১৯. রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হিজরত

আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তা’আলার ইচ্ছে ও কুরাইশদের প্রচেষ্টা (بين تدبير قريش وتدبير الله سبحانه وتعالى):

তারা তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য এমন জঘন্য পরামর্শ সভা অত্যন্ত গোপনে করে যাতে কার্যসিদ্ধির আগ পর্যন্ত কেউ জানতে না পারে। তারা তাদের এতদিন যাবৎ প্রতিরোধের ধরণে পরিবর্তন নিয়ে আসে যা পূর্বের সব সিদ্ধান্তের চেয়ে নিতান্ত ভয়াবহ ও লোমহর্ষক। এটা ছিল কুরাইশদের চক্রান্ত। অন্যদিকে আল্লাহ তা’আলাও কৌশল অবলম্বন করলেন। তাদেরকে এমনভাবে ব্যর্থ করে দেয়া হলো যে তারা বুঝতেও পারল না। তখন জিবরাঈল (আঃ) মহান ও বরকতময় প্রভুর তরফ থেকে আল্লাহর বাণী নিয়ে তার সম্মুখে উপস্থিত হলেন এবং তাকে কুরাইশ মুশরিকদের ষড়যন্ত্রের কথা জনালেন। তিনি বললেন যে, ‘আপনার প্রভু পরওয়ারদেগার মক্কা থেকে হিজরত করার অনুমতি প্রদান করেছেন জিবরাঈল (আঃ) তাঁকে হিজরতের সময় নির্ধারণ করে দিলেন এবং কুরাইশদের কিভাবে প্রতিহত করতে হবে তা বলে দিলেন। অতঃপর বললেন, আপনি এ যাবৎ যে শয্যায় শয়ন করে এসেছেন আজ রাত্রে সে শয্যায় শয়ন করবেন না।[1]

হিজরত সংক্রান্ত আল্লাহর বাণী প্রাপ্ত হওয়ার পর নাবী কারীম (ﷺ) ঠিক দুপুরে আবূ বাকর (রাঃ)-এর গৃহে তশরীফ আনয়ন করলেন। উদ্দেশ্য ছিল, হিজরতের সময় এবং পন্থা প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। ‘আয়িশাহ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, ‘আমরা আব্বাস (আবূ বাকর (রাঃ)-এর) বাড়ীতে ঠিক দুপুরে বসেছিলাম তখন এক ব্যক্তি এসে খবর দিল যে, নাবী কারীম (ﷺ) মাথা ঢেকে আগমন করছেন। এটা দিবা ভাগের এমন সময় ছিল যে সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাধারণতঃ কোথাও যেতেন না। আবূ বাকর (রাঃ) বললেন ‘আমার মাতা-পিতা আপনার জন্য কোরবান হোক, আপনি এ সময় কোন্ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনার জন্য আগমন করেছেন?’

‘আয়িশাহ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ভিতরে আসার অনুমতি চাইলেন, তাঁকে ভিতরে আসার অনুমতি দেয়া হলে তিনি ভিতরে প্রবেশ করলেন। তারপর আবূ বাকর (রাঃ)-কে বললেন, ‘আপনার কাছে যে সকল লোক রয়েছে তাদের সরিয়ে দিন।’

আবূ বাকর বললেন, ‘যথেষ্ট, আপনার গৃহিনী ছাড়া এখানে আর কেউই নেই। আপনার প্রতি আমার মাতা-পিতা কুরবান হোক, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)।

তিনি বললেন, ‘ভাল, হিজরত করার জন্য আল্লাহ রাববুল আলামীনের তরফ থেকে আমাকে অনুমতি প্রদান করা হয়েছে।

আবূ বাকর বললেন, ‘সাথে… হে আল্লাহর (ﷺ)! আপনার প্রতি আমার পিতামাতা উৎসর্গ হোক।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘হ্যাঁ’’।

তারপর হিজরতের সময় সূচী নির্ধারণ করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আপন গৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন এবং রাতের আগমনের জন্য প্রতীক্ষারত রইলেন। তিনি (ﷺ) এ দিন এমনভাবে প্রস্তুতি নিলেন যে, হিজরতের উদ্দেশ্যে তাঁর প্রস্তুতির কথা কেউ জানতে পারল না। নচেৎ জানতে পারলে অন্য যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে কুরাইশরা দ্বিধাবোধ করতো না।

[1] ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ৪৮২ পৃঃ। যাদুল মাদ ২য় খণ্ড ৫২ পৃঃ।

 রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বাড়ি ঘেরাও (تَطْوِيْقُ مَنْزِلِ الرَّسُوْلِ ﷺ):

এক দিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন হিজরতের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকলেন, অন্য দিকে মক্কার পাপিষ্ঠরা দারুন নাদওয়ার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকল। উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নিম্ন তালিকাভুক্ত এগার জন পাপীষ্ঠকে নির্বাচন করা হল। তাদের নাম হচ্ছে যথাক্রমেঃ

(১) আবূ জাহল বিন হিশাম, (২) হাকাম বিন আবীল ‘আস, (৩) উক্ববা বিন আবূ মু’আইত্ব, (৪) নাযর বিন হারিস (৫) উমাইয়া বিন খাআফ, (৬) যাম’আহ বিন আসওয়াদ, (৭) তু’আইইমা বিন আদী, (৮) আবূ লাহাব, (৯) উবাই বিন খালাফ, (১০) নুবাইহ বিন হাজ্জাজ এবং তার ভাই (১১) মুনাব্বিহ বিন হাজ্জাজ।[1]

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর স্বভাবগত অভ্যাস ছিল তিনি এশার সালাত পর রাত্রের প্রথম প্রহরে ঘুমিয়ে যেতেন এবং অর্ধ রাত্রিতে জেগে মাসজিদুল হারামে চলে যেতেন। তিনি (ﷺ) সেখানে তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করতেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ‘আলী (রাঃ)-কে বললেন, ‘তুমি আমার এ সবুজ হাযরামী[2] চাদর গায়ে দিয়ে আমার বিছানায় ঘুমিয়ে থাক। তারা তোমার ক্ষতি করতে পারবে না।

অতঃপর রাতের এক তৃতীয়াংশ গত হলো, ধরনীতে নিস্তব্ধতা নেমে এল এবং অধিকাংশ মানুষ ঘুমিয়ে পড়ল- এমন সময় উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গ অতি গোপনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বাড়িতে হাজির হলো। তাঁকে বাধা দেওয়ার জন্য তারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ঘরের দরজায় অবস্থান করলো। তাদের ধারণা ছিল, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঘুমিয়ে আছেন, তিনি যখনই বেন হবেন তারা তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের চক্রান্ত বাস্তবায়ন করবে।

তাদের এ ঘৃণ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়ণ ও কার্যকর করার ব্যাপারে তাদের অবস্থা এতই দৃঢ় ছিল যে, কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা কেল­াহ ফতেহ করে দেবে। আবূ জাহল চরম অহংকার, উপহাস ও তাচ্ছিল্যের সঙ্গে নাবী (ﷺ)-এর গৃহ ঘেরাওকারী আপন সঙ্গীদের বলল, ‘মুহাম্মাদ (ﷺ) বলছে যে, যদি তোমরা তার ধর্মে প্রবেশ কর, তার অনুসরণ কর তাহলে অনারবদের উপর আরবদের শাসন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। মৃত্যুর পরে আবার যখন তোমাদের উঠানো হবে তখন উরদুনের বাগান সমূহের মতো বাগান দেয়া হবে। আর যদি তোমরা তা না কর তাহলে তার পক্ষ থেকে তোমাদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালানো হবে। আর এ অবস্থায় মৃত্যুর পর আবার যখন তোমাদের উঠানো হবে তখন ঠিকানা হবে জাহান্নাম। সেখানে না কি অনন্ত কাল জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে হবে।[3]

যাহোক, জঘন্যতম এ পাপাচার অনুষ্ঠানের জন্য নির্ধারিত সময় ছিল রাত দুপুরের পরক্ষণ। এ জন্য তারা রাত জেগে সময় কাটাচ্ছিল এবং নির্ধারিত সময়ের জন্য প্রতীক্ষারত ছিল। কিন্তু আল্লাহর ব্যবস্থাই হচ্ছে চূড়ান্ত এবং তাঁর বিজয়ই হচ্ছে প্রকৃত বিজয়। তাঁরই একক এখতিয়ারে রয়েছে আসমান ও জমিনের একচ্ছত্র আধিপত্য। তিনি যা চান তাই করেন। তিনি যাঁকে বাঁচাতে চান কেউই তাঁর কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারে না। আবার তিনি যাকে পাকড়াও করতে চান পৃথিবীর কোন শক্তিই তাকে রক্ষা করতে পারে না। এ প্রসঙ্গে নিম্নের আয়াতে কারীমায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে সম্বোধন করে বলা হয়েছে,

‏(‏وَإِذْ يَمْكُرُ بِكَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا لِيُثْبِتُوْكَ أَوْ يَقْتُلُوْكَ أَوْ يُخْرِجُوْكَ وَيَمْكُرُوْنَ وَيَمْكُرُ اللهُ وَاللهُ خَيْرُ الْمَاكِرِيْنَ‏)‏ ‏[‏الأنفال‏:‏30]‏‏.‏

‘‘স্মরণ কর, সেই সময়ের কথা যখন কাফিরগণ তোমাকে বন্দী করার কিংবা হত্যা করার কিংবা দেশ থেকে বের করে দেয়ার জন্য ষড়যন্ত্র করে। তারা চক্রান্ত করে আর আল্লাহ্ও কৌশল করেন। আল্লাহ্ই সর্বশ্রেষ্ঠ কৌশলী।’ (আল-আনফাল ৮ : ৩০)

[1] যা’দুল মাহদ ২য় খন্ড ৫২ পৃঃ।

[2]
হাযমারাউতের (দক্ষিণ ইয়েমেনের) তৈরি চাদরকে হাযরামী চাদর বলা হয়।

[3]
প্রাগুক্ত ১ম খন্ড ৪৮৩ পৃঃ।

 হিজরতের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর গৃহত্যাগ (الرَّسُوْلُ ﷺ يُغَادِرُ بَيْتَهُ):

কুরাইশ মুশরিকগণ তাদের দুরভিসন্ধি বাস্তবায়নের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েও চরমভাবে ব্যর্থ হয়ে গেল। উন্মত্ত জিঘাংসু শত্রু পরিবেষ্টিত রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আলী (রাঃ)-কে বললেন, ‘তুমি আমার এ সবুজ হাযরামী[1] চাদর গায়ে দিয়ে আমার বিছানায় ঘুমিয়ে থাক। তারা তোমার ক্ষতি করতে পারবে না। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এ চাদর গায়ে দিয়েই শুয়ে থাকতেন।[2]

তারপর নাবী কারীম (ﷺ) গৃহের বাহিরে গমন করলেন এবং মুশরিকদের কাতার ফেড়ে এক মুষ্টি কংকরযুক্ত মাটি নিয়ে তাদের মাথার উপর ছড়িয়ে দিলেন। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাদের দৃষ্টি দরে রাখলেন যার ফলে তারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে আর দেখতে পেল না। এ সময় তিনি এ আয়াত কারীমাটি পাঠ করছিলেন,

‏(‏وَجَعَلْنَا مِن بَيْنِ أَيْدِيْهِمْ سَدًّا وَمِنْ خَلْفِهِمْ سَدًّا فَأَغْشَيْنَاهُمْ فَهُمْ لاَ يُبْصِرُوْنَ‏)‏ ‏[‏يس‏:‏9‏]

‘‘তাদের সামনে আমি একটা (বাধার) প্রাচীর দাঁড় করিয়ে দিয়েছি, আর পেছনে একটা প্রাচীর, উপরন্তু তাদেরকে ঢেকে দিয়েছি; কাজেই তারা দেখতে পায় না।’ (ইয়া সীন ৩৬ : ৯)

এ সময় এমন কোন মুশরিক বাকি ছিল না যার মাথায় তিনি মাটি নিক্ষেপ করেন নি। এরপর তিনি আবূ বাকর (রাঃ)-এর গৃহে গমন করলেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে সঙ্গে নিয়ে ইয়ামান অভিমুখে যাত্রা করলেন। তারপর রাতের অন্ধকার থাকতেই তাঁরা মক্কা থেকে কয়েক মাইল দূরত্বে ‘সাওর’ নামক পর্বত গুহায় গিয়ে পৌঁছলেন।[3]

এদিকে অবরোধকারীরা রাত ১২ টার অপেক্ষা করছিল। কিন্তু তার আগেই তাদের নিকট তাদের ব্যর্থতা ও অক্ষমতার সংবাদ পৌঁছে গেল। অবস্থা হল এই যে, তাদের নিকট এক আগন্তুক এসে তাদেরকে সাঃ-এর দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল ‘আপনারা কিসের জন্য অপেক্ষা করছেন? তারা বলল, ‘আমরা মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে খতম করার অপেক্ষায় রয়েছি।

সে বলল, ‘উদ্দেশ্য সাধনে তোমরা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছ। আল্লাহর কসম! কিছুক্ষণ পূর্বে মুহাম্মাদ (ﷺ) তোমাদের সম্মুখ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছেন। যাওয়ার পূর্বে তিনি তোমাদের মাথার উপর এক মুষ্টি মৃত্তিকা ছড়িয়ে দিয়ে গিয়েছেন।’

তারা বলল, ‘আল্লাহর কসম! আমরা তো তাকে দেখিনি। এ বলে তারা মাথা ঝাড়তে ঝাড়তে দাঁড়িয়ে পড়ল। এরপর দারুণ হতাশা ও ক্রোধের সঙ্গে তারা দরজার ফাঁক-ফোকর দিয়ে গৃহের মধ্যে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে থাকল। চাদর জড়ানো অবস্থায় শায়িত আলী (রাঃ) দৃষ্টি গোচর হলে তারা বলতে লাগল, ‘আল্লাহর কসম! এই তো মুহাম্মাদ (ﷺ) শুয়ে আছে।’ তিনি শুয়ে আছেন এ ভ্রান্ত বিশ্বাস নিয়েই তারা সেখানে সকালের জন্য অপেক্ষা করতে থাকল। এ দিকে যখন সকাল হল এবং আলী (রাঃ) বিছানা ছেড়ে উঠলেন তখন তারা বুঝতে পারল যে, সত্যি সত্যিই মুহাম্মাদ (ﷺ)-নেই। তারা অত্যন্ত ক্রদ্ধ এবং বিক্ষুব্ধ কণ্ঠে আলী (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করল, ‘মুহাম্মাদ (ﷺ) কোথায়’’? হযরত আলী (রাঃ) বললেন, ‘‘আমি জানিনা।’’

[1] হাযমারাউতের (দক্ষিণ ইয়েমেনের) তৈরি চাদরকে হাযরামী চাদর বলা হয়।

[2]
ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৮২-৪৮৩ পৃঃ।

[3]
ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৮৩ পৃঃ। যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৫২ পৃঃ।

 গৃহ থেকে গুহা পর্যন্ত (مِنْ الدَّارِ إِلَى الْغَارِ):

রাসূলুল্লাহ ২৭শে সফর চতুর্দশ নবুওয়াত সাল মোতাবেক ১২/১৩ই সেপ্টেম্বর, ৬২২[1] খ্রিষ্টাব্দ মধ্যরাতের সামান্য কিছু সময় পর নিজ গৃহ থেকে বাহির হয়ে জান-মালের ব্যাপারে সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য সঙ্গী আবূ বাকর (রাঃ)-এর গৃহে গমন করেছিলেন এবং সেখান থেকে পিছনের একটি জানালা দিয়ে বাহির হয়ে দুজনই পথ বেয়ে অগ্রসর হতে থাকেন যাতে রাতের অন্ধকার থাকতেই তারা মক্কা নগরীর বাহিরে চলে যেতে সক্ষম হন। কারণ, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জানতেন যে, কুরাইশগণ তাঁকে দেখতে না পেলে সর্বশক্তি দিয়ে তার সন্ধানে লেগে পড়বে এবং সর্বপ্রথম যে রাস্তায় দৃষ্টি দেবে তা হচ্ছে মদীনার কর্মব্যস্ত রাস্তা যা উত্তর দিকে গেছে। এ জন্য তাঁরা সেই পথে যেতে থাকলেন যে পথটি ছিল সেই পথের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। অর্থাৎ ইয়ামান যাওয়ার পথ যা মক্কার দক্ষিণে দিকে অবস্থিত ছিল। এ পথ ধরে পাঁচ মাইল দূরত্ব অতিক্রম করে সুপ্রসিদ্ধ সওর পর্বতের পাদদেশে গিয়ে পৌঁছলেন। এ পর্বতটি ছিল খুব উঁচু, পর্বত শীর্ষে আরোহণের পথ ছিল অাঁকা-বাঁকা ও পাক জড়ানো। আরোহণের ব্যাপারটিও ছিল অত্যন্ত আয়াস-সাধ্য। এ পর্বত গাত্রের এখানে-সেখানে ছিল প্রচুর ধারালো পাথর যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পদযুগলকে ক্ষত-কিক্ষত করে ফেলেছিল। বলা হয়েছে যে, তিনি পদচিহ্ন গোপন করার জন্য আঙ্গুলের উপর ভর দিয়ে চলছিলেন। এ জন্য তাঁর পা জখম হয়েছিল। যাহোক, আবূ বাকর (রাঃ)-এর সহায়তায় তিনি পর্বতের শৃঙ্গদেশে অবস্থিত গুহার পাশে গিয়ে পৌঁছলেন। এ গুহাটিই ইতিহাসে ‘গারে সওর বা সওর গুহা’ নামে পরিচিত।[2]

[1] রাহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ৯৫ পৃঃ। সফরের মাস চতুর্দশ নবুওয়াত বর্ষের সময় হবে যখন বৎসর আরম্ভ হবে মুহারম মাসে। আর যদি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যে মাসে নবুওয়াত প্রাপ্ত হয়েছিলেন সে মাস থেকে বৎসর গণনা করা হয়ে থাকে তাহলে তা ছিল নবুওয়াত ত্রয়োদশ বর্ষের সফর মাসে। সাধারণ ইতিহাসবিদগণ প্রথম হিসাবটি গ্রহণ করেছেন। আর যাঁরা দ্বিতীয়টি গ্রহণ করেছেন, তাঁরা ঘটনার ক্রমধারায় ভুল করেছেন। আমি মুহাররম থেকে বছরের শুরু ধরেছি।

[2]
রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ৯৫ পৃঃ। শাইখ আবদুল্লাহ মুখাতসারুস ১৬৭ পৃঃ।

 গুহায় প্রবেশ (إِذْ هُمَا فِي الْغَارِ):

গুহার নিকট উপস্থিত হয়ে আবূ বাকর (রাঃ) বললেন, ‘আল্লাহর ওয়াস্তে আপনি এখন গুহায় প্রবেশ করবেন না। প্রথমে আমি প্রবেশ করে দেখি এখানে অসুবিধাজনক কোন কিছু আছে কিনা। যদি তেমন কিছু থাকে তাহলে প্রথমে তা আমার সম্মুখীন হবে এবং এর ফলে আপনাকে প্রাথমিক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে না। এ কথা বলার পর আবূ বাকর (রাঃ) গর্তের ভিতরে প্রবেশ করলেন এবং প্রথমে গর্তটি পরিষ্কার করে নিলেন। গর্তের এক পাশে কিছু ছিদ্র ছিল। নিজের কাপড় টুকরো টুকরো করে তিনি ছিদ্রপথের মুখগুলো বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু কাপড়ের টুকরোর ঘাটতির কারণে দুটো ছিদ্র মুখ বন্ধ করা সম্ভব হল না। আবূ বাকর (রাঃ) ছিদ্র দুটোর মুখে নিজ পদদ্বয় স্থাপন করার পর ভিতরে আগমনের জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট আরয করলেন। তিনি ভিতরে প্রবেশ করে আবূ বাকর (রাঃ)-এর উরুতে মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লেন।

এদিকে আবূ বাকর (রাঃ)-এর পায়ে ছিদ্র মধ্যস্থিত স্বর্প কিংবা বিচ্ছু কোন কিছুতে দংশন করল। তিনি বিষে কাতর হয়ে উঠলেন অথচ নড়াচড়া করলেন না এ ভয়ে যে, এর ফলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ঘুম ভেঙ্গে যেতে পারে। এদিকে বিষের তীব্রতায় তাঁর চক্ষু যুগল থেকে অশ্রু ঝরতে থাকল এবং সেই আশ্রু বিন্দু ঝরে পড়ল রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মুখমণ্ডলের উপর। এর ফলে তাঁর ঘুম ভেঙ্গে গেলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আবূ বাকর (রাঃ)! তোমার কী হয়েছে?’’

তিনি আরয করলেন, ‘আমার মাতা-পিতা আপনার জন্য কুরবান হউক, গর্তের ছিদ্র পথে কোন কিছু আমার পায়ে কামড় দিয়েছে। এ কথা শ্রবণের পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজের মুখ থেকে কিছুটা লালা নিয়ে সেই ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিলেন। ফলে আবূ বাকর (রাঃ)-এর দংশন জনিত বিষব্যথা দূরীভূত হল।[1] এ পর্বত গুহায় তাঁরা উভয়ে একাদিক্রমে তিন রাত্রি (শুক্র, শনি ও রবিবার রাত্রি) অবস্থান করলেন।[2] আবূ বাকর (রাঃ)-এর পুত্র আব্দুল্লাহও ঐ সময় একই সঙ্গে সেখানে রাত্রি যাপন করতেন। ‘আয়িশাহ (রাঃ)-এর বর্ণনাতে তিনি ছিলেন একজন কর্মঠ, বুদ্ধিমান ও ধীশক্তিসম্পন্ন যুবক। সকলের অগোচরে রাত গভীর হলে তিনি সেখানে যেতেন এবং সাহরী সময়ের পূর্বেই মক্কায় ফিরে এসে মক্কাবাসীগণের সঙ্গে মিলিত হতেন। এতে মনে হতো যেন তিনি মক্কাতেই রাত্রি যাপন করেছেন। গুহায় আত্মগোপনকারীগণের বিরুদ্ধে মুশরিকগণ যে সকল ষড়যন্ত্র করত তা অত্যন্ত সঙ্গোপনে তিনি তাঁদের নিকট পৌঁছিয়ে দিতেন।

এদিকে আবূ বাকর (রাঃ)-এর গোলাম ‘আমির বিন ফুহাইরা পর্বতের ময়দানে ছাগল চরাত এবং যখন রাত্রির এক অংশ অতিবাহিত হয়ে যেত তখন সে ছাগল নিয়ে গারে সওরের নিকটে যেত এবং আত্মগোপনকারী নাবী (ﷺ) এবং তাঁর সাহাবীকে (রাঃ) দুগ্ধ পান করাত। আবার প্রভাত হওয়ার প্রাক্কালে সে ছাগলের পাল নিয়ে দূরে চলে যেত। পরপর তিন রাত্রেই সে এরূপ করল।[3] অধিকন্তু, আব্দুল্লাহ বিন আবূ বকরের গমনাগমন পথে তাঁর পদ চিহ্নগুলো যাতে মিশে যায় তার জন্য ‘আমির বিন ফুহাইরা সেই পথে ছাগল খেদিয়ে নিয়ে যেত।[4]

[1] উমার বিন খাত্তাব থেকে ইমাম রাযীন একথা বর্ণনা করেছেন। রেওয়ায়েতে এটা আছে যে, মৃত্যুর প্রান্তকালে বিষ তাঁর দেহে প্রতিক্রিয়া করল এবং এটাই ছিল তাঁর মৃত্যুর প্রত্যক্ষ কারণ, মিশকাত ২য় খন্ড ৫৫৬ পৃঃ। বাবু মানাকেবে আবূ বকর দ্রঃ।

[2]
ফাতহুল বারী ৭ম খন্ড ৩৩৬ পৃঃ।

[3]
সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৫৫৩-৫৫৪ পৃঃ।

[4]
ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৮৬ পৃঃ।

 কুরাইশদের প্রচেষ্টা:

এদিকে কুরাইশদের অবস্থা এই ছিল যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে হত্যার উন্মাদনায় উন্মত্ত অবস্থায় রাত্রি অতিবাহিত করার পর প্রভাতে যখন তারা নিশ্চিতভাবে জানতে পারল যে, তিনি তাদের আয়ত্বের বাইরে চলে যেতে সক্ষম হয়েছেন, তখন তারা একদম দিশেহারা হয়ে পড়ল এবং ক্রোধের আতিশয্যে ফেটে পড়তে চাইল। তাদের ক্রোধের প্রথম শিকার হলেন আলী (রাঃ)। তাঁকে টেনে হিঁচড়ে ক্বাবা’হ গৃহ পর্যন্ত নিয়ে গেল এবং প্রায় এক ঘন্টা কাল যাবৎ তাঁর উপর নানাভাবে নির্যাতন চালাল যাতে তার নিকট থেকে তাঁদের দুজনের সম্পর্কে খোঁজ খবর কিছুটা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়।[1] কিন্তু তাঁর কাছ থেকে কোন সংবাদ গ্রহণ করা সম্ভব না হওয়ায় আবূ বাকর (রাঃ)-এর গৃহের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল এবং সেখানে গিয়ে দরজায় করাঘাত করল। দরজার করাঘাত শুনে আসমা বিনতে আবূ বাকর (রাঃ) বের হলেন। তারা তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার পিতা কোথায় আছেন?’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহই ভাল জানেন, আমি জানি না আববা কোথায় আছেন?’ এতে কমবখত খবীস আবূ জাহল তাঁর গন্ডদেশে এমন জোরে চপেটাঘাত করল যে, সে ব্যথার চোটে চিৎকার করে উঠল এবং তার কানের বালী খুলে পড়ে গেল।[2]

এরপর কুরাইশগণ একটি তড়িঘড়ি সভা করে সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল যে, তাঁদের ধরার জন্য অনতিবিলম্বে সম্ভাব্য সর্বপ্রকার ব্যবস্থা অবলম্বন করা হোক। ফলে মক্কা থেকে বেরিয়ে যে দিকে যত পথ গেছে সকল পথেই অত্যন্ত কড়া সশস্ত্র পাহারা বসিয়ে দেয়া হল। অধিকন্তু, সর্বত্র এ ঘোষণাও প্রচার করে দেয়া হল যে, যদি কেউ মুহাম্মাদ (ﷺ) এবং আবূ বাকর (ﷺ)-কে অথবা দুজনের যে কোন একজনকে জীবন্ত কিংবা মৃত অবস্থায় হাজির করতে পারবে তাকে একশত উষ্ট্রের সমন্বয়ে একটি অত্যন্ত মূল্যবান পুরষ্কার প্রদান করা হবে।[3]

এই প্রচারনার ফলে বিভিন্ন বাহনারোহী, পদাতিক ও পদচিহ্নবিশারদগণ অত্যন্ত জোরে শোরে অনুসন্ধান কাজ শুরু করে দিল। প্রান্তর, পর্বতমালা, শস্যভূমি, বিরান অঞ্চল সর্বত্রই তারা অনুসন্ধান কাজ চালিয়ে যেতে থাকল, কিন্তু ফল হল না কিছুই।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও আবূ বাকর (রাঃ) যে পর্বত গুহায় আত্মগোপন করে ছিলেন অনুসন্ধানকারীগণ সে গুহার প্রবেশ পথের পার্শ্বদেশে পৌঁছে গেল, কিন্তু আল্লাহ আপন কাজে জয়ী হলেন। সহীহুল বুখারী শরীফে আনাস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যে, ‘আবূ বাকর (রাঃ) বলেছেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সঙ্গে গুহায় থাকা অবস্থায় মাথা তুলে মানুষের পা দেখতে পেলাম।’ আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর নাবী (ﷺ) তাদের মধ্যে কেউ যদি শুধু নিজ দৃষ্টি নীচের দিকে নামায় তাহলেই আমাদেরকে দেখে ফেলবে।’

তিনি বললেন,‏[‏اُسْكُتْ يَا أَبَا بَكْرٍ، اِثْنَانِ، اللهُ ثَالِثُهُمَا‏]‏ ‘আবূ বাকর (রাঃ) চুপচাপ থাক। আমরা দুজন, আর তৃতীয় জন আছেন আল্লাহ তা‘আলা।’ অন্য একটি বর্ণনায় ভাষা এরূপ আছে, ‏[‏مَا ظَنُّكَ يَا أَبَا بَكْرٍ بِاِثْنَيْنِ اَللهُ ثَالِثُهُمَا] ‘হে আবূ বাকর (রাঃ) এরূপদুজন লোক সম্পর্কে তোমার কী ধারণা যাদের তৃতীয়জন হলেন আল্লাহ।[4]

প্রকৃত কথা হচ্ছে এটা ছিল একটি মো’জেযা (অলৌকিক ঘটনা) যা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নাবী (ﷺ)-কে প্রদান করেছিলেন। কাজেই অনুসন্ধানকারীগণ সে সময় ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হল যেখানে তিনি (ﷺ) ও তাদের মধ্যে ব্যবধান ছিল কয়েক ফুটেরও কম।

[1] রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ৯৬ পৃঃ।

[2]
ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৮৭ পৃঃ।

[3]
সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৫৫৪ পৃঃ।

[4]
সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৫১৬, ৫৫৮ পৃঃ। এক্ষেত্রে অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে যে, আবূ বকর (রাঃ)-এর অস্থিরতার কারণ নিজ প্রাণের ভয় নয় বরং এর একমাত্র কারণ ছিল যা রিওয়ায়েতে বর্ণনা করা হয়েছে যে, যখন আবূ বকর (রাঃ) পদরেখা বিশারদগণকে দেখেছিলেন তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সম্পর্কে তাঁর চিন্তা হল। তিনি বললেন, ‘আমি যদি মারা যাই তবে কেবলমাত্র আমি একজন লোকই মরব। কিন্তু যদি আপনাকে হত্যা করা হয়, তাহলে পুলো উম্মতটাই ধ্বংস হয়ে যাবে। সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছিলেন ‘চিন্তা করবেন না। অবশ্যই আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন। দ্রঃ শেখ আব্দুল্লাহ কৃত মুখতাসারুস সীরাহ ১৬৮ পৃঃ।

 মদীনার পথে (فِي الطَّرِيْقِ إِلَى الْمَدِيْنَةِ):

তিনদিন যাবৎ নিস্ফল দৌড়ঝাঁপ এবং খোঁজাখুঁজির পর যখন কুরাইশদের আকস্মিক প্রজ্জ্বলিত ক্রোধাগ্নি কিছুটা প্রশমিত হওয়ায় অনুসন্ধান কাজের মাত্রা মন্দীভূত হয়ে এল এবং তাদের উৎসাহ উদ্দীপনা কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ল তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং আবূ বাকর (রাঃ) মদীনার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করার জন্য সংকল্পবদ্ধ হলেন। আব্দুল্লাহ বিন আরীকাত লাইসী যিনি সাহারা জনমানবশুন্য পথ সম্পর্কে অভিজ্ঞ ছিলেন, মদীনায় পৌঁছিয়ে দেয়ার জন্য পূর্বে তাঁর সঙ্গে চুক্তি ও মজুরী নির্ধারিত হয়েছিল এবং তার নিকট দুটি বাহনও রাখা হয়েছিল। ঐ ব্যক্তি তখনো কুরাইশ মূর্তিপূজকদের দলভুক্ত থাকলেও পথ প্রদর্শক হিসেবে তাঁর উপর নির্ভর করার ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ ছিল না। তাঁর সঙ্গে এ মর্মে কথাবার্তা ছিল যে, তিন রাত্রি অতিবাহিত হওয়ার পর চতুর্থ রাত্রিতে বাহন দুটি নিয়ে তাকে গারে সওর পৌঁছতে হবে। সেই কথা মোতাবেক সোমবারের দিবাগত রাত্রিতে বাহন দুটি নিয়ে উপস্থিত হয়ে (সেটি ছিল ১ম হিজরী সনের রবিউল আওয়াল মাসের চাঁদনী রাত মোতাবেক ১৬ই সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিষ্টাব্দ) বললেন ইয়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ)! আমার বাহন দুটির মধ্যে একটি আপনি গ্রহণ করুন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, মূল্যের বিনিময়ে।

এদিকে আসমা বিনতে আবূ বাকর (রাঃ) সফরের সামগ্রী নিয়ে এলেন কিন্তু তাতে ঝুলানোর জন্য বন্ধনের রশি লাগাতে ভুলে গিয়েছিলেন। যখন যাত্রার সময় হয়ে এল এবং আসমা (রাঃ) সামগ্রী ঝুলাতে গিয়ে দেখলেন তাতে বন্ধন রশি নেই, তখন তিনি তাঁর কোমরবন্ধ খুললেন এবং তা দু ভাগে ভাগ করে ছিঁড়ে ফেললেন। তারপর এক অংশের সাহায্যে সামগ্রী ঝুলিয়ে দিলেন এবং দ্বিতীয় অংশের সাহায্যে কোমর বাঁধলেন। এ কারণেই তার উপাধি হয়েছিল যাতুন নিত্বাক্বাইন।[1]

এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও আবূ বাকর (রাঃ) উটের পিঠে আরোহণ করলেন। ‘আমর বিন ফুহায়রাও সঙ্গে ছিলেন। পথ প্রদর্শক আব্দুল্লাহ বিন আরীকাত মদীনা যাত্রার সাধারণ পথে না গিয়ে লোহিত সাগরের উপকূলের পথ ধরলেন। সর্বপ্রথম সওর গুহা হতে যাত্রা আরম্ভ করে তিনি (পথ প্রদর্শক) ইয়ামেনের পথে যাত্রা করলেন এবং দক্ষিণ দিকে অনেক দূর পর্যন্ত নিয়ে গেলেন। তার পরে পশ্চিমদিকে ঘুরে সমুদ্রোপকূলের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন। তারপরে এমন এক পথে নিয়ে গেলেন যে পথের সন্ধান সাধারণ লোকেরা জানত না। এরপর উত্তর দিকে মোড় নিলেন যে পথ লোহিত সাগরের খুব কাছাকাছি ছিল। এপথে খুব অল্প মানুষ চলাচল করত।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ পথে যে সকল স্থান দিয়ে অতিক্রম করেছিলেন ইবনে ইসহাক্ব তার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন পথপ্রদর্শক যখন তাদের দুজনকে নিয়ে বের হলেন তখন মক্কার নিম্নভূমি অঞ্চল দিয়ে নিয়ে গেলেন এরপর উপকূল দিয়ে চলতে চলতে ‘উসফানের নিম্ন দিয়ে পথ কাটলেন। এরপর আমাজের নিম্নদিয়ে এগিয়ে চললেন এবং কুদাইদ পার হয়ে রাস্তা কাটলেন। তারপর সান্নায়াতুল মাররাহ দিয়ে তারপরে লিক্বফ দিয়ে তার পরে লিক্বফের বিস্তৃতি ভূমি অতিক্রম করেন। তারপর হাজ্জাজের বিস্তৃীর্ণ ভূমিতে পৌঁছলেন এবং সেখান থেকে মিযাযের মোড় দিয়ে অতিক্রম করেন। তারপর যুল গুযওয়াইনের মোড়ের শস্য শ্যামল ভূমিতে যান। তারপরে যূ কাশর মাঠে প্রবেশ করে জুদাজাদের দিকে যান এবং সেখান থেকে আজরাদে পৌঁছেন। এরপর মাদজালাহ তি’হিনের বিস্তৃীর্ণ অঞ্চলের পাশ দিয়ে যু সালাম অতিক্রম করেন। সেখান থেকে আবাবীদ তাপরে ফাজহ অভিমুখে যাত্রা করেন। তারপরে ‘আরজে অবতরণ করলেন। তারপরে রকূবার ডান পার্শ্ব দিয়ে সান্নায়াতুল ‘আয়িরে গেলেন এবং রি’ম উপত্যকায় অবতরণ করেন। এরপরই কুবায় গিয়ে পৌঁছলেন।[2]

[1] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৫৫৩-৫৫৫ পৃঃ। ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৮৬ পৃঃ।

[2]
ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৯১-৪৯২ পৃঃ।

 পথে ঘটিত কতিপয় বিচ্ছিন্ন ঘটনা (وَهَاكَ بَعْضُ مَا وَقَعَ فِي الطَّرِيْقِ):

১. সহীহুল বুখারী শরীফে আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, ‘আমরা (গারে সওর থেকে বেরিয়ে) একটানা সারা রাত এবং পরের দিন দুপুর পর্যন্ত চলতে থাকলাম। রোদের প্রখরতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ক্রমান্বয়ে পথচারীর সংখ্যা কমতে থাকল এবং ঠিক দুপুরে পথ জনশূন্য হয়ে গেল। আমরা তখন দীর্ঘ বড় পাথর দেখতে পেলাম যার ছায়ায় তখনো রোদ আসেনি। আমরা সেখানে নেমে পড়লাম। আমি নিজ হাতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শয়নের জন্য একটি জায়গা সমতল করে দিলাম এবং সেখানে একখানা চাদর পেতে দিয়ে বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আপনি এখানে শয়ন করুন আর আমি আপনার আশ-পাশের সব কিছু দেখাশুনা করছি। তিনি শয়ন করলেন এবং আমি সামনে ও পেছনের খোঁজ খবর নেওয়া এবং দেখাশোনার জন্য বেরিয়ে পড়লাম। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম একজন রাখাল তার ছাগলের পাল নিয়ে পাথরের দিকে চলে আসছে। সেই পাথর থেকে সেও ঐ জিনিসই চাচ্ছে যা আমরা চেয়েছিলাম। আমি তাকে বললাম, ‘হে যুবক তুমি কার লোক?’

সে মক্কা অথবা মদীনার কোন লোকের কথা বলল। আমি তাকে বললাম, ‘তোমার ছাগীর ওলানে কি কিছু দুধ আছে?’ সে বলল, ‘হ্যাঁ’’। আমি পুনরায় বললাম, ‘সেটি কি দোহন করতে পারি?’ সে বলল, ‘হ্যাঁ’’। তারপর সে একটি ছাগী ধরে নিয়ে এল। আমি বললাম, ‘মাটি, খড়কুটো এবং লোম থেকে ওলানটা পরিষ্কার করে নাও। পরিষ্কার করে নেয়ার পর একটি পেয়ালায় অল্প কিছুটা দুধ দোহন করল। তারপর দুধটুকু আমি একটি চামড়ার পাত্রে ঢেলে নিলাম। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পানি এবং ওযুর জন্য ঐ পাত্রটি আমি সঙ্গে নিয়েছিলাম।

আমি দুগ্ধ পাত্র হাতে রাসূলুল্লাহর নিকট এসে দেখি তখনো তিনি ঘুমন্ত অবস্থায় রয়েছেন। কাজেই, তাকে ঘুম থেকে জগানোর সাহস হল না। তারপর যখন তিনি জাগ্রত হলেন তখন আমি দুধের মধ্যে কিছুটা পানি ঢেলে দিলাম যাতে দুধের তলদেশ ঠান্ডা হয়ে যায় এবং বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এ দুগ্ধটুকু পান করুন’’, তিনি পান করলেন। তাকে পান করানোর সুযোগ প্রদানের জন্য আনন্দ উদ্বেল চিত্তে আল্লাহর সমীপে শুকরিয়া আদায় করলাম।

দুগ্ধ পানের পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘এখনো কি যাত্রার সময় হয়নি?’

আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল কেন হবে না, যাত্রার উপযুক্ত সময় হয়েছে,’ তারপর আমরা পুনরায় যাত্রা শুরু করলাম।[1]

২. এই প্রবাস যাত্রাকালে আবূ বাকর (রাঃ) সাধারণতঃ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর রাদীফ থাকতেন। অর্থাৎ তিনি বাহনে নাবী (ﷺ)-এর পিছনে বসতেন। তিনি পিছনে বসতেন এ কারণে যে, তার মধ্যে বার্ধক্যের চিহ্ন প্রকাশ পেয়েছিল এবং মানুষের দৃষ্টি প্রথমেই তার উপরেই পড়তো। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মধ্যে তখনো যৌবনের চিহ্ন পরিষ্ফুট ছিল এজন্য তার প্রতি মানুষের দৃষ্টি অপেক্ষাকৃত কম যেতো। এর ফল ছিল কোন লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে সে আবূ বাকর (রাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করত আপনার সম্মুখের লোকটি কে? আবূ বাকর (রাঃ)-এর এক অত্যন্ত সূক্ষ্ণ উত্তর প্রদান করতেন। বলতেন, ‘এই লোকটি আমাকে পথ বলে দিচ্ছেন। এতে লোকেরা সহজভাবে পথের কথাই বুঝতেন। কিন্তু এ কথার মাধ্যমে তিনি কল্যাণের পথকেই বোঝাতে চেয়েছেন।[2]

৩. এই প্রবাস যাত্রাকালে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) খুযা’আহ গোত্রের উম্মু মা’বাদের তাঁবুদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করেন। ইনি একজন নামকরা স্বাস্থ্যবান মহিলা ছিলেন। হাতে হাঁটু ধারণ করে তাঁবুর অঙ্গনে বসে থাকতেন এবং গমনাগমনকারীদেরকে পানাহার করাতেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন আপনার নিকট কিছু আছে? তিনি বললেন, ‘আমার নিকট যদি কিছু থাকত তাহলে আল্লাহর ওয়াস্তে আপনাদের মেহমানদারীতে কোন প্রকার ত্রুটি হতো না। ঘরে তেমন কিছুই নেই, বকরীগুলোও রয়েছে দূরদূরান্তে। সময়টা ছিল দূর্ভিক্ষ কবলিত।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দেখলেন তাঁবুর এক কোনে একটি বকরী রয়েছে।

তিনি বললেন, ‘হে উম্মু মা’বাদ, এটা কেমন বকরী? মহিলা বললেন, ওর দুর্বলতার কারণে ওকে দলের বাহিরে রাখা হয়েছে। নাবী (ﷺ) বললেন ওর ওলানে কি কিছু দুধ আছে? তিনি বললেন, ‘দুধ দানের মতো তার কোন শক্তিই নেই।’ নাবী (ﷺ) বললেন, ‘অনুমতি দিলে আমি তাকে দোহন করি’’।

মহিলা বললেন, ‘হ্যাঁ’’, আমার মাতা-পিতা আপনার জন্য কুরবান হোক। যদি আপনি ওলানে দুধ দেখতে পান তবে অবশ্যই দোহন করবেন।’

এ কথাবার্তার পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বকরীটির ওলানের উপর হাত ফিরালেন, আল্লাহর নাম নিলেন এবং দু’আ করলেন। তারপর বকরীটা তার পেছনের পা দুটি বিস্তার করল এবং তার ওলান দুধে ভরপুর হয়ে উঠল।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উম্মু মা’বাদের বেশ বড় আকারের একটি পাত্র নিলেন এবং এত পরিমাণ দুধ দোহন করলেন যে, দুধের ফেনা পাত্রের উপরে উঠে গেল। দুধ দোহনের পর উম্মু মা’বাদকে পান করালেন। তিনি দুগ্ধপানে পূর্ণরূপে পরিতৃপ্ত হলেন। তারপর সঙ্গী সাথীদের পান করালেন। পূর্ণ পরিতৃপ্তির সঙ্গে সকলকে পান করানোর পর তিনি নিজে পান করলেন। দ্বিতীয় বারেও তিনি এত পরিমাণ দুধ দোহন করলেন যে, পাত্র ভরে গেল। এ দুগ্ধ উম্মু মা’বাদের নিকট রেখে দিয়ে তিনি সঙ্গীদের সহ মদীনার পথে অগ্রসর হলেন।

অল্পক্ষণ পরেই তাঁর স্বামী আবূ মা’বাদ আপন দুর্বল বকরী যা দুর্বলতা হেতু ধীরে ধীরে পায়ে হাঁটছিল হাঁকাতে হাঁকাতে এসে পৌঁছল। পাত্রভর্তি দুধ দেখে তিনি বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়লেন। তাঁর সহধর্মিনীকে জিজ্ঞেস করলেন, এ দুধ তুমি কোথায় পেলে? সে ক্ষেত্রে দুগ্ধবতী বকরীগুলো দূর চারণ ভূমিতে ছিল এবং বাড়িতে কোন দুগ্ধবতী বকরীই ছিলনা, সেক্ষেত্রে পাত্রে এত দুধ এল কোথায় থেকে?

স্ত্রী উম্মু মা’বাদ তাঁর স্বামীকে সেই বরকতময় মেহমানের কথা জানালেন যিনি পথ চলার সময় তাঁর গৃহে আগমন করেন এবং যেভাবে যা ঘটেছিল তা সবিস্তারে বর্ণনা করলেন। এ সব কথা শ্রবণের পর স্বামী আবূ মা’বাদ বললেন, ‘একে তো ঠিক সেই লোক বলে মনে হচ্ছে যাঁকে কুরাইশগণ খুঁজে বেড়াচ্ছেন।’ আবূ মা’বাদ পুনরায় তাঁর স্ত্রীকে বললেন, ‘আচ্ছা তাঁর আকৃতি প্রকৃতি বর্ণনা কর দেখি।’

স্বামীর এ কথা শ্রবণের পর উম্মু মা’বাদ অত্যন্ত জীবন্ত ও আকর্ষণীয়ভাবে তাঁর গুণাবলী ও যোগ্যতার এমন একটি নকশা অংকণ করলেন তাতে মনে হল শ্রবণকারীগণ যেন তাঁকে চোখের সম্মুখেই দেখছে (কিতাবের শেষ ভাগে সেই গুণগুলোর কথা উল্লে­খিত হবে)। মেহমানের এ সকল গুণের কথা অবগত হয়ে আবূ মা’বাদ বললেন, ‘আল্লাহর শপথ! ইনি তো কুরাইশদের সেই সাথী লোকেরা যাঁর সম্পর্কে বিভিন্ন প্রকার কথা বলছেন। আমার ইচ্ছা তাঁর বন্ধুত্ব গ্রহণ করি এবং যদি কোন পথ পাই তাহলে অবশ্যই তা করব। এদিকে মক্কায় একটি ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়ছে যা মানুষ শুনতে পাচ্ছে কিন্তু বক্তাকে দেখতে পাচ্ছে না। কথাগুলো ছিল এরূপ :

جزى الله رب العرش خير جزائـه ** رفيقين حَلاَّ خيمــتى أم مَعْبَـدِ

هـمـا نزلا بالبِــرِّ وارتحلا بـه ** وأفلح من أمسى رفيق محمــد

فيا لقُصَىّ مــا زَوَى الله عنكـم ** به من فعال لا يُحَاذى وسُــؤْدُد

لِيَهْنِ بني كعـب مكــان فَتاتِهـم ** ومقعدُهـا للمؤمنـين بَمْرصَـد

سَلُوْا أختكم عن شاتهـا وإنائهـا ** فإنكم إن تسألوا الشاة تَشْـهَـد

অর্থঃ আরশের প্রভূ আল্লাহ ঐ দু’বন্ধুকে উত্তম পুরষ্কার দেন যারা উম্মু মা’বাদের তাঁবুতে অবতরণ করেছিলেন। তারা দুজনে কল্যাণের সঙ্গে অবতরণ করেছেন এবং কল্যাণের সঙ্গে গমন করেছেন। যিনি মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর বন্ধু হয়েছেন, তিনি সফলকাম হয়েছেন। হায় কুসাই! আল্লাহ তোমাদের থেকে কত নজিরবিহীন কার্যকলাপ ও নেতৃত্ব গুটিয়ে নিয়ে তাদেরকে দিয়েছেন, অর্থাৎ বনু কা‘বদেরকে, ওদের মহিলাবর্গের অবস্থান স্থল এবং মুমিনদের সেনাচৌকী বরকতময় হোক। তোমরা নিজ ভগ্নিদেরকে তাদের পাত্র এবং বকরী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো। তুমি যদি স্বয়ং বকরীদেরকেও জিজ্ঞেস কর তবে তারাও সাক্ষ্য দেবে।

আসমা (রাঃ) বলছেন, ‘আমরা জানতাম না যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কোন্ দিকে গমন করেছেন। ইতোমধ্যে একজন মক্কার নিম্নভূমি থেকে এ কবিতা পাঠ করতে করতে এল। মানুষ তার পিছনে পিছনে চলছিল, তার কথা শুনছিল, কিন্তু তাকে কেউই দেখতে পাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত সে মক্কার উচ্চভূমি থেকে বের হয়ে গেল।’

তিনি বলেন, ‘আমরা যখন তাঁর কথা শুনলাম তখন বুঝতে পারলাম রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কোন দিকে গমন করেছেন। অর্থাৎ তিনি গমন করেছেন মদীনার দিকে।[3]

৪. সুরাক্বাহ বিন মালিক পথের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিছু ধাওয়া করে। এ ঘটনা সুরাক্বাহ নিজেই বর্ণনা করেছে। সে বলেছে, ‘আমি নিজ সম্প্রদায় বনী মুদলিজের এক সভায় বসেছিলাম। ইতোমধ্যে একজন লোক আমার পাশে এসে দাঁড়াল। সে বলল, ‘হে সুরাক্বাহ! আমি কিছুক্ষণ পূর্বে উপকূলে কতিপয় লোককে দেখলাম। আমার ধারণা এরা হবেন মুহাম্মাদ (ﷺ) এবং তাঁর সঙ্গীগণ।’

সুরাক্বাহ বলেন, ‘আমি বুঝে গেলাম যে, এরা তাঁরাই।’ কিন্তু ঐ লোকটির ধারণা পালটিয়ে দেয়ার জন্য তাকে বললাম, ‘এরা তারা নয়। বরং তুমি অমুক অমুককে দেখেছ যারা আমার চোখের সম্মুখ দিয়ে অতিক্রম করল।’

‘এরপর সভাস্থানে সামান্য সময় অপেক্ষা করে অন্দর মহলে চলে গেলাম এবং নিজ দাসীকে নির্দেশ দিলাম আস্তাবল থেকে আমার ঘোড়াটি বের করে নিয়ে গিয়ে ঢিবির পিছনে আমার জন্য অপেক্ষা করতে। এদিকে আমি নিজ তীর গ্রহণ করলাম এবং বাড়ির পিছন দরজা দিয়ে বের হলাম। এ সময় আমার হাতের লাঠিটির এক মাথা মাটির সঙ্গে ঘর্ষণ খাচ্ছিল এবং অন্য মাথা নীচু করে রাখা ছিল। এ অবস্থায় আমি নিজ ঘোড়ার নিকট গিয়ে তার উপর আরোহণ করলাম। তারপর লোকটির কথিত দিক লক্ষ্য করে ঘোড়া ছুটিয়ে চললাম।’

‘‘আমি দেখলাম সে আমাকে নিয়ে স্বাভাবিকভাবে ছুটছে। এক পর্যায়ে আমি তাদের নিকটবর্তী হয়ে গেলাম, কিন্তু আকস্মিকভাবে আমাকে সমেত ঘোড়ার পা পিছলিয়ে যাওয়ায় আমি ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেলাম। আমি উঠে দাঁড়িয়ে তুনের দিকে হাত বাড়ালাম এবং পাশার তীর বের করে জানতে চাইলাম যে, তাঁকে বিপদে ফেলতে পারব কিনা। কিন্তু যে তীরটি বেরিয়ে আসল সেটা আমার অপছন্দনীয়। কিন্তু আমি তীরের সাংকেতিক অভিব্যক্তি এড়িয়ে অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করলাম। সে আমাকে নিয়ে ছুটতে লাগল এবং এক পর্যায়ে নাবী (ﷺ)-এর কণ্ঠ নিঃসৃত কুরআনের পাঠ আমার কর্ণকূহরে প্রবিষ্ট হল। তিনি কোন সময়ের জন্যও পিছনে ফিরে তাকান নি। কিন্তু আবূ বাকর (রাঃ) বার বার পিছনে ফিরে তাকাচ্ছিলেন।

আর সামান্য পথ অতিক্রম হলে তাঁদের পথ রোধ করতে পারি এমন এক অবস্থায় আকস্মিকভাবে আমার ঘোড়ার পা হাঁটু পর্যন্ত মাটিতে ঢুকে গেল। এতে আমি তার পিঠ থেকে ছিটকে পড়ে গেলাম। আমি অবস্থাটা সামলিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াবার জন্য ঘোড়াটিকে ধমকা-ধমকি শুরু করলাম। আমার ধমক খেয়ে সে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল কিন্তু সহজে তা পারল না। অবশেষে অনেক কষ্ট করে সে পা টেনে বের করল। কিন্তু সে যখন বহু কষ্টের পর উঠে দাঁড়াল তখন তার পদচিহ্ন থেকে আসমানের দিকে ধোঁয়ার মতো ধূলি প্রবাহের সৃষ্টি হয়েছিল।

আমি আবার পাশার তীর থেকে আমার ভাগ্যান্বেষণের ইঙ্গিত সম্পর্কে জানতে চাইলাম। কিন্তু আবার ঐ তীরটিই বাহির হল, যা আমার অপছন্দনীয় ছিল। এরপর আমি তাঁদের নিরাপত্তা চেয়ে আহবান জানালে তাঁরা থেমে গেলেন। আমি ঘোড়া খেদিয়ে তাঁদের নিকট পৌঁছলাম। যখন আমি তাঁদেরকে থামিয়ে ছিলাম তখনই আমার মনে এ কথাটা গেঁথে গিয়েছিল যে, মুহাম্মাদ (ﷺ)-ই শেষ পর্যন্ত জয়ী হবেন। এজন্য আমি তাকে বললাম যে, ‘আপনার সম্প্রদায় আপনার প্রাণের বিনিময়ে পুরষ্কার ঘোষণা করেছে’ এবং ঐ কথার সূত্রেই আমি তাঁকে মানুষের মনোভাব সম্পর্কে সতর্ক করে দিলাম। অধিকন্তু, কিছু খাদ্য-সামগ্রী এবং আসবাবপত্রেরও ব্যবস্থা করে দিতে চাইলাম। কিন্তু আমার কাছ থেকে কোন কিছুই গ্রহণ করলেন না এবং আমাকে কোন প্রশ্নও জিজ্ঞেস করলেন না। শুধু এ টুকুই বললেন যে, ‘আমাদের ব্যাপারে গোপনীয়তা রক্ষা করবেন।’ আমি আরয করলাম ‘আমাকে নিরাপত্তা পরওয়ানা লিখে দিন।’ তিনি ‘আমির বিন ফুহাইরাকে তা লিখে দেয়ার নির্দেশ প্রদান করায়। তিনি এক টুকরো চামড়ার উপর তা লিখে আমার হাতে দিলেন। তারপর নাবী (ﷺ)-এর দল সম্মুখে পানে অগ্রসর হলেন।[4]

এ ঘটনা সম্পর্কে খোদ আবূ বাকর (রাঃ)-এর এক রেওয়ায়েতে এর বর্ণনা রয়েছে যে, ‘আমাদের যাত্রা করার পর আমাদের স্বগোত্রীয় লোকজন অনুসন্ধান কাজে তৎপর হয়ে ওঠে, কিন্তু সুরাক্বাহ বিন মালিক বিন জু’শুম ছাড়া যারা নিজ ঘোড়ায় উঠেছিল তার কেউই আমাদের নাগাল পায়নি। আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমাদের পিছনে আগমনকারীরা আমাদেরকে পেয়ে যাবে।’

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন,

‏(‏لاَ تَحْزَنْ إِنَّ اللهَ مَعَنَا‏)‏ ‏[‏التوبة‏:‏40‏]

‘‘চিন্তার কোন কারণ নেই, আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সঙ্গেই আছেন।(আত্-তাওবাহ ৯ : ৪০)[5]

যাহোক, সুরাক্বাহ প্রত্যাবর্তন করে দেখে যে, লোকজন সব হন্যে হয়ে অনুসন্ধান কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সে তাদের বলল, ‘এ দিকের খোঁজ খবর আমি নিয়েছি। এদিকে তোমাদের যা কাজ ছিল তা যথারীতি করা হয়েছে। এভাবে সে লোকদের ফিরিয়ে নিয়ে গেল। দিনের প্রথম ভাগে যে ছিল আক্রমণকারী শত্রু, দিনের শেষ ভাগে সেই হল জীবন রক্ষাকারী বন্ধু।[6]

৫. পথে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ছোট্ট কাফেলার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় বুরাইদাহ বিন হুসাইব আসলামীর। সে ছিল নিজ সম্প্রদায়ের নেতা এবং শক্তিমান পুরুষ। তার সাথে প্রায় আশি জন লোক ছিল। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তার সঙ্গী সাথীগণও ইসলাম গ্রহণ করেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এশার সালাত আদায় করেন এবং এসব লোকেরাও তাঁর পেছনে সালাত আদায় করেন। বুরাইদাহ তার স্বীয় গোত্রের সঙ্গেই বসবাস করেন এবং উহুদ যুদ্ধের পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন।

আব্দুল্লাহ বিন বুরাইদাহ বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ফাল বিশ্বাস করতেন কিন্তু ত্বিয়ারাহ (এর প্রকার ভাগ্য নির্ণয়) বিশ্বাস করতেন না। বুরাইদাহ (রাঃ) সত্তর জন লোকের এক কাফেলাসহ মদীনায় আগমন করেন। অতঃপর তারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করলে তাদের জিজ্ঞাসা করেন, তোমরা কোন কওমের লোক। তারা বললো আমরা আসলাম গোত্রের। এরপর আবূ বাকরকে বললেন, আমি নিরাপদ হলাম। অতঃপর তিনি (ﷺ) কোন গোত্রের? তারা বললো বনু সাহম গোত্রের। তিনি বললেন তোমার অংশ বের হয়ে গেছে।

৬. রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আবূ আওস তামীম বিন হাযার আসলামী অথবা আবূ তামীম আওস বিন হাযার আসলামীর নিকট দিয়ে আরয-এর হারশা ও জুহফাহর মধ্যবর্তী কাহদাওয়াত অতিক্রম করছিলেন। তাঁর পিঠের ব্যথার কারণে ধীরে পথ চলছিলেন। সে সময় তিনি (ﷺ) এবং আবূ বাকর (রাঃ) একই উটের সওয়ারী ছিলেন। আওস লোকজন তাঁকে সওয়ার জন্য একটা উট প্রদান করলেন এবং তাদের সাথে মাস’উদ নামক এক ক্রীতদাসকে সঙ্গে দিয়ে দিলেন। ক্রীতদাসকে বলে দিলেন যে, তাঁদের সাথে সাথে পথ চলবে। কক্ষনোই তাঁদের থেকে পৃথক হবে না। ফলে সে তাঁদের সাথে চলতে থাকলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁরা মদীনায় পৌছে গেলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মাসউদকে তার মনিবের নিকটে ফিরত পাঠালেন। আর তাকে এ নির্দেশ দিলেন যে, সে যেন আওস গোত্রের লোকেদের বলে যে, তারা যেন তাদের এ উটের গর্দানে গাধার ন্যায় দুটো আংটা পরিয়ে দেয় এবং উভয়ের মাঝে দুরত্ব রাখে। এটাই তাদের চিহ্ন। মুশরিকরা উহুদ প্রান্তরে উপস্থিত হলে আওস তার ক্রীতদাস মাসউদ বিন হুনাইদাহকে ‘আরয হতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দরবারে গিয়ে মুশরিকদের বিষয়ে খবর দেয়ার জন্য প্রেরণ করলেন। এ ঘটনাকে ইবনু মা’কূল ত্বাবারী থেকে বর্ণনা করেছেন।

তিনি রাসূলুলাহ (ﷺ)-এর মদীনায় আগমনের পর ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তিনি আরযে বসবাস করতেন।

৭. পথ চলার পরবর্তী পর্যায়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সঙ্গে যুবাইর বিন আওয়ামের সাক্ষাৎ হয়। মুসলিমগণের একটি বাণিজ্য কাফেলার সঙ্গে তিনি সিরিয়া থেকে প্রত্যাবর্তন করছিলেন। যুবাইর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও আবূ বাকর (রাঃ) কে সাদা কাপড় প্রদান করেন।[7]

[1] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৫১০ পৃঃ।

[2]
সহীহুল বুখারী আনাসহেত ১ম খন্ড ৫৫৬ পৃঃ।

[3]
যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৫৩-৫৪ পৃঃ। বনু খোযয়ার আবাদী অবস্থানের প্রতিদৃষ্টি রেখে কথাই অধিক গ্রহণযোগ্য যে, গটনাটি গার থেকে যাত্রা পরে ২য় দিনে সংঘটিত হয়েছিল।

[4]
সহীহুল বুখারী শরীফ ১ম খন্ড ৫৫৪ পৃঃ। বনী মুদলেজদের বাড়ি রাবেগের নিকটবর্তী ছিল। সুরাক্বাহ সেই সময় নাবী (সাঃ)-এর অনুসন্ধানে রত হয়েছিলেন যখন তিনি কুদাইদ থেকে উপরে যাচ্ছিলেন। যাদুল মা’আদ ২য় খন্ড ৫৩ পৃঃ। এটা অধিক গ্রহণযোগ্য কারণে যে, গুহা থেকে যাত্রার তৃতীয় দিবসে পিছু ধাওয়ার ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল।

[5]
সহীহুল বুখারী শরীফ, ১ম খন্ড ৫১৬ পৃঃ।

[6]
যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৫৩ পৃঃ।

[7]
সহীহুল বুখারী উরওয়াপুত্র যুবাইর থেকে ১ম খন্ড ৫৫৪ পৃঃ।

 কুবাতে আগমন (النُّزُوْلُ بِقُبَاءٍ):

৮ই রবিউল আওয়াল, ১৪ই নাবাবী সনে, অর্থাৎ ১ম হিজরী সন মোতাবেক ২৩ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কুবাতে আগমন করেন।[1]

‘উরওয়া বিন যুবাইরের বর্ণনায় রয়েছে যে, মদীনাবাসী মুসলিমগণ মক্কা থেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর রওয়ানা হওয়ার সংবাদ শুনেছিলেন এজন্য তাঁরা প্রত্যেক দিন সকালে বের হয়ে হাররার দিকে গমন করতেন এবং তার পথ চেয়ে থাকতেন। দুপুরে রোদ যখন অত্যন্ত প্রখর হয়ে উঠত তখন তাঁরা গৃহে ফিরতেন। এক দিবসে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর মুসলিমগণ যখন গৃহে ফিরে এলেন তখন একজন ইহুদী তাঁর নিজের কোন কাজে একটা টিবির উপর উঠলে সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং তার সঙ্গীদের দেখতে পায়। সাদা কাপড়ে আবৃত অবস্থায় তাঁরা যখন আসছিলেন তখন তাঁদের পোষাক হতে যেন চাঁদের কিরণ বিচ্ছুরিত হচ্ছিল। এ অবস্থা দেখে সে আত্মহারা হয়ে উচ্চ কণ্ঠে বলল, ‘ওগো আরবের লোকেরা! তোমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়েছে, তোমাদের বহু আকাঙ্ক্ষিত অতিথি ঐ যে এসে গেছেন।’ এ কথা শোনামাত্রই মুসলিমগণ অস্ত্রাগারে দৌড় দিলেন[2] এবং অস্ত্র শয্যায় সজ্জিত হয়ে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-কে স্বাগত জানানোর জন্য সমবেত হলেন।

ইবনুল কাইয়্যেম বলেছেন : এর মধ্যেই বণী ‘আমর বিন আউফ গোত্রের (কুবার বাসিন্দা) লোকজনদের শোরগোল উঁচু হয়ে উঠল এবং তাকবীর ধ্বনি শোনা গেল। মুসলিমগণ নাবী কারীম (ﷺ)-এর আগমনে তাঁকে খুশআমদেদ জানানোর উদ্দেশ্যে হর্ষোৎফুল্ল­ কণ্ঠে তাকবীর ধ্বনি দিতে দিতে সমবেত হতে থাকল। তিনি তাঁদের মাঝে এসে উপস্থিত হলে সকলে সম্মিলিতভাবে তাঁকে মুবারকবাদ জ্ঞাপন করলেন এবং চতুর্দিক থেকে পরিবেষ্টন করে দাঁড়ালেন। এ সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) শান্তির আবরণে আচ্ছাদিত ছিলেন এবং আল্লাহর বাণী অবতীর্ণ হচ্ছিল,

‏(‏فَإِنَّ اللهَ هُوَ مَوْلَاهُ وَجِبْرِيْلُ وَصَالِحُ الْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمَلَائِكَةُ بَعْدَ ذٰلِكَ ظَهِيْرٌ‏)‏ ‏[‏التحريم‏:‏4‏]

‘‘তবে (জেনে রেখ) আল্লাহ তার মালিক-মনিব-রক্ষক। আর এ ছাড়াও জিবরীল, নেক্কার মু’মিনগণ আর ফেরেশতাগণও তার সাহায্যকারী।’ (আত্-তাহরীম ৬৬ : ৪)

‘উরওয়া বিন যুবাইর (রাঃ)-এর বর্ণনা রয়েছে যে, লোকজনের সঙ্গে মিলিত হবার পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের সঙ্গে নিয়ে ডানদিকে ফিরলেন এবং ’’আমর বিন আওফ গোত্রে গমন করলেন। সে সময়টা ছিল রবিউল আওয়াল মাসের সোমবার। অতঃপর আবূ বকর (রাঃ) লোকেদের সাথে কথাবার্তা বলার জন্য দাঁড়ালেন আর রাসূল (ﷺ) চুপ করে বসে থাকলেন। সে সকল আনসার রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এখন পর্যন্ত দেখেন নি তারা একের পর এক আসতে থাকলেন তাঁকে স্বাগতম জানাতে।

অন্য বর্ণনায় রয়েছে, আবূ বকর (রাঃ) আগমন করলেন। এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ এর উপর সূর্যের তাপ লাগতে লাগল তখন আবূ বাকর (রাঃ) স্বীয় চাদর দিয়ে তাঁকে ছায়া দিলেন। ফলে লোকেরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে চিনে ফেললেন।

পুরো মদীনা যেন স্বাগতম জানানোর জন্য কুচকাওয়াজ করছিল। সে দিন এমনই একটা দিন ছিল মদীনার ইতিহাসে এমন দিন আর আসেনি।

রাসূলুল্লাহ কুলসুম বিন হাদাম এবং বলা যায় যে, সা’দ বিন খায়সামার বাড়ীতে অবস্থান করেছিলেন। এর মধ্যে প্রথম মতটি অধিক শক্তিশালী।

এদিকে আলী (রাঃ) মক্কায় তিন দিন অবস্থানের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট লোকদের গচ্ছিত আমানত আদায় করার পর পদদলে মদীনা অভিমুখে যাত্রা করলেন। তারপর মদীনায় পৌঁছে তিনি কুবায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন এবং কুলসুম বিন হাদামের বাড়িতেই অবস্থান করলেন।[3]

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কুবাতে চারদিন[4] (সোমবার, মঙ্গলবার, বুধ ও বৃহস্পতিবার) অথবা দশ দিন থেকে বেশী অথবা পৌঁছা ও যাত্রার দিন ছাড়া চবিবশ দিন অবস্থান করেন। আর এ সময়ের মধ্যেই মসজিদে কুবার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন এবং তাতে সালাতও আদায় করেন। তাঁর নবুওয়াত প্রাপ্তির পর এটা হচ্ছে সর্ব প্রথম মসজিদ যার বুনিয়াদ তাকওয়া (আল্লাহ ভীতির) উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পঞ্চম দিনে (অথবা দ্বাদশ দিনে অথবা চবিবশতম দিনে) শুক্রবারে তিনি আল্লাহর নির্দেশে আরোহণ করলেন। আবূ বাকর (রাঃ) তাঁর রাদীফ (পিছনে আরোহণকারী) ছিলেন। তিনি বনু নাজ্জারদেরকে (যাঁরা তাঁর মামাগোষ্ঠির ছিলেন) সংবাদ প্রেরণ করেছিলেন। ফলে তাঁরা তরবারী ধারণ করে উপস্থিত হলেন। তিনি তাঁদেরসহ মদীনার দিকে যাত্রা করলেন। তারপর বনু সালিম বিন আউফের আবাসস্থানে পৌঁছিলে জুমার সালাতের সময় হয়ে যায়। তিনি এ স্থানে বাতনে অদীতে জুমা পড়লেন। সেখানে এখনো মসজিদ রয়েছে। সেখানে মোট একশত লোক ছিলেন।[5]

[1] রহামাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ১০২ পৃঃ। সময় নাবী (সাঃ)-এর বয়স একেবারে কাঁটায় কাঁটায় ৫০ বছর হয়েছিল। আর যাঁরা তাঁর নবুওয়াত কাল ৯ই রবিউল আওয়াল ৪১ ফীল বর্ষ মানছেন তাঁদের কথা মোতাবেক নবুওয়াতের ঠিক ১৩ বছর পূর্ণ হয়েছিল। অবশ্য যাঁরা তাঁর নবুওয়াতের সময় কাল রমাযান ১৪ ফীল বর্ষ মানেন তাঁদের কথা মোতাবেক ১২ বছর ৫মাস কিংবা ২২ দিন হয়েছিল।

[2]
সহীহুল বুখারী শরীফ ১ম খন্ড ৫৫৫ পৃঃ।

[3]
যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৫৪ পৃঃ ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৯৩ পৃঃ। রহমতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ১০২ পৃঃ।

[4]
এটা ইবনে ইসহাক্বের রেওয়াতে। ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৯৪ পৃঃ। আল্লামা মানসুরপুরী এটাই গ্রহণ করেছেন। রাহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ১০২ পৃঃ দ্রঃ। কিন্তু সহীহুল বুখারীর একটি বর্ণনা রয়েছেন যে, নাবী কারীম (সাঃ) কুবাতে ২৪ দিন অবস্থান করেছিলেন। কিন্তু অন্য একটি বর্ণনায় আছে দশরাত হতে কয়েকদিন হতে বেশী ১/৫৫৫ অন্য এক (তৃতীয়) বর্ণনায় চৌদ্দ রাত ১/৫৬০ পৃঃ। ইবনুল কাইয়্যেম শেষ বর্ণনাটিকে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তিন নিজে ব্যাখ্যা করেছেন যে, নাবী (সাঃ) কুবাতে সোমবার পৌঁছেন এবং সেখান থেকে শুক্রবার যাত্রা করেন্ (যা’দুল মা’আদ) ২/৫৪ ৫৫ পৃঃ।) আর এটা জানা যায় যে, সোমবার আর জুমা (শুক্রবার) পৃথক পৃথক দু’সপ্তাহের ধরা হলে পৌঁছা যাত্রার দিন দুটি বাদ দিলে সর্ব মোট হচ্ছে ১০ দিন আর পদার্পণ যাত্রার দিন সহ হচ্ছে ১২ দিন। সর্বমোট চৌদ্দ দিন কিভাবে হবে?

[5]
সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৪৫৫-৫৬০ পৃঃ। যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৫৫ পৃঃ। ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৪৯৪ পৃঃ। রমহাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ১০২ পৃঃ।

 মদীনায় প্রবেশ (الدُّخُوْلُ فِي الْمَدِيْنَةِ):

জুমআর সালাত শেষে নাবী (ﷺ) মদীনায় প্রবেশ করলেন। ঐ দিন থেকেই এ শহরের নাম ইয়াসরিরের পরিবর্তে মদীনাতুররাসূল বা রাসূলের শহর হয়ে যায় সংক্ষেপে একে মদীনা বলা হয়ে থাকে। এটা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক ঐতিহাসিক দিবস। মদীনার অলিতে গলিতে সর্বত্র সেদিন তাকদীস ও তাহমীদের (পবিত্রতা ও প্রশংসার) গুঞ্জণ ধবনি শ্রুত হচ্ছিল। আনসারদের ছেলেমেয়েরা আনন্দ উদ্বেল কণ্ঠে নিন্মের কবিতার চরণগুলো সুর ও ঝংকার সহকারে গেয়ে বেড়াচ্ছিল।

طـلـع الـبــدر علـينا**مـن ثـنيــات الـوداع
وجـب الشـكـر علـين**مـــا دعــا لـلـه داع
أيـهـا المبـعـوث فـينا**جـئـت بـالأمـر المطاع

‘‘দক্ষিণ পাশের পাহাড় হতে পূর্ণিমার চন্দ্র আমাদের উপর উদিত হয়েছে।’

‘‘কি উত্তম ধর্ম ও শিক্ষা! আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা আমাদের প্রতি ওয়াজেব।’

তোমার নির্দেশ অনুসরণ করা ফরয। তোমার প্রেরণকারী হচ্ছেন কিবরিয়া (মহাপ্রভূ)[1]

আনসারগণ যদিও ধনী ছিলেন না, তবুও সকলের আশা ছিল যে, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) তার বাসাতেই অবস্থান করুন। ফলে তার উটনী আনসারদের যে বাড়ি কিংবা মহল্লার পাশ দিয়ে অতিক্রম করত সেখানকার লোকজন উটনীর লাগাম ধরে নিতেন এবং অনুরোধ করতেন যে, আসবাবপত্র, অস্ত্রশস্ত্র ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা প্রস্তুত রয়েছে, আগমন করুন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলতেন ‘উটনীর পথ ছেড়ে দাও। সে আল্লাহর পক্ষ থেকে নিদের্শিত রয়েছে। ফলে উটনী একটানা চলতে থাকল এবং ঐ স্থানে এসে বসে পড়ল যেখানে মসজিদে নাবাবী রয়েছে।

কিন্তু তিনি নীচে অবতরণ করলেন না। তারপর উটনী পুনরায় উঠে দাঁড়াল এবং কিছু দূরে গিয়ে ঘুরে ফিরে দেখার পর পূর্বের জাগাতেই এসে বসে পড়ল। এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নীচে অবতরণ করলেন। এটা ছিল তাঁর নানীর, অর্থাৎ বনু নাজ্জার গোত্রের মহল্লা। আর উটনীর জন্য ছিল এটা আল্লাহর তরফ থেকে নির্দেশনা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) চেয়েছিলেন তাঁর নানার গোত্রে অবস্থান করে তাঁদের মর্যাদা বৃদ্ধি করতে, সেই জন্যই এ ব্যবস্থা।

এখন বনু নাজ্জার গোত্রের লোকজনেরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে নিজ নিজ গৃহে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁর নিকট আবেদন নিবেদন শুরু করে দিলেন। কিন্তু আবূ আইউব আনসারী (রাঃ) উষ্ট্রের পালান উঠিয়ে নিলেন এবং বাড়িতে নিয়ে গেলেন। এতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলতে লাগলেন মানুষ তার পালানের সাথে রয়েছে। এদিকে আস’আদ বিন যুরারাহ (রাঃ) এসে উটনীর লাগাম ধরে নিলেন, ফলে উটনী তার নিকটেই রয়ে গেল।[2]

সহীহুল বুখারী শরীফে আদাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ‘কোন্ লোকের বাড়ি আমার থেকে নিকটে’’?

আইউব আনসারী (রাঃ) বলেন, ‘আমার বাড়ি, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এটা আমার বাড়ি আর এটা আমার দরজা।’

তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁকে বললেন, ‘যাও এবং আমার বিশ্রামের জায়গা ঠিক কর। তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং আবূ বাকর (রাঃ) দুজনকেই সেখানে যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানালেন।[3]

কিছুদিন পর নাবী পত্নী উম্মুল মু’মিনীন সওদা (রাঃ) এবং নাবী তনয়া ফাত্বিমাহ (রাঃ) ও উম্মুল কুলসুম (রাঃ) এবং উসামা বিন যায়দ (রাঃ) ও উম্মু আয়মান (রাঃ) মদীনায় গিয়ে পৌঁছলেন। এদের সকলকে আব্দুল্লাহ বিন আবূ বাকর (রাঃ)- আবূ বকরের আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে যাদের মধ্যে ‘আয়িশাহও ছিলেন- নিয়ে এসেছিলেন। অবশ্য নাবী তনয়া যায়নাব (রাঃ), আবুল আসের নিকট থেকে গিয়েছিলেন। তিনি তাকে আসতে দেননি। তিনি বদরের যুদ্ধের পরে এসেছিলেন।[4]

‘আয়িশাহ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মদীনায় পৌঁছার পর আবূ বাকর (রাঃ) ও বিলাল (রাঃ) জ্বরে আক্রান্ত হন। আমি তাদের খেদমতে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম আববাজান! আপনি কেমন আছেন? তারপরে বিলালকে লক্ষ্য করে বললাম আপনি কেমন আছেন? তিনি অর্থাৎ ‘আয়িশাহ (রাঃ) বলেছেন যখন আবূ বাকর (রাঃ)-এর জ্বর আসত তখন তিনি এ কবিতা পাঠ করতেন,

كل امرئ مُصَبَّحٌ في أهله ** والموت أدنى من شِرَاك نَعْلِه

অর্থঃ প্রতিটি মানুষকে তার আত্মীয়ের মাঝে সুপ্রভাত বলা হয়ে থাকে অথচ মৃত্যু তার জুতার ফিতার চাইতেও নিকটবর্তী।

বিলালের অবস্থা যখন একটু সুস্থ থাকত তখন তিনি নিজের দুঃখপূর্ণ স্বর উঁচু করে বলতেনঃ

ألا ليت شِعْرِى هل أبيتَنَّ ليلة ** بوَادٍ وحولى إذْخِرٌ وجَلِيْـلُ
وهل أردْن يومـًا ميـاه مِجَنَّة ** وهل يَبْدُوَنْ لى شامة وطَفِيْلُ

‘হায় যদি আমি জানতাম যে, আমার কোন একরাত্রি যাপন হবে এক প্রান্তরে (মক্কায়) এবং আমার পাশে ইযখির ও জালীল (ঘাস) থাকবে এবং কোন দিন কি মাজিন্না ঝর্ণাতে অবতরণ করতে পারব এবং আমি সামা ও তুফাইল পাহাড় দেখতে পাব?’

‘আয়িশাহ (রাঃ) বলেছেন যে, আমি রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে তাদের এ প্রলাপের সংবাদ দিলাম। তখন তিনি বললেন,

‏[اللهم حبب إلينا المدينة كحبنا مكة أو أشد، وصححها، وبارك في صاعها ومدها، وانقل حماها فاجعلها بالجُحْفَة‏]‏‏.‏

‘‘হে আল্লাহ, আমাদের নিকট মদীনাকে এমন প্রিয় করে দাও যেমন মক্কা প্রিয় ছিল বরং তার চেয়ে অনেক বেশী। মদীনার মাঠ, ঘাট ও আবহাওয়া স্বাস্থ্যের উপযোগী করে দাও এবং উহার ‘সা‘’ ও ‘মুদ্দে’ (শস্য মাপার পাত্র বিশেষ) বরকত দাও, তার অসুখ প্রত্যাবর্তন করে জুহফাহ’য় পৌঁছিয়ে দাও।[5] আল্লাহ তাঁর দু‘আ শুনলেন ও অবস্থার পরিবর্তন ঘটল।

এখান পর্যন্ত পবিত্র জীবনের এক প্রকার ও ইসলামী দাওয়াতের এক যুগ অর্থাৎ মক্কী জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটল। আমরা এখন তাঁর মাদানী জীবন সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করবো। আল্লাহ তা’আলা তাওফীক দাতা।

[1] কবিতার অনুবাদটি আল্লামা মানসুরপুরী করেছেন। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম লিখেছেন যে, কবিতাটি তাবুকের যুদ্ধ হতে নাবী (সাঃ)-এর ফেরত আসার সময় পাঠ করা হয়েছিল এবং যাঁরা বলেছেন এটা নাবী (সাঃ)-এর মদীনায় প্রবেশের সময় পাঠ করা হয়েছিল তাঁদের ভুল হয়েছে। (যা’দুল মা’আদ ৩/১০২ পৃঃ।) কিন্তু আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম ভুল হওয়ার কোন সুস্পষ্ট প্রমাণ প্রদান করেন নি। এর বিপরীতে আল্লামা মানসুরপুরী কবিতাটি নাবী (সাঃ)-এর মদীনায় প্রবেশের সময় পাঠ করা হয়েছিল বলে অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ব্যাপারে তাঁর নিকট দলীলও রয়েছে। রহমাতুল্লিল আলামীন ১/১০৬ পৃঃ।

[2]
যা’দুল মা’আদ ২য়/৫৫ পৃঃ। রাহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ১০৬ পৃঃ।

[3]
সহীহুল বুখারী শরীফ ১ম খন্ড ৫৫৬ পৃঃ।

[4]
যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৫৫ পৃঃ।

[5]
সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৫৮৮-৫৮৯ পৃঃ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *