মামুন এসেছিল। দুপুরে ভাত খেয়েছে।
এই খবরে মুনা বিন্দুমাত্র উৎসাহ দেখাল না। সে আজ একগাদা জিনিসপত্র কিনে বাড়ি ফিরেছে সন্ধ্যা পার করে। তিনটা বড় বড় প্যাকেট তার হাতে। উৎসাহ নিয়ে কি কি সে কিনল। তাই দেখাচ্ছে। জিনিসপত্রগুলি বিচিত্র। একটা গ্লোব। ব্যাটারি লাগান। সুইজ টিপলেই পৃথিবী ঘুরতে থাকে। একটা নব ঘুরিয়ে পৃথিবীর ঘূর্ণনের বেগ কমানো বা বাড়ানো যায়। মুনা উজ্জ্বল মুখে বলল, জিনিসটা সুন্দর না? বাবু অবাক হয়ে বলল, হ্যাঁ সুন্দর। এটা কি জন্যে কিনেছ?
পছন্দ হয়েছে তাই কিনেছি। আসল জিনিসটা দেখলে মাথাটা খারাপ হয়ে যাবে।
কি সেটা?
রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর দেখবি। শাড়ি কিনলাম দুটা। দেখ তো বকুল কেমন।
শাড়ি দেখে বকুল অবাক। কি চড়া রঙ চোখ ধাঁধিয়ে যায়। দেখেই বুঝা যাচ্ছে খুব দামী শাড়ি।
শাড়িগুলি কেমন কিছু বলছিস না কেন?
গায়ে কটকট করবে।
করুক কটকট। আমি কি বুড়ি হয়ে গেছি যে সাদা শাড়ি পড়তে হবে?
রাতের খাবার-দাবার শেষ হয়ে যাবার পর আসল জিনিসটা বেরুল। একটি ক্যাসেট প্লেয়ার। ছোটখাটো চমৎকার একটা জিনিস। বাবু অবাক হয়ে বলল, কত দাম আপা?
তেইশশ টাকা। জিনিসটা কেমন?
সুন্দর খুব সুন্দর। এত টাকা কোথায় পেলে তুমি?
ব্যাংকে যা ছিল খরচ করে ফেললাম। কি হবে টাকা জমিয়ে? পাঁচটা ক্যাসেট কিনেছি কোনটা দিব বল। রবীন্দ্র সঙ্গীত না হিন্দি। হিন্দি ক্যাসেট আছে তিনটা। একটা আছে পুরনো দিনের গান। কোনটা দেব বল?
বকুল বা বাবু কেউ কিছু বলল না। মুনা মহাউৎসাহে নিজেই একটি ক্যাসেট চালু করল। শওকত সাহেব তাস খেলে রাত নটার দিকে বাড়ি ফিরে শুনলেন–গান হচ্ছে–মাটি মে পৌরণ, মাটি মে শ্রাবণ, মাটি মে তনবিন জায়গা যব মাটি মে সব মিল যায়গা।
শওকত সাহেব বড়ই অবাক হলেন।
বাকের ঠিক করল। আজ বিকেলে যাবে ও-বাড়িতে। ব্যাপারটা তলিয়ে দেখা দরকার। দু’টি মেয়ে ছিল। ক’দিন ধরে দেখা যাচ্ছে তিনটে মেয়ে। তিন নম্বরটি বেঁটে ধরনের। মোটাসোটা। তবে এ অন্য দুজনের চেয়েও সুন্দর, গায়ের রঙ সোনার মত। মাথা ভর্তি চুল। এর সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হয়েছে এক’দিন মুন্দির দোকানে এসেছে কিসমিস কিনতে। কালো একটা চশমায় মুখ ঢাকা। শীতের দিনের বিকেলে যখন চারদিক এমনিতেই অন্ধকার তখন এ রকম একটা কালো চশমার মানে কি মুখ ঢেকে রাখা না?
জোবেদ আলীকে জিজ্ঞেস করেছিল মেয়েটির কথা। জোবেদ আলী গম্ভীর মুখে বলেছে। ওদের চাচাত বোন। চিটাগাং-এ থাকে। বেড়াতে এসেছে।
কি পড়ে?
বিএ ফাস্ট ইয়ার।
এখানের দু’জন ওরা কি পড়ে?
এরা আইএ পড়ে।
কলেজে-টলেজে তো দেখি না।
ভর্তি হয়নি এখনো। ট্রান্সফার নিয়ে এসেছে।
ও আচ্ছা।
ভর্তি নাও হতে পারে। বাবার কাছে চলে যেতে পারে।
ইরানে?
না ইরাকে।
এই ইরান-ইরাক ব্যাপারটাও সন্দেহজনক। পোস্টম্যানকে বাকের জিজ্ঞেস করেছিল–বিদেশী চিঠিপত্র এদের কেমন আসে? পোস্টম্যান বলেছে…. এই ঠিকানায় এখনো চিঠিপত্র আসা শুরু করে নাই। এর মানে কি? দুমাস হয়ে গেছে। এর মধ্যে চিঠিপত্র দিয়ে কেউ খোঁজ করবে না?
সবচে যা সন্দেহজনক, মেয়ে তিনটি পাড়ার কোনো বাড়িতে এখন পর্যন্ত যায়নি। এই বয়সের মেয়েরা দিনরাত ঘরে বসে থাকবে কেন? তাছাড়া এরা প্রচুর গয়না পরে। অবিবাহিত মেয়েরা সাজগোজ করে ঠিকই এত গয়না পরে না। ব্যাপারটা নিয়ে ইয়াদের সঙ্গে আলাপ করলে ভাল হত। কিন্তু ইয়াদ হারামজাদাটা বিয়ের পর ভেড়ুয়া নাম্বার ওয়ান হয়ে গেছে। সেই তেজ সেই সাহসের কিছুই নেই। মাথার মধ্যে তার শুধু সংসার ঘুরছে। সেদিন গিয়ে দেখে গামছা পরে কমোড় পরিষ্কার করছে। বেরিয়ে এসে বলল, কি করব বল বৌয়ের পরিষ্কার বাতিক। চাকর-বাকরের হাতে দিলে কিছুই হয় না। তুই নিজের চোখে দেখ কেমন ঝকঝকে করে ফেলেছি।
তোর বৌ কোথায়?
বাপের বাড়ি গেছে। আজ থাকবে সেখানে। আমাকে যেতে হবে। নয় তো তোর সঙ্গে জাম্পেশ আড্ডা দিতাম। শালা আড্ডা দেওয়াই ভুলে গেলাম।
না গেলেই হয় শ্বশুর বাড়িতে। থেকে যা আড্ডা দেই। পাড়ায় একটা ব্যাপার হচ্ছে এটা বলি।
ইয়াদ আঁতকে উঠল। হতাশ মুখ করে বলল, কোন উপায় নেই রে ভাই। আমি না গেলে ভূমিকম্প হয়ে যাবে। ওর আবার আমি পাশে না থাকলে ঘুম হয় না। ভূতের ভয়। অল্প বয়সের মেয়ে বিয়ে করে যারা ভুল করেছি রে ভাই।
রাগে গা জ্বলে যাবার মত কথা। ইয়া ধামড়ি মেয়ে বলে কী-না অল্প বয়সের মেয়ে।
পাড়ার সমস্যা কি বল শুনি। অনেক’দিন যাওয়া হয় না। সবাই আছে কেমন?
ভালই।
নাটক হচ্ছে নাকি? বদরুলের সঙ্গে দেখা হল? বই কোনটা নামাচ্ছিস?
জানি না এখনো।
তারপর বল কি ব্যাপার?
বাকের বলতে শুরু করতেই ইয়াদ তাকে থামিয়ে দিল। মুখ কাচুমাচু করে বলল, মেঝেতে ছাই ফেলিস না রে দোস্ত। বউ রাগ করে। দাঁড়া এসট্রে দিচ্ছি। কার্পেটে ছাই ফেললে তোলা মুশকিল। আঠার মত লেগে যায়।
বাকেরের মুখ তেতো হয়ে গেল। কি ছিল আর কি হয়েছে। বিয়ে তো আরো মানুষে করে কিন্তু এ রকম কেউ হয়? হারামজাদার পাছায় লাথি দিয়ে মুখে দুধের বোতল ধরিয়ে দিতে হয়।
ইয়াদ বাহারি একটা এসস্ট্রে এনে রাখল।
কেমন অদ্ভুত এসট্রে দেখলি। কচ্ছপের মত। সুন্দর না?
হুঁ।
দাম কত বল দেখি?
জানি না কত। আমি উঠলাম।
এখনি উঠবি? কি যেন বলবি বলছিলি।
আরেক দিন বলব।
আচ্ছা আসিস আরেক দিন।
বাকেরের আফসোসের সীমা রইল না। এত পয়সা খরচ করে এখানে আসাটা ভুল। শালা ভেভুয়া। পাড়ার একটা ব্যাপার। কিন্তু কোনো উৎসাহ নেই। এ কি অবস্থা। অথচ এক কালে এরই আশা-ভরসা ছিল।
সিগারেটটা ফেলে দিয়ে বাকের গেটে টোকা দিল। এরা একটা দারোয়ানও দেখি রেখেছে। দারোয়ানটার মধ্যে ড্যাম কেয়ার ভাব। দারোয়ান খসখসে গলায় বলল, কারে চান?
গেট খোল।
কারে চান বলেন?
আরে তুই তো মহা মাতবর দেখছি। চড় দিয়ে চাপার দীত ফেলে দিব। বাড়ি কোথায় তোর?
চুপ, মুখ সামলাইয়া কথা কন।
হারামজাদা বলে কি?
মেয়ে দু’টির মা বের হয়ে এলেন। সাদা সিন্ধের শাড়ি। পরনে চোখে রিমালেস চশমা। সিনেমার বড়লোক ছেলের মার মত চেহারা। ভদ্রমহিলা চিকন স্বরে বললেন, কি হয়েছে খসরু?
আম্মা ঝামেলা করতাছে।
গেট খুলে দে।
ভদ্রমহিলা এগিয়ে এসে মধুর গলায় বললেন, এস বাবা। এস। নতুন লোক, কার সঙ্গে কি ব্যবহার করতে হয় জানে না। বাকের খাতির-যত্বের বহরে হকচকিয়ে গেল।
বসার ঘরটি সুন্দর করে সাজানো। দেয়ালে তিনটা জলরঙ ছবি। ঝুলন্ত হ্যাংগারের অর্কিড। নিচু নিচু সোফা। তরমুজ আকৃতির ছটা বাতি রুপালি শিকলে ঝুলছে।
বাবা, তোমাকে তো চিনতে পারলাম না।
আমার নাম বাকের।
ও আচ্ছা। জোবেদ আলী বলেছে তোমার কথা।
নতুন এসেছেন। খোঁজ-খবর নিতে আসলাম।
ভাল করেছি। খুব ভাল করেছ। মেয়েগুলিকে নিয়ে একা একা থাকি। বস বাবা কি খাবে?
কিছু খাব না।
তা কি হয়? প্রথম এসেছি।
তিনি নিজেই উঠে গিয়ে মিষ্টি নিয়ে এলেন। রুপোর গ্রাসে পানি। কিন্তু মেয়েগুলি আসছে না, উকি-কুঁকিও দিচ্ছে না।
তুমি করে বলছি। রাগ হচ্ছে না তো।
জি না।
জোদেব আলী বলছিল, তোমরা নাকি নাটক করছ?
জি একটা হচ্ছে।
কি নাম নাটকের?
নাম ঠিক হয় নাই।
নাটক তো খুব খরচান্ত ব্যাপার। টাকা-পয়সা জোগাড় হচ্ছে কীভাবে?
চাঁদা তুলে। সবাই দিচ্ছে।
কই আমার কাছে তো তোমরা কেউ আসনি?
বাকের অত্যন্ত অস্বস্তির সঙ্গে সন্দেহে ভেঙে মুখে দিল। সুন্দর একটা গন্ধ সন্দেশে। বাকের কান খাড়া করে রাখল। যদি ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায়। কোনো রকম সাড়াশব্দ নেই।
বাকের উঠে আসার সময় ভদ্রমহিলা তাকে এক হাজার টাকা দিলেন নাটকের খরচের জন্য। বাকেরের মুখ শক্ত হয়ে গেল। রহস্য পরিষ্কার হতে শুরু করেছে।
আবার এস বাবা।
জি আসব।
নাটকে আমার খুব সখ্য ছিল। এখন কিছুই নেই।
বেরুবার সময় দারোয়ান সালাম দিয়ে গেট খুলে দিল। বাকের এই প্রথম দেখল মেয়ে তিনটি বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে তাকে। তার দিকে চোখ পড়তেই দু’টি মেয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। বেটেটা শুধু দাঁড়িয়ে রইল। এদের কারো নাম জানা হল না। জিজ্ঞেস করা দরকার ছিল।
দারোয়ান গেটে তালা লাগাচ্ছে। বাকের ফিরে এসে জিজ্ঞেস করল, মেয়েগুলির নাম কী জান? দারোয়ান এমন ভাবে তাকিয়ে রইল যেন প্রশ্নটা বুঝতে পারছে না।
নাম জান না ওদের?
জি না।
কী ডাক?
বড় আফা, ছোট আফা, মাইঝা আফা।
ও আচ্ছা।
বেঁটে মেয়েটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে। বাকের গেটের কাছে দাঁড়িয়েই সিগারেট ধরাল। এই সিগারেটটা সে এখানে দাঁড়িয়েই শেষ করবে। দেখবে মেয়েটা কি করে। মেয়েটি ভেতরে ঢুকে গেল। শুধু দারোয়ান গেটের ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে।