রাজাদের উপত্যকা
দিন পনেরো ভবেশদার কোনো খবর ছিল না। একদম বেপাত্তা! দোকান বন্ধ, ফোন সুইচড অফ। সেইসময়েই খেয়াল করেছিলাম যে আমরা ভবেশদার বাড়িটা আসলে কোথায় সেটাই জানি না! অথচ সেই মানুষটার সঙ্গে এতগুলো মাস কাটালাম, এত আড্ডা মারলাম। আমার আর পিজির দু-জনেরই চিন্তা হচ্ছিল, কলেজ স্ট্রিটে ওঁর দোকানের আশেপাশের দোকানগুলোতে জিজ্ঞাসা করেও খুব একটা সুবিধা হল না। সবাই চেনে ভবেশদাকে। কিন্তু বাড়ি কোথায় সেটা কেউ জানে না।
দু-দিন আগেই যদিও ভদ্রলোক হঠাৎই উদয় হলেন। একেবারে আমাদের রুমের দরজায়। দিনটা ছিল শুক্রবার। বিকেলের দিক। সদ্য মেডিসিনের ক্লাস শুরু হয়েছে, আমি পিজিকে পেশেন্ট বানিয়ে বিছানায় শুইয়ে ক্লিনিকাল এগজামিনেশন প্র্যাকটিস করছিলাম আর পিজি ‘এই আমার পেটে হাত দিস না, কাতুকুতু লাগছে’ বলে বার বার লাফিয়ে উঠছিল। এমন সময় নাকে এল চেনা বিড়ির গন্ধ, পিছনে ঘুরে দেখি আমাদের মমিদা দাঁড়িয়ে আছে। ভবেশদার এই নামটা পিজির দেওয়া, যদিও ভুলেও কখনো ওকে এই নামে ডাকি না। ভবেশদার কাঁধে সেদিন আবার গাঢ় নীল রঙের ঢাউস একটা ব্যাগ ছিল।’
‘কী ব্যাপার, মানিকজোড়? কোনো খবর নেই তোমাদের, তাই দেখা করতে চলে এলুম।’
‘খবর তো আপনার নেই। একদম হাওয়া হয়ে গেছিলেন। আর এখন এসে আমাদের বলছেন। কোথায় ছিলেন এতদিন?’
‘আরে, কোথায় আবার থাকব, বাড়িতেই ছিলাম। একটু পড়াশোনা করছিলাম।’
‘আপনি আবার কী পড়ছিলেন?’
ভবেশদা কাঁধের ব্যাগটা মাটিতে নামিয়ে চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন,
‘রাজাদের উপত্যকার কথা। অদ্ভুত একটা জায়গা, যেটা পাঁচশো বছর ধরে ফারাওদের কবরখানা ছিল।’
পিজিকে দেখলাম ক্যান্টিনে ফোন করে টুক করে চা আর ঘুগনির অর্ডার দিয়ে দিল, আড্ডা যে জমে যাবে সেটা দু-জনেই ভালো বুঝছিলাম।
হাচিসনের ক্লিনিকাল মেথডের বইটাকে বন্ধ করে রাখতে রাখতে আমি বললাম, ‘রাজাদের উপত্যকা? মানে ভ্যালি অফ দ্য কিংসের কথা বলছেন?’
‘হুঁ, আরবিতে জায়গাটার নাম ওয়াদি আবওয়াব আল মুলুক, মানে ভ্যালি অফ দ্য গেটস অফ দ্য কিংস। সেটাই পপুলার কালচারে ভ্যালি অফ দ্য কিংস হয়ে গেছে।’
‘আচ্ছা, এখানেই তুতানখামেনের সমাধি ছিল না!’
‘হ্যাঁ, এখানেই ছিল তো। কেভি৬২। তবে তুতানখামেন ছাড়াও আরও তেষট্টিখানা কবর আছে ভাই এখানে। এখনও লুকিয়ে থাকা নতুন নতুন কবরের খোঁজ পাচ্ছেন আর্কিয়োলজিস্টরা। বছর দশেক আগেই একটা এরকম কবর পাওয়া গেল ওখানে। জায়গাটা কত রহস্য যে বুকে নিয়ে বসে আছে সেটা বই পড়ার আগে জানতেই পারতাম না।’
পিজি এবারে দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলল,
‘আমাদের আর বই পড়ে কী হবে! আপনিই আছেন তো!’
‘হুঁ, এত গল্প যে বলি সেগুলো মাথায় তো রাখতে পারো বলে মনে হয় না।’
‘কী বলছেন! স্পন্দন আপনার গল্পগুলো সব লিখে রাখে, জানেন! ওর হেব্বি মেমোরি! অ্যানাটমিতে অনার্স এমনি এমনি পেয়েছিল নাকি!’
‘বল কী, স্পন্দন ভাই। তুমি সব লিখে রাখছ! প্ল্যানটা কী?’
‘কিছুই প্ল্যান না, আপনার গল্পগুলো শুনতে ভালো লাগে। তাই লিখে রাখার চেষ্টা করি।’
‘আরিব্বাস! তাহলে একেবারে উলুবনে মুক্তো ছড়াচ্ছি না, কি বলো?! ভ্যালি অফ দ্য কিংসের গল্পই হোক তাহলে।’
চেয়ার থেকে নিজেকে পিজির বিছানাতে শিফট করে ভবেশদা শুরু করলেন,
‘নীল নদের পশ্চিম পাড়ে, লাক্সর শহর, আগে যার নাম ছিল থেবস, তার কাছে এই উপত্যকা। দু-পাশে খাড়াই চুনাপাথরের পাহাড়। ভ্যালিতে ঢোকার রাস্তাটাও সরু। এখানেই পাহাড় কেটে বানানো হত রাজাদের কবর।’
ভ্যালি অফ দ্য কিংস-এ পাহাড় কেটে বানানো সমাধি
‘কেন? ফারাওরা তো পিরামিড বানাত, মাস্তাবা বানাত। সেখানে এরকম পাহাড় কেটে সমাধি বানানোর কী মানে?’
‘মানে তো আছেই। ফারাওদের পিরামিড, মাস্তাবাগুলোর ঐশ্বর্য ডাকাতদের বার বার টেনে আনত। কবরখানার রাস্তায় গোলকধাঁধা বানিয়ে, পিরামিডের মধ্যে ফলস দরজা তৈরি করেও ডাকাতির হাত থেকে কোনো রেহাই মেলেনি। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে পিরামিড বানানোর সময় কাজ করা শ্রমিকই ডাকাত হয়ে ফিরে আসত। গুপ্ত দরজার হদিশ ছিল তাদের মুখস্থ। ফলত এককণা সোনাও আর সেইসব সমাধিতে অবশিষ্ট ছিল না। সোনার লোভে ফারাওদের মমিও তছনছ করে ফেলত ওরা। সোনা গেলে যাক, কিন্তু মমি নষ্ট হলে তো ফারাওয়ের মৃত্যুর পরের জগতে যাওয়ার পথই বন্ধ হয়ে যাবে। তাই ১৫৩৯ বিসি থেকে ভ্যালি অফ দ্য কিংসে ফারাওদের নতুন সমাধি বানানো শুরু হতে লাগল।
ফারাওয়ের সমাধিতে প্রদীপের আলোয় ছবি ও লিপি আঁকা
‘প্রথম যে ফারাওয়ের সমাধি তৈরি হল, সে হল প্রথম তুতমোসিস । যে আর্কিটেক্ট সেটা বানায় সে হল ইনেনি, ইনেনিই এই জায়গাটা খুঁজে বের করেছিল। ফারাওয়ের সমাধি বানানোর পরে ইনেনি গর্ব করে বলেছিল যে এমন জায়গায় কবরটা লুকোনো আছে যেখানকার কথা কেউ কোনোদিন শোনেনি, কেউ কোনোদিন দেখেনি।’
‘কিন্তু সমাধি বানাতে নিশ্চয়ই বেশ কিছু লোক লেগেছিল। তারাই তো এর কথা বাইরে ফাঁস করে দিতে পারত।’
‘যাতে না পারে তার জন্য যে সবরকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। খুব কম সংখ্যক লোককেই এই কাজে লাগানো হয়েছিল। তাদের প্রত্যেককে কাজে যোগ দেওয়ার আগে শপথ নিতে হত। এদেরকে বলা হত সত্যের ভৃত্য। কোথাও মুখ খুললেই এদের মৃত্যু ছিল অনিবার্য। সবাই মোটা টাকা মাইনে পেত। কিন্তু প্রত্যেককেই ভ্যালির পাশেই দেইর এল মেদিনা নামের একটা জায়গায় থাকতে হত পরিবার নিয়ে। সেই জায়গাটার চারিদিকে উঁচু পাঁচিল দেওয়া ছিল। বাইরের জগতের সঙ্গে কোনো সংস্পর্শেই আসতে দেওয়া হত না তাদের। ভ্যালিতে আবার যখন-তখন সারপ্রাইজ ভিজিট চলত, যাতে কাজের গোপনীয়তা রক্ষা হচ্ছে কি না জানা যায়।’
‘আচ্ছা ভবেশদা, আপনি বললেন তুতানখামেেনর টুম্বটা হল কে ভি ৬২। এর কী মানে?’
‘কে ভি মানে হল কিংস ভ্যালি, ইজিপ্টোলজিস্ট জন গার্ডনার উইলকিনসন এই নাম্বারিং সিস্টেম চালু করেছিলেন সমাধিগুলোর জন্য। রানিদের কবর দেওয়ার জন্য আলাদা একটা উপত্যকা ছিল, বুঝলে। তার নাম ভ্যালি অফ দ্য কুইনস। এখানকার টুম্বগুলোর নাম্বারিং তাই কিউভি ১,২,৩… এরকম।’
‘তাহলে গার্ডনারই প্রথম ভ্যালি অফ দ্য কিংস খুঁজে পান?’
‘ধুস, এই জায়গাটার অস্তিত্বের কথা একসময় বাইরের জগতের সামনে চলেই আসে। রোমান সময়ে এটা একটা টুরিস্ট স্পট ছিল বলতে পারো। নেপোলিয়নের সময়েও কিছু আর্কিয়োলজিস্ট এখানে এসেছিলেন। তাঁরদের মধ্যে এডোয়ার্ড টেরেজ নামের একজন সাহেব তৃতীয় আমেনহোটেপের টুম্বও খুঁজে পেয়েছিলেন। কিন্তু প্রথম যে আর্কিয়োলজিস্ট এখানে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ শুরু করেন তিনি হলেন অন্য আরেকজন। কে বলো তো? আগের দিন এর কথাই বললাম তো, যুবক মেমনন, আবু সিম্বেলের মন্দির…’
‘জিওভান্নি বেলজোনি! এখানেও!’
‘হ্যাঁ, ভাই। এখানেও বেলজোনি। আবু সিম্বেল থেকে ফেরার পরে বেলজোনি নজর দেন ভ্যালি অফ দ্য কিংসের দিকে, খোঁড়াখুঁড়ি করতে করতে বেলজোনি খুঁজে পেয়েছিলেন ফারাও আই-এর কবর, যে তুতানখামেনের পরে মসনদে বসেছিল। প্রথম রামেসিসের কবরও পাওয়া যায়। তবে দুটোতেই আশাপ্রদ তেমন কিছুই পাওয়া যায়নি। বেলজোনি কিন্তু একটুও না দমে কাজ চালিয়ে যান। তার ফলও পেলেন যদিও।
‘১৮১৭ সালের অক্টোবর মাসের একটা দিন। বেলজোনি হঠাৎ খেয়াল করলেন একটা পাহাড়ের গায়ে জল গড়িয়ে পড়ার নালি পথ। কোনো একসময়ে হয়তো এখান দিয়ে সত্যিই জল পড়ত, সেইজন্যই পাথর ক্ষয়ে ক্ষয়ে এরকম চ্যানেল তৈরি হয়েছে। কিন্তু বেলজোনি খেয়াল করলেন সেই চ্যানেল নীচের দিকে নামতে নামতে হঠাৎ ছোটো ছোটো পাথরের ধ্বংসস্তূপের মাঝে হারিয়ে গেছে। তাহলে কি ওর পিছনে কিছু আছে!
‘কয়েক হাজার বছর ধরে জমে থাকা নুড়িপাথরের স্তূপ সরানো খুব মুশকিলের হল। জায়গায় জায়গায় পাথরের টুকরোগুলো জমাট বেঁধে গেছে। বেলজোনি একটা খেজুর গাছের গুঁড়ি তুলে এনে শ্রমিকদের বললেন সেটাকে হরাইজন্টালি ধরে বার বার সেই পাথরের স্তূপে আঘাত করতে, যাতে পাথরের টুকরোগুলো আলগা হয়ে পড়ে।’
‘বুঝেছি! ব্যাটারিং র্যাম! পদ্মাবতে দেখেছিলাম তো! তা ছাড়া গেম অফ থ্রোনসে…’
পিজির মুখের কথা শেষ হল না। ভবেশদার রক্তচক্ষু দেখে ওকে থামতে হল। ছেলেটার বাজে বকার অভ্যেসটা কোনোদিন শুধরোবে না।
‘তা যেটা বলছিলাম, বেলজোনির এই টেকনিকে কিন্তু ভালো কাজ হল। পাথর সরানো গেল বেশ খানিকটা। বেরিয়ে এল একটা বড়ো পাথরের দরজা। মানে একটা সমাধির দরজা। বেলজোনি এই সমাধি আবিষ্কার করার বেশ কয়েক বছর পরে জানা যায় যে সেই কবরটা ছিল ফারাও সেতির।’
‘সেতি?’
‘হ্যাঁ, ইনি ছিলেন দ্বিতীয় রামেসিসের বাবা। উনিশতম ডাইনেস্টির রাজা। খুব জনপ্রিয় ফারাও ছিলেন সেতি। ওঁর সময়েই দেশ জুড়ে রেশনের ব্যবস্থা চালু হয়। দেশের প্রতিটা মানুষের জন্য বরাদ্দ হয় রুটি, রোস্টেড মাংস, আর কিছু শাকসবজি। মাসে দু-বার করে সবাইকে দু-বস্তা করে গমও দেওয়া হত। এহেন জনদরদি রাজার কবরও ছিল দেখবার মতো।
‘সমাধির দরজার গায়ের ফাটল দিয়ে কোনোরকমে ভেতরে ঢুকেই বেলজোনি অবাক হয়ে গেলেন! একটা বিশাল হল ঘরে এসে পড়েছেন উনি। ওঁর চারিদিকের দেওয়ালে আঁকা রঙিন ছবি। আর খোদাই করা আছে হায়রোগ্লিফের লিপি।
সেতির সমাধিতে ঢোকার গুপ্ত সুড়ঙ্গের ম্যাপ
‘সেই বড়ো ঘর থেকে বেরোতেই দেখা গেল মাটি নীচের দিকে ঢালু হয়ে নেমে গেছে। সেই রাস্তায় হঠাৎ একটা বড়ো কুয়ো। এতটাই গভীর যে মশালের আলোতেও তার তল পাওয়া গেল না। সামান্য অসাবধান হলেই এতে পড়ে মৃত্যু অনিবার্য ছিল। কুয়োর অন্যপ্রান্তে উঠে গেছে একটা বড়ো দেওয়াল। সেই দেওয়ালের গায়ে একটা বেশ বড়ো গর্ত। তবে দেওয়ালে আরেকটা জিনিস দেখে বেলজোনি বেশ অবাক হলেন। দেওয়াল বেয়ে একটা বেশ মোটা দড়ি ঝুলছে।’
‘অ্যাঁ, দড়ি এল কোথা থেকে?’
‘চোরের দলের লাগানো দড়ি।’
‘এখানেও! মানে ভ্যালি অফ দ্য কিংসেও ডাকাতি হয়েছিল!’
মিউজিয়ামে রাখা সেতির সমাধিতে পাওয়া দড়ি
‘হয়েছিলই তো। এসব কথা কতদিন আর চাপা থাকে। তাও ৫০০ বছর জায়গাটা লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল।
‘তারপরে ওদের হাল হয় সেই পিরামিড আর মাস্তাবার মতোই। ডাকাতরা সবই লুঠ করে নিয়ে যায়।’
‘যাহ, তার মানে এই সমাধিতেও বেলজোনি কিছুই পাননি!’
সেতির সমাধিতে নামার পথের চারদিকে দেওয়াল জুেড় আঁকা ছবি
‘তা কি আমি বলেছি? সবুর করো। বেলজোনি এখন কুয়োর পাশে দাঁড়িয়ে টপকাবার পথ ভাবছে। পর পর ক-টা খেজুর গাছের গুঁড়ি পাশাপাশি পেতে ব্রিজ বানিয়ে কুয়োর অন্য প্রান্তে যাওয়া হল। অন্যদিকের দেওয়ালে লাগানো দড়ির টুকরোটাতে ঝুলে গর্তের ভেতর দিয়ে আরেকটা বড়ো ঘরে এসে পৌঁছোলেন বেলজোনি। সেই ঘরের একপাশে আবার নীচের দিকে সিঁড়ি নেমে গেছে। সেই সিঁড়ি শেষ হল আরেকটা বড়ো ঘরে, সেই ঘরের দেওয়াল জুড়ে মিশরীয় দেবদেবীদের ছবি। তাদের গায়ের রং তখনও অটুট আছে। ঘরের এক পাশ থেকে পাওয়া গেল বেশ কিছু উশাবতি।’
‘উশাবতি? মানে সেই পুতুলগুলো যাদের মমির সঙ্গে রাখা হত, যাতে তারা মৃত্যুর পরের রাজ্যে ফারাওদের জন্য কাজ করে দেয়।’
‘বাহ! তোমার তো মনে আছে দেখছি। উশাবতিদের পেতেই বেলজোনি বুঝল ফারাওয়ের মমিও নিশ্চয় খুব কাছাকাছিই আছে! পাশের আরেকটা ছোটো ঘরেই পাওয়া গেল ফারাওয়ের কফিন!
দেইর-এল-বাহারিতে পাওয়া সেতির মমি (অধ্যায় ২১)
‘প্রায় স্বচ্ছ অ্যালাবাস্টার পাথরের তৈরি। গায়ে বুক অফ দ্য ডেড-এর মন্ত্র খোদাই করা আছে। ইজিপশিয়ান আর্টের মাস্টারপিস বলা যেতে পারে এই কফিনকে। এখন রাখা আছে লন্ডনের স্যার জন স্লোয়ান মিউজিয়ামে।’
সেতির সমাধির ভেতরে দেওয়াল জুেড় আঁকা ছবি
‘কফিন খুলেই ফারাওয়ের মমি পাওয়া গেল!?’
‘ধুর, কফিন একদম ফাঁকা ছিল।’
‘মানেটা কী? মমি কোথায় গায়েব হয়ে গেল?’
‘শুধু সেতির টুম্বে নয়, ভ্যালি অফ দ্য কিংসের অন্য আর দুটো টুম্ব বাদ দিয়ে বাকিগুলোর একটাতেও কোনো মমি পাওয়া যায়নি!’
‘বলেন কী? যার জন্য এত বড়ো কবরখানা বানানো সেই মমিই গায়েব!’
‘সেইসব মমিরা কোথায় গেল সেটা না হয় তোমাদের পরে আরেকদিন জিজ্ঞাসা করব। গুগল করে দেখে রেখো। বেলজোনির এই কবর আবিষ্কারের সঙ্গে একটা বেশ মজার ঘটনা জড়িয়ে আছে বুঝলে, সেটা বলি আগে, না হলে আবার ভুলে যাব।
প্রায় স্বচ্ছ অ্যালাবাস্টার পাথরের তৈরি সেতির কফিন
‘বেলজোনির সেতির কবর আবিষ্কারের খবরটা দাবানলের মতো ছড়িয়ে গিয়েছিল চারিদিকে। খবর তো আর খবর থাকে না, গুজবে বদলে যায়। সেই গুজব কানে গিয়ে পৌঁছোল হামিদ আঘার কানে। হামিদ আঘা ছিল ‘‘কেনা’’ নামের একটা শহরের মাতব্বর গোছের। সেতির কবরের মধ্যে নাকি একটা দারুণ ঐশ্বর্য পাওয়া গেছে! এটা শোনার সঙ্গেসঙ্গেই বেশ কয়েকটা পুলিশকে বগলদাবা করে আঘা ঘোড়া ছোটাল ভ্যালি অফ দ্য কিংসের দিকে।
‘গুপ্তধনের লোভে দু-দিনের রাস্তা দেড়দিনে পার করে আঘা যখন সেতির সমাধির মধ্যে ঢুকল তখন বেলজোনি ওখানেই ছিলেন। সমাধির দেওয়ালে দেওয়ালে আঁকা দারুণ ছবিগুলোর দিকে আঘা একবার তাকিয়েই মন্তব্য করল, এসব মেয়েমানুষদেরই ভালো লাগবে।
‘কিন্তু যার জন্য এতটা পথ আসা সেটা কোথায়! সমাধি তন্নতন্ন করে খুঁজেও কিছু পাওয়া গেল না। এবারে শুধু একদম ভেতরের ঘরটা দেখা বাকি।
‘সেই ছোট্ট ঘরটাতে ঢুকেই আঘা দেখল বেলজোনি বসে আছেন সেতির অ্যালাবাস্টার পাথরের তৈরি কবরের ওপরে।
‘ ‘‘গুপ্তধন কোথায়?!’’
‘ ‘‘কোন গুপ্তধন?’’
‘ ‘‘যেটা তুমি লুকিয়ে রেখেছ।’’
‘ ‘‘আমি এখানে কিচ্ছু পাইনি তো খুঁজে। একটা সোনার কণাও ছিল না।’’
‘ ‘‘ইয়ার্কি হচ্ছে! জানো আমি কে? আমার একটা আদেশে তোমার মাথা আলাদা হয়ে যাবে শরীর থেকে। ভালো চাও তো বলো সেই গুপ্তধনটা কোথায়?’’
‘ ‘‘কোন গুপ্তধনের কথাটা বলছেন সেটা তো বলুন আগে?!’’
‘আঘা এবারে বেলজোনিকে বলল তার কথা, যেটার লোভে ওর এতটা পথ উজিয়ে আসা। কিন্তু আঘার কথা শুনে বেলজোনি হাসি আর চেপে রাখতে পারলেন না। ওইটুকু ঘরটা হাসির চোটে গমগম করতে লাগল।
‘সেকী? হাসির কী হল?’
‘হাসবে না? আঘা কোন গুপ্তধনের খোঁজে এসেছিল জানো?’
‘কী?’
‘আঘা শুনেছিল যে সেতির সমাধিতে নাকি সোনার তৈরি একটা ইয়াব্বড়ো পেনিস পাওয়া গেছে। সেটা আবার হিরে আর মুক্তোতে মোড়ানো! গুজবের লেভেল কোথায় যেতে পারে খালি ভাব!’
শেষে সোনার তৈরি পেনিস!! আমি আর পিজি দু-জনেরই হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেল। পিজি বলল,
‘এই হামিদ আঘা তো হেব্বি গামবাট টাইপের ছিল! তা, এরপরে কী হল?’
‘কী আবার হবে? বেলজোনির হাসির চোটে আঘা বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। বেটা তখন ভালোই বুঝতে পেরেছে নিজের বোকামিটা। তাই আর কথা না বাড়িয়ে সুড়সুড় করে ওখান থেকে পালিয়ে আসে।’
‘আর বেলজোনি?’
‘সে-ভদ্রলোকের ধৈর্য অপরিসীম, বুঝলে। আলেকজান্ডার রিকি নামের এক ইতালিয়ান পেইন্টারের সঙ্গে মিলে বেলজোনি সেতির কবরের দেওয়ালে আঁকা প্রতিটা ছবি কপি করতে থাকেন। কিছু পাতায় জলরঙে এঁকে। আর কিছুর মোমের ছাপ নিয়ে। সমাধির প্রচণ্ড গরমে মোম বার বার গলে যেত। তাও সব মিলিয়ে ওঁরা প্রায় এক হাজার ছবি আর পাঁচশো হায়রোগ্লিফিক ইনস্ক্রিপশনের কপি তৈরি করেন।
‘১৮২০ সালে জিওভান্নি বেলজোনি লন্ডনে ফেরত আসেন। গোটা দেশের সবকটা নিউজপেপারের প্রথম পাতায় তখন ওঁর ছবি আর ওঁর অ্যাডভেঞ্চারের কথা। ওঁকে নিয়ে লেখা বই ইতালিয়ান, ফ্রেঞ্চ আর জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়। সে এক হইহই ব্যাপার, বুঝলে।
‘১৮২১-এর মে মাসে বেলজোনি লন্ডনের পিকাডিলিতে নিজের এগজিবিশন শুরু করেন। প্রথম দিনেই মিশরের ঐশ্বর্য দেখতে ভিড় করেছিল ১৯০০ মানুষ! সেদিন সকলকে তাক লাগিয়ে দেওয়ার জন্য বেলজোনি একটা নাম-না-জানা মমিও আন-র্যাপ করেছিলেন। অবশ্যই একদম হাতুড়ে পদ্ধতিতে। সেইদিনই আবার বেলজোনি সেতির কবর থেকে পাওয়া ফারাওয়ের নাম লেখা দুটো কার্তুজ দান করেন একজন ইংরেজ ডাক্তারকে। কে বলো তো? থমাস ইয়ং।’
১৮২০ সােল লন্ডন থেকে প্রকাশিত বেলজোনির অ্যাডভেঞ্চারের বই
বেলজোনির অ্যাডভেঞ্চারের আর্ট প্লেট
‘মানে, যিনি সেই হায়রোগ্লিফের মানে বের করার কাজে লেগেছিলেন?’
‘ঠিক, এই সেই থমাস ইয়ং, বেলজোনির দেওয়া কার্তুজ থেকেই থমাস কয়েকটা হায়রোগ্লিফিক চিহ্নর মানে বের করতে সক্ষম হন। সেটা আবার শাম্পোলিয়নকে সাহায্য করে বাকি হায়রোগ্লিফের মানে বের করতে।’
‘বাপ রে! বেলজোনি না থাকলে মিশরের ইতিহাসটাই অর্ধেক অজানা থেকে যেত তো।’
‘ঠিক তাই। একজন সার্কাসে-খেলা-দেখানো পালোয়ানের জন্য ইজিপ্টের কত অজানা ইতিহাস আজকে আমরা জানতে পারছি বলো। বেলজোনির নামে পরে কয়েন বেরোয়। ওঁর জন্মভূমি পাদুয়াতে ওঁর একটা স্ট্যাচুও আছে।’
‘আচ্ছা, লন্ডনের এগজিবিশনের পরে বেলজোনির কী হল?’
১৮২১ সােল লন্ডনের ইজিপশিয়ান হলে বেলজোনির এগজিবিশন
‘অন্য যে কোনো লোক হলে অত নামডাক, প্রভাব প্রতিপত্তিতেই গা ভাসিয়ে দিত। কিন্তু এ যে বেলজোনি। ১৮২৩ সালে বেলজোনি আবার বেরিয়ে পড়েন অ্যাডভেঞ্চারে। এবারের লক্ষ্য পশ্চিম আফ্রিকার নিগার নদী ধরে এগিয়ে হারানো শহর টিমবাকটুকে খুঁজে বের করা। ঠিক যে স্বপ্নটা দেখেছিলেন ওঁর গুরু জোহান বুর্কার্ড। অদ্ভুতভাবে বেলজোনিও পারেননি সেই শহর খুঁজে বের করতে। বুর্কার্ডের মতোই বেলজোনিও ডিসেন্ট্রির কবলে পড়ে আফ্রিকার জঙ্গলের মধ্যে মারা যান ১৮২৩-এর তেসরা ডিসেম্বর। একটা গাছের নীচে কবর দেওয়া হয় তাঁরকে। যে মানুষটা নিজে এত কিছু আবিষ্কার করেছিলেন তাঁরর কবর আজ অবধি কেউ আর খুঁজে পায়নি।
‘একটা দারুণ মানুষের গল্প বললেন, সত্যি। শুধু বেলজোনির জীবন নিয়েই হলিউড একটা ব্লকবাস্টার সিনেমা বানিয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু ভবেশদা, বেলজোনির পরে ভ্যালি অফ দ্য কিংসের কী হল?’
‘ভিক্টর লোরেট নামের এক ব্রিটিশ আর্কিয়োলজিস্ট ব্যাপক খোঁড়াখুঁড়ি চালান ওখানে। সেই সময়েই ফারাও তৃতীয় তুতমোসিস, দ্বিতীয় আমেনহোতেপের সমাধি পাওয়া যায়। তারপরে আরেক আর্কিয়োলজিস্ট থিওডোর ডেভিস এখানে কাজ করেন টানা বােরা বছর। একে একে আবিষ্কার হতে থাকে বাকি ফারাওদের সমাধিও। একটা সময় মোটামুটি সবাই ধরে নেয় যে ভ্যালি অফ দ্য কিংসের আর কিছু দেওয়ার নেই। সবই আবিষ্কার হয়ে গেছে। শুধু একজন মানুষ এই কথায় বিশ্বাস করেননি। আর এই অবিশ্বাসের জন্যই ইজিপ্টোলজির ইতিহাসে আজকে সবার আগে তাঁরর নামটাই আসে মুখে।’
ভবেশদা কার কথা বলছেন সেটা বুঝতে আর বাকি রইল না আমাদের।
হাওয়ার্ড কার্টার!!
তবে সেই গল্প শুরু হল মেস থেকে ডিনার করে আসার পরে।