ঊনবিংশ পরিচ্ছেদঃ উৎকণ্ঠা
ঈসা খাঁ দাক্ষিণাত্যে জেহাদের জন্য গমন করিবার পরে স্বর্ণময়ী দুর্ভাবনায় উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিল। পিতার অসম্মতি প্রকাশে এবং ঈসা খাঁর জেহাদ গমনে তাহার চিত্ত বিষম ব্যাকুল হইয়া পড়িল। হায়! সে যাঁহাকে সম্পূর্ণরূপে আপনার হৃদয়-মন সমর্পণ করিয়া প্রেম-দেবতা রূপে বরণ করিয়া অন্তরের অন্তস্তম প্রদেশে প্রীতির সিংহাসনে বসাইয়াছে-যাঁহার রাতুল চরণে আপনার সর্বস্ব বিকাইয়া বসিয়াছে-নেত্রে তাঁহার পরমরূপ সর্বদা দীপ্তি পাইতেছে-কর্ণে যাঁহার প্রীতিমাখা মধুরবাণী সর্বদা পীযুষধারা বর্ষণ করিতেছে-হৃদয়ের প্রতি অণুপরমাণু যাঁহার প্রেম সুধায় আকৃষ্ট এবং বিহবল, তাহার সেই সুখদ বসন্তের প্রাণ-জুড়ান, মন-মাতান মলয় সমীকরণ, তাহার হৃদয়-আকশের সেই শরচ্ছন্দ্র, তাহার জীবন-মরুর সেই বর্ষণশীল-বারিদখণ্ড, তাহার আতপতগ্ধ পথের সেই সুশীতল বটচ্ছায়া, তৃষ্ণার্ত জীবনের সেই অমৃতনির্ঝরিণী, জীবনতরণীর সেই ধ্রুবতারা, মানসকুঞ্জের সেই বসরাই গোলাপ, তাহার পিতার অসম্মতিতে এবং স্বীয় জননীর অমতে তাহাকে আদর করিয়া চরণতলে স্থান দিতে কি সমর্থ হইবেন? তাহাকে কি তিনি স্মরণ করিতেছেন? তিনি কি তাহাকে উদ্ধার করিতে সমর্থ হইবেন? যদি না হন, কিংবা হায়! যদি ইচ্ছা না করেন, তবে কি হইবে? হায়! আমি যাঁহার পদে জীবন-যৌবন ডালি দিয়া বসিয়াছি, তাঁহাকে আমি পাইব না! তাঁহার চরণে আমাকে সমর্পণ করা হইবে না। কিন্তু যাহাকে আমি জানি না-চিনি না-চাই না, আমাকে নাকি তাহার হস্তেই দেওয়া হইবে। বিধাতঃ! ইহাই যদি ধর্ম হয়, তবে আর অধর্ম কাহাকে বলে? ইদিলপুরের শ্রীনাথ চৌধুরীর সঙ্গে বিবাহের কথা নাকি পাকাপাকি হইয়াছে, অথচ আমি তাহার বিন্দু-বিসর্গ পর্যন্ত অবগত নহি, ইহা অপেক্ষা স্ত্রী জাতির ভীষণ অত্যাচার আর কি হইতে পারে? হায়! হিন্দুজাতির বিচারে কি স্ত্রীলোকের আত্মা নাই!-বিচার নাই! নিজের সুখ-দুঃখ বোধ নাই! স্ত্রীলোক কি জড় পদার্থ কিংবা খেলার দ্রব্য, যে তাহার রুচি, অনুরাগ, ইচ্ছা এ-সমস্ত সম্বন্ধে কিছুই বিবেচনা করা হয় না-জিজ্ঞাসা করা হয় না! হা বিধাতঃ! ইচ্ছা এমন জাতিতে স্ত্রীলোক কেন জন্মে? যদি জন্মে তবে বাল্যেই মরে না কেন? যদি না মরে, তবে তাহার রুচি, অনুরাগ, বিচারশক্তি হরণ করা হয় না কেন?
থা’ক সে সব। এক্ষণে কোন পন্থা অবলম্বন করিব? হায়! কি কুক্ষণেই ঈসা খাঁর সেই চাঁদ বদন দর্শন করিয়াছিলেন। হায়! কিছুতেই যে সে মুখের শোভা, সে বিস্ফোরিত আঁখির মধুময়ী দৃষ্টি, সে কণ্ঠের অমৃত-নিস্যন্দিনীবাণী ভুলিতে পারি না। সে-হৃদয় যেন অফুরন্ত প্রেমপারাবার, তাহাতে ডুবিলে যেন সমস্ত জ্বালা জুড়াইয়া যায়। সমস্ত আকাঙ্খা পূর্ণ হয়। তাহাকে পাইলে আর কিছুই পাইতে বাকী থাকে না। তাঁহার কথা স্মরণে কত আনন্দ, কত উল্লাস। সে নাম স্মরণেও হৃদয়ে পরতে পরতে সুধা বঞ্চিত হয়! হায়! তেমন সুন্দর, তেমন প্রিয়, আনন্দকর আর কে? এইরূপ দুশ্চিন্তায় রায়-নন্দিনী দিন যাপন করিতে লাগিল।
আশ্বিন মাস যাইয়া কার্তিক মাস যায়। স্বর্ণময়ীর বিবাহের জন্য আয়োজন হইতে লাগিল। অগ্রহায়ণ মাসের ২৭শে তারিখে বিবাহ। রাজবাড়ীর দাস-দাসী, ভৃত্য, কর্মচারী, স্ত্রী ও পুরুষ সকলের মুখেই আনন্দ। সকলের মুখেই বিবাহের কথা। যতই বিবাহের দিন নিকটবর্তী হইতে লাগিল, স্বর্ণ ততই নিদাঘ-তাপ-দগ্ধ গোলাপের ন্যায়, শুঙ্ক এবং কর্দমে পতিত কমলের ন্যায় মলিত হইতে লাগিল। কি উপায় অবলম্বন করিলে, এ বিবাহ-পাশে হইতে উদ্ধার পাওয়া যাইবে, তাহা ভাবিয়া ভাবিয়া আকুল হইল। ঈসা খাঁকে প্রাণ-মন সমর্পণ করিয়া, তাঁহাকে হৃদয়-সিংহাসেন বরণ করিয়া বসাইয়া,-অন্যকে পাণিদান করিবে? না। না! তাহা কখনও হইবে না। এমন ব্যভিচার, এমন বিশ্বাসঘাতকতা, এমন অধর্ম কিছুতেই করিতে পারিবে না। তৎপরিবর্তে মৃত্যুতে আলিঙ্গন করা শতগুণে শ্রেয়ঃ। স্বর্ণ ভীষণ দুর্ভাবনায় দিনদিন বিবর্ণ ও বিশুঙ্ক হইতে লাগিল। তাহার পিতা, ঈসা খাঁর প্রস্তাবে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনের পরে, ঈসা খাঁর মানসিক মতিগতি বা কি দাঁড়াইল, তাহাও জানিতে পারিল না। স্বর্ণের এই গভীর মনোবেদনা, চিত্তের অস্থিরতা, সরলা নাম্নী একজন সখী ব্যতীত আর কেহই জানিত না। স্বর্ণ তাহাকে জীবনের সুখ-দুঃখভাগিনী জানিয়া প্রাণের কথা মর্ম-ব্যথা সমস্তই অকপটে তাহার নিকট প্রকাশ করিত।
সরলা তাহার বাল্য-সখী। শিশুকাল হইতে উভয়ের গভীর অনুরাগ। স্বর্ণের বিপদে, স্বর্ণের দুশ্চিন্তায় সরলাও ব্যাকুলা হইয়া পড়িল। অবশেষে ঠাকুর যশোদানন্দ বা জহিরুল হকের নিকট পরামর্শ গ্রহণ করিবার জন্য স্বর্ণ সরলাকে কৌশল করিয়া পাঠাইয়া দিল। শাহ সোলতান মহীউদ্দীনের নিকট হইতে পানি-পড়া আনিবার উপলক্ষে সরলা জহিরুল হককে সমস্ত কথা নিবেদন করিল।
যশোদানন্দ সুকুমারী স্বর্ণময়ীকে বাল্যকাল হইতেই আপন কন্যার ন্যায় ভালোবাসিতেন এবং স্নেহ করিতেন। কারাগারে যখন যশোদানন্দের নির্যাতন ও লাঞ্ছনায় তাঁহার পূর্বের ভক্ত অনুরক্ত শিষ্য-শিষ্যাগণ আনন্দবোধ করিতেছিল, তখন একমাত্র স্বর্ণের চক্ষেই তাঁহার জন্য সহমর্মিতার পবিত্র অশ্রুবিন্দু ফুটিয়াছিল। স্বর্ণ অবসর এবং সুবিধা পাইলেই চঞ্চল চরণে করুণাপূর্ণ আঁখি ও মমতাপূর্ণ হৃদয় লইয়া কিরূপ ব্যাকুলভাবে কারাগৃহের দ্বারে আসিয়া দাঁড়াইত এবং কিরূপ পরিপূর্ণ সহৃদয়তার সহিত তাঁহার দুঃখে সহানুভূতি জানাইত এবং পরিশেষে তাহার বুদ্ধি-কৌশলে জহিরুল হক সেই সাক্ষাৎ নরক হইতে কিরূপে প্রমুক্ত হইলেন, তাহা স্মরণ করিয়া অশ্রু বর্ষণ করিতে লাগিলেন। স্বর্ণের প্রাণের যন্ত্রণা এবং মহাবিপদের কথা শুনিয়া তাঁহার স্নেহ-মমতা আরও উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল। কোমলপ্রাণ্য, উদি্ভন্ন-যৌবনা স্বর্ণময়ীর সরল হৃদয়খানি প্রেমানুরাগে কিরূপে দগ্ধ হইতেছে-নৈরাশ্যের ভীষণ ঝটিকা, তাহার আশা-আনন্দ ও আলোকপূর্ণ মানস-তরুণীকে কিরূপভাবে বিষাদের অগাধ সলিলে ডুবাইয়া দিতেছে, তাহা ভাবিয়া একান্ত ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন।
স্বর্ণময়ী যে ঈসা খাঁর প্রেমের আবদ্ধ হইয়াছে, জহিরুল হক তাহা স্বপ্নেও জানিতেন না। ঈসা খাঁর বিবাহ-প্রস্তাবে তিনি যদি আপত্তি উত্থাপন না করতেন, তাহা হইলে স্বর্ণময়ীর জীবন-পূর্ণিমা আজ এমন অমাবস্যায় পরিণত হইত না। তিনিই যে স্বর্ণময়ীর প্রণয়-পথে কণ্টক রোপন করিয়াছেন, তাহা স্মরণ করিয়া লজ্জিত এবং মর্মাহত হইলেন। এক্ষণে প্রাণপাত করিয়াও সে কণ্টক উদ্ধার করিতে পারিলে, তিনি সুখী হইতে পারেন! স্বর্ণের ভবিষ্যৎ কি হইবে? কিরূপে ইদিলপুরের শ্রীনাথ চৌধুরীর সহিত বিবাহ-সম্পর্ক ভঙ্গ করিয়া ঈসা খাঁর সহিত স্বর্ণময়ীর উদ্বাহ ক্রিয়া সম্পন্ন করিবেন, তাহাই জহিরুল হকের একমাত্র চিন্তার বিষয় হইয়া উঠিল। স্বর্ণকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করিতে পারিলে শ্রীনাথ চৌধুরীর পাপ-পাণিপীড়ন হইতে তাহাকে রক্ষা করিতে পারা যায় বটে, কিন্তু ঈসা খাঁর জননী আয়েশা খানমের অমতে ঈসা খাঁর সহিত কিরূপে তাহাকে পরিণয়সূত্রে সম্মিলিত করা যাইবে, ইহাও এক গভীর সমস্যার বিষয়। অন্যদিকে স্বর্ণ মুসলমান হইলেই বা তাহাকে কোথায় আশ্রয় দেওয়া যাইবে? কেদার রায়ের রোষানলে দগ্ধিভূত হইতে কে স্বীকার করিবে।
জহিরুল হক স্বর্ণময়ী সম্বন্ধে অনেক চিন্তা করিলেন, কিন্তু মস্তিস্ক-সিন্ধু আলোড়ন করিয়াও কিছু স্থির করিতে পারিলেন না। অবশেষে অধীর হইয়া তাঁহার ধর্মগুরু ধর্মাত্মা হযরত সুফী মহীউদ্দীন শাহের চরণে সমস্ত বৃত্তান্ত বিষদরূপে বিবৃত করিলেন। শাহ সাহেব ক্ষণকালের জন্য নেত্র নিমীলিত করিয়া ধ্যানস্থ হইলেন। তৎপর বলিলেন, “কয়েকদিন অপেক্ষা কর, কি করতে হবে জানতে পারবে।”