নমিতা যে এভাবে দড়ি-ছেঁড়া হয়ে চলে যেতে পারে একথা জলপাইগুড়ির ওরা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। যে নমিতার মুখ দিয়ে কথা বেরোতো না, সেহঠাৎ কিনা স্পষ্ট গলায় বলে বসলো আমি চলে যাবো! বলে বসলো এই দাসত্ব-বন্ধন থেকে মুক্তি চাই!
আশ্রয়দাতাদের কাছে এ কথাটা লজ্জারও বটে দুঃখেরও বটে। সর্বোপরি অপমানেরও।
মামীশাশুড়ী ফেটে পড়লেন, মামাশ্বশুর পাথর, আর দিদিশাশুড়ী গাল পাড়তে শুরু করলেন।
ও হতভাগী নেমকহারামের বেটী, যে মামাশ্বশুর অসময়ে তোকে মাথায় করে এনে আশ্রয় দিয়েছিল, তার মুখের ওপর এতো বড়ো কথা? সে তোকে দানবৃত্তি করাতে এনেছিল? ভেতর ভেতরে এতো প্যাঁচ তোর? বলি যাবি কোন চুলোয় যাবার যদি জায়গা আছে তো এসেছিলি কেন কেতেথ্য হয়ে পড়েই বা ছিলি কেন এতোকাল?
অনিলবাবু ক্লান্ত গলায় বললেন, আঃ মা, থামো! বোমার যদি হঠাৎ এখানে অসুবিধে বোধ হয়ে থাকে, আর তার প্রতিকারের উপায় আমাদের হাতে না থাকে, বাধা দেওয়ার কথা ওঠে না।
মামীশাশুড়ী নমিতার ওই দৃঢ় ঘোষণার পর থেকে সমগ্র সংগারের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলেন, আর তার ভিতরটা ডুকরে ডুকরে উঠছিল, এই সমস্ত কাজ তার ঘাড়েই পড়তে বসলো। নমিতা চলে যাবে মানেই তাকেই বিছানা ছেড়ে উঠত হবে ভোর পাঁচটার সময়, উঠেই গরম জল বসাতে হবে বাড়িসুদ্ধ সকলের মুখ ধোবার জন্যে। হা, হাত-মুখ ধোওয়ার জলও গরম না করে উপায় নেই এ সময়টা, কারণ কালটা শীতল। কেমন বুঝে বুঝে মোক্ষম সময়টিতে চালটি চাললো! কিছুদিন থেকেই বেশ বে-ভাব, দেখা যাচ্ছিল, যেন এই সংসারে কাজ করে সেবা-যত্ন করে তেমন কৃতাৰ্থমন্য ভাব আর নেই, যেন না করলেই নয় তাই! তবু করছিল, সেইগুলি তাঁর ওপর এসে পড়লো, অথচ তার শরীব ভাল নয়–বিশেষ করে শীতকালে মোটেই ভাল থাকে না, বেলা আটটার আগে বিনা ছেড়ে উঠলে সয় না। ওই বেড-টি-টুকু গলায় ঢেলে একটু বল পান। আর এরপর? সেই বেড-টি তাকেই বানাতে হবে, আর সবাইয়ের মুখে মুখে ধরতে হবে। হতে পারে যাদের হাতগুলি মশারির মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসবে গরম পেয়ালাটি ধরতে, তারা তারই স্বামী-পুত্র-কন্যা, কিন্তু শরীরের কাছে তো কিছু না।
কিন্তু শুধুই তো ওইখানেই কর্তব্য শেষ নয়, তারপর জলখাবার বানাতে হবে, তারপর আবার চা বানাতে হবে, সাজিয়ে সাজিয়ে টেবিলে ধরতে হবে, তারপর কুটনো, তারপর রান্না, তারপর পরিবেশন, তারপর দেখতে বসা কার কী দরকার : ঠিক স্কুলে যাবার সময়ই জামার বোতাম ছিঁড়ে গেল, কার বইয়ের ব্যাগের স্ট্র্যাপ জং ধরা, কার প্যান্ট ময়লা, কার গেঞ্জি শুকোয়নি, আরো কত কী!… সেই কুরুক্ষেত্র কাণ্ডের পর চান করে এসে আবার শাশুড়ীর নিরামিষ দিকের রান্নাবান্না। বুড়ী গরমকালে যদিও বা এক আধদিন নিজে দুটো ফুটিয়ে নিতে পারেন, শীতকালে কদাপি না। অথচ এই সময়ই যতো খাবার ঘটা–কশি, মটরশুটি, নতুন আলু, পালংশাক, মুলো, বেগুন-আনাজের সমারোহ। বুড়ীর হাতে-পায়ে শক্তি নেই, হজমশক্তিটি বেশ আছে। নিরামিষ ঘরে রোতই ঘটা চলে। তাছাড়া আবার কারও প্রখর দৃষ্টি, মার সম্যক যত্ন হচ্ছে কিনা।
অতএব শাশুড়ীর রাজভোগটি সাজিয়ে দিয়ে আবার পড়তে হবে বিকেলের জলখাবার নিয়ে। নিত্যনতুন খাবার-দাবার করে করে নমিতা দেবী তো মুখগুলি আর মেজাজগুলি লম্বা করে দিয়েছেন। করবেন না কেন, পরের পয়সা, পরের ভাড়ার–দরাজ হাতে খরচ করে করে সবাইয়ের সুয়ো হওয়া! এখন তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে সরে পড়ার তাল! সাদামাটা জলখাবার, রুটি-মাখন কি লুচি পরোটা আর রুচবে ছেলেমেয়েদের? কে সামলাবে সেই হাপা?
শুধুই কি জলখাবার? রাতে?
একখানি একখানি করে গরম রুটি সেঁকে পাতে দেবার ক্ষমতা তার আছে? না পারলেই বাবু-বিবিদের রুচবে না হয়তো। নমিতা করত এসব। তবুও তো তম্বি-গাম্বির কামাই ছিল না। এসব বদ অভ্যেস নমিতাই করিয়েছে। তার মানে নীরবে নিঃশব্দে মামাশ্বশুরের ভাঁড়ার ফর্সা করেছে, আর মামীশাশুড়ীর ভবিষ্যৎ ফর্সা করেছে! এসব পরিকল্পিত শত্রুতা ছাড়া আর কি?
নমিতাকে দেখে তাই বিষ উঠছে তার।
আর হঠাৎ কেমন ভয়-ভাঙা হয়ে বসে আছে দেখো! বসে আছে শোবার ঘরের ভেতর, তাড়াহুড়ো করে বিকেলের জলখাবারের দিকে এগিয়ে আসছে না!
কেন? কিসের জন্যে?
অসময়ে যে আশ্রয় দেয়, তার বুঝি আশ্রিতের ওপর কোনো জোর থাকে না? যাক দিকি, কেমন যায়?
স্বামীর ওই গা-ছাড়া কথায় তাই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন ভদ্রমহিলা, রুক্ষ গলায় বলে উঠলেন, কেন? বাধা দেওয়ার কথা ওঠে না কেন? হঠাৎ ‘যাবো’ বললেই যাওয়া হবে? হোটেলে বাস করছিস নাকি? তাই এক কথায় আমার এখানে পোষাচ্ছে না বলে চলে যাবো? তুমি বলে দাও, এ সময় তোমার যাওয়া হতে পারে না।
অনিলবাবু মৃদু মানুষ, মৃদু গলাতেই বলেন, অকারণ মাথা গরম কোরো না মৃণাল, বাধা দেবার আমি কে?
তুমি কেউ না?
জোর করবার উপযুক্ত কেউ না!
ওঃ! তাহলে এতদিন এতকাল গলায় বেঁধে বইলে কেন শুনি? মৃণাল চিৎকার করে বলেন, কেউ যদি নও তুমি, তবে এযাবৎ ভাত-কাপড় দিয়ে পুষলে নে? আনতে গিয়েছিলে কেন?
চেঁচামেচি করে লাভ কী মৃণাল, ওই কেন-গুলোর উত্তর যদিও নিজেই ভালোই জান। নীপু রীতা খোকা বীরা সবাই তখন ছোট, তোমার শরীর খারাপ, মা পড়লেন অসুখে, সে সময় বিজুর সন্ন্যাসী হয়ে চলে যাওয়া, আমাদের কাছে ভগবানের আশীর্বাদের মতই লাগেনি কি?
মৃণালিনী চাপা তীব্র গলায় বলেন, ওঃ! তার মানে উপকার শুধু আমাদেরই হয়েছিল, ওর কিছু না?
তা কেন! উপকার পরস্পরেরই হয়েছিল, কিন্তু উনি যদি এখন এই জীবনে ক্লান্ত হয়ে ওঠেন, বলার কী আছে বল?
চমৎকার! কিছুই নেই? বয়সের মেয়ে, তেজ করে একা চলে গিয়ে কোথায় থাকবে, কী করবে, সেটা দেখবার দায়িত্ব নেই তোমার? তুমি ওর একটা গুরুজন নয়?
অনিলবাবু মৃদু হেসে বলেন, গুরুজনের ততোক্ষণই গুরুদায়িত্ব মৃণাল, লঘুজন যতক্ষণ গুরু-লঘু জ্ঞানটুকু রাখে। তারা যদি সে জ্ঞানটার উপদেশ মানতে না চায়, তখন আর কোন্ দায়িত্ব? নাবালিকা তো নয়?
আমার মনে হচ্ছে ভিজে বেড়ালের খোলসের মধ্যে থেকে তলে তলে কারুর সঙ্গে প্রেম ট্রেম চালিয়ে
আঃ মৃণাল থামো।
বেশ থামছি। তবে এটা জেনো, আমাকে থামিয়ে দিলেও পাড়ার লোককে থামাতে পারবে না।
এর সঙ্গে পাড়ার লোকের সম্পর্ক কী?
আছে বৈকি সম্পর্ক। পাড়ার লোকের সঙ্গে সব কিছুই সম্পর্ক থাকে। তারা ভাবতে বসবে না, হঠাৎ এমন চলে যাওয়া, ভেতরে নিশ্চয় কিছু ব্যাপার আছে।
ভাবতে বসলে নাচার!
তোমার আর কি! “নাচার” বললেই হয়ে গেল! দুষলে লোকে আমাকেই দূষবে। বলবে, মামীশাশুড়ী মাগী দুর্ব্যবহার করি তাড়িয়েছে।
বললে গায়ে ফোস্কা পড়ে না।
যাদের গায়ে কচ্ছপের খোলস, তাদের পড়ে না, মানুষের চামড়া থাকলে পড়ে।
তাহলে ফোস্কার জ্বালা সইতেই হবে।
হবে! তবু তুমি ওকে বারণ করবে না? একটা সৎ-পরামর্শও দেব না?
ঠিক আছে, দেব। বলেছিলেন অনিলবাবু। এবং নমিতাকে ডেকে বলেছিলেন, আমি বলছিলাম বৌমা, ফট করে চলে না গিয়ে, বরং বিজুকে একটা চিঠি লিখে বিস্তারিত জানিয়ে–
বিস্তারিত লেখবার তো কিছু নেই মামাবাবু।
না, মানে এই তুমি যে আর এখানে থাকতে ইচ্ছুক নও, সেটা জানতে পারলে হয়তো
কিছুই করবে না। নমিতা কষ্টে চোখের জল চেপে বলে, করবার ইচ্ছে থাকলে চিঠি পর্যন্ত লিখতে বারণ করতেন না।
অনিলবাবু মাথা নীচু করেই বলেছিলেন, তা বটে। কিন্তু তোমার এখানে কী কী অসুবিধে হচ্ছে, সেটা যদি একটু বলতে, চেষ্টা করে দেখতাম, তার কিছু প্রতিকার–
এসময় নমিতার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল।
নমিতাও মাথা নীচু করে বলেছিল, অসুবিধে কিছু নেই মামাবাবু, এখানে যে সুবিধেয় ছিলাম, তা নিজের বাড়িতেও থাকিনি কোনোদিন। কিন্তু, একটু থেমে বলেছিল, আসলে এখন শুধু এই প্রশ্নটাই স্থির হতে দিচ্ছে না, এই জীবনটার কোনো অর্থ আছে কিনা!
মামাশ্বশুরের সঙ্গে না-হা ছাড়া কোনো কথা কখনো বলেনি নমিতা, তাই বলে ফেলে যেন থরথর করছিল, তবু বলেছিল।
অনিলবাবু একটু হেসেছিলেন। বলেছিলেন, সে প্রশ্ন করতে বসলে, আমাদের কারো জীবনেরই কি কোনো অর্থ খুঁজে পাওয়া যাবে বৌমা? কিন্তু থাক, আমি তোমায় বাধা দেব না, দ্যাখো যদি অপর কোথাও শান্তি পাও!
অনিলের মা বেজার গলায় বলেছিলেন, নাতবৌ তোর সঙ্গে অতো কি কথা কইছিল রে?
অতো আর কি! এই যাওয়ার কথা!
নিলো তোর পরামর্শ? কু-মতলব ছাড়লো?
আমি তো কোনো পরামর্শ দিতে যাইনি মা, আমরা যে তাকে যেতে বাধা দেব না, সেই কথাটাই জানিয়ে দিলাম।
বা বা! ভ্যালাবে মোর বুদ্ধিমত্ত ছেলে! এই অসময়ে দেশে লোকজনের আকাল, অমন একটা করিৎকর্মা মেয়েকে এক কথায় ছেড়ে দেয় মানুষে?
আমরা ওঁকে ঝি রাখিনি মা! বলে চলে এসেছিলেন অনিলবাবু।
আর তখনই হঠাৎ ওঁর মনে হয়েছিল, কেন নমিতা তার জীবনের অর্থ খুঁজে পাচ্ছে না।
বাড়ির প্রতিটি ছেলে মেয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ-রাগ করে করে নমিতাকে বিধেছিল, আর তাতেই হয়তো নমিতার মনের মধ্যে যেটুকু দ্বিধা আসছিল, সেটুকু মুছে যাচ্ছিল।
শুধু নীপু বলেছিল, যাক, বৌদি তাহলে সত্যিই চলে যাবে? আমাদের স্রেফ মৃণালিনী দেবীর হাতে ফেলে দিয়ে?
তখনই চোখে জল এসেছিল নমিতার। তবু চলে গিয়েছিল নমিতা।
কে জানে জীবনের কোন অর্থ খুঁজে পেতে।
অথচ কত নিশ্চিন্তেই থাকতে পেতো নমিতা, যদি সে জীবনের মানে খুজতে না বেরতো।
জলপাইগুড়ি শহরে অনিলৰাবুর যথেষ্ট মান-সম্মান আছে, সেই বাড়িরই একজন হয়েই তো ছিল নমিতা। কোথাও কারো নেমন্তন্ন হলে অনিলবাবুর স্ত্রী-কন্যার সঙ্গে সমপর্যায়ভূক্ত হয়েই তো যেতে পেতো, দৃষ্টিকটু হবার ভয়ে নিজের বা মেয়ের শাড়ি-গহনা দিয়েই সাজিয়ে নিয়ে যেতেন তাকে মামীশাশুড়ী। আর পাঁচজনের কাছে, এটি আমাদের একটি বৌমা বলে পরিচয়ও দিতেন।
এইখানেই কি অনেকটা দাম পাওয়া গেল না। অনেকটা মান?
তাছাড়া নিজের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নমিতার খাওয়াদাওয়ারও তারতম্য করেননি কোনোদিন ভদ্রমহিলা, যদি কিছু তারতম্য ঘটে থাকে তো সে নমিতা নিজেই ঘটিয়েছে। পোড়াটা, কাচা, ভাঙাটা সে নিজের ভাগেই রেখেছে বরাবর। তা সে যাক, অন্যদিকে তাকিয়ে দেখো, নিরাশ্রয় হয়ে যাওয়া নমিতা কতোবড়া নির্ভরতার একটি আশ্রয় পেয়েছিল, চিরদিনই বজায় থাকতো এ আশ্রয়। তাছাড়া এ বাড়িতে কেউ কোনদিন ‘দুর ছাই’ করেছে তাকে, বলুক দিকি কেউ?
সকলের উপর কথা, কেউ কোনদিন নমিতার কর্তৃত্বের ওপর হস্তক্ষেপ করেছে? বড়োজোর অনিলবাবুর মা কোনোদিন বলেছেন, রোজদিনই ঘটার রান্নাবান্না! পরের পয়সায় হাতধন্যি! একটু বিবেচনা করে কাজ করতে হয় নাতবো!
কোনদিন হয়তো অনিলবাবুর স্ত্রী বলেছেন, এই নমিতাই আমাদের পরকাল খেলো! এরপর আর রাধুনীর রান্না কারুর রুচবেই না! অবিশ্যি রাঁধুনীকে তো আমার হাততোলায় থেকে কাজ করতে হয়, নিজের হাতের বাহাদুরি দেখাবার স্কোপও পায় না।
নমিতা সে স্কোপ পায়। অতএব নমিতা পারে ভাল রান্না রেঁধে হাতের মহিমা দেখাতে। অর্থাৎ নমিতা রান্নাঘর ভাড়ারঘরের সর্বময়ী কর্ত্রী! যদিও আপন স্বভাবের নম্রতায় সে দু’বেলাই জিজ্ঞেস করতো, মামীমা, বলুন কী রান্না হবে?
কিন্তু মামীমা সে-ভার নিতেন না, উদার মহিমায় বলে দিতেন, তোমার যা ইচ্ছে করো বাছা, কী রান্না হবে ভাবতে গেলেই আমার গায়ে জ্বর আসে।
তবে?
এই অখণ্ড অধিকারের মর্যাদার মধ্যেও জীবনের মানে খুঁজে পেল না নমিতা? আর সেই খুঁজে না পাওয়ার খানিকটা ভার আবার চাপিয়ে গেল অনামিকার মাথায়?
অনামিকাই কি পাচ্ছেন সে মানে? মানে–তার নিজের জীবনের মানে?
অতীতের স্মৃতি হাতড়াতে তো জীবন বলতে একটা ভাঙাচোরা অসমান, রং-জৌলুসহীন বস্তুই চোখে পড়ে, তাই বর্তমানের রীতি অনুযায়ী তার কাছে যখন সাক্ষাৎকারীরা এসে সাক্ষাৎকারটা লিপিবদ্ধ করতে চায়, তখন অতীতের স্মৃতিকথা বলতে গিয়ে কোথাও কোনো সম্পদ সম্বল খুঁজে পান না অনামিকা।
অথচ অন্য সকলেরই আছে কিছু-না কিছু। মানে কবি-সাহিত্যিকদের, লেখক-লেখিকাদের। তাঁরা ওদের প্রশ্নে তাই, স্মৃতিচারণের মধ্যে নিমগ্ন হয়ে যান, অথবা স্মৃতিকথার খাতার সিঁড়ি ধরে নেমে যান অনেক গভীরে। যেখানে হাত ডোবালেই মুঠোয় উঠে আসে মুঠোভর্তি মণিমুক্তো।
সেই টলটলে নিটোল মুক্তোগুলি দিয়ে গাঁথা যায় স্মৃতিকথার মালা।
অনামিকার গোপন ভাঁড়ারে মণিমুক্তার বালাই নেই।
তাই কোনো কোনো পত্রিকার বিশেষ ফিচারের তালিকায় যখন অনামিকা দেবীর পালা আসে, তখন প্রশ্নের উত্তর দিতে রীতিমতো বিপদেই পড়ে যান অনামিকা।
হেসে বলেন, আমার মতন জীবন তো বাংলা দেশের হাজার হাজার মেয়ের। তার মধ্যে কেউ সংসার করে, কেউ চাকরি করে, কেউ গান গায়, আমি গল্প লিখি এই পর্যন্ত, এ ছাড়া তোকই বাড়িতে কিছু দেখতে পাচ্ছি না?
ওরা বলে আপনার বড়ো বেশী বিনয়। লেখা মানেই তো তার অন্তরালে অনেক কিছু। কোথা থেকে পেলেন প্রেরণা, উদ্বুদ্ধ হলেন কোন্ যন্ত্রণায়? কার কার প্রভাব পড়েছে আপনার ওপর–?ইত্যাদি ইত্যাদি।
উত্তর দিতে বেশ মুশকিলে পড়তে হয়। এসব কি বলবার কথা না বলার মতো কথা? তবু বকিয়ে মারে।
এই তো সেদিন একটা রোগা নিরীহ চেহারার ছেলে কোন্ এক পত্রিকার তরফ থেকে এনে প্রায় হিমসিম খাইয়ে দিয়েছিল অনামিকা দেবীকে।
বায়না অবশ্য সেই একই, ভাষাও তাই, আমাদের কাগজে তাবৎ সাহিত্যিকের স্মৃতিকথা ছাপা হয়ে গিয়েছে, অথচ আপনারটা এখনো পাইনি।
এটা যে ছেদো কথা তা বুঝতে দেরি হয় না কারোরই। অনামিকার মুখে আসছিল পাওনি নাওনি। কিন্তু মুখে আসা কথাকে মুখের মধ্যে আটকে ফেলতে না পারলে আর সভ্যতা কিসের?
তাই শুধু বললেন, ‘ও।’
ছেলেটি উদাত্ত গলায় বললো, ঠিকানাটা জানা ছিল না কিনা। উঃ, আপনার ঠিকানা যোগাড় করতে কি কম বেগ পেয়েছি! বহু কষ্টে
এবারও অনামিকা বলতে পারতেন, আশ্চর্য তো! অথছ বাজারে কম করেও আমার শ’খানেক বই চালু আছে, অতএব তাদের প্রকাশকও আছে, এবং প্রকাশকের ঘরে অবশ্যই আমার ঠিকানা আছে। তাছাড়া বাজার-প্রচলিত বহু পত্রিকাতেই আমার কলমের আনাগোনা আছে। সেখানেও একটু খোঁজ করলেই ঠিকানাটা হাতে এসে যেতো৷ বেশী খাটতেও হতো না, যেহেতু “টেলিফোন” নামক একটা যন্ত্র মানুষের অনেক খাটুনি বাঁচাবার জন্যে সদাপ্রস্তুত।
কিন্তু বলে লাভ কি?
বেচারী সাজিয়ে-গুছিয়ে একটা জুৎসই কৈফিয়ত খাড়া করে আবেগের মাথায় কথা বলতে এসেছে, ওই আবেগের ওপর বরফজল ঢেলে দিয়ে কি হবে!
তার থেকে খুব আক্ষেপের সুরে বলা ভালো, ইস, তাই তো! তাহলে তো খুব কষ্ট হয়েছে, তোমার।
এবার ওপক্ষের ভদ্রতার পালা, না না, কষ্ট আর কী। শেষ পর্যন্ত যখন দেখা হলো, তখন আবার কষ্টের কথা ওঠে না। এখন বলুন কোন সংখ্যা থেকে শুরু করবেন? সামনের সংখ্যা থেকেই? বিজ্ঞাপন দিয়ে দিচ্ছি–
আরে আরে, কী মুশকিল! কথাটাই শুনি ভাল করে!
বা, বললাম তো আমাদের “জ্যোতির্ময় স্বদেশ’-এর স্মৃতিচারণ সিরিজে
ওটা একটা সিরিজ বুঝি?
হ্যাঁ তাই তো দেখেননি? এ তো প্রায় দু’আড়াই বছর ধরে চলছে। দেশের যত শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের একধার থেকে–মানে একটির পর একটিকে ধরে ধরে–
কথাটা ঠিকভাবে শেষ করতে না পেরেই বোধ হয় ছেলেটি হঠাৎ চুপ করে গেল।
অনামিকার মনে হলো ও বোধ হয় বলতে যাচ্ছিল এক ধার থেকে কোতল করেছি, অথবা একটির পর একটিকে ধরে ধরে হাড়িকাঠে ফেলেছি আর কোপ দিয়েছি। বললো না শুধু সে ভদ্রতার দায়ে। যে দায়ে মুখের আগায় এসে যাওয়া কথাকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আটকে ফেলতে হয়।
তবু অসমাপ্ত কথারই উত্তর দেন অনামিকা, যতো শ্রেষ্ঠদের? কিন্তু তার মধ্যে আমাকে কেন?
এ কী বলছেন! আপনাকে না হলে তো সিরিজ সম্পূর্ণ হয় না! নবীন প্রবীণ মিলিয়ে প্রায় আশিজনের স্মৃতিচারণ হয়ে গেছে–
হঠাৎ ওর স্মৃতিচারণ শব্দটা গোচারণের মত লাগলো অনামিকার। হয়তো ওই ‘আশি’ শব্দটার প্রতিক্রিয়াতেই।
অনামিকার পুলকিত হবারই কথা।
বাংলা দেশে যে এতোগুলি শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক আছেন এ খবরটি পুলকেরই বৈকি। তবে বোঝা গেল না হলেন কিনা পুলকিত। বরং যেন বিপন্নভাবেই বললেন, তবে আর কি, হয়েই তো গেছে অনেক
তা বললে তো চলবে না, আপনারটা চাই।
কিন্তু আমি ত মোটেই নিজেকে আপনাদের ওই শ্রেষ্ঠ-টেষ্ঠ ভাবি না।
আপনি না ভাবুন দেশ ভাবে। ছেলেটির কণ্ঠ উদ্দীপ্ত, আর দেশ জানতে চায় কেমন করে বিকশিত হলো এই প্রতিভা। শৈশব বাল্য যৌবন সব কিছুর মধ্যে দিয়ে কী ভাবে
কিন্তু আমি তো কিছুই দেখতে পাই না, অনামিকার গলায় হতাশা, রেলগাড়িতে চড়ে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ফেলে-আসা-পথটা দেখলে যেমন একজোড়া রেললাইন ছাড়া আর কিছুই বিশেষ চোখে পড়ে না, আমারও প্রায় তাই। একটা বাঁধা লাইনের ওপর দিয়ে চলে আসা। একদা জন্মেছি, একদিন না একদিন মরবোই নিশ্চিত, এই দুটো জংশন স্টেশনের মাঝখানেই ওই পথটি। মাঝখানের স্টেশনে স্টেশনে কখনো কখনো থেমেছি, জিবরাচ্ছি, কখনো ছুটছি।
আপনাদের সঙ্গে কথায় কে পারবে? কথাতেই তো মাত করছেন। কিন্তু আমি ওসব কথায় ভুলছি না। আমি এডিটরকে কথা দিয়ে এসেছি–বিজ্ঞাপন দিন আপনি, আমি ওঁর সঙ্গে সব ব্যবস্থা ঠিক করে ফেলছি।
তুমি তো আমার ঠিকানাই জানতে না, প্রত্যক্ষ দেখোওনি কখনো, এরকম কথা দিলে যে?
ছেলেটি একটি অলৌকিক হাসি হাসলো। তারপর বললো, নিজের ওপর আস্থা থাকা দরকার। যাক, কবে দিচ্ছেন বলুন?
কবে কি? আদৌ তো দিচ্ছি না।
সে বললে ছাড়ছে কে? গোড়ায় অমন সব ইয়ে–মানে সকলেই ঠিক সেই কথাই বলেন,
আমার স্মৃতির মধ্যে আর লেখবার মতো কি আছে? সাধারণ ঘরের ছেলে ইত্যাদি প্রভৃতি যতো ধানাইপানাই আর কি। তারপর? দেখছেন তো এক-একখানি? সকলের মধ্যেই কোনো একদিন-না-একদিন “নিঝরের স্বপ্নভঙ্গ”ঘটেছে, তারই ইতিহাস
আমার বাপু ওসব কিছুই ঘটেনি-টটেনি।
তাই কি হয়? ও তো হতেই হবে। আপনার বিনয় খুব বেশি, তাই চাপছেন। কিন্তু আমাদের আপনি হঠাতে পারবেন না। লেখাটা ধরে ফেলুন।
কী মুশকিল! সত্যিই বলছি, লেখবার মতো কিছুই নেই। মধ্যবিত্ত বাঙালীর ঘরের মেয়ে, সাত-আটটি ভাইবোনের মধ্যে একজন, খেতে-পরতে পেয়েছি, যেখানে জন্মেছি সেখানেই আছি, আশা করছি সেখানেই মরবো, ব্যস এই তো। এর মধ্যে লেখবার কী আছে?
বাঃ, হয়ে গেল ব্যস? মাঝখানের এই বিপুল সাহিত্যকৃতি?
দেখো সেটাও একটা কী বলবো ঘটনাচক্র মাত্র। একদা শখ হলো, লিখবো! লিখলাম, ছাপা হলো। আর তখন দিনকাল ভালো ছিলো, মেয়েদের লেখা-টেখা সম্পাদকরা ক্ষমাঘেন্না করে ছাপতেনও, আবার চাইতেনও। সেই চাওয়ার সূত্রেই আবার নবীন উৎসাহে লেখা, আবার হয়ে গেলো ছাপা, আবার–মানে আর কি, যা বললাম, ঘটনাচক্রের পুনরাবৃত্তি থেকেই তোমাদের গিয়ে ওই বিপুল কৃতি না কি বললে-সেটাই ঘটে গেছে।
তার মানে বলতে চান কোনো প্রেরণা না পেয়েই আপনি–
বলতে চাই কি, বলছিই তো। পাঠক-পাঠিকা এবং সম্পাদক আর প্রকাশক, এরাই মিলেমিশে আমাকে লেখিকা করে তুলেছেন। এছাড়া আর তো কই
ঠিক আছে, ওটা যখন আপনি এড়িয়ে যেতেই চাইছেন, তখন আপনার জীবনের বিশেষ বিশেষ কিছু স্মৃতির কথাই লিখুন। জীবন-সংগ্রামের কঠিন অভিজ্ঞতা, অথবা।
কিন্তু গোড়াতেই যে বললাম “বিশেষ” বলে কিছুই নেই। জীবন-সংগ্রামই বা কোথা? জীবনে কোনদিন পার্টস-হোটলে খাইনি, কোনদিন গামছা ফেরি করে বেড়াইনি, কোনোদিন বাড়িওয়ালার তাড়নায় ফুটপাথে এসে দাঁড়াইনি, রাজনীতি করিনি, জেলে যাইনি, এমন কি গ্রামবাংলার অফুরন্ত প্রাণপ্রাচুর্যের মধ্যে হুটোপাটি করে বেড়াবার সুযোগও ঘটেনি। শহর কলকাতার চার দেওয়ালের মধ্যে জীবন কাটছে, বিশেষ স্মৃতি কোথায়?
ছেলেটা তবুও দমে না। বলে ওঠে, নেই, সৃষ্টি করুন! কলমের যাদুতে কী না হয়!
বানিয়ে বানিয়ে লিখবো? হেসে ফেলেন অনামিকা।
ছেলেটা হাসে না বরং মুখটা গোমড়াই করে বলে, বানিয়ে কেন, আপন অনুভূতির রঙে রাঙিয়ে তুচ্ছ ঘটনাকেই সেই রঙ্গিন আলোয় আলোকিত করে–মানে সবাই যে-কর্মটি করেছেন। ছেলেটা হঠাৎ মুখটা একটু বাকায়, রাংকে সোনা বললেই সোনা! যে যা লিখেছেন, তার কতটুকু সত্যি আর কতটুকু কথার খেলা, সে তো আর আমাদের জানতে বাকি নেই—
অনামিকা হঠাৎ একটু শক্ত গলায় বলে ওঠেন, তাই যখন নেই, তবে আর ওতে দরকার কি?
বাঃ, আমি কি বলছি সকলেই বানিয়ে লিখছেন? বলছি-আপনাদের কলমের গুণে সাধারণ ঘটনাও অসাধারণ হয়ে ওঠে, সাধারণ জীবনও সাধারণোত্তর মনে হয়।
আমার লেখার মধ্যে মেন গুণ থাকবে এ বিশ্বাস আমার নেই বাপু! অনুভূতির রঙ্গে রাঙানো-টাঙানো–নাঃ, ও আমার দ্বারা হবে না।
তার মানে দেবেন না, তাই বলুন?
দেব না বলছি না তো, বলছি পেরে উঠবো না।
তার মানেই তাই। কিন্তু আমাকে আপনি ফেরাতে পারবেন না। আমার তাহলে মুখ থাকবে না। যাহোক কিছু না নিয়ে হাড়িবো না। আপনার শ্রেষ্ঠ বইগুলির নায়ক নায়িকার চরিত্র কাকে দেখে লেখা সেটাই অন্ততঃ লিখুন, ওই ‘আত্মকথা’র সিরিজে ঢুকিয়ে দেওয়া যাবে।
বলার মধ্যে বেশ একটু আত্মস্থ ভাব ফুটে ওঠে ওর।
অনামিকা আবার হেসে ফেলেন, কিন্তু কাউকে দেখে লিখেছি, এটাই বা বললো কে?
ছেলেটি তর্কের সুরে বলে, না দেখলে লেখা যায়?
কী আশ্চর্য! গল্প-উপন্যাস মানেই তো কাল্পনিক।
এটা বাজে কথা। সমস্ত ভালো ভালো লেখকদের শ্রেষ্ঠ চরিত্রগুলিই লোককে দেখে লেখা। শরৎচন্দ্র বিভূতিভূষণ তারাশঙ্কর বনফুল, দেখুন এদের আপনি যদি বলেন, কিছু না দেখে লিখেছেন–
ওকে দেখে মনে হলো যেন অনামিকা ওকে ঠকাতে চেষ্টা করছেন। অনামিকা হাসলেন।
কথাটা ঠিক তা নয়। বললেন অনামিকা, দেখতে তো হবেই। দেখার জগৎ থেকেই লেখার জগৎ। আমি শুধু এই কথাই বলছি-আমি অন্তত কোন বিশেষ একজনকে দেখে, ঠিক তাকে এঁকে ফেলতে পারি না। অথবা সেটা আমার হাতে আসেই না। অনেক দেখে দেখে একজনকে আঁকি, অনেকের কথা আহরণ করে একজনের মুখে কথা ফোটাই, আমার পদ্ধতি এই! তাই হয়তো অনেকেই ভেবে বসে, “আমায় নিয়ে লেখা।” তোমরাও খুঁজতে বসো–দেখি কাকে নিয়ে লেখা। অনামিকা একটু থামেন, তারপর বলেন, জানি না কোন একজন মানুষকে যথাযথ দেখে গল্প লেখা যায় কিনা? শ্রীকান্ত কি যথাযথ? কিন্তু সে যাক, অন্যের কথা আমি বলতে পারবো না, আমার কথাই আমি বলছি–আমি সবাইকে নিয়েই লিখি, অথবা কাউকে নিয়েই লিখি না।
ছেলেটা উত্তেজিত হয়।
ছেলেটা টেবিলে একটা ঘুষি মেরে বলে, তবে কি আপনি বলতে চান, ওই যে আপনার কী যেন বইটা–হ্যাঁ, একাকী বইটার নায়িকার মধ্যে আপনার নিজের জীবনের ছাপ আদৌ পড়েনি?
অনামিকা ঈষৎ চমকান, অবাক গলায় বলেন, একাকী? ও বইটার নায়িকা তো একজন গায়িকা!
তাতে কি? আপনি না হয় একজন লেখিকা! ওটুকু তো চাপা দেবেনই। তা ছাড়া সব মিলছে, সেখানেও নায়িকা আনম্যারেড, এখানেও আপনি
অনামিকা চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ান। মৃদু হেসে বলেন, তবে আর ভাবনা কি? আত্মজীবনী তো লিখেই ফেলেছি। ইচ্ছে হলে ওটাই তোমাদের কাগজে ছাপিয়ে দিতে পার।
তাই? মানে ওই ছাপা বইটা?
তাছাড়া আর উপায় কি? একটা লোকের তো একটাই জীবন। অতএব আত্মজীবনীও দু’দশটা হতে পারে না!
এটা আপনি রাগ করে বলছেন। নাছোড়বান্দা ছেলেটি ধৈর্যের সঙ্গে বলে, হতে পারে আপনার অজ্ঞাতসারেই ওই ছাপটা এসে পড়েছে। লেখকদের এমন হয়
হয় এমন? বলছো?
অনামিকা যেন কাঠগড়া থেকে নামার ভঙ্গীতে হাঁফ ফেলে বলেন, তাহলে তো বাচাই গেল!
আপনি ঠাট্টা করছেন?
আরে ঠাট্টা করবো কেন? স্বস্তি পেলাম, তাই। কিন্তু আর তো বসতে পারছি না, একটু কাজ আছে।
কিন্তু ওই ইঙ্গিতটুকুতেই কি কাজ হয়?
পাগল!
শেষ পর্যন্ত প্রতিশ্রুতি না নিয়ে ছাড়বে নাকি সেই সম্পাদক প্রেরিত ছেলেটি?
শেষ পর্যন্ত রফা–কেন স্মৃতিকথা লিখলাম না—
লিখতে হয়েছিল সেটা অনামিকা দেবীকে। জ্যোতির্ময় স্বদেশ-এর সেই স্মৃতিচারণ সিরিজেই ঢুকিয়ে দিয়েছিল তারা লেখাটা।
কিন্তু লেখাটা কি খুব সহজ হয়েছিল অনামিকার কাছে? কেন লিখলাম না?
আশীজন নবীন এবং প্রবীন লেখক-লেখিকা যা করলেন, তা আমি কেন করলাম না, এটা লেখা খুব সোজা নয়।
কিন্তু অনামিকা কোন্ স্মৃতির সমুদ্রে ডুব দেবেন? কোন স্মৃতির সৌরভে ঘ্রাণ সেবেন?
অনামিকা কি তার সেই ঘষা পয়সার মতো শৈশবটাকে তুলে ধরে বলবেন, দেখো দেখো–কী অকিঞ্চিৎকর! এইজন্যেই লিখলাম না!
তা হয় না। তাই কেন লিখলাম না বলতে অনেকটাই লিখতে হয়।
অথচ সত্যিই বা কেন লিখলেন না?
লেখা কি যেতো না? বকুলের জীবনটাকেই কি গুছিয়েগাছিয়ে তুলে ধরা যেতো না?
নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গের মতো সহসা প্রবল একটা কিছু ঘটে না যাক, কোথাও কি পাথরের ফাটল বেয়ে ঝর্ণার জল এসে আছড়ে পড়েনি?
পড়েছে বৈকি। উঠেছে তার কলধ্বনি।
হয়ত ওই থেকেই দিব্যি একখানা স্মৃতিচারণ হতে পারতো।
কিন্তু নিজের সম্পর্কে ভারী কুণ্ঠা অনামিকার! নিজের সম্পর্কে মূল্যবোধের বড়ই অভাব। একেবারে অন্তরের অন্তস্থলে সেই বকুল নামের তুচ্ছ মেয়েটাকে ছাড়া আর কাউকেই দেখতে পান না।
নিন্দা-খ্যাতি প্রশংসা-অপ্রশংসার মালায় মোড়া অনামিকা দেবী সেই বকুলটাকে আশ্রয় নিয়ে রেখেছেন মাত্র। আবৃত করে রেখেছেন তার তুচ্ছতাকে।
তাই অনুরোধ উপরোধের ছায়া দেখলেই ঠেকাতে বসেন।
কিন্তু কেন এই নুরোধ-উপবোধ?
কেন ওই আশীজনের পর আরও শীজনের জন্যে ছুটোছুটি?
কোথাও কোনোখানে কি শ্রদ্ধা আছে? আছে, আগ্রহ-ভালবাসা সমীহ?
যদি থাকে, তবে কেনই বা বার বার মনে হয়, ওই সিরিজ আর ফিচার, সাক্ষাৎকার আর সমাচার, স্বাক্ষরসংগ্রহ আর অভিমত-কী মূল্য এসবের? ব্যবসায়িক মূল্য ছাড়া?
এযুগে কোথায় সেই প্রতিভার প্রতি মোহ? জ্যেষ্ঠজনের প্রতি শ্রদ্ধা? পণ্ডিতজনের কথার প্রতি আস্থা?
এ যুগ আত্মপ্রেমী।
ওই যে রোগা-রোগা কালো-কালো ছেলেটা, যে নাকি নাছোড়বান্দার ভূমিকা নিয়ে এতোক্ষণ বকিয়ে গেল, সে কি সত্যিই এই সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে অনামিকা দেবী নামের লেখিকাটিকে বুঝতে চেষ্টা করেছিল? তার বক্তব্যের মধ্যেকার সুরটি শুনতে চেয়েছিল? অন্তত তাকিয়েছিল কৌতূহলের দৃষ্টিতে?
পাগল না ক্ষ্যাপা।
যা করতে এসেছি তা করে ছাড়বো, এ ছাড়া আর কোন মনোভাবই ছিল না ওর। আর ওদের ওই জ্যোতির্ময় স্বদেশ-এর পৃষ্ঠায় যাদের নাম সাজিয়ে রেখেছে আর রাখতে চাইছে, তাদেরই যে ধন্য করেছে, এমন একটি আত্মসন্তুষ্টি ছিল ওর মধ্যে। ছিল, আছে, থাকবে।
বিশেষ করে মহিলা লেখিকাঁদের ব্যাপারে জাতে তুলছি ভাবটি বিদ্যমান থাকে বৈকি।
না থাকবেই বা কেন, যুগযুগান্তরের সংস্কার কি যাবার?
ছেলেটা চলে যাবার পর অনামিকা টেবিলের ধারে এসে বসলেন। বেশ কিছুদিন থেকে একটা উপন্যাসের প্লট মনের মধ্যে আনাগোনা করছে, তার গোড়া বাধা স্বরূপ সেদিন পাতা দুই লিখে রেখেছিলেন, সেটাই উল্টে দেখতে ইচ্ছে হলো। আজ মনে হচ্ছে কোথাও যাবার নেই, লেখাটা খানিকটা এগিয়ে ফেলা যেতে পারে।
খাতাটা টেনে নিয়ে চোখ বুলালেন…- যে জীবনের কোথাও কোনো প্রত্যাশা নেই, নেই কোনো আলো, আশা, রং, সে জীবনটাকেও বাঁচিয়ে রাখার জন্যে কেন এই আপ্রাণ প্রয়াস? পৃথিবীতে আরো কিছুদিন টিকে থাকার জন্যে কেন এই ঝুলোঝুলি?…ডাক্তার চলে যাবার পর বিছানার ধারের জানলা দিয়ে পড়ন্ত বিকেলের আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রৌঢ় শিবেশ্বর খাস্তগীর একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেললেন, তবে কি মানুষের সব চেয়ে বড়ো প্রেমাস্পদ এই পৃথিবীটাই? সবখানের সব আশ্রয় ভেঙে গুড়ো হয়ে গেলেও, জীবনের সব আকর্ষণ ধূসর হয়ে গেলেও, এই পৃথিবীটাই তার অনন্ত আকর্ষণের পসরা সাজিয়ে নিয়ে বলে, কেউ না থাকুক, আমি তো আছি! আর তুমিও আছ। আমি আর তুমি এইটুকুই কি কম? এইটুকুই তো সব। তুমি আর আমির মধ্যেই তো সমস্ত সম্পূর্ণতা, সব কিছু স্বাদ।
হয়তো তাই। তা নইলে আমিই বা কেন এখনো ডাক্তার ডাকছি, ওষুধ খাচ্ছি, সাবধানতার সব বিধি পালন করছি? সে কি শুধু আমার অনেক পয়সা আছে বলে? এই অপরিমিত পয়সা থাকলে কি আমি বাঁচবার চেষ্টায়–
আর লেখা হয়নি। টেলিফোনটা ডেকে উঠলো। যেমন সব সময় ডাকে–চিন্তার গভীর থেকে চুলের মুঠি ধরে টেনে এনে খোলা উঠোনে আছাড় মারতে।
তবু খুব শান্ত গলায় প্রশ্ন করতে হয়, আপনি কে বলছেন? হ্যাঁ, আমি অনামিকা দেবী কথা বলছি। কী বললেন? নাম? মেয়ের? ইস! ছি ছি, একদম ভুলে গেছি। নানা কাজে এমন মুশকিল হয়– লজ্জায় কুণ্ঠায় যেন মরে যেতে হয়, আপনি যদি দয়া করে কাল সকালে একবার–কালই নামকরণ উৎসব? ও হো! তারিখটা ডায়েরিতে লিখে রাখতে বলেছিলেন? হা, সত্যি এখন সবই মনে পড়ছে। মানে লিখে রেখেওছি, খুলে দেখা হয়নি। আচ্ছা আপনি বরং আজই সন্ধ্যের দিকে আর একবার কষ্ট করে নয়তো আপনার ফোন নাম্বারটাই…বাড়ি থেকে বলছেন না? আচ্ছা তাহলে আপনিই–
টেলিফোনটা নামিয়ে রেখে একটা হতাশ নিঃশ্বাস ফেললেন। যেন প্রতিশ্রুতি দিয়ে মহাজনের ঋণশোধ করে উঠতে পারেননি। অন্ততঃ কণ্ঠে সেই কুণ্ঠা। না ফুটিয়ে উপায়ও নেই। সৌজন্যের উপরই তো জগৎ।
ভুলে সত্যিই গিয়েছিলেন, এখন মনে পড়লো, ভদ্রলোক তার নবজাতা কন্যার নামকরণের জন্য আবেদন জানিয়ে আবেগ-মুগ্ধ-কন্ঠে বলেছিলেন, আর সেই সঙ্গে আশীর্বাদ করবেন, যেন আপনার মতো হতে পারে।
এহেন কথা ভুলে গেলেন অনামিকা?
খারাপ, খুব খারাপ! অথচ সত্যিই লিখে রেখেছিলেন। ভাগ্যিস রেখেছিলেন। খুলে দেখলেন, আরো অনেক প্রতিশ্রুতি দেওয়া রয়েছে। শুধু অদেখা ভদ্রলোকের মেয়ের নামকরণই নয়, পাড়ার ছেলেদের হাতে-লেখা পত্রিকার নামকরণ করে দিতে হবে!…তাছাড়া পাড়ার সরস্বতী পুজোর স্মারক পত্রিকার জন্য শুভেচ্ছা, সবুজ সমারোহ ক্লাবের রজত জয়ন্তী স্মারক পত্রিকার জন্য ছোট গল্প, ভারতীয় চর্মশিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মীবৃন্দের রিক্রিয়েশান ক্লাবের বার্ষিক উৎসবের স্মারক পত্রিকার জন্য চর্মশিল্পের উপর যাহোক একটু লেখা, নিভাননী বালিকা বিদ্যালয়ের চল্লিশ বৎসর পূর্তি উপলক্ষে একটি সময়োপযোগী প্রবন্ধ …প্রধানা শিক্ষিকার চেহারাটি মনে পড়ে গেল অনামিকার, গোল গোল কালো-কালো চেহারা, কালো চোখ দুটিও পরিপাটি গোল, সেই চোখ দুটি বিস্ফারিত করে চাপা গলায় বলেছিলেন ভদ্রমহিলা, আপনি বলছেন ছেলেগুলোকে নিয়েই যতো গণ্ডগোল, মেয়ে-স্কুলে তবু শান্তি আছে? ভুল-ভুল অনামিকা দেবী, এটি আপনার সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। প্রাইমারি সেকশন বাদ দিলে, সাড়ে চারশো মেয়ে নিয়ে ঘর করছি, বলবো কি আপনাকে, যেন সাড়ে চারশোটি ফণা তোলা কেউটে! কথা বলতে যাও কি একেবারে ফোঁস! কীভাবে যে নিজের মানটুকু বাঁচিয়ে কোনোমতে স্কুল চালিয়ে চলেছি, তা আমিই জানি।…এর মধ্যে থেকেই আবার সবই করতে হচ্ছে। মেয়েদের আবার এই চল্লিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে কিছু ঘটা-পটা হোক। মানে নাচ গান অভিনয় কমিক, অথচ আজকাল মেয়ে-স্কুলে ফাংশান করা যে কি দারুণ প্রবলেম! মেয়েরা জানে সবই, বুঝেও বুঝবে না। গেলবারের, মানে এই গত পুজোর সময় মেয়েরা একটা সোস্যাল করলো, জানতে পেরে পাড়ার ছেলেদের সে কি হামলা! বলে কিনা আমাদের দেখতে দিতে হবে।…বুঝুন অবস্থা! ওরা তো আর দুষ্ট ছেলে নেই, পুরো গুণ্ডা হয়ে উঠেছে, বুঝিয়ে তো পারা যায় না। শেষে ওদের দলপতিকে আড়ালে ডেকে হাত জোড় করে বলতে হলো, বাবা, তোমাদের কথা রাখলে কি মেয়েদের গার্জেনরা আমাদের স্কুল আস্ত রাখবেন? হয়তো আইন-আদালত হবে, হয়তো এতোদিনের স্কুলটাই উঠে যাবে। এদিকে ভালো বলতে তো এই একটাই মেয়ে-স্কুল? তোমাদেরই বোনেরা ভাইঝি-ভাগ্নীরা পড়তে আসে..ইত্যাদি অনেক বলায় কী ভাগ্য যে বুঝলল। কথাও দিলো ঠিক আছে…কিন্তু বলুন, বারে বারে কি এ রিস্ক নেওয়া উচিত? মেয়েরা শুনবে না। আপনাকে বলবো কি, মনে হয় বেশীর ভাগ মেয়েই যেন চায় যে, বেশ হামলা-টামলা হোক, হৈচৈ কাণ্ড বাধুক একটা, ওই ৩ ছেলেগুলোর সঙ্গে মুখোমুখি একটা দহরম-মহরম হোক! এ কি সর্বনাশা বুদ্ধি বলুন? তাই বলছি, মেয়েদের যাতে একটা শুভবুদ্ধি জাগ্রত হয়, সেই মতো একটি সুন্দর করে লেখা প্রবন্ধ আমাদের সুভেনীরের জন্যে দিতে হবে আপনাকে।
অনামিকা দেবী বোধ হয় বলেছিলেন, আপনারা সর্বদা এত চেষ্টা করছেন, সামান্য একটা প্রবন্ধের দ্বারা কি তার থেকে বেশী হবে?
মহিলা আবেগ-কশিত গলায় খুব দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, হলে আপনার কথাতেই হবে। আপনাকে বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা যে কী ভালবাসে
অনামিকা কি তখন মনে মনে একটু হেসেছিলেন? ভেবেছিলেন কি জ্ঞানচৈতন্য দেবার চেষ্টা করি না বলেই হয়তো একটু ভালোবাসে। সে চেষ্টা শুরু করলে
কিন্তু সে হাসিটা তো প্রকাশ করা যায় না।
সাহিত্যিকের দায়িত্ব নাকি ভয়ানক গভীর; সমাজের ওঠা-পড়ার অদৃশ্য সূত্রটি নাকি তাদেরই হাতে। তবে শুধু তো নিভাননী বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকাই নয়, এ ধ্বনি তা সর্ব সোচ্চার। অথচ–অতো কথায় পরও অনামিকা দেবী কিনা সেই গুরুদায়িত্বের কণিকাটুকু পালনের কথাও শ্রেফ ভুলে বসে আছেন?
দেখলেন ওঁদের চল্লিশপুর্তির উৎসবের আর মাত্র ষোল দিন বাকি, আজই অতএব দিতে পারলে ভালো হয়। ছাপবার সময়টুকু পাওয়া চাই ওদের।
বাকি সবগুলোই হয়তো আজকালই চেয়ে বসবে। কী করে যে ভুলে বসে আছেন অনামিকা দেবী!
দেওয়া উচিত।
উপন্যাসের প্লটটা সরিয়ে রাখতেই হলো। হয়তো আরো অনেক দিনই রাখতে হবে। এগুলো শেষ হতে হতে আরো কিছু কিছু এসে জমবে তো।
অথচ অহরহ একটা অভিযোগ উঠছে আজকের দিনের কবি-সাহিত্যিকদের বিরুদ্ধে, কেউ নাকি আর মননশীল লেখা লিখছেন না। সবই নাকি দায়সারা, এবং টাকার জন্যে। আগেকার লেখকরা লিখতেন প্রাণ দিয়ে মন দিয়ে, সমগ্র চেতনা দিয়ে, আর এযুগের লেখকরা লেখেন শুধু আঙুলের ডগা দিয়ে!..হা, ওই ধরনেরই একটা কথা সেদিন কোন্ একটা কলেজের সাহিত্য আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দিয়ে বসে বসে শুনতে হয়েছিল অনামিকা দেবীকে, ছাত্রসভায় সদস্যদের আবেগ-উত্তপ্ত অভিযোগ ভাষণ।
দোষ স্বীকার করতেই হয়েছিল নতমস্তকে, নইলে কি বলতে বসবেন, আর কোন যুগে এযুগের মতো সাহিত্যকে সবাই ভাঙিয়ে খাচ্ছে? সমাজের আপাদমস্তক তাকিয়ে দেখো, সাহিত্যিকই আজ সকলের হাতিয়ার। আর তাদের হাতে রাখতে কত রকমের জালবিস্তার। টাকার টোপ, সম্মানের টোপ, পুরস্কারের টোপ, ক্ষমতার টোপ ছড়িয়ে রাখা আছে সমাজ সরোবারের ঘাটে ঘাটে। তা ছাড়া এই অনুরোধের বন্যা!
তবে কোন নিরালা নিশ্চিন্ততায় বসে রচিত হবে মননশীল সাহিত্য? ভরসা শুধু নতুনদের।
যাদের ভাঙিয়ে খাবার জন্যে এখনো সহস্র হাত প্রসারিত হয়নি। কিন্তু সে আর ক’দিন? যেই একবার সুযোগ-সন্ধানীদের চোখে পড়ে যাবে, ওর কলম বলি, ওঁর মধ্যে সম্ভাবনা–তবুনি তো হয়ে যাবে তার সম্ভাবনার পরিসমাপ্তি। তার সেই বলিষ্ঠ কলমকে কোন্ কোন কাজে লাগানো যায়, সেটাই হবে চিন্তণীয় বস্তু।
যদি আজ-কাল, পরশু-তরশু, তার পরদিন শুধু লেখাটা লিখতে পেতাম! জীবনের সব মূল্য হারিয়েও বেঁচে থাকার চেষ্টাটা যার অব্যাহতি, সেই ব্যাধিগ্রস্ত ঐেঢ় শিবের খাদ্যগীরের কাহিনীটা!
একটা নিঃশ্বাস ফেলে নিভাননী বালিকা বিদ্যালয়ের বালিকাঁদের জ্ঞানদানের খসড়াটা তৈরী করতে করতে কয়েকটা নাম লিখে রাখলেন একটুকরো কাগজে। শুনতে মিষ্টি অথচ অসাধারণ, কেউ কোনোদিন মেয়েদের তেমন নাম রাখেনি এমন দুরূহ, মহাভারতের অপ্রচলিত অধ্যায় থেকে, অজানা কোনো নায়িকার এমনি গোটাকয়েক।
কোনোটাই হয়তো রাখবে না, নিজেরাই নিজেদের পছন্দে রাখবে, তবু অনামিকার–কর্তব্যটা তো পালন করা হলো।
কিন্তু কলম নামিয়ে রেখে ভাবতে বসলেন কেন অনামিকা?
কার কথা? সেই মেয়েটার কথা কি?
যার কথা বাড়িতে আর কেউ উচ্চারণ করছে না। না, সেই বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া মেয়েটার নাম বাড়িতে আর উচ্চারিত হয় না। তাকে খুঁজে পাবার জন্যে তলায় তলায় যে আপ্রাণ চেষ্টা চলছিল সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে।
সংসারে যেন একটা কৃষ্ণ যবনিকা পড়ে গেছে সেই নামটার ওপর। সেই প্রাণচঞ্চল বেপরোয়া দুঃসাহসী মেয়েটার মৃত্যু ঘটে গেছে।
অথচ-খুব গভীরে একটা নিঃশ্বাস পড়লো অনামিকার, অথচ ওকে যদি অন্তত ওর মাও বুঝতে পারতো! পারেনি। ছোট্ট থেকে ও যে অভিভাবকদের ইচ্ছের ছাঁচে ঢালাই না হয়ে নিজের গড়নে গড়ে উঠেছে, এই অপরাধেই তিরস্কৃত হয়েছে। ওর কাছে সত্যের যে একটা মূর্তি আছে, সেই মূর্তিটার দিকে কেউ তাকিয়ে দেখেনি, সেটাকে উচ্ছৃঙ্খলতা বলে গণ্য করেছে।
অথচ অনামিকা? বাড়িতে আরো কতো ছেলেমেয়ে, তবু বরাবর তার নারীচিত্তের সহজাত বাৎসল্যের ব্যাকুলতাটুকু ওই উদ্ধত অবিনয়ী বেপরোয়া মেয়েটাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে।