পেটকাটা মানুষ ও জাগ্রত যুবসমাজ
মরিয়ম বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা এসএম হলে হাজির হয়। সবকিছু আগের মতোই আছে, দেয়ালে বুলেটের গর্তগুলি খালি নতুন। আর আবেদ কোথাও নেই। সুমন দাঁত মাজছিল। মরিয়মকে দেখে মুখভর্তি টুথপেস্ট গিলে ফেলে। পাশের রুম থেকে সিটি বাজায় একজন। মরিয়ম অনেকদিন পর প্রাণ খুলে হাসল। সুমন তাতে আরো অবাক হয়। নোংরা তোয়ালে মুখ মুছে, শার্ট গায় দিতে দিতে ভাবে, আবেদ ভাই এত বদলে গেলেন-রাত যেন দিন, দিন যেন রাত। এখন মেয়েটিকে সে কী বলবে–সত্য না মিথ্যা? দিনটা মিথ্যা দিয়ে শুরু করে তার লাভ? আবেদ ভাই তো রুমমেট সুমনকেও আজকাল চিনেন না। অথচ ২৫ মার্চ রাতে তার ভারী শরীরটা এপাশ থেকে সে ধাক্কা দিয়ে তুলে না-দিলে তিনি দেয়াল টপকাতেই পারতেন না। ততক্ষণে হলের ভেতর মিলিটারি ঢুকে পড়েছে। জাস্ট এক বছর দুই মাস। কত তাড়াতাড়ি মানুষ সবকিছু ভুলে যায়, বিশেষত নেতারা। সে একজন সাধারণ কর্মী। এ অবস্থায় বিদ্রোহ করার অধিকার তার আছেই।
এক অবাঙালির সওদাগরি অফিসের মালিক এখন আবেদ। প্রাক্তন মালিককে ভারত হয়ে পাকিস্তান পালিয়ে যেতে সাহায্য করার বিনিময়ে তার পরমাসুন্দরী মেয়েকে সে বিয়ে করেছে। অর্থাৎ যুদ্ধজয়ের পর পুরো রাজত্বসহ রাজকন্যা তার ভাগে। হাতে হাতে স্বাধীনতার ফল। অথচ যুদ্ধে সুমন আর মন্টুও গিয়েছিল। একজন নোংরা তোয়ালেতে এখন মুখ মুছছে, আরেকজন ফিরে আসেনি। দুজনই আবেদের অনুজ, পরম শিষ্যের মতো ছিল। সুমনকে আরো অবাক করে দিয়ে মরিয়ম বলে যে, যুদ্ধের আগে তাদের সম্পর্ক চুকেবুকে গেছে। আবেদের ব্যক্তিগত জীবন জানার তার দরকার নেই। মরিয়ম শুধু তার ঠিকানাটা চায়। সে নিজে একজন বীরাঙ্গনা। ‘বীরাঙ্গনা মানে জানো তো,’ সুমনের হাঁ-করা মুখের সামনে পাঁচ আঙুল ঘুরিয়ে বলে, ‘যে জাতির গর্ব, স্বাধীন বাংলাদেশের পবিত্র নারী!’
শিরীষ অরণ্যের কারুকাজময় ছায়ায় প্রবেশ করে মরিয়মের বিস্মৃতকালের এক গল্প মনে পড়ে। ফুলবাগিচা আর সুরম্য প্রাসাদের এক আশ্চর্য নগরীর গল্প। সেখানে বাস করত এক রাজকুমার। তার স্ত্রী ছিল, পুত্র ছিল। সংসার সুখের ছিল কি না, জানে না। তাকে যুদ্ধে যেতে হলো এমন এক দেশে, যেখানে কালো চুলের, সম্মোহনী। চোখের নারীদের বাস। সে তাদের একজনকে ভালোবাসল, কিন্তু বন্দি করে রাখল। সে তাকে প্রাণের কথা খুলে বলল কিন্তু যুদ্ধ শেষে নিজের দেশে চলে গেল। গল্পটা শেষ হয় এখানে। তবে কিছু কিছু গল্প থাকে, যা কখনো শেষ হয় না।
আবেদের স্ত্রী পাকিস্তানি, পাঞ্জাবি নয় তো, তার বাড়ি কি লাহোরে?
মরিয়ম রিকশার জন্য পলাশীর মোড়ে এসে দাঁড়ায়। তাকে এগিয়ে দিতে এসেছে সুমন। সে এখন বেশ ধাতস্থ আর আন্তরিক। সেখানে প্রথম আর শেষ দিনের সেই মুচিকে তারা দেখতে পেল না। জায়গাটা শূন্য। পাশের বস্তিটিও নেই। ২৫ মার্চ রাতে ঘুমন্ত মানুষদের নিয়ে পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। সুমন পোড়া জমিনের দিকে তর্জনী তুলে বলে, ‘মুচির বাসা ছিল ওই বস্তিতে।’
আবেদের বদলে রাস্তায় আজ সুমন। মুচি তার বস্তিসহ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। মরিয়ম যেন পুরাণের সেই ফিনিক্স পাখি, যার ধ্বংস নেই। পোড়া ছাই থেকে নতুন শরীর নিয়ে সে উড়ে এসেছে বিগত জীবনে, আগের ঠিকানায়। এটা যুদ্ধ-পরবর্তী যে কোনো দেশের যে-কোনো সময়ের মানুষের কাহিনি। যার একটাই শিরোনাম, যা লেখাও হয় বারবার, তাতে যুদ্ধ থামেনি। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বা সময় কোনোটাই মরিয়মের অনুকূলে নেই যে, নিজের জন্য বা আর কারো জন্য একদণ্ড বসে শোক করবে।
কফিলউদ্দিন আহমেদ এখন বঁটি হাতে যে কালো গেটের আড়ালে মেয়ের জন্য অপেক্ষা করছেন, তাতে নতুন কালিতে নিজের নাম-ঠিকানা লেখা হয়ে গেছে। বাঁশঝাড়টাই শুধু রাতারাতি ফলানো যায়নি। সিজনের প্রথম বর্ষণে থোকা থোকা জংলি ফুল ফুটেছে যে পাতকুয়োটায়, সেটা এখনো বোজা। এ ছাড়া বাদবাকি ঠিকঠাক। এখন মেয়েকে আসতে দেখলে তিনি এক কোপে খতম করে দেবেন। মনোয়ারা বেগমের সতর্কবাণী, ‘নিজে নিজের পথ দেখো। বাঁচলে নিজে বাঁচবা, মরলে নিজে মরবা। আমরা তোমার সাথে-পাছে নাই। মরিয়ম তাই নিজের পথ নিজে দেখছে–একটা ফিনিক্স পাখি। নতুন জীবন পেলেও পুরোনো পথে সে বিচরণ করে, যেখানে আবার আগের মানুষ নেই, যারা আছে তারা আগের জায়গায় নেই। একটা মৃত্যু থেকে আরেকবার জন্মলাভের জন্য তার বয়সটা খুব অল্প–মাত্র ২৩ বছর।
সঙ্গে ঠিকানা থাকা সত্ত্বেও আবেদের অফিস খুঁজে পেতে সেই দুপুর। লাঞ্চ ব্রেক চলছে। মরিয়ম গেটের ধারে অপেক্ষা করে। পাশেই সুসজ্জিত দারোয়ান। তবে পোশাকের নিচে সে অপেশাদার একজন মানুষ। নিজের টুলে মরিয়মকে বসতে দিয়ে জানায়, সে আবেদের দেশের বাড়ি থেকে এসেছে, সম্পর্কে চাচা হয়। পুরোনো অফিসের রেওয়াজমাফিক সাহেবকে এখন তার স্যার বলতে হচ্ছে। আগের দারোয়ান বিহারি ছিল। সে যে কতল হয়েছে, নিজের গলা বরাবর তর্জনী চালিয়ে নতুন দারোয়ান তা দেখায়। তবে নিজের ভাতিজা বলে নয়, স্যার খুব ভালো আর পরোপকারী। বীরাঙ্গনা অফিসের প্যাকেট দিয়ে লাঞ্চ সারে। বলে ‘ঘেন্না করবা না, ওরা তোমাদের মা-বোন, দেশের জন্য ইজ্জত দিছে। নিজের ভাতিজা বলে নয়, ‘স্যারের চেত-ঘিন কিছু নাই, নইলে ওই মাগি গো হাতের খানা খায়-কন?’ এবার আবেদের দূরসম্পর্কের চাচার কিছু গোপন কথা বলার আছে। একবার অফিসের দিকে সে তাকায়, একবার মরিয়মের দিকে ঘোরে, ‘বউ অবাঙ্গাইল্লা বুঝচ্ছেন, যুদ্ধের ফক্করে পড়ে বিয়া করছে, ভাত-মাছ রান্তে জানে না। অফিস থেকে একজনকে বেরিয়ে আসতে দেখে দারোয়ানের খুব গরম লাগে। মাথার ক্যাপ হাতে নিয়ে নাড়তে নাড়তে আপন মনে বলে, ‘নতুন জিনিস তো ওম ছাড়ে নাই।’ তারপর নিজের পোশাকের সে তারিফ করে, ‘ডেরেসটা এক্কেরে ভাতিজা, থুক্কু স্যারের নিজের হাতে কিনা।’
আবেদের দূর সম্পর্কের চাচার সঙ্গে রমিজ শেখের কোথায় যেন মিল আছে। মরিয়ম ভাবে, সে বেঁচে থাকলে কি এ অফিসের দারোয়ান হতো আর মরিয়ম হতো সাহেবের ব্যক্তিগত সেক্রেটারি কাম টেলিফোন অপারেটর? একটা যুদ্ধ অনেক অসম্ভবও সম্ভব করে তোলে। মরিয়মের ডাক এসেছে স্যারের রুম থেকে। দারোয়ান মাথায় ক্যাপ চাপিয়ে আনাড়িভাবে সালাম ঠুকে বলে, ‘আইয়্যেন গো বড়মানুষের মাইয়্যা মাঝেসাঝে, কথা কওনের মানুষ পাই না আমি।’ রমিজ শেখ একই কথা বারবার বলত। কারণ তার তিরিশ বছরের জীবনের দশটা বছর কেটেছে জেলখানায়।
মরিয়ম জানে, সে কোথায় আর কার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। আবেদের বোধ হয় দর্শনার্থী কে, জানা ছিল না। যত তাড়াতাড়ি পেছনে চেয়ার ঠেলে সে উঠে দাঁড়ায়, তার চেয়ে ক্ষিপ্রগতিতে বসে পড়ে। নিজেকে সামলাতে সামলাতে মিনিটের ভগ্নাংশ মনে হয় ঘণ্টা, দিন–আস্ত একটা বছর, আরো দুটি বাড়তি মাস। পলাশীর মোড় থেকে ২৫ মার্চ, ভারতের ট্রেনিং ক্যাম্প, যুদ্ধ, রেসকোর্সে আত্মসমর্পণ, রাজত্বের সঙ্গে রাজকন্যা, এসব কিছুর ওপর দিয়ে তাকে তখন প্রাণপণে দৌড়াতে হয়। তারপর থামে যখন, তখনো মরিয়ম দাঁড়িয়ে, তাকে বসতে বলা হয়নি। বসার পর বিকট শব্দে একটা বোমা ফাটে। শব্দের পরিবর্তে তা বারুদভর্তি হলে সুসজ্জিত অফিসটাই উড়ে যেত। কিন্তু মরিয়ম অটল। ঝানু, ক্ষমতাবান, সশস্ত্র পুরুষদের যে দিনের পর দিন দেখেছে। উলঙ্গ হতে, খুন করতে, ভোগ করতে, ঘৃণা করতে, ভালোবাসতে-পূৰ্বপ্রেম তার মনে ছায়া ফেলে না। প্রাক্তন প্রেমিককে মনে হয় অর্বাচীন বালক। তার ভালোবাসা-প্রতারণা চৈত্রের কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি যেন, যা বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের পর বর্ষার প্রবল বর্ষণে হারিয়ে গেছে। তাকে ক্ষমা করা-না-করা সমান। মরিয়মের এখন একটা চাকরি দরকার, আবেদ ছাড়া এত বড় শহরে চাকরিদাতা কাউকে চেনে না সে। এখন আবেদ যদি বলে ক্ষমা করার বিনিময়ে মরিয়মকে একটা চাকরি দেবে, তাহলে খুশি মনেই সে তাকে ক্ষমা করবে। তাই নিজের বীরাঙ্গনা পরিচয় দিয়ে সে একটা চাকরি চাইছে আবেদের কাছে। চাকরিটা যে তার খুব দরকার, তা বোঝাতে কফিলউদ্দিন আহমেদের বঁটি হাতে গেটের আড়ালে লুকিয়ে থাকা আর মনোয়ারা বেগমের নিজের পথ নিজে দেখো’ উক্তিটিরও স উল্লেখ করে। তারপর বলে যে, দারোয়ান পদে আরো একজনের চাকরির জন্য সে এখানে আবেদন করত। তার আর দরকার নেই। কারণ লোকটা যুদ্ধে মারা গেছে। আর পদটাও দেখা যাচ্ছে খালি নেই। এ ছাড়া মন্টুর খবর আবেদও জিগ্যেস করে না, মরিয়মও তাকে বলে না। একজন শহিদ মুক্তিযোদ্ধার বোন হিসাবে কেন, তার বীরাঙ্গনা পরিচয়ই তো যথেষ্ট একটা চাকরি পাবার জন্য। আবেদ নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা। তদুপরি আরোহণ করেছে সেই চেয়ারে, যেখানে একদিন মোটা মাথার অবাঙালিদের বসে থাকাটা তাকে যুদ্ধ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। যুদ্ধে তার পক্ষ জিতেছে। নিজগুণে চেয়ারটাও সে বাগিয়েছে। মরিয়ম এখন চাকরি না-পেলে আবেদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে?
আবেদের মাথায় কিছু কথা ঢোকে, কিছু ঢোকে না। অবাক হওয়ার পর সে হতাশ হয় এই ভেবে যে, তাকে হারিয়ে মেয়েটার মনে কোনো হাহাকার নেই। সে যদি চাকরি চাওয়ার পরিবর্তে তার গালে দুটি চড় মারত, আবেদের ভালো লাগত। তার নবলব্ধ ক্ষমতা সার্থক হতো। অর্থবিত্ত, ভালো একটা বাড়ি, সুন্দরী স্ত্রী পুরুষের সব নয়। আরো লাগে। এসবের একটা হলো, যাকে সে ছেঁড়া কাপড়ের পুটলি বানিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে, কুকুরীর মতো পুরুষটির পদতলে তার বারবার ফিরে আসা। মেয়েটা সেইভাবে আসেনি। সে নিজের তালে আছে। কিন্তু যুদ্ধের আগে তো এমন ছিল না! তখন বিয়ে ছাড়া যে মেয়ে কিছু বুঝত না, কয়টা পুরুষের নিচে শুয়েছে যে, এখন আর পুরুষ নয়, হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছে? চেহারায়ও কেমন রাভি রান্ডি ভাব। যেন দুনিয়া জয় করে ফিরেছে। বীরাঙ্গনা মানে অসহায়-নির্যাতিত নারী, সহানুভূতির আড়ালে সর্বান্তঃকরণে সকলে তাদের ঘৃণাই করে। তারপর এত সাহস সে কই পায় যে, প্রাক্তন প্রেমিকের কাছে প্রেম ফেরত না-চেয়ে, চাকরি চাইতে আসে? শুধু নিজের জন্য নয়, একটা মরা লোকের জন্যও, যে বেঁচে থাকলে নাকি এই অফিসের দারোয়ান হতো। কোথাও একটা গলদ আছে। তা খুঁজে বের করতে সময় আর ভাবনা দরকার। আবেদ তাকে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অনতিবিলম্বে বিদায় করে।
মরিয়ম সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার ছেড়ে ওঠে না। চাকরি পাওয়া-না-পাওয়া নিয়ে তার মনে এক রাজ্যের সংশয়। আবেদকে ঠিক বিশ্বাস করা যায় না। তাই বসে থেকেই সে বলে, মরিয়ম তার প্রাক্তন প্রেমিকা, তাকে সে বিয়ে করেনি, তা না করুক, মেয়েটার এখন যখন একটা চাকরি দরকার, তা তো দিতেই পারে। মৃত লোকটা, যে বেঁচে থাকলে আবেদের অফিসের দারোয়ান হতে পারত, তার কথা না-হয় বাদই দেওয়া গেল। যদিও ক্ষমতার তখতে যে বসে আছে, তার জন্য শহিদ আর বীরাঙ্গনা উভয়ের সেবা করা ফরজ। এর ব্যত্যয় ঘটলে, আবেদ কি নিশ্চিত আরেকটা যুদ্ধ হবে না?
আবেদের ড্রয়ারে পিস্তল থাকা বিচিত্র নয়। কোনো কোনো মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র জমা দিলেও কেউ কেউ দেয়নি। সে তাকে গুলি করতে পারে। পুলিশ ডেকে বলতে পারে, মেয়েটা একজন ছিনতাইকারী বা পাকিস্তানি গুপ্তচর বা সিআইএ’র এজেন্ট, টাকা খেয়ে একজন স্বনামধন্য মুক্তিযোদ্ধার জান কবজ করতে এসেছে। এসবের কোনো একটা ঘটার আগে মরিয়ম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। নির্বিঘ্নে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। তাকে সালাম ঠুকে গেট খুলে দেয় সেই লোকটা, যার জায়গায় বেঁচে থাকলে রমিজ শেখের চাকরির আবেদন সে করতে পারত।
অ্যাডভেঞ্চারের সুখ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। সেগুনবাগিচা থেকে হাতিরপুল। বাংলাদেশের জাগ্রত যুবসমাজের এক পাতার একটি লিফলেট মরিয়মের চলন্ত রিকশায় উড়ে আসে। যার লোমহর্ষক শিরোনাম পেটকাটা মানুষ। তাতে মহিলাদের অশালীন পোশাক পরিহারের জন্য ১৫ দিন সময় দেওয়া হয়েছে। তার পরও যদি এমতাবস্থায় রাস্তায় কাউকে দেখা যায়, দুর্ভাগ্যজনক ও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে। জাগ্রত যুবসমাজ মনে করে, পেটকাটা ও হাতকাটা ব্লাউজ আর নাভির নিচে শাড়ি পরা অশালীন। এ ধরনের পোশাক স্বাধীন দেশে চলতে দেওয়া হবে না। মরিয়মের পরনে মিলের লাল পেড়ে কোড়া শাড়ি আর লম্বা হাতার ব্লাউজ বীরাঙ্গনাসুলভ পোশাক-আশাক। তবে পুনর্বাসনকেন্দ্রে এমন সাজসজ্জার দু-চারজনকে সে দেখেছে। তারা ভারতফেরত। ফ্যাশনটা বোধ হয় ওখানকারই, যা স্বাধীনতার পাঁচ মাসের মাথায় বাংলাদেশের জাগ্রত যুবসমাজ বরদাস্ত করতে পারছে না। এই জাগ্রতরা আসলে কারা?
‘কারা আবার, বদমাশ লোকেরা। যারা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায়।’ মরিয়মের কলেজ-লাইফের বান্ধবী রিনা লিফলেটটা দেখে চটে যায়। কারণ দর্জি দিয়ে এরকম আধ ডজন ব্লাউজ সে গত মাসেই বানিয়েছে। এখনো সব কটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে পরা হয়ে ওঠেনি। পরে যাবেই-বা কোথায়। কলেজের মেয়াদ শেষ। বাসা থেকে পরিষ্কার বলে দিয়েছে, ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করানো হবে না, যদি পড়তে চায় বিয়ের পর পড়বে। বদমাশ ছেলেদের লিফলেটটা দলা পাকাতে পাকাতে মরিয়মের হাতের ব্যাগের দিকে তার চোখ যায়। ব্যাপারটা নতুন নয়। এ বাসার দ্বার রিনার বান্ধবীদের জন্য অবারিত। মরিয়ম সেই ভরসাতেই এসেছে। দু-চারটা রাতের মামলা। চাকরি পেলে সে চলে যাবে। তবে কতগুলো কথা তাকে জনে জনে বানিয়ে বলতে হয়। প্রথম বাসায় ঢুকে যেমন রিনাকে বলল একবার। সেই একই কথা বলল, যখন রান্নাঘর থেকে রিনার মা খালাম্মা বেরিয়ে এলেন। তৃতীয়বার বলতে হলো, খালুজান অফিস থেকে বাসায় ফেরার পর। রিনাদের একদম বাসার পাশেই বক্তৃতার মাঠ। সেখানে বিকাল থেকে একটা বামপন্থি দলের জনসভা চলছে। মরিয়মের মিথ্যা কথাগুলোর মাঝখানে প্রত্যেকবার তাই বক্তৃতার ভগ্নাংশ ঢুকে পড়ছিল : কমরেড লেনিন। বাবা-মা মেরিকে নিয়ে নয় মাস খুব উৎকণ্ঠায় ছিলেন। বাড়ির কাছে মিলিটারি ক্যাম্প। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এখনই সুবর্ণ সুযোগ। তারা মন্টুকে নিয়ে ভাবেননি। দেশে থাকলে মিলিটারি মারত, তবু ভালো যে, সে যুদ্ধ করছে। স্বাধীনতার ধাত্রী যদি হয় ভারত, তবে পিতা হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। নতুন দেশের পরিচয় তার পিতার নামেই হবে, হওয়া উচিত। সেই মন্টুই আর ফিরল না। চাকরি খোঁজা ছাড়া এখন উপায় কী মরিয়মের। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে বাবা-মা খুব ভেঙে পড়েছেন। ঢাকায় আসতে দিতে চান নাই। একপ্রকার জোর করেই ফুলতলি থেকে তাকে চলে আসতে হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনে আমরা মুজিব সরকারকে সর্বান্তকরণে সাহায্য করব। (সর্বহারা জনতার করতালিসহ স্লোগান) ইনকিলাব জিন্দাবাদ। তোমার নেতা আমার নেতা। মুজিব-ইন্দিরা-কোসেগিন। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।
বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর মরিয়ম ঘুমাতে যায় রিনার ঘরে। সারা দিন সে পাগলের মতো বকবক করেছে। তার মধ্যে কটা সত্য, কটা মিথ্যা–ভেবেছিল গুনতে গুনতে ঘুমিয়ে পড়বে। রিনা ঘ্যান ঘ্যান করে তাকে সে সুযোগ থেকেও বঞ্চিত করে। যুদ্ধের বছরটা মাত্র ন’মাসের হলেও অনেক লম্বা। আর বিরক্তিকর। রিনা তাই লুডুখেলা ধরেছিল। ওর ১৩-১৪ বছরের ভাই দুটি ধরেছিল বিড়ি ফোকা। তারা তখন মামার বাড়িতে।
আবার শুরু হলো যুদ্ধ! মরিয়মের মাথার মধ্যে ধুমধাম আওয়াজ। সেখানে কালভার্ট, স্কুলঘর, দালানকোঠা ভাঙতে শুরু করেছে। ততক্ষণে রিনা আবার যুদ্ধ ছেড়ে সোজা চলে যায় ভালোবাসা, মন দেওয়া-নেওয়ার। গাঁয়ে মিলিটারি ঢুকে মেয়েদের কখন ধরে নিয়ে যায়, এ নিয়ে চিন্তা করে করে তার বাবা-মায়ের যখন পাগল হওয়ার জোগাড়, সে তখন চুরিচামারি করে লুডুর গুটি পাকাতে ব্যস্ত। শুরুতে এই কাজে বাগড়া দিলেও মামাদের পাশের বাড়ির একটি ছেলে হঠাৎ তাকে সাহায্য করতে শুরু করে। খেলার পার্টনার হিসাবে ছেলেটা তার বিপক্ষে। তাহলেও সাপের ছোবল থেকে বাঁচিয়ে মইয়ের চূড়ায় রিনাকে সে কয়েকবার পৌঁছে দেয়। তাতে করে খেলা জমে না ঠিকই, প্রেম জমজমাট হয়। একটা চারকোনা কাগজের ওপর কয়েকটা ছোট-বড় সাপ। আর মই নিয়ে তারা যুদ্ধের ভেতর যুদ্ধকে বাদ দিয়ে এক ঝুঁকিপূর্ণ ভালোবাসায় মেতে ওঠে। সে এক তুলকালাম কাণ্ড। তাদের একবার সাপে খায়, তারপর মই বেয়ে তারা ঊর্ধ্বে উঠে যায়, সেখান থেকে পিছলে পড়ে নিচে, তার পরও থামে না, মইয়ের দিকে ছুটে যায়, যার চূড়ার পাশের ঘরেই এক মস্তবড় সাপ হাঁ করে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। এ ছাড়া সংখ্যাগুলো দ্রুত বাড়ে-কমে তাদের পতন ও উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু তারা প্রেমপ্রতিজ্ঞায় থাকে অবিচল। এমনকি বিষয়টা জানাজানি হয়ে যাওয়ার পরও।
ছেলেটা যুদ্ধের বাজার হিসাব করলে সুপাত্রই। তবে নিচু বংশের। বাপ-দাদারা কোত্থেকে এসেছে, কী বৃত্তান্ত-কারো জানা নেই। এ গাঁয়ে আবাস স্থাপনের পর রিনার মামার বড় আব্বার রায়ত ছিলেন তারা। রিনার বাবা-মা-মামার এ বিয়েতে তাই ঘোর আপত্তি। তারা সাপখোপ মইটইসহ লুডুর ঘর পুকুরে ফেলে দিয়ে মেয়েকে। ঘরবন্দি করেন। আশ্চর্য, যুদ্ধের দিনে ছেলেমেয়ে দুটি পালিয়ে যেত কোথায়! ভারতের শরণার্থী ক্যাম্প ছাড়া তো অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না। ঘরবন্দি হয়েও বিপদ কাটেনি। মাথায় কোরান শরিফ নিয়ে তওবা কাটার দিন রিনা যখন মইয়ের ওপর ভয়ে টলমল করছে, ছেলের বড় বোন তখন জানালা পথে শক্তপোক্ত মই আঁকা একটা কাগজ ছুঁয়ে তাকে কিরা কাটতে বলে। আর বলে যে, আসলে আগের তওবাটা সাপ ছিল। বোনের মারফত ছেলেটি তাকে সাপের ছোবল থেকে বাঁচানোর আর মইয়ের চূড়ায় পৌঁছে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করছে। রিনা কিরা কাটে আবার। একদিকে সাপ, আরেক দিকে মই। ভারত-পাকিস্তান তখন যুদ্ধ বেধে গেছে। মাত্র বারো দিনের মামলা। রিনার বাবা-মা জানালাপথে চিঠি আসার খবর ঠিকই জানতে পেয়েছিলেন মামাতো বোন পিচকির মারফত। তাতে শুধু মই আছে, কিছু লেখাজোখা নেই শুনে তারা নিশ্চিন্ত হন। কিন্তু সে নিজে কোনোক্রমে বিষয়টার ফয়সালা করতে পারছে না। তার পক্ষে যোগাযোগ করার উপায় নেই। কারণ ছেলেটা এখন কোথায়–তাও সে জানে না। সময় সময় মনে হয়, তাকে গাছে তুলে মইটা বুঝি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
সেই রাতে রিনাকে স্বপ্নে সাপে কাটে, মরিয়ম মই থেকে পড়ে যায়।
পরের রাতে ঠিক উল্টো। তৃতীয় রাতে প্রথম রাতের স্বপ্নটা ফিরে আসে। মরিয়মের ঘুমের ওষুধ ফুরিয়ে গেছে। এদিকে চাকরিবাকরির খবর নেই। রিনার পেটকাটা, হাতকাটা ব্লাউজ একেক দিন একেকটা গায় দিয়ে সে আবেদের অফিসে যায়। কিছুটা সময় মুখোমুখি চেয়ারে বসে যেসব কথা রিনাদের বাসায় গোপন রাখে, সেসব কথা সে আবেদকে শোনায়। হাতিরপুলের বাসায় সে শহিদ মুক্তিযোদ্ধার বোন, যে চাকরি খুঁজছে। এখানে সে বীরাঙ্গনা, চাকরি যার প্রাপ্য। আবেদকে তা দিতেই হবে, কারণ সে এখন তখতে বসে আছে। আবেদ প্রথম দিনের মতো প্রতিশ্রুতি দিয়ে রোজ তাকে বিদায় করে। পরদিন আবার পেটকাটা-হাতকাটা ব্লাউজ, রিনার যেসব বাইরে পরে যাওয়ার সুযোগ নেই, তা পরে মরিয়ম বেরোয়। আবেদের মুখোমুখি বসে। সামনের টেবিলের ওপর অদৃশ্য চৌকো কাগজে সাপ আর মই। তাতে তারা দুজনেই গুটি চালে। সেখানে সাপে কাটার বা মই বেয়ে উর্ধ্বে ওঠারলাভ-লোকসানের ঝুঁকি সমান সমান। তার মধ্যে একদিন মরিয়মের অসতর্কে চাল দেওয়া গুটি মেজর ইশতিয়াকের ঘরে পড়ে যায়। তাতে সর্বাঙ্গে সর্পদংশনের জ্বালা অনুভব করে আবেদ। সে এই বলে মরিয়মকে শাসায় যে, তার তেজ কোত্থেকে আসে এখন সে বুঝতে পারছে। মেরি আসলে দালাল, ভুয়া বীরাঙ্গনা। যুদ্ধের সময় মিলিটারির রক্ষিতা ছিল। আরেকবার চাকরি চাইতে এলে সে তাকে পুলিশে দেবে। কত মেয়ে-দালাল এখন সেন্ট্রাল জেলে পচে মরছে! মরিয়মও গুটি-ঘর সব উল্টে দিয়ে তাকে জানায়, মুক্তিযোদ্ধার আসল আর নকল বাজারে আছে। মানুষ সুযোগ পেলে পিটিয়ে মারে নকলদের। আবেদ যে আসল না, তা সে আগে থেকেই জানত, এখন জনে জনে তা রটিয়ে দেবে। মরিয়ম আর্মির রক্ষিতা হলে আবেদ কী। সেও তো অবাঙালি সওদাগর আর তার মেয়ের পয়সায় কেনা গোলাম।
সেই রাতে মরিয়মকে সাপে কাটে, মই থেকেও সে পড়ে যায়।
পরদিন অফিসে ঢোকার আগে বড় রাস্তার মুখে দারোয়ান মরিয়মের জন্য অপেক্ষা করে। নতুন পোশাকটার নিচে সে দরদরিয়ে ঘামছে আর সময় জানার জন্য হাতে ঘড়ি না থাকায় ঘন-ঘন আকাশের দিকে তাকাচ্ছে। আবেদ ভাতিজা হয়েছে তো কী, হঠাৎ বড়লোক, তাই পয়সার গরমি দেখায়। তা না হলে কেউ নিজের অফিসে পুলিশ ডেকে আনে একটা মেয়েকে ধরিয়ে দিতে! তারও তো ঘরে মা-বোন আছে। তাদের পুলিশ ধরলে কেমন লাগবে আবেদ মিয়ার? সব রক্তের দোষ। আবেদের বাপ-চাচারা মামলাবাজ ছিল। নিজের ভালো করতে না পারলেও অন্যের ক্ষতি করতে পিছপা হতো না। আবেদের আপন দাদা, দারোয়ানের আব্বার সব জমিজমা জাল দলিল করে দখলে নিয়ে নেয়। সেই কারণে আবেদ মিয়া আজকে স্যার, সে দারোয়ান। নিকুচি করি চাকরির। রাস্তায় দাঁড়িয়ে সে দারোয়ানের ইউনিফরম খুলে ফেলে। আর মামলাবাজের নাতির গোলামি নয়, সে একজন মুক্ত মানুষ। স্বাধীন দেশের নাগরিক।
রাস্তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে যে রিকশা থামায়, মরিয়ম প্রথম তাকে চিনতে পারে না। ভাবে, রিনার ভাষায় বদমাশদের একজন; পেটকাটা-হাতকাটা, নাভির নিচে শাড়ি পরা মেয়েদের বিরুদ্ধে জাগ্রত যুবসমাজের নামে বাজারে যারা লিফলেট ছেড়েছে, তাদেরই একজন হয়তো ল্যাঙ্গট পরে তার রিকশায় চড়াও হচ্ছে। কিন্তু লোকটা সেরকম নয়, ভদ্র আর বিনয়ী, হাতজোড় করে তাকে সামনে এগোতে বারণ করছে। কেন? আল্লাহর দোহাই, আবেদের দূরসম্পর্কের চাচা ল্যাঙ্গট পরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে মরিয়মকে বলে, আবেদ তার ভাতিজা হয়েছে তো কী। অফিসে পুলিশ। মরিয়ম একপাও যেন আর না এগোয়। খোদা সাক্ষী। তাকে সেন্ট্রাল জেলে পাঠানো হবে। আবেদ এখন অফিসের লনে বসিয়ে তাদের চা-নাশতা খাওয়াচ্ছে।
রিকশার চাকা আবার হাতিরপুলের বাসার দিকে ঘুরে যায়। বাসাসংলগ্ন মাঠে বক্তৃতার মঞ্চ বাঁধা হচ্ছে। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে হাতুড়ি-কাস্তে খচিত লাল ঝান্ডা আর দাবিদাওয়ার অসংখ্য প্ল্যাকার্ড। সর্বহারার মুক্তি আসন্ন। শুধু মজুরি বাড়ালে চলবে না, চাই সমাজতন্ত্র। শিল্প-কারখানার জাতীয়করণ ত্বরান্বিত করতে হবে।
দরজা খুলে দেন রিনার মা। মরিয়মের আজ তাড়াতাড়ি ঘরে ফেরাটা চাকরির ব্যাপারে তাকে আশান্বিত করে। এখন আর এ বাড়িতে যুদ্ধ নিয়ে, পাকিস্তানি আর্মির অত্যাচার নিয়ে কথা হয় না। বাজারদর, চুরি-ডাকাতি আলোচনার মূল বিষয়। মন্টুর প্রতি যতখানি সহানুভূতি তাদের ছিল, খবরের কাগজে মুক্তিবাহিনীর লুটতরাজ আর খুনখারাবির সংবাদ পড়ে তা-ও উবে গেছে। বেঁচে থাকলে সে তো ডাকাতই হতো। তবু ভালো, ছেলেটা শহিদ হয়ে কলঙ্কের দায় থেকে বাবা-মাকে মুক্তি দিয়ে গেছে। মরিয়মের গলায় তাদের তুলে দেওয়া ভাত আটকে যায়। টেবিলের চড়া দামে কেনা খাবারগুলো মনে হয় দূরের এক ভোজসভার। তাতে হক নেই ওর। রিনা অন্যমনস্ক। গাছ থেকে নামার জন্য তার একটা মই দরকার ছিল, সে তা পেয়েও গেছে।
চাকরির পরিবর্তে মরিয়মকে জেলে পাঠানোর ব্যবস্থা আবেদ যেদিন করে, সেদিনই রিনার নামে মই আঁকা একটি চিঠি আসে। মই আর সাপ। সাপ আর মই । দুর্ভাগ্য আর সৌভাগ্য একটা চৌকো ঘরে পাশাপাশি অবস্থান করে। ছেলেটি চিটাগাং থেকে ঢাকা বদলি হওয়ার যে তদবির করছিল, তা হয়ে গেছে। সে মুক্তিযুদ্ধ করেনি। তবে নয় মাস চাকরি না করায় এই তার পুরস্কার। রিনা খুশিতে অস্থির হয়ে হাফ ডজন পেটকাটা-হাতকাটা ব্লাউজ মরিয়মকে দুম করে দিয়ে দেয়। বলে যে, ছয়টার একটাও তাকে আর ফেরত দিতে হবে না। তবে তার প্রশ্ন–যুদ্ধের নয় মাস, মরিয়ম কী নিয়ে ব্যস্ত ছিল যে, তার সাপ-লুডো খেলা হলো না? তাহলে কি আজকে চাকরি চাকরি করে পথে পথে ঘুরতে হতো! ইশ, কী বোকা মেয়ে, রিনা মরিয়মকে তিরস্কার করে–সে কী করে জানে না যে, সাপ যেখানে, মেয়েদের সৌভাগ্যও সেখানে!
পরদিন মরিয়ম ব্যাগ গোছায়। চাকরির সম্ভাবনা নেই যখন, ঢাকা বসে থেকে কী হবে। খালাম্মা, খালুজানকে বলে, সে আপাতত ফুলতলি গ্রামে ফিরে যাচ্ছে। তারা খুশি হন। রিনা পেটকাটা-হাতকাটা ব্লাউজের সঙ্গে ম্যাচ করে বড় বড় সূর্যমুখী ছাপার রুবিয়া ভয়েলের শাড়ি তার নাভির নিচে পরিয়ে দেয়। হাতে তুলে দেয় লম্বা ডান্ডার একটা কালো ছাতা, যা জাগ্রত যুবসমাজের মাথায় ব্যবহারের জন্য রাস্তায় তার দরকার হতে পারে। যদিও লিফলেটটা দেখেছে শুধু মরিয়ম আর রিনা কিন্তু খালাম্মা-খালুজান একসঙ্গে হেসে ওঠেন। একটি সুখী-সমৃদ্ধিশীল পরিবারকে পেছনে ফেলে রাস্তায় নামে মরিয়ম। সে ফিরে যাচ্ছে ফুলতলি গায়ে নয়, নারী পুনর্বাসনকেন্দ্রে। সেখানে পৌঁছেই তার প্রথম কাজ হবে পরনের পোশাক ছেড়ে বিনা মূল্যের মিলের শাড়ি আর লম্বা হাতার ব্লাউজ ঝটপট পরে ফেলা।