পাঁচ বৎসর বয়েসে, সরস্বতী পূজার দিনে নবীনকুমারের হাতেখড়ি হলো। এই উপলক্ষে বেশ ধুমধাম হলো সিংহ সদনে।
বিম্ববতীর পিত্ৰালয়ের কারুর শিক্ষার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। তাঁর শ্বশুর স্বামীও বিদ্যাচচাঁ না করেও প্রভূত বিষয়সম্পত্তির অধিকারী হয়েছেন। কিন্তু বিম্ববতীর দত্তকপুত্ৰ গঙ্গানারায়ণ প্রধানত স্বীয় যত্নে আজ কৃতবিদ্য এবং এই বিদ্যার গুণে সে বিনয়ী, সুশীল ও ধীরস্থির। গঙ্গানারায়ণকে প্রীতি করে না, এমন কেউ নেই। বিম্ববতী পুত্ৰগর্বে গর্বিত এবং গঙ্গানারায়ণের চরিত্রের ক্রম পরিণতি দেখেই তিনি বিদ্যাচাচা সম্পর্কে আকৃষ্ট হয়েছেন।
হিন্দু কলেজের পাঠ সমাপ্ত করে গঙ্গানারায়ণ এখন বিধুশেখরের নির্দেশ মতন পারিবারিক ব্যবসায় ও জমিদারির কাজে শিক্ষিত হচ্ছে। রামকমল সিংহ তো সব দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়ে গেছেন, কমলাসুন্দরীকে নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়েছেন উত্তরভারত পরিভ্রমণে, গত পাঁচ মাস তাঁর কোনো সংবাদই নেই। যত দূর জানা যায়, তিনি বারানসীতে এক বিশাল প্রাসাদ ভাড়া নিয়ে নৃত্যগীতের আসরে মত্ত হয়ে আছেন।
বিম্ববতী দেখেছেন, কর্তাদের ধারা কিছুই বতায়নি। গঙ্গানারায়ণের ওপরে। সে সুরা পান করে না। সন্ধ্যার পর জুড়িগাড়ি হাঁকিয়ে গৃহ থেকে নিৰ্গত হয়ে ভোররাত্রে বাড়ি ফেরার যে রীতি, গঙ্গানারায়ণ তেমনটি করেনি একদিনও। যথা সময়ে অফিস দেখতে যায় এবং সন্ধ্যার পর বিদ্বান বন্ধুদের সঙ্গে নানাপ্রকার তর্কে মেতে থাকে। এ গৃহের মজলিশকক্ষে এখন আর নূপুরের নিক্কন কিংবা বোতল-গোলাসের ঠিনৎকার শোনা যায় না, বরং গঙ্গানারায়ণের বন্ধুরা সেখানে নানা রকম কেতাব থেকে উচ্চেকণ্ঠে পাঠ করে পরস্পরকে শোনায়।
বিধুভুষণও গঙ্গানারায়ণের ওপরে খুব সন্তুষ্ট। হিন্দু কলেজে পাঠ নিয়েও সে ফিরিঙ্গি বনে যায়নি কিংবা দেবেন্দ্র ঠাকুরের হুজুগে দলে গিয়ে ভেড়েনি। তাছাড়া ইতিমধ্যেই দুবার জমিদারি মহল পরিদর্শন করতে গিয়ে সে যথেষ্ট নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছে এবং সুবন্দোবস্ত করে এসেছে।
বিম্ববতী চান, নবীনকুমারও তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে অনুসরণ করুক। কর্তারা যা বিষয়-বৈভব করে গেছেন, তাতে এদের সাত পুরুষ বিনা পরিশ্রমে চালিয়ে যেতে পারবে। সুতরাং বিষয় না দেখে যদি শুধু বিদ্যাচচাঁ কিংবা ধমানুশীলনেও মেতে থাকে তাতে অন্তত সংসারের শান্তি আসবে। দুই ভ্ৰাতায় খুব ভাব। নবীনকুমারের জন্মের পর যে শঙ্কা বিম্ববতী ও তাঁর স্বামীর মনে জেগেছিল, তা অমূলক প্রতিপন্ন হয়েছে। গঙ্গানারায়ণ তার কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে অতিশয় ভালোবাসে। আর নবীনকুমারও যতই দুরন্তাপনা করুক, সে গঙ্গানারায়ণের খুবই বশবর্তী এবং এক একদিন সে গঙ্গানারায়ণের বন্ধুদের তর্কসভায় গিয়ে চুপটি করে বসে থাকে।
নবীনকুমারের শিক্ষা সম্পর্কে বিম্ববতী বিধুশেখরের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। এ গৃহে বিধুশেখর নিত্য আসেন এবং পরপুরুষদের মধ্যে একমাত্র সরাসরি বিধুশেখরের সঙ্গেই কথা বলেন বিম্ববতী। যখন নবম বৰ্ষীয়া কন্যা, সেই সময় নববধূ হয়ে এই বাড়িতে এসেছিলেন বিম্ববতী, আজ তাঁর বয়স প্রায় ত্রিশ বৎসর, এই সুদীর্ঘকাল কত সুখ-দুঃখের কথা হয়েছে বিধুশেখরের সঙ্গে। গত কয়েক বৎসর তো স্বামীর সঙ্গে বিম্ববতীর প্রায় দেখাই হয় না। তা নিয়ে অবশ্য কোনো ক্ষোভ প্ৰকাশ করেন না বিম্ববতী, কারণ, যেটুকু সময় রামকমল সিংহ গৃহে থাকেন, তখন তিনি যেন বিম্ববতীর দাসানুদাস। গদগদ কণ্ঠে বলেন, বিম্ব, তুমি আমার লক্ষ্মী, তুমিই আমার জগদ্ধাত্রী, তোমার জন্যই আমার এত সব হয়েচে। তুমি যদি রাগ করো তো বলো, আমি বাড়ির বাইরে এক পা যাবো না। তবে, আমায় আর বিষয় দেখতে বলো না! আর যে কটা দিন বেঁচে আচি.। সঙ্গে সঙ্গে বিম্ববতী বলেন, ওগো, না, না, তোমার যা মন চায়। তাই তুমি কর্বে.।
বিধুশেখরের মত এই যে, নবীনকুমার গৃহেই বিভিন্ন শিক্ষকের কাছে বিদ্যাভ্যাস করুক। সংস্কৃতের সঙ্গে সঙ্গে সে ইংরাজীও শিখবে বইকি, কিন্তু সেজন্যে তাকে সাহেব শিক্ষকদের স্কুলে পাঠাবার দরকার নেই। আজকাল ভদ্র ঘরের অনেক যুবকও ইংরাজী শিখেছে, গঙ্গানারায়ণের বন্ধুদের মধ্যেও তো দু-একজন গরীব অথচ মেধাবী ছাত্ৰ আছে, তাদেরই কারুর ওপর ভার দেওয়া যেতে পারে। বিম্ববতীর তাতে কোনো আপত্তি নেই।
হাতেখড়ির দিন দীক্ষাচার্য হিসেবে বিধুশেখর তিনজন বিশিষ্ট ব্ৰাহ্মণকে আনাবার ব্যবস্থা করলেন। আজকাল অবশ্য প্রকৃত ব্ৰাহ্মণ খুঁজে পাওয়া ভার। পয়সার লোভে অনেক ব্ৰাহ্মণই বিবেক ধর্মবিসর্জন দিয়ে ধনীদের খোসামোদ করে।
সংস্কৃত কলেজের সেক্রেটারী বাবু রসময় দত্ত বিধুশেখরের বন্ধুস্থানীয়। বাঙালী বা ভারতীয়দের মধ্যে বোধ হয় তিনিই সবোচ্চ সরকারি কর্মে নিযুক্ত, তাঁর বেতন নব্ববুই টাকা। সাহেবদের কাছে রসময় দত্তের খুব প্রতিপত্তি। কিন্তু রসময় দত্ত ব্ৰাহ্মণ নন, তাঁকে আচার্যকরা যায় না। সুতরাং ঐ কলেজেরই অ্যাসিস্ট্যাণ্ট সেক্রেটারী বৃদ্ধ রামমাণিক্য বিদ্যালঙ্কারকে একজন আচার্য হিসেবে মনোনয়ন করলেন বিধুশেখর। রসময় দত্তই বললেন, আর একজনের কথা, তাঁর নাম দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। এই মানুষটির সঙ্গে কথাবার্তা বলে বিধুশেখর মুগ্ধ হলেন। দুর্গাচরণ সত্যিই বিচিত্র প্রকৃতির মানুষ, ইংরাজী ও সংস্কৃত দুই ভাষাতেই বিশেষ দক্ষতা আছে, এক সময় হেয়ার সাহেবের স্কুলে শিক্ষকতা করতেন, তারপর হঠাৎ শিক্ষকতা ছেড়ে মেডিক্যাল কলেজে ছাত্র হিসেবে ভর্তি হলেন। চিকিৎসাবিদ্যা উত্তমরূপে শিক্ষা করার পর তিনি দুঃস্থ-আতুর মানুষদের চিকিৎসায় সাহায্য দেন। আবার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের হেড রাইটার হিসাবেও নিযুক্ত। ইংরাজদের শিক্ষা-বিজ্ঞান আহরণ করেও এর চালচলন খাঁটি দেশীয়দের মতন, এই প্রকার মানুষই বিধুশেখরের পছন্দ। এই দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় থাকেন তালতলায়, তাঁর বাড়িতেই বিধুশেখরের পরিচয় হলো আর একজনের সঙ্গে। একেই তিনি তৃতীয় আচার্য হিসেবে মনোনীত করে ফেললেন। ইনি মেদিনীপুরের ব্ৰাহ্মণ, বয়েসে যুবক এবং বিশিষ্ট পণ্ডিত হিসেবে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছেন। এর নাম ঈশ্বরচন্দ্ৰ বন্দ্যোপাধ্যায়। কিছুকাল আগে সংস্কৃত কলেজ থেকে বিদ্যাসাগর পদবী পেয়েছেন, ইদানীং ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে প্ৰধান পণ্ডিতের কাজ করেন। যুবকটির চেহারা কদাকার। কিন্তু মুখমণ্ডলে আত্মাভিমানের ছাপ প্রকট।
বিধুশেখরের সঙ্গে পরিচয় হতেই ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, মহাশয়কে আমি বিলক্ষণ চিনি। আপনার স্মরণ নাই, কিন্তু আপনার বাড়িতে গিয়ে একদিন এমন ভূরিভোজ খেতে হয়েছিল যে আজও সেকথা মনে এলে আতঙ্ক হয়। সে আপনার এক কন্যার বিবাহের সময়, আমাদেরই এক সতীর্থ আপনার জামাতা। বরযাত্রীদের খাওয়াইয়ে খাওয়াইয়ে প্ৰাণে মেরে ফেলার চেষ্টাই বুঝি আপনাদিগের রীতি?
বিধুশেখর উচ্চহাস্য করে উঠেছিলেন।
কিছুক্ষণ রঙ্গালাপের পর বিধুশেখর অত্যন্ত বিনয় সহকারে বলেছিলেন, পণ্ডিতপ্রবর, এই বাগদেবীর পূজায় যদি আমার বন্ধু রামকমল সিংহের গৃহে পদধূলি দেন, তবে আমি ধন্য হই! বন্ধুর একটি পঞ্চম বৰ্ষীয় সুলক্ষণ পুত্ৰ আছে, সে আমারও পুত্ৰবৎ, আপনারা সেইদিন তাহাকে আশীর্বাদ কল্লে সে জ্ঞানপথের পথিক হতে পারে।
দুর্গাচরণ বললেন, সেদিনও ভূরিভোজনের ব্যবস্থা থাকবে তো?
ঈশ্বরচন্দ্ৰ বন্ধুকে বললেন, ঔদরিক! অমনি বুঝি নোলা শক শক করে উঠলো?
দুর্গাচরণ বললেন, ভাই, বামুনের ছেলে উত্তম আহারের সম্ভাবনা দেখলে চাঞ্চল্য ঘটবে না, একি একটা কথা হলো? বংশের অবমাননা হবে যে!
ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিধুশেখরকে বললেন, এই উপলক্ষে বামুন পণ্ডিত ডাকছেন যখন, তখন শাল দোশালা বিদায় দেবেন নিশ্চয়?
বিধুশেখর বললেন, আজ্ঞে, সে তো আমাদের প্রথাই রয়েচে!
ঈশ্বরচন্দ্ৰ আবার বললেন, আর সোনাদান?
দুর্গাচরণ হাসতে হাসতে বললেন, ঈশ্বর, তুমি বোধ হয় জানো না, রামকমল সিংহী কত বড় ধনী। তেনার মনটাও খুব খোলসা শুনিচি! সোনাদোনা দিয়ে তোমায় ভরিয়ে দেবেন।
বিধুশেখর বললেন, আমি এইটুকু বলতে পারি, আপনাদের কোনো প্রকার অসম্মান হবে না। আমার বন্ধু আপনাদের মযাদার যোগ্য জিনিসই দেবেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, দত্ত মহাশয়, দুর্গাচরণবাবু অতিশয় পরিহাস-প্রবণ। তিনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ছাড়া কথা কইতে পারেন না। সেইজন্যই আমার বিষয়টি আমি স্পষ্টাক্ষরে বলি। আপনার বন্ধুপুত্রের হাতেখড়ির সময় উপস্থিত থাকতে রাজি আছি, কিন্তু আমার কিছু শর্ত আছে। সোনা-দানা, শাল-দোশালা দূরে থাক, গুরুদক্ষিণা হিসাবেও আমাকে একটি পাইপয়সা দিতে পারবেন না। আমি পঞ্চাশ টাকা বেতন পাই, তাতেই আমার সংসার অতি উত্তমরূপে চলে যায়। কাহারো কাছ থেকে দান গ্ৰহণ করার প্রয়োজন হয় না।
বিধুশেখর অভিভূত ভাবে নিবাক হয়ে রইলেন।
ঈশ্বরচন্দ্র আবার বললেন, দুর্গাচরণবাবুকেও আমি যথেষ্ট চিনি। উনি বেতন পান আশি টাকা, উহারও দান গ্রহণ করার প্রয়োজন দেখি না। সুতরাং আমরা কিছুই লবো না, এই শর্তে যদি রাজি থাকেন, তবে আমরা যেতে পারি। এই উপলক্ষে যদি অর্থ ব্যয় করতে চান, তবে কিছু দুঃস্থ ছাত্রকে সাহায্য করুন, সেটা কাজে দেবে।
বিধুশেখর বললেন, আপনাদের যা অভিপ্ৰায়, সেই মতই হবে।
দুর্গাচরণ বললেন, ঈশ্বর, তুমি আমরা, আমরা বলে ঠিক করলে না। তুমি নিজে কিছু গ্ৰহণ করতে চাও না, বুঝলাম! আর আমার সম্পর্কেও সটান এমন বলে দিলে যে ইচ্ছে থাকলেও আমি চক্ষুলজ্জায় আর কিছু নিতে পারবো না! কিন্তু উনি রামমাণিক্য বিদ্যালঙ্কারকেও আচাৰ্য করেছেন, তাঁকে কেন বঞ্চিত করো, সে বুড়োর যথেষ্ট লোভ আছে আমি জানি। তাছাড়া, বিদ্যালঙ্কারের মস্ত বড় সংসার, কতদিন আর চাকরি করতে পারবেন তার ঠিক নেই। তাঁর অর্থের প্রয়োজন আছে। আমি বলি কী, ইহারা আমাদের তিনজনকে যা দেবেন স্থির করেছিলেন, তার সবটাই বিদ্যালঙ্করকে দিন না কেন!
ঈশ্বরচন্দ্ৰ বললেন, এটা একটা ভারী কাজের কথা বলেছেন। তবে তেমনই করুন। কিন্তু কিছু দুঃস্থ ছাত্রকে সাহায্য করার কথাও ভুলবেন না।
বিধুশেখর বুঝলেন, তিনি যোগ্য ব্যক্তিদের কাছেই এসেছেন।
ঈশ্বরচন্দ্র আবার বললেন, আর একটি কথা। আমি দুগ্ধ জাতীয় কোনো খাদ্য খাই না। মাছ-মাংসও পরিত্যাগ করেছি। আপনার গৃহে শুধু ফলাহার করবো। অধিক কিছু খাবার জন্য পীড়াপীড়ি করবেন না। আপনাদের মতন বড় মানুষদের গৃহে একদিন আহার করলে পেটের পীড়া সারাতে এক বৎসর লেগে যায়।
দুর্গাচরণ বিধুশেখরকে বললেন, মহাশয়, এই ব্যাপারে। কিন্তু আমি ঈশ্বরের সঙ্গে একমত নই। আমি পেটুক মানুষ, লুচি মণ্ডাতে আপত্তি নেই।
মহাসমারোহে সরস্বতী পূজা সম্পন্ন হয়ে গেল। বাহির মহলের উঠানে শামিয়ানা খাঁটিয়ে সেখানে সব ব্যবস্থা হয়েছে। রামকমল সিংহ উত্তর ভারত থেকে এখনো ফেরেননি, গত সপ্তাহেই তাঁর এক দূত এসে আবার এককাঁড়ি টাকা নিয়ে গেছে, সুতরাং সব দায়িত্ব বিধুশেখরের একার। অচেনা যে-কেউ ভাবাবে তিনিই এ বাড়ির কত।
তিন ব্ৰাহ্মণ পাশাপাশি বসেছেন মখমলের আসনে। বালক নবীনকুমারকে সকাল থেকে উপবাসী রেখে, স্নান করিয়ে, কোড়া পট্টবস্ত্র পরিয়ে নিয়ে আসা হলো তাঁদের সামনে। প্ৰথমে রামমাণিক্য বিদ্যালঙ্কার নানা প্রকার মন্ত্রোচ্চারণ করে আশীর্বাদ করলেন তাকে। অধিকাংশ দাঁত নেই, বৃদ্ধ একেবারে ফোকলা, তাই কোনো কথাই প্ৰায় বোঝা যায় না।
তারপর দুর্গাচরণও নবীনকুমারের মস্তক স্পর্শ করে কয়েকটি মন্ত্র পড়ে আশীর্বাদ করলেন। নবীনকুমারের কোনো রূপ আড়ষ্টতা নেই। সে তার অস্বাভাবিক তীব্ৰ চোখ মেলে দেখছে ওঁদের। দুর্গাচরণ বললেন, এ বালকের মুখে প্রতিভার জ্যোতি আছে।
আচার্যদের যে প্ৰণাম করতে হয়, সেটা নবীনকুমারকে কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছে না। দুপাশ থেকে গঙ্গানারায়ণ আর বিধুশেখর বারংবার বলছেন, প্ৰণাম কর। পণ্ডিতমশাইদের পায়ে হাত দিয়ে প্ৰণাম করা! নবীনকুমার মুখ ফিরিয়ে শুধু তাকাচ্ছে, সে যেন জানেই না প্ৰণাম কাকে বলে। শেষ পর্যন্ত গঙ্গানারায়ণ তার হাত ধরে আচাৰ্যদের পায়ে ছোঁয়ালো।
ঈশ্বরচন্দ্ৰ কোনো সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারণ করলেন না। তিনি বললেন, আসল হাতেখড়িই তো হলো না। খড়ি কই? শ্লেট কই?
শ্লেট-পেন্সিল ও কয়েকখানি পুস্তক সরস্বতী মূর্তির পায়ের কাছে রাখা ছিল, সে সব পুষ্পস্তবকের নীচে চাপা পড়ে গেছে। পুরোহিত সেগুলি হাতিয়ে বার করলেন।
ঈশ্বরচন্দ্র নবীনচন্দ্রকে টেনে নিয়ে কোলে বসিয়ে বললেন, তোমার মুক্তার মতন হস্তাক্ষর হোক। এসো দিকি, আমরা দুজনে মিলে একটু লিখি।
বালকের হাতে পেন্সিল ধরিয়ে দিয়ে নিজেও তার হাতটি চেপে ধরলেন। তারপর বললেন, প্ৰথমে ওপর থেকে নীচে এই একটা সোজা দাগ। এই, এই! তারপর বাম দিকে তেকোণা করে দুটো দাগ। এই, এই, এই! এবার কী হলো? ঘুড়ি দেখেছে তো? ছেলেরা মাঠে যে ঘুড়ি ওড়ায়? এই হলো একটা ঘুড়ির অর্ধেক, তাই না, এবার ডানদিকে একটা শুণ্ডি, এই! এবার কী হলো? এর নাম ক!
নবীনকুমার বললো, ক!
দুর্গাচরণ বললেন, ও কি, ঈশ্বর, আগে অ আ না লিখিয়ে প্রথমেই ব্যঞ্জনবর্ণ ধরালে?
ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, ওতেই হবে। প্রথম দিন কিছু একটা লিখলেই হয়। অ-এর চেয়ে ক লেখা বালকদের পক্ষে সহজ।
নবীনকুমার বারবার বলতে লাগলো, ক, ক, ক, ক!
তারপর ঈশ্বরচন্দ্র তার হাত ছেড়ে দিতেই সে নিজের শ্লেটের ওপর আঁকিবুঁকি কাটতে লাগলো।
ঈশ্বরচন্দ্র দারুণ বিস্মিত হয়ে বললেন, এ কী? এ বালক কি আগেই লেখা অভ্যোস করেছে?
গঙ্গানারায়ণ বললো, না তো!
ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, এ তো ক লিখতে জানে! এই যে একটা লিখেছে।
অপর দুই ব্ৰাহ্মণও শ্লেটের ওপর উঁকি দিলেন। সত্যিই তো, ঈশ্বরচন্দ্ৰ যে ক লিখে দিলেন, নবীনচন্দ্র তার পাশে আর একটি ক লিখে ফেলেছে। যতই আঁকাবাঁকা রেখা হোক, তবুক বলে চেনা যায়। প্ৰথম দিনেই এমন লেখা কোনো বালকের পক্ষে সম্ভব নয়।
বিধুশেখরও শ্লেটখানি তুলে নিয়ে দেখলেন। চারপাশে আরও অনেকে ভিড় করে এলো। দূরে চিকের আড়ালে রয়েছেন বিম্ববতী এবং অন্য রমণীরা।
ঈশ্বরচন্দ্ৰ শ্লেটটা ফেরৎ নিয়ে বললেন, দেখি, দেখি, আর একটা লেখো তো!
কোনো আপত্তি নেই, বালক আবার লিখে দেখালো।
ঈশ্বরচন্দ্ৰ বাঁ হাতের চেটো দিয়ে শ্লেটটা একেবারে মুছে ফেলে বললেন, আর একবার লেখো তো! কী সুন্দর ছেলে! আর একবার লেখো!
শ্ৰী সকলেরই একেবারে গুছিত অবস্থা। নবীনকুমার সেই শূন্য শ্লেটে, কিছু না দেখেই আবার ক লিখেছে।
দুর্গাচরণ প্রশ্ন করলেন, আপনারা সত্যি জানেন, এ বালক আগে লিখতে শেখেনি?
গঙ্গানারায়ণ ও বিধুশেখর দুজনেই বললেন, আজ্ঞে, না। হাতেখড়ির আগে কেউ কি লেখাপড়া শেখায়?
দুর্গাচরণ এবার নিজে শ্লেটটা নিয়ে ইংরেজি এ আর বি অক্ষর দুটি লিখলেন। তারপর নবীনকুমারকে বললেন, ঠিক এই রকম দুটি পাশে লিখে দেখাও তো!
নবীনকুমার যেন বেশ কৌতুক পেয়েছে। খুব মন দিয়ে পেন্সিল ঘষে সে এ এবং বি অক্ষর ফুটিয়ে তুললো। দুর্গাচরণ সব মুছে দিলেন, তারপরও নবীনকুমার লিখে দেখাতে পারলো।
আর কোনো সন্দেহ রাখার উপায় নেই। বাড়ির কারুর কাছ থেকে যদি বা বাংলা অক্ষর লিখতে শিখেও থাকে, ইংরেজি অক্ষর শেখাবার মতন লোক কোথায় পাওয়া যাবে?
দুর্গাচরণ বললেন, ভাই, শ্রুতিধরের কথা শুনেছি। কিন্তু এই বালক কি দৃষ্টিস্মৃতিধর?
বিধুশেখর বললেন, এ শিশু জন্মের অতি অল্পকাল পর থেকেই নানাপ্রকার বিস্ময়ের কাজ করেচে। এ হাঁটতে শিখেচে, কথা কইতে শিখেচে অন্য ছেলেপুলেদের চেয়ে অনেক আগে। হ্যাঁরে গঙ্গা, ও ক মাসে কথা কইতে শিখেচিল রে?
গঙ্গানারায়ণ পিছন ফিরে মায়ের দিকে চাইলো। সেখান থেকে অন্য লোক মারফৎ উত্তর এলো, আট মাসে!
দুর্গাচরণ বললেন, আমি দেখেই বুঝেছি, এ বালক ক্ষণজন্ম।
বিধুশেখর গর্বিতভাবে বললেন, ওর কুষ্ঠিতেও আছে, ও বংশের মুখ উজ্জ্বল করবে।
দুর্গাচরণ বললেন, এর দিকে নজর রাখবেন ভালো করে। স্বাস্থ্যের যত্ন নেবেন। দেখবেন, যেন, এ শিশু দীৰ্ঘজীবী হয়!
গঙ্গানারায়ণ বললো, দেড় দুবছর বয়েস থেকেই ও অনেক রকম ছড়া বলতে পারে। একলা একলা ছড়া বলে বলে দরদালানে ঘুরে বেড়ায়।
ঈশ্বরচন্দ্ৰ বললেন, কই শুনি। একটা ছড়া বলো তো?
গঙ্গানারায়ণ বললেন, বল তো নবীন, একটা ছড়া বল তো। নবীনকুমার অমনি চোখ বুজে বললো :
তুমি প্ৰভু সৃষ্টিধর জগতের পতি
তোমা পানে সদা মোরা যেন থাকে মতি!
তিন ব্ৰাহ্মণ একসঙ্গে বাহবা দিয়ে উঠলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বললেন,বড় সুন্দর কণ্ঠস্বর, আর একটা বলো তো!
এবার নবীনকুমার কণ্ঠস্বর চড়িয়ে বললো :
এসো এসো চাঁদবদনি
এ রসে নিরসো কোরো না। ধনি?
দুর্গাচরণ ও ঈশ্বরচন্দ্ৰ হেসে উঠলেও রামমাণিক্য বিদ্যালঙ্কার নাক কুঁচকোলেন। তিনি বললেন, এ সব আবার কোথা থেকে শিখলো!
ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, আর একটু বলো তো, আর জানো না? নবীনচন্দ্র আবার দুলে দুলে বলতে লাগলো :
তোমাতে আমাতে একই অঙ্গ
তুমি কমলিনী আমি সে ভৃঙ্গ
অনুমানে বুঝি আমি সে ভুজঙ্গ
তুমি আমার তার রতনমণি
আধো আধো বালকের কথা নয়। প্ৰায় সঠিক উচ্চারণ। শুনতে শুনতে একটা হাসির হুল্লোড় পড়ে গেল। এমনকি বিধুশেখরও হেসে ফেললেন। একমাত্র বিদ্যালঙ্কারই অসন্তুষ্ট হলেন একটু। ঠাকুর দেবতার সামনে একি অশ্লীল কথা! তাও এক বালকের মুখে!
ঈশ্বরচন্দ্ৰ বললেন, চেনা চেনা যেন মনে হয়, এ গান কার রচনা?
দুর্গাচরণ বললেন, এ তো গোঁজলা ওঁই-এর গান, বহু পুরাতন। এদানি শোনাই যায় না।
ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, এ শিশু এ গান শিখলে কেমন করে?
গঙ্গানারায়ণ বললো, ভিকিরী, বৈষ্ণব, কীর্তনীয়রা বাড়িতে এলে আমার ভাইটি তাদের গান খুব মন দিয়ে শোনে। সে সব শুনে শুনেই শিখেচে।
ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, তাহলে তো এক বালক শ্রুতিধরও বটে!
দুর্গাচরণ বললেন, এমন আশ্চর্য শিশু আমি আগে আর দেখিনি তো বটেই, কোথাও শুনিনি পর্যন্ত! ঈশ্বর ওকে দীর্ঘজীবী করুন।
তারপর উভয়ে মিলে নবীনকুমারকে প্রভূত আদর করতে লাগলেন। দূর থেকে দেখে বিম্ববতীর মন গর্বে ভরে গেল। পুত্রের ব্যবহার দেখে তাঁর নিজের এখনো মাঝে মাঝে খটকা লাগে, কোনো রকম অপ্ৰাকৃত কিছুর প্রভাব আছে কি না। কিন্তু এত বড় গুণী ব্যক্তিরা তাঁর পুত্রের এমন সুখ্যাতি করছেন যখন, তখন আর কোনো চিন্তা নেই।
ব্ৰাহ্মণদের এবার জলপান করানো হবে। নবীনকুমারকেও এখন খাওয়ানো দরকার, তাই গঙ্গানারায়ণ তাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাবার জন্য ভাইকে ক্রেগড়ে তুলে নিল। নবীনকুমার জিজ্ঞেস করলো, দাদা, আমার হাতেখড়ি হয়ে গ্যাচে?
গঙ্গানারায়ণ বললো, হ্যাঁ। তোমার খুব ভালো হাতেখড়ি হয়েচে।
তখন নবীনকুমার তীক্ষ্ণ জোরালো গলায় বললো, দাদা, দুলালের হাতেখড়ি হবে না?
বিধুশেখর বিস্মিতভাবে বললেন, দুলাল? দুলাল কে?
গঙ্গানারায়ণ নবীনকুমারের পিঠ চাপড়ে বলে উঠলো, এখন খাবার খাবি। চল, চল!
নবীনকুমার কেঁদে উঠলো, না, আমি যাবো না। দুলালের হাতেখড়ি হবে। দুলালকে ডাকো। দুলালকে ডাকো।
গঙ্গানারায়ণও জানে না দুলাল কে। খানিকটা বিব্রত অবস্থায় সে নবীনকুমারকে নিয়ে দৌড়ে চলে গেল। মায়ের কাছে নামিয়ে দিয়ে সে জিজ্ঞেস করলো, দুলাল কে মা? দ্যাখো, ছোটবাবু আবার কী বাতিক ধরেচে।
বিম্ববতী বললেন, কী জানি বাবা, নীচের যে ছেলেটি ওর সঙ্গে খেলে, সেই নাকি!
নবীনকুমার দুলালের নাম করে ড়ুকরে কাঁদতে শুরু করেছে। তখন গঙ্গানারায়ণ ও বিম্ববতী দুজনেই তাকে অনেক কষ্টে বোঝালেন যে, হ্যা, হ্যাঁ, হবে, হবে, দুলালেরও হাতেখড়ি হবে, পরে হবে।
ভিড়ের একেবারে পিছন দিকে থাকোমণি তার পুত্রকে নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। মনিব পুত্রের মুখে দুলালের নাম উচ্চারণ সে-ও শুনতে পেয়েছে। কিন্তু সে ভয় পেয়ে গেল, তার মন বললো, এ সব ভালো নয়। বাবুদের কোনো ব্যাপারের মধ্যেই থাকা ভালো নয়। ছেলেকে নিয়ে থাকোমণি সরে গেল তাড়াতাড়ি।
দুলালচন্দ্ৰকে নবীনকুমার খুঁজে পেল বিকেলবেলা। শ্লেট আর পেন্সিল সে সারাদিন আর কাছছাড়া করেনি। এগুলিকে সে নতুন খেলনা হিসেবে পেয়েছে।
—দুলাল, তুই হাতেখড়ি দিলিনি? তোর বিদ্যে হবে না।
দুলালচন্দ্ৰ হাতেখড়ি মানে জানে না। সে দূর থেকে দেখেছিল। সাদা রঙের হাঁসের ওপর বসা সরস্বতী ঠাকুরের সামনে স্তূপ করা ছিল সন্দেশের পাহাড়। তার ভাগ্যে একটিও জোটেনি।
—আয়, আমি তোকে হাতেখড়ি শেখাবো। বোস, আমার সামনে বোস, হাঁটু গেড়ে বোস।
নিজে ঠিক ব্ৰাহ্মণ আচার্যদের ভঙ্গিতে পিঠ সোজা করে বসে সে অবিকল তাঁদের নকল করে বলতে লাগলো, লেখ, ক! ঘুঁড়ির আধেক আর একটা শুণ্ডি! তোকে আগে কেউ লিখতে শিখিয়েচে? লেখ, এ, বি!
এবার আমায় প্ৰণাম কর।