১৯. নিষিদ্ধ গন্ধম

কলকাতা যেতে হবে। আবৃত্তিলোকের কবি সম্মেলনে কবিতা পাঠের আমন্ত্রণ। সৌমিত্র মিত্র ঢাকায় চলে এসেছেন ঢাকার কয়েকজন কবিকে নিজমুখে আমন্ত্রণ জানাতে। আমার বাড়িতে বসেই ঠিক হল কাদের কাদের আমন্ত্রণ জানানো হবে। সৌমিত্র মিত্র নিজে কজন কবিকে আমন্ত্রণ পত্র দিয়েছেন, বাকিগুলো বিলি করার ভার আমার ওপর। আমার কানে কানে তিনি বলে যান, ‘এবারের অনুষ্ঠানে মূল আকর্ষণ কিন্তু তুমি।’ মূল আকর্ষণের জন্য যত না, তার চেয়ে বেশি আনন্দ প্রিয় কলকাতাটি দেখার। উত্তেজনায় আমি স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছি না কোথাও। কলকাতার অনুষ্ঠান শেষ হলে দার্জিলিং চলে যাব, শান্তিনিকেতন ঘুরে আসব, থাকব পুরো দু সপ্তাহ, এ হল গোপন ইচ্ছে। দু সপ্তাহের জন্য ক্যাজুয়াল লিভ নেওয়া যায় না। ডাক্তার রশীদ পরামর্শ দিলেন আর্ন লিভ নেওয়ার। আর্ন লিভের জন্য দরখাস্ত করে দিই।

নির্মলেন্দু গুণ দেশে নেই। কায়েস নামে গুণের এক ভক্ত গুণকে আমেরিকায় বেড়াতে নিয়ে গেছে। অসীম সাহা কোনও এক অজ্ঞাত কারণে প্রথমে রাজি হয়েও পরে আর রাজি হলেন না কলকাতায় যেতে। আমি শামসুর রাহমানএর বাড়ি থেকে তাঁর পাসপোর্ট আর ভিসার কাগজে তাঁর সই নিয়ে নিজেই দৌড়ে দৌড়ে ভিসা করিয়ে টিকিট করে আনি। নিজের ভিসা টিকিটও করি। টানা এক সপ্তাহ বেইলি রোডের দোকান থেকে প্রিয় প্রিয় মানুষের জন্য জামদানি শাড়ি আর আদ্দির পাঞ্জাবি কিনেছি, বইপাড়া থেকে কারও জন্য বই, শান্তিনগর বাজার খুঁজে কারও জন্য শুঁটকি মাছ, কারও জন্য মুক্তাগাছার মণ্ডা, নকশি কাঁথা, বড় ভালবেসে কারও জন্য বয়াম ভরে আমের আচার আর পুরো কলকাতার জন্য নিয়েছি থোকা থোকা ভালবাসা, সে অবশ্য কোনও সুটকেসে আঁটেনি। যাবার দিন কায়সারের গাড়িতে করে শামসুর রাহমানকে তাঁর বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে বিমান বন্দরে গিয়েছি। যেন সৌমিত্র মিত্রর কোনও অনুষ্ঠান নয়, আবৃত্তিলোকের কোনও ব্যপার নয়, যেন অনুষ্ঠানটি আমার, যেখানে যাচ্ছি। যেন কলকাতা আমার শহর, যে শহরে সকল কবিকে আমি পরম পুলকে সাদরে সগৌরবে নিয়ে যাচ্ছি। আমার উচ্ছলত!ই সবচেয়ে বেশি। বিমান বন্দরে বেলাল চৌধুরী আর স্থপতি-কবি রবিউল হুসাইন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সুটকেসগুলো চেক ইন পার করে দিয়ে বোর্ডিং কার্ড নিয়ে মহাআনন্দে এগোতে থাকি সামনে। মহানন্দেই পাসপোর্ট দিই ইমিগ্রেশনের লোকের হাতে। শামসুর রাহমান আর আমি সামনে, আমাদের পেছনে বাকি সব কবি। আমার তখন কখন দমদম পৌঁছবো, কখন চৌরঙ্গি, পার্ক স্ট্রিট, কলেজ স্টিট, গড়িয়াহাট, চিৎপুরে টই টই করে ঘুরে বেড়াব, কখন প্রিয় প্রিয় কবিদের সঙ্গে কলকাতায় জমিয়ে আড্ডা দেব, এই তাড়া। লোকটি আমার পাসপোর্ট থেকে মুখ তুলে আমার দিকে তাকান। আবার পাসপোর্টে চোখ, আবার আমার মুখে। এরপর পকেট থেকে একটি ছোট কাগজ বের করে একবার কাগজে চোখ, আরেকবার পাসপোর্ট। লোকটি আমাকে পাসপোর্ট হাতে নিয়ে দ্রুত এগিয়ে যান ইমিগ্রেশনের কোনও বড় কর্তার ঘরের দিকে। বড় কর্তা আর লোকটি ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নিচু স্বরে কিছু কথা বলেন। কি কথা বলেন কে জানে! আমার পাসপোর্ট নিয়ে কি কথা বলার থাকতে পারে! পাসপোর্টে যে ছবি, সে তো আমারই ছবি। পাসপোর্টে যে নাম ঠিকানা সে তো আমারই নাম ঠিকানা। তবে কিসের এত কানাকানি কথা! লোকটি ফিরে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি চাকরি করেন?

হ্যাঁ করি।

কোথায়?

ঢাকা মেডিকেলে।

বিদেশে যাওয়ার পারমিশান আছে আপনার?

বিদেশে যেতে আবার কারও পারমিশান লাগে নাকি!

লোকটি আমাকে বলেন না কার পারমিশান লাগে। কেবল বলেন, অনুমতি না থাকলে আপনার যাওয়া হবে না। আমরা বড় কর্তার ঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস করি ঘটনা কি। ঘটনা কি তিনিও বুঝিয়ে বলেন না। বড় কর্তার সামনের তিনটে চেয়ারে আমরা বসি। আমি, শামসুর রাহমান, বেলাল চৌধুরী। পেছনে দাঁড়িয়ে রবিউল হুসাইন। দরজার বাইরে বাকি কবিরা। বড় কর্তার বোধহয় মায়া হয় আমাদের দেখে। কত চোর ছেঁচড় গুণ্ডা বদমাশকে পার করে দিচ্ছেন তিনি, অথচ যে মানুষ দল বেঁধে কবি সম্মেলনে যাচ্ছে, তাকে আটকাতে হচ্ছে। তিনি আমাদের দিকে একটি টেলিফোন এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ওপর থেকে কেউ ফোনে অর্ডার করলে আমরা ছেড়ে দেব।’ টেবিলে দুটো টেলিফোন ছিল। আরেকটি টেলিফোন ঘন ঘন বাজছে, বড় কর্তা রিসিভার কানে নিয়ে ঘন ঘনই বলছেন, ‘জি সার উনি এখানেই, জি স্যার আমার সামনেই বসে আছে, জি স্যার যেতে দেওয়া হচ্ছে না, জি স্যার ঠিক আছে।’ বড় কর্তা কি আমার কথা বলছেন ফোনের ওপারের স্যারকে! আমার সন্দেহ হয়, তিনি আমার কথাই বলছেন। ওই স্যারটি নিশ্চয়ই আগে থেকেই কোনও আদেশ দিয়ে রেখেছেন যেন আমাকে যেতে বাধা দেওয়া হয়।

এদিকে বেলাল চৌধুরী আর শামসুর রাহমান ওপরের মানুষগুলোকে এক এক করে খুঁজছেন মরিয়া হয়ে। সে যে কী শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। বেলাল চৌধুরী বললেন, ‘হেলথ সেক্রেটারি আমাদের বন্ধু, তাঁকে একবার পাওয়া গেলে কোনও সমস্যা নেই।’ বার বার ফোন করেও তাঁকে পাওয়া যাচ্ছে না। বেলাল চৌধুরী আইজির নম্বরে ফোন করেন, আইজি নেই। শামসুর রাহমান তাঁর এক মন্ত্রী বন্ধুকে ফোন করেন, তিনি ঢাকার বাইরে। সময় দ্রুত এগোচ্ছে। উড়োজাহাজে উঠে গেছে সব যাত্রী। কবির দলটি কেবল বাকি। মনকে বলছি, স্থির হও, দুর্যোগ কেটে যাবে। কিন্তু মন কিছুতে স্থির হচ্ছে না। সময় যাচ্ছে, নির্দয় সময় সামান্য করুণা করছে না আমাদের। টেলিফোনে আঙুলের অনবরত সঞ্চালনের পর শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল কবি ইমরান নূরকে। তিনিই স্বাস্থ্য সচিব। ওপরের লোক। স্বস্তির একটি শ্বাস ফেলি আমরা। আমাদের ঠোঁট থেকে উড়ে যাওয়া হাসিটি চকিতে ফিরে আসে। শামসুর রাহমান বললেন, ‘আমরা কলকাতা যাচ্ছি, কিন্তু তসলিমাকে যেতে দিচ্ছে না, আপনি এদের বলে দিন যেন ওকে যেতে দেয়। আপনি বলে দিলেই হবে।’

ইমরান নূর কথা বলতে চাইলেন বড় কর্তার সঙ্গে। সাংকেতিক কথা কি না জানি না, আমাদের কারও পক্ষে বোঝা সম্ভব হয় না কি কথা তাঁরা বলেন। বড় কর্তা কথা শেষ করে শামসুর রাহমানকে দিলেন রিসিভার। ইমরান নূর জানিয়ে দিলেন, ‘তসলিমার যাওয়া হচ্ছে না।’

‘কেন যাওয়া হচ্ছে না?’

‘দেশের বাইরে যেতে গেলে পারমিশান লাগবে সরকারের।’

‘সেটা আপনি ব্যবস্থা করে দিন। আপনি এখন এদের বলে দিলে কি হয় না?’

‘না হয় না।’

‘কিছুতেই কি হবে না? দেখুন একটু চেষ্টা করে হয় কি না।’

‘হয় না।’

শামসুর রাহমানের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। বেলাল চৌধুরী মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকেন। আমার সামনে দুলে উঠলো ইমিগ্রেশন অফিসারের ঘরটি, ঘরের দেয়াল, দুলে উঠলো পুরো বিমান বন্দর, দুলে উঠল স্বপ্ন সুখ। আমাকে আর সামনে পা বাড়াতে দেওয়া হয় না। উড়োজাহাজ তখন ছাড়ছে ছাড়ছে প্রায়। ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে বাকি যাত্রীরা এখনই যেন জাহাজে উঠে যান। বেলাল চৌধুরী বিষণ্ন মুখে বললেন, ‘আমি থেকে যাই, আমি আর তসলিমা পরে আসছি। শামসুর রাহমান বললেন, না আপনি যান, আমি থেকে যাই, ঝামেলা মিটিয়ে আজ বিকেলের ফ্লাইটে না হয় আমরা যাবো।’ ওঁদের কথায় আমার চোখে জল চলে আসে। আমি বাস্পরূদ্ধ কণ্ঠে বলি, ‘আমার জন্য দেরি করবেন কেন? আপনারা চলে যান। আমি আসছি পরে।’

অধৈর্য হয়ে উঠছে বাকি কবিরা। কবিদের কারও কারও বিষণ্ন মুখ, কারও বা প্রসন্ন মুখ। সরকারি চাকরি করা আর কোনও কবিকে এই হাঙ্গামা পোহাতে হচ্ছে না। কারও জন্য সরকারি অনুমতির প্রয়োজন হয়নি। কেবল আমার জন্য প্রয়োজন। দলের মধ্য থেকে রফিক আজাদ শামসুর রাহমানের হাত ধরে ‘আসুন তো, প্লেন ছেড়ে দিচ্ছেঞ্চ বলে টেনে নিয়ে যান সামনে। বেলাল চৌধুরী বলে গেলেন, ‘এক্ষুনি তুমি ইমরান নূরের অফিসে চলে যাও, দেখ কি করতে বলে, করে, আজ বিকেলের ফ্লাইটেই চলে এসো। আজ যদি সম্ভব না হয়, তবে কাল সকালের ফ্লাইটে যে করেই হোক এসো।’

আমাকে পেছনে রেখে দলের সবাই উড়োজাহাজের দিকে এগোতে লাগলেন। শামসুর রাহমান বার বার করুণ চোখে তাকাচ্ছিলেন পেছনে অসহায় দাঁড়িয়ে থাকা আমার দিকে। আমি একা দাঁড়িয়ে। দলের শেষ মানুষটি যখন অদৃশ্য হয়ে যায়, এক বন্দর মানুষের সামনে আমি হু হু করে কেঁদে উঠি। ওঁদের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আমার যে এমন ঝড় বইবে বুকে, এমন যে উথলে উঠবে কষ্ট, তা আমি তখন বুঝিনি। কাচের ঘরের মত ভেঙে গেল আমার স্বপ্নের দালানকোঠা। পুরো বন্দর শুনল সেই ভাঙনের শব্দ, পুরো বন্দর শুনল আমার বুক ছেঁড়া আর্তনাদ।

আমাকে পাসপোর্ট ফেরত দেওয়া হল না। হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলা হল, ‘এই কাগজটি দেখিয়ে এসবি অফিস থেকে আপনার পাসপোর্ট নিয়ে নেবেন।’

‘কখন দেবে পাসপোর্ট?’

‘আজকে বিকালে গেলে বিকালেই পাবেন। যদি না হয়, কালকে সকালে তো পাবেনই।’ উড়োজাহাজের পেটের ভেতর থেকে ফেরত এসেছে নম্বর সাঁটা আমার দুটো সুটকেস। সুটকেসদুটো সামনে নিয়ে অনেকক্ষণ অবশ বসে থাকি। হঠাৎ কি করে কি হয়ে গেল, পুরোটাই যেন আস্ত একটি দুঃস্বপ্ন। এখনও আমার ঠিক বিশ্বাস হতে চাইছে না সত্যি সত্যিই ঘটে গেছে এমন মর্মান্তিক একটি ব্যপার।

কায়সার প্রায় সকালে বিজয়নগরে তার এক বন্ধুর আপিসে গিয়ে বসে। সেখানে ফোন করে কায়সারকে পেয়ে তাকে বিমান বন্দরে আসতে বলি। কায়সার এলে বাড়িতে না গিয়ে সোজা সচিবালয়ে যাই ইমরান নূরের সঙ্গে দেখা করতে। তিনি আমাকে আলাদা ঘরে নিয়ে মুখোমুখি বসে বললেন তাঁর কোনও ক্ষমতাই নেই আমার জন্য কিছু করার। কেন তাঁর ক্ষমতা নেই তা তিনি বলতে চাইলেন না। বহির্বাংলাদেশ ছুটির জন্য আবেদন করার উপদেশ দিলেন কলকাতা যেতে হলে আমার বর্হিবাংলাদেশ ছুটি চাই। এরকম যে একটি ছুটি নেবার নিয়ম আছে তা আমার জানা ছিল না। হরদম দেখছি ডাক্তাররা দেশের বাইরে যাচ্ছেন, কাউকে এরকম ছুটি নিতে হয়নি। আমার বেলায় আইনের সাত রকম মারপ্যাঁচ। আইন মানতে আমার তো কোনও অসুবিধে নেই। সচিবালয় থেকে ছুটে যাই হাসপাতালে। দরখাস্ত লিখে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অগ্রায়ন নিয়ে সোজা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে দরখাস্তটি দেওয়ার পর তিনি দেখলেন, পড়লেন, বললেন আমি যেন কাল আসি। কাল কেন? আজই সই দিয়ে দিন। না, আজ সই হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না? এটি আমার আজই দরকার। আজই দরকার হোক, কিন্তু হচ্ছে না।

বাড়ি ফিরে আসি। সৌমিত্র মিত্র ফোন করছেন বিকেলের ফ্লাইটে আসা হচ্ছে কি না আমার জানতে। বলে দিই হচ্ছে না।

‘কাল হবে?’

‘চেষ্টা করবো।’

পরদিন সকালে মালিবাগের স্পেশাল ব্রাঞ্চ অফিসে পাসপোর্ট আনতে যাই। পাসপোর্ট ফেরত দেওয়া হয় না আমকে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে বহির্বাংলাদেশ ছুটির কি হল দেখতে যাই, কিছুই হয়নি জেনে আবার ক্লান্ত বিপর্যস্ত আশাহত আমি ফিরে আসি। কলকাতা থেকে সৌমিত্র মিত্র বার বারই ফোন করে জানতে চাইছেন কতদূর এগিয়েছে যাওয়ার ব্যপারটি। বলছেন আমার জন্য সবাই ওখানে অপেক্ষা করছেন, আমি না গেলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। কেলেঙ্কারি হবে তো আমি কি করব, আমাকে তো পাসপোর্টই ফেরত দেওয়া হচ্ছে না। তার পরদিনও দেখি, তার পরদিনও। আমাকে কিছুই দেওয়া হয়না। না পাসপোর্ট। না ছুটি।

আমার কলকাতা যাওয়া হয় না।

কবিরা ফিরে এলে জিজ্ঞেস করি, কেমন হল সম্মেলন, কারা কারা কবিতা পড়ল, কেমন আছে কলকাতা, নন্দনে কী চলছে, রবীন্দ্রসদনে কী হচ্ছে, শিশির মঞ্চেই বা কী.. । ওঁরা বলেন, যতটুকু বলেন, শুনে আমার সাধ মেটে না।

বইমেলা এসে যায়। এর আগের বছরের মেলায় তসলিমা নাসরিন পেষণ কমিটির মিছিল বেরিয়েছে, মেলায় আমার বই পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, মেলা কর্তৃপক্ষ আমাকে মেলায় যেতে নিষেধ করেছেন। এ বছরের মেলায় অন্য সব কবি লেখকরা যাচ্ছেন, আমিই কেবল বসে আছি ঘরে। ঘরে মন বসে না। মন খেলায় মেতে ভেলায় ভেসে মেলায় যায়। একদিন আমার দুর্দমনীয় ইচ্ছে আমাকে খাঁচা ভেঙে বের করে আনে, যে করেই হোক যাবই আমি মেলায়। কিসের ভয় আমার! আমি তো কোনও অপরাধ করিনি। যে কোনও মানুষেরই অধিকার আছে মেলায় যাওয়ার। আমার কেন থাকবে না! আমি কেন নিজের ন্যূনতম স্বাধীনতাটুকু কর্তৃপক্ষের অন্যায় আদেশে বিসর্জন দেব! মেলায় যাওয়ার সিদ্ধান্তটি খসরুকে জানালে তিনি তাঁর দুজন বন্ধু সঙ্গে নেবেন বললেন। একা যাওয়ার তো প্রশ্ন ওঠে না, যেতে হবে সদলবলে। টাক-মাথা ছিপছিপে চশমা চোখের দার্শনিক চেহারার শহিদুল হক খান আমার নিরাপত্তা রক্ষক হিসেবে এগিয়ে এলেন। শহিদুল হক খান টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করেন, প্রচুর কথা বলেন কিন্তু সুন্দর কথা বলেন। তাঁর অনুষ্ঠানে আমাকে একবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছিলাম কিন্তু তাঁর দেওয়া নাট্যসভা পুরস্কারটি গ্রহণ করেছিলাম। তাঁর সঙ্গে একরকম বন্ধুতা গড়ে ওঠে আমার। আমার বাড়িতে দেখা হতে হতে খসরু আর শহিদুলের মধ্যেও জমে ওঠে। খসরু দেখতে যেমনই হোক, খুব হৃদয়বান মানুষ তিনি। বন্ধুদের জন্য যতটুকু করা উচিত তার চেয়েও বেশি করেন। ইত্তেফাকের সাংবাদিক আলমগীরের সঙ্গে পরিচয় হল আমার বাড়িতে, কদিন পরই তিনি আলমগীরকে তাঁর ব্যবসার অংশীদার করে নিলেন। আমার কখনও গাড়ি প্রয়োজন হলে তিনি নিজে যদি ব্যস্ত থাকেন, তাঁর গাড়িটি পাঠিয়ে দেন। হঠাৎ একদিন আমাকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন আমার জন্য আস্ত একটি নতুন কমপিউটার নিয়ে এসে। খসরু ধনী হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু দেশের আর ধনীদের মত তাঁর আচরণ নয়। কত মুক্তিযোদ্ধাকেই দেখেছি নিজের আখের গুছিয়ে নিয়ে আরাম করছেন, দেশকে শকুনে ঠোকরাচ্ছে কি শেয়ালে খাচ্ছে এ নিয়ে কোনও দুশ্চিন্তা করেন না। খসরু মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তাঁর আদর্শ তিনি কারও কাছে বিক্রি করেননি। মুক্তিযদ্ধের পক্ষের শক্তিকে তিনি সাধ্যাতীত সাহায্য করেন। আওয়ামি লীগের নেতারা তাঁর কাছে গিয়ে বসে থাকেন দলের চাঁদার জন্য, কাউকে তিনি ফিরিয়ে দেন না। আমার একদিকে খসরু, আরেকদিকে শহিদুল হক, আমি হেঁটে যাই বইমেলার দিকে। আনন্দ আর আশঙ্কা দুটোই আমাকে কাঁপায়। মেলায় হাঁটাহাঁটি ঘোরাঘুরি চলবে না। কোনও একটি স্টলে কিছুক্ষণ বসে মেলার স্বাদ নিয়ে সাধ মিটিয়ে দু পাশে নিরাপত্তা নিয়ে ফিরে যেতে হবে, এই হল শুভাকাঙ্খীদের সিদ্ধান্ত। পার্ল পাবলিকেশন্সের স্টলে ঢুকতেই মিনু আমাকে দেখে উল্লাসে ফেটে পড়েন। প্রচুর লোক নাকি আমার বই কিনছে, আমার অটোগ্রাফের জন্য বার বার ঘুরে যাচ্ছে। মেলার এই আলোকিত প্রাঙ্গন, লেখক পাঠকের এই মিলনকেন্দ্রটির উৎসব উৎসব পরিবেশ দেখে, গানের সুরে, কবিতার শব্দে কোলাহলে কলরোলে মুখরিত বইমেলাটি দেখে মুহূর্তের মধ্যে আমি ভুলে যাই আমার কোনও বিপদ আছে এখানে, যেন আর সব লেখকের মত বইমেলায় থাকার, ঘূরে বেড়াবার সব অধিকার আমার আছে। পুরো দেশটির সবচেয়ে সভ্য, শিক্ষিত, সবচেয়ে সচ্চরিত্র, সৎ সদাচারী, সুজন সজ্জন, স্বাধীনচেতা সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক মানুষেরা যে জায়গাটিতে জড়ো হন, নিরাপত্তা যদি সেখানে না থাকে তবে আর আছে কোথায়! আমার জন্য মসজিদ নিরাপদ নয়, কোনও রক্ষণশীল লোকদের আঙিনা নিরাপদ নয়, কোনও অন্ধকার গলি, কোনও নির্জন পথ নিরাপদ নয়, কোনও সন্ত্রাসীর আড্ডাখানা, মাতালের আস্তানা নিরাপদ নয়, কোনও ধর্মীয় জলসা নয়, কোনও জামাত শিবিরের আখড়া নয়, খল পুরুষের এলাকা নয়। নিজের ঘরের বাইরে যদি কোনও নিরাপদ কিছু আমার জন্য থেকে থাকে, তবে তো এই মেলাই। বড় চেনা এই মেলা আমার, বড় অন্তরে এই মেলা আমার,হৃদয়ের রক্তস্রোতে এই মেলা, প্রতিটি হৃদস্পন্দনে মেলা, এই মেলা আমার দীর্ঘ শোকের পরের অমল আনন্দ, সারা বছরের প্রাণপাত পরিশ্রমের পর এই মেলা যেন হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আবেশে চোখ বোজার প্রশান্তি। মিনু জানান, লজ্জা খুব বিক্রি হচ্ছে, কয়েকদিনেই প্রথম মুদ্রণ শেষ হয়ে গেছে, এখন দ্বিতীয় মুদ্রণ চলছে, তিনি নিশ্চিত তাঁকে অচিরে তৃতীয় মুদ্রণে যেতে হবে। এ কদিনেই কয়েক হাজার লজ্জা শেষ হয়ে যাচ্ছে। বিস্ময়ের ঘোর কাটে না আমার। লজ্জা কেন লোকে কিনবে! লজ্জায় কী আছে! এটি কোনও প্রেমের উপন্যাস নয়, চমকপ্রদ কোনও কাহিনী নেই এতে, যে কথা সকলে জানে, সে কথাই গল্প আকারে লেখা, তথ্য ভারাক্রান্ত। পাঠক সাধারণত এসব বই পছন্দ করে না। পার্ল পাবলিকেশন্সের স্টলে বসার সঙ্গে সঙ্গেই মানুষ লাইন ধরে বই কিনতে শুরু করে। সবাই যে লজ্জার জন্য লজ্জা কেনে তা নয়। নতুন বই কেনার আগ্রহে কেনে। স্টলে এসে জিজ্ঞেস করে, তসলিমা নাসরিনের নতুন বই কী বেরিয়েছে? নতুন বই লজ্জা। একটা লজ্জা দিন। দু টা লজ্জা দিন। তিনটে লজ্জা দিন। অন্যান্য স্টলের লোক আসে নিতে, পঞ্চাশটা লজ্জা দিন, একশটা লজ্জা দিন। প্রথম ভেবেছিলাম সম্ভবত হিন্দুরা বইটি কিনছে। কিন্তু অটোগ্রাফ দেওয়ার সময় অনেকেই তাদের নাম লিখতে বলে, নামগুলো হিন্দু নাম নয়। লজ্জা বিক্রি হয় আর আমার মনে ভয় জন্মাতে থাকে, যারা এই বই কিনছে, দু পাতা পড়ার পরই নিশ্চয়ই তাদের আর ভাল লাগবে না। তসলিমার লেখার ভক্ত বলে বইটি কিনছে, নাকি বিশেষ করেই লজ্জা কিনছে, জেনেই কিনছে কী আছে এতে, আমার বোঝা হয় না। সুযোগও হয় না ক্রেতাদের কাউকে জিজ্ঞেস করার। লজ্জার জন্য ভিড় বাড়তে থাকে। অটোগ্রাফের জন্য ভিড়। এক মুহূর্তের জন্য কলমকে অবসর দিতে পারি না। শহিদুল বসে আছেন পাশে। খসরু দাঁড়িয়ে আছেন দরজায়, তাঁর বলশালী বন্ধুরা আশে পাশে কোথাও আছে। এত লোক আমাকে ভালবাসে, আমার বই পড়ে, আমার কেন নিরাপত্তার অভাব হবে এই মেলায়! তা সম্ভবত খসরুও অনুমান করেন, তিনি একটু ঘুরে আসি বলে জনারণ্যে হাওয়া খেতে যান। এর খানিক বাদেই ঘটনা ঘটে। ঘটনাটি প্রথম আঁচ করতে পারিনি কেউই। স্টলের সামনের খোলা অংশটি ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে মানুষ। স্টলের বসে থাকা দাঁড়িয়ে থাকা সবাই লক্ষ করছি কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ঘিরে থাকা মানুষগুলোর পেছনে শ তিনেক মানুষ দাঁড়িয়ে গেল। স্টল ঘিরে প্রচণ্ড ভিড়, কিন্তু কেউ বই কিনতে চাইছে না, কেউ সরছেও না। ভিড়ের লোকগুলো কি চায়, কেন এখানে খামোকা দাঁড়িয়ে আছে, কেন জায়গা দিচ্ছে না যারা বই কিনতে আসছে তাদের, তা স্টলের একজন চেঁচিয়ে জানতে চায়। তার জানতে চাওয়ার কোনও উত্তর মেলে না, কেবল একটি হৈ হৈ শব্দ ছাড়া। হৈ হৈ কিছুক্ষণ চলল। শব্দটি কোনও শোভন শব্দ নয়। মিনু আমাকে আস্তে করে আমার চেয়ারটি পিছিয়ে নিতে বললেন। ভিড় আর আমাদের মধ্যে মাত্র দেড় হাত দূরত্ব, দেড়হাতের মধ্যে লম্বা টেবিলের মত পাতা। আমি চেয়ার পিছিয়ে নিয়ে বসলাম। সঙ্গে সঙ্গে সমস্বরে উদ্ভট সব শব্দ করা শুরু করল ভিড়ের লোকেরা। উদ্ভট শব্দ রূপান্তরিত হয় ‘ধর এরে মার এরেঞ্চশব্দে। ‘মাথা ফাটাইয়া দে, কাপড় খুইল্যা নে, হাত ভাইঙ্গা ফেলঞ্চশব্দে। স্টলের একজন ‘পুলিশ, পুলিশ কোথায়ঞ্চ বলে চেঁচাচ্ছে, মিনু তাকে দৌড়ে পুলিশ ডেকে আনতে বলেন। পুলিশ ডাকতে যাওয়ার পথ নেই কোনও। স্টল থেকে বেরোবার জন্য সূতো পরিমাণ জায়গা নেই। হঠাৎ ঢিল। একটির পর একটি ঢিল এসে পড়ছে আমার গায়ে। কানের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে, ঘাড়ে পড়ছে, বুকে এসে লাগছে, হাতে লাগছে। আমাকে আড়াল করে ততক্ষণে দাঁড়িয়ে গেছেন শহিদুল আর মিনু। আমি স্তব্ধ বিস্ময়ে হতবাক আর বিবর্ণ হয়ে আছি। বড় বড় ঢিল ছোঁড়া হচ্ছে স্টলের বইয়ের তাকে, বই হুড়মুড় করে পড়ছে নিচে, পাথর পড়ল বাল্বের ওপর, বাল্বের কাচ ছিঁটকে পড়ল আমাদের গায়ে। অন্ধকার হয়ে গেল পুরো স্টল। অনুচ্চ স্বরে স্টলের লোকেরা নিজেদের মধ্যে দ্রুত কিছু বলে নিল। কুলকুল করে ঘামছে এক একজন। এরপর তিনশ লোকের ধাককা স্টলের দিকে। ধাককার চোটে সামনের যে টেবিলের বাধাটি ছিল সেটি ভেঙে পড়ল। পুলিশ থামের মত দূরে দাঁড়িয়ে আছে। এ পা ও এগোচ্ছে না। পুলিশের জন্য অপেক্ষা করার আর সময় নেই। আমার দিকে ধেয়ে আসা লোকেরা যে কোনও মুহূর্তে আমাকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলবে। আমাকে প্রাণে বাঁচাতে গেলে এই মুহূর্তে কিছু একটা করতেই হবে স্টলের লোকদের। মুহুর্তের মধ্যে যে যা পারেন, মেঝেয় মোটা মোটা কাঠ ছিল, বাঁশ ছিল, স্টল বানিয়ে বাড়তি জিনিসগুলো স্টলের ভেতরেই ছিল, সেগুলো দুহাতে তুলে নিয়ে একযোগে ভাঙা টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে ধর ধর বলে ধাওয়া দিল। এক ধাওয়ায় ভিড় পিছিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুটো পুলিশ দৌড়ে এসে আমার চিলের মত ছোঁ মেরে স্টল থেকে বের করে নিল, দুদিকে দুটো পুলিশ আমার দু বাহু শক্ত করে ধরে দৌড়োতে লাগল। পেছন থেকে আরও কিছু পুলিশ আমাকে সামনের দিকে ধাককা দিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। আমার হাতব্যাগ কোথাও পড়ে গেছে, পায়ের জুতোও কোথাও খুলে গেছে, শাড়ি ঝুলছে খুলে, ওই অবস্থাতেই দৌড়ে আমাকে নিয়ে তুলল একাডেমির দোতলায়। আমাকে ভেতরে ঢুকিয়েই পুলিশ বন্ধ করে দিল লোহার দরজাটি। স্টল থেকে একাডেমির মূল দালানটিতে আসার পথের দু পাশে পুরো মেলার লোক ভিড় করে দেখছিল দৃশ্য। দৃশ্যটি নিশ্চয়ই দেখার মত ছিল। দোতলায় তখন আমার গা থরথর করে কাঁপছে। পুলিশেরা কথা বলছেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের সঙ্গে। মহাপরিচালক আমাকে ডেকে নিয়ে কড়া স্বরে বলে দিলেন, আমি যেন আর কখনও ভুলেও বইমেলায় না আসি। বাংলা একাডেমির বইমেলায় সারাজীবনের জন্য আমি নিষিদ্ধ।

যেরকম কালো গাড়ি করে চোর গুণ্ডাদের পাকড়াও করে পুলিশ থানায় নিয়ে যায়, সেরকম গাড়িতে তুলে পুলিশেরা আমাকে শান্তিবাগের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এল। পথে একজন পুলিশ বলল, ‘ধর্ম নিয়ে লেখেন কেন? ধর্ম নিয়ে লিখলে এইরকম কাণ্ড তো হবেই।’ আরেকজন বললেন, ‘আমরা না বাঁচালে আপনাকে আর বেঁচে ফিরতে হত না আজকে।’

খানিক পর শান্তিবাগে খসরু এলেন। শহিদুল হক খান এলেন। মিনু এলেন। সকলেই ঘটনার আকস্মিকতায় স্তম্ভিত। সকলে ফ্রিজ থেকে নিয়ে ঠাণ্ডা পানি খেলেন। মিনু জানালেন তাঁর স্টল পুরো ভেঙে ফেলেছে। বই সব লুট হয়ে গেছে। শহিদুল হক পায়চারি করতে করতে বললেন যে তিনি দেখেছেন হুমায়ুন আজাদ এবং আরও কিছু লেখক দূরে দাঁড়িয়ে ওইসময় চা খাচ্ছিলেন আর কাণ্ড দেখছিলেন। খসরু বললেন যে তিনি ভিড়ের জন্য নিজে তিনি স্টলের দিতে যেতে পারছিলেন না। পুলিশদের তাগাদা দিচ্ছিলেন কিছু একটা ব্যবস্থা করতে কিন্তু তারা মোটেও নড়তে চাইছিল না।

আমি স্তব্ধ বসেছিলাম। চোখের সামনে বারবারই ভয়ংকর দৃশ্যগুলো ভেসে উঠছে আর ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে শরীর। স্টল থেকে ওই হঠাৎ ধাওয়াটি না দিলে কী হত অবস্থা, জিজ্ঞেস করি। কারও মুখে কোনও উত্তর নেই। কী হত, তা তাঁরাও নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারেন।

একুশে ফেব্রুয়ারির আগের রাতে শহীদ মিনার লাল সূর্য আঁকা একটি কাপড় দিয়ে সাজানো হয়। আমার ওপর আক্রমণ হওয়ার ঘণ্টাখানিক আগে মিনারের লাল সূর্যটি পুড়িয়ে দিয়েছে কারা যেন! শহীদ মিনারের সূর্য পুড়িয়ে দেওয়া লোকগুলোই কি ভিড় করেছিল বইমেলার স্টলে, আলো নিভিয়ে দিয়েছিল স্টলের! অন্ধকার করে দিয়েছিল আমার স্বাধীনতার জগতটি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *