॥ ১৯ ॥
নতুন এক আনন্দকে আবিষ্কার করলেন হেমকান্ত। শান্ত নদী, চর, নীল ও গভীর আকাশ, দিগন্তে গারো পাহাড়, এই অপরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশে কোমল সূর্যের আলোয় নৌকো করে খানিকটা ঘুরে বেড়ানো। কতকাল জলে বৈঠা মারেননি তিনি।
রোজ সকালে কৃষ্ণকান্তর পড়াশুনো শেষ হওয়ার অপেক্ষায় থাকেন তিনি। ছেলের যে ইস্কুল আছে তা তাঁর খেয়াল থাকে না। পরীক্ষার পর সবে ইস্কুল খুলেছে, তাই কৃষ্ণকান্তরও বড় একটা গরজ নেই ক্লাস করার। বরং বাবার সঙ্গে এই দুর্লভ জলযাত্রা তার কাছে অনেক বেশী আকর্ষণীয়।
পড়া শেষ করে কৃষ্ণকান্ত ছুটে আসে বাবার ঘরে।
হেমকান্ত প্রসন্ন মুখে উঠে পড়েন। বলেন, চলো।
সোৎসাহে কৃষ্ণকান্ত বলে, আজ সেই জায়গাটায় যাবেন বাবা?
কোন জায়গাটায়?
যেখানে কাকা ডুবে গিয়েছিল।
হেমকান্ত মৃদু হেসে বলেন, সেই জায়গাটা দেখে কী করবে?
এমনি। দেখব।
কাকার কথা তুমি খুব ভালো নাকি?
খুব ভাবি।
হেমকান্ত খুশিই হন। বলেন, মহৎ মানুষদের কথা চিন্তা করাও ভাল। তাতে নিজের ভিতরেও মহত্ত্ব জেগে ওঠে।
কয়েকদিন অভ্যাসে হেমকান্ত নৌকো বাওয়ার বিস্মৃত কলাকৌশল আবার আয়ত্ত করলেন। মাঝি বসে থাকে, তিনি এবং কৃষ্ণকান্ত নৌকো চালান। বয়সের তুলনায় কৃষ্ণকান্ত বেশ দীর্ঘকায় এবং সবল। এটা অবশ্য এই বংশেরই ধারা। হেমকান্ত নিজেও বেশ দীর্ঘকায়। তবে শরীরের চর্চা করেন না বলে এখন আর ততটা সবলদেহী নন। কিন্তু তাঁর শরীরে এখনো তেমন মেদ সঞ্চার হয়নি। সংযম এবং মিতাচারের ফলে অল্প শ্রমে ক্লান্তও হন না। স্বাস্থ্য তাঁর ভালই। নৌকো বাইতে বাইতে তাঁর শরীরের জরার ভাবটাও ঝরে গেছে। এখন আর বার্ধক্যের পদধ্বনি নিজের শরীরে তেমন টের পান না। যখন দীঘল চেহারার কৃষ্ণকান্ত দুটি কচি হাতে বৈঠা টানে তখন তার অপরূপ দেহ ভঙ্গিমার ভিতর যেন নিজেকেই খুঁজে পান হেমকান্ত।
শীতের সকালে ছোটো খেয়া নৌকোটি মৃদুমন্দ চালে ভেসে চলেছে। বৈঠা তুলে নিয়েছেন হেমকান্ত। তার ইশারায় কৃষ্ণকান্তও তাই করেছে। মৃদু স্রোতে নৌকো বয়ে চলেছে ভাঁটিতে। নদীর মাঝ বরাবর অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা আছে। মুগ্ধ বিভোর হেমকান্ত সেই নিস্তব্ধতাকে অনুভব করছেন। মাঝে মধ্যে গাংচিল বা কোনো পাখির ডাক ভেসে আসে। আর আছে জলের মৃদুমন্দ শব্দ। যেন তা এই নিস্তব্ধতাকেই গভীরতর করে তোলে। কৃষ্ণকান্ত তার বাবার এই তদগত ভাব লক্ষ্য করে সতর্কভাবে চুপ করে থাকে। নৌকো যাতে দিকভ্রষ্ট না হয় তার জন্য হেমকান্ত অভ্যস্ত হাতে একটি বৈঠা জলে ডুবিয়ে রাখেন কিছুক্ষণ। আবার তুলে ফেলেন। এছাড়া অনেকক্ষণ আর তাঁর বাহ্যিক কোনো নড়াচড়া থাকে না।
অনেকটা ভাঁটিয়ে গিয়ে যেখানে নদী একটা বাঁক নিয়েছে সেইখানে নৌকোকে ধীরে ধীরে তীরের দিকে চালনা করেন হেমকান্ত। ভারী নির্জন জায়গা। ধারে কাছে গাঁ গঞ্জ নেই। নদীর ধারে বেঁটে কাঁটা ঝোপ আর বেতবন। তটস্থ মাঝি জিজ্ঞেস করে, নৌকো বাঁধব কর্তা?
বাঁধ। হেমকান্ত উলস স্বরে বলেন।
বুড়ো মাঝি একটা লগী পুঁতে নৌকোটা বাঁধে। হেমকান্ত হাঁটুজলে নেমে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণকান্তর দিকে চেয়ে বলেন, নামো।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো কৃষ্ণকান্ত জলে নেমে দাঁড়ায়। শীতের হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা জল তার কোমর অবধি ওঠে। হেমকান্ত সেদিকে খেয়াল করেন না। ধীরে ধীরে তীরভূমির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলেন, এই সেই জায়গা। এই সেই জায়গা।
বেতবন উত্তুরে বাতাসের শব্দ হুহু করে শোকাবহ শব্দ তুলে বয়ে যাচ্ছে। ঝিমঝিম করছে রোদ। আস্তে আস্তে হেমকান্ত ডাঙায় উঠে দাঁড়ালেন, সঙ্গে কৃষ্ণকান্ত।
হেমকান্ত নদীর ধারে দাঁড়িয়ে উদাস দৃষ্টিতে ব্রহ্মপুত্রের বহমানতার দিকে চেয়ে থেকে বলেন, কোকোটা ডুবেছিল আরো উজানের দিকে। অনেকটা দূরে, শহরের কাছাকাছি। নলিনী এত দূরে ভেসে এসেছিল। কেন কে জানে!
কৃষ্ণকান্ত বোবা বিস্ময়ে শান্ত সুন্দর জায়গাটির চারদিকে চেয়ে সেই ঘটনার বিষন্ন রেশটুকু খুঁজতে থাকিল। তারপর বয়সোচিত ছেলেমানুষী একটা প্রশ্ন করল, কাকা কি সাঁতার জানত?
হেমকান্ত তার দিকে ফিরে একটু হেসে বললেন, জানত। খুব ভাল সাঁতার দিতে পারত নলিনী। ভরা বর্ষাতেও ব্রহ্মপুত্র এপার ওপার করত।
তাহলে ডুবে গলা কেন?
কে জানে। ভবিতব্য।
মনু পিসি বল, সাঁতার জানলে নাকি কেউ জলে ডুবে যেতে পারে না।
হেমকান্ত একথার জবাব দিলেন না। আঘাটায় দাঁড়িয়ে চেয়ে রইলেন স্রোতের দিকে। নদীর স্রোত জিনিসটাই ভারী অদ্ভুত। এ যেন সময় ও জল একসঙ্গে মিশে চলেছে মোহনার দিকে।
কৃষ্ণকান্ত বলল, মনু পিসি বলে, কাকাকে কেউ মেরে জলে ফেলে দিয়েছিল।
বলে নাকি? হেমকান্ত একটু হাসলেন।
কৃষ্ণকান্ত উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কাকার গায়ে কি খুব জোর ছিল বাবা?
তা মন্দ ছিল না। ব্রহ্মচারী মানুষ সে। সৎযম ছিল, সর্বদা পরিশ্রম করত। জোর থাকারই কথা।
ব্যায়াম করত না?
বোধহয় করত।
কাকা লাঠি চালাতে জানত?
শিখেছিল খানিকটা।
তাহলে কাকাকে মারল কী করে?
হেমকান্ত একটু হেসে বললেন, সেটা তুমি তোমার মনু পিসিকেই জিজ্ঞেস কোরো।
কৃষ্ণকান্ত তার সরল চোখে অগাধ বিস্ময় নিয়ে বাবার দিকে চেয়ে বলে, মনু পিসি বলে, কাকার গায়ে নাকি ভীষণ জোর ছিল। একবার কাকা লাঠি নিয়ে একদল ডাকাতকে মেরেছিল।
হেমকান্ত হোঃ হোঃ করে হেসে ওঠেন। কৃষ্ণকান্তর মনের মধ্যে একটা বীরত্বের বীজ বপন করতে চাইছে রঙ্গময়ী। রঙ্গময়ী নয়, পুরোদস্তুর মিথ্যময়ী। হাসলেও হেমকান্ত এ ব্যাপারটাকে প্রশ্রয় দিতে চাইলেন না। ছেলের পিঠে হাত রেখে বললেন, মনু একটু বাড়িয়ে বলেছে। অতটা নয়। নলিনী ডাকাত মারলে আমি ঠিকই জানতে পারতাম।
একথায় কৃষ্ণকান্ত একটু হতাশ হল। কাকার বীরত্বের কথা তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় বটে, কিন্তু সে জানে, তার বাবা সর্বদাই ঠিক কথা বলেন। সরলভাবেই কৃষ্ণকান্ত বলে, তাহলে মনু পিসি কি মিথ্যে কথা বলেছে?
রঙ্গময়ীকে মিথ্যাবাদী বলতে বাধে হেমকান্তর। তিনি বললেন, রূপকথা বা ভূতের গল্পও তো বানানো জিনিস, তা বলে যারা সেগুলো লিখেছেন তাঁরা কি মিথ্যেবাদী?
যুক্তিটা ঠিক বুঝল না কৃষ্ণকান্ত। হাঁ করে কিছুক্ষণ বাবার দিকে চেয়ে থেকে বলল, ভুতের গল্প কি সত্যি নয় বাবা?
না। ভূত বলে কিছু নেই।
কিন্তু কমপাউডার কাকা যে মাকে মাঝে মাঝে দেখতে পায়!
ওটা তো পাগল। ও কী দেখে আর কী না দেখে তার কোনো মাথামুণ্ডু আছে নাকি?
পক্ষীরাজ ঘোড়া! তাও কি নেই?
না। ওসব মানুষের কল্পনা।
কৃষ্ণকান্ত একটু ব্যথিত হল বোধহয়। কিন্তু চুপ করে ভাবতে লাগল।
হেমকান্ত একবার ভাবলেন শিশুমনের কল্পনাশক্তিকে আঘাত করে হয়তো কাজটা ভাল করলেন না। কিন্তু পর মুহূর্তেই মনে হল, তিনি যেমন অতিশয় কল্পনাপ্রবণ ও বাস্তববুদ্ধি বর্জিত হয়েছেন তেমনটা না হওয়াই কৃষ্ণকান্তর পক্ষে ভাল। অন্তত এই একজন কঠোর বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন যুক্তিবাদী ও কর্মঠ হয়ে উঠুক।
হেমকান্ত ছেলের দিকে স্নেহভরে চাইলেন, বললেন, এসো, এখানে দাঁড়িয়ে কাকাকে একটা নমস্কার জানাও। শ্রদ্ধাবোধ বড় ভাল জিনিস।
কৃষ্ণকান্ত সঙ্গে সঙ্গে হাতজোড় করে চোখ বুজল।
হেমকান্তও কিছুক্ষণ চোখ বুজে নলিনীকান্তকে স্মরণ করলেন। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই কত কথা মনে পড়ে গেল। তাঁদের তিন ভাইতে খুব সদ্ভাব ছিল, কিন্তু বাক্য বিনিময় বিশেষ হত না। তিন জনের প্রকৃতিই কিছু গম্ভীর। তাছাড়া নলিনী নিজেকে সংসারের বাইরে নিবাসিত করেছিল বলে তার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল আরো কম। বেঁচে থাকলে আজ নলিনীর বয়স চল্লিশ বিয়াল্লিশ হত। একটি সাইকেল ছিল তার অচ্ছেদ্য বাহন। কোথায় কোথায় চলে যেত সাইকেলে চেপে। বেলা অবেলা মানত না, নিয়মিত স্নান খাওয়া ছিল না। তেলের অভাবে মাথার চুল পিঙ্গল বর্ণ ধারণ করেছিল। গলে অযত্নের দাড়ি বেড়ে উঠত। সাধারণ টুইলের শার্ট আর ধুতিই ছিল তার পরিধান। পায়ে তালতলার চটি আর কাঁধে উড়নি। পাবনার এক আশ্রমের সঙ্গে ছিল তার গভীর যোগাযোগ। মাঝে মাঝে বাড়ি থেকে উধাও হয়ে সে আশ্রমে গিয়ে বেশ কিছুদিন করে থেকে আসত। পাকাপাকি আশ্রমবাসী হওয়ার তীব্র আকাঙক্ষা ছিল তার। কিন্তু মা বেঁচে থাকতে সেটা আর পেরে ওঠেনি। বড় ছেলে সন্ন্যাস নিয়েছে, ছোটোটিও আশ্রমবাসী হলে মা শোকে মারা পড়তেন। কিন্তু আজ হেমকান্ত ভাবেন, নলিনী আশ্রমবাসী হলেই বোধহয় ভাল হত। বেঁচে তে থাকত।
বুড়ো মাঝি হারান এতক্ষণ সশ্রদ্ধভাবে চুপ করে ছিল। এখন হঠাৎ হাত জোড় করে বলে উঠল, কর্তা, কয়েকখানি কচি বেত কেটে নেবো? বেতাই খেতে বড় ভাল।
হেমকান্ত ঘাড় নেড়ে বললেন, আন্।
কৃষ্ণকান্ত বলে, আমি যাবো বাবা?
হেমকান্ত বলেন, ভীষণ কাটা। সাবধানে যেও।
হেমকান্ত শুষ্ক বালুকাময় তীরে বসলেন। হারান নোকোর খাল থেকে একটা চকচকে দা বের করে বেতবনে চলল। সঙ্গে কৃষ্ণকান্ত। হেমকান্ত আনমনা চোখে দেখতে লাগলেন। হুহু করে হাওয়া কত জায়গা, কত গাঁ গঞ্জ ছুয়ে এলে তাঁর কনে কত কী বলে যাচ্ছে ফিসফিস করে। বেলা দুপুরের খাড়া ও চড়া রোদে বা তেতে আছে বালি। হেমকান্ত রোদকে অগ্রাহ্য করে বাতাসের কথা শুনতে লাগলেন।
বাতাস বলে, বহু এসে গোছা তুমি, বহু দূর। আর কি ফিরে যাওয়ার দরকার আছে। তোমার ছেলেকে নিয়ে মাঝি৷ ফিৱে যাক। তুমি বেরিয়ে পড়ে মহাপৃথিবীর দিকে।
হ্যাঁ, বাতাসের কথা তো এ নয়। এ হয়তো বই গভীর অভ্যন্তলের কথা। বাতাসে সেই কথাই ছড়িয়ে যাচ্ছে। একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করলেন তিনি। বেরিয়ে পড়া তাঁর কাছে সহজ নয় ঠিকই, আবার অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু তিনটি ভাইয়ের মধ্যে বংশের ললাতে জ্বলছে মাত্র একটি। তিনি চলে গেলে কৃষ্ণকান্তকে স্থানান্তরিত করা হবে। বিশাখার বিয়ে দিতে দেরী হবে না। ছেলেরা জমিদারীতে উৎসাহী নয়। আয় কমে যাচ্ছে, ঋণ বাড়ছে। তারা হয়তো গোটা সম্পত্তিই বিক্রী করে। দেবে। বাড়ি অন্ধকার হয়ে যাবে।
না, মালো কিছুদিন অপেক্ষা করতেই হবে তাঁকে।
বাতাস ফিসফিস করে বলল, আর কোনো কারণ নেই? রঙ্গময়ী! রঙ্গময়ীর কথা ভুলে গেলে! তোমার চেয়ে শক্ত বন্ধন!
বুকে বা ধারে আবার সেই ব্যাথা। অবোধ যন্ত্রণা। হেমকান্ত ফিসফিস করে বললেন, মনু সুখী হোক।
সুখ কি সোজা! জানো না, প্রিয় মানুষ ছাড়া মানুষের কোনো সুখই নয় তুমি ছাড়া রঙ্গময়ীর এই বিশ্ব দুনিয়ায় সুখের আর কে ভাগীদার আছে?
শুধু আমি! তা কেন রঙ্গময়ীর আছে সেবা, আছে দেশোদ্দার, আছে স্বদেশে প্রীতি। আমি তো অপদার্থ।
সে সব যুক্তি কি বোঝে হ্রদয়? বাল্যাবধি রঙ্গময়ী কাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছে সে কি জানো না?
যদি এতদিনে রঙ্গময়ীর বিয়ে হয়ে যেত তাহলে? তখন কোথায় থাকত সেই বাল্যপ্রেম, কোথায় থাকথাম, আমি?
তুমি ঠিকই থাকতে। তার হৃদয়ের সংগোপনে এক কোণে। রঙ্গময়ীর বিদ্রোহ ছিল অন্যরকম। বিয়ে ভাঙার জন্য নিজের নামে কলঙ্ক রটনাকে সে কি প্রশ্রয় দিত না! না দিলে সে অন্তত একবার তার নিন্দুকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করত। তা না করে সে এসে ঝগড়া করত তোমার সঙ্গে।
তা ঠিক। কিন্তু আমি কী করব? আমার কী করার আছে।
রঙ্গময়ী তোমার সবচেয়ে বড় বন্ধন। মহাপৃথিবীর দিকে যে অবারিত পথ তাতে সবচেয়ে বড় বাধা রঙ্গময়ী।
না। নিঃশব্দে এক আর্তনাদ বুক থেকে উঠে এল হেমকান্তর।
শোনো, তুমিও রঙ্গময়ীর জীবনে এক অভিশাপ। তোমাদের ওই বাড়ি, ওই সংসারে আজও সে দাসীর মতো পড়ে আছে এক অদ্ভুত মোহের জন্য। তা কি জানো? নইলে রঙ্গময়ীর জন্যও ছিল অন্য এক পৃথিবী। সে তোমাকে ত্যাগ করতে পারে না।
হেমকান্ত মাথা নত করে বসে রইলেন।
বাবা, বাড়ি যাবেন না? কৃষ্ণকান্তের আচমকা ডাকে চমকে ওঠেন তিনি।
চলো যাই। বলে উঠলেন তিনি।
কৃষ্ণকান্ত এক গোছা বেত বয়ে এনেছে। কাঁটায় হাত রক্তাক্ত কিন্তু তার মুখে তৃপ্তির হাসি।
নৌকোয় ওঠার পর হেমকান্ত বললেন, হাত দুটো নদীর জলে ধুয়ে নাও।
কৃষ্ণকান্ত নৌকোর বাইরে ঝুঁকতেই হেমকান্ত বললেন, সাবধান। নদীতে কুমীর আর কামট আছে। দেখে নাও।
কৃষ্ণকান্ত মাথা নাড়ল। শীতের জল স্বচ্ছ। দুপুরের রোদ বহুদূর জলের মধ্যে প্রবেশ করেছে। দেখে শুনে জলে হাত দিল কৃষ্ণকান্ত।-কাঁটায় হাত ছড়ে যাওয়াতেও যে বাবা তাকে বকেননি এর জন্য সে কৃতজ্ঞ বোধ করে।
উজানে নৌকো বাইতে বেশ কষ্ট। এক জোড়া বৈঠা হারানের হাতে। দ্বিতীয় জোড়া হেমকান্তর হাতে। তিনি গলদঘর্ম হচ্ছেন।
কৃষ্ণকান্ত হাত বাড়িয়ে বলল, আমি কিছুক্ষণ বাই বাবা?
পারবে? হাত তো কেটে ফেলেছো!
ওটা কিছু নয়। পারব।
নাও। ছেলের হাতে বৈঠা দিয়ে হেমকান্ত ধুতির খোঁটায় মুখের ঘাম মুছলেন।
বাড়ি ফিরে আসার পর রঙ্গময়ী একটু রাগারাগি করল, এত বেলা পর্যন্ত একটা দুধের বাচ্চাকে নিয়ে টো-টো করে ঘুরে বেড়াও, তোমার হল কী বল তো! বেত কাটতে গিয়ে ছেলেটার হাত দুটো কী পরিমাণ কেটেকুটে গেছে! আচ্ছা বাপ যাহোক।
হেমকান্ত রঙ্গময়ীর দিকে ভাল করে তাকাতে পারেন না। কেমন এক পাপবোধ তাঁকে ছেঁকে ধরেছে ভূতের মতো। শুধু বললেন, কষ্ট করতে শিখুক, আঘাত সহ্য করতে অভ্যাস করুক। না হলে তোমার স্বদেশী দলে ভিড়বে কী করে?
স্বদেশী দলে ও কেন ভিড়বে? ও হচ্ছে জমিদারের ছেলে, ইংরেজ কর্তাদের পেয়ারের লোক।
ও তো জমিদারী চায় না। ও চায় স্বদেশী হতে।
তাই নাকি? তোমাকে বলেছে?
সরাসরি বলেনি। হাবে ভাবে বলছে।
তাহলে এখন থেকে সাবধান হও।
কী করে সাবধান হবো? ও হচ্ছে একটা হাওয়া। যার গায়ে লাগে সেই বিগড়ে যায়। ওঝা-বদ্যির কাজ নয় যে সারিয়ে দেবে।
অতই যদি ভয় তবে কনক কলকাতায় নিয়ে যেতে চাইছে, পাঠিয়ে দাও না কেন?
পাঠালেই বা কী হবে? ওর মনু পিসি যে ওর বারোটা বাজিয়ে রেখেছে।
রঙ্গময়ী এ কথায় হেসে ফেলল। বলল, তাহলে আমাকেই না হয় তাড়াও। ছেলের চেয়ে তো আমি বড় নই।
তাড়াবো! ওরে বাবা।
কেন, আমাকে তাড়ানো কি খুব কঠিন?
তোমাকে তাড়াতে গেলে নিজেকেই না ভিটে থেকে উচ্ছেদ হতে হয়।
ওসব কথার কোনো মানে হয় না। আমি ভেবে দেখেছি, আমি গেলেই তোমাদের মঙ্গল।
কিসের মঙ্গল?
সব দিক দিয়েই মঙ্গল।
এটা রাগের কথা। হেমকান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, মনু, বিশাখা কেমন মেয়ে?
রঙ্গময়ী অবাক হয়ে বলল, তার মানে? বাপ হয়ে নিজের মেয়ের কথা আমার কাছে জানতে চাইছো কেন?
বাপ হলেই যে নিজের মেয়েকে ভাল চেনা যাবে একথা তোমাকে কে বলল? বরং তুমি নিজে মেয়ে বলেই বিশাখাকে ভাল বুঝতে পারবে।
রঙ্গময়ী একটু বিরক্ত হল যেন। বলল, মেয়ে তো ভালই। কিন্তু কথাটা উঠল কেন হঠাৎ?
এমনি।
এমনি নয়। তোমার প্রশ্নের পিছনে কারণ আছে। বলো
সেদিন হঠাৎ বিশাখার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। মনে হল, ও স্বদেশীদের তেমন পছন্দ করে না।
রঙ্গময়ী হাঁ করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, ও আবার কোনদেশী কথা! বিশাখা স্বদেশীদের পছন্দ করতে যাবেই বা কেন?
হেমকান্ত মৃদু হেসে বলেন, কথা সেটা নয়।
তবে আবার কী কথা?
কথা হল, তুমি বিশাখাকে প্রভাবিত করতে পারোনি। কেন পারোনি মনু? অথচ কৃষ্ণকে পেরেছে।
রঙ্গময়ী একথায় হঠাৎ একটু দিশাহারা বোধ করে চুপ করে থাকে। তারপর ধীর স্বরে বলে, তোমাকে যতটা ন্যালাক্ষ্যাপা আর উদাসীন দেখায় তুমি ততটা নও তাহলে?
আমি অপদার্থ মনু, সে তো জানোই।
না, আমি তা জানি না। কিন্তু তুমি এত লক্ষ করতে শিখলে কবে?
তাহলে ধরেছি ঠিক!
রঙ্গময়ী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, বিশাখা আমাকে ভালবাসে, কিন্তু তবু ও একটু অন্যরকম। একটু নিজের মতো।
ও কি স্বার্থপর?
তা তো বলিনি।
তবে কী?
সাবধানী বলা যায়। মেয়েদের পক্ষে সাবধানী হওয়া ভাল।
ওর ধারণা আমি শশীকে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলাম। কোথা থেকে যে ধারণাটা হল।
রঙ্গময়ী বলে, শশীর ব্যাপারটা ওর ভাল লাগেনি। কে জানে, সেইজন্যই হয়তো—
কথাটা শেষ করল না রঙ্গময়ী।
হেমকান্ত চোখ তুলে প্রশ্ন করেন, সেইজন্যেই কী?
আমি ভাল জানি না।
কী জানো না?
সে তুমি অন্যের কাছ থেকেই শুনতে পাবে। আমি যাই।
রঙ্গময়ী চলে গেলে হেমকান্ত ভ্রূকুটি করে বসে থাকেন। কথাটা হয়তো ভাল নয়। তবু জানা দরকার।