পাটনার প্রাচীন চিত্র
খাঁ বাহাদুর খুদাবস বাঁকিপুরের সরকারী উকীল এবং তিনবৎসর হায়দ্রাবাদ রাজ্যে প্রধান জজ ছিলেন। তিনি নিজের সংগ্রহ ও পিতা হইতে প্রাপ্ত ছয় হাজার ফার্সী ও আরবি হস্তলিপি, প্রায় দুই সহস্র ইংরাজী গ্রন্থ, অনেক মুদ্রিত ফার্সী-আরবী বই এবং একটি সুন্দর বড় দোতলা দালান ও সংলগ্ন জমি সাধারণের নামে লিখিয়া দিয়া খুদা-বখ্শ পুস্তকালয় স্থাপন করেন। ভারতে মুসলমান গ্রন্থের এরূপ প্রকাণ্ড ও মূল্যবান্ আগার আর একটিও নাই। দিল্লীর বাদশা ও সম্ভ্রান্ত লোকদিগের জন্য লিখিত অতি সুন্দর সুন্দর হস্তলিপি, চিত্র ও হস্তাক্ষরের নমুনা, কয়েকজন বিখ্যাত পারসিক কবির স্বহস্তলিখিত গ্রন্থাবলী, মধ্য-এসিয়া আরব ও স্পেনে লিখিত মূল্যবান্ আরবী বই– এখানে একত্র করা হইয়াছে। কতকগুলিতে বাদশাহ জাহাঙ্গীর, শাহজাহান, কুমার দারাশুকো প্রভৃতির হাতের লেখা, অথবা মুসলমান রাজারাণীদের মোহর আছে। এই ভাণ্ডারের তিনখানি সচিত্র হস্তলিপি হইতে মুঘল-যুগে ভারত চিত্রবিদ্যার ক্রমবিকাশের ইতিহাস অতি স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়। প্রত্যেক-খানারই অঙ্কনের বৎসর ঠিক জানা আছে এবং তাহা হইতে মুঘল দরবারের চিত্রকরদের প্রণালী কোন্ সময় কিরূপ ছিল, তাহা নিঃসন্দেহে বলা যাইতে পারে; কোন্ প্রণালী আগে কোনটি পরে, অথবা কোনটি কোন বাদশাহের সময়ের তাহার সম্বন্ধে কল্পনার আশ্রয় লইতে হয় না। প্রথম, আলীমৰ্দ্দান খাঁ শাহজাহানের সঙ্গে প্রথম দেখা করিবার দিন (১৬৪০ খ্রিঃ) যে শাহনামা মহাকাব্য তাঁহাকে উপহার দেন, সেখানি। ইহাতে শুধু চীন চিত্রকরের আঁকা মধ্য-এসিয়ার ‘বুখারার’ প্রণালীর বিশুদ্ধ দৃষ্টান্ত। এই প্রণালী ভারতবর্ষে আসিয়া দিল্লীর রাজ সভায় হিন্দুচিত্রকরদের হাতে পড়িয়া হিন্দু ও সারাসেন কলার মিশ্রণে কিরূপ পরিবর্তিত হইল তাহার প্রথম অবস্থা তারিখ-ই-খানদান্-তাইমুরিয়া নামক গ্রন্থের ছবিতে অতি পরিষ্কার দেখিতে পাওয়া যায়। এখানি আকবরের সভায় আঁকা; তাইমুর হইতে আকবরের রাজত্বের ২২ বৎসর পর্যন্ত মুঘল-ইতিহাস সম্বলিত। প্রতি চিত্রের নীচে তাহার পরিকল্পনাকারী ও সমাপ্তকারী চিত্রীদ্বয়ের নাম। ইহাদের অনেকেই হিন্দু এবং প্রায় সকলেরই নাম আইন-ই-আকবরীর ১ম খণ্ডের পশ্চাতে আকবরের চিত্রকরদের নামের তালিকার মধ্যে পাওয়া যায়। ইহাতে আকবরের যে কয়েকখানি প্রতিকৃতি আছে তাহা সমসাময়িক এবং সৰ্ব্বাপেক্ষা বিশ্বাসযোগ্য। দর্শকেরা দেখিবেন যে, এইসব ভারতীয় চিত্রকর জল ও পর্ব্বত আঁকার চীনে প্রথা চুরি করিয়া অতি অল্প বদলাইয়াছে, কিন্তু মুখগুলি ভারতীয়, ঐ শাহনামার মতো গালফুলা শ্মশ্রুবিহীন চীনামুখ নহে। বর্ণ ও অলঙ্কারের গৌরবে এই আকবরী যুগের চিত্রগুলি অমূল্য। তৃতীয় গ্রন্থ, শাহজাহানের সময়ে রচিত তাঁহার ইতিহাস, নাম পাদিশাহনামা। এখানিতে ভারতীয় চিত্রপ্রণালী সূক্ষ্ম অলঙ্কারের ছটা, রঙ্গের বৈচিত্র এবং খুঁটিনাটির প্রতি দৃষ্টি, এবং অবয়বের কোমলতায় চরম সীমায় পৌঁছিয়াছে; আকবরী যুগের সেই অর্দ্ধ-কর্কশ সতেজ ভাব নাই, কিন্তু এখনও অবনতি আরম্ভ হয় নাই।
সেই অবনতির দৃষ্টান্ত ১৬৭৬-১৭৫০ খ্রিস্টাব্দের নানা সময়ে অঙ্কিত একখানা ছবি সংগ্রহে (“মুরাক্কা”তে) স্পষ্ট দেখিতে পাওয়া যায়। তাহার পর, অর্থাৎ অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্দ্ধ বিংশ বৎসরে লক্ষ্মৌ-এর জঘন্য চিত্রকলার উৎপত্তি; তাহার উপর ইউরোপীয় চিত্রের প্রভাব পড়িয়াছে, অথচ ইউরোপীয় ভাল ছবির মত প্রকৃতির অনুসরণ, রঙ্গে পরিপক্কতা এবং উচ্চ আধ্যাত্মিক আদর্শ নাই, কিন্তু মুঘলযুগের গুণগুলিও সব হারাইয়াছে। রণজিৎ সিংহের জন্য অঙ্কিত চিত্রগুলিরও সেই দুর্দ্দশা, যেন ছেলেদের চোখ ভুলাইবার জন্য আঁকা, চিন্তাশীল বা পণ্ডিত লোকের জন্য নহে। অনেক ভিন্ন ভিন্ন ছবি, অতি আশ্চৰ্য্য কঠিন বা সুন্দর ফার্সী হস্তাক্ষরের নমুনা, বাদশাহ ও যুবরাজদের স্বাক্ষর প্রভৃতি এখানে দেখিতে পাওয়া যায়। তিনশত বৎসর পূর্ব্বে পারস্যে, তুর্কীতে ও মধ্য-এসিয়ায় অঙ্কিত কয়েকখানি ছবিও আছে। হস্তলিপিগুলির মধ্যে আরবী-ফার্সী পাঠকদের উপাদেয় অমূল্য ৪/৫ খানি গ্রন্থ আছে। সার ওয়াল্টার স্কট ওয়েভার্লি নবেলগুলির যে প্রথম সংস্করণ বেনামী প্রকাশ করেন তাহা দেখিয়া ইংরাজ পাঠক সুখী হইবেন। ভারত-সম্বন্ধে পুরাতন সচিত্র ইংরাজী অনেক মূল্যবান বই এখানে আছে। ফলতঃ সব ইংরাজী বইগুলির মূল্য লক্ষ টাকার উপর হইবে; ফার্সী আরবী হস্তলিপির মূল্য ৪/৫ লক্ষের কম নহে। পুস্তকাগারের বাড়ীটিও দেখিয়া চক্ষু জুড়ায়; নির্ম্মাণ-ব্যয় অর্দ্ধলক্ষের উপর। দক্ষিণের পাঠাগারটি সরকারী খরচে তৈয়ারী হয়। মধ্যে খুদাবখ্ চিরনিদ্রায় শায়িত। ইনিই ভারতীয় বড়লী।
স্থানীয় আম্মানী ব্যারিষ্টার মানুক সাহেব অনেক সহস্র টাকা ব্যয় করিয়া প্রায় ১৫/১৬ বৎসর ধরিয়া ভারতীয় প্রাচীন চিত্র সংগ্রহ করিতেছেন। তাঁহার বাড়ীতে যে নিজস্ব চিত্রশালা আছে তাহা দেখিলে ভারতীয় কলাসম্বন্ধে অনেক স্থির সত্য জানা যায়, এবং এসিয়ার ভিন্ন ভিন্ন দেশের (জাপান, চীন, তিব্বত, পারস্য, নেপাল ও মধ্য-এসিয়ার) দৃষ্টান্তের সহিত ভারতীয় চিত্রের তুলনা করিবার সুবিধা হয়। তাঁহার বাড়ীতে আকবরী-যুগের কয়েকখানি, শাহজাহানী যুগের অনেক, এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর শত শত ছবি আছে। মুঘল-রাজসভায় শিক্ষিত হিন্দুচিত্রকরগণ হিন্দু বিষয় লইয়া কিরূপ প্রণালীতে ছবি আঁকিতেন (যাহাকে কুমারস্বামী “রাজপুত-আর্ট” বলেন) তাহার এত বেশী ও এত সুন্দর দৃষ্টান্ত আর কোথাও নাই। কতকগুলি কৃষ্ণ-চরিত্রের ও যোগীদের বিষয়ে চিত্র দেখিয়া আর চোখ ফিরাইতে ইচ্ছা করে না; সেগুলি এমন গভীর ভাবাত্মক এবং এত সুন্দর ও সূক্ষ্মভাবে আঁকা যে, ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠ চিত্রের নিকট পরাস্ত হইবে না। একখানি চিত্রে রাম লঙ্কা জয় করিয়া ঠিক মুঘল-বাদশাহের মত পোষাক পরিয়া রথ, গজ, অশ্ব ও কামান লইয়া (!) কুচ করিতেছেন; আর একখানিতে বৃন্দাবনের গোপেরা মুঘল মসব্দারের মত জামা-পাগড়ী পড়িয়া ঢাল তরবার লইয়া কৃষ্ণের সঙ্গে ভেট করিতে যাইতেছেন! একখানি মুর্শীদাবাদের গজদন্তে খোদা কৃষ্ণলীলা ঠিক বরাহৎ স্তূপের পাথরের অল্প উঁচু ছবি (Relief)র মত; একই অঙ্কন-পদ্ধতি! কিছু আধুনিক ১৪ খানি ছবিতে দূতী-সম্বাদ হইতে রাধাকৃষ্ণের মিলন পর্যন্ত দৃশ্যগুলি পরে পরে অতি সুন্দরভাবে চিত্রিত হইয়াছে। দুইখানি ছবি,- তান্ত্রিক যোগিনী এবং যমুনার পরপারে কৃষ্ণ বসিয়া, আছে গাভী ও মহিষ আসিতেছে, চিত্র-হিসাবে অমূল্য; অথচ আধুনিক “ইণ্ডিয়ান আর্টের” দোষ একটিও নাই। এ দুটি সর্ব্বোচ্চ কোন প্রতিভার পরিকল্পিত।
[প্রবাসী, ভাগ ১৬, খণ্ড ২, সংখ্যা ৪, মাঘ, ১৩২৩।]