১৯. বনের ভেতর চৌকি পাতা

বনের ভেতর চৌকি পাতা। চৌকির উপর শীতলপাটি। সিদ্দিকুর রহমান শীতলপাটিতে শুয়ে আছেন। পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়েছে তার গায়ে। রোদটা ভালো লাগছে। চৌকির উপর কিছু ধান ছিটিয়ে রাখা হয়েছে। সিদ্দিকুর রহমানের ধারণা, পাখিরা ধান খেতে চৌকিতে এসে বসবে। তার ধারণা ঠিক হয় নি। কোনো পাখি আসছে না। তারা মানুষের প্রতি তাদের ভয় দূর করতে পারে নি।

বন্য কোনো ফুল কাছেই কোথাও ফুটেছে। তিনি ফুলের কড়া ঘাণ পাচ্ছেন। কাঁঠালাচাপার তীব্র ঘাণ। বনের ভেতরে কাঠালাচাপার কোনো গাছ তার চোখে পড়ে নি। গন্ধটা আসছে কোথা থেকে? তিনি শোয়া থেকে উঠে বসলেন। সুলেমান-লোকমান কেউ তার পাশে নেই। ইদানীং তিনি তাদের বনের ভেতর ঢুকতে দেন না। তারা এসে পাটি বিছিয়ে চলে যায়। বনের বাইরে অপেক্ষা করে। আজ কেউ আশেপাশে থাকলে ভালো হতো। কাঁঠালচাপা গাছে ফুল ফুটেছে কি-না দেখতে বলতেন।

সিদ্দিকুর রহমানের পেছনে খুটাখুটি শব্দ হচ্ছে। তিনি ঘাড় ফিরিয়ে খুবই অবাক হলেন। নীল রঙের একটা পাখি খুঁটে খুঁটে ধান খাচ্ছে। পাখির মাথায় ঝুটি আছে। ঠোঁট টিয়া পাখির ঠোঁটের মতো লাল। সিদ্দিকুর রহমান যে পাখিটার দিকে তাকিয়ে আছেন তা সে বুঝতে পারছে। কিন্তু ভয় পাচ্ছে না। খুঁট খুঁট শব্দে ধান খেয়ে যাচ্ছে। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, কিরে তুই একা কেন? তোর সঙ্গীসাথিরা কই? হঠাৎ কথা শুনে পাখি সামান্য চমকে গেল। ডানা ঝাপ্টাল। আবার শান্ত হয়ে গেল। সিদ্দিকুর রহমান মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছেন। নীল পাখির একটি সঙ্গীকে তার মাথার উপর দিয়ে কয়েকবার উড়ে যেতে দেখা গেল। সে মনে হয় সাহস সঞ্চয় করছে। পরিস্থিতি বিবেচনা করছে।

তিনি আবারো শুয়ে পড়লেন। পাখিরা আসুক। কেউ কেউ এসে বসুক তার গায়ে।

ধর্মপাশা থানার ওসি সাহেব ঘোড়ায় চড়ে এসেছেন। সিদ্দিকুর রহমান সাহেবের সঙ্গে দেখা করবেন। জরুরি। লোকমান-সুলেমানের উপর দায়িত্ব কেউ যেন বনে ঢুকতে না পারে। ওসি সাহেবকে তারা সাহস করে এই কথা বলতে পারল না।

ওসি সাহেব বললেন, উনি বনের ভেতর কী করেন?

সুলেমান বলল, উনার শরীর খারাপ। উনি শুয়ে থাকেন।

শরীর খারাপ হলে বনের ভেতর শুয়ে থাকতে হবে কেন?

সুলেমান জবাব দিল না। এই প্রশ্নের জবাব তার কাছে নেই। ওসি সাহেব বললেন, জঙ্গলে কোথায় শুয়ে থাকেন?

ব্যবস্থা আছে।

কী ব্যবস্থা?

চলেন নিজের চোখে দেখবেন।

ওসি সাহেব যে দৃশ্য দেখলেন তার জন্যে তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। সিদ্দিকুর রহমান শুয়ে আছেন, তাকে ঘিরে রাজ্যের পাখি। কিছু পাখি। আবার তার গায়ের উপর বসে আছে। পায়ের শব্দে সব পাখি উড়ে গেল। সিদ্দিকুর রহমান উঠে বসলেন। ওসি সাহেব বললেন, স্যার সাল্লামালিকুম। আমাকে চিনেছেন? ওসি ধর্মপাশা।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, কী ব্যাপার?

স্যার একজন লোক সম্পর্কে খোঁজ নিতে এসেছি। আনিস নাম। আপনার বাড়িতে জায়গির থাকত।

এখন সে নাই।

স্যার জানি। সে জেলে আছে। ঘুঘু লোক। পিস্তলসহ ধরা পড়েছে। কমিউনিস্ট পার্টি করত।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, আমি তাকে ভালো লোক হিসাবে জানি।

ভালো-মন্দের বিচার একেকজনের কাছে একেক রকম। আপনার কাছে যে ভালো, অন্যের কাছে সে খারাপ।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, যে ভালো সে সবসময় ভালো। সবের কাছে ভালো।

ওসি সাহেব বললেন, স্যার, এই বিষয়ে আপনার সঙ্গে তর্ক করব না। আপনার কাছে একটা অনুমতির জন্যে এসেছি। আনিস যে ঘরে থাকত সেই ঘরটা সার্চ করব। ঘরে কাগজপত্র কী আছে দেখব।

অনুমতি না দিলে সার্চ করবেন না?

অনমতি না দিলেও সার্চ করব। আমার সঙ্গে সার্চ ওয়ারেন্ট আছে।

তাহলে অনুমতি চাইলেন কেন?

ভদ্রতা করলাম স্যার। আমরা তো ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ না। আমরা পাকিস্তান সরকারের পুলিশ। আমরা ভদ্র।

যান। সার্চ করেন।

সার্চটা আপনার সামনে করতে চাই।

আমি এখান থেকে যাব না। বাড়িতে আমার বড় মেয়ে আছে। নাম লীলা। সব কিছু এখন সে দেখে। সে থাকবে আপনার সঙ্গে।

স্যার, আরেকটা বেয়াদবি করব। আমরা শুধু আনিস যে ঘরে থাকত সেই ঘর সার্চ করব না। আমরা পুরো বাড়ি সার্চ করব। সরকারের হুকুম। আমরা হুকুমের গোলাম।

সিদ্দিকুর রহমান কিছু বললেন না। আবার চৌকিতে শুয়ে পড়লেন।

 

সন্ধ্যা পর্যন্ত বাড়ি সার্চ হলো। মূলবাড়ি, শহরবাড়ি। নদীর পাড়ে নিরঞ্জন যেখানে থাকে। সেই ছনের ঘর। কিছুই বাদ গেল না। চারটা বাধাই করা মোটা মোটা খাতা ছাড়া কিছু পাওয়া গেল না। খাতার প্রতিটি পাতায় একটা শব্দ লেখা লীলাবতী!

ওসি সাহেব লীলাবতীর দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার নামই তো লীলাবতী! এই লোক লক্ষবার আপনার নাম লিখেছে, কারণ কী?

লীলাবতী বলল, আপনি যেমন কারণ জানেন না। আমিও জানি না।

তার সঙ্গে আপনার পরিচয় ছিল না?

লক্ষ বার নাম লেখার মতো পরিচয় ছিল না।

সে যে অতি বিপদজনক ব্যক্তি তা কি জানেন?

আগে জানতাম না। এখন জানলাম।

আগে কী জানতেন?

আগে জানতাম উনি লাজুক ধরনের একজন মানুষ। ওসি সাহেব শুনুন, আমি খুব খুশি হবো খাতা চারটা যদি আপনি রেখে যান।

খাতাগুলি সীজ করা হয়েছে। রাখা যাবে না।

আপনাদের কাছে চারটা খাতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে সাংকেতিক ভাষায় অনেক গোপন তথ্য লুকানো?

ওসি সাহেব জবাব দিলেন না। তিনি মঞ্জুকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

আপনি কে?

আমার নাম মঞ্জু। মঞ্জুল করিম।

আপনি এই বাড়ির কে?

আমি এই বাড়ির কেউ না।

এই বাড়ির কেউ না, তাহলে এই বাড়িতে আছেন কেন?

আমি লীলাবতীকে তার মামার বাড়ি থেকে এ বাড়িতে নিয়ে এসেছি।

সেটা কবে?

প্রায় দেড় বছর।

দেড় বছর ধরে এ বাড়িতে আছেন? আপনি কী করেন? অর্থাৎ এই বাড়িতে আপনার কাজটা কী?

মঞ্জু, হকচাকিয়ে গেলেন। তাই তো, এ বাড়িতে তার কাজটা কী?

ওসি সাহেব বললেন, আপনাকে যে আমার সঙ্গে একটু থানায় যেতে হবে।

কেন?

জিজ্ঞাসাবাদ করব।

জিজ্ঞাসাবাদ এখানে করেন।

সব জিজ্ঞাসাবাদ সব জায়গায় করা যায় না।

আমি থানায় যাব না। জিজ্ঞাসাবাদ যা করার এখানে করেন।

ওসি সাহেব বললেন, ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট।

পুলিশের দল রাত আটটায় মঞ্জুকে হ্যান্ডকাফ এবং কোমরে দড়ি বেঁধে ধর্মপাশা থানার দিকে রওনা হলো। সারা গ্রামের মানুষ ভেঙে পড়ল। এই দৃশ্য দেখার জন্যে।

পরীবানু কাঁদছে। তার দুই পুত্র ঝড়-তুফান চিৎকার করে কাঁদছে। জইতরী-কইতরী কাঁদছে। সিদ্দিকুর রহমান তাঁর বাড়ির উঠানে ইজিচেয়ারে স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। তাঁর পেছনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে সুলেমান-লোকমান। এক সময় সিদ্দিকুর রহমান চাপা গলায় বললেন, আমার বাড়ির মেহমান পুলিশ আমার সামনে থেকে ধরে নিয়ে গেল। এত বড় অপমান আল্লাহপাক আমার জন্যে রেখেছেন?

তাঁর কথা শেষ হবার আগেই সুলেমান নিঃশব্দে উঠান ছেড়ে গেল। সুলেমানের ছাড়া অলঙ্গায় (বর্শ জাতীয় অস্ত্র) ধর্মপাশা থানার ওসি নিহত হলেন, সেকেন্ডে অফিসার গুরুতর আহত হলেন। রিজার্ভ পুলিশ তলব করা হলো ময়মনসিংহ থেকে। সিদ্দিকুর রহমান সাহেবকে গ্রেফতার করে ময়মনসিংহ নিয়ে যাওয়া হলো পরের দিন ভোরে। সেই দিন দুপুরেই শত শত মানুষ ধর্মপাশা থানা ঘেরাও করে থানা জ্বলিয়ে দিল। দৈনিক আজাদ পত্রিকায় যে রিপোর্টটি ছাপা হলো তার শিরোনাম–

ধর্মপাশা থানা ভস্মিভূত ও লুষ্ঠিত
চার পুলিশ নিহত

 

তারিখ ৪ জুলাই ১৯৫৭ সন।

সিদ্দিকুর রহমান সাহেবের দিন কাটছে জেল হাজতে। মামলা চলছে দীর্ঘদিন। হাতকড়া বাঁধা অবস্থায় তিনি দিনের পর দিন কোর্ট যাচ্ছেন। কোর্ট থেকে ফেরত আসছেন। উকিলদের জেরার মুখে তিনি একটি কথাই বলছেন, সুলেমান নিজের ইচ্ছায় কিছু করে নাই, আমি তাকে বলেছি মঞ্জুকে ছাড়িয়ে আনতে। মঞ্জু, আমার বাড়ির অতিথি। তাকে কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাবে তা হয় না। সিদ্দিকুর রহমান সাহেবের উকিল বাবু নিত্যরঞ্জন সাহা তাকে অনেক বুঝিয়েছেন। তাকে বলেছেন, আপনি অপরাধ নিজের ঘাড়ে টেনে নিচ্ছেন, এতে লাভ হবে না। সুলেমান বাঁচবে না, তাকে ফাঁসিতে ঝুলতে হবে। মাঝখান থেকে আপনি বিপদে পড়বেন। আপনি যেটা সত্যি সেটা বলুন। বলুন আপনি এই বিষয়ে কিছুই জানেন না। সুলেমান যা করেছে নিজের দায়িত্বে করেছে। সিদ্দিকুর রহমান বলেছেন, আমি একেকবার একেক কথা বলি না উকিল সাহেব।

লীলা ময়মনসিংহ জেলখানায় অনেকবার বাবাকে দেখতে এসেছে। শুরুতেই সিদ্দিকুর রহমান বলেছেন, মাগো, মামলা নিয়ে কোনো কথা বলবে না। মামলা নিয়ে চিন্তা করবে উকিল-মোক্তার। কথা বলবে উকিল-মোক্তার। তুমি অন্য বিষয়ে কথা বলো। দুঃখ-কষ্টের কথা বলব না। আনন্দের কথা যদি থাকে বলো।

একটি আনন্দ সংবাদ লীলা দিয়েছে। তিনি অত্যন্ত আনন্দ পেয়েছেন। পরীবানুর সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে মঞ্জুর। সিদ্দিকুর রহমান সংবাদ শুনে বলেছেন, আমি আমার দীর্ঘ জীবনে অল্প কিছু ভালো সংবাদ পেয়েছি, এটা তার একটা। যদি সম্ভব হয় বিবাহের পরে পরীবানু এবং মঞ্জু যেন আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। বিবাহের উপহার হিসাবে আমি তাদের দানপত্র করে কিছু বিষয়-সম্পত্তিও দিব। মাগো এখন আমাকে বলো, এই দুইজনের বিবাহের চিন্তাটা কি তোমার মাথায় এসেছে?

লীলা বলল, হ্যাঁ।

সাবাস বেটি। সাবাস। কেউ কোনো বড় কাজ করলে আমরা বলি সাবাস। কেন বলি জানো?

জি না।

তাহলে আমার কাছ থেকে শোনো। পারস্যের এক সম্রাট ছিলেন, নাম শাহ আব্বাস। উনি ছিলেন মহান সম্রাট। সারাজীবন তিনি বড় বড় কাজ করে গেছেন। তারপর থেকে কেউ যদি বড় কোনো কাজ করত বা ভালো কাজ করত সবাই বলত— আরো এই লোক দেখি শাহ আব্বাসের মতো! সেখান থেকে হলো সাবাস। কেউ ভালো বা বড় কিছু করলেই আমরা বলি সাবাস।

এই গল্প আপনাকে কে বলেছে?

আনিস মাস্টার বলেছে। তার কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। মাগো শোনো, আনিস মাস্টারের মামলা কোর্টে উঠতেছে বলে খবর পেয়েছি। এই মামলার যাবতীয় খরচ আমি দিব। তুমি ব্যবস্থা করো।

আমি যা করার করব।

তোমার মা, সে কেমন আছে? সত্য কথা বলবা। আমি বুঝদার মানুষ। আমাকে বুঝা দেওয়ার কিছু নাই।

উনার শরীর ভালো না। শরীর খুবই খারাপ। তবে মাথা এখন ঠিক আছে। চিন্তা-ভাবনা পরিষ্কার।

আলহামদুলিল্লাহ। শরীরের সুস্থতা কোনো বিষয় না মা। মনের সুস্থতাই সুস্ততা।

 

রমিলাকে মূল বাড়ি থেকে শহরবাড়িতে নেয়া হয়েছে। তার সেবার সব দায়দায়িত্ব নিয়েছে পরীবানু। কাজটা সে করে কঠিন শৃঙ্খলায়। একটুও এদিকওদিক হবার উপায় নেই। প্রতিদিন দুপুরে কর্পূর মেশানো গরম পানি দিয়ে গোসল। এই গোসল রমিলাকে করতেই হবে। একবেলার জন্যেও বাদ যাবে। না। গায়ে জ্বর থাকলেও বাদ যাবে না। বিকালে পাকা পেঁপে। পরীবানু মুখে তুলে পেঁপে খাওয়াবে। সেখানেও না করা যাবে না। খাওয়া-খাদ্যের হাত থেকে বাচার জন্যে রমিলা প্রায়ই নানান কৌশল করেন। কোনো কৌশলই কাজ করে না। একদিন তিনি বললেন, মাগো, তোমাকে একটা সিমাসা দেই। যদি সিমাসা ভাঙাতে পারো তাহলে খাব। ভাঙাতে না পারলে খাব না। সিমাসাটা হলো—

নাই পুষকুনির নাই জলে
নাই পদ্ম ফোটে
কও দেখি জিনিসটা কী
বুদ্ধি থাকলে ঘটে।

পরীবানু বলল, আমার ঘটে কোনো বুদ্ধি নাই। একটা বুদ্ধি আছে, আপনি না খাওয়ার মতলব করছেন। লাভ নাই, হাঁ করেন।

রাতে পরীবানু ঘুমায় রমিলার সঙ্গে। রমিলা নানান বিষয়ে কথা বলেন। কিন্তু একবারও জানতে চান না সিদ্দিকুর রহমান মানুষটার কী হলো। তিনি কোথায় আছেন কীভাবে আছেন। লীলা একদিন বলল, মা, চলেন। আপনাকে বাবার সঙ্গে দেখা করিয়ে আনি। তিনি সঙ্গে সঙ্গে গুটিয়ে গিয়ে বললেন, নাগো মা, না।

লীলা বলল, না কেন?

মানুষটাকে আমি সারাজীবন দেখেছি মাঠে ময়দানে, খোলা জায়গায়। আইজ সে তালাবন্ধ, এইটা দেখতে মন চায় না।

মা, আপনার কি মানুষটার জন্যে খারাপ লাগে না?

রমিলা লীলাকে বিস্মিত করে দিয়ে বললেন, সেই রকম খারাপ লাগে না।

কেন সেই রকম খারাপ লাগে না?

মানুষটা হিসাবের মধ্যে পড়ছে, এই জন্যে খারাপ লাগে না।

বুঝিয়ে বলেন। হিসাবের মধ্যে পড়েছে মানে?

রমিলা শান্ত গলায় বললেন, আল্লাহপাক হিসাবে দুনিয়া চালান। তাঁর হিসাবে ক্ৰটি নাই। মাসুদরে তোমার পিতা তালাবন্ধ করছিল, আল্লাহপাক সেই হিসাবে উনাকে তালাবন্ধ করেছেন। মাসুদ চলে গেছে, আল্লাহপাক সেই হিসাব করে আরেকজনরে উপস্থিত করেছেন, তার নাম মঞ্জু।

আপনার মতো চিন্তা করতে পারলে সুখে থাকতে পারতাম।

তুমি যে আমার মতো চিন্তা করবা না, সুখে থাকবা না— এইটাও আল্লাহ পাকের হিসাব।

লীলা বলল, মা, আপনি তো ভবিষ্যৎ বলতে পারেন, এই মামলার রায় কী হবে বলতে পারেন?

রমিলা বললেন, কোরান মজিদে আল্লাহপাক বলেছেন– নাসরুম মিনাল্লাহি ওয়া ফাতহুন কারিব।

এর অর্থ কী?

এর অর্থ, আল্লাহ তাদের বিজয় দান করেন, যারা এর উপযুক্ত। আমার হুজুরের এই আয়াতটা খুব পছন্দ ছিল। হুজুরের কথা তো তোমাকে বলেছি। বলি নাই?

বলেছেন। এখন বলুন বাবা কি বিজয়ের উপযুক্ত?

সেই বিবেচনা আল্লাহপাক করবেন। হিসাব তাঁর কাছে।

পরীবানুর সঙ্গে এখন তার প্রবল সখ্য হয়েছে। প্রায়ই নিশিরাতে তিনি ধাক্কা দিয়ে পরীবানুর ঘুম ভাঙান। পরীবানু আতঙ্কিত গলায় বলেন, মা, শরীর ঠিক আছে? কোনো অসুবিধা?

রমিলা চাপা গলায় বলেন, কোনো অসুবিধা নাই। তুমি একটা গীত করো। শুনি।

পরীবানু প্ৰায় সঙ্গে সঙ্গেই গীত ধরে—

পীরিতের ভাঙা নাও
নিয়া বান্ধই কোথায় যাও
কোন পবনে নাম লেখাও
দেখাও যৈবনের বাহার।।

গান শুনতে শুনতে রমিলা হাত রাখেন। পরীবানুর পিঠে। নিজে গানের তালে তালে মাথা দোলাতে শুরু করেন। একসময় ক্ষীণ এবং অস্পষ্ট স্বরে তিনিও পরীবানুর সঙ্গে গাইতে থাকেন— দেখাও যৈবনের বাহার।

পরীবানু গান শেষ করে বলে, মা, খুশি হয়েছেন?

রমিলা বলেন, তোমার সকল কর্মকাণ্ডেই আমি খুশি। আমার যদি বিষয়সম্পত্তি থাকত সব তোমারে দিয়া যাইতাম। আমার কিছুই নাই।

আপনার এমন এক জিনিস আছে যা অন্য কারোর নাই, সেইটা আমারে দিয়া যান।

কোন জিনিসগো মা?

ভবিষ্যৎ বলার ক্ষমতা। এইটা আমারে দিয়া যান।

হাতে থাকলে দিতাম। আমার হাতে নাই।

আশ্বিন মাসের এক মধ্যরাতে রমিলা লীলাকে ডেকে পাঠালেন। শান্ত গলায় বললেন, মাগো শোনো, আমার দাদি শাশুড়ির মৃত্যু যখন উপস্থিত হয় তখন তোমার পিতা তার জন্যে দিঘির পাড়ে একটা ঘর বানায়ে দিলেন। মউত ঘর। আমার দাদি শাশুড়ির মৃত্যু মউত ঘরে হয়েছিল। তিনি বড়ই কষ্ট করেছিলেন। তাঁর শরীর পচে গিয়েছিল, চউখ গলে গিয়েছিল। আমি তার সেবা করতাম। শেষের দিকে তার উপর আমি বড়ই নারাজ হয়েছিলাম। আল্লাহপাক তার হিসাব ঠিক রাখবেন। আমারও আমার দাদি শাশুড়ির মতো কষ্টের মৃত্যু হবে। আমার শরীর পচে গেলে যাবে। আমি চাই না তখন কেউ আমার সেবা করুক। তুমি আমার জন্যে মাউত ঘর বানাতে বলো।

লীলা বলল, আমি আপনার জন্যে মউত ঘর বানাব না। আপনার যদি মৃত্যু হয় এই বাড়িতে হবে। আপনার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমি আপনার সেবা করব।

মাগো, অতি ভয়ঙ্কর মৃত্যু আমার জন্যে অপেক্ষা করতেছে। আমি চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতেছি।

রমিলার শেষ ভবিষ্যৎবাণী ফলে নি। তিনি কার্তিক মাসের তিন তারিখ নিজ বিছানায় শুয়ে মারা গেছেন। সামান্যতম মৃত্যুযন্ত্রণাও তার হয় নি। তাঁর ঠোঁটে লেগে থাকা হাসি দেখে মনে হচ্ছিল, জীবনের শেষপ্রান্তে এসে তার মনে হয়েছে রঙ্গে ঢং-এ জীবনটা তো ভালোই পার করলাম।

লীলা তার মায়ের মৃত্যুর বিষয়ে লিখল— মৃত্যুর সময় আমি তাঁর পাশে ছিলাম। সেদিনই তিনি নতুন সাবান দিয়ে গোসল করে নতুন শাড়ি পরলেন। লজ্জিত গলায় আমাকে বললেন, কাঁচা সুপারি, খয়ের আর চুন দিয়ে একটা পান খাব মা। ঠোঁট লাল করব। আমি পান এনে দিলাম। উনি বললেন, চুনটা ভালো না। শঙ্খ চুন আনায়ে দেও। শঙ্খ চুন আনতে বাজারে লোক গেল। আমি বললাম, আজ মনে হয় আপনি ভালো বোধ করছেন। আসুন বাগানে গিয়ে বসি। তিনি বললেন, না। তারপরই তাঁর মধ্যে সামান্য অসুস্থতা দেখা গেল। তিনি বললেন, আমার মাথাটা তোমার কোলে নাও। আমি তার মাথা কোলে নিলাম। তিনি অস্পষ্ট স্বরে বললেন, আল্লাহপাক আমার অপরাধ ক্ষমা করেছেন। আমি বললাম, মা, আপনি তো কোনো অপরাধ করেন নাই। অপরাধের ক্ষমার প্রশ্ন আসছে কেন?

তিনি হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, সব মানুষই অপরাধের মধ্যে বাস করে গো মা। পায়ের নিচে পড়ে পিঁপড়া মারা যায়, সেটাও তো অপরাধ। আমার বিরাট ভাগ্য আল্লাহপাক আমার সব অপরাধ ক্ষমা করেছেন। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়। আমি এত সহজ এবং এত সুন্দর মৃত্যু আগে কখনো দেখি নি। ভবিষ্যতে কোনো দিন দেখব তাও মনে হয় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *