বর্তমান জগতে আরব-ভূমি
মধ্যযুগে অন্ধকারের রাজত্ব ছিল বটে, তবু সে যুগে আরব-ভূমির সামনে অন্ধকারের যবনিকা টেনে রাখে নাই কিন্তু আধুনিক যুগ তা করেছে। ১৫১৭ সাল হতে শুরু করে ওসমানীয় আধিপত্যের চারশ’ বছর পর্যন্ত আরব-প্রাচ্য বরাবর রাহু-গ্রস্ত থাকে। ওসমানীয় তুর্করা মুসলিম-জগতের একটি বিপুল শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করে। তারা কেবল আরব-ভূমিসমূহ জয় করে নাই, উপরন্তু ককেশাস হতে ভিয়েনার নগর দ্বার পর্যন্ত সমস্ত ভূভাগের উপর তাদের বিজয়-বৈজয়ন্তী উড্ডীন করেছে–তাদের রাজধানী কন্সটানটিনোপল হতে তারা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের উপর আধিপত্য করেছে। এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী পর্যন্ত পশ্চি ইউরোপীয় রাষ্ট্রনায়করা তাদের সমীহ করে চলেছে। ইতিমধ্যে অতীতের গৌরবোজ্জ্বল মদীনা, দামেস্ক, কায়রো বিস্মৃতির অতল তলে ডুবে যায়–অথচ একদা এগুলি পরাক্রমশালী সাম্রাজ্য ও মহোজ্জ্বল সংস্কৃতি কেন্দ্রস্থল ছিল। এসব এখন কন্সটানটিনোপল হতে প্রেরিত প্রাদেশিক গভর্নরদের বাসস্থান ও সৈন্যদের কেল্লা হয়ে দাঁড়ায়। দামেস্ক ও বাগদাদের দুর্জয় বাহিনী অতীতে চার চার বার এই রাজধানী আক্রমণে উদ্যত হয়। এখন হতে এই শহরের উপর সকলের নজর পড়ে।
সুলতান-খলীফাদের সাম্রাজ্যে আরবদের ছাড়া নানা জাতির, নানা ভাষার, নানা ধর্মের আরো বহু শ্রেণীর লোকের বাস ছিল; একমাত্র তলোয়ারের জোরে এদের একত্রে রাখা হত। পরাজিত জাতিসমূহের সবারই এক ভাগ্য ছিল? অতিরিক্ত কর-ভার অত্যাচারমূলক শাসন। এমন অবস্থার ভিতর আরবী ভাষা ভাষীদের মধ্যে শিল্প, সাহিত্য ও বিজ্ঞানে যদি কোন সৃজনশীল অবদান সৃষ্টি না হয়ে থাকে, তবে তাতে আশ্চার্যের কিছুই নাই।
আরব-প্রাচ্য বিজেতার পুত্র মহান সুলায়মান (১৫২০–১৫৬৬)-এর আমলে তুর্ক সাম্রাজ্যের মহিমার সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করে এবং তার অব্যবহিত পরেই এর পতন শুরু হয়। পতনের যুগ দীর্ঘ ও জটিল ছিল। ১৬৮৩ সালে ভিয়েনা দখল করার নিষ্ফল প্রয়াসের পর তুর্ক-শক্তিতে আক্রমণের পালা, খতম হয়ে আত্মরক্ষার পালা শুরু হয়। শান্তির বদলে প্রধানতঃ যুদ্ধ-বিগ্রহের জন্য সাম্রাজ্যের সংগঠন, সাম্রাজ্যের বিপুল বিস্তৃতি, প্রজাপুঞ্জের মধ্যে হাজারো রকমারি, ধর্মীয় সংস্থাকে স্বায়ত্তশাসনের প্রচুর সুবিধা দান, মুসলিম তুর্ক আর মুসলিম আরবের মধ্যে বিভেদ, চূড়ান্ত ক্ষমতা সুলতান-খলীফার হাতে কেন্দ্রীভূতকরণ এবং সিংহাসনের উত্তরাধিকার সম্বন্ধে অনিশ্চয়তা–সাম্রাজ্যের সংস্থাপনায় এগুলি ছিল অন্তর্নিহিত দুবর্লতা। অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাশীয়া, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রিয়ার মত বিভিন্ন শক্তি তুর্ক সাম্রাজ্যের নানা অংশের প্রতি লোলুপ দৃষ্টি হানতে এবং তুরস্ক সম্বন্ধে বিশেষ নীতি অবলম্বন করতে শুরু করে। এর ফলে সাম্রাজ্যের পতনের স্রোত দ্রুততর হয়ে পড়ে। আরব-জগত এককালে পারস্য হতে স্পেন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল; ক্রমে সে বিশাল সাম্রাজ্য সঙ্কুচিত হয়ে আসে। পারস্য ভাষা ও জাতীয়তা এর আগেই তার নিজস্ব আত্মপ্রতিষ্ঠার অধিকার ঘোষণা করে। তুর্করা কন্সটানটিনোপল অধিকার (১৪৫৩) করার আগেই স্পেন কার্যতঃ স্বাধীন হয়ে যায়। উত্তর আফ্রিকা, মিসর, খাস আরব এবং আরব-হেলাল–আটলান্টিক হতে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত এক অখণ্ড অঞ্চল। তাদের আরবী ভাষা ও ইসলামী বৈশিষ্ট্য রক্ষা করে যেমন আজো তারা করছে। মরক্কো ছাড়া এসব দেশ উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশের আগ পর্যন্ত তুর্ক সাম্রাজ্যের অঙ্গ ছিল। একমাত্র লেবাননই বরাবর তার বাসিন্দাদের মধ্যে খৃষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠতা রক্ষা করে এসেছে।
আরব দেশসমূহের মধ্যে আলজিরীয়াকে সর্বাগ্রে তুর্ক সাম্রাজ্য হতে খসিয়ে নেওয়া হয়। ১৮৩০ সালে এদেশ ফ্রান্স দখল করে এবং পরে একে ফ্রান্সের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে ঘোষণা করা হয়। এরপর ১৮৮১ সালে তিউনিসীয়া ফ্রান্সের কবলে আসে। ১৯১২ সাল পর্যন্ত ইউরোপের তিনটি ল্যাটিন শক্তি ফ্রান্স, স্পেন ও ইটালী মরক্কো হতে লিবীয়া পর্যন্ত সমগ্র ভূভাগে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে। সমগ্র উত্তর আফ্রিকা সবার আগে আরব মুসলিম-জগত হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পাশ্চাত্য প্রভাবের অধীন হয়; এ ভূভাগ মুসলিম-জগতের সীমান্ত অঞ্চলে অবস্থিত; এর বাসিন্দাদের মধ্যে অনারবের সংখ্যা প্রচুর ছিল। এই সমস্ত কারণ হেতু এ ভূভাগের বাসিন্দারা জাতীয়তা হারিয়ে স্বতন্ত্র পথে চলে। পশ্চিম এশিয়া এবং মিসরই প্রকৃতপক্ষে ইসলামের হৃদয় এবং কেন্দ্রভূমি। ভূগোলের দিক দিয়ে মিসর আফ্রিকার একাংশ হলেও ইতিহাস ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে একে পশ্চিমে এশিয়ার অঙ্গ মনে করা যেতে পারে।
প্রথম মহাযুদ্ধের আগ পর্যন্ত পশ্চিম এশিয়া ও মিসরসহ এই বিশাল ভূখণ্ড নামে বা প্রকৃতপক্ষে তুর্ক-সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। ১৮৮২ সাল হতে মিসর ইংরেজদের কবলে ছিল; এই মহাযুদ্ধকালে মিসর তুরস্কের শেষ বন্ধন ছিন্ন করে। এই সুযোগ মক্কার শরীফ হোসেনও তুর্কদের অধীনতা অস্বীকার করে বসেন। তিনি মহানবীর অন্যতম অধঃস্তন পুরুষ ছিলেন। তিনি মক্কাকে কেন্দ্র করে নতুন খিলাফত স্থাপন করে নিজেই খলীফা পদে সমাসীন হবেন–এই স্বপ্নে বিভোর হয়ে অন্যান্য আরবগণকে বিদ্রোহী হতে উৎসাহ দেন। ১৯২৪ সালে যখন মুস্তফা কামাল তুর্ক-খিলাফতের বিলোপ সাধন করেন, তখন এই আরব রাজা” নিজেকে মুসলমানদের খলীফা ঘোষণা করেন। তুর্ক-সাম্রাজ্য হতে খসে এনে আধুনিক আরব-সাম্রাজ্য স্থাপনের এ ছিল দ্বিতীয় চেষ্টা। এর আগের শতাব্দীর প্রথম তিন দশকের মধ্যে মিসরের রাজ-প্রতিনিধি মুহম্মদ আলী প্রথম এমনি একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ দেড়শ’ বছর টিকে থাকে। দুটি চেষ্টাই উপযুক্ত সময়ের আগে করা হয়। জনসাধারণের রাজনৈতিক চেতনার উপর এর বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠিত ছিল না। তাছাড়া, এ উভয় চেষ্টা নিকট প্রাচ্যে বৃটিশ ও অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তির স্বার্থের বিরোধী ছিল । শেষ পর্যন্ত শরীফ হোসেন নিজ পৈত্রিক রাজ্য হতেও ইবনে সউদ কর্তৃক বিতাড়িত হন। ইবনে সউদ নজ্বদের রক্ষণশীল ওয়াহ্হাবীদের বিজ্ঞ ও সুদক্ষ নেতা ছিলেন। ১৯০০ হতে ১৯২৫ সালের মধ্যে এই সুচতুর মরু-নেতা পারস্য উপসাগর হতে লাহিত সাগর পর্যন্ত সুবিস্তৃত একটি রাজ্য গড়ে তোলেন। মহানবীর পর আরব উপদ্বীপে এত বড় রাজ্য আর কেউ স্থাপন করতে পারে নাই। ১৯৩২ সালে সউদী আরব’ নামে এ রাজ্যের নাম বিঘোষিত হয়। সউদী আরবের লাগ দক্ষিণে ইয়ামন অবস্থিত। ইয়ামনের ধর্মীয় শাসনকর্তা ইমাম ইয়াহীয়া প্রথম মহাযুদ্ধ কালে নিজ দেশকে তুরস্কের অধীনতা হতে মুক্ত করেন। প্রাসাদ-চক্রান্ত ও পারিবারিক ষড়যন্ত্রের ফলে ইমাম ইয়াহীয়া ১৯৪৮ সালে নিহত হন। তার পুত্র সায়েফুল ইসলাম এখন ইয়ামনের সুলতান। এদিকে সউদী আরবের ইবনে সউদও ইন্তিকাল করেন ও তদস্থলে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ইবনে সউদ উপাধি গ্রহণ করে পিতার সিংহাসনে আসীন হন। বর্তমানে এই দ্বিতীয় ইবনে সউদ এবং সায়ফুল ইসলামই সমগ্র আরবে সম্পূর্ণ স্বাধীন শাসনকর্তা। উপদ্বীপের বাকী অংশ স্থানীয় শেখ ও সুলতানদের দ্বারা শাসিত হয়। এরা সবাই বৃটেনের সঙ্গে সন্ধি-সূত্রে আবদ্ধ। ইয়ামন এবং অনেকাংশে সউদী আরবও পাশ্চাত্য প্রভাবের আওতার বাইরে রয়ে গেছে। দুনিয়া জোড়া আধুনিকতায়নের জোয়ার কি জানি কেমনে এদের উপকূল বাদ দিয়ে গেছে। বিগত সিকি শতাব্দী কালের মধ্যে সউদী আরব, কুয়ায়েত এবং বাহরায়েনে যে অপর্যাপ্ত তেলের খনি আবিষ্কৃত হয়েছে এবং যে দক্ষতা ও সাফল্যের সঙ্গে খনিজ সম্পদ কাজে লাগান হচ্ছে তাতে এই সব স্থানের রাজনৈতিক গুরুত্ব অত্যন্ত বেড়ে গেছে; আর সংশ্লিষ্ট দেশগুলিও অতুল ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়েছে।
প্রথম মহাযুদ্ধের পর সিরিয়া ও লেবাননকে ফ্রান্সের অছি রাজ্যে পরিণত করা হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত এ দুই দেশ ফরাসী গোলামীর জিঞ্জির ভাঙ্গতে পারে নাই। ফিলিস্তিনকে বৃটিশ অছি রাজ্যে পরিণত করা হয় এবং স্থানীয় অধিবাসীদের প্রবল আপত্তি ও প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলির বাধা দান সত্ত্বেও ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনকে নিয়ে ইসরাইল রাষ্ট্র সৃষ্টি করা হয়। ট্রান্স-জর্দান বৃটিশ অছি রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল; ১৯৪৬ সালে একে স্বাধীন বলে ঘোষণা করা হয়। এ রাজ্যের সুলতান হন শরীফ হোসেনের ছেলে এবং আমীর ফয়সলের বড় ভাই আবদুল্লাহ। আমীর ফয়সল কয়েক দিনের জন্য সিরিয়ার সিংহাসনে বসেন। পরে ফরাসীরা তাকে তাড়িয়ে দেয়; অতঃপর ১৯২১ সালে বৃটিশ-শক্তি তাঁকে নব সৃষ্ট রাষ্ট্র ইরাকের সিংহাসনে বসায়। অছি রাজ্যগুলির মধ্যে লেবাননই প্রথম নিজকে রিপাবলিক বলে ঘোষণা করে। ইরাক সংস্কৃতির দিক দিয়ে সিরিয়ার পেছনে থাকলেও সবার আগে অছি-রাজ্যের বন্ধন কেটে পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করে। ১৯৩০ সালে ইরাকের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয় । ইংরেজের সঙ্গে একটা সন্ধি হয়, যেমন এর ছয় বছর পর মিসরও সন্ধি করে। এই সন্ধিসূত্রে ইংরেজকে স্বতন্ত্র সুবিধা দান করা হয়।
এসব দেশের মধ্যে মিসরই সর্বাগ্রে নব-জীবনের চাঞ্চল্য অনুভব করে। সাড়াটা আসে পশ্চিম থেকে উপলক্ষ ছিল ১৭৯৮ সালের নেপোলিয়নের আক্রমণ। ফরাসী বিজেতা ভ্যাটিকান থেকে একটা আরবী প্রেস লুণ্ঠন করেছিলেন; মিসর অভিযানকালে তিনি অন্যান্য উপকরণের মধ্যে এই প্ৰেসখানি সঙ্গে আনেন এবং তাঁর নিজের পণ্ডিতদের সমবায়ে ও সহযোগিতায় একটি সাহিত্য-সংস্থা গঠন করেন। নীলনদের উপত্যকায় উপরোক্ত প্ৰেসখানিই ছিল সর্বপ্রথম মুদ্রা-যন্ত্র। ক্রমে—’বুলাগ ছাপাখানা’ নামে এর যথেষ্ট উন্নতি হয়। আজো এ প্রতিষ্ঠানটি বেঁচে আছে।
নেপোলিয়নের পরে আসেন তধুনিক মিসরের জন্মদাতা মুহম্মদ আলী। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের এই অবিচ্ছিন্ন সাক্ষাতের মধ্যে ভবিষ্যতের বিরাট সম্ভাবনা উপলব্ধি করে তিনি এগিয়ে চলতে সংকল্প করেন। তিনি ইউরোপে বিভিন্ন ছাত্র মিশন পাঠান এবং তাঁর দেশের অফিসার ও বিদ্বান ব্যক্তিদের ট্রেনিং দেওয়ার জন্য ইউরোপীয়–বিশেষ করে ফরাসী মিশন দাওয়াত করে আনেন।
১৮৩১ সালে যখন মুহম্মদ আলী তাঁর আরব-সাম্রাজ্যের স্বপ্ন সফল করার উদ্দেশ্যে সিরিয়া বিজয়ের জন্য অভিযান করেন, তখন তিনি ভূমধ্যসাগরের সমস্ত পূর্ব সীমান্তে পশ্চিম ইউরোপীয় সাংস্কৃতির প্রভাবের প্রবেশ-পথ উন্মুক্ত করে দেন। এই সময়ে প্রটেস্টেন্ট মিশনারীরা প্রধানতঃ আমেরিকান–দলে দলে এসে এসব অঞ্চলে স্থায়ীভাবে কাজ শুরু করেন। লেবাননের বর্তমান রাজধানী বৈরুতে ১৮৩৪ সালে আমেরিকান প্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। সাবেক সিরিয়ায় এই-ই ছিল প্রথম উন্নত-ধরনের প্রেস। তিন বছর পর স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রটেসটেন্ট গীর্জা সংগঠিত হয়। অনেক দিন পর জেসুইট সম্প্রদায়ের খৃস্টান পাদ্রীরাও এই সময় লেবাননে ফিরে আসেন। ১৮৫৩ সালে বৈরুতে তাদের ইমপ্রিমেরী ক্যাথলিক স্থাপিত হয়। দুটি প্রেসই এখনো চালু আছে; সাজসরঞ্জামে এগুলি অতি উন্নতমানের প্রেস। আধুনিক আরবীতে বাইবেলের দুটি অনুবাদ এই ছাপাখানা দুটি হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। আরবীতে বহুসংখ্যক ইংরাজী ও ফরাসী গ্রন্থের অনুবাদ হয় এবং সে সব তরজমা লোক-প্রিয় হয়ে ওঠে। আমেরিকান মিশনারীরা অবশেষে ১৮৬৬ সালে সিরীয় প্রটেসৃটেন্ট কলেজ স্থাপন করেন; বর্তমান ‘বৈরুত আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়’ এই কলেজেরই রূপান্তরিত পর্যায়। আট বছর পর শহরের অপর প্রান্তে ‘সেন্ট জোসেফ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। এখন পর্যন্ত এই অঞ্চলে শিক্ষাদান ক্ষেত্রে এই দুটি প্রতিষ্ঠানই নেতৃত্বের স্থান অধিকার করে আছে। ইতিমধ্যে বিশেষ করে লেবাননে স্থানীয় লোকের দ্বারা অসংখ্য স্কুল, ছাপাখানা, খবরের কাগজ, মাসিক কাগজ এবং সাহিত্য ও বিজ্ঞান সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়।
সমুদ্রতীরবর্তী এই পার্বত্য অঞ্চলকে সুদূর অতীতের ফিনিশীয়, রোমক ও বাইজেন্টাইন আমল হতে পাশ্চাত্য অভিমুখী বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ফখরুদ্দীন-আল-মানী (১৫৯০–১৬৩৫) এবং বশীরুল শিহাবী (১৭৮৬ ১৮৪০) লেবাননের দুই কৃতী সন্তান ছিলেন। এদের অধীনে লেবানন ওসমানীয় শাসন হতে অর্ধ স্বাধীনতা লাভ করে। ইটালীয়, ফরাসী ও বৃটিশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও প্রতিষ্ঠানসমূহের সঙ্গে এই সময় লেবাননের ঘনিষ্ঠতর সংযোগ ঘটে। মুহম্মদ আলীর বহু আগে ফখরুদ্দীন ইউরোপীয়–বিশেষ করে ফ্রান্স ও ফ্লোরেন্সের সওদাগরগণকে লেবাননের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্বন্ধ স্থাপন করতে উৎসাহিত করেন এবং টাসূকেনী হতে কৃষি মিশন দাওয়াত করে আনেন। তিনি এবং বশীর উভয়ই তুর্ক সুলতান কর্তৃক স্বদেশ হতে নির্বাসিত হন এবং ইস্তাম্বুলে ইন্তিকাল করেন। ফখরুদ্দীনকে হত্যা করা হয়।
তুর্ক শাসকদের উস্কানীতে দ্রুজ ও ম্যারোনাইটদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ দেখা দেয় এবং সেই অজুহাতে ১৮৬০ সালে তুর্ক কর্তৃপক্ষের আদেশে এক নির্মম নরহত্যার অনুষ্ঠান হয়। তখন ইউরোপীয় শক্তিপুঞ্জ মিলে লেবাননকে স্বায়ত্ত শাসন দিতে প্রতিশ্রুতি দেয় এবং সেই নিশ্চয়তার ফলে একজন খৃস্টান গভর্নর লেবানন শাসন করতে থাকেন। স্বায়ত্তশাসনের এই ব্যবস্থার ফলে পশ্চিম ইউরোপ হতে অবিচ্ছিন্ন প্রবাহে নব নব, ভাব ও সে ভাবের প্রয়োগ-জ্ঞান দেশে আসতে শুরু হয়। পার্বত্যাঞ্চলের বাসিন্দারা বেশীর ভাগই খৃস্টান থাকায় তারা নতুন ভাবধারা গ্রহণে অধিকতর উৎসুক ছিল। তাদের পূর্বপুরুষদের মত তাদের সন্তানেরা অনেকে উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে সভ্য জগতের বিভিন্ন অংশে গিয়ে বসবাস শুরু করে। এদের কাছে বিশেষ প্রিয় ছিল আমেরিকা। লেবানন ও সিরিয়ার এই ঔপনিবেশিকেরা আমেরিকা হতে তাদের পুরোনো বাসভূমিতে নব ভাব প্রেরণের জন্য নতুন পথ সৃষ্টি করে। সুতরাং, অল্পকালের মধ্যেই আধুনিকায়ন ও ধর্ম-নিরপেক্ষ ব্যবস্থার রূপায়ণের ব্যাপারে লেবানন তার প্রতিবেশী রাজ্যগুলিকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যায়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে প্রাচ্যের উপর পাশ্চাত্যের এই অভিঘাত আধুনিক ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা সম্ভাবনাপূর্ণ ব্যাপার। পুরাতন সমাজ ভেঙ্গে তার স্থলে নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে আর সেই দ্রুত ক্রমবিকাশেরই অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে সামাজিক, আর্থিক, ধর্মীয় এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। নতুন জীবন-ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতি স্থাপনের জন্য আজও অনেক সমস্যার সমাধান প্রয়োজন।
পাশ্চাত্য জগত হতে যে সব নতুন ভাবধারা প্রাচ্যে আমদানী হয়, তার মধ্যে জাতীয়তা ও রাজনৈতিক গণতন্ত্রই সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী। জাতীয়তার আদর্শকে বরণ করে নেওয়ার ফলেই শুরু হয় স্বাধীনতা-সংগ্রাম এবং ফলে অতীত ও বর্তমানের যোগসূত্র অনেকাংশে ছিন্ন হয়ে যায়।
আরব জাতীয়তার জাগরণের আরম্ভ ছিল সম্পূর্ণ জ্ঞানাত্মক আন্দোলন হিসেবে। যারা এ জাগরণের অগ্রদূত, তারা বেশীরভাগই ছিলেন সিরিয়ার বুদ্ধিজীবী–বিশেষ করে বৈরুতের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাপ্রাপ্ত লেবানীজ খৃস্টান। এরা মিসরে বসে আন্দোলন পরিচালনা করতেন। এ আন্দোলনের প্রথম বহিঃপ্রকাশ ছিল প্রাচীন আরবী সাহিত্যের চর্চা এবং ইসলামী ইতিহাসের গবেষণা। আরব সাম্রাজ্যের অতীত গৌরব-মহিমা, জ্ঞান-বিজ্ঞানে আরব জাতির অতীত কীর্তি ও অবদান–এসবের সঙ্গে পরিচয়ের ফলে শিক্ষিত মহলের চিত্তে এক গর্বিত চাঞ্চল্যের সঞ্চার হয়। পিছনের দিকে চেয়ে তারা সামনের দিকে চাইতে শিখে। জ্ঞানাত্মক জাগরণের পরেই আসে রাজনৈতিক জাগরণ এবং একটা পুনর্জীবিত ও পুনর্মিলিত আরব-সমাজের জন্য উদগ্র আকা বহুজনের বুকে মোচড় দিয়ে ওঠে। রাজনৈতিক অবসাদের স্থানে রাজনৈতিক কর্ম-চাঞ্চল্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
এ আরব জাতীয়তার ভিত্তি-ভূমি ব্যাপক। এর মূলনীতি এই যে, ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত আরব ভাষাভাষী জাতি এক : তারা এক ভাষা এবং এক সাধারণ সংস্কৃতির বন্ধনে আবদ্ধ। এ প্রচেষ্টা এগিয়ে চলে প্যান-ইসলামের পথে নয়–প্যান-আরবত্বের পথে। এ আন্দোলনের অগ্রগমনের পথে জটিল স্থানীয় সমস্যা এসে সামনে দাঁড়ায়; ফলে আন্দোলন মূল পথ হতে সরে আসে। মিসরে এ আন্দোলনের পথে প্রথম বিরাট বাধারূপে এসে উপস্থিত হয়, ১৮৮২ সালে ইংরেজের মিসর অধিকার। অতঃপর বৃটিশ শাসনের বিরোধিতাতেই মিসরের উৎসাহ-উদ্দীপনা নিঃশেষ হয়ে যেতে থাকে। এই সময় হতেই মিসরীয় জাতীয়তাবাদ প্যান-আরবত্ব হতে ভিন্ন পথে চলতে শুরু করে। মিসরীয় আন্দোলনে আঞ্চলিক এবং স্থানীয় স্বার্থ বড় হয়ে ওঠে। আধুনিক যুগে মিসরবাসী এই প্রথম উপলব্ধি করে যে, সে মিসরীয়। “মিসর মিসরীয়দের জন্য এই হয়ে দাঁড়ায় সগ্রাম-ধ্বনি।
প্রথম মহাযুদ্ধের ফলে আরব-জগত আরো ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, আরব জাতীয়তাবাদও আরো ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সিরিয়াতে এর শক্তি প্রথম নিয়োজিত হয় তুর্কীকরণ নীতির বিরুদ্ধে; সিরিয়ার ঘাড়ে ফরাসী অছি শাসন চাপিয়ে দেওয়া পর এ-শক্তি নিয়োজিত হয় ফরাসী-সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। এইরূপে ফিলিস্তিনে স্থানীয় জাতীয়তার শক্তি প্রথম প্রযুক্ত হয় বৃটিশ অছিগিরির বিরুদ্ধে; তারপর প্রযুক্ত হয় ইসরাইলের বিরুদ্ধে। লেবানন প্রথমে অছি-শাসনের পক্ষে ছিল; পরে এর তীব্র বিরোধিতা করে পূর্ণ আজাদী অর্জন করে। লেবানন ও সিরিয়ার বুক হতে অছিবাদের শাসনের শেষ চিহ্ন মুছে ফেলা হয় ১৯৪৩ ও ১৯৪৫-এর মধ্যে। আরব অর্ধচন্দ্রের পূর্ব শৃঙ্গে ১৯২০ সালের দিকে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদিতার বিরুদ্ধে এক ইরাকী জাতীয়তা গড়ে ওঠে। ক্ষুদ্র ট্রান্সজর্দান ইতিপূর্বে কোন কালেই স্বাধীন ছিল না; ইংরেজরা এ জনপদকে ১৯২১ সালে সিরিয়া হতে ছিন্ন করে এনে আমীর আবদুল্লহর অধীন এক স্বাধীন রাষ্ট্রের পরিণত করে।
এইরূপে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের আরব-অঞ্চলসমূহ দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে স্বতন্ত্র জাতি বা উপজাতি গড়ে তুলতে চেষ্টা করে। কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ এবং ইহুদীবাদের অভ্যুদয় এই বিচ্ছিন্ন অংশসমূহকে আবার একত্র হওয়ায় সাহায্য করে। ফিলিস্তিনে ইহুদীবাদের প্রতিষ্ঠাকে আরবরা সর্বত্রই অন্যায় অনুপ্রবেশ মনে করে আসছে। সাধারণ স্বার্থের তাগিদ এবং ক্রমবর্ধমান সংহতি-বোধ চূড়ান্ত বিকাশ লাভ করেছে আরব-লীগের সংগঠনে। ১৯৪৫ সালে কায়রোতে এই ঐক্য-চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আরব-লীগের বর্তমান সদস্য সংখ্যা দশ; মিসর, ইরাক, সউদী আরব, ইয়ামন, লেবানন, সিরিয়া, জর্দান, লিবীয়া, মরক্কো এবং সুদান। শাসন-ব্যবস্থার দিক দিয়ে এ মধ্যে ইরাক*, জর্দান এবং লিবীয়া নির্বাচনভিত্তিক পার্লামেন্ট সহ নিয়মানুগ রাজতন্ত্র; মিসর, সিরিয়া এবং লেবানন রিপাবৃলিক। এ সমস্ত রাষ্ট্রই এখন জাতিসংঘের সদস্য এবং বেশীর ভাগেরই লন্ডন, নিউইয়র্ক, প্যারিস ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রাজধানীতে কূটনৈতিক প্রতিনিধি আছে।
তৃতীয় একেশ্বরবাদমূলক ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা–ধর্ম ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে পূর্ববর্তী ধর্ম দুটির অবদান ভাগী, প্রতীচ্যের সঙ্গে গ্রীকো-রোমান ঐতিহ্যের অংশীদার, সমগ্র মধ্যযুগব্যাপী মুক্ত-জ্ঞানের মশালধারী, ইউরোপীয় রেনেসাঁর মহানুভব দাতা-আরবী-ভাষী জাতিরা এসবই ছিল। মাঝখানে তারা পেছনে পড়ে গিয়েছিল। এবার তারা জগতের অগ্রগমন-রত গণতান্ত্রিক জাতিসমূহের মধ্যে স্থান গ্রহণ করেছে। আমরা আশান্বিত হৃদয়ে ভাবছি : আবার তাদের অবদানে বিশ্বের প্রগতি ও সমৃদ্ধির পথ সুগমতর হয়ে উঠেবে।
———
* সম্প্রতি (১৪ জুলাই, ১৯৫৮) এক সামরিক অভ্যুত্থানের ফলে ইরাকের বাদশাহ্ ফয়সল নিহত হন এবং সঙ্গে সঙ্গে ইরাকে রাজতন্ত্রের অবসান ঘোষণা করা হয়।
.
পরিশিষ্ট
স্যার ফিলিপ কে. হিট্টির জগদ্বিখ্যাত বই The History of the Arabs. এটি পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বাংলাদেশের জনগণের কাছে আরব জাতির ইতিহাস ঐতিহ্য সংক্রান্ত প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে এর মূল্য অপরিসীম। পঞ্চাশের দশকে হিট্টির এই বৃহৎ গ্রন্থের একটি সংক্ষিপ্ত (abridged) সংস্করণ প্রকাশিত হয় নিউইয়র্ক থেকে। ইবরাহীম খাঁ সেই সংক্ষিপ্ত সংস্করণটির বাংলা অনুবাদ করেন। আরব জাতির ইতিহাস শিরোনামে তা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫৯ সালের জানুয়ারী মাসে। ঢাকস্থ ফ্রাঙ্কলিন পাবলিকশন্সের সহযোগিতায় ইসলামিক একাডেমীর পক্ষে মুহিউদ্দীন খান, আশ্বিনপুর, নায়েব গাঁ ত্রিপুরা (ঢাকা অফিস ১৫, কোর্ট হাউস স্ট্রীট, ঢাকা) হতে প্রকাশিত এবং মুহম্মদ হোসেন, দি স্টার প্রেস, ২১/১ শেখ সাহেব বাজার লেন ঢাকা থেকে মুদ্রিত। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৮ + ২১৫। মূল্য চার টাকা।
হিট্টির ইতিহাস অনেকটা কাব্যিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক ভাষায় লিখিত। ইবরাহীম খাঁ অনুবাদে সে মেজাজ অক্ষুণ্ণ রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। আবার এদেশীয় স্বল্পশিক্ষিত মুসলমান পাঠকের বোধগম্যকরণের দিকেও ছিল তার সচেতন দৃষ্টি। ফলে এটি একটি অনবদ্য অনুবাদে পরিণত হয়।
.
জীবনপঞ্জি
নাম : ইবরাহীম খাঁ। ডাকনাম খাজা বা খাজা মিয়া। খাজা ছদ্মনামে তাঁর বেশ কিছু রচনা প্রকাশিত হয়েছে। প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ নামেই পরিচিতি লাভ করেছিলেন।
জন্ম : ১৮৯৪ সালে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষদিকে ‘এক বৃহস্পতিবার বার বেলা’য় বর্তমান টাঙ্গাইল জেলার ভূয়াপুর থানার অন্তর্গত বিরামদী (বর্তমানে শাবাজনগর) গ্রামে ইবরাহীম খাঁ জন্মগ্রহণ করেন। পিংনা হাইস্কুলের ভর্তি রেজিস্ট্রারে তার জন্ম তারিখ দেখানো হয়েছে ১ সেপ্টেম্বর ১৮৯৫। বংশ : টাঙ্গাইল শহরের মাইল সাতেক পূর্ব-দক্ষিণে বাসাইল গ্রামে পাঠান বংশের কয়েক গোষ্ঠী খাঁ পরিবার বাস করতেন। এঁরা ইবরাহীম খাঁর পূর্বপুরুষ। তাঁর ছ পুরুষ আগে এ বংশের দুভাই বিরামদীর পাশে ফশলান্দী গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন। ইবরাহীম খাঁর পিতা শাবাজ খাঁ থেকে বিরামদী গ্রামে স্থায়ী আবাস গড়ে তোলেন। তিনি ছিলেন গ্রামীণ মধ্যবিত্ত। মাতা রতন খানম। ছয় ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ৬ষ্ঠ–(১) আবদুল করীম খ, (২) শাহে বানু, (৩) আবদুস সোবহান খাঁ, (৪) কাজিম উদ্দীন খাঁ, (৫) এবাদত আলী খাঁ, (৬) ইবরাহীম খাঁ ও (৭) লুৎফর রহমান খাঁ।
শিক্ষা : বাড়িতে বড় ভাইয়ের কাছে বাংলা, মুনশির কাছে আরবি পড়ায় ইবরাহীম খাঁর হাতেখড়ি। ফশলান্দীর পাঠশালা থেকে নিম্ন প্রাইমারী এবং লোকের পাড়া পাঠশালা থেকে উচ্চ প্রাইমারি পাস। ১৯০৬ সালে হেমনগর হাইস্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেণী পাসের পর ১৯০৭ সালে পিংনা হাইস্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে ঐ স্কুল হতে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পাস করেন ১৯১২ সালে। তিনি ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ হতে ১৯১৪ সালে দ্বিতীয় বিভাগে আই. এ. এবং ১৯১৬ সালে কলিকাতার সেন্ট পলস্ কলেজ হতে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে অনার্সসহ বি. এ. পাস করেন। ১৯১৭ সালে আইনের প্রিলিমিনারী, ১৯১৮ সালে ল-ইন্টার, ১৯১৯ সালে ইংরেজি সাহিত্যে প্রাইভেট এম. এ. এবং ১৯২৩ সালে আইন পাস করেন।
সংসার : ১৯১৭ সালের ১ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের বড় বাশালিয়া গ্রামের রঈছ মমতাজউদ্দীন খাঁ ওরফে নয়ামিয়ার কনিষ্ঠা কন্যা আনজুমান নেছার সঙ্গে ইবরাহীম খাঁর বিয়ে হয়। তাদের প্রথম সন্তান শামসুজ্জামান খাঁ দুলামিয়া আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে এম. এ. পড়ার সময় মারা যান। দ্বিতীয় পুত্র মরহুম আসাদুজ্জামান খাঁ সুজা মিয়া বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ-এর শ্বশুর। একমাত্র কন্যা বেগম খালেদা হাবিব সমাজসেবী এবং শিক্ষাবিদ। কাকলী উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। তৃতীয় পুত্র আমিনুজ্জামান খা (আমিন) ভূয়াপুর থানা (উপজেলা) পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন, বর্তমানে বিলেতে বসবাসরত। ১৯৭৬ সালের ১১ নভেম্বর ইবরাহীম খাঁর স্ত্রী মারা যান।
কর্ম : ১৯১৯ সালের ২৮ নভেম্বর ইবরাহীম খাঁ করটিয়া হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষকের পদে যোগ দেন। ১৯২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে শিক্ষকতা ত্যাগ করে তিনি ময়মনসিংহ শহরে ওকালতি ব্যবসা শুরু করেন। ১৯২৫ সাল অবধি ওকালতি ব্যবসায় থাকার পর ১৯২৬ সালের ২ জানুয়ারি পুনরায় হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষকপদে যোগ দেন এবং আটিয়ার জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নী ওরফে চাঁদ মিয়ার সৌজন্যে সা’দত কলেজ প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দেন। ১৯২৬ সালের জুলাই মাসে কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি এর প্রিন্সিপাল হন এবং একটানা ২২ বছর ঐ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। আসাম ও অবিভক্ত বাংলায় সা’দত কলেজ মুসলমান প্রতিষ্ঠিত প্রথম কলেজ এবং ইবরাহীম খাঁ ছিলেন প্রথম মুসলমান প্রিন্সিপাল। ১৯৪৭ সালের ৪ নভেম্বর সরকারের আমন্ত্রণে তিনি পূর্ববাংলা মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের প্রেসিডেন্টের পদ গ্রহণ করেন এবং ১৯৫৩ সালের ১৪ জুলাই অবসর গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৪৮ সালে ভূয়াপুর কলেজ (বর্তমানে ইবরাহীম খাঁ মহাবিদ্যালয়) এবং পরবর্তীকালে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও প্রিন্সিপাল আবুল কাসেমের সহযোগিতায় বাংলা কলেজ (বর্তমানে ঢাকায় মীরপুরস্থ সরকারি বাংলা কলেজ) প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ; সাধারণ সম্পাদক ইবরাহীম খাঁ এবং অধ্যক্ষ প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম। ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রাদেশিক শিক্ষক সমিতিরি সভাপতি ছিলেন ইবরাহীম খাঁ। তিনি ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে বাংলার প্রাদেশিক আইনসভায়, পাকিস্তান গণপরিষদে এবং ১৯৬২ সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে সদস্য নির্বাচিত হন। ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ তারিখে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে তিনি দলীয় রাজনীতি হতে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি পাকিস্তান কৃষি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে, কলিকাতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটে এবং বাংলা একাডেমীর প্রথম দুই কার্যনির্বাহী পরিষদে নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। তিনি আন্তপার্লামেন্টারী মত বিনিময় কার্যক্রমের অংশ হিসেবে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ ও চীন সফর করেন। তিনি নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেন।
পুরস্কার ও সম্বর্ধনা : ১৯৩৮ সালে ইবরাহীম খাঁ ‘খানবাহাদুর’ উপাধি পান, পরাধীন দেশে এই খেতাব তিনি গ্রহণ করেন নি এবং ১৯৪৩ সালে তা বর্জন করেন। ১৯৪৪ সালের ১৯ মার্চ পূর্ববঙ্গ সাহিত্য সংসদ তাঁকে বিশেষ সম্বর্ধনা প্রদান করে। নাট্যসাহিত্যে তাঁর অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমী পুরস্কার পান ১৯৬৩ সালে। ১৯৬৩ সালেই তিনি সরকারি খেতাব তমঘায়ে কায়েদে আজম লাভ করেন এবং ১৯৭১ সালে দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তা বর্জন করেন। ১৯৭৫ সালের ৩১ মে বাংলা একাডেমীতে বাংলাদেশ সাহিত্য ও সংস্কৃতি পরিষদের আয়োজনে জাতীয় সম্বর্ধনা লাভ করেন তিনি। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একুশে পদক প্রদান করেন। কায়কোবাদ সাহিত্য মজলিশ তার গণসম্বর্ধনার আয়োজন করে ১৯৭৭-এর ১৫ মে। মৃত্যু : ২৯ মার্চ, ১৯৭৮ সকাল সাড়ে দশটায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ। পরদিন ভূয়াপুর কলেজ প্রাঙ্গণে তার স্ত্রীর কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।