বৈশাখের শুরু। ভোরের আলো ভালোমতো ফোটে নি। আকাশ মেঘলা বলে চারদিক অন্ধকার হয়ে আছে। আকাশের মেঘ কিছুটা মনে হয় নিচেও নেমে এসেছে। জায়গায় জায়গায় গাঢ় কুয়াশা। বৈশাখ মাসের সকালে কুয়াশা পড়ে না। আজ পড়েছে।
হরিচরণের কবর এবং তার চারপাশ কুয়াশার মধ্যে পড়েছে। দূর থেকে আবছাভাবে বাঁধানো কবর এবং কবরের পাশের আমগাছটা চোখে পড়ছে। মনে হচ্ছে কেউ একজন কবরের ওপর মস্ত ছাতা মেলে ধরে আছে।
কবরের ঠিক মাথার কাছে আমগাছ কেউ লাগায় নি। আপনাআপনি হয়েছে। এবং অতি দ্রুত বিশাল বৃক্ষের রূপ নিয়েছে। প্রতি বছর এই গাছে মুকুল আসে না। দু’বছর পর পর আসে। এই বছর ঝাঁকিয়ে মুকুল এসেছে। গাছের ডালভর্তি সুতা। সবার ধারণা কোনো কিছুর জন্যে আমগাছে সুতা বেঁধে প্রার্থনা করলে তা মিলে। মেয়েদের ক্ষেত্রে নিজের মাথার চুল বঁধতে হয়।
আমগাছের কাণ্ডে হাত রেখে যে যুবকটি দাঁড়িয়ে আছে তার নাম শিবশংকর। কোলকাতায় জাপানিরা বোমা ফেলবে এমন এক গুজব ছড়িয়ে পড়ার পর শিবশংকরের বাবা মনিশংকর ছেলেকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আতঙ্কে বাস করার কোনো মানে হয় না। শিবশংকরকে নিয়ে এমনিতেই তিনি আতঙ্কে থাকেন। তার স্বাস্থ্য মোটেই ভালো যাচ্ছে না। অসুখবিসুখ লেগেই থাকছে। শিব শংকরের সঙ্গে তিনি গোপীনাথ বল্লভ নামের একজনকে পাঠিয়েছেন। গোপীনাথ হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক। যোগ ব্যায়াম ভালো জানেন। যোগ ব্যায়ামের ওপর তার একটা বই আছে। বইয়ের নাম- ‘যোগ ব্যায়াম, নিরোগ শরীর’।
গোপীনাথ বল্লাভের দায়িত্ব শিবশংকরের স্বাস্থ্যু ঠিক করে দেয়া। এই কাজটা তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করছেন। তাঁর নির্দেশেই সূর্য ওঠার আগে শিবশংকরকে উঠতে হয়। খালিপায়ে শিশিরভেজা ঘাসের ওপর একঘণ্টা হাঁটতে হয়। হাঁটার পর পাঁচ মিনিট বজাসন এবং পাঁচ মিনিট শিবাসন করতে হয়। আসনের পর ভারপেট পানি খেয়ে গলায় আঙুল দিয়ে সেই পানি বমি করে উগরে ফেলতে হয়। এই পদ্ধতির নাম পাকস্থলী ধৌতকরণ।
ধৌতকরণ শেষ হবার পর এক কাপ চিরতার পানি এবং মধু দিয়ে মাখিয়ে এক কোয়া রসুন খেতে হয়। রসুন খাবার পর আবার পাঁচ মিনিটের জন্যে শবাসন।
জটিল নিয়মকানুন। শিবশংকর প্রতিটি নিয়ম নিখুঁতভাবে পালন করে। তার প্রকৃতিটাই এমন যে, সে যা করে নিখুঁতভাবে করার চেষ্টা করে। যেন তাকে গণিতের একটা সূত্র দেয়া হয়েছে। তাকে থাকতে হবে সূত্রের ভেতরে। তবে পায়ে শিশির মাখানোর একটা পর্যায়ে সে হরিচরণের কবরের সামনে এসে দাঁড়ায়। প্ৰণামের ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। আমগাছটার চারদিকে চক্কর দেয়। এই চক্কর দেয়ার মধ্যেও সে অংক নিয়ে এসেছে। ফিবোনাচ্চি রাশিমালায় চক্কর। প্রথম দিনে এক চক্কর, দ্বিতীয় দিনে এক চক্কর। তৃতীয় দিনে ২ বার, চতুর্থ দিনে ৩ বার।
ফিবোনাচ্চি রাশিমালা হলো, ১, ১ ২ ৩ ৫ ৮, ১৩ ২১ …। এই রাশিমালায় যে-কোনো সংখ্যা আগের দু’টি সংখ্যার যোগফল। শিবশংকর আজ ১৩ সংখ্যায় পড়েছে। আমগাছ ঘিরে সে চক্কর দিচ্ছে। দূর থেকে দৃশ্যটা দেখলেন মাওলানা ইদরিস। তিনি কাছে এসে অবাক হয়ে বললেন, কে?
শিবশংকর জবাব দিল না। যন্ত্রের মতো ঘুরতে লাগল। তের প্রদক্ষিণ শেষ করে বিনীত ভঙ্গিতে বলল, আমার নাম শিবশংকর।
তুমি মনিশংকর বাবুর ছেলে? কেমন আছ বাবা?
ভালো আছি।
গাছের চারদিকে ঘুরছ কেন?
এম্নি। কাকু, আপনি ভালো আছেন?
ভালো আছি বাবা। আমাকে চিনেছ?
কেন চিনিব না! এত ভোরে কোথায় গিয়েছিলেন?
নদীর ঘাটে গিয়েছিলাম। এমনি গিয়েছিলাম, কোনো কাজে না।
শিবশংকর অস্পষ্ট গলায় প্রায় বিড়বিড় করে বলল, প্রতিটি মানুষের কাজকর্মের ত্রিশভাগ অর্থহীন।
মাওলানা বললেন, কথাটা ভালো বলেছ তো। তবে কিছু মানুষের জন্যে এটা ঠিক না। হরিচরণ বাবু জীবনে কখনো অর্থহীন কাজ করেন নি।
শিবশংকর বলল, আপনি তো তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখেন নি। কাছ থেকে দেখলে হয়তোবা জানতেন তার জীবনের ত্রিশভোগ কাজ অর্থহীন।
তুমি পড়াশোনা কী করছ?
কলেজে ভর্তি হয়েছি।
মেট্রিকে তো খুব ভালো করেছিলে। স্বর্ণপদক পেয়েছিলে। মনিশংকর বাবু এই উপলক্ষে সবাইকে খানা দিলেন। তোমারও আসার কথা ছিল।
হঠাৎ শরীর খুব খারাপ করল, আসতে পারলাম না। আমার শরীর ভালো না। প্রায়ই অসুখবিসুখ হয়।
হরিচরণ বেঁচে থাকলে তোমার কারণে আনন্দ পেতেন। তিনি যে তোমার অসুখ ভালো করেছিলেন, এটা কি তোমার মনে আছে?
শিবশংকর নিচু গলায় বলল, মনে আছে। তবে তিনি আমার অসুখ সারান নি, এই ক্ষমতা মানুষের নাই। আমি ভালো হয়েছি আপনাআপনি। মানুষের শরীরে নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আছে। সেই ক্ষমতাই কাজ করেছে।
মাওলানা বললেন, বাবা যাই?
শিবশংকর দুই হাত জোড় করে মাথা খানিকটা নিচু করে বলল, নমস্কার।
হিন্দুরা মুসলমানদের প্রতি এই আদব দেখায় না। মুসলমানরাও দেখায় না। বিধর্মী কাউকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে না। তিনি নিজে বলতে কোনো বাধা দেখেন না। ‘আসসালামু আলাইকুম’-এর অর্থ – তোমার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।
হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ বাড়ছে। কেন বাড়ছে তিনি জানেন না। উড়া উড়া শোনা যাচ্ছে— মুসলমানদের জন্যে আলাদা দেশ হবে, হিন্দুদের জন্যে আলাদা দেশ। মুসলমানের দেশে কোনো হিন্দু থাকতে পারবে না। মন্দির থাকতে পারবে না। সব মন্দির শুদ্ধ করে মসজিদ বানানো হবে। হিন্দু দেশেও একই ব্যবস্থা। তবে তাদের ব্যবস্থা আরেকটু জটিল। হিন্দুরাজ্যে ভাগ ভাগ থাকবে – এক ভাগে ব্ৰাহ্মণ, আরেক ভাগে ক্ষত্রিয় …। শুধু অস্পৃশ্যদের জন্যে আলাদা দেশ হবে। অস্পৃশ্যরা সেই দেশে থাকবে। সেই দেশের নামও না-কি ঠিক হয়েছে ‘হরিজন দেশ’। নামটা দিয়েছেন মহাত্মা গান্ধি। তিনি হবেন হরিজন দেশের রাজা।
গত কয়েকদিন ধরে জুম্মাঘরের টিনের ছাদে একটা শকুন বসছে। এটা ভালো লক্ষণ না। অতি অশুভ লক্ষণ। কে জানে বান্ধবপুর হয়তো হিন্দুরাজ্যে পড়বে। তারা মসজিদটাকে মন্দির বানিয়ে ফেলবে। সন্ধ্যাবেলায় মসজিদ থেকে আজানের শব্দ আসবে না। কাঁসার ঘণ্টার শব্দ আসবে।
মাওলানা ইদরিস অবেলায় খেতে বসেছেন। চারটা প্রায় বাজে। আসরের নামাজের সময় হয়ে যাচ্ছে। আসরের আজান পড়ে গেলে আর খাওয়া যাবে না। আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত খাওয়া নিষেধ। এই সময়ে কেয়ামত হবে বলেই খাওয়া-খাদ্যে মন না দিয়ে শেষ বিচারের কথা ভেবে বিষণ্ণ থাকার বিধান আছে। সেই সময় সূর্য নেমে আসবে মাথার এক হাতের মধ্যে। শরীর থেকে ঝরনার মতো ঘাম বের হবে। মানুষ নিজের ঘামের সমুদ্রে ড়ুবে যাবে। ‘ইয়া নফসি! ইয়া নফসি!’ বলার ফুরসন্তও পাবে না।
আজ খানা খেতে এত দেরি হবার কারণ খাওয়া জোগাড় হয় নি। এখন যে জোগাড় হয়েছে তাও বলা যাবে না। কুরানি দিয়ে নারকেল কুরিয়ে এক প্লেট নারকেল এবং লবণ মাখানো দুটা শসা নিয়ে মাওলানা বসে আছেন। পাশে এক গ্লাস পানি। আলাদা একটা পিরিচে সামান্য লবণ এবং এক টুকরা কাগজি লেবু। লেবু থেকে সুন্দর গন্ধ আসছে। তিনি নিয়মমাফিক প্রথমেই চোখ বন্ধ করে আল্লাহপাককে ধন্যবাদ দিলেন। তিনি বললেন, ‘হে গাফুরুর রহিমা! তুমি যে তোমার বান্দাকে ভুলে যাও নাই এতেই আমি খুশি। তুমি বান্দার রিজিকের ব্যবস্থা করেছ, এই জন্যে বান্দার আনন্দের সীমা নাই।’
মাওলানা বিসমিল্লাহ বলে লবণ জিভে ছোয়ালেন। নবী-এ-করিম (দঃ) জিভে লবণ ছুইয়ে খাওয়া শুরু করতেন। প্রতিটি বিষয়ে নবীকে অনুসরণ করা সব মুসলমানের কর্তব্য। তাঁর খাবার সময় জুলেখা সামনে থাকে। আজ জুলেখা নেই। সে পাশের ঘরে কী যেন করছে— খুঁটিখাট শব্দ আসছে। মাওলানা ডাকলেন, জুলেখা!
জুলেখা সামনে এসে দাঁড়াল। তার চোেখ-মুখ কঠিন। একটু আগে সে যে কেন্দেছে, এটা বোঝা যায়। গালের পানির দাগ শুকিয়ে আছে। মাওলানা বললেন, অতি তৃপ্তি সহকারে খানা খাচ্ছি।
জুলেখা বলল, আপনার মুখে রুচি বেশি— যাই দিব তাই তৃপ্তি নিয়া খবেন। আমপাতা সিদ্ধ করে দিলে আমপাতা খেয়েও বলবেন, শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। –
মাওলানা বললেন, আজকের খাওয়া নিয়া তুমি মনঃকষ্টে আছ, এইটা বুঝতে পারতেছি। মনঃকষ্টে থাকবা না— আল্লাহপাক নারাজ হবেন।
নারাজ হবেন কেন?
কারণ তিনি রিজিকের মালিক। তার ঠিক করে দেয়া রিজিক দেখে মন খারাপ করলে তিনি নারাজ হবেন না?
জুলেখা তীব্র গলায় বলল, নারাজ হলে হবেন। আমি মনে কষ্ট নিয়া থাকব।
মাওলানা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, তুমি যে মনঃকষ্টে থাকবা এইটাও কিন্তু তার বিধান। তিনি সূরা বনি ইস্রাইলে বলেছেন, ‘আমি তোমাদের ভাগ্য তোমাদের গলায় হারের মতো ঝুলাইয়া দিয়াছি। ইহা আমার পক্ষে সম্ভব।’ তুমি যে মনে কষ্ট পেয়েছ, এইটাও তোমার গলার হারে লেখা ছিল বলেই পেয়েছ।
জুলেখা বলল, আমি যদি আজ সন্ধ্যায় আপনার বাড়ি ছেড়ে চলে যাই, সেটাও কি গলার হারে লেখা?
মাওলানা বললেন, তুমি কোথায় যাবে?
আমি আগে যে প্রশ্ন করেছি। তার জবাব দেন।
মাওলানা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তুমি যা করবে। সবই তোমার ভাগ্যে লেখা।
জুলেখা বলল, আমি আপনারে ফালায়া চইলা গেলে আপনি রাগ করতে পারবেন না। এইটা আমার ভাগ্যে লেখা ছিল।
মাওলানা শসায় কামড় দিলেন। জুলেখা তাকে ধাধায় ফেলে দিয়েছে। সে যে চলে যাবার কথা বলছে— এটা কতটুক সত্যি তাও বুঝতে পারছেন না। পোয়াতি অবস্থায় অদ্ভুত অদ্ভুত। অনেক চিন্তা মাথায় আসে। বিচিত্র সব কাজ করতে ইচ্ছা করে। জুলেখার বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার ব্যাপারটা এরকম কিছুই হবে। সে যাবে কোথায়? তার যাবার জায়গা কই?
জুলেখা বলল, বেশ কিছু দিন ধরে আমি ঠিকমতো খাওয়া-খাদ্য করতে পারতেছি না। কারণ ঘরে খাওয়া নাই। পেটের সন্তানটার জন্যে আমার ভালো খানা দরকার। এই সন্তান আমার অনেক কষ্টের। এর অন্যত্ব হইতে আমি দিব না। সেই জন্যেই আপনারে ছেড়ে যাব।
মাওলানা বিস্মিত হয়ে বললেন, তুমি কই যাবে? খাওয়া-খাদ্য কে তোমারে দিবে?
জুলেখা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, আল্লাহপাক দিবেন, তবে অন্যের মাধ্যমে দিবেন।
অন্যটা কে?
সেটা আপনার জানার প্রয়োজন নাই।
মাওলানার মুখে খাওয়া এখন রুচিছে না। খাওয়া ফেলে উঠে পড়তেও পারছেন না। এতে রিজিকের অসম্মান হয়। আল্লাহপাক রিজিকের অসম্মান পছন্দ করেন না। রিজিকের অসম্মান এক অর্থে তারই অসম্মান।
জুলেখা বলল, একটা সোনার নাকফুল আর আটটা রুপার চুড়ি বিছানার উপর রেখেছি। খাওয়া শেষ করে এগুলি নিয়া বাজারে যাবেন। বিক্রি করে চাল, ডাল, তেল কিনবেন।
মাওলানা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আচ্ছা। তিনি এখন নিশ্চিত হয়েছেন জুলেখা কোথাও যাবে না। তিনি শশার ওপর কাগজি লেবুর রস দিলেন। শশায় কামড় দিলেন। কী স্বাদ! আল্লাহপাকের মহিমা। সামান্য শশায় তিনি বেহেশতি খানার স্বাদ দিয়েছেন।
বান্ধবপুর বাজারে বিরাট উত্তেজনা। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু পালিয়ে গেছেন। ইংরেজ সরকার তাকে গৃহবন্দি করে রেখেছিল। অসংখ্য গোরা পুলিশ বাড়ি ঘিরে রেখেছিল। তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে একটা মাছিরও যেখানে পালাবার উপায় নেই, সেখানে একজন জলজ্যান্ত মানুষ কীভাবে পালাবে? এই অসাধ্য নেতাজি সাধ্য করেছেন। পুলিশের এখন মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল অবস্থা। গোলগাল চেহারার যাকেই পাচ্ছে তাকেই ধরছে। ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞাস করছে, ‘তুম নেতাজি হ্যায়?’
মাওলানা ইদরিস অবাক হয়েই একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, নেতাজিটা কে? উনার পরিচয় কী?
যাকে প্রশ্ন করা হয়েছে সে বিরক্ত হয়ে বলল, নেতাজিরে চিনেন না, আপনি থাকেন। কই? জঙ্গলে?
মাওলানা বিব্রত বোধ করছেন। অনেককে তিনি চিনেন। জিন্নাহ সাবকে চিনেন, মহাত্মা গান্ধিকে চিনেন। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হককে চিনেন। নেতাজির নাম এই প্রথম শুনছেন। তিনি যে অতি ক্ষমতাধর ব্যক্তি এটাও বোঝা যাচ্ছে।
সন্ধ্যাবেলায় এককড়ির দোকানে খবরের কাগজ পাঠ হয়। প্রথমবারের মতো মাওলানা খবরের কাগজের পাঠ শোনার জন্যে দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালেন।
পত্রিকা পাঠক গৌরাঙ্গ বললেন, আজকের কাগজের পুরা পাতা গরম খবরে ভর্তি। এত গরম যে, কাগজে হাত দিলেই হাতে ফোসিকা পড়ে যাবে। গৌরাঙ্গ কাগজের গরম কমানোর জন্যে ক্রমাগত কাগজে ফুঁ দিচ্ছেন। শ্রোতারা খুবই আমোদ পাচ্ছে। গৌরাঙ্গ বললেন, কোনটা রেখে কোনটা পড়ি? যুদ্ধের খবরটা পরে পড়ব। গান্ধিজিরও গরম খবর আছে। উনি ডিগবাজি খেয়েছেন।
গান্ধিজির ডিগবাজি
হিটলারের বোমারু বিমানের আক্রমণে লন্ডন নগরী ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়ায় গান্ধিজি মনক্ষুন্ন। তিনি বলিয়াছেন, ব্রিটিশদের ধ্বংস করিয়া ভারতের স্বাধীনতা আমি চাই না।
শ্রোতাদের ভেতর থেকে বিস্ময়ের ধ্বনি উঠল। একজন বলল, গান্ধিজি ইংরেজের পয়সা খেয়েছেন। এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই।
আরেক শ্রোতা বলল, সারাজীবন বলেছে। রাম রাম, এখন বলে টে। টে। যুদ্ধের খবর শুনি, গান্ধিজি শুইন্যা লাভ নাই। নেতাজি পালায়া কোথায় গেছেন এই বিষয়ে কিছু আছে? এখন আমাদের ভরসা নেতাজি। গান্ধি দিয়া কাম হবে না। শুন্দ্রের পুলার গালে চুমা দিয়া স্বরাজ আনা যায় না।
গৌরাঙ্গ বললেন, বড় খবর আছে। সবের শেষে পড়ব।
মাওলানা ইদরিস পুরো কাগজ শুনে বাড়ি ফিরে দেখলেন, জুলেখা ঘরে নেই। সন্ধ্যার পর পুকুর থেকে পানি আনার জন্যে আগে পুকুরে যেত। শরীর ভারী হবার পর যাওয়া বন্ধ করেছে। তারপরও মাওলানা পুকুর ঘাটে খোঁজ নিতে গেলেন। সেখানেও জুলেখাকে পাওয়া গেল না।
জুলেখা বাড়িঘর সুন্দর করে গুছিয়ে চলে গেছে। যাওয়ার আগে দুটা আগরবাতির কাঠি জুলিয়েছে। কাঠি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, কিন্তু গন্ধ আছে। মন শান্ত করার জন্যে মাওলানা দরুদ পাঠ শুরু করলেন। একাগ্ৰচিত্তে দারুদ পড়লে অশান্ত মন শান্ত হয়। উন্মাদ রাগ গলে পানি হয়ে যায়। তাঁর প্রচণ্ড ক্ষুধা বোধ হচ্ছে। চাল ডাল তেল নুন। এখন ঘরে আছে। ইচ্ছা করলেই খিচুড়ি বসাতে পারেন। তাঁর সেই ইচ্ছা করছে না। তিনি নৌকাঘাটায় গেলেন। জুলেখা নৌকা নিয়ে কোথাও গেলে ঘাটের মাঝিরা বলতে পারত। মাঝিরা কেউ কিছু বলতে পারল না।
লাবুস হরিচরণের বাড়িতে থাকতে শুরু করেছে। প্রথম দিন সে একাই ছিল, দ্বিতীয় দিনে একজনকে চাকরি দেয়া হলো। সে মহা উৎসাহে কাজে লেগেছে। তার নাম হাদিস উদ্দিন, মধ্যবয়স্ক ছোটখাটো মানুষ। পোলিওর কারণে একটা পা অশক্ত। সে চলে লেংচাতে লেংচাতে। বাজারে তাকে ডাকা হতো। ব্যাঙউদ্দিন। কারণ সে নাকি ব্যাঙের মতোই লাফিয়ে চলে। এই পর্যন্ত তার জীবন কেটেছে ওস্তাদ চোর দরবার মিয়ার সাগরেদি করে। বছরখানেক ধরে দরবার মিয়া নিখোঁজ বলে সে কৰ্মশূন্য। বাজারে এর-তার দোকানের বারান্দায় তার খেয়ে না-খেয়ে দিন কাটছিল। চোরের সাগরেদকে কেউ চাকরি দেয় না। লাবুস দিয়েছে। সে কয়েকবারই লাবুসকে বলেছে, আর কাউকে লাগবে না। কাজ যা আছে আমি একাই পারব। আমার হাত দশটা। দুইটা দেখা যায়। বাকি আটটা দেখা যায় না।
হাদিস উদ্দিন লোকটি আসলেই কাজের। সে ঘরদুয়ার মোটামুটি গুছিয়ে ফেলেছে। উঠানে কোমর সমান ঘাস গজিয়েছিল। ঘাস কাটা হয়েছে। টিউবওয়েল নষ্ট হয়ে পড়ে ছিল। সেতাবনগর থেকে টিউবওয়েলের কারিগর এনে কল সারিয়েছে। হাদিস উদ্দিন রান্নাবান্নাতেও দক্ষ। সে লাবুসকে প্রথমদিনই বলেছে, আপনে খাইতে বসবেন চটি জুতা হাতে নিয়া। খাইতে গিয়া যদি দেখেন লবণ হয় নাই, কোনো একটা পদ খারাপ হয়েছে, তখন সঙ্গে সঙ্গে চটি জুতা দিয়া গালে বাড়ি দিবেন। ভালো হইলে কিছু বলার নাই, খারাপ হইলে চটি জুতা।
লাবুস পুকুরঘাটে বসে আছে। সে সন্ধ্যা থেকেই বসে আছে। এখন রাত আটটা। আকাশে পরিষ্কার চাঁদ উঠেছে। চাঁদের ছবি পড়েছে পুকুরে। সুন্দর লাগছে দেখতে। কোনো বাতাস নেই বলে পুকুরের পানি নড়াচড়া করছে না। লাবুস যেখানে বসেছে, সেখান থেকে আকাশের চাঁদ এবং পুকুরের চাঁদ দুটাকেই একসঙ্গে দেখা যাচ্ছে। অদ্ভুত লাগছে। আশেপাশে কোথাও কেয়া ফুল ফুটেছে। তার তীব্র সুবাসও নাকে এসে লাগছে।
হাদিস উদ্দিন লাবুসের পাশে ফর্সি হক্কা রাখতে রাখতে বলল, ছোটকর্তা, তামুক খান।
লাবুস বলল, আমি তামাক খাই না।
হাদিস উদিনের মনটাই খারাপ হয়ে গেল। সিন্দুক ঘাটতে গিয়ে হুক্কার সন্ধান সে আজ সকালেই পেয়েছে। সারা দুপুর তেঁতুল দিয়ে ঘষে ঘষে রুপার হুঙ্কা ঝকঝকে করা হয়েছে। এক ফাঁকে তামাক টিক্কা আনতে তাকে বাজারে যেতে হয়েছে। সবচে’ ভালো তামাকই এনেছে। মেশকে আধুরী। তার ওস্তাদ দরবার মিয়া এই তামাক খুব পছন্দ করতেন।
হাদিস বলল, হুক্কা নিয়া যাব? না-কি একটা টান দিয়া দেখবেন ঘটনা কী? ভালো লাগতেও পারে।
টান দিব না।
খানা কখন খাবেন ছোটকর্তা?
দেরি আছে। আরেকটা কথা, তুমি আমাকে ছোটকর্তা ডাক কেন? বড়কর্তাটা কে?
হাদিস বলল, আপনিই বড়কর্তা। বয়স কম বলে ছোটকর্তা বলি। আপনি নিষেধ করলে আর ছোটকৰ্তা বলব না।
নিষেধ করছি না। তোমার যা ইচ্ছা ডাকবে।
হাদিস ছোট্ট একটা মিথ্যা কিছুক্ষণ আগে বলেছে। সচরাচর মিথ্যা কথা সে বলে না। তার কাছে বড়কর্তা দরবার মিয়া। আর কাউকে বড়কর্তা ডাকা তার পক্ষে অসম্ভব।
হাদিস ইতস্তত করে বলল, দুইটা মিনিট আপনার সঙ্গে কথা বলব?
বলো।
এই বাড়িতে যে একটা গুপ্তঘর আছে আপনি জানেন?
লারুস বলল, জানি। হরিকাকু আমাকে দেখিয়েছিলেন। কোলে করে গুপ্তঘরে ঢুকেছেন। সিন্দুকের ভিতর দিয়ে গুপ্তঘরে যেতে হয়। তুমি সন্ধান কীভাবে পেয়েছ? সন্ধান পাওয়ার তো কথা না।
হাদিস আগ্রহের সঙ্গে বলল, সিন্দুকে কী আছে দেখতে গেছি, জিনিসপত্র নামাইতেছি- হঠাৎ দেখি সিন্দুকের নিচের তক্তার এক কোনায় একটা আংটা। আংটা টান দিতেই সিন্দুকের তালা খুলে গেল- দেখলাম এক সুরঙ্গ।
সুরঙ্গের ভিতরে ঢুকেছিলা?
না।
ঢুক নাই কেন?
আপনারে নিয়া ঢুকব, এইজন্যে ঢুকি নাই।
ও আচ্ছা। এখন তুমি যাও।
রাতে কি সুরঙ্গে ঢুকবেন? চুকলে মশাল জ্বলাই। সাপখোপ থাকতে পারে।
রাতে ঢুকব না।
আগামীকাল দিনে কি ঢুকবেন?
আগামীকালেরটা আগামীকাল চিন্তা করব। আর শোন, আজ রাতে আমি २ीय না।
ক্ষুধা হয় নাই?
ক্ষুধা হয়েছে, কিন্তু খাব না। উপাস দিব।
হাদিস বিস্মিত হয়ে বলল, কেন খামুকা উপাস দিবেন?
লাবুস বলল, একসময় খাওয়া ছিল না, উপাস দিছি। এখন খাওয়া থাকা সত্ত্বেও উপাস দিব। দুই উপাসের মধ্যে পার্থক্য কী দেখব।
হাদিসের ভুরু কুঁচকে গেল। তার ক্ষীণ সন্দেহ হলো, ছোটকর্তার মাথায় ফর্টিনাইন আছে। মাথা ফর্টিনাইন লোকের সাথে কাজ করা মুশকিল। তারা চলে ঝোকের মাথায়। তার ওস্তাদ দরবার মিয়ার মাথার মধ্যেও ফটিনাইন ছিল। কোনো চোর পূর্ণিমার রাতে চুরিতে বের হয় না। তার ওস্তাদ বের হতেন। হাসি মুখে বলতেন, আন্ধাইরে চুরি করব কোন দুঃখে?
লাবুস হাদিস উদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার এখানে কােজ নেয়ার আগে তুমি তো অনেকদিন বাজারে ছিলো।
জি।
তোমার জানামতে বাজারে কেউ কি আছে যে প্রায়ই অভাবের কারণে না খেয়ে থাকে?
একজন আছে। রামায়ণ পাঠ করে— শ্ৰীনাথ। কাজকর্ম পায় না। পেরায়ই এক দুই বেলা না খায়া থাকে। কী জন্যে জানতে চান?
এমি। তুমি এখন যাও।
রাতে সত্যই খাবেন না?
না।
এইখানে কতক্ষণ বইসা থাকবেন?
বুঝতে পারছি না।
চাদ অনেক ওপরে উঠে গেছে। লাবুস একই সঙ্গে দুটা চাদ এখন আর দেখতে পারছে না। কেয়া ফুলের গন্ধ এখনো আছে। গন্ধ তীব্র হয়েছে। লাবুসের মনে হলো, একসঙ্গে কয়েকশ কেয়া ফুল ফুটেছে।
ছোটকর্তা তাকে চলে যেতে বলেছেন। হাদিস চলে যায় নি। একটু দূরে শিমুলগাছের আড়ালে লুকিয়ে বসে আছে। লুকিয়ে থাকার ব্যাপারে সে ওস্তাদ। বড়কর্তা দরবার মিয়া তাকে লুকিয়ে থাকার কৌশল শিখিয়েছেন। হাতেকলমে শিখিয়েছেন।
ল্যাংড়া, মন দিয়া শোন কী বলি। সাদা রঙ থাইকা একশ হাত দূরে থাকিবি। সাদা রঙ দূর থাইকা দেখা যায়। সাদা রঙের কাপড় গেঞ্জি সব ‘নাট’। লুকায়া যখন থাকিবি হাসবি না। হাসলে দাঁত বাইর হবে, দূর থাইকা দাঁত দেখা যাবে। বুঝছস?
বুঝছি।
চোখ কখনো পুরা খুলবি না। পিটপিট কইরা দেখবি। কী জন্যে বল দেখি?
জানি না বড়কর্তা।
আরো গাধা, চোখে সাদা অংশ আছে। দূর থাইকা চোখের সাদাও দেখা যাবে। জন্তু জানোয়ারের দিকে নজর কইরা দেখবি। তারার চোখে কোনো সাদা অংশ নাই। কী জন্যে বল দেখি?
জানি না বড়কর্তা।
এক জন্তু যেন আরেক জন্তুরে দূর থাইকা না দেখে এই জন্যে এমন ব্যবস্থা। দেখলে একজন আরেকজনের উপর ঝাঁপ দিয়া পড়বে।
বাহ।
গাছের আড়ালে যখন লুকাবি ঘাপটি মাইরা বইসা থাকবি না। দুই হাতে গাছ জড়ায়ে শরীর মিশায়ে থাকিবি। তোর সামনে দিয়া লোক যাবে তোরে দেখবে না। ভাববে গাছের গুড়ি।
হাদিস এখন অবশ্যি গাছ জড়িয়ে ধরে বসে নেই। গাছে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসেছে। পুরনো দিনের কথা ভাবছে। বড়কর্তার সঙ্গে কী সুখের সময়ই না কেটেছে! সেইসব দিন কি আর আসবে? এই বাড়িতে কত সুন্দর সুন্দর জিনিস। সুরঙ্গের ভেতরে কী আছে কে জানে। জিনিসপত্রের সব হিসাব সে চোখে চোখে রাখছে। বইয়ের কাপড় দিয়ে মোড়ানো এক পোয়া ওজনের একটা কৃষ্ণমূর্তি পেয়েছে। সে সরিয়ে ফেলেছে। তার ধারণা জিনিসটা সোনার। ওস্তাদ দরবার মিয়া থাকলে অন্ধকারেও মূর্তি হাতে নিয়ে বলতে পারতেন জিনিসটা সোনার না রুপার, নাকি তামার। সে বুঝতে পারছে না। বুঝতে হলে স্বর্ণকারের দোকানে নিয়ে যেতে হবে। লোক জানাজানি হবে। কী দরকার, তাড়াহুড়োর কিছু নাই। ওস্তাদ দরবার মিয়া বলতেন— এক কদম ফেলে যে এক মিনিট চিন্তা করে দ্বিতীয় কদম ফেলবে সে-ই দুনিয়ার সবচে’ বড় দৌড়বিদ।
পুকুরে ধুপ করে শব্দ হলো। মাছে ঘাই দিল বলে মনে হয়। হাদিস গাছের আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে ভয়ে এবং আতঙ্কে বসে গেল। ঘাটের সিঁড়িতে দু’জন মানুষ পাশাপাশি বসে আছে। দুইজন একই ব্যক্তি- ছোটকর্তা লাবুস। এতে কোনো ভুল নাই। হাদিস চোখ বন্ধ করে তিনবার বলল, ‘আল্লাহু শাফি। আল্লাহু কাফি’। জিন-ভূতের ব্যাপার হলে এখন চোখ মেললে কিছু দেখবে না। হাদিস চোখ মেলল। এখনো দুজনকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। চাঁদের আলোয় দুজনেরই ছায়া পড়েছে ঘাটে। সেই ছায়াও দেখা যাচ্ছে। দু’জন যে একই দিকে তাকিয়ে আছে তাও না। একজন তাকিয়ে আছে পুকুরের দিকে, অন্যজন পাকাবাড়ির দিকে।
হাদিসের দমবন্ধের মতো হলো। বুকে ব্যথা শুরু হলো। সে দুহাতে বুক চেপে ধরে নিজের অজান্তেই কাঁপা গলায় ডাকল, ছোটকর্তা! দু’জনই একসঙ্গে তাকাল তার দিকে। একজন মিলিয়ে গেল। অন্যজন রইল।
লাবুস বলল, কিছু বলবে?
হাদিস কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ঘরে চলেন। ছোটকৰ্তা। কী কারণে জানি
ভয় লাগতেছে।
লাবুস উঠে দাঁড়াল। ঘরের দিকে রওনা হলো। হাদিস এখনো গাছের আড়াল থেকে বের হতে পারছে না। তার হাত-পা জমে গেছে।
রাত অনেক হয়েছে। বান্ধবপুর জামে মসজিদের ইমাম করিম সাহেব তাঁর বাড়ির উঠানে কাঠের চেয়ারে বসে আছেন। তাঁর সামনে একটু দূরে মাটিতে যে বসে আছে তার আসল নাম মজনু। লোকে তাকে ডাকে মজু গুণ্ডা। যদিও কেউ তাকে কখনো গুণ্ডামি করতে দেখে নি। মজু গুণ্ডা অতি বলশালী ব্যক্তি, বিশাল শরীর। সেই তুলনায় মাথা অস্বাভাবিক ছোট। চোখ বড় বড়। চোখের সাদা অংশ সবসময় লাল থাকে।
মজুর হাতে বিড়ি। সমীহ করে প্রতিবারই মাথা ঘুরিয়ে বিড়িতে টান দিচ্ছে। প্রতিবার বিড়িতে টান দেয়ার আগে খাঁকারি দিয়ে থুথু ফেলছে।
করিম মজু গুণ্ডাকে ধৰ্মকথা শোনাচ্ছে। মজু গুণ্ডাকে দেখে মনে হচ্ছে সে আগ্রহ নিয়ে ইমাম সাহেবের কথা শুনছে।
মজু!
জে বলেন।
সবচে’ বড় সোয়াবের কাজ কী জানো? কাফের মারা। ধর তুমি নামাজ কালােম পড় না। রোজা রাখ না। জুম্মার নামাজে সামিল হও না। তারপরেও একজন কাফের তুমি ধ্বংস করলা। তোমার হাতে বেহেশতের দরজার চাবি চইলা আসল। সেই চাবি দিয়া তুমি নিজেই বেহেশতের দরজা খুলবা। সত্ত্বরাজন তুর এবং ত্ৰিশজন গোলমান গেটের বাইরে সোনার সিংহাসন নিয়া তোমার জন্যে অপেক্ষা করবে। তুমি ঢোকা মাত্র তারা গোলাপজলের পানি দিয়া তোমাকে গোসল করাবে। রেশমি কাপড় পর্যায়ে সিংহাসনে বসাবে। বাদ্যবাজনা করে নিয়ে যাবে। বুঝেছ?
হুঁ।
অন্য ধর্মের কাফেরের চেয়ে নিজ ধর্মে যদি কেউ কাফের থাকে। সেই কাফের ধ্বংস করার সোয়াবা দশগুণ বেশি। কারণ একটাই— অন্য ধর্মের কাফের ইসলামের যে ক্ষতি করবে, ইসলাম ধর্মের ভেতরে থাকা কাফের তার চেয়ে দশগুণ বেশি ক্ষতি করবে।
মজু গুপ্ত এক দিলা থুথু ফেলে বলল, কারে খুন করতে হবে বলেন। এত প্যাচাল পাড়ার দরকার নাই। নগদ একশ’ টেকা দিবেন। কার্য সমাধা করে দিব। কাকপক্ষীও জানবে না। কার্য সমাধা হওয়ার পরে আমি দুইমাস বাইরে থাকি। এই দুই মাসের খরচ। আলাদা।
করিম অবাক হয়ে বললেন, মানুষ খুন করার কথা আসল কী জন্যে? আমি তোমাকে পাপ-পুণ্যের বিষয়ে কথা বলতেছি।
মজু উঠে দাঁড়িয়ে হাই তুলতে তুলতে বলল, যাই। টাকার জোগাড় যদি হয় খবর দিয়েন।
মাজু রওনা দিয়েছে। একবারও পেছন ফিরে তাকাচ্ছে না। করিম হতাশ গলায় বললেন, একশ’ পারব না। এত টাকা আমার নাই। পঞ্চাশে কি সম্ভব?
না।
ধর পঞ্চাশ এখন দিলাম। তুমি কাৰ্য সমাধা করলা। তারপরে ধীরে সুস্থে যখন যা পারি তা দিয়া একশ’ পুরা করলাম।
মজু আবারো থুথু ফেলে মুখ মুছতে মুছতে বলল, পুরা টেকা জোগাড় কইরা খবর দিবেন। দুই মাসের রাহাখরচা আলাদা। খুন হবে নগদ। টেকাও দিবেন নগদ।
করিম উঠানে বসে আছেন। মজু গুণ্ডার দেখাদেখি তার মুখেও ক্রমাগত থুথু জমছে। হারামজাদা লাবুসটাকে শাস্তি না দিয়ে তিনি বেহেশতে গেলেও শান্তি পাবেন না। এই হারামজাদার কারণে তাকে ন্যাংটা হয়ে দৌড়াতে হয়েছে। শুরুতে ভেবেছিলেন ঘটনা কেউ দেখে নি। ঘাটের দুই একজন মাঝি যে দেখেছে এই বিষয়ে তিনি এখন নিশ্চিত। লোকজন আড়ালে তাকে ‘ন্যাংটা মাওলানা।’ ডাকে। এই অপমান সহ্য করার মানুষ। তিনি না। করিমের মুখে আবার থুথু জমেছে। তিনি ঠিক মজু গুণ্ডার মতোই থুথু ফেললেন। মানুষ অনুকরণ প্রিয়।
শরিফা ঘরের ভেতর থেকে ডাকল, ভিতরে আসেন। ঘুমাইবেন না?
করিম বিরক্ত চোখে তাকিয়ে রইলেন। জবাব দিলেন না। শরিফ এগিয়ে গেল।
করিম বললেন, তোমারে তখন ঘর থাইকা বাইর হইতে নিষেধ করছি না?
শরিফা বলল, উঠানে কেউ নাই, আপনি একা। একটা কথা জিজ্ঞাস করব?
কর।
কিছুদিন যাবৎ দেখতাছি আপনি পেরেশান। কী হইছে?
করিম ইতস্তত করে বললেন, জিন খোররম বড় ত্যক্ত করতেছে। তার কারণে পেরেশান।
আবার দেখা পাইছেন?
হুঁ।
ভালো কোনো মাওলানার কাছ থাইকা তাবিজ আইনা পরেন।
আমার চেয়ে বড় মাওলানা এই অঞ্চলে কে আছে?
শরিফা বলল, নিজের তাবিজ সবসময় নিজের জন্য কাজ করে না। মাওলানা ইদরিসের কাছ থাইকা তাবিজ নেন। শুনেছি তিনি সুফি মানুষ।
করিম বিরক্ত গলায় বলল, শোনা কথায় কান দিবা না। ইদরিস বিরাট বন্দ। এক নষ্টামাগিরে নিয়া কিছুদিন সংসার করছে। সেই মাগি পেট বাধায়া এখন আছে নটিবাড়িতে। সন্তান খালাস কইরা আবার পুরান ব্যবসা শুরু করব।
আপনারে কে বলছে?
কেউ বলে নাই, আমি জানি।
শরিফা বলল, কেউ না বললে আপনি কেমনে জানবেন? আপনি কি (छिलन कविट्रिट?
করিম স্ত্রীর স্পর্ধা দেখে অবাক হলেন। তিনি চিন্তাই করতে পারেন নি। শরিফা এই ধরনের কথা বলতে পারে। তার রাগ চরমে উঠে গেলেও রাগ দ্রুত কমালেন। সহজ গলায় বললেন, তুমি বিরাট বেয়াদবি করেছ। যাই হোক, ক্ষমা করলাম। এমন বেয়াদবি আর করবা না। ভাত দাও।
মাওলানা খেতে বসেছেন। শরিফা সামনে বসে গরম ভাতে পাখা দিয়ে হাওয়া করছে। আজকের আয়োজন ভালো। করিমের পছন্দের পাবদা মাছ। হাওরের লালমুখা বড় পাবদা! ঝোল ঝোল করে রান্না। শরিফা পাতের এক কোনায় আদা সরিষা বাটা দিয়া রেখেছে। তরকারির সাথে এই জিনিস মিশিয়ে খেতে খুবই ভালো লাগছে। করিম বলল, তুমি রান্দা শিখেছি ভালো। এই বিষয়ে কোনো ভুল নাই। রান্দা কার কাছে শিখেছি? শাশুড়ি আম্মার কাছে?
শরিফা প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আগ্রহের সাথে বলল, আচ্ছা জিন কি ভাতমাছ খায়? মিষ্টি খাইতে পছন্দ করে, এইটা আমি শুনেছি। ভাত-মাছ খায়?
জানি না।
জিন খোররমের সাথে সাক্ষাৎ হইলে মনে কইরা জিজ্ঞাস কইরা জানবেন।
করিম বিরক্ত হয়ে বললেন, তুমি কি তারে দাওয়াত কইরা খাওয়াইব। ‘ খামাখা কথা বলে।
শরিফা চুপ করে গেল। তার খুব ইচ্ছা করছিল। জিন খোররমের সাথে তার যে সাক্ষাৎ হয়েছিল। এই ঘটনাটা বলে। রূপবান এক যুবকের বেশ ধরে সে এসেছে। নিজের নাম সে খোররম বলে নাই। অন্য কী যেন বলেছে। এখন মনে নাই। তাকে সে মা বলেছে। পাটিতে বসে খানা খেয়েছে। এত বড় একটা ঘটনা কাউকে বলার উপায় নাই।
খাওয়া শেষ করে করিম পান মুখে দিলেন। শরিফা বলল, এত বড় পাবদা মাছ আমি কই পাইলাম জিজ্ঞাস করলেন না?
করিম পানের পিক ফেলতে ফেলতে বললেন, তোমার ভাইজান পাঠাইছেন। হাওরের মাছ আর কে পাঠাবে!
ধরেছেন ঠিক। ভাইজান নিজেই এসেছিলেন। পাঁচ মিনিট বসেন নাই। লঞ্চ ধরতে দৌড় দিয়েছেন। উনি যাবেন কইলকাতা। ছবিঘরে ছবি দেখবেন।
করিম বিরক্ত হয়ে বললেন, তুমি তোমার ভাইরে বললা না ছবিঘরে ছবি দেখা বিরাট গুনার কাজ?
বলি নাই। ভাইজান আমারে কিছু টাকা দিয়া গেছে। মাছের ব্যবসায় বিরাট লাভ করেছে। এইজন্যে।
কত টাকা দিয়েছেন? সত্য কথা বলবা, তোমার টাকা নিয়া আমি পালায়া যাব না।
একশ’ টাকা।
করিম চমকে উঠলেন। সেই চমক শরিফার চোখে পড়ল না।
তোমার ভাইয়ের মন ভালো। একশ’ টেকা ভাইনরে দিয়েছে সহজ কথা না। তবে শহর বন্দরে গিয়া টাকা নষ্ট করা ঠিক না। অর্থ সঞ্চায়ের জিনিস, অপচয়ের জিনিস না। অপচয়কারী শয়তানের ভাই।
শরিফা বলল, শয়তান আমার ভাইয়ের ভাই হইলে সম্পর্কে আমিও শয়তানের ভাইন। আর আমারে বিবাহের কারণে আপনে শয়তানের দুলাভাই। হি হি হি।
করিম কঠিন গলায় বললেন, এইগুলা কেমন কথা?
তামাশা করলাম।
স্বামী নিয়া তামাশা করব না। স্বামী তামাশার বিষয় না।
স্বামী কিসের বিষয়?
ভক্তি শ্রদ্ধার বিষয়। হিন্দু মেয়ের সবই খারাপ। একটা শুধু ভালো গুণ। তাদের পতিভক্তি। হিন্দু মেয়েরা দিন কীভাবে শুরু করে জানো? স্বামীর পা ধোয়া পানি খাইয়া।
শরিফা বলল, এখন থাইকা আমিও আপনের পা ধোয়া পানি খাব।
তার প্রয়োজন নাই।
অবশ্যই প্রয়োজন আছে। সকালবেলা এক বালতি পানি আইন্যা দিব। আপনে পা ড়ুবায়ে দিবেন। সারাদিন আমি এই বালতির পানি খাব। দুপুরে এই পানি দিয়া গোসল করব।
অনেক রঙ্গ তামাশা হইছে। এখন যাও, পান আন। পান খাব।
স্ত্রীর উল্টাপাল্টা কথায় করিম যথেষ্টই বিরক্ত। তবে তিনি বিরক্তির প্রকাশ দেখালেন না। তাঁর মাথায় সম্পূর্ণ অন্য চিন্তা।
শ্ৰীনাথ লাবুসের অধীনে চাকরি নিয়েছেন। নায়েব সর্দার জাতীয় কাজ। আয় ব্যয়ের হিসাব রাখা। খাজনার কাগজপত্র ঠিক রাখা। শ্ৰীনাথের জন্যে ঘর দেয়া হয়েছে। শ্ৰীনাথ শর্ত দিয়েছেন, তাঁর ঘরে কোনো মুসলমান ঢুকবে না। মুসলমানের রান্না কোনো খাবারও তিনি খাবেন না। স্বপাক আহারের ব্যবস্থা।
লাবুস সব শর্ত মেনে নিয়েছে। শ্ৰীনাথ বললেন, আপনি আমাকে মহাবিপদ থেকে উদ্ধার করেছেন। দিনের পর দিন উপবাস করতে হয়েছে। অনুকষ্ট থেকে আপনি আমাকে মুক্তি দিয়েছেন। আমি একদিন তার প্রতিদান দিব।
লাবুস বলল, আচ্ছা।
হাদিস উদ্দিন নামে যাকে আপনি চাকরি দিয়েছেন, তার বিষয়ে কি আপনি কিছু জানেন?
না।
সে বিরাট বড় চোর দরবার মিয়ার শিষ্য। হাদিস উদ্দিন নিজেও বিরাট চোর। তাকে আপনার বিদায় করা প্রয়োজন। আমার পরামর্শ এই মুহূর্তে তারে বিদায় করবেন।
লাবুস বলল, হাদিস উদ্দিনের কারণে আমি আপনাকে চাকরি দিয়েছি। আপনার উপবাসের কষ্টের কথা সে-ই আমাকে বলেছিল।
শ্ৰীনাথ বললেন, সে আমার উপকার করেছে। এখন আমি আপনার অধীনের কর্মচারী। আমি আপনার স্বাৰ্থ দেখব। তারটা না।
লাবুস বলল, আমার স্বাৰ্থ দেখার প্রয়োজন নাই। আপনি থাকবেন আপনার মতো, সে থাকবে তার মতো। এই বিষয়ে আলোচনা এইখানেই শেষ।
আপনি কিন্তু বিপদ নিয়া বাস করতেছেন।
ঠিক আছে করলাম। এখন আপনি আমাকে হিড়ম্বা রাক্ষসেরা কাহিনীটা বলেন।
কী বলব?
একদিন দূর থেকে আপনার গলায় রামায়ণ পাঠ শুনেছিলাম। বড় আনন্দ পেয়েছিলাম। আপনার কণ্ঠস্বর মধুর।
শ্ৰীনাথ বললেন, হিন্দু ধর্মগ্রন্থের পাঠ শোনা অন্য ধর্মের মানুষদের জন্যে নিষিদ্ধ। যে পাঠ করবে। তার পাপ হবে, যে শ্রবণ করবে তারও পাপ।
তাহলে থাক।
তবে মুখস্থ বিদ্যা থেকে পাঠ করায় দোষ নাই। গ্রন্থ সঙ্গে না থাকলে ঠিক আছে।
শ্ৰীনাথ পাঠ শুরু করলেন—
নিদ্ৰা যায় নিরুপমা সুবদনী ঘনশ্যামা
এ রামা তোমার কেবা হয়।
এ ঘোর দুৰ্গম বনে, নিদ্রা যায় অচেতনে,
নাহি জানো রাক্ষস আলয়।
তিলেক নাহিক ভর, যেন আপনার ঘর
অতিশয় দেখি দুঃসাহস।
এই বন অধিকারী, পাপ আত্মা-দুরাচারী
ভয়ঙ্কর হিড়িম্ব রাক্ষস।