রাণুর জন্য পাত্র নির্বাচন এবং পাকা কথা হয়ে গেল অবশ্য কবির অনুপস্থিতিতেই।
ঘটকালি করলেন লেখিকা অনুরূপা দেবী। এ সম্বন্ধ একেবারে আশাতীত।।
বর্তমানে বাঙালিদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী ব্যবসায়ী রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। দ্বারকানাথ ঠাকুরের পর ব্যবসা ক্ষেত্রে তাঁর মতন সফল আর কেউ নন। ইংরেজ শ্ৰেষ্ঠীদের সঙ্গেও তিনি পাল্লা দিয়ে অতুল ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়েছেন, ব্রিটিশ সম্রাট তাঁকে দিয়েছেন নাইটহুড।
স্যার রাজেনের সুযোগ্য পুত্র বীরেন বিলেত থেকে লেখা-পড়া শিখে এসে যোগ দিয়েছে পিতার ব্যবসায়ে। তার জন্য পাত্রী খোঁজা চলছিল, অনুরূপা দেবীর মাধ্যমে কাশীর অধিকারী পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ হতেই আর বেশি কথাবার্তার প্রয়োজন হল না। এক পক্ষ মুগ্ধ হল রূপ দর্শনে, অন্য পক্ষ আকৃষ্ট হল বিত্তে।
মুখোপাধ্যায় পরিবারটি সনাতন হিন্দু রীতি নীতি যেমন মানে, তেমনই বিলিতি চাল চলনেও অভ্যস্ত। খাঁটি ব্রাহ্মণ ঘরের সুলক্ষণা, সুদর্শনা কন্যার ঠিকুজি কুষ্ঠি যেমন মিলিয়ে নেওয়া হল, তেমনই বিয়ের আগে কিছুদিন চলতে লাগল কোর্টশিপ। রাণুকে এনে রাখা হল আলিপুরে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের বাড়িতে, বীরেন এক একদিন ঘোড়ায় চেপে সেখানে আসে, নানা বিষয়ে আলোচনা হয়, এক একদিন সে ভাবী পত্নীকে নিয়ে হাওয়া খেতে যায় ময়দানে।
কবি এ সব কিছুই জানতে পারলেন না।
হারানামারু জাহাজে চেপে সমদ্র পাড়ি দিতে দিতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, পেরু পোঁছোবার আগেই চিকিৎসকদের নির্দেশে তাঁকে নামিয়ে নেওয়া হল বুয়োনোসআয়ারসে। সেখানকার শহরতলি সান ইসিদ্রোতে এক বাগানবাড়িতে তিনি সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলেন ভিক্টোরিয়া ওকামপো নামে এক ধনবতী মহিলার সেবা ও সান্নিধ্যের উষ্ণতায়।
কবিকে না জানিয়েই সব ঠিক হয়ে গেল, এ জন্য অপরাধবোধ হল রাণুর মায়ের। কবি কোথায় রয়েছেন, তাও জানা নেই। অথচ এমন পাত্র হাতছাড়াও করা যায় না। সমস্ত খবর জানিয়ে একটা চিঠি লিখে বম্বেতে পাঠিয়ে দেওয়া হল, খামের ওপরে লেখা রইল টু অ্যায়েট অ্যারাইভাল। এবং স্থির হল, কবি এসে পৌঁছবার পর হবে আশীর্বাদ। ততদিন কোর্টশিপ চলুক।
শেষ পর্যন্ত পেরু যাওয়া হলই না কবির।
ফেরার পথে ইওরোপ হয়ে বম্বে পৌঁছেই পেলেন সেই চিঠি। পড়েই বুঝলেন, এ সম্বন্ধ অবধারিত। পাত্র সম্পর্কেও আপত্তি জানাবার কারণ নেই। এক অধ্যাপকের কন্যার গলায় বরমাল্য দেবে এক রাজপুত্র। একালের ধনী ব্যবসায়ীরাই তো রাজার স্থান নিয়েছে।
কলকাতায় আসবার আগেই তিনি চিঠিতে জানিয়ে দিলেন তাঁর সম্মতি, শুভেচ্ছা ও আশীর্বাদ।।
দেশে ফেরা মানেই নানান সমস্যায় জড়িয়ে পড়া। রাজনৈতিক ডামাডোল ও পুলিশি ধরপাকড় চলছেই। কবি আর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকতে চান না, আর সে জন্যই সমালোচিত ও নিন্দিত হচ্ছেন কিছু কিছু পত্রপত্রিকায়। তিনি গান্ধীজির চরকা-নীতি সমর্থন করতে পারেননি, শান্তিনিকেতনে এসে দেখলেন, সেখানে প্রায় ঘরে ঘরে চরকায় তকলিতে সুতো কাটা চালু হয়ে গেছে, বিধুশেখর শাস্ত্রী ও নন্দলাল বসুর মতন মানুষও তাতে উৎসাহের সঙ্গে মেতেছেন।
কবি অসন্তুষ্ট হলেও তা প্রকাশ করলেন না, ওঁদের নিষেধও করলেন না।
হঠাৎ তাঁর রচনার স্রোতটিও শুষ্ক হয়ে গেল। পুরনো নাটকগুলো মাজা ঘষা করেন, নতুন কিছু মনে আসে না। মাঝে মাঝেই অন্যমনস্ক হয়ে যান।
জার্মানি থেকে বিশিষ্ট বন্ধু কাইসারলিঙ একটি প্রবন্ধ লেখার অনুরোধ পাঠিয়েছেন। তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিবাহ প্রথা বিষয়ে একটি সংকলন সম্পাদনা করছেন। তাঁর খুব ইচ্ছে ভারতীয় বিবাহের আদর্শ বিষয়ে রচনাটি কবির লেখা হবে।
ভারতীয় বিবাহের আদর্শ বলে সত্যিই কি কিছু আছে? বিয়ে তো পাত্র-পাত্রীরা করে না। তাদের বাবা-মায়েরা বিয়ে ঘটিয়ে দেয়। এর মধ্যে প্রেমের স্থান কোথায়? প্রেম আছে কাব্যে। সমাজ জীবনে তো শুধু প্রথা ও লোকাচার।
আসন্ন একটি বিবাহের কথা কবির মনের মধ্যে সদা জাগ্রত, তাই তিনি এই বিষয়টি নিয়ে লিখতে রাজি হলেন।
হঠাৎ একটি চিঠি পেয়ে কবির বুকে যেন আচম্বিতে বজ্রাঘাত হল। তিনি কাঁপতে লাগলেন।
চিঠিখানি লিখেছেন রাণুর মা। তাঁর কাছে কয়েকটি উড়ো চিঠি এসেছে, সেই চিঠিগুলোও তিনি পাঠিয়ে দিয়েছেন এই সঙ্গে। এবং জানিয়েছেন, এ রকম চিঠি রাণুর ভাবী শাশুড়ির কাছেও গেছে।
স্বাক্ষরহীন চিঠিগুলি কদর্য ইঙ্গিতে ভরা। কবির সঙ্গে রাণুর সম্পর্কের নানান বর্ণনা লিখে জানানো হয়েছে, এ বিবাহ সুখের হতে পারে না। দু’একটি চিঠিতে লেখা হয়েছে অন্য কথা। কবি নিজে তো রাণুকে বিয়ে করবেন না। তিনি তো গুরুদেব সেজে আছেন, তাই তিনি চান, নিজের অতি বশংবদ, কোনও ছেলের সঙ্গে রাণুর বিয়ে দিয়ে নিজের কাছে রাখতে। সেই উদ্দেশ্যে তিনি একটি যুবকের সঙ্গে রাণুর পরিচয় করিয়ে দিয়ে, দুজনের এমন অবাধ মেলামেশার প্রশ্রয় দিয়েছেন, যা অবৈধ প্রেমের পর্যায়ে পড়ে। এ কন্যা কীটদ্ৰষ্ট, রাজেন মুখার্জির মতন উচ্চ বংশের যোগ্য হতে পারে না।
এ সব চিঠি পড়ার সময় কবিকে দেখলে কেউ চিনতেই পারবে না। তাঁর এমন পাংশুবর্ণ, বিহ্বল মুখ কেউ কখনও দেখেনি।
বিভিন্ন রচনা ও সামাজিক ভূমিকার জন্য সারাজীবনে তিনি প্রচুর কটুক্তি ও নিন্দাবর্ষণ সহ্য করেছেন। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত চরিত্র ও নৈতিকতা বিষয়ে কেউ কখনও দোষারোপ করেনি। চৌষট্টি বছর বয়েসে এসে তাঁর নামে এমন কলঙ্ক আরোপের চেষ্টা চলেছে?
এ সব কথা হু-হু করে ছড়ায়। পাত্র পক্ষ এর সামান্য অংশও বিশ্বাসযোগ্য মনে করলে এ বিয়ে ভেঙে যাবে। এতদুর প্রস্তুতির পর বিয়ে ভেঙে গেলে রাণুর সারা জীবনটাই নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
না, না, যেমন করেই হোক, রক্ষা করতে হবে এই সম্বন্ধ।
কবির বুকটা মুচড়ে মুচড়ে উঠছে। সেই অবস্থায় তিনি চিঠি লিখতে বসলেন পাত্রের মাকে:
…কোনও এক গুপ্তনামা নিন্দুক রাণুর চরিত্রে কলঙ্ক আরোপ করিয়া আপনাকে যে পত্র দিয়াছে, রাণুর মা আজ তাহা আমার নিকট পাঠাইয়া দিয়াছেন।
বিদেশ হইতে বোম্বাই ফিরিয়া আসিয়াই সংবাদ পাইলাম, আপনাদের ঘরে রাণুর বিবাহের সম্বন্ধ স্থির হইয়াছে। শুনিয়া বড় আহ্লাদে রাণুকে আশীর্বাদ করিয়া পত্র পাঠাইলাম। শ্রীমান বীরেনকেও লিখিবার উদ্যোগ করিতেছি, এমন সময় রাণুর মার চিঠি পাইয়া আমি স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছি।
রাণুকে তাহার শিশুকাল হইতে জানি এবং একান্ত মনে স্নেহ করি। ইহা জানি, তাহার চরিত্র কলুষিত হওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব। তাহার বয়েসে বাঙালির ঘরের মেয়েরা যে সাধারণ অভিজ্ঞতা সহজে লাভ করে, তাহার তাহা একেবারেই ছিল না, সে এমনই শিশুর মতন কাঁচা যে তাহার কথাবার্তা ও আচরণ অনেক সময়ই হাস্যকর মনে হইত। এইরূপ অনভিজ্ঞতাবশত লোক ব্যবহার সম্বন্ধে তাহার কোনও ধারণা ছিল না। এই কারণে রাণুর বিবাহ সম্বন্ধে আমার মনে বিশেষ উদ্বেগ ছিল। আমি তাহার জন্য এমন সৎপাত্র কামনা করিতেছিলাম, যে তাহার একান্ত সরলতার যথার্থ মূল্য বুঝিবে এবং লৌকিকতার ত্রুটি ক্ষমা করিবে।
এক সময় আমার এক বন্ধু পুত্র আমাদের জোড়াসাঁকোর বাড়িতে দৈবক্রমে রাণুকে দেখিয়া তাহাকে বিবাহের জন্য উৎসুক হইয়া উঠে। সগোত্রে বিবাহে তাহার পিতার সম্মতি হইবে না আশঙ্কা করিয়া আমি প্রথমে বাধা দিই। তখন তাহার পিতা কলিকাতায় ছিলেন না। সেই ছেলেটি ও তাহার একজন গুরুস্থানীয় আমাকে বারবার আশ্বাস দিলেন যে, আপত্তি গুরুতর হইবে না এবং বিবাহ নিশ্চয়ই ঘটিবে।
ছেলেটি ভাল, তাহার হাতে রাণু কষ্ট পাইবে না নিশ্চয় ভাবিয়া আমি তাহাদের পরিচয়ে বাধা দিই নাই, কিন্তু পরিচয় বলিতে একবার শান্তিনিকেতনে দেখা হইয়াছিল। রাণু তখন আমার কন্যা মীরা ও বউমার সঙ্গে ছিল। ছেলেটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে দেখা হওয়া তাহার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব ছিল।
আপনি আমার কন্যা বেলাকে জানিতেন। তাহার ছোট ভাই শমী বাঁচিয়া নাই। আমি অনেকবার ভাবিয়াছি যে, সে যদি বাঁচিয়া থাকিত, তবে রাণুর সঙ্গে নিশ্চয় তাহার বিবাহ দিতাম।
সঙ্গে সঙ্গে আর একটি চিঠি লিখলেন সরযুকে :
চিঠি পেয়ে বজ্রাহত হলুম। কিন্তু ভয় পেয়ো না। আমার যা সাধ্য তা আমি করবো। Lady Mukherji কে আজই চিঠি লিখে দিলুম। Sir Mukherji কে নিমন্ত্রণ করে পাঠিয়েছি। খুব সম্ভব দুজনেই এখানে আসবেন। রাণুকে বোলো, বেশি উদ্বিগ্ন না হয়। সমস্তই ঠিক হয়ে যাবে।
চিঠি লিখছেন, আর কবির হাতে কাঁপছে।
নিন্দুকরা এর মধ্যে আরও কত বিষ ছড়াচ্ছে কে জানে! ওই সব আড়ালের নিন্দুকরা কারা তা জানার উপায় নেই, খুব কাছের মানুষও হতে পারে।
কবি স্নান করলেন না, আহারেও তাঁর রুচি হল না।
কবির শরীর খারাপ মনে করে উদ্বিগ্ন হয়ে প্রতিমা খোঁজ নিতে এল বারংবার। কবি তাকেও কিছু বলতে পারছেন না।
ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থেকেও তাঁর ঘুম এল না। চোখে ভাসতে লাগল রাণুর মুখ। সে ও কি এসব শুনেছে? কী প্রতিক্রিয়া হয়েছে তার? সে কি কান্নাকাটি করছে খুব।
প্রশান্তর মুখে কবি শুনেছেন, ভাবী স্বামীর সঙ্গেই বেশ ভাব হয়ে গেছে রাণুর। মনে মনে সে একেবারে তৈরি হয়ে রয়েছে এই বিয়ের জন্য। এখন যদি বিয়েটা ভেঙে যায়।
যে-আঘাত সে পাবে, তার পরেও কি সে তার ভানুদাদাকে ভালো বাসতে পারবে?
তিনিই বা রাণুকে সান্ত্বনা দেবেন কোন ভাষায়?
সস্ত্রীক রাজেন মুখার্জি যখন কবির সঙ্গে দেখা করতে এলেন, তখন তাঁর সঙ্গে রয়েছে আরও কয়েকটি কুৎসাপূর্ণ চিঠি।
দু’পক্ষে কয়েকদিন ধরে আলোচনা চলল।
কবি বারবার ব্যাকুল ভাবে বোঝাতে লাগলেন, রাণুদের পরিবারের সকলের সঙ্গে তাঁর অনেকদিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, রাণুকে তিনি বিশেষ স্নেহ করেন, কিছু কুলোক তার মন্দ ব্যাখা করতে চাইছে।
শেষ পর্যন্ত ঠিক হল, বীরেনের মতামত নেওয়া হবে। সে রাজি হলে আর কোনও বাধা থাকবে না।
বীরেন বিলিতি আদব-কায়দায় অভ্যস্ত। সে রাণুকে দেখেছে একাধিক বার, কথা বলেছে, তাকে পছন্দ করেছে। উড়ো চিঠি টিটি সে গ্রাহ্য করে না, তার আপত্তির কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
বিয়ের তারিখও ধার্য হয়ে গেল। মেঘ মুক্ত হয়ে কবি বিরাট স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন।
রাণু এসব কিছুই জানে না। সে বিয়ের আগের কয়েকটা দিন ভানুদাদার সঙ্গে কাটাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। লিখছে চিঠির পর চিঠি।
কবি এখন সতর্ক হয়ে গেছেন। রাণুর চিঠির উত্তর দিচ্ছেন নির্লিপ্ত ভাষায়। শেষ চিঠিতে লিখলেন :
বিবাহের অধিকদিন আগে তোমার পক্ষে কলকাতা যাওয়া ঠিক হবে না। বিশেষত আমার বাড়িতে থাকলে সর্বদাই নানাদিক থেকে উৎপাতের আশঙ্কা আছে। খুবই ইচ্ছা ছিল, বিবাহের আগে কিছুকাল তোমরা সবাই আমার বাড়িতেই থাকব কিন্তু সেটা ঘটতে দিল না।
শান্তিনিকেতনে ওদের উৎপাত চিঠি ছাড়া আর কোনও আকারে পৌঁছতে পারবে না। সুতরাং এখানে তোমরা যতদিন খুশি নিরুপদ্রবে থাকতে পারো।
রাণু প্রায় জোর করেই বাবা-মাকে রাজি করিয়ে, সবাইকে নিয়ে চলে এল শান্তিনিকেতন। এবার যেন অন্যরকম। পদে পদে বিধিনিষেধ। সবাই খালি উপদেশ দেয়, দৌড়োবে না, বৃষ্টি ভিজবে না, দুপুর রোদে বেরোলে রং কালো হয়ে যাবে। ঠিক সময় খাবে, ঠিক সময় ঘুমোবে।
এমনকী রাণুর ভানুদাদাও সবার সামনে তাকে অনবরত উপদেশ দেন, শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে কেমনভাবে ব্যবহার করতে হবে সবার সঙ্গে। গুরুজনদের সেবা আর ছোটদের প্রতি স্নেহপূর্ণ ব্যবহারে হতে হবে আদর্শ স্ত্রী।
রাণু অন্য সব বিধিনিষেধ মানে, শুধু রাত্তিরবেলা সে একবার ভানুদাদার কাছে যাবেই যাবে। তখন ভানুদাদা তার একান্ত আপন। ভানুদাদাও অপেক্ষা করেন তার জন্য। ওপরের বারান্দায় জ্যোৎস্নালোকে বসে দুজনের কত কথা, কত গান।
এখন আর বাবা-মাও তাকে নিষেধ করেন না। আর তো মাত্র কয়েকটি দিন, তারপর মেয়ে চলে যাবে পরের বাড়িতে। সব মাবাবারই মনটা এই সময় নরম হয়ে থাকে। খুব বড়লোকের বাড়ির বউরা বাপের বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে পারে না। বিয়ের পর রাণুর সঙ্গে আর কবে দেখা হবে, তার ঠিক নেই! সেইজন্যই এখন বেশি শাসন করে মেয়ের মনে আঘাত দিতে মন চায় না।
সব বাঙালি মেয়েকেই একটা বয়েস থেকে বিয়ের জন্য প্রস্তুত হতে হয়। রাণুর এর চেয়ে ভাল বিয়ে তো আশা করা যায় না। তার মনে খুশির ছোঁয়া লেগেছে ঠিকই, আবার যখন তখন কান্নাও পায়। মুক্ত বিহঙ্গকে বন্দি করা হবে খাঁচায়, হোক না সেটা সোনার তৈরি খাঁচা।
ভানুদাদার সঙ্গে হাসি-গল্প করতে করতে হঠাৎ সে কেঁদে ফেলে ঝরঝরিয়ে। কবি বাধা দেন না, চেয়ে থাকেন একদৃষ্টিতে।
এক সময় কান্না থামিয়ে সে জিজ্ঞেস করে, ভানুদাদা, আমি আর শান্তিনিকেতনে আসব না?
কবি বললেন, না এসে পারবে? তোমার স্বামীকে বুঝিয়ো।
রাণু বলল, কী জানি ভয় করে। শুনেছি, তাঁর খুব কাজের নেশা।
কবি বললেন, কাল হঠাৎ রাতে ঘুম ভেঙে গেল। মনে হল, সকালে উঠে তোমাকে আর দেখতে পাব না। তোমার বাবা কলকাতা ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, বোধহয় তোমাদের সবাইকে নিয়ে চলে গেছেন।
রাণু বলল, তা কখনও সম্ভব? তোমাকে না জানিয়ে চলে যেতে পারি?
কবি বললেন, অসম্ভবের কথাও এক এক সময় মনে আসে। আর ঘুম এল না, একটা গান লিখে ফেললুম। এখনও দিনুকে শেখানো হয়নি।
রাণু বলল, আমি তবে প্রথম শুনব।
কবি গাইতে লাগলেন :
না বলে যায় পাছে সে আঁখি মোর ঘুম না জানে।
কাছে তার রই, তবুও ব্যথা যে রয় পরাণে।
যে পথিক পথের ভুলে এল মোর প্রাণের কূলে
পাছে তার ভুল ভেঙে যায়, চলে যায় কোন্ উজানে।
এল যেই এল আমার আগল টুটে
খোলা দ্বার দিয়ে আবার যাবে ছুটে।
খেয়ালের হাওয়া লেগে যে খ্যাপা ওঠে জেগে
সে কি আর সেই অবেলায় মিনতির বাধা মানে।
এ গান শুনেও কান্নার কী আছে? তবু রাণু কান্নায় ভেঙে পড়ল। সে জানে, কবি কত ব্যথা পাচ্ছেন ভেতরে ভেতরে। সে নিজেও তো কল্পনা করতে পারছে না, এরপর ভানুদাদার সঙ্গে তার দেখাও হয়তো হবে না, তবু তার জীবনটা কাটবে কী ভাবে।
কবি তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, এসো।