভার্গিস যার অর্থ মিটিং শেষ হয়ে গেছে, এবার ঘর খালি করে দিন।।

অফিসাররা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে এক কাপ কালো কফির হুকুম দিলেন ভার্গিস। আজ বেশ আরাম লাগছে। যদিও টেপরেকর্ডারের মাধ্যমে আকাশলালের কথা বলা তিনি পছন্দ করেননি। লোকটা অত্যন্ত ধূর্ত। তিনি যা চিন্তা করেন তা যেন আগে থেকে ভেবে ফেলে। ভাবুক। এখন আর কোনও উপায় নেই বলে আত্মসমর্পণ করছে।

কফি খেতে গিয়ে ভার্গিসের মনে হল যদি আত্মসমর্পণ ভান হয়। কাছাকাছি না এলে ওকে সার্চ করা যাবে না। ও যদি হাত দশেক তফাতে এসে সোজা তাঁর বুক লক্ষ করে গুলি চালায় তা হলে কিছুই করতে পারবেন না তিনি। হয়তো গুলি করার পর লোকটাকে জ্যান্ত ফিরে যেতে দেবে না তাঁর বাহিনীর লোকজন কিন্তু তাতে কি লাভ হবে। যে লোকটা জানে এমনিতেই মরতে হবে তার পক্ষে তো প্রধান শত্রুকে মেরে মরাই স্বাভাবিক।

কফিটাকে বিস্বাদ লাগল। ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে হবে। সরাসরি সামনে না থেকে দূরে গাড়ির মধ্যে অপেক্ষা করলে নিশ্চয়ই আকাশলাল প্রকাশ্যে আসবে না। বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট থাকলেও মুখ মাথা কি করে আড়াল করবেন? ভার্গিস মনে মনে একটা পরিকল্পনা এঁটে নিলেন। যদি দেখেন আকাশলাল গুলি করতে হাত তুলছে তা হলে এই পরিকল্পনাটা কাজে লাগবে।

টেলিফোন বাজল। অবহেলায় রিসিভারটা তুললেন ভার্গিস, ‘হ্যালো।’

‘আজকের জন্যে তুমি তৈরি ভার্গিস?’ মিনিস্টারের গলা।

‘সেন্ট পার্সেন্ট।’

‘উৎসবের জনতা নিয়ন্ত্রণে থাকবে?’

‘কোন বছর সেটা না থেকেছে?’

ভার্গিসের পাল্টা প্রশ্নে ওপাশে কিছুটা সময় চুপচাপ কাটল। ভার্গিস সেটা বুঝলেন, কিছু বললেন না। যা হবার তা তো হবেই।

‘তুমি তা হলে নিশ্চিত আজ বিকেলের মধ্যেই আকাশলালকে ধরতে পারবে?’

‘আমি তো আপনাকে বলেছি।’

‘ফোন করেছিল সে?’

এবার একটু অস্বস্তি হল। যে গলায় কথা বলছিলেন ভার্গিস তা পাল্টে গেল, হ্যাঁ, ‘ফোনে কথা হয়েছে। লোকটা বারোটার সময় আত্মসমর্পণ করবে।’

‘হোয়াট? আত্মসমর্পণ? অসম্ভব।’

‘ওর নাভিশ্বাস উঠে গেছে। আর লুকিয়ে থাকতে পারছে না। আমিই ওকে উপদেশ দিলাম আত্মসমর্পণ করতে। আপনি সাড়ে বারোটায় ওর সঙ্গে কথা বলতে পারবেন।’

‘ফোন লোকেট করেছিলে?’

‘হ্যাঁ। কিন্তু একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল।’ টেপরেকর্ডারের কথা বলতে একটুও ভাল লাগল না ভার্গিসের।

মিনিস্টার বললেন, ‘ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে আমার অসুবিধে হচ্ছে ভার্গিস। মনে হচ্ছে এর পেছনে কোনও মতলব আছে। থাকগে, ভাগ্য তোমার পক্ষে থাকুক। আর হ্যাঁ, বাবু বসন্তলালের বাংলোর কেয়ারটেকারের ব্যাপারটা তোমার কাছ থেকে এখনও শুনতে পাইনি।’

ধ্‌ক্‌ করে উঠল ভার্গিসের বুক। এরা সব ঠিকঠাক জানতে পেরে যায় কি করে। উত্তর একটা দিতে হবে। ভার্গিস বলল, ‘ওহো! আমি আজই খবরটা পেলাম। লোকটা নাকি পাগল হয়ে গিয়েছে। সামান্য একটা কেয়ারটেকার তাও পাগল, তার কথা বলে আপনাকে বিব্রত করতে চাইনি।’

‘ওই কেয়ারটেকারটাকে খুঁজে বের করো। পাওয়ামাত্র আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে।’

‘বেশ। কিন্তু আমার মনে হয় ওর সঙ্গে বাবু বসন্তলালের হত্যার কোনও যোগাযোগ নেই। লোকটা ভয় পেয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। দেহাতি মানুষ।’ ভার্গিস অভিনয় করলেন।

‘লোকটাকে দরকার।’ মিনিস্টার লাইন কেটে দিল।

রিসিভার নামিয়ে রেখে ভার্গিস মনে মনে বললেন, আর বোকামি নয়।

আজ শহরের প্রতিটি খোলা জায়গায় মানুষজন থিক থিক করছে। দিনটা শুরু হয়েছিল চমৎকারভাবে, আকাশে মেঘের চিহ্ন নেই কোথাও। হালকা ফুরফুরে রোদে ওই উৎসবের মেজাজ যেন আরও খুলে গিয়েছিল। বেলা বাড়তেই সবার গন্তব্যস্থল হয়ে দাঁড়াল মেলার মাঠ এবং তার দিকে যাওয়ার রাস্তাগুলো। ঢাক ঢোল ভেঁপু বাজছে সর্বত্র, উড়ছে বেলুন। এই উৎসব হয়তো কোনওকালে বিশেষ এক ধর্মের মানুষদের প্রয়োজনে শুরু হয়েছিল। কিন্তু সেখানে ধর্মীয় আচারানুষ্ঠান প্রবল না হয়ে ওঠায় উৎসবের আনন্দে অংশ নিতে অন্য ধর্মের মানুষেরা আপত্তি করেনি। মেলায় ঘুরে বেড়ানো কেনাকাটা করতে কোনও বিশেষ ধর্মের ছাড়পত্র লাগে না। সাধারণ মানুষ চিরকাল এই অল্পেতেই খুশি।

আকাশলাল তৈরি হয়ে বসে ছিল। একটু আগে স্বজনকে তার কাছে নিয়ে আসা হয়েছিল। আকশলাল ঠিক কি চায় তা সে স্বজনকে বুঝিয়ে বলেছে। লোকটা সম্পর্কে স্বজনের কৌতূহল একটু একটু করে বাড়ছিল। এখন প্রস্তাব শোনার পর তার মনে হল চ্যালেঞ্জটা সে গ্রহণ করবে। সে বলল, ‘আপনি যখন আমার ওপর নির্ভর করছেন তখন দায়িত্ব আমি নিচ্ছি। তবে একটা কথা জানবেন, শুধু মুখ নয়, শরীরের সর্বত্র যেসব চিহ্ন এই মুহূর্তে আপনার পরিচয় হিসেবে রয়েছে সেগুলোকে আমি রাখতে চাই না।’

আকাশলাল হাসল, ‘ডাক্তার, এ ব্যাপারে আপনার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রইল।’

‘আমি কোথায় কাজ করব?’

‘ডেভিড আপনাকে সাহায্য করবে।’

ঠিক পৌনে এগারটায় হায়দাররা ফিরে এল। তারাও তৈরি। আকাশলাল জিজ্ঞাসা করল, ‘আমার সঙ্গে কে কে যাচ্ছে?’

হায়দার বলল, ‘চারজনকে আমরা এর মধ্যেই মেলার মাঠে পাঠিয়ে দিয়েছি। কিন্তু খবর এসেছে ভার্গিস মাঠের ঠিক একটা ধারে কিছুটা জায়গা ঘিরে ফেলেছে বাঁশ দিয়ে। পাবলিককে ওখানে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। ঘেরা জায়গাটার পেছনের রাস্তা ওরা নো এনট্রি করে রেখেছে। ব্যাপারটা ভাল লাগছে না।’

‘হয়তো আমাকে অভ্যর্থনা জানাতে ওটা করেছে ভার্গিস।’

‘কিন্তু ঢোকার রাস্তাগুলোতে পুলিশের লোক ছড়িয়ে আছে।’

‘খুবই স্বাভাবিক। তুমি হলেও তাই রাখতে।’ আকাশলাল স্বজনের দিকে হাত বাড়াল, ‘গুডবাই ডক্টর। তোমাকে মেলায় যাওয়ার অনুমতি দিতে পারছি না বলে দুঃখিত। ভার্গিস তোমাকে পেলে এই মুহুর্তে ছাড়বে না। তবে কাজ হয়ে যাওয়ার পর তুমি যাতে ইন্ডিয়ায় ফিরে যেতে পার তার ব্যবস্থা আমার বন্ধুরা করবে। তুমি এবং তোমার স্ত্রীর কাছে আমি কৃতজ্ঞ।’

আকাশলালকে নিয়ে ওরা বেরিয়ে এল। ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এল ওরা। হলঘরে কয়েকজন পাহারাদার সপ্রশংস চোখে আকাশলালকে দেখছিল। প্রত্যেকের হাত কপালে চলে যেতেই আকাশলাল তাদের নমস্কার করল।

এই বাড়ি থেকে বেরুবার যে পথটা স্বজন জেনেছে সেই পথ দিয়ে গেল না আকাশলাল। স্বজন দেখল বাঁদিকের একটা দরজার সামনে পৌঁছে আকাশলাল শব্দ করল। একটু বাদেই একজন সে দরজাটা ভেতর থেকে খুলল। চেহারায় সম্পন্ন বাড়ির কাজের মেয়ে বলেই মনে হয়। স্বজন শুনল আকাশলাল বলছে, ‘আমি খবর পাঠিয়েছিলাম, উনি যদি কয়েক মিনিট সময় আমাকে দেন।’

দুদিনে মানুষটাকে সে যত দেখছে তত বিস্ময় বাড়ছে। যার জন্যে সরকার এত লক্ষ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে তার ব্যবহার, কথাবার্তা এমন মার্জিত ভদ্র হবে কে জানত। কাজের মেয়েটি আকাশলালকে নিয়ে ভেতরে চলে গেল। ওর সহযোগীরা বাইরে অপেক্ষা করছে। স্বজন বুঝতে পারছিল না যে কাজের দায়িত্ব তাকে দিয়ে গেল আকাশলাল তা কি করে করা সম্ভব? এই যে লোকটা সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পুলিশের হাতে ধরা দিতে যাচ্ছে তার পরিণাম মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। মৃত মানুষের ওপর সে কখনও অস্ত্র-প্রয়োগ করেনি। প্রয়োজনও হয় না করার।

পকেট থেকে দুটো ছবি বের করল স্বজন। পোস্টকার্ড সাইজ ছবি। আকাশলালের মুখের দুটো দিক। খুব সাম্প্রতিক ছবি না হলেও ওর মুখ তেমন পাল্টায়নি। নাকের পাশে একটা ছোট আঁচিল আছে। এত ছোট যে তিল বলে ভুল হবে। ঠোঁটের দু কোণ থেকে যে ভাঁজটা সেটা সরালেই— স্বজন মাথা নাড়ল। না সে চব্বিশ ঘণ্টা সময় পাচ্ছে। একটা লোক তার দেশের জন্যে এভাবে নিজেকে খরচ করতে করতে শেষ সীমায় পৌঁছেছে, নিজে রাজনীতি না করলেও শ্রদ্ধাশীল না হয়ে পারা যায় না। ব্যাপারটা নিয়ে আরও ভাবতে হবে।

আকাশলাল ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠল কাজের মেয়েটির সঙ্গে। তার বুকে চাপ পড়ছিল বলে গতি কমছিল। মেয়েটি একটু অবাক হয়েই বারংবার পেছনে তাকাচ্ছিল। আকাশলাল তার কাছেও বিস্ময়। মালিক তাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়েছেন বলে সে এ-বাড়ির অন্য প্রান্তে যায় না, কারও সঙ্গে কথাও বলে না। কিন্তু তার মনে হল লোকটা খুব অসুস্থ। মুখ হাঁ করে বাতাস নিচ্ছে।

ওপরে ওঠার পর আকাশলাল একটু দাঁড়াল। মনে হল সে সহজ হয়েছে। বলল, ‘আজকাল একটুতেই, ঠিক আছে এখন, চলো—!’

বিশাল একটি সোফায় হেলান দিয়ে যে বৃদ্ধা বসেছিলেন তাঁর মাথায় একটিও কালো চুল নেই। দুটো হাত যেন হাড়জড়ানো শিরাদের ভিড়। মুখও কুঁচকে গিয়েছে। কাজের মেয়েটি সামনে গিয়ে কিছু বলতেই জানলার বাইরে তাকানো চোখ দুটো এদিকে ফিরল, ‘বলো, আকাশ!’

আকাশলাল দুহাত যুক্ত করল, ‘আজ উৎসবের দিন। আমি স্থির করেছি আজই ঠিক দিন’।

‘কিসের ঠিক দিন?’

‘আমি আত্মসমর্পণ করছি।’

‘কি?’ বৃদ্ধা সোজা হয়ে বসলেন, ‘তুমি আত্মসমর্পণ করছ?’

‘হ্যাঁ। আপাতত এ ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই।’

‘তুমি জানো এর পরিণাম কি হবে?’

‘হ্যাঁ জানি।’

‘আর যারা তোমার সঙ্গে থেকে লড়াই করে এসেছে তাদেরও সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছ?’

‘না। তারা থাকবে। তাদের লড়াই থামবে না।’

‘আমি বুঝতে পারছি না তোমার কথা।’

‘যদি কখনও সুযোগ পাই আপনাকে বুঝিয়ে বলব। আপনি আমাকে আশীর্বাদ করুন যাতে আমাদের পরিকল্পনা সার্থক হয়।’

‘অসম্ভব। তুমি আত্মসমর্পণ নয় আত্মহত্যা করতে চলেছ আর আমি তোমাকে আশীর্বাদ করব? কখনও নয়। তোমার মা আমার বান্ধবী ছিলেন। আমি তাঁর আত্মার শান্তির জন্য আজ প্রার্থনা করব।’ বৃদ্ধা ধীরে ধীরে শুয়ে পড়লেন সোফায়।

আকাশলাল বলল, ‘জানি না ইতিহাস কখনও এসব কথা লিখবে কি না, কিন্তু প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা আপনার কাছে কৃতজ্ঞ।’

চোখ বন্ধ করেই বৃদ্ধা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেন?’

‘আপনি আশ্রয় না দিলে আমরা কোথায় ভেসে যেতাম।’

বৃদ্ধা হাত নাড়লেন। যার অর্থ এসব তিনি শুনতে চান না।

আকাশলাল বলল, ‘এবার আমি চলি।’

বৃদ্ধা সাড়া দিলেন। আকাশলাল সরে যেতে শুরু করেছে, বৃদ্ধা ডাকলেন, ‘শোন। তোমার সঙ্গীদের বলো এক ঘণ্টার মধ্যে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে।’

‘সেকি?’ চমকে উঠল আকাশলাল।’

‘হ্যাঁ।’

‘কিন্তু আপনি আমাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন পুলিশ না আসা পর্যন্ত… ।’

‘দিয়েছিলাম। আমি লেডি জে সি প্রধান। পুলিশ আমার বাড়ির ওপর কখনই সন্দেহের চোখে তাকাবে না। যদি তোমরা তাদের আগবাড়িয়ে ডেকে না আনো তা হলে কোনও ভয় নেই। কিন্তু আমি দিয়েছিলাম একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাকে। কাপুরুষকে নয়।’

আকাশলাল হেসে ফেলল, ‘আপনি ঠিক বলেছেন। আপনি হিন্দু। হিন্দুদের আত্মীয় বিয়োগ হলে অশৌচ পালন করতে হয় এগারো দিন। আমার মৃত্যুর খবর পেলে অন্তত এগারোটা দিন যা চলছিল তা চলতে দেবেন। তারপর আর কেউ এখানে থাকবে না, আমি আপনাকে কথা দিলাম।’

বৃদ্ধা হাত নাড়লেন সেইভাবেই। কোনও কথা আর বলতে চান না তিনি। অর্থাৎ আকাশলালের প্রস্তাব তিনি মেনে নিলেন।

গাড়িটা ধীরে ধীরে বাগানের পথ দিয়ে এগিয়ে আসছিল। ড্রাইভার ছাড়া পেছনের আসনে আরও দুজন বসেছিল। একজন আকাশলাল। তার মুখ একটা মাফলারে জড়ানো। পাশে ত্রিভুবন। গাড়িটা বড় রাস্তায় পড়েই গতি বাড়াল। এদিকটা মেলার পথ নয় বলেই লোকজন কম, গাড়ির ভিড় বেশি নেই।

কিছুটা দূর যাওয়ার পর ত্রিভুবন হেনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল রাস্তার পাশে, একা। ত্রিভুবন বলল, ‘আমরা কি গাড়িতেই অপেক্ষা করব?’

আকাশলাল মাথা নাড়ল, ‘না। তুমি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাও। এরকম একটা জায়গায় গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকলে অনেকের সন্দেহ হবে।’

‘কিন্তু আপনি— ’

‘একটু ঝুঁকি নিতেই হবে।’

গাড়িটা দাঁড়াল। আকাশলাল দরজা খুলে নামতেই হেনা এগিয়ে এল। কিন্তু ত্রিভুবনের ইচ্ছে করছিল না প্রিয় নেতাকে এভাবে ছেড়ে যেতে। আকাশলাল তার দিকে হাত বাড়াল, ‘বিদায় বন্ধু।’

ত্রিভুবন নিজেকে সংযত করে হাত মেলাল।

গাড়িটা চলে যেতে আকাশলাল হেনার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাঃ, তুমি তো বেশ সুন্দর হয়েছ। এবং বুদ্ধিমতীও।’

হেনা মাথা নামাল, ‘সেটা কি করে বুঝলেন?’

‘সোম নিশ্চয় বুঝতে পেরেছিল তোমরা ওকে চিনে ফেলেছ!’

‘হ্যাঁ, গ্রামের কয়েকজন ওঁর দিকে তেড়ে এসেছিল চিনতে পেরে।’

‘তারপর?’

‘আমি ওঁকে পরে বুঝিয়েছিলাম লোকগুলো ভুল করেছে। সোমের মতোই দেখতে এক জনের সঙ্গে ওরা গুলিয়ে ফেলেছে।’

‘সোম বিশ্বাস করেনি?’

‘না। আমার তো তাই মনে হয়। তবে সেটা মনে রেখে দিয়েছিলেন।’

‘হুঁ। ত্রিভুবনকে তুমি বিয়ে করছ কবে?’

‘আশ্চর্য। এই প্রশ্ন এখন আপনার মাথায় আসছে? এই সময়ে?’

আকাশলাল রসিকতা করতে যাচ্ছিল, এমন সময় দূরে ঢাকঢোল বাজিয়ে একটা মিছিল আসতে দেখা গেল। মানুষগুলো কোনও গ্রাম থেকে তাদের গ্রামদেবীকে বহন করে নিয়ে চলেছে মেলার মাঠে। হেনা এগিয়ে গেল তাদের দিকে।

মিছিলটা আকাশলালের সামনে এসে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়াল। আটজন মানুষ বাঁশের ওপর মূর্তি বহন করছে। মৃর্তির চারপাশে পর্দা টাঙানো। ওরা নিচু হতেই আকাশলাল ঘেরাটোপে উঠে বসল। সেখানে কোনও দেবী বা মূর্তি নেই। মিছিলটি চলল আগের মতোই ঢাকঢোল বাজিয়ে। মিছিলের জনাকুড়ি মানুষকে দেখে প্রকৃত দেহাতি ভক্ত বলে মনে হচ্ছিল। ভিড় বাড়ছিল রাস্তায়। কিন্তু মিছিলকে পথ করে দিচ্ছিল সবাই শ্রদ্ধায়। মেলার মাঠে না-যাওয়া দেবীর মুখদর্শন করা যাবে না, এটাই নিয়ম।

আকাশলাল দেখল, ঘেরাটোপের ভেতর নির্দেশমত পোর্টেবল মাইক রাখা আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *