মনসুর সোফায় আধশোয়া হয়ে আছে।
সোবাহান সাহেবের কারণেই সে এমনভাবে বসা। সোবাহান সাহেব চান যে সে আরাম করে বসে ক্ষুধা সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতার লেখাটা শুনে। মনসুর একবার শুধু ক্ষীণ স্বরে বলল, স্যার লেখাটা কত পৃষ্ঠা?
সোবাহান সাহেব বললেন, তিনশ বাইশ পৃষ্ঠা হয়েছে। এখনো লিখছি। আরো বাড়বে।
মনসুর হতভম্ব হয়ে বলল, সবটা আজ শুনাবেন?
হ্যা। নয়তো ফ্লো ঠিক থাকে না। ফ্লো থাকাটা খুব দরকার। একসঙ্গে না। শুনলে তুমি পরিষ্কার বুঝতে পারবে না।
তা ঠিক।
তুমি আরাম করে পা তুলে বস। খুব মন দিয়ে শুনবে। কিছু মিস করবে: की।
জ্বি আচ্ছা।
আর পড়ার সময় হু হা এই সব কিছু বলবে না। এতে আমার অসুবিধা হয়। কনসানট্রেসান কেটে যায়।
আমি কিছু বলব না।
ভেরী গুড।
সোবাহান সাহেব শুরু করলেন এবং অতি দ্রুত পড়ে যেতে লাগলেন। ঘণ্টা খানিক পার হবার আগেই ঘরে ঢুকল ফরিদ। সোবাহান সাহেবকে থামিয়ে বলল, দুলাভাই আপনার কাইন্ড পারমিশান নিয়ে কি আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?
কি কথা?
যাকে আপনি লেখা পড়ে শুনাচ্ছেন সেই গাধা ঘুমুচ্ছে। তাকিয়ে দেখুন–হা করে ঘুমুচ্ছে।
সোবাহান সাহেব তাকালেন এবং তার মন সত্যি সত্যি খুব খারাপ হয়ে গেল। আসলে তাই। ডাক্তার ঘুমুচ্ছে। হা করেই ঘুমুচ্ছে।
সোবাহান সাহেব উচ্চস্বরে ডাকলেন, মিলি মিলি। সেই শব্দেও ডাক্তারের ঘুম ভাঙলি না। কয়েকবার শুধু ঠোঁট কাঁপল। মিলি পাশে এসে দাঁড়াবার পর সোবাহান সাহেব বললেন, ডাক্তারের মাথার নিচে একটা বালিশ দাও মা ও ঘুমিয়ে পড়েছে। ক্ষুধা বিষয়ক আমার এই জটিল লেখা পড়তে পড়তে যে কেউ ঘুমিয়ে পড়তে পারে এটা আমার কল্পনার বাইরে ছিল। মনটাই খারাপ হয়ে গেল।
মিলি ডাক্তারের মাথায় নিচে একটা বালিশ দিয়ে দিল। পাতলা চাদরে গা ঢেকে দিল। এই সামান্য কাজটা করতে তার ভাল লাগল। প্ৰবল ইচ্ছা করতে লাগল। এই ছেলেটার হাতটা একটু ছুয়ে দেখতে। মানুষের মনে কেন এরকম ইচ্ছা! হয়? এই ইচ্ছার নামই কি ভালবাসা? তাহলে ভালবাসা ব্যাপারটা কি শরীর নির্ভর? কবি যে বলেন প্ৰতি অঙ্গ লাগি তার প্রতি অঙ্গ কাদেরে– এই কথা কি সত্যি? সত্যি হলে খুব কষ্টের ব্যাপার হবে। ভালবাসার মত এত বড় একটা ব্যাপারকে দেহে সীমাবদ্ধ করা খুব অন্যায়। খুবই অন্যায়। তবু কেন জানি ভালবাসা শেষ পর্যন্ত দেহেই আশ্রয় করে। বড় রহস্যময় এই পৃথিবী। বড়ই রহস্যময়।
মিলি গায়ে চাদর দিয়ে দিচ্ছে পাশে মুখ বিকৃত করে দাঁড়িয়ে আছে ফরিদ। সে বলল, এত বড় গাধা আমি আমার লাইফে দেখিনিরে মিলি। একটা ভদ্রলোক আগ্রহ করে তোকে একটা লেখা পড়ে শোনাচ্ছেন আর তুই ব্যাটা ঘুমিয়ে পড়লি? তোর একটু লজ্জাও লাগল না? আবার দেখনা নাক ডাকাচ্ছে। কষে একটা চড় দেব না-কি?
মিলি বলল, বেচারাকে ঘুমুতে দাও মামা বিরক্ত কর না।
আমার কি ইচ্ছে করছে জানিস? আমার ইচ্ছে করছে গাধাটাকে ধরাধরি করে রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসি। হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গলে একটা শক খাবে। বুঝবে কত ধানে কত চাল।
তুমি এ ঘর থেকে যাও তো মামা।
ঘরে প্রচণ্ড মশা। বেচারাকে মশা বিরক্ত করছে। সোফার উপর মশারী খাটিয়ে দেয়া যায় না। মিলি মসকুইটো কয়েল জ্বলিয়ে দিল।
রাতে ভাত খেতে খেতে সোবাহান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ডাক্তার কি এখনো ঘুমুচ্ছে? মিলি লজ্জিত গলায় বলল, হ্যাঁ বাবা।
সোবাহান সাহেব বিস্মিত স্বরে বললেন, খুবই আশ্চার্যের ব্যাপার। ফরিদ বলল, দুলাভাই আমার ধারণা আপনার ক্ষুধা বিষয়ক বইটাতে ঘুম উপদ্রোকারী কিছু একটা আছে। আপনি যখন ডাক্তার ব্যাটাকে পড়ে শুনাচ্ছিলেন তখন আমিও দুতিন পৃষ্ঠা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনলাম। আমার তিনবার হাই উঠল।
সোবাহান সাহেব কঠিন চোখে তাকালেন, কিছু বললেন না।
ফরিদ বলল, ইনসমনিয়ার ওষুধ হিসেবে এই বই বাজারে ছাড়া যেতে পারে। আমি ঠাট্টা করছি না দুলাভাই। আমি ড্যাম সিরিয়াস।
বিলু বলল, চুপ করতো মামা।
চুপ কর, চুপ কর এই কথা ইদানীং আমাকে খুব বেশি শুনতে হচ্ছে। আমার এটা শুনতে ভাল লাগছে না। সব মানুষেরই কিছু ব্যক্তিগত মতামত থাকতে পারে। এবং সেই মতামত প্ৰকাশের অধিকারও তার থাকা উচিত বলে আমি মনে করি। দুলাভাইয়ের বইটি পড়ে আমার ঘুম আসছে এটা বলে দুলাভাইয়ের বইয়ের প্রতি আমি কোন অশ্রদ্ধা প্ৰকাশ করছি না। বইটির নতুন একটি ডাইমেনসনের দিকে আমি ইংগীত করছি।
মিনু বললেন, আর একটা কথা বললে এই ভাতের চামচ দিয়ে তোর মাথায় একটা বাড়ি দেব।
তা দাও। তবু আমার কথাটা আমি বলবই। সক্রেটিস ন্যায় কি? এ কথাটা বোঝাতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করলেন। তাকে হেমলক নামের তীব্র হলাহল পান করতে হল। আমি ক্ষুধা এবং ঘুমের সম্পর্ক বলতে গিয়ে না হয় চামচের একটা বাড়ি খেলা মই।
সোবাহান সাহেব শান্ত গলায় বললেন, খাওয়া দাওয়ার পর তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে ফরিদ।
ফরিদ বলল, জি আচ্ছা।
কথাগুলো অপ্রিয়। তবু আমি ঠিক করেছি কথাগুলো তোমাকে বলব।
জি আচ্ছা।
আনিস ছোকরা কি এখনো আসে নি?
বিলু বলল, না আসে নি।
কোথায় আছে? কোন খবর পাঠিয়েছে?
না।
ওকে যেন আর এ বাড়িতে ঢুকতে দেয়া না হয়। যে মানুষ তার দুটি বাচ্চা ফেলে উধাও হয়ে যায় তাকে এ বাড়িতে আমি থাকতে দিতে পারি না।
ফরিদ বলল, আপনার এই প্ৰস্তাব আমি সর্বান্তকরণে সমর্থন করছি দুলাভাই।
তোমার সমর্থনের আমি কোন প্রয়োজন বোধ করছি না।
প্রয়োজন বোধ না করলেও সমর্থনা করছি। আপনি বোধহয় জানেন না। দুলাভাই যে সত্য এবং ন্যায়ের পেছনে আমি সদা সর্বদা হিমালয়ের পর্বতের মতাই দাঁড়াই।
তোমার কি খাওয়া শেষ হয়েছে ফরিদ?
জ্বি না। এখন একবাটি ডাল খাব। খাওয়া দাওয়ার পর আমি একবাটি ডাল খাই। ভেজিটেবল প্রোটিন। এটার খুবই দরকার।
ডাল খাওয়া শেষ হবার পর তুমি দয়া করে আমার ঘরে এসো। তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে।
সোবাহান সাহেব নিতান্তই অনুত্তেজিত স্বরে যেসব কথা বললেন, সেগুলো হচ্ছে, ফরিদ আমার ব্লাড প্রেসার হচ্ছে একশ ষাট বাই পচানব্বই। আমার বয়সে এটাই স্বাভাবিক। কিছুদিন থেকে লক্ষ্য করছি তোমার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বললেই আমার ব্লাড প্রেসার বেড়ে যায়।
বাড়ে তা কি জানতে পারি?
এ পর্যন্ত দুবার মেপেছি। দেখেছি উপরেরটা হয় দুশ নিচেরটা একশ দশ।
বলেন কি কোয়ায়েট ইন্টারেস্টিং।
তোমার কাছে ইন্টারেস্টিং মনে হতে পারে! আমার কাছে ইন্টারেষ্টিং নয়। আমি চাই তুমি আর কখনো আমার সামনে না। আস।
তা কি করে সম্ভব?
আমার শ্বশুর সাহেব তোমার নামে আলাদা করে কিছু টাকা আমার কাছে গচ্ছিত রেখে গেছেন। এই টাকাটা আমি তোমাকে দিয়ে দিতে পারি। সেই টাকায় বাড়ি টারি কিনে তুমি মোটামুটি রাজার হালে থাকতে পার।
ফরিদ আগ্রহী গলায় বলল, অনেক টাকা না-কি?
হ্যাঁ অনেক টাকা। তবে তোমাকে আমি টাকাটা দিতে পারছি না। কারণ শ্বশুর সাহেব বলেছন তোমার মাথাটা ঠিক না হলে যেন তোমার কাছে টাকা না দেয়া হয়। তোমার মাথা ঠিক না।
আমার মাথা ঠিক না?
না।
আর আপনারটা হানড্রেড পার্সেন্ট ঠিক?
আমার মাথা নিয়ে কথা হচ্ছে না। তোমারটা নিয়ে কথা হচ্ছে।
ফরিদ হঠাৎ দাঁড়াল। গাঢ় গলায় বলল, দুলাভাই আমি চললাম। আমার কারণে আপনার প্রেসার বাড়বে না।
মনে হচ্ছে ফরিদের নিজের ব্লাড প্রেসারও হু হু করে বাড়ছে। মাথার ভেতর প্ৰলয় কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে। মনে হয় এই অবস্থাতেই কবি নজরুল লিখেছিলেন—
আমি ভরা তরী করি ভরা ড়ুবি, আমি টর্নেডো, আমি ভাসমান মাইন।
আমি ধূর্জটি, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর!
আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সূত, বিশ্ব বিধাত্রীর।
ফরিদের রাগ অনুরাগ কোনটাই দীর্ঘস্থায়ী হয় না বলে নিজের ঘরে যেতে যেতে নিজেকে অনেকটা সামলে ফেলল। বসার ঘরে সোফায় ডাক্তার হা করে ঘুমুচ্ছে। ব্যাটাকে কষে একটা চড় দেবার ইচ্ছা অনেক কষ্টে দমন করতে হল। চড়টা দিতে পারলে রাগটা পুরোপুরি চলে যেত। রাগ কমানোর অনেকগুলো পদ্ধতির মধ্যে একটি হচ্ছে অন্যের উপর রাগ ঢেলে দেয়া। কিংবা উল্টো দিক থেকে সংখ্যা গোনা—একশ, নিরানব্বই, আটানব্বই, সাতানব্বই, ছিয়ানব্বই ফরিদ সংখ্যা পদ্ধতি চেষ্টা করল। পদ্ধতি আজ কাজ করছে না। সব দিন সব পদ্ধতি কাজ করে না। চুল ধরে হাঁচকা টান দিয়ে ডাক্তার ব্যাটাকে সোফা থেকে ফেলে দিলে কেমন হয়, ভদ্রতায় বাঁধছে। সমাজে বাস করার এই হচ্ছে সমস্যা। সামাজিক বিধি-নিষেধ মেনে চলতে হয়। ইচ্ছা করলেও কারোর চুল ধরে হ্যাচক টান দিয়ে নিচে ফেলে দেয়া যায় না।
ফরিদ মেঘ গৰ্জন করল, এই ব্যাটা উঠ।
ডাক্তার ধড়মড় করে উঠে বসল। তার কাছে সব কিছুই এলোমেলো। এখানে সে কি করছে? ঘুমুচ্ছে না-কি? এখানে ঘুমুচ্ছে কেন? সামনে ফরিদ মামা না? উনি এমন করে তাকিয়ে আছেন কেন?
স্লামালিকুম মামা।
ওয়ালাইকুম সালাম।
কি করছেন মামা?
তেমন কিছু করছি না। একটু আগে ভয়ঙ্কর কিছু করার ইচ্ছা করছিল এখন করছে না।
ডাক্তারকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফরিদ নিজের ঘরে চলে গেল। ঠাণ্ডা পানিতে ঘাড় ভিজিয়ে নিতে হবে তাতে মূল স্নায়ু শীতল হবে। বেশ খানিকটা ক্যাফিনও শরীরে ঢুকাতে হবে।
এতেও স্নায়ুর উত্তেজনা খানিকটা কমবে। কাদেরকে চায়ের কথা বলা দরকার। চিনি দুধ ছাড়া কড়া চা। প্রচুর ক্যাফিন দরকার। শুধু ক্যাফিনে কাজ হবে না, গানও লাগবে। এসব ক্ষেত্র রবীন্দ্র সংগীত খুব কাজ করে। মেঘের পর মেঘ জিমেছে। এই বিশেষ গানটি রাগ কমানোর ব্যাপারে কোরামিন ইনজেকশনের মত। পরপর দুবার শুনলেই রাগ-জল। আজ ঐ গানটিরও সাহায্য দরকার। আজকের অবস্থা বড়ই খারাপ।
ডাক্তারের ঘুম এখন পুরোপুরি ভেঙেছে।
সে এই মুহূর্তে বড় ধরনের লজ্জাও বোধ করছে। পুরো ব্যাপারটা এখন মনে পড়ছে। ক্ষুধার উপর লেখা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছে। কি অসম্ভব লজ্জার কথা। ছিঃ ছিঃ ছিঃ। মিলি নিশ্চয়ই ঘটনা শুনেছে। না জানি সে কি ভাবছে। তাকে গাধা ভাবছে নিশ্চয়ই।
রাত এখন প্রায় দেড়টা। এত রাতে চুপচাপ সোফায় শুয়ে থাকা ছাড়া কোন গতি নেই। কিন্তু আবার ক্ষিধেও লেগেছে। ক্ষুধা ব্যাপারটা কত ভয়াবহ তা প্ৰবন্ধ পড়ে ঠিক বোঝা যায় নি— এখন বোঝা যাচ্ছে। তার মনে পড়ল। আজ দুপুরেও তেমন কিছু খাওয়া হয় নি।
ঘুম ভাঙার পর থেকে চোখের সামনে শুধু নানান রকম খাবারে ছবি ভাসছে। এই মুহুর্তে যে ছবিটি ভাসছে সেই ছবিটি বেশ অস্বস্তিকর— বিশাল একটা চিনামটির প্লেট। সেই প্লেটে শিউলি ফুলের মত দেখতে পোলাও। পোলাওয়ের উপর আস্ত একটা ভেড়ার রোস্ট। রোস্টটির বর্ণ সোনালি। এত জিনিস থাকতে চোখের সামনে ভেড়ার রোস্ট ভাসছে কেন সেটা একটা রহস্য। চামড়া ছাড়িয়ে নেবার পর ভেড়া এবং ছাগলে কোন তফাৎ নেই। তবু কেন শুধু ভেড়ার কথা মনে হচ্ছে? রোস্টটাতো ছাগলেরও হতে পারে।
খুট করে শব্দ হল।
ঘরে ঢুকল পুতুল। তার ঘুম আসছিল না। সে এসেছিল পানি খেতে। বসার ঘরে আলো জুলতে দেখে কৌতুহলী হয়ে এসেছে। ডাক্তারকে রাতে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে সে খুবই অবাক হয়েছে। তবে অবাক হওয়াটা সে প্রকাশ হতে দিল না। সহজ স্বরে বলল, স্নামালিকুম।
মনসুর বলল, ওয়ালাইকুম সালাম। ভাল আছ?
এই মেয়েটির সঙ্গে তার অনেকবার দেখা হয়েছে। তবে কখনো তেমন আলাপ হয়নি। মেয়েটা যে এতটা সুন্দর সে আগে লক্ষ্য করেনি। আলাদাভাবে এর নাক মুখ চোখ কোনটাই সুন্দর না। তবু সব কিছু মিলিয়ে মেয়েটাকে দেখতে তো বড় ভাল লাগছে। মনসুর উৎসাহের সঙ্গে বলল, কেমন আছ পুতুল? পুতুল বিস্মিত গলায় বলল,
ভাল।
আমি ক্ষুধা বিষয়ক লেখাটা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ব্যাপারটা খুবই অন্যায় হয়েছে। জেগে দেখি সোফায় শুয়ে আছি- মাথার নিচে বালিশ।
মশার কামড়ে ঘুম ভেঙেছে। আমার মনে হয় ক্ষিধের কারণে। প্ৰচণ্ড ক্ষিধে লেগেছে বুঝলে পুতুল।
পুতুল বলল, আপনি বসুন দেখি ঘরে কি আছে।
তোমার কষ্ট করার দরকার নেই পুতুল। তবে ফ্রীজটা খুলে দেখ। ঠাণ্ডা গরমে কোন অসুবিধা নেই।
আপনি বসুন আমি দেখি—
বাহ মেয়েটার কথা থেকে গ্রাম্য ভাবাটাওতো দূর হয়েছে। মেয়েটাকে বুদ্ধিমতী বলেও মনে হচ্ছে। মনসুরের মনে হল মেয়েটা কোন একটা ব্যবস্থা করবেই। কিছু না পেলে দুটাে ডিম ওমলেট করে নিয়ে আসবে।
মনসুরের চোখে আগের দৃশ্য ফিরে এল। সেই ভেড়ার রোস্ট। তবে তার সঙ্গে নতুন কিছু চিত্র যুক্ত হয়েছে। ভেড়ার রোষ্টের উপর এখন মুরগির রোষ্টও দেখা যাচ্ছে।
আধা ঘণ্টা পর পুতুল এসে বলল, খেতে আসুন।
খাবার ঘরে খাবার দেয়া হয়েছে। ভাত, রুই মাছের তরকারী, উচ্ছে ভাজা, ডাল। সবই গরম। রীতিমত ধোঁয়া উঠছে। একটা প্লেটে পেয়াজ কাচামরিচ দুটুকরা লেবু।
হতভম্ব মনসুর বলল, সব কি এখন রান্না করলে?
পুতুল হাসতে হাসতে বলল, এত অল্প সময়ে বুঝি রান্না করা যায়। সবই ফ্রীজে ছিল। আমি শুধু গরম করেছি। আপনি খেতে বসুন।
পুতুল প্লেটে ভাত উঠিয়ে দিল।
মিলির ঘুম আসছিল না। একটা মানুষ সোফায় শুয়ে আছে। হয়ত বেচারাকে মশারা ইতোমধ্যে খেয়ে ফেলেছে। একজনকে এই অবস্থায় রেখে ঘুমুতে যাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। সে নিঃশব্দে বসার ঘরে ঢুকল। সেখান থেকে খাবার ঘরে। খাবার ঘরে কি হচ্ছে? মনসুর খাচ্ছে? কে খাওয়াচ্ছে তাকে? তাকে দুজনের কেউ লক্ষ্য করল না। মিলি পর্দার আড়াল থেকে লক্ষ্য করল দুজন কি সুন্দর গল্প করছে। এত খাতির দুজনের মধ্যে? কই এই খাতিরের কথাতো তার জানা ছিল না? আবার হাসির শব্দ আসছে। খিলখিল করে নিশ্চয়ই পুতুল মেয়েটাই হাসছে। রাগে মিলির গা জুলে যেতে লাগল। যদিও সে খুব ভাল করেই জানে রাগ করার কিছুই নেই। কেন সে রাগ করবে? তার রাগ করার কি আছে?
হাসাহাসির কারণ হচ্ছে ঠিক এই সময় ডাক্তার একটা মজার রসিকতা করছিল- রসিকতাটা বানর বিষয়ক। ডাক্তার কখনো রসিকতা করে কাউকে হাসাতে পারে না। এই প্রথম সে একজন গ্ৰাম্য বালিকাকে মুগ্ধ করল— পুতুল হাসতে হাসতে ভেঙে গড়িয়ে পড়ল। কিংবা কে জানে এই গ্ৰাম্য বালিকাটি হয়ত মুগ্ধ হবার অভিনয় করল। ডাক্তার অভিনয় ধরতে পারল না।
পর্দা ধরে ঈর্ষায় নীল হয়ে গেল মিলি। তার ভেতরে এত ঈর্ষা ছিল তাও সে জানতে না। সে যেভাবে এসেছিল সেইভাবে ফিরে গেল। নিজের উপস্থিতি সে কাউকে জানতে দিল না।
বানর গল্পের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে ডাক্তার দ্বিতীয় গল্প শুরু করল। পুতুল। এই গল্পটিও চোখ বড় বড় করে শুনল এবং এক সময় হেসে উঠল খিলখিল করে।
ডাক্তার বানর বিষয়ক তৃতীয় গল্প খুঁজতে শুরু করল। তেমন কোন গল্প মনে পড়ছে না। এই মেয়েটি বানর ছাড়া অন্য কোন গল্পে হাসবে কি না তাও বোঝা যাচ্ছে না। রিক্সাটা নেয়া ঠিক হবে না। বানর সংক্রান্ত গল্পই মনে করতে হবে। ডাক্তারের ধারণা মেয়েদের ব্রেইন Unidirectional. যে মেয়ে বানর সংক্রান্ত রসিকতায় হাসে সে অন্য রসিকতায় হাসবে না। তাকে বানর বিষয়ক গল্পই বলতে হবে। অন্য গল্প না। নারী জাতি খুব প্রবলেমের জাতি। এক চক্ষু হরিণীর মত।