নিষেধের বেড়া
নিষেধ কেন! শুদ্ধ সুন্দর থাকার জন্যই তো! এ ব্যাপারটির সঙ্গে সম্পর্কে আমার জন্মের মত চুকেছে। আর তবে কি কারণে আমার ওপর আদেশ নিষেধ! কিসের জন্য আমি বাবা মার আদেশ নিষেধ পালন করতে যাব। ওঁদের তো আর ভয়ের কিছু নেই। যে কারণে ভয় তার চেয়ে অনেক বড় কিছু ঘটে গেছে আমার জীবনে। আমার জন্য আর সতর্কে থাকার কিছু নেই। নিষেধ আরোপ করেই বা লাভ কি!নিষেধের বেড়া আমি পার হই। বেড়া ডিঙিয়ে ঘাস না খাই, বেড়া ডিঙিয়ে রুদ্রকে অবকাশে নিয়ে যাই। সবাই দেখুক কাকে আমি ভালবাসি, সবাই জানুক যখন জানতেই হবে একদিন, যখন ডাক্তারি পাশ করে তার কাছে যেতেই হবে সারাজীবনের জন্য! রুদ্রর সঙ্গে কারও পরিচয় করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যেও রুদ্রকে নিয়ে যাওয়া নয় বাড়িতে। অবকাশে হরদম আমার ক্লাসের বন্ধুরা আসছে। কেবল বন্ধুরাই নয়, বড় ক্লাসের ভাইরা জ্ঞান দিতে আসেন, ছোট ক্লাসের ভাইরা জ্ঞান নিতে আসে। কারও জন্য বাধা নয় আর অবকাশ, বাবা হয়ত অনেককে দেখে আড়ালে দাঁতে দাঁত ঘঁত্রে, কিন্তু সামনে কখনও নয়, তিনি নিস্পৃহতা দেখান, দেখিয়েছেন কিন্তু কাউকে তাড়িয়ে দিতে পারেননি, কাউকে মুখের ওপর বলতে পারেননি চলে যাও, ছাত্র শিক্ষক সম্পর্কটিই বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃতিত্ব আমারও আছে, আমিই সেই মেডিকেলের প্রথম বর্ষ থেকে একটু একটু করে এ বাড়িতে চোখ সওয়া করেছি ছেলেপিলেদের উপস্থিতির, কেবল রুদ্রর জন্যই অলিখিত নিষেধাজ্ঞা ছিল, রুদ্রর জন্যই ভয় ছিল আমার, এই ভয়টি আমার হঠাৎ করেই উবে গেছে, তাই নিষেধাজ্ঞাটি ডিঙোতে আমার বুক ধুকপুক করে না। ইয়াসমিন বাড়িতে ছিল। মাও ছিলেন। কিন্তু রুদ্রর সামনে কারও যাওয়া হয়নি। তার চা খাওয়া হয়নি। চা খেতে খেতে বাড়িতে আসা আর ছেলেরা যেমন গল্প করে আমার সঙ্গে, তেমন করা হয়নি। কারণ বাবা এসেছেন। এই দুপুরবেলার সাড়ে বারোটায় চরম অসময়ে বাবার বাড়ি আসার কোনও কারণ নেই তবওু এসেছেন তিনি। আমরা দুজন তখন কেবল বাড়িতে ঢুকেছি। বাইরের দরজা তখনো হাট করে খোলা। রুদ্র কেবল সোফায় বসেছে। আমি কেবল বৈঠকঘর পার হয়ে ভেতর বারান্দায় দাঁড়িয়ে চাএর কথা বলতে যাবো লিলিকে বা নার্গিসকে বা সুফিকে বা মাকে, তখন কালো ফটক খোলার শব্দ শুনে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখি বাবা হেঁটে আসছেন মাঠ পেরিয়ে সিঁড়ি পেরিয়ে বারান্দাঘর পেরিয়ে বৈঠকঘরের দিকে। রুদ্রকে দেখলেন তিনি,বিস্ফারিত দু চোখ রুদ্রর দিকে ফেলে, তর্জনি কালো ফটকের দিকে তুলে, সারা বাড়ি কাঁপিয়ে তিনি বললেন, গেট আউট। বাবার চিৎকারে রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন মা, শোবার ঘর থেকে ইয়াসমিন। রুদ্র কালো ফটকের বাইরে অদৃশ্য হতেই আমি সকলকে হতবাক করে দিয়ে ফটকের দিকে হেঁটে যাই। পেছনে বাবার রক্ত চোখ, পেছনে তর্জনি, পেছনে মার আর্তচিৎকার নাসরিন যাইস না, ফিইরা আয়, পেছনে ইয়াসমিনের বুবু বুবু বলে আমাকে ফেরাতে চাওয়া।
পিচ গলছে রাস্তায়। গোলপুকুর পাড়ের দিকে হাঁটতে থাকা রুদ্রর কাছে পৌঁছোই আমি, রুদ্র ফুঁসছে রাগে। আমি যে নিষেধের এই বেড়া ডিঙিয়ে তার কাছে চলে এলাম, আমি যে একদিকে বাবা মা বোন আরেক দিকে রুদ্র এ দুজনের মধ্যে রুদ্রকে বেছে নিলাম, এ যে কত বড় একটি পদক্ষেপ আমার, এ সম্ভবত তার পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়নি। আমি যে সবল অস্বীকার করলাম তাঁকে যাকে আমি সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করি, যিনি আমার জীবনটি গড়ে তুলতে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করছেন, তাঁরই আদেশ জীবনে এই প্রথম আমি অমান্য করার সাহস করেছি, তাঁরই রক্তচক্ষুকে জীবনে এই প্রথম আমি পরোয়া করিনি, তাঁরই অহঙ্কার আমি চুড়ো থেকে এক ধাক্কায় ফেলে দিয়েছি মাটিতে, তাঁরই সম্মান আমি আজ ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছি, তাঁরই স্বপ্ন আমি আজ ভেঙে টুকরো করেছি, বোঝা সম্ভব নয় বলেই রুদ্র বলে, আমাকে অপমান করতে বাড়িতে নিয়েছিলে তুমি! না অপমান করতে নয়। আমি তো জানতাম না বাবা অমন হঠাৎ বাড়ি আসবেন! তুমিই তো চাইতে অবকাশে যেতে, বাবার সঙ্গে দেখা করতে! চাইতে তো! চাইতে না! গোলপুকুর পাড়ের আগুনে রাস্তা থেকে একটি রিক্সা নিয়ে সোজা বাসস্ট্যান্ডের দিকে দুজন। কোনও প্রস্তুতি নেই আমার ঢাকা যাওয়ার কিন্তু বাসে চড়ি। বাড়ি থেকে অনুমতি তো নেওয়া হয়ইনি, এমন কি কাউকে না জানিয়ে, যে, আমি ঢাকা যাচ্ছি, আমি বাসে চড়ি। সকলে ভাববে কোথায় আমি, আমি কেন বাড়ি ফিরছি না, বিকেল হবে রাত হবে দুশ্চিন্তা বাড়বে তা জেনেও আমি বাসে চড়ি। বাস যেতে থাকে ঢাকার দিকে। আগুনে বাতাস আগুনে ধুলো উড়িয়ে চোখে মুখে ছিটোতে থাকে। আমি শীতল চোখে চেয়ে থাকি ওড়াওড়ি ধুলোর দিকে, শীতল চোখে চেয়ে থাকি রাস্তার কাক কুকুর আর মানুষের ছোটাছুটির দিকে। আমি শীতল চোখে চেয়ে থাকি গরুগাড়ি, মটর গাড়ি, রিক্সা,বাস, ট্রাকের দিকে। আমি শীতল চোখে চেয়ে থাকি ফসল উঠে যাওয়া নিঃস্ব খেতের দিকে, চেয়ে থাকি নিজের দিকে।
বাসের সবচেয়ে পেছনের আসনে বসা রুদ্রর বাঁ পাশে একটি লোক রাজনীতি নিয়ে কথা বলছে তার পাশের লোকের সঙ্গে। রুদ্র সেই রাজনীতিতে একটু একটু করে ঢুকে যায়। এরশাদ সরকারের পতন যে হবেই হবে, এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত, পাশের লোকগুলোও নিশ্চিত। রাজনীতি থেকে আলোচনা গড়িয়ে বাজার দরে নামে। চাল ডাল তেল নুন থেকে শুরু করে মাছ মাংসের দামে, এবং কি হারে কি গতিতে সব সাধারণের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে এসব নিয়ে ক্ষোভ হতাশা ইত্যাদিও শেষ হয়। এরপর আলোচনায় মানুষের চরিত্র। অসততা এবং সততা। এ নিয়েও কিছুক্ষণ। রুদ্রর মতের সঙ্গে পাশের লোকটির মত প্রায় একশভাগ মিলছে বলে লোকটি বারবারই প্রসন্ন চোখে রুদ্রকে দেখছিল। এবার যে সব প্রশ্ন বাসে ট্রেনে করা স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হয়, সেই প্রশ্নগুলিই রুদ্রকে করা হয়। তা আপনের বাড়ি কই ভাই?
বাড়ি খুলনায়।
থাকেন কি ময়মনসিংহে।
না। ঢাকায় থাকি।
ও। তা উনি কি হয় আপনার?
আমার স্ত্রী।
আপনার শ্বশুরবাড়ি বুঝি ময়মনসিংহে।
হ্যাঁ।
তা ভাই কি করেন আপনে? মানে চাকরি বাকরি ..
লিখি।
মানে?
আমি লিখি।
লেখেন?
হ্যাঁ লিখি।
কী লেখেন?
কবিতা লিখি।
কবিতা লেখেন? লোকটি ফ্যাক ফ্যাক করে হাসে। কৌতূহলে লোকটির চোখ একবার ছোট হচ্ছে, বিস্ময়ে হচ্ছে বড়। ছোট বড় চোখ স্থির হয়ে আছে রুদ্রর চোখে, রুদ্রর শান্ত চোখে, শ্যাওলা পড়া চোখে।
লোকটি এবার চোখে চোখ রেখেই, শব্দগুলোকে বিচ্ছিত করে,ধীরে, কিন্তু যথাসম্ভব গলার এবং মনের জোর খাটিয়ে,যেন একটি শব্দও আবার কোনও ফাঁক ফোকর দিয়ে বেরিয়ে না যায়, বলে তা তো বুঝলাম কবিতা লেখেন, আমার ছেলেও কবিতা লেখে, কিন্তু আপনার পেশা কি?
আমার পেশা কবিতা লেখা। রুদ্র অত্যন্ত শান্ত কণ্ঠে জবাব দেয়।
এরকম উত্তর লোকটি সম্ভবত প্রথম শুনেছে। এরপর আর কোনও কথা বাড়ায়নি, বাসের জানালায় চোখ রেখে বাকি পথ পার করে।
রুদ্র আমাকে আগেও বলেছে, সে কোথাও চাকরি বাকরি করতে চায় না। চায় লেখাকেই পেশা হিসেবে নিতে। কেন এ দেশে লেখকেরা লেখাকে একমাত্র পেশা হিসেবে নেয় না তা তার আজও বোধগম্য নয়।
নেয় না কারণ টাকা পাওয়া যায় না ভাল। একটা কবিতার জন্য বল তুমি কত পাও? কুড়ি টাকা পঁচিশ টাকা, বড়জোর পঞ্চাশ টাকা, এই তো! এই টাকায় কি থাকা খাওয়া চলবে?
লেখকের সম্মানী বাড়াতে হবে।
বাড়াবে কে?
পত্রিকার লোকেরা।
তারা না বাড়ালে কি করবে?
আন্দোলন করব। লেখা দেব না।
লেখা না দিলে, যারা বিনে পয়সায় বা কম পয়সায় লেখা দেবে, তাদের লেখা নেবে ওরা।
বিনে পয়সায় কেউই দেবে না লেখা।
লিখি তো আমিও, লিখে টাকা রোজগারের কথা কখনও ভাবিনি। কবিতার সঙ্গে কোনও কিছুর বিনিময়, ভাবলে লজ্জা হয় আমার। তুমি আমাকে কবিতা দাও, আমি তোমাকে ভালবাসা দেব। এ চলে। কিন্তু টাকা দাও তাহলে কবিতা লিখব, কবিতা কি বেচা কেনার জিনিস! ওরকম হলে কবিতাকে আমার পেঁয়াজ রসুনের মত মনে হতে থাকে। টাকা জিনিসটি আমার হাতের ফাঁক গলে সবসময়ই বেরিয়ে যায়, কবিতাকে টাকার হাতে সঁপে দিলে ওই হবে, বেরিয়ে যাবে।
রুদ্রকে শত বলে প্রেমিক বানাতে না পারলেও এমএ পরীক্ষাটি দেওয়াতে পেরেছি। পরীক্ষায় তাকে বসতেই দেওয়া হচ্ছিল না, শেষ পর্যন্ত ভিসিকে মহা অনুরোধ উপরোধে নরম করিয়ে পরীক্ষা দিতে সে পেরেছে। এমএ পাশ করে এ দেশে কিছু হওয়ার বা কিছু করার জো নেই জেনেও বলেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছো যখন বেরোও, যে কোনও কোথাও ঢুকে পড়লে যেমন বেরোতে হয়, তেমন। পেছনের জানালা বা ঘুলঘুলি দিয়ে বেরোলে ঠিক ভাল দেখায় না, বেরোলে সদর দরজা দিয়েই বেরোও। বেরিয়েছে বটে কিন্তু লেখাকে পেশা করার স্বপ্ন তার যায়নি।
মহাখালিতে বাস থামলে রিক্সায় মুহম্মদপুর যাই। শেষ বিকেলে বেরোই বাইরে। টিএসসি চত্বরে দাঁড়িয়ে রুদ্র বন্ধু খুঁজতে থাকে আড্ডা দেওয়ার। সন্ধের অন্ধকারে মাঠে দাঁড়িয়ে চা খেতে খেতে বন্ধুদের দেখা মেলে। লেখক বন্ধু কবি বন্ধু সাংবাদিক বন্ধু নাটক করা বন্ধু রাজনীতি করা বন্ধু গান গাওয়া বন্ধ কিছু না করা বন্ধু। কারও না কারও দেখা মেলেই। রুদ্র বউ বলেই আমার পরিচয় দেয় এখন, আমি আপত্তি করি না। এক বাড়িতে থাকছি, বাবার তর্জনি উপেক্ষা করেছি, আর কিসের সঙ্কোচ! আড্ডা শেষে বাড়ি ফেরার পথে দুটো থালা, চারটে চায়ের কাপ, দুটো পানির গেলাস, দুটো ছোট পাতিল চাল ডাল তেল ডিম নুন চাপাতা চিনি ইত্যাদি কিনে বাড়ি ফিরি। সংসারের প্রথম কেনাকাটা, রুদ্র হেসে বলে। রেস্তোরাঁয় খেতে তার আর ভাল লাগে না, এখন থেকে ঘরে রান্না হবে, ঘরে খাবে। কিন্তু রান্নাটি করবে কে! আমি তো কখনও রান্না করিনি, না করলেও এটি আমাকেই করতে হবে। এখন থেকে সংসারি হবে সে। আর বাহির নয়, আর টইটই নয়, আর এলোমেলো জীবন নয়। আমি যে রান্না করতে জানি না, আমাকে যে কাল সকালেই চলে যেতে হবে ময়মনসিংহে, ক্লাস আছে, খুব জরুরি ক্লাস, পরীক্ষা আছে, খুব কঠিন পরীক্ষা, বলা হয় না। সংসার উদ্বোধন করতে গিয়ে ভাত রাঁধতে গিয়ে ভাত হয় না সেদ্ধ, বাড়িঅলার কাছ থেকে মশলা ধার করে ডাল চুলোয় দেওয়া হয় বটে, তবে ডাল না হয়ে জিনিসটি অন্য কিছু হয়। শেষ পর্যন্ত ডিম ভেজে মখু রক্ষা করি। ওই খেয়ে উৎফুল্ল রুদ্র রাতে আমাকে স্পর্শ করে। রুদ্র স্পর্শ করলে আমার সারা শরীর অবশ-মত হয়ে যায়। শরীরে রোধ নিরোধ মনে জোর যুক্তি যা কিছু আছে, নষ্ট হয়ে যায়। আমি জলের মত রুদ্র-পাত্রে গড়িয়ে যাই। এ কি ভালবাসা নাকি সংস্কার, নিজেকে প্রশ্ন করি।যেহেতু একটু একটু করে লোকে জানতে পারছে যে আমাদের বিয়ে হয়েছে, কাগজপত্রে নয়ত মনে, যেহেতু একবার বিয়ে হলে আর ফেরার উপায় থাকে না, যেহেতু লোকে বলে স্বামীর সঙ্গে যে করে হোক মানিয়ে নিয়ে বাকি জীবন পার করা, আর দশটা মেয়ে যেমন করে, ভাল, তাই কি!তাই কি আমি রুদ্র থেকে সরে আসতে পারছি না, সরবো ভেবেও? নাকি খুব সরল এবং সোজা একটি কারণ,যে,আমি তাকে ভালবাসি। সংস্কার কি আমি খুব একটা মানি? মানলে হাবিবুল্লাহর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হত না,যেহেতু মেয়েদের ছেলেবন্ধু থাকাটা সংষ্কারের বাইরে। মানলে রুদ্রর সঙ্গেই কোনও সম্পর্কে দাঁড়ায় না, যেহেতু রুদ্র ডাক্তারও নয়, ইঞ্জিনিয়ারও নয়, একজন ডাক্তার-মেয়ের স্বামী সাধারণত যা হয়ে থাকে, এবং যা হওয়া স্বাভাবিক বলে সকলে, সকলে বলতে আমার আত্মীয়, প্রতিবেশি, চেনা অচেনা মানুষেরা মনে করেন। আমি তো সেই সংস্কারের পরোয়া না করে রুদ্রর মত চালচুলোহীন ছেলেকে বলেছি ভালবাসি। স−ম্ভাগে তৃপ্ত তুষ্ট রুদ্রকে দেখে ভাবি রুদ্র কি সত্যিই আমাকে ভালবাসে? ভালবাসলে অন্য নারীর শরীর কি করে ছোঁয় সে? আমি তো পারি না। এই যে হাবিবুল্লাহ প্রেমার্ত চোখে তাকিয়ে থাকে নির্নিমেষ, আমার তো ইচ্ছে হয় না ওকে খানিকটা ছুঁয়ে দেখতে। হাবিবুল্লাহর মত সুদর্শন পুরুষ চোখের সামনে ন্যাংটো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও আমি তো এতটুকু তৃষ্ণাতর্ হব না। শরীর তো মন থেকে খুব দূরে থাকে না। এই ভাবনাগুলি একান্ত আমার, দূরে সরাতে চাইলেও ভাবনা আমাকে ছেড়ে এক পাও দূরে যায় না।
ময়মনসিংহে ফিরে আসি। মা জিজ্ঞেস করেন, কই ছিলি? আমি কোনও উত্তর দিই না।
আমি কোথায় যাই, বা না যাই, কোথায় থাকি না থাকি, তা কারও জানার দরকার নেই। বলে দিই। স্পষ্টই বলে দিই।
বাড়ি থেইকা বাইর হইয়া যা না। যেই বেডার সাথে রাইত কাডাইছস, তার কাছেই যা।
সময় হইলেই যাইয়াম। কারো কইয়া দিতে হইব না।
মা গাল দিয়ে হলেও কথা বলেছেন, বাবা কথা বলেন না। আমার ছায়াও মাড়ান না। কলেজে যাওয়ার রিক্সাভাড়াও দেন না। সাত দিন পার হয়ে যায়, বাবার হাত থেকে টাকা খসছে না। আমি যে একটি প্রাণী বাড়িতে আছি, বাবা যেন তা জানেন না, জানলেও ভুলে গেছেন। সাতদিন পর সকালবেলা মা মিনমিন করে বাবাকে বলেন, ও কি কলেজ বন্ধ কইরা বইসা থাকব নাকি। রিক্সাভাড়া দিয়া যান।
মার দিকে একটি খেয়ে ফেলা দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে রুখে ওঠেন, ওরে বাসাত থেইকা বাইর হইয়া যাইতে কও। আমার বাসায় থাকার ওর কোনও অধিকার নাই। বাবা আমার উদ্দেশে ছুঁড়ে দিতে থাকেন এক একটি বিষমাখা তীর, আমার বাসায় থাকতে তাকে কেডা কইছে? ওই বেডা কেডা? কোথাকার বেডা? বেডা কি করে? কত বড় সাহস এই ছেড়ির ওই বেডারে বাসায় আনে। কত বড় সাহস আমার সামনে দিয়া বেডার সাথে বাইরে যায়! ও আমার বাসায় কি করে? লাত্থি দিয়া বাসা থেইকা বার করব, না কি ও এমনে যাইব?
বাবা চলে গেলে মা বলেন আমাকে, বুঝ,মজা বুঝ। নিজের জীবনডার কত সর্বনাশ করছস। তর বাপে তরে আর লেহাপড়ার খরচ দিব না। মেডিকেলে পড়া তো বন্ধ হইব। বাপের খুব স্বপ্ন আছিল একটা মেয়ে ডাক্তার হইতাছে। সব গেছে।
সব গেছের বিলাপ শুনি বসে।
রাতে আমার পাশে বসে মা নরম স্বরে বলেন, যেই লোকটার সাথে গেছিলি, তার নাম কি? তার নাম কি রুদ্র? রুদ্রকে কি তুই বিয়া করছস?
আমি মার সামনে থেকে উঠে চলে যাই কথা না বলে। মা আমার পেছন পেছন হাঁটেন আর বলেন, বিয়া না করলে ক যে বিয়া করস নাই। কই তর বাপেরে। তর বাপ হয়ত নরম হইতেও পারে।
দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকে বাড়ির পরিবেশে। আমার দিকে সকলের চোখ। ঘৃণার চোখ!চোখ সংশয়ের, অবিশ্বাসের। আমি যেন আর আগের আমি নই, আমি অপ্রকৃতিস,্থ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে বাড়িতে বসে আছি। ইচ্ছে করে বেরিয়ে পড়ি বাড়িটি থেকে। যেদিকে দুচোখ যায়, যাই। অনিশ্চয়তা আমাকে ছোবলে ছোবলে নীল করছে। এ সময় আপাতত সমস্যার একটি সমাধান করেন মা। মা নিজে গিয়ে নতুন বাজার থেকে ডাবঅলা ধরে আনেন। রশিদকে পাননি, অন্য লোক। নিজের দুটো গাছের কটি ডাব বিক্রি করে আমাকে টাকা দিলেন কলেজে যাওয়ার। দিলেন কিন্তু বললেন বাবার কাছে যেন আমার অন্যায়ের জন্য ক্ষমা চেয়ে, এমন অন্যায় জীবনে আর কখনও করব না প্রতিজ্ঞা করে, নিয়মিত কলেজে হাসপাতালে যাওয়ার খরচ নিই। না আমি তা করি না। রুদ্রকে চিঠি লিখি বাড়ির অবস্থা জানিয়ে। এও লিখি সে যেন আমাকে কিছু টাকা পাঠায়। রুদ্র চিঠি পেয়ে মানিঅর্ডার করে টাকা পাঠায়। এক হাজার টাকা। এই টাকা আমার সকল দুর্ভাবনাকে আমার চৌহদ্দি থেকে দূর দূর করে দূর করে। কেবল কলেজে যাওয়া আসাতেই যে টাকা খরচ হতে থাকে তা নয়। বিকেল হলে ইয়াসমিনকে নিয়ে রিক্সায় হুড ফেলে দিয়ে অর্থাৎ বাধ্যতামূলক ঘোমটাটি খসিয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকি শহরময়। অদ্ভুত এক আনন্দ এই ঘুরে বেড়ানোয়। যেন দুটি মুক্ত পাখি, যেন বাধঁ ন ছিঁড়ে বেরিয়েছি এইমাত্র। মালাইকারি খেতে ইচ্ছে হচ্ছে, শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে নেমে খেয়ে নিই দুটো মালাইকারি, দইয়ের ওপর ভেসে থাকা রসগোল্লাও। বাবা বাড়িতে বিস্কুট পাঠাচ্ছেন না অনেকদিন, বিস্কুটের দোকানে গিয়ে এক পাউন্ড বিস্কুট কিনে নিই। মা পীরবাড়ি যাবেন, রিক্সা ভাড়া নেই, উদার হস্ত দিয়ে দেয় পাঁচ টাকা। বাড়িতে ডাল ভাত ছাড়া কিছু নেই, ইয়াসমিনকে নিয়ে গাঙ্গিনার পাড়ের রেস্তোরাঁয় গিয়ে মাংস ভাত খেয়ে আসি, কখনও আবার নতুন চিনে রেস্তোরাঁয়।
বাবা লক্ষ করেন আমি কলেজে যাচ্ছি, কিন্তু তার কাছে হাত পাতছি না। লক্ষ করেন, বাড়িতে ডাল ভাত ছাড়া অন্য কিছুর ব্যবস্থা না করার পরও কোনও বাজারের লিস্টি কেউ পাঠাচ্ছে না তাঁর কাছে, এসব তাঁর দম্ভে বিঘ্ন ঘটায়। মাকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন, ওই ছেড়ি কলেজে যে যায় রিক্সাভাড়া কই পায়? তুমি দেও?
আমি দিয়াম কোত্থেকা? আমার হাতে কোনও টাকা পয়সা দেইন নাকি?
তাইলে পাইছে কই?
কি জানি!
কি জানি মানে? তোমার জানতে হইব না?
জাইনা কি হইব? টাকা পয়সা দেওয়া বন্ধ কইরা দিছেন। তার তো যোগাড় করতে হইব! যোগাড় করছে।
কিভাবে যোগাড় করছে? কার কাছ থেইকা।
সেইডা তারে গিয়া জিগান। কথা বন্ধ করছেন কেন? কথা বন্ধ করলে কি সব সমস্যার সমাধান হইয়া যায়?
আমার বাড়ি থেইকা যে চইলা যাইতে কইছি, যায় না কেন?
কই যাইব?
যেই বেডার কাছ থেইকা টাকা নিছে তার কাছে যাক গা।
গেলে খুশি হইন নাকি? এহন তো নোমান কামালরে আর টাকা পয়সা দিতে হয় না। আমারে ত কিছুই দেইন-ই না। দুইডা মেয়েরে যা দিতাছিলেন, তাও সহ্য হইতাছে না আপনের। আপনের টাকা পয়সা একলা আপনেই ভোগ করতে চান, ভোগ করেন। মেয়েরা ত আইজ না হইলেও কাইল যাইবই এই বাড়ি ছাইড়া। এহনই ভাগাইতে চান কেন? বাড়ি খালি করতে চাইলে কন, আমরা সবাই যাই গা। একলা থাকেন।
বাবা কোনও উত্তর দেন না। শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকেন উঠোনের দিকে। বাবা যে ইয়াসমিনকে ডেকে নিয়ে বলবেন, তুমিই এখন আমার স্বপ্ন। তুমি এখন আমার মান রাখো। সে সম্ভাবনাটিও নেই। ইয়াসমিন, বৃত্তিধারী ছাত্রী, মেট্রিকে প্রথম বিভাগ পাওয়া, রসায়নে তারকাখচিত নম্বর পাওয়া, ইন্টারমিডিয়েটে এসে দ্বিতীয় বিভাগ। বাবার আশার প্রদীপ নিবিয়ে খোলাম-কুচির মত ভেঙে পরীক্ষার ফল বেরোনোর পর ও বলতে শুরু করেছে, আসলে ওই দেবনাথ স্যারের জন্যই আমার পরীক্ষা ভাল হয় নাই।
দেবনাথ পণ্ডিত ইয়াসমিনকে বাড়িতে এসে পড়াননি, আমাকে যেমন পড়িয়েছিলেন। দলে পড়িয়েছেন।একশ ছাত্র ছাত্রীকে পড়াতে হলে দল ছাড়া আর কোনও গতি নেই। ওই দলের এক কোণে পড়ে থেকে ইয়াসমিন অংকের মাথামুণ্ডু কিচ্ছু বোঝেনি। আমার অবশ্য মনে হয় বাড়ির নতুন দুজন মানুষ এক হাসিনা দুই সুহৃদ নিয়ে ওর উত্তেজনা এত বেশি ছিল যে বই নিয়ে ও মোটেও বসতে চায়নি। আমি পড়তে বসার জন্য অনুরোধ করলে আমাকে ধমকে সরিয়ে দিয়েছে। বাবা বললে অবশ্য বসেছে, কিন্তু সে বসা সত্যিকার বসা ছিল না। দ্বিতীয় বিভাগ নিয়ে ওর পক্ষে মেডিকেলে ভর্তি হওয়া সম্ভব নয়। বাবা জলদগম্ভীর স্বরে বলেন,জীবন তো বরবাদ হইয়া গেল। এখন ইমপ্রুভমেন্ট পরীক্ষা দিয়া দেখ ফাস্ট ডিভিশান পাস কি না। মেডিকেলে ভর্তি হইতে পারস কি না। তা না হইলে গাধা ছাত্রীদের মত ওই আনন্দমোহনে গিয়াই বিএসসি তে ভর্তি হ। কি করবি আর।
বাড়িতে ইয়াসমিনের আদর খানিকটা কমে যায়। অবশ্য মার কাছে কমে না। মা বলেন, কোনও লেখাপড়াই খারাপ না। ভাল কইরা পড়লে সব লেখাপড়াই ভাল। শুনে, বাবা নাক সিটকে বলেন, এই অশিক্ষিত বেটি বলে কি এইসব!
মা ঘুরে দাঁড়িয়ে বলেন, কেন সুলেখা তো ডাক্তারি পড়ে নাই। কি সুন্দর এম এ পাশ কইরা এখন ব্যাংকের জি এম হইছে।
বাবা খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসেন। বাবার হাসি থেকে দূরে সরতে মা রান্নাঘরের দিকে যখন যেতে থাকেন, থামিয়ে বলি, কওতো জিএম মানে কি?
বড় অফিসার।
আমিও খ্যাঁক খ্যাঁক।
মা চলে যান রান্নাঘরে। ও ঘরটিই মার জন্য শ্রেয়, তা মাও বোঝেন, আমরাও। ইয়াসমিনকে জন্য বিজ্ঞানের কোনও একটি ভাল বিষয় নিয়ে অনার্স পড়ার পরামর্শ দিই। চেয়ারে দুলতে দুলতে, পা টেবিলের ওপর।
ফিজিক্স?
অসম্ভব।
কেন অসম্ভব?
কঠিন।
তাইলে কেমেস্ট্রি। মেট্রিকে তো লেটার পাইছিলি।
না। কেমেস্ট্রিও কঠিন।
তাইলে ম্যাথ?
প্রশ্নই আসে না।
জুওলজি নে।
না।
তাইলে এক কাজ কর।
কি?
লেখাপড়া ছাইড়া দে।
ইয়াসমিনের লেখাপড়া অনেকটা ছেড়ে দেওয়া পর্যায়েই দাঁড়িয়েছে। ওকে দেখে মনে হয় না কোনও রকম ইচ্ছে আছে কখনও বই হাতে নেওয়ার। ইমপ্রুভমেন্ট পরীক্ষার ফরম পূরণ করে এসে, দাদা বগুড়া থেকে ময়মনসিংহে বেড়াতে এলেন দুদিনের জন্য, বললেন, চল বগুড়া বেড়াইয়া আসবি, ইয়াসমিন হৈ হৈ করে বগুড়া চলে গেল বেড়াতে। দাদা আর হাসিনার বদৌলতে পাওয়া ইয়াসমিনের ঘাড়ের আর হাঁটুর ব্যথা তখনও কিন্তু সারেনি। সেদিনের সেই উঠোনের ঘটনার পর, দাদা আর হাসিনা দুজনের সঙ্গেই আমরা কথা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আমি বন্ধই রেখেছি, ইয়াসমিন শুরু করেছে, তবে ভাববাচ্যে। ওকে বগুড়া থেকে ঘুরিয়ে দাদা যখন ফেরত দিতে এলেন ময়মনসিংহে, বাবা কাছে ডাকলেন তাঁর জ্যষ্ঠ পুত্রটিকে, ঘন হয়ে বসলেন পাশে।
বগুড়ায় কেমন লাগতাছে?
ভাল।
কি রকম ভাল?
কোম্পানী বাড়িভাড়া দিতাছে।
বাড়ি কেমন?
ভালই। তিনটা রুম আছে। ড্রইং বেড ডাইনিং।
উঠান আছে?
না উঠান নাই, উঠান থাকব কেন? এপার্টমেন্ট বিল্ডিং ত।
নিজে বাজার কর?
জিনিসপত্রের দাম কেমন বগুড়ায়?
তা একটু দাম বেশিই আছে ওইখানে।
সংসার খরচে মাসের পুরা টাকাই কি চইলা যায়?
খরচ ত আছে, কিছু তো যায়ই।
রিপ্রেজেনটিটিভের চাকরি কইরা আর কতই বা পাও!
আমি ত আর রিপ্রেজেনটিটিভ না, কবেই না সপুারভাইজার হইয়া গেছি!
তফাতটা কি?
ঘোরাঘুরিটা কিছু কম।
টাকা পয়সা জমাইতাছ ভবিষ্যতের জন্য?
কিছু কিছু।
শরীরে সেন্ট মাইরা বাবুগিরি কইরা ঘুরতাছ, টাকা পয়সা ইচ্ছামত উড়াইতাছ, জমাইবা কেমনে?
কই সেন্ট? সেন্ট ত আজকাল কিনিই না।
নিজের বাড়িঘর সব রাইখা বিদেশে পইড়া আছ কেন?
চাকরি তো করতে হইব।
ওই চাকরি ছাইড়া দিয়া ময়মনসিংহে ফিরো। আমি তোমারে আরোগ্য বিতান দিয়া দিতাছি। ওষুধের ব্যবসা কর। চাকরিতে যা পাও, তার চেয়ে ব্যবসা ভাল কইরা করলে ভাল টাকা কামাইতে পারবা।
টানা চার ঘন্টার বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয়, দাদা ফাইসন্স কোম্পানীর চাকরি ছেড়ে বাপের ব্যবসা দেখাশুনো করবেন। বগুড়া ফিরে গেলেন তিনি, ওখান থেকে মাস খানিক পর বউবাচ্চাজ্ঞজনিসপত্র সব নিয়ে, কেবল শখের চাকরিটি না নিয়ে ফিরে এলেন। দাদা বগুড়ায় চাকরি নিয়ে চলে যাওয়ার পর বাবা নতুন আসবাব কিনেছেন, টেলিভিশন, ফ্রিজ, এসবও কিনেছেন। ঘর এখন খালি নেই যে দাদা তাঁর সব আসবাব ফেলতে পারবেন। বিশাল খাবার টেবিলটি আর তালাবন্ধ কাচের বাসনপত্রের আলমারিটি দাদা তাঁর আগের শোবার ঘরে রেখে ঘরটিকে আলাদা একটি খাবার ঘর বানিয়ে বাবার নির্দেশে নিজের আজদাহা খাট আলমারি আয়নার টেবিল আলনা ইত্যাদি উঠোনের দুটো টিনের ঘরের একটিতে গুছিয়ে স্ত্রীপুত্রসহ থাকতে শুরু করলেন। দাদারা ফিরে আসার পর দাদা আর হাসিনার কোনও প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ বা না ছাড়া কিছু কথা হয় না আমার, বড়জোর খুব প্রয়োজনে দুএকটি কথা হতে থাকে, কিন্তু যা হতে থাকে তা ভাববাচ্যে। সম্বোধনহীন কথা বলায় পারদশির্ আমার জন্য এ কঠিন কিছু নয়। বাবা আরোগ্য বিতানের পাশে দুটি ঘর ভাড়া নিয়ে একটি লেপতোশকের ব্যবসায়ীর কাছে ভাড়া দিয়ে আরেকটিতে নিজের আলাদা চেম্বারের ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। দাদার হাতে আরোগ্য বিতান, ওষুধের দোকান। বাবার হাতে রোগী দেখা, দাদার হাতে ব্যবসা। ব্যবসায় খাটাতে বাবা নিজের কয়েক লক্ষ টাকা অকাতরে ঢেলে দিলেন দাদার হাতে।
আমার খরচ চলতে থাকে রুদ্রর টাকায়। আমার কি প্রয়োজন না প্রয়োজন তার দিকে বাবা ফিরে তাকান না। আমাকে নিয়ে তাঁর কোনও আর উৎসাহ নেই। আমি উচ্ছন্নে চলে গেছি, লাগাম ছিঁড়ে বেরিয়ে গেছি, আমি নিষেধের বেড়া ডিঙিয়ে গেছি, আমি আর আমি নেই, আমি নষ্ট হয়ে গেছি। আমাকে নিয়ে আশা ভরসাও নেই আর। এই বাবা, মনে হত,আমাকে ডাক্তার বানানোর জন্য, জীবন উৎসর্গ করেছেন। অথচ রুদ্রকে অপমান করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে আমার বেরিয়ে যাওয়া, এবং একরাত বাড়ি না ফেরার কারণে তিনি আমাকে প্রায় ত্যাজ্য-কন্যা করে দিলেন! ধ্বসে গেল আমাকে নিয়ে তাঁর স্বপ্নের প্রাসাদ!কি সহজ এই ধ্বসে যাওয়া! কী পলকা স্বপ্ন নিয়ে ছিল তাঁর বাস!এমন তো নয় যে আমি কাউকে বলেছি রুদ্রর সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্কে আছে বা রুদ্রকে আমি বিয়ে করেছি বা আমি তোমাদের আর পরোয়া করি না!যদি বলতাম, বুঝতাম, তিনি হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে যা করার করছেন। বাবার আচরণ আমাকে ক্ষুব্ধ করে। মনে হতে থাকে এ জগতে রুদ্র ছাড়া আপন কেউ নেই আমার।
রুদ্র আসে ময়মনসিংহে। শহরে রিক্সার হুড ফেলে দুজন ঘুরি। যে দেখে দেখুক। বাবার কাছে খবর যায় যদি, যাক, আমার আর ভয় কিসের! রুদ্রর দাবি আমাকে তার সঙ্গে হোটেলে থাকতে হবে রাতে। ময়মনসিংহ শহরের ঘিঞ্জি এলাকায়, ছোটবাজারে, শান্তনীড় নামের হোটেলে একটি ঘর ভাড়া করে সে। অন্ধকার সিঁড়ি পার হতে ভয় ভয় লাগে। চারতলায় একটি ছোট্ট স্যাঁতসেঁতে ঘরে, একজনের একটি চৌকি কেবল ধরে, ঢুকে আমি নিঃশ্বাসের জন্য একটু শুদ্ধ হাওয়া খুঁজি, পাই না। হাওয়া ভারি হয়ে আছে, হাওয়ায় পেচ্ছাবের গন্ধ, কফ থুতুর গন্ধ। ঘরে কোনও জানালাও নেই যে খুলে দেব। বিছানার চাদরে বালিশে এমনকি এক চিলতে পেচ্ছাবপায়খানাটির সর্বত্র মনে হয় ছড়িয়ে আছে সিফিলিসের জীবাণু শরীর বেয়ে বিμছুর মত হেঁটে উঠবে কোথাও যদি স্পর্শ করি। গা ঘিন ঘিন করে। বিছানায় নতুন চাদর বিছিয়ে দিতে বল। বালিশ পাল্টো দিতে বল। আমার ঘেন্না লাগছে, অন্য কোনও ভাল হোটেলে চল। না রুদ্র কিছুই করবে না। আমাকে টেনে সে বিছানায় নেয়। টেনে আমার জামা খুলে নেয়, টেনে আমার পাজামা। আমার ওপর নিজে সে ন্যাংটো হয়ে চড়ে বসে। আমার মন বিছানার নোংরা চাদরে, নোংরা বালিশে। ভয়ে সিঁটিয়ে থাকা আমার শরীর নিয়ে রুদ্র আনন্দ করে। আনন্দ শেষে সে সিগারেট ধরায়। গুমোট ঘরটির নানা গন্ধের মধ্যে যোগ হয় সিগারেটের গন্ধ। পেটের নাড়ি বেয়ে বমি উঠে আসে গলায়। মাথা ঘোরে। রুদ্র বলে, কাল ঢাকা চল।
আমার ওয়ার্ড এন্ডিং পরীক্ষা আর দুদিন পর।
বাদ দাও ওয়ার্ড এন্ডিং। ও না দিলে কিছু হবে না।
কিছু যে হবে সে আমি জানি। জেনেও বাড়ি গিয়ে নিজের দুটো বাড়তি জামা একটি ব্যাগে নিয়ে বেরোই দুপুরের বাস ধরতে, মা পেছন থেকে বলেন, কই যাস? ঢাকা যাই। ঢাকা কার কাছে যাস? প্রশ্নের কোনও উত্তর না দিয়ে আমি বোবা কালা আমি এগোতে থাকি। পেছনে বেড়া ডিঙোনোর আমার জন্য মার উদ্বেগ, পেছনে আমার না গেলেই নয় ক্লাস। পেছনে আমার না দিলেই নয় ওয়ার্ড এন্ডিং। ঢাকা পৌঁছে রুদ্রর দুটো ঘরে শুয়ে থাকা বসে থাকা, তার নতুন কবিতা পড়া, জীবনে কখনও রান্না-না-করা হাতে রান্না করা, রিক্সার হুড ফেলে বিকেলে হাওয়া খেতে বাইরে যাওয়া, সন্ধেয় অসীম সাহার ইত্যাদি প্রিন্টাসের্ বসে নির্মলেন্দু গুণ,মহাদেব সাহার সঙ্গে রাজনীতি,সাহিত্য-সমাজ-সংস্কৃতি নিয়ে গল্প করে রাতে ঘরে ফেরা। রাতে শরীর নিয়ে খেলা করে রুদ্র। শরীরের গভীরে যেতে যেতে বলে, যেন পাথরকুচির ওপর দিয়ে যাচ্ছি। এত পাথরকুচি!এত পাথরকুচি!আরও গভীরে আরও গহনে অন্ধকারে পাথরকুচির ওপর ছুটতে ছুটতে ক্লান্তিতে নুয়ে বলে, উফ তোমার দাঁত এত ধারালো, এমন কামড় দিয়ে ধরো, কিছুতেই ছুটতে পারি না।
ভোর হলেই আমি ছটফট করি ময়মনসিংহে ফিরতে। এত উতলা হওয়ার কি আছে, আর দুটো দিন থাকো। দুদিন থাকা হয়। দুদিন পর রুদ্ররও দিন ফুরিয়ে আসে ঢাকার। তাকে ফিরতে হবে মোংলায়।
কিছু টাকা লাগবে আমার?
যে টাকা পাঠিয়েছিলাম ফুরিয়ে গেছে?
হ্যাঁ।
কি করে ফুরোলে?
হিসেব রাখিনি।
এত বেহিসেবি হলে চলবে কেন?
মাথাটি আপনাতেই নত হয়ে আসে আমার। বাবার সামনে টাকার জন্য হাত পাততে গিয়ে ঠিক যেভাবে নত হয় মাথা, সেভাবেই নত হয়ে আসে। চোখদুটো নত। বাবার সামনে চোখও এমন নত থাকে।
কত দরকার এখন? কত দিলে চলবে?
আমি নখ খুঁটি। হাতের নখ। পায়ের নখ।
তিনশ হলে চলবে?
চলবে।
টাকাটি হাতে নিই, হাতে নিতে যদিও খুব লজ্জা হয়। নিজেকে একটি উপদ্রব মনে হতে থাকে। দাঁড়াবার শক্তি নেই, মেরুদণ্ডের জোড় নেই, একটি পরগাছার মত নিজেকে মনে হয়। আমার লজ্জা যায় না। কারও কাছ থেকে যদি না নিতে হত টাকা, যদি নিজে উপার্জন করতে পারতাম! যদি শরমের এই নত মাথাটি আমি একটু তুলতে পারতাম! ময়মনসিংহে ফিরে এলে মা বলেন, ঢাকায় কার কাছে ছিলি, কামালের বাসায়? তর বড়মামার বাসায়? ঝুনুর বাসায়?
না।
তাইলে কার বাসায়?
আমি কথা বলি না।
মা বলেন, তুই যে কোন পথে যাইতাছস! তর কপালে যে কি আছে!আল্লাহ খোদা বিশ্বাস করস না। যা ইচ্ছা তাই করতাছস। যেই বেডা তরে ফুসলাইয়া বাড়ির বাইর করতাছে, তারে নিয়া কি তুই সুখী হইবি? এখনও বাদ দে। এখনও সময় আছে। বাবা মা ভাই বোন সবার কথা ভাব একটু। কত ডাক্তার ছেলে তরে বিয়া করতে চায়। কাউরে পাত্তা দেস নাই। এখন কারে নিয়া ঘুরস, তুইই জানস। জীবনটারে নষ্ট করিস না। তর বাপের কাছে ক, ক যে তুই ভালা হইয়া চলবি। বাপের কথা শুইনা চলবি। তর বাপে তর সব খরচ দিব। এখনও সময় আছে ক।
মাকে পাশ কাটিয়ে আলনা থেকে এপ্রোনটি হাতে নিয়ে চলে যাই হাসপাতালে।
এখন থেকে বেহিসেবি হলে চলবে না। সোনার গয়নার মত টাকা পয়সা গোসলখানায়, জানালায়, টেবিলে, বিছানায় ফেলে রাখা চলবে না।জমা খরচের খাতা করে দুদিন রিক্সাভাড়া- ১২টাকা, বাদাম- ১টাকা, চা- ৩ টাকা, চিরুনি- ১ টাকা, কলম- ২টাকা, কাগজ- ৫ টাকা.. লেখার পর আর লেখা হয় না, হিসেবের খাতাটিও খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রায় বিকেলেই, রোদের তাপ কমে এলে,পড়ার টেবিল থেকে উঠে ইয়াসমিনকে বলি, চল, বাইরে থেইকা ঘুইরা আসি। ইয়াসমিন বাইরে যাওয়ার নাম শুনে লাফিয়ে ওঠে। মা বলতে থাকেন, ও নিজে নষ্ট হইছে, এহন ইয়াসমিনডারেও নষ্ট করব।