নবীনকুমার যেন এই পৃথিবীকে আবার নতুন ভাবে ফিরে পেয়েছে। বেঁচে থাকার প্রতিটি মুহূর্ত এখন তার কাছে রোমাঞ্চকর মনে হয়। শীত শেষ হয়ে গেছে, বাতাস এখন বড় মনোরম।
বজরার ছাদে দাঁড়িয়ে সে সকালের রেশমী রৌদ্রের স্পর্শে যেন শরীরের প্রতিটি রন্ধে সুখানুভব করে। একটি টিটিভ পক্ষী মাথার ওপর দিয়ে টি-টি-টি-টি করে ডেকে চলে যায়, অনেকক্ষণ ধরে বাজতে থাকে সেই শব্দের রেশ। আকাশে শুভ্ৰবৰ্ণ থোকা থোকা মেঘ, মাঝে মাঝে সেই মেঘের নিচ দিয়ে দলবদ্ধ হাঁসের ঝাঁক শান্তভাবে কোনাকুনি উড়ে যায় দিগন্তের দিকে। পদ্মার চরে মধ্যে মধ্যেই দেখা যায় নিষ্পন্দ হয়ে শুয়ে আছে একটি দুটি কুমীর, প্ৰাণের কোনো চিহ্ন আছে বলেই মনে হয় না, কিন্তু বজরা নিকটবর্তী হলেই তারা সাড়াৎ করে নেমে পড়ে জলে।
কুমীর দেখলেই নবীনকুমার তারস্বরে ডাকে, সরোজ, দেকে যাও, দেকে যাও। ছুটে এসো—
সরোজিনী আসবার আগেই কুমীরগুলি অদৃশ্য হয়ে যায়। সরোজিনী অবিশ্বাস করে। সে জীবনে কখনো কুমীর দেখেনি। কুমীর যে ডাঙ্গায় উঠে বসে থাকে, একথা সে কিছুতেই সত্য বলে মানতে চায় না। নবীনকুমার বলে, তুমি তাকিয়ে থাকে, আবার দেকতে পাবে! কিন্তু সরোজিনীর ভাগ্যে কুম্ভীর-দর্শন ঘটে না। সে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়। তারপর হঠাৎ এক সময়ে সে সবিস্ময়ে বলে ওঠে, ওমা, ওটা কী গো, ওটা কী?
ভয়ে সে নবীনকুমারের হাত চেপে ধরে।
বস্তুটি নবীনকুমারও দেখেছে। কিন্তু সেটি যে কী, তা সে জানে না।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আবার জলের ওপর ভুস করে জেগে উঠেই একটি বেশ বড়সড় প্রাণী আবার ড়ুবে গেল। সেটা যে কোনো মৎস্য নয়, তা অবশ্যই বোঝা যায়।
নবীনকুমার মাল্লাদের ডেকে জিজ্ঞেস করে। তারা জানায় ঐ প্রাণীটির নাম শুশুক। নবীনকুমার তাও প্রথমে বুঝতে পারে না। তারপর মনে পড়ে। তখন সে বালকের মতন আনন্দে হাততালি দিয়ে বলে ওঠে, জানি জানি, শুশুক, শিশুমার। বইতে পড়িচি, সরোজ, তুমি পড়োনি তো, তাই জানো না। শুশুক আর শিশুমার একই!
সরোজিনী বললো, বাবাঃ, যেমুন বিদঘুটে দেকাতে, তেমুন বিতিকিচ্ছিরি নাম! শিশুমার…ছোট ছেলেপুলে ধরে ধরে বুঝি খেয়ে ফ্যালে?
নবীনকুমার তার বিজ্ঞতা প্রকাশের জন্য এবার গম্ভীরভাবে বললো, না গো, নামই ঐ রকম, বইতে ওদের নামে ছড়া আচে!
।ঐ দ্যাকো জলকপি শান্ত শিশুমার
হাঙ্গর কুন্তীরসম নাই দন্তে ধার!
নবীনকুমারকে খুশী করবার জন্যই যেন পরপর আরও কয়েকটি শুশুক নদীর জলে ডিগবাজির কসরৎ দেখায়।
ক্ৰমে পদ্মা নদী ছেড়ে বজরা একটি ছোট নদীতে প্ৰবেশ করলো। সামনের কোনো গঞ্জ থেকে তরিতরকারি ও ডাল ক্ৰয় করতে হবে।
এ নদীর পরিসর ছোট হওয়ায় দু পারের গাছপালা স্পষ্ট দেখা যায়। বসন্ত ঋতুর আগমনে অনেক বৃক্ষে নতুন পাতা গজাচ্ছে। নবীনকুমার মুগ্ধ ভাবে তাকিয়ে দেখে যে বিভিন্ন গাছের পাতার সবুজ রঙও কত ভিন্ন ভিন্ন। কলাগাছের নতুন পাতা লাঠির মতন সোজা হয়ে গোটানো থাকে। এই সব কিছুই নবীনকুমারের কাছে অভিনব। জলের পাশে একপদী বক দেখে তার মনে পড়ে মহাভারতের ধর্ম বকের কথা, যে যুধিষ্ঠিরকে নানা প্রকার কুট প্রশ্ন করেছিল। গ্রন্থের পৃষ্ঠায় বর্ণিত দৃশ্য যেন অকস্মাৎ উঠে আসছে তার চোখের সামনে।
মাঝে মাঝে দেখা যায়, গোবর দিয়ে নিকোনো ঝকঝকে মাটির কুটীর। ছোট ছোট ছেলেরা বজরা দেখে দৌড়ে এসে হাত তুলে চিৎকার করে। দূর থেকে কে যেন ডেকে ওঠে, আমিনা, অ, আমিনা, ইদিকে আয় পোড়ারমুহী-। নবীনকুমারের মনে হয়, এ কণ্ঠস্বরা যেন তার কত চেনা। বহু যুগ আগে, ঠিক এইখানে নদীতীরে এইরকম ভাবে সে আমিনা ডাক শুনেছিল। পরমুহূর্তেই তার শরীর একটি চিন্তায় কেঁপে ওঠে। যদি তার শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়েই থাকতো, তা হলে বঞ্চিত হতো। এই সব আনন্দ থেকে। না, সেরকম ভাবে বেঁচে থাকা অনর্থক, তা হলে সে নিশ্চয়ই আত্মঘাতী হতো।
আবার এক সময় সে ভাবে, তার এই মারাত্মক ব্যাধিটি এক হিসেবে তার মঙ্গলসাধনই করেছে। ব্যাধি হয়েছিল বলেই তো তার জননী তাকে নদীপথে ভ্ৰমণে পাঠিয়েছেন। নইলে তো এসব কিছুই এখন দেখা হতো না। এবার থেকে সে প্রতি বৎসর একবার নদী ভ্ৰমণে আসবে।
একটা রঙীন পাখি ঝুপ করে জলে পড়ে যেতেই নবীনকুমারই চেঁচিয়ে উঠলো, ওমা, সরোজ দ্যাকো, দ্যাকো, একটা পাখি জলে ড়ুবে গেল। মরে গেল আপনা আপনি!
মাঝি মাল্লারা হেসে ওঠে তার কথা শুনে। একজন বলে, আজ্ঞে না, কত্তাবাবু। ও পাখি বড় শেয়ানা, ওগুলোনরে কয় মাছরাঙা পাখি, জল থেকে কুচো মাছ ধইরে খায়।
নবীনকুমারের আবার বিস্ময় লাগে। আকাশের পাখি জলেও ড়ুব দিতে পারে! সত্যিই তো পাখিটা একটা ছোট চাঁদা মাছ ঠোঁটে নিয়ে আবার উড়ে যায়। সে নির্নিমেষে পাখিটার দিকে চেয়ে থেকে বলে, সরোজ, কী সুন্দর না?
সরোজিনী বলে, হ্যাঁ। আপনি ওপরে থাকবেন? আমি এখন নাইতে চল্লুম।
—সরোজ, একদিন নদীতে নাইবে? তোমাতে আমাতে।
—মাগো মা, নদীতে নাইবো কি! এত জল দেকালেই আমার ভয় করে।
—জল দেকালে তোমার ভয় হয়? কই এতদিন বলোনি তো?
—বজরার ওপরে ভয় নেই। কিন্তু জলে নামতে পারবো না।
—আমি নদীতে নামবো। আমি সাঁতার শিকবো। পরমুহূর্তেই সে হাঁক দেয়, দুলাল, দুলাল।
বজরা কিনারে ভিড়ছে, দুলাল আর দিবাকর গঞ্জের হাটে নামবার জন্য গলুইয়ের কাছে দাঁড়িয়ে। ডাক শুনে দুলাল ওপরে উঠে এলো।
নবীনকুমার জিজ্ঞেস করলো, দুলাল, তুই সাঁতার জানিস?
দুলাল তো বাল্যকাল থেকেই নবীনকুমারের সঙ্গে সঙ্গে সর্বক্ষণ থাকে, সে আর সাঁতার শিক্ষার সুযোগ পেল কোথায়। সে উত্তর দিল, আজ্ঞে না।
নবীনকুমার বিরক্ত হয়ে বললো, কেন শিকিসনি? তুই একটা উল্লুক।
–আজ্ঞে।
—আমি নদীতে নাইবো, তুই আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকবি। সাঁতার জানিস না, আমি যদি ভেসে যাই, তুই আমায় বাঁচাবি কী করে?
—আপনি নদীতে নামবেন? সে হবে না। কত্তামা পইপই করে নিষেধ করে দিয়েচেন, আপনাকে যেন কিছুতেই জলে নামতে না দেওয়া হয়।
—সে কতা পরে। তুই সাঁতার শিকিসনি কেন? আজ থেকেই সাঁতার শিকতে লেগে যা—
—আজ্ঞে দিবাকরদাদাও জলে নামতে বারণ করেচেন।
—তুই কার হুকুমে চলিস, আমার না দিবাকরের? কী বলিচি, মাতায় ঢুকেচে? আজি থেকে সাঁতার শিকতে লেগে যাবি।
–আজ্ঞে।
–কিয়ৎকাল পরে নবীনকুমার বোটের ছাদ থেকে নেমে আসে নিজের কামরায়। এখন তার গ্রন্থপাঠের সময়। নানাপ্রকার চাপল্য দেখালেও নবীনকুমার তার সমবয়সী যুবকদের তুলনায় অনেক বেশী পড়াশুনা করেছে। পাঠ তার নেশা। সে বই পড়ে পালঙ্কে শুয়ে, উপপুড় হয়ে।
স্নান সেরে ধৌত বস্ত্ৰ পরে সরোজিনী এলো সে কামরায়। শুষ্ক গামছা দিয়ে সে মাথার ভিজে চুল ঝাপড় দিতে লাগলো, তাতেও নবীনকুমরের পাঠের মনোযোগ ভঙ্গ হলো না। তারপর সরোজিনী আরশির সামনে দাঁড়িয়ে সিঁথিতে সিন্দূর লাগাতে লাগাতে জিজ্ঞেস করলো, আপনি কাল কী স্বপ্ন দেকেচোন, আমায় বললেন না?
গ্ৰন্থ সরিয়ে রেখে নবীনকুমার সরোজিনীর সদ্য সিক্ত প্ৰফুল্ল মুখখানি দেখে মুগ্ধ হলো। বাইরের প্রকৃতির মতন সে এই কিশোরীটিকেও যেন নতুনভাবে আবিষ্কার করছে।
উঠে বসে সে বললো, সরোজ, কাল স্বপ্নে দেকলুম, আমি যেন স্বৰ্গে চলে গেচি!
সরোজিনী তৎক্ষণাৎ রাগত ভূভঙ্গী করে বললো, ছিঃ, আবার ঐ কতা?
নবীনকুমার বিস্মিত হয়ে বললো, কেন, কী হলো? স্বর্গে যাওয়া দোষের?
—আপনি বলেচিলেন না, আর কক্ষুনো মরার কতা উচ্চারণ করবেন না!
—ওঃ হো। সেই কতা। না, না, মরার কতা বলিনি। এ হলো গে সশরীরে স্বর্গে যাওয়া। যেমন যুধিষ্ঠির গিস্লেন, না, না, যুধিষ্ঠিরের মতন বুড়ে বয়েসে নয়, পুরুরবার মতন, তুমি মহারাজ পুরুরবার উপাখ্যান জানো? মহাভারতে আচে!
—না, জানি না।
—আমি তোমায় পড়ে শোনাবো। স্বপ্নে দেকলুম, মহারাজ পুরুরবার মতন আমিও স্বর্গে গেচি, দেবীসভায় আমার বসবার জায়গা দেওয়া হয়েচে খাতির করে আর সেখেনে উর্বশী নাচচেন, তারপর হঠাৎ বুকের মধ্যে ধড়াস করে উঠলো। দেকলুম কী জানো, উর্বশীর মুখখানা এক্কেবারে অবিকল তোমার মতন।
—যাঃ! সব মিচে কত।
—মোটেই মিচে কতা নয়। মা কালীর দিব্যি। সত্যি দেকলুম। তুমি আমার পানে চেয়ে হাসলে।
—বুঝিচি, আপনি আমায় নিয়ে রঙ্গ কচ্চেন।
—তুমি বিশ্বাস করলে না, সরোজ? একদম হুবহু মিলে গেল-কালিদাসের নাটক আচে, বিক্রমোর্বশী, ঠিক এই রকম। তুমি এসো, আমার পাশে বসো, আমি তোমায় নাটকটা পড়ে শোনাচ্চি।
—এখুন শুনতে পারবো না। ও-বেলা। এখুন আমার কাজ রয়েচে না?
—এখন আবার কী কাজ?
—নেয়ে এলুম, এখুন পুজোয় বসবো।
—পুজো-টুজো রাকো। শুনেই দ্যাকো না, কী সুন্দর গল্প, কেমন দিব্য কবিতার ভাষা।
—পুজো ছেড়ে আমি গল্প শুনতে বসবো? শোনো কতা! আমার মা বলে দিয়েচেন, প্রত্যেকদিন যেন মন দিয়ে শিব পুজো করি। আমাদের বংশের ধারা।
শিব পুজো করার কী দরকার।
—ঠাকুর দেবতা নিয়ে আমন ধারা কতা বলবেন নাকো! নবীনকুমার দ্রুত পালঙ্ক থেকে নেমে এসে সরোজিনীকে আলিঙ্গন করে বললো, চেয়ে দ্যাকো, আমি তোমার জ্যান্ত শিব নয়?
সরোজিনী আর্তকণ্ঠে বললো, ওমা, এ কী করলেন, ছুঁয়ে দিলেন! আমায় আবার নাইতে হবে। পুজো করার আগে কাক্কেও ছুঁতে নেই।
নবীনকুমার পত্নীর গণ্ডে ওষ্ঠ স্থাপন করে ফিসফিস করে বললো, আবার নেয়ো বরং। এখন একটুখানি আমার পাশে বসো। সরোজ, মানুষ পুজো করে কেন? ভগবানকে পাওয়ার জন্য তো। কাব্য পাঠ করলেও ভগবানকে পাওয়া যায়।
নবীনকুমার বললো, তুমি বিশ্বাস করলে না! আমাদের শাস্তরেই বলেচে, কাব্যের স্বাদ হলো ব্ৰহ্ম স্বাদ সহোদর। অর্থাৎ ব্রহ্মের সমান সমান। এসো, আমার পাশে একটু বসবে এসো।
সরোজিনী প্ৰায় ক্ৰন্দনের উপক্রম করে বললো, পুজোর নাম করে পুজোয় না। বসলে পাপ হয়। আপনার মঙ্গলের জন্যই তো পুজো করি। আবার নেয়ে পুজো সেরে আসি, তারপর আপনার কতা শুনবো।
নবীনকুমার তাকে ছেড়ে দিয়ে বললো, বেশ, যাও। কিন্তু ছেড়ে দিচ্চি এক শর্তে। এর পর থেকে আর আমায় আপনি বলবে না, তুমি বলবে।
সরোজিনী চক্ষু প্ৰায় কপালে তুলে বললো, ও মা, সে কি অসম্ভব কতা! মেয়েমানুষ কথুনো স্বামীকে তুমি বলে? স্বামী গুরুজন না?
—ছাই গুরুজন। চাকর-বাকররা সব আপনি বলে, আর তুমিও আপনি বলবে! আজি থেকে হুকুম দিলুম, লোকজনের সামনে না বলো, আমার কাচে যখন একলা থাকবে, তখন শুধু তুমি করে বলবে।
—আমার পাপ হবে না?
—সব পাপ আমার। আমি তোমার শিবের মতন স্বামী, সব পাপ আমি খেয়ে ফেলতে পারি! সরোজিনী স্নান করতে চলে যাবার পর নবীনকুমার একলাই কালিদাসের নাটকটি খুলে বসলো। কিছুক্ষণ পড়ার পর তার আবার কী খেয়াল হলো, বইটি সমেতই সে উঠে চলে গেল পাশের কামরায়।
সেখানে একটি টেবিলের ওপর দোয়াতদানি ও শকুনির পালকের কলম রাখা আছে। এবং একটি লাল রঙের খেরোর খাতা। দিবাকররা সেই খেরোর খাতায় হিসেবপত্র লেখে। নবীনকুমার একটি টুল টেনে নিয়ে বসে খাতাটি খুলে সাদা পৃষ্ঠা বার করলো। তারপর কালিতে কলম ড়ুবিয়ে মুক্তাক্ষরে লিখলো : বিক্রমোর্কশী। মহাকবি কালিদাস বিরচিত। শ্ৰীনবীনকুমার সিংহ কর্তৃক বঙ্গভাষায় অনুবাদিত।
তারপর সে লিখতে লাগলো চরিত্রলিপি। মনে মনে তখনই সঙ্কল্প করে নিল যে ফিরে গিয়ে বিদ্যোৎসাহিনী সভার পক্ষ থেকে এই নাটকের অভিনয় করাবে সে। সে স্বয়ং নেবে পুরুরবার ভূমিকা।
এর পর থেকে চার দিন নবীনকুমারের আর অন্য কোনো বিষয়ে হুঁশ রইলো না। সে একটানা লিখে যেতে লাগলো নাটক। এদিকে দুলালচন্দ্ৰ প্ৰতিদিন নদীতে নেমে জল দাপিয়ে প্রাণান্তকর পরিশ্রমে শিখতে লাগলো সাঁতার, কিন্তু নবীনকুমারের আর সেদিকে একটুও মন নেই। সরোজিনী মধ্যরাত্রে ঘুম ভেঙে দেখে, তখনও তার স্বামী জাহাজী লণ্ঠন জ্বেলে লিখে চলেছে। রাত্রে নোঙ্গর-করা বজরা ঢেউতে দুলছে সামান্য। শোনা যায় জোয়ারের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, এ ছাড়া সবদিক নিস্তব্ধ। সরোজিনী জিজ্ঞেস করে, হ্যাঁ গা, আপনি ঘুমুবেন না? শরীর আবার খারাপ হবে যে! নবীনকুমার মুখ তুলে শুধু একবার তাকায়, একটিও কথা বলে না, আবার রচনায় মনোনিবেশ করে। কখনো কখনো বিরক্তিতে কুঞ্চিত হয় তার ললাট। বজরার বহরে অনেক রকম মানুষই আনা হয়েছে, কিন্তু কোনো সংস্কৃত পণ্ডিত আনা হয়নি। নবীনকুমারের সংস্কৃত জ্ঞান ততটা প্রখর নয়, মাঝে মাঝে দু-একটি সমাসবদ্ধ পদের জটিলতায় সে দিশাহারা হয়ে যায়। তখন সে আন্দাজ মতন কোনো একটা অর্থ বসিয়ে দেয়। ফিরে গিয়ে কোনো পণ্ডিতকে দিয়ে শুধরে নিলেই হবে।
মাঝে মাঝে কোনো নগরে-বন্দরে যখন বজরা থামে, তখন লোক মারফত সমস্ত কুশল সংবাদাদি দিয়ে পত্র পাঠানো হয় বিম্ববতীর কাছে। নির্দিষ্ট কোনো বন্দরে বিম্ববতীর কাছ থেকেও পত্র নিয়ে এসে লোক অপেক্ষা করে থাকে। নবীনকুমারের স্বাস্থ্য ফিরেছে এবং শ্রবণ ও স্মৃতিশক্তিরও পুনরুদ্ধার হয়েছে জেনে বিম্ববতী আনন্দ সাগরে ভাসছেন। গতকালই তিনি সংবাদ পাঠিয়েছেন যে তা হলে আর বিলম্ব করা কেন, এবার তো ফিরলেই হয়। জীবনে এই প্রথম তিনি পুত্রমুখ আদৰ্শন করে এত দীর্ঘদিন রইলেন। এখন তিনি অধীর হয়ে উঠেছেন। তা ছাড়া চৈত্র মাস পড়ে গেছে, যে-কোনো সময় কালবৈশাখী ওঠার সম্ভাবনা। এ সময় নদীপথ নিরাপদ নয়।
বজরার বহর এখন ফেরার মুখ ধরেছে। কিন্তু ফিরতে ফিরতে আরও পক্ষকাল তো লাগবেই।
নাটকের অনুবাদটি সম্পূর্ণ করতে নবীনকুমারের মোট এগারো দিন লাগলো। শরীরে একটুও ক্লান্তিবোধ নেই, বরং মনে অদ্ভুত আনন্দ। একটা কাজ শেষ করার তৃপ্তিই অন্যরকম। এর আগে নবীনকুমার ছোটখাটো দু-চার পাতার রচনা লিখেছে, কিন্তু এক সঙ্গে এতখানি লেখেনি। তার আত্মবিশ্বাস হলো, তা হলে সে গ্রন্থকার হতে পারবে।
এতগুলি দিন অনবরত শুয়ে বসে থাকার ফলে তার হাত-পায়ে খানিকটা যেন জড়তা এসেছে। তার ইচ্ছে করলো খানিকটা লাফ ঝাঁপ করতে, তীরে নেমে কিছুক্ষণ দৌড়োতে।
সেদিন অপরাহ্ন সে উঠে এলো বজরার ছাদে। আকাশময় কোদালে মেঘ। হাওয়া দিচ্ছে শন শন করে, ঝড় উঠতে পারে। দিবাকর চিন্তিতভাবে কথাবার্তা বলছে মাঝিমাল্লাদের সঙ্গে।
নবীনকুমার চেয়ে দেখলো নদীর দক্ষিণ পাশে এক স্থলে একটি সুন্দর বাঁধানো ঘাট। তার কিছু দূরে একটি ছোট টিলার ওপরে একটি বেশ বড় সাদা রঙের অট্টালিকা, তার চারদিকে নিবিড় গাছপালা।
সে জিজ্ঞেস করলো, এ স্থানটির নাম কী?
দিবাকর বললো, আজ্ঞে, ইব্রাহিমপুর। সামনেই আর কিছুদূরে ময়নাডাঙ্গা, সেখেনে আমরা বজরা ভিড়োবো।
টিলার ওপরে বড় বাড়িটির এক কোণে একটি লোহার চোঙ, সেখান থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। জায়গাটি নবীনকুমারের বেশ পছন্দ হলো।
সে বললো, মেঘ উঠেচে, আর সামনে যাবার প্রয়োজন কী? এখানেই বজরা ভেড়ানো হোক না। আমি একটু হাত পা ছড়াবো।
দিবাকর বললো, আর একটুখন অপিক্ষে করুন। ময়নাডাঙ্গার আর দেরি নেই। এ জায়গাটি ভালো নয়কো।
—কেন, এ জায়গাটি মন্দ কিসের?
—এখেনে বড় নীলকর সাহেবদের হেঙ্গামা। ঐ যে টিলার ওপর বাড়িটে দেকচেন, এঁটে নীলকুঠি।
—নীলকুঠি রয়েচে বলে কি এ তল্লাটে মানুষজন যেতে পারবে না? এ আবার কেমন ধারা কত?
–আজ্ঞে, নীলকররা বড় অত্যেচার করে। মানীর মান রাকতে জানে না। এখেনকার লোকজন অনেকে ভয়ে পালিয়েচে।
—কী নাম বললে জায়গাটার? ইব্রাহিমপুর! এখেনে আমাদের জমিদারি আচে না?
—ছিল, সে সব জমি আমরা নীলকরদের ইজারা দিয়ে দিইচি। ওনাদের অত্যোচারে আর রক্ষে করা গেল না। ভালো আখের খেত ছেল, বড়বাবুর আমলে ইব্রাহিমপুর থেকে বিলক্ষণ মোটা টাকা উগুল হতো, সে সব গ্যাচে, রয়েচে শুধু কুঠিবাড়িটি।
–সেখানে কে থাকে?
—জনাচারেক কর্মচারী রাকা হয়েচে, দেকাশুনো করে।
—বজরা ভেড়াও, আমি সেই কুঠিতে একবার যাবো।
—আজ্ঞে হুজুর, ও কতা উচ্চারণ করবেন না। সাধ করে কেউ নীলকরদের কাচ ঘ্যাঁষে? কতায় বলে বাঘে ছুঁলে আঠেরো ঘা আর নীলকরে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা।
—দিবাকর, আমি কখনো নীলকর সাহেব দেকিনি। তারা কি বাঘ-সিংহীর চেয়েও হিংস্ৰ? ইংরেজ এ দেশ শাসন কচ্চে, তা বলে কি লোককে দেশ-ছাড়া করবে? নীলকরদের ভয়ে সবাই পালালে ওদেরই বা কাজ চলবে কী করে? তুমি মিচিমিচি ভয় দেকাচো! বজরা ভেড়াতে বলো, আমি একবার নেমে দেকবো।
দিবাকর হাত জোড় করে কাচুমাচু মুখে বললো, ছোটবাবু, দয়া করে এ হুকুমাটে দেবেন না। দয়া করে আমার কতটা শুনুন। কত্তামা অনেক করে বলে দিয়েচেন, যেখোনে সেখেনে যেন না নামি। মেঘের যা চেহারা, ঝড় উঠতে দেরি আচে, এর মধ্যেই বেলাবেলি আমরা ময়নাডাঙ্গা পৌঁচে যাবো। তখুন। আপনি ড্যাঙ্গায় নেমে হাত পা ছড়াবেন।
—তুমি এত ভয় পাচ্চো কেন বলে তো, দিবাকর?
—হুজুর, জায়গাটা অপয়া!
—অপয়া? কিসের অপয়া?
—আপনার বড় দাদা গঙ্গানারায়ণ সিংহ এই জায়গা থেকেই নিরুদ্দেশ হয়েছেলেন। নবীনকুমার কয়েক পলক একদৃষ্টে স্থিরভাবে তাকিয়ে রইলো দিবাকরের মুখের দিকে। তারপর অত্যন্ত কঠোর কর্কশ কণ্ঠে বললো, দিবাকর, আমি বলচি না বজরা ভেড়াতে? তুমি আমার সঙ্গে ছলিবলি কচ্চো?
ধমক খেয়ে ঘাড় হেঁট করলো দিবাকর। বিড়বিড় করে বললো, কত্তামা আমার ওপর ভার দিয়েছেলেন…আমাকে তিনি যা নয়। তাই বলবেন।
—ফের দেরি কচ্চো?
সেই ঘাটেই লাগলো বজরা। একদা মধ্যরাতে এখান থেকেই অদৃশ্য হয়েছিল গঙ্গানারায়ণ। পুরোনো আমলের মাঝিমাল্লা কয়েকজন এখনো রয়েছে এই বজরায়, তারা সেদিনের কথা স্মরণে এনে পরস্পরের প্রতি চেয়ে নীরব হয়ে রইলো।
দুলালকে সঙ্গে নিয়ে ঘাটে নামলো নবীনকুমার। গঙ্গাদাদার কথা আর তেমনভাবে মনে পড়ে না। কিন্তু তার মনে পড়লো সম্প্রতি কালের একটি ঘটনা। বিধুশেখরের কন্যা সুহাসিনীর পুত্রের অন্নপ্রাশনের দিনে সুহাসিনী অকস্মাৎ গঙ্গানারায়ণের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে ক্ৰন্দন করেছিল। সুহাসিনীও তো অনেক বালিকাবস্থাতেই দেখেছে। গঙ্গানারায়ণকে। মানুষ চলে যায়, তবু কোথাও কোথাও এমন গভীর ছাপ রেখে যায়।
সুহাসিনী সেদিন গঙ্গানারায়ণের জন্য কেঁদেছিল, সেই কথা মনে পড়ায় নবীনকুমারেরও চক্ষু জ্বালা করে উঠলো। কোনো কথা না বলে সে বসলো পাথর বাঁধানো ঘাটটিতে। তার মনে হলো, যেন তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা গঙ্গানারায়ণের আত্মা অদৃশ্য থেকে তার দিকে চেয়ে আছে। স্থানটি অদ্ভুত রকমের স্তব্ধ। নীলকরদের কুঠি থেকেও কোনো আওয়াজ আসছে না।
একটু পরে হঠাৎ বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি নামলো। দুলাল ব্যস্ত হয়ে বললো, ছোটবাবু, শিগগির বোটে চলুন, একদম ভিজে যাবেন।
নবীনকুমার কোনো উত্তর দিল না। সে বসে ভিজতে লাগলো বৃষ্টিতে। অনেকক্ষণ ধরে। কর্মচারীদের শত ডাকাডাকিতেও সে কৰ্ণপাত করলো না।