উনবিংশ পরিচ্ছেদ
যেজন্য মৌপাহাড়িতে আসা তাহার বিশেষ কিছু সুরাহা হইল না। তাহাদের বাড়িতে বসবাসকারী ভদ্রলোক পুনরায় বিনয়ের সঙ্গে বলিলেন, তাহার আরও খানিকটা সময় প্রয়োজন। কতটা সময়? না, সেটা তিনি এখনই বলিতে পারিতেছেন না, তবে সবদিক একটু গুছাইয়া উঠিতে পারিলেই তিনি নিজেই তাহা জানাইয়া দিবেন। পরের বাড়ি অধিকার করিয়া থাকা! ছি ছি, সে প্রবৃত্তি যেন তাহার কখনও না হয়।
কাজল বুঝিতে পারিল এ বাড়ি সহজে উদ্ধার হইবে না। ভদ্রলোকের বিনয় এবং ব্যবহারের মিষ্টতা যে একান্তই মিথ্যাচার তাহা তাঁহার চোখের দিকে তাকাইলে বুঝিতে বাকি থাকে না। অপূর্বকুমার রাযের ভক্তের অভাব নাই, কিন্তু তাহারা তাহাদের প্রিয় লেখকের স্মৃতিরক্ষার জন্য সঙঘবদ্ধ হইয়া লড়িবে—এ আশা করা বৃথা। তাহার বাবার সঙ্গে পরিচয় এবং বন্ধুত্ব ছিল এমন লোকও মৌপাহাড়িতে এখন বিশেষ নাই। অনেক সময় কাটিয়া গিয়াছে, পটভূমির সার্বিক পরিবর্তন ঘটিয়াছে, প্রকৃত সাহায্য দান করিবার মতো কেহ কোনদিকে নাই।
যে খাটে ছোটবেলায় সে বাবা ও মায়ের সঙ্গে ঘুমাইত, সেই খাটে বসিয়া বিড়ি টানিতে টানিতে লোকটা ছদ্ম বিনয় করিতেছে। যে কুলুঙ্গিতে তাহার মায়ের লক্ষ্মীর আসন পাতা ছিল, সেখানে এখন বার্লির কৌটা, নারিকেল তেলের শিশি, এক বাক্স টেক্কা-মার্কা দেশলাই এবং আরও কী কী যেন রহিয়াছে। এমন অদ্ভুত পরিস্থিতিতে সে কখনও পড়ে নাই। তাহার বাবার পবিত্র স্মৃতিপূত বাড়ি, সেখানে অন্য লোক বাস করিতেছে, বলিলেও উঠিতেছে না। সে নিজেও অন্যের বাড়িতে রাত কাটাইতেছে। বাড়িটা কি হাতছাড়া হইয়া যাইবে? সম্পত্তির ওপর তাহার বিন্দুমাত্র লোভ নাই, কিন্তু বাবার স্মৃতিরক্ষার ব্যবস্থা তো করিতেই হইবে। তাহার বাবার সাহিত্য যে চিরজীবী হইবে ইহাতে তাহার কোনো সন্দেহ নাই। আগামীযুগের মানুষ তাহার কাছে কৈফিয়ৎ চাহিবে—এত বড়ো সাহিত্যিকের সন্তান হইয়া সে পিতার স্থায়ী স্মৃতিরক্ষার জন্য কী করিয়াছে?
সে কী করিতে পারে? একা?
অবশ্য একথা ঠিক যে, বড়ো সাহিত্যিকের স্মৃতিকে চিরস্থায়ী করিবার জন্য আলাদা ব্যবস্থা গ্রহণ করিবার প্রয়োজন হয় না, নিজের রচনার মধ্যেই তিনি বাঁচিয়া থাকেন। পাঠক আগ্রহ করিয়া না পড়িলে লাইব্রেরি আর সংগ্রহশালা স্থাপন করিয়া কোনো লাভ নাই। পৃথিবীতে কোথায় হোমার বা কালিদাসের স্মৃতিভবন আছে? কিন্তু মানুষ তাঁহাদের ভুলিয়া যায় নাই।
না, উপমাটা যথাযথ হইল না, সেকালের সহিত আধুনিক যুগের অনেক তফাৎ। সেকালে মুদ্রণযন্ত্র ছিল না, সংরক্ষণের বৈজ্ঞানিক উপায় আবিষ্কৃত হয় নাই। মানুষ কাব্য শুনিয়াই তৃপ্ত হইত। মুখে মুখে তাহা প্রচারিত হইত, অথবা উৎসাহীরা হাতে লিখিয়া পুঁথির নকল করিয়া লইত। আজ ‘রঘুবংশ’-এর পাণ্ডুলিপির সন্ধান পাওয়া গেলেও কি নিশ্চিতভাবে বলা যাইবে যে তাহা স্বয়ং কালিদাসেরই হস্তাক্ষর?
কিন্তু যুগ বদলাইয়াছে। এখন সে বাবার পাণ্ডুলিপি, কল ডায়েরি, জামাজুতা সবই ইচ্ছা করিলে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করিতে পারে। এই কাজ সে না করিলে সব হারাইয়া যাইবে, তছনছ হইয়া যাইবে। আজ হইতে পাঁচশত বৎসর পবে সে থাকিবে না, বর্তমান পৃথিবীব ভৌগোলিক মানচিত্র বদলাইয়া যাইবে, শক্তি হস্তান্তরিত হইবে পাত্র হইতে পাত্ৰান্তরে, এবাবেব বসন্তে যত কোকিল ডাকিয়াছিল তাহাদের বংশ অতীতেব ছায়ামূর্তিতে পর্যবসিত হইবে—কিন্তু তাহার বাবা থাকিবে। সেই আগামীকালের উৎসুক মানুষদের জন্য ভাবিতে হইবে।
বাড়ি হইতে বাহির হইবার সময উঠানেব স্মৃতিস্তম্ভটার দিকে তাহার নজর পড়িল। সাদা পাথরের ফলকে তাহার মায়ের লেখা কবিতাটি উৎকীর্ণ বহিছে। বাতাসের সঙ্গে ভাসিযা আসা লাল ধুলায় পাথরটা বিবর্ণ। সে পকেট হইতে রুমাল বাহিব করিয়া সযত্নে পাথরের গা হইতে ধুলা ঝাড়িয়া দিতে লাগিল। বৃদ্ধ ভদ্রলোক বারান্দায় দাঁড়াইয়া হাসিয়া বলিলেন—অনেক ধুলো, রোজ জমছে–কত আর সাফ করবেন?
কাজল তাহার দিকে তাকাইয়া বলিল—কেউ জমতে দেয়, কেউ পরিষ্কার করে। আপনি কোন দলে?
ভদ্রলোক নিঃশব্দে বাড়ির ভেতরে সরিয়া গেলেন।
হেমন্তকাল হইলেও দুপুরে রৌদ্র বেশ চড়িল। খাওয়াদাওয়া সারিয়া কাজল হেডমাস্টার মশাইয়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করিল। মাস্টারমশাই বলিলেন—এবার বরং একটু বিশ্রাম করে নিন, চারটেয় চা দেব–
বিকালে চা খাইয়া কাজল একটু বেড়াইতে বাহিব হইল।
রেলওয়ে লেভেল ক্রসিং পার হইয়া যে রাস্তাটা শহরের বাহিরের দিকে গিয়াছে সেই পথ ধরিয়া সে চলিল। জাতীয় সড়কে উঠিয়া পথটা আবার ওপাশের জঙ্গলের মধ্যে নামিল। এই পথ ধরিয়া আট-দশ মাইল গেলে ধারাগিরি জলপ্রপাত, ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে সে একবার আসিয়াছিল। মৌপাহাড়ির আরও দুএকজন সপরিবারে সঙ্গে ছিলেন। এখনও স্বপ্নের মতো মনে পড়ে—তিনখানি গরুর গাড়ি ক্যাচকেঁচ শব্দ করিয়া মন্থর গতিতে চলিয়াছে। সময়টা ছিল বসন্তকাল, নানান লতাপাতার একটা অদ্ভুত মিশ্র গন্ধ বাতাসে। বনকাটি পাহাড় ছাড়াইয়াই বাসাডেরার দিকে পথ ক্রমশ উঁচুতে উঠিতে লাগিল। তাহার বাবা মাঝে মাঝে গাড়ি হইতে নামিয়া হাঁটিয়া চলিতেছে। বাবার হাতে একটা কী গাছের সরু ডাল, মনের আনন্দে বাবা সেটাকে একটু বাদে বাদেই তলোয়ারের মতো সাঁই সাঁই করিয়া ঘুরাইতেছে।
বাবার আগুনের মতো রঙ, বড়ো বড়ো চোখ, লম্বা উন্নত চেহারা।
বনের মধ্যে আলো পড়িয়া আসিতেছে।
বহু পিছনে ফেলিয়া আসা শৈশবের সেই দিনটা আর একবার ফিরিয়া আসে না?
কোনদিকে কেহ নাই। নির্জন বনভূমিতে আশ্চর্য অলৌকিক সন্ধ্যা নামিতেছে। একটা বড়ো অর্জুনগাছের নিচে একখানি শিলাখণ্ডের ওপর সে বসিল। অনেকদিন পরে এমন নির্জনতা সে উপভোগ করিতেছে। পৃথিবীর সমস্ত বড়ো শিল্প, তা সে সাহিত্যই হউক বা সংগীত কিংবা দর্শকই হউক, জন্ম লইয়াছে এই নির্জনতা, একাকীত্ব আর যন্ত্রণা হইতে। সে আজকাল বড়ো বেশি শহুরে হইয়া পড়িয়াছে। কোথায় গেল হোটবেলার সেই সহজ আনন্দ, সেই দিগন্তবিস্তীর্ণ মাঠ, আলোর মধ্যে আরও এক আলো, চোখের মধ্যে আরও এক চোখ? জীবনকে সার্থক করিবার জন্য কী করিতেছে সে? হ্যাঁ, কিছু ভালো ভালো বই পড়িতেছে বটে, কিন্তু এই বিশাল বিশ্বজগৎটার দৃশ্যমান কর্মকাণ্ডের আড়ালে যে রহস্যময় শক্তি ক্রিয়াশীল, তাহার কতটুকু জানা হইল? সময় বড়ো কম, প্রতিদিন একদিন করিয়া সময় কমিয়া আসিতেছে।
কিছু করিতে হইবে না–ব্ল্যাকবোর্ডে বড়ো বড়ো দুর্বোধ্য অঙ্ক কষিবার প্রয়োজন নাই, ল্যাবোরেটরিতে জটিল যন্ত্র লইয়া নাড়াচাড়া করিবার দরকার নাই, দর্শনের দুরুহ তত্ত্বের জালে জড়াইবার আরশ্যকতা নাই, কেবলমাত্র এইরকম শান্ত পরিবেশে থাকিয়া দুই চোখ ভরিয়া বিশ্বের সৌন্দর্য দেখিলেই চলিবে। জন্ম হইতে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিদিনের বাঁচার ইতিহাস, প্রতি সকালের স্নিগ্ধ আমন্ত্রণ, মায়ের ভালোবাসা, প্রথম প্রণয়ের শিহরণ জাগানো পবিত্র অনুভূতি, মহাকাল ও মহাবিশ্ব সম্বন্ধে গভীর অনুধ্যানএই থাকিলেই চলিবে। দেহের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী, কিন্তু প্রত্যেক চিন্তাশীল মানুষের উচিত পরবর্তী প্রজন্মের জন্য নিজের অভিজ্ঞতার ইতিহাস লিপিবদ্ধ করিয়া বাখা। কীর্তিই মানুষকে অমর করে, স্বল্পকালের জীবন নহে।
আলো একেবারেই কমিয়া আসিয়াছে। সন্ধ্যার সময় বনকাটি আর বাসাডেরা পাহাড় হইতে বুনো হাতি নামে। কাজল ফিরিবার পথ ধরিল।
পেছনে শুষ্ক ঝরাপাতার ওপর কাহার যেন পায়ের শব্দ। সে ফিরিয়া তাকাইল। না, কিছু নাইকেহ নয়। হয়তো বাতাস। অথবা অতীত। অতীত তো পেছনেই থাকে।
মাঝে মাঝে একই ধরনের বিপর্যয় মানুষের জীবনের ওপর আসিতে থাকে। মৌপাহাড়ি হইতে ফিরিয়া কাজল খবর পাইল নিশ্চিন্দিপুরে তাহাদের ভিটা ও সংলগ্ন জমি কাহারা বেড়া দিয়া ঘিরিয়া লইতেছে। নিশ্চিন্দিপুরেরই একজন লোক, তাহাকে কাজল চেনে না, সে আসিয়া সংবাদটা দিয়া গেল। কোনো কোনো মানুষ দুঃসংবাদ দেওয়ার সুযোগ পাইলে ভারি খুশি হয় এমনিতে তাহারা কোনো যোগাযোগ রাখে না, কিন্তু কারুকে চিন্তিত করিয়া তুলিবার মতো পরিস্থিতি হইলে একেবারে দৌড়াইয়া আসে।
দিনদুয়েক পরে কাজল নিশ্চিন্দিপুর রওনা হইল। এখন আর আগের মতো অবস্থা নাই, একেবারে গ্রামে ঢুকিবার পথ পর্যন্ত বাস চলিতেছে। পথে-ঘাটে প্রায়ই মোটরগাড়ি দেখা যায়, গ্রামের ছেলেমেয়েরা অবাক বিস্ময়ে ছুটিয়া আসে না। তাহার বাবা কিংবা পিসির মতো আর কি তাহারা রেলগাড়ি দেখিবার জন্য মাঠঘাট ভাঙিয়া আগ্রহে ছুটিয়া যায়? পৃথিবী বদলাইতেছে, মানুষ বদলাইতেছে, সবকিছুই বদলাইতেছে।
গ্রামে পৌঁছাইয়া কাজলের মন আরও খারাপ হইয়া গেল। পরিবর্তন এভাবে পরিচিত জীবনকে গ্রাস করে? নিশ্চিন্দিপুরের সেকালের আর বিশেষ কেহ বাঁচিয়া নাই, যাহারা আছে তাহারাও অনেকেই বিদেশে বাস করে। রানুপিসির বয়েস হইয়া গিয়াছে, চুলে পাক ধরিয়াছে, তবু সমস্ত নিশ্চিন্দিপুরে রানুপিসিই তাহার একমাত্র আশ্রয়—যাহার সঙ্গে বাল্যের একটা সম্পর্ক রহিয়াছে।
কিন্তু গ্রামে জনসংখ্যা বাড়িয়াছে। অচেনা সব লোক। এরা কোথা হইতে আসিল? দুপুরবেলা খাইতে খাইতে প্রশ্নটা সে রানুপিসিকে করিল।
রানু বলিল—আর বলিস না, আমাদের ছোটবেলার সে গা আর নেই, সব পালটে গিয়েছে। দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গ থেকে দলে দলে লোক এসে জমি কিনে গাঁয়ে বাস করছে। যশোর খুলনা ঢাকা বরিশাল—আরও কত সব জেলা থেকে। আমরাই সবাইকে চিনি না, তা তুই চিনবি কোথা থেকে? অত বড়ো কুঠির মাঠ, গিয়ে দেখ তার সব প্রায় ভর্তি–
—বাড়ি উঠেছে?
—সার সার বাড়ি উঠেছে, মুদির দোকান হয়েছে, তিন-চারটে বড়ো পাড়া বসে গিয়েছে, তুই দেখলে আর চিনতে পারবি না—
তাহার পর কিছুটা যেন আত্মগত স্বরে বলিল—তোর পিসি দুর্গা আমার খুব বন্ধু ছিল। দুর্গা আর আমি মাঝেমাঝেই কুঠির মাঠে বেড়াতে যেতাম, জানিস? কত সুন্দর ছিল সে সব দিন! একটা এড়াঞ্চির ঝোপের পাশে বসে দুজনে গল্প কবতাম-বিরাট বড়ো ঝোপ। গতবছর সুন্দরপুর যাচ্ছিলাম তোর পিসেমশাইয়ের এক আত্মীয়ের বাড়িতে, কুঠির মাঠের পাশ দিযেই পথ, দেখলাম আমাদের ছোটবেলার সে ঝোপটা আর নেই, কাবা যেন কেটে ফেলেছে। হয়তো ব্যাপারটা কিছুই না, বুঝলি? কিন্তু তোর বাবা আমার চোখ খুলে দিয়েছিল। হঠাৎ এমন মন-কেমন করে উঠল ঝোপটার জন্য যে কী বলব!
কাজল দেখিল রানুর চোখে জল আসিয়া টলটল করিতেছে।
কাজলের গলায় ভাত আটকাইয়া যাইতে লাগিল। রানুপিসির কাছে যেন তাহার এবং তাহার বাবার শৈশব জমা রহিয়াছে। কত স্মৃতি, বাবার কাছে শোনা কত গল্প, কত তুচ্ছ হাসিকান্নার মালায় গাঁথা বিস্মৃত অতীতদিন! সে বুঝিতে পারিল, পৃথিবীতে যেখানেই সে বাস করুক না কেন, আসলে তাহার আশ্রয় এই গ্রামে।
রানু বলিল–খাচ্ছিস না যে? খা–
কাজল বলিল–রানুপিসি, আমার বাবা এই গ্রামকে প্রাণেব মতো ভালোবাসতেন, তাব লেখাতেও এই গ্রামকে অমর করে রেখে গিয়েছেন। আমিও এক্ষুনি বুঝতে পারলাম আমাকেও একদিন আবার এখানে ফিরে আসতে হবে। তুমি দেখো, আমি ঠিক নিশ্চিন্দিপুবে এসে বাস করবো।
রানু যেন কেমন অবাক হইয়া কাজলের দিকে তাকাইল, তারপর বলিল—তোর বাবাও গাঁ ছেড়ে যাবার সময় ঠিক এই কথা বলে গিয়েছিল, কিন্তু কথা রাখে নি—
-বাবা যে অল্পবয়েসেই চলে গেল পিসি, নইলে ঠিক ফিরে আসত—
–তুই সত্যি আসবি? সত্যি করে বলছিস?
-–ঠিক আসবো পিসি। দেরি হবে হয়তো, কিন্তু সত্যি আসবো। আর—
কাজল চুপ করিয়া আছে দেখিয়া রানু বলিল—আর কী?
—তুমি ততদিন বেঁচে থেকো পিসি। নইলে আমার ফিরে আসবার মানে থাকবে না। কার কাছে, কার জন্য ফিরে আসবে বলো? কেউ তো নেই, যারা আছে তারাও বন্ধু নয়—
রানু বলিল—হারে, তোদর ভিটের চারপাশের জমিগুলো নাকি চনু ঘিরে নিচ্ছে? সত্যি?
–হ্যাঁ পিসি। কে ঘিরহে জানতাম না, খবর পেয়ে এসেছিলাম, এসে দেখি চনুর কাণ্ডচনু তোর ছোটবেলার বন্ধু না?
একসঙ্গে খেলতাম, খুব বন্ধুত্ব ছিল দুজনের।
-তোর সঙ্গে দেখা হয়েছে? কী বলল?
—এখনও দেখা হয়নি। এসেই যখন খবর পেলাম যে চনু জমি ঘিরছে, তখন ভাবলাম আগে ওর কাছেই যাই, দেখি ওর কী বলার আছে। তা ডাকাডাকি করতে চনুর ছেলে বেরিয়ে এসে বলল—বাবা বাড়ি নেই, বৈরামপুর গিয়েছে। কাল সকালে আর একবার যাবো
সামান্য বিশ্রাম করিয়া কাজল বলিল–পিসি, যাই একবার আমাদের ভিটের দিক থেকে ঘুরে আসি। ফিরে এসে চা খাবো। আজ সন্ধেবেলা চালভাজা খাওয়াবে পিসি? অনেকদিন খাইনি
কথাটা সম্পূর্ণ সত্য নয়। মালতীনগরে রোজ সে চালভাজা খায় না সত্য, কিন্তু ইচ্ছা হইলেই মাঝে মাঝে সে মাকে বলে। হৈমন্তী ছেলের জন্য কাঠখোলায় চাল ভাঙ্গিয়া দেয়। আসলে সে জানে কোন আরদার করিলে রানুপিসি খুশি হইবে। রানু বলিল—একটু দাঁড়া, কাপড়টা বদলে নিই, আমিও তোর সঙ্গে যাবে।
বাঁশবাগানের ভিতর দিয়া পথ। বেলা এখনও বেশ আছে, কিন্তু বাঁশবনের মধ্যে কেমন একটা রহস্যময় আলোছায়ার জগৎ। প্রাণের শিকড় যে জমিতে আছে সেখানে উপস্থিত হইলে মানুষ যুক্তি ভুলিয়া যায়, প্রাচীন ঐতিহ্য রক্তের মধ্যে অশান্ত কল্লোল তোলে। কাজলের মনে হইল প্রতি পা ফেলিবার সঙ্গে সঙ্গে সে এক অদ্ভুত জগতে প্রবেশ করিতেছে-যেখানে সবই সম্ভব। এখুনি সে তাহার ঠাকুমা কিংবা ঠাকুরদাকে দেখিতে পাইবে, তাহার বাবাকে কিশোররূপে খেলা করিতে দেখিতে পাইবে। অনেকদিন আগের সে যুগটা আবার পুরাতন নাটকের মতো তাহার সামনে অভিনীত হইবে। বাহিরের পৃথিবীটা এখানে তাহার বুঢ় প্রভাব বিস্তার কবিতে পারে নাই। এখানে মেঘের ছাযাব মতে, ফুলের হাল্কা গন্ধের মতো, দূরত বাঁশির শব্দের মতো, মায়ের স্নেহের মতো নরম আলোয় পবিবেশ পরিপূর্ণ। সত্য জীবন এখানেই বিকশিত, যে জীবন হাজার বছর ধরিয়া নির্জনে শান্ত স্রোতস্বিনীর মতো প্রবাহিত।
রানু বলিল—ঠিক এইখানটায় ছিল তোদর খিড়কির দরজা। তোর ঠাকুমা ঘুমিয়ে পড়লে দুগগা এই দরজা দিয়ে পালিয়ে আসত, আমরা পুরোনো দীঘির আমবাগানে বসে গল্প করতাম, তেঁতুল মেখে খেতাম
আবার সেই বুনো গন্ধটা বাহির হইয়াছে, এখানে আসিলেই কাজল যেটা পায়।
বাড়ির সব দেওয়ালই পড়িয়া গিয়াছে, ঢুকিবাব আর কোনো পথ নাই। ঘেঁটু, কালকাসুলে আর আসশেওড়ার জঙ্গলে ভিটা ঢাকা পড়িয়াছে, গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে ধ্বংসস্তূপের দু-একখানা ইট দেখা যায়। শান্ত অপরাহু। ওপাশের সজিনা গাছের ডালে বসিয়া কী একটা পাখি ডাকিতেছে।
কাজলের বুকের ভিতরটা অদ্ভুত এক অনুভূতিতে ভরিযা উঠিল। তাহার পিতা-পিতামহপ্রপিতামহ যেন মহাকালের স্রোতে কোথায় ভাসিয়া গিয়াছে, তেমনই একদিন সেও কোথায় অনির্দেশ্য ভবিষ্যতের অলিন্দপথে মিলাইয়া যাইবে। আজকের আনন্দ, ভালোবাসা, ওই নাম-না-জানা পাখিটা, সামান্য কয়েককাঠা জমি লইয়া বাল্যবন্ধুর ষড়যন্ত্র—এসব কোথায় থাকিবে সেই দূর ভবিষ্যতে?
থাকিবে বিশুদ্ধ আনন্দ আর থাকিবে মহাজীবন। সে থাকিবে না, মহাজীবন থাকিবে।
সন্ধ্যার পর চনুর সঙ্গে দেখা হইল। তাহার কথাবার্তার ধরনে কাজলের দৃঢ় বিশ্বাস হইল সে মিথ্যাকথা বলিতেছে। সে বৈরামপুর যায় নাই, বাড়িতেই ছিল। কাজল যে খবর পাইয়া হঠাৎ আসিয়া পড়িবে, এটা সে ভাবে নাই, কাজেই কী বলিবে তাহা ঠিক করিবার জন্য দেখা করিবার সময়টা পিছাইয়া দিতেছিল।
শুক্লপক্ষ। চমৎকার জ্যোৎস্নায় চারদিক মায়াময় দেখাইতেছে। এমন সুন্দর পরিবেশে কাজল চনুর সঙ্গে বৈষয়িক আলোচনায় বসিল। কাজল জিজ্ঞাসা করিল—কেমন আছিস বল, অনেকদিন দেখা হয় না—
–ওই একরকম। আমাদের আবার থাকা! তোমরা শহরে বড়ো বড়ো ব্যাপার নিয়ে থাকো, তোমাদের ব্যাপারই আলাদা। আমরা ভাই গাঁয়ের মানুষ খেটে খেতে হয়, আমাদের দুঃখ তোমরা বুঝবে না–
চনুর ঠেস দেওয়া কথার ধরনে কাজলের মনটা খারাপ হইয়া গেল। একটু কুশল প্রশ্ন নাই, কিছু নাই, বহুদিন পর প্রথম দেখায় শৈশবের বন্ধুর মুখে এসব কী কথা? আর শহরে থাকে বলিয়া সে কি শ্রম করে না? হয়তো মাঠে চাষের কাজ করে না, কিন্তু যে কাজ সে করে তাহাতে যথেষ্ট পরিশ্রম করিতে হয়। যাহার যা কাজ!
সে বলিল—তুই আমাকে তুমি করে কথা বলছিস যে বড়ো? আমরা ছোটবেলার বন্ধু না?
–না ভাই, ছোটবেলার কথা ছেড়ে দাও। এখন কি আর তোমাদের সঙ্গে আমার মেলে?
তাহাদের পুরানো ভিটার দিকের বকুল গাছটা হইতে একটা নিমপেঁচা ডাকিয়া উঠিল। উঠানে জ্যোৎস্নায় গাছপালার পাতা আর ডালের ছায়া পড়িয়া কাঁপিতেছে।
কাজল বলিল—বিকেলে আমাদের ভিটের দিকে গিয়েছিলাম, দেখলাম অনেকখানি জমি কারা বেড়া দিয়ে ঘিরে রেখেছে—তুই এ ব্যাপারে কিছু জানিস?
চনু অকারণেই একটু গরম হইয়া বলিল—আমি ঘিরেছি। আমাদের জমি আছে, তাই ঘিরেছি। কেন, তাতে কী হয়েছে?
-রাগ করছিস কেন ভাই? আমি কি অন্যায় কিছু বলেছি? ওদিকটায় তোর কিছুটা জমি আছে সে আমি জানি, কিন্তু দেখে মনে হল আমাদের কিছু জমি তোর দেওয়া বেড়ার মধ্যে ঢুকে গিয়েছে। তাই
–তাই কী? তুমি ভুল করছে, ওখানে তোমার কোনো জমি নেই–
কাজল দুঃখিত গলায় বলিল—আছে কিনা সে আমরা দুজনেই জানি। মনের অগোচরে তো কোনো সত্য গোপন থাকে না। তুই এমন করলি কেন? আমাকে একবার খবর দিলে তো পারতিস! তোর জমির প্রয়োজন থাকে, আমি তোকে অন্য জায়গায় জমি দিতাম। বাবা মারা যাবার আগে গ্রামে কিছু জমি মায়ের নামে কিনে দিয়ে গিয়েছিলেন, তার থেকে দিতাম। তোর পছন্দমত প্লট বেছে নিতে পারতিস, আমি টাকা নিতাম না। তুই ছোটবেলার বন্ধু হয়ে আমার সঙ্গে এমন করলি?
–অন্য জায়গায় জমি নিয়ে আমি কী করবো? বাড়ির লাগোয়া না হলে আমার চলবে না। তাছাড়া আমি কোনো অন্যায় করিনি–জমি আমার।
–পুরোনো ভিটের পাশে পৌনে একবিঘে জমির টুকরোটা কি করে তোর হল চনু?
চনু বলিল—এটা তোমার বাবা আমার মাকে দান করেছিলেন। আমার কাছে কাগজ আছে—
কাজল প্রথমটা এত অবাক হইয়া গেল যে তাহার মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না, তাহার পর সে বলিল—কাগজ আছে? কী কাগজ? পাকা দলিল, না দানপত্র?
-কেন, পাকা দলিল না হলে কি তুমি মানবে না?
—তা নয়, বাবা যদি সাদা কাগজেও কাউকে কিছু লিখে দিয়ে থাকেন আমি তার মর্যাদা দেব। কই সে কাগজ?
চনু বলিল—আজ রাত্তিরে খুঁজে বার করতে পারব না। কাল সকালে এসো, দেখাব।
নিমপেঁচাটা আবার ডাকিয়া উঠিল।
জ্যোৎস্নাভরা এই উঠানে সে আর চনু ছোটবেলায় খেলা করিত। তে হি নো দিবসাঃ গতা।
কাজল বলিল—আচ্ছা ভাই উঠি। কাল সকাল আটটা নাগাদ একবার আসব, দেখাস কাগজখানা। বাবা যদি সত্যি ও জমি তোদের লিখে দিয়ে থাকেন, তাহলে অন্তত আমার দিক থেকে তোর কোনো চিন্তা নেই। চলি।
হেমন্তরাত্রিতে হালকা কুয়াশার আররণে তাহাদের গ্রামের কী অপূর্ব রূপই না বিকশিত হইয়াছে! হায় রে, ইহার সঙ্গে মানুষগুলিও যদি ভালো হইত! সংকীর্ণ পরিধির মধ্যে ইহাদের মন সঠিকভাবে বাড়িয়া ওঠে নাই, এই গ্রামের দিগন্তেই তাহাদের জীবনের দিগন্তের সীমা। সংস্কৃত উপকথার সেই যাযাবর হাঁসেদের কথা মনে পড়িল, যাহারা মানস সরোবর যাইবার পথে বাংলাদেশের এক গ্রামে একটি ছোট পুকুরের ধারে রাত্রির আশ্রয় লইবার জন্য নামিয়াছিল। স্থানীয় গ্রাম্য হাঁসেরা বুঝিতে পারিল না, এত কষ্ট করিয়া তাহারা কেন মানস সরোবরে যাইতেছে, কী আছে সেখানে? যাযাবর হাঁসেরা হিমালয়ের পর্বতশৃঙ্গ, তুষার আর অপার্থিব সৌন্দর্যের বিবরণ দিল। শুনিয়া গ্রাম্য হাঁসেরা হাসিয়া আকুল। সেখানে তাহাদের পুকুরের মতো গুগলি পাওয়া যায় কি? তাহা না হইলে এত কষ্ট করিয়া কী লাভ?
রানুপিসিদের বাড়ির পথে বাঁশবাগানটায় ঢুকিয়া কাজল দাঁড়াইয়া পড়িল।
এমন সৌন্দর্যময় রাত্রিও পৃথিবীতে আসে! চারিদিক নিঃশব্দ, কেবল দূরে কাহাদের বাড়িতে একটা কুকুর ডাকিতেছে। জ্যোৎস্নায় বাঁশপাতার নকশাকরা ছায়া মাটিতে পড়িয়াছে। বাতাসে আসন্ন শীতের মনোরম স্পর্শ আর কীসের যেন মৃদু সুগন্ধ। কবেকার সব কথা যেন মনে পড়িয়া যায়, তাহার জন্মেরও আগে ঘটিয়া যাওয়া সেসব ঘটনা কী করিয়া তাহার চেতনায় ধরা দিতে পারে তাহা সে বুঝিতে পারে না, কিন্তু কেমন একটা মেদুর অনুভূতি হয় সে কথা সত্য। জীবনের পটভূমি অকস্মাৎ অনেক বিস্তৃত হইয়া যায়। সে কেবল তাহার গৃহাঙ্গনে, ভারতবর্ষে কিংবা পৃথিবী নামক এই গ্রহটায় বাস করে না, বিশাল অনন্ত বিশ্ব সমস্ত নক্ষত্র নীহারিকাসহ তাহার অস্তিত্বের অংশ, এই সুন্দর জ্যোৎস্নাময়ী রাত্রি সেই মহত্তর জীবনের সংবাদ পৌঁছাইয়া দিতেছে। আনন্দ—আনন্দেই মুক্তি, আনন্দেই সত্যকার বাঁচিয়া থাকা।
পরের দিন চনু তাহাকে একটা ময়লা কাগজের টুকরা হাতে দিয়া বলিল—এই যে, পড়ে দেখ—
কাজল হাসিবে কী কাঁদিবে ঠিক করিতে পাবিল না। বহু ভাঁজ হওয়া একটা নোংরা কাগজ, তাহাতে আঁকাবাঁকা অক্ষরে, ভুল বানানে একখানি হিজিবিজি জমি দানের প্রতিশ্রুতি। নিচে লেখা— অপূর্বকুমার রায়। এই হস্তাক্ষর কখনওই তাহার বাবার নহে। স্বাক্ষরের নিচে যে তারিখ, তাহার দেড় বৎসর আগেই তাহার বাবা মারা গিয়াছে। বেচারা চনু! গ্রাম্যবুদ্ধিতে সঠিক হিসাব করিয়া উঠিতে পারে নাই। এরূপ ভৌতিক দানপত্র সহসা দেখা যায় না।
কাগজটা চনুর হাতে ফেরত দিয়া কাজল বলিল—চনু, আমার এক মাস্টারমশাই বলতেনসত্যি কথা বলতে প্রয়োজন সাহসের, আর মিথ্যে কথা বলতে বুদ্ধির। ঠিক বলতেন না?
-কী বলতে চাও তুমি?
–কিছুই না। এটা আমার বাবার হাতের লেখা নয়।
–আমি এই কাগজ জাল করেছি বলতে চাও?
–সেটা তো আমার চেয়ে তুই-ই ভালো জানিস। তাছাড়া এমন একটা লেখাকে দানপত্রও বলে না। আইনের চোখে এ জিনিস টিকবে বলে মনে হয় না। এতে অনেক গোলমাল রয়েছে।
চনু রাগিয়া অস্থির হইল। জমি সে কাহাকেও ছাড়িয়া দিবে না, তাহার জন্য সে শেষ অবধি দেখিতে রাজি।
কাজল চুপ করিয়া সব শুনিল, তারপর বলিল—কাউকে পোড়াতে নিয়ে গিয়েছিস কখনও?
আলোচনার দিক বদলে থতমত খাইয়া চনু বলিল—তার মানে?
–গিয়েছিস কখনও?
–গিয়েছি তো, তাতে কী?
শান্ত গলায় কাজল বলিল—আমি প্রথম আমার দাদামশাইকে দাহ করতে নিয়ে যাই। তুই তো তাঁকে দেখেছিস-সুরপতিবাবু, মনে আছে? তার আগে আর কখনও চোখের সামনে শবদাহ দেখিনি। দাদু খুব রাশভারী মানুষ ছিলেন, লোকে তার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে সাহস পেত না। সেই দাদুকে যখন চিতায় ওঠানো হল, দেখলাম কী অসহায়ভাবে তার দেহ চিৎ হয়ে পড়ে আছে। মন্ত্র পড়া হলে শ্মশানের পুরোহিত দাদুর দেহের ওপর আরও কখানা কাঠ চাপিয়ে দিয়ে তলা থেকে টেনে তার শরীরে ঢাকা দেবার শেষ কাপড়টুকুও বের করে নিল। উলঙ্গ ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন, উলঙ্গই চলে গেলেন।
চনুর গলার তেজ কমিয়া আসিয়াছে, অবাক গলায় সে বলিল—কী বকছো পাগলের মতো? কী বলতে চাও তুমি?
–বলতে চাইছি যে, সেই প্রথম আমার মনে হল—এ দুনিয়া থেকে কেউ কিছু নিয়ে যেতে পারে না। আমরা সবাই কথাটা জানি, কিন্তু কেউ মনে রাখি না। খামোকা পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কয়েকটা বছর ঝামেলা করে কাটাই। ও জমি আমি কোনেদিন ভোগ করতে আসবো না চনু, ওখানে আমার বাবার স্মৃতিভবন তৈরি হবে। তাকে অনেক লোক ভালোবাসে। তাদের সেই ভালোবাসার জোর থাকলে ওখানে স্মৃতিভবন হবেই, কেউ আটকাতে পারবে না। সে বন্যার জল তুই ঠেকাতে পারবি না। যদি তা না হয়, তাহলে সেটাকেই ভবিতব্য বলে মেনে নেব। তোর সঙ্গে আমার কোন ঝগড়া নেই। ততদিন কলাবাগান কর না, ক্ষতি কী–তবে আমাকে বলে কবলেই পারতিস, তাতে অন্তত আমাদের বন্ধুত্বটা নষ্ট হত না।
খাওয়া-দাওয়া করিয়া একটু বেলায় কাজল বাড়ির দিকে রওনা হইল। বানু ছোটবেলার মতো তাহার চিবুক ধরিয়া চুমু খাইয়া বলিল—তাড়াতাড়ি আবার আসবি, কেমন? একবার মাকে নিয়ে আয় না
-মায়ের শরীর মোটে ভালো যাচ্ছে না পিসি। আসলে বাবার মারা যাওয়াটা মা কিছুতেই মেনে নিতে পারেন নি, মনের কষ্টে ভেতরটা আস্তে আস্তে ক্ষয়ে যাচ্ছে। এমন দিন যায় না যেদিন বাবার কথা বলতে বলতে মা কাঁদে না
রানু বলিল–আমরা কেউ তোর বাবাকে ভুলি নি, তোর মাকে সে কথা বলিস–
গ্রামের পথ আঁকিয়া-বাঁকিয়া পাকা সড়কের দিকে চলিয়াছে। সে পথ ধরিয়া বাঁদিকে গেলে আষাঢ়, আর ওপাশে সোনাডাঙার মাঠ। অনেক-অনেকদিন আগে দুইটি গরিব ঘরের বালকবালিকা ওই পথ দিয়া রেলগাড়ি দেখিবার আশায় ছুটিয়া গিয়াছিল। তাহাদেব একজন এই গ্রামেই রহিয়া গিয়াছে, এই গ্রামেরই শান্ত নদীতীরে তাহার শেষ শয্যা রচিত হইয়াছিল। নির্জন বসন্ত দ্বিপ্রহরে এখনও কি সে গহন লতাকুঞ্জে কঁচপোকা খুঁজিয়া বেড়ায়?
কতদিন আগে স্বরূপ চক্রবর্তী গ্রামের নদীতীরে সন্ধ্যাবেলা দেবী বিশালাক্ষ্মীকে দেখিয়াছিলেন? সে কবেকার কথা? দেবী কি নিশ্চিন্দিপুর ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছেন?