১৯. দ্য লায়ন অ্যান্ড দ্য সারপেন্ট
পরের দুসপ্তাহ হ্যারি ওর পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে চলল। ওর বুকের মধ্যে রয়েছে অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন সাহস আর দৃঢ়তা। সেই শক্তি ওকে আমব্রিজের ক্লাসে একটুও অবনত করতে পারছে না। আমব্রিজের দিকে তাকিয়ে ও ভয় পায় না বরং তার ফোলা ফোলা চোখের তলা দেখে মনে মনে হাসে। আমব্রিজ ঘুণাক্ষরেও জানে না, ডাম্বডোরের ডিফেন্স আর্মি (ডিএ) কেমনভাবে এগিয়ে চলেছে। যখন আমব্রিজ ক্লাসে উইলবার্ট নিকহার্ডসের বই পড়ান তখন হ্যারির মন পড়ে থাকে তার সংগঠন আর পরিকল্পনার দিকে। নেভিল হারমিওনকে পরাজিত করেছে। কলিন ক্রিভে অনেক পরিশ্রম করে ইমপেডিমেন্ট জিঙ্কস আয়ত্বে এনেছে। তিনটে মিটিং হয়ে গেছে, সকলে খুবই পরিশ্রম করেছে। পার্বতী প্যাটেল দারুণ কার্যকরী রিডাক্টর কার্স তৈরি করেছে। সেগুলোকে ব্যবহার করে টেবিলের ওপর সিকোপগুলো ধূলো করে দিয়েছে।
তাহলেও বিরাট সমস্যা! কোনওভাবে একটি দিন ঠিক করতে পারে না। সমস্যা অ্যাঞ্জেলিনার তিনটে কিডিচ টিমের প্র্যাকটিসকে নিয়ে, তারপর সঠিক আবহাওয়ার সমস্যা। কখনও বৃষ্টি, কখনও রোদ। প্র্যাকটিসের দিন ঠিক হলো, কিন্তু বন্ধ হয়ে গেলো ধূমধাম বৃষ্টির জন্য। এইসব কথা ভেবে ও সমস্যা দেখে হ্যারি ডি-এর মিটিং কোনও বিশেষ একটি দিনে বাতিল করে দিল। হারমিওন এদিকে সকলের অসুবিধে ইত্যাদি লক্ষ্য করে দারুণ একটা মেথড অফ কমিউনিকেটিং টাইম বার করে ফেলেছে, সভ্যদের ডেকে পাঠাবার পরবর্তী মিটিং-এর তারিখ ও সময় জানানোর ব্যাপারে।
ও ডিএর প্রতিটি সভ্যকে একটা করে নকল গেলিয়ন দিতে বললো (রন ঝুড়ি ভর্তি নকল গেলিয়ন দেখে ভেবেছিলো হারমিওন প্রত্যেককে একটা করে আসল সোনার গেলিয়ন দিচ্ছে।
হারমিওন বললো, প্রতিটি গেলিয়নের প্রান্তে কিছু নম্বর আছে দেখতে পাচ্ছো? (চতুর্থ মিটিং-এর সময় ও ডিজাইনটা দেখাচ্ছিলো) টর্চের আলো পড়লে ওই নকল কয়েনের নাম্বার বেশ বড় হবে, আর হলুদ বর্ণের হবে। আসল গেলিয়নে টর্চের আলোয় ধরলে শুধু তার নম্বর প্রতিফলিত হবে গেলিয়নের গায়ে। নকল গেলিয়নে আমাদের পরবর্তী মিটিং-এর তারিখ ও সময় পরিবর্তন হলে পরিবর্তনের সময় ও তারিখ ফুটে উঠবে। তারিখ বদলালে ফেক কয়েন গরম হয়ে যাবে। তাহলে কী হলো? তোমরা যদি নকল গেলিয়ন পকেটে রাখা তাহলে তারিখ বদলালে কয়েন গরম হবে ও তোমরা বুঝতে পারবে। হ্যারির কাছে যে নকল কয়েন থাকবে ও তাতে ইচ্ছা শক্তির পরিবর্তন করবে। এটা সম্ভব হচ্ছে আমি প্রত্যেকটি নকল কয়েনে প্রোটিন চার্মস দিয়েছি। হ্যারির ইচ্ছে মতো তারা বদলাবে।
সকলেই হারমিওনের দিকে কোনও কথা না বলে তাকিয়ে রইল। ও বললো, ব্যাপারটা আমব্রিজও টের পাবেন না। আমাদের পকেটে নকল কয়েন রাখাটা অন্যায় নয়অবশ্য যদি সেটা কিছু কেনা টেনার সময় ব্যবহার না করা হয়।
টেরি বুট বললো, তুমি প্রোটিন চার্ম তৈরি করতে পারো?
হারমিওন বললো–হ্যাঁ।
–তাহলে তাহলে NEWT স্ট্যান্ডার্ডে? ও আমতা আমতা করে বললো।
হারমিওন কোনও কৃতিত্ব নিতে চায় না। মৃদু হেসে বললো–ও হ্যাঁ তা হবে।
–তুমি এতো চালাক, কতো কি জানো, তাহলে তুমি র্যাভেনক্ল হাউজে নেই কেন? তোমার মতো বুদ্ধি কজনের আছে! ওর কথা শুনে হারমিওন হাসল। শুটিং হ্যাট যা ঠিক করবে তা মানতে হবে। প্রথমে অবশ্য আমি র্যাভেন ক্লতে বিবেচিত হয়েছিলাম, কিন্তু শুটিং হ্যাট শেষ পর্যন্ত আমাকে গ্রিফিন্ডরে পাঠাল। তার মানে এই নয় যে, আমরা গেলিয়নস ব্যবহার করছি।
সব সভ্যরা ঝুড়ি থেকে একটা করে নকল সোনার গেলিয়ন তুলে নিল। হ্যারি আড়চোখে হারমিওনকে দেখতে লাগলো।
–তুমি জানো এই কয়েনগুলো দেখে আমার কী মনে আসছে?
–না তো, কী?
–ডেথ ইটারের কাটা দাগ। একজন ডেথইটারের কাটা কালো দাগ ভোল্ডেমর্ট স্পর্শ করলেই বাকি সব ডেথ ইটারদের কাটা কালোদাগে জ্বালা শুরু হয়, তখন তারা বুঝতে পারে ভোল্ডেমর্ট ওদের ডাকছেন।
–ও হ্যাঁ, হারমিওন ধীর স্থির হয়ে বললো, ওখান থেকেই আইডিয়াটা পেয়েছি। তবে তফাৎ এই পরীক্ষাটা আমি গেলিয়নে করেছি আর ভোল্ডেমর্ট ওর অনুগামীদের দেহের চামড়ার কালদাগে করেছেন।
হ্যারি হারমিওনের দেয়া নকল গেলিয়ন পকেটে রেখেদিল। হারমিওন বললো, তবে এর একটা বিপদ কি জানো? বিপদ হচ্ছে, যদি আমরা ভুলে টুলে এটাকে লিগ্যাল টেন্ডার ভেবে খরচ করি।
রন বললো, প্রচুর সম্ভাবনা আছে।
গ্রিফিন্ডারদের সঙ্গে স্লিদারিনের কিডিচ ম্যাচের দিন যতোই এগিয়ে আসতে থাকে অ্যাঞ্জেলিনার অনুরোধে পরবর্তী ডিএর মিটিং হ্যারি ততো পিছিয়ে দিতে বাধ্য হয়। রোজই প্র্যাকটিস করার আব্দার করে। তাছাড়া অনেকদিন খেলা ঠিক মতো হয়নি। সকলেরই দারুণ ইন্টারেস্ট।
হ্যারি প্রফেসর ম্যাকগোনাগলের উদারতা দেখে অবাক হয়ে গেল। গ্রিফিন্ডর গ্রুপের ছেলে–মেয়েরা যাতে ভাল করে খেলা প্র্যাকটিস করতে পারে তার জন্য ম্যাকগোনাগল হোমওয়ার্ক দেওয়া কমিয়ে দিলেন। দৈনন্দিন হ্যারি, রন আর অন্যদের উৎসাহ দিতে লাগলেন। স্নেইপ যাতে বাধা সৃষ্টি না করতে পারেন সেদিকেও সজাগ হয়ে রইলেন।
তাছাড়া স্নেইপ দারুণ পার্টিম্যান। কিডিচ মাঠ তার গ্রুপের ছেলে–মেয়েদের প্র্যাকটিসের জন্য বলতে গেলে রোজই বুক করে রাখতে লাগলেন। এছাড়া স্নিদারিনদের করিডোরে গ্রিফিরদের ঠাট্টা-তামাশা কটুক্তি করার অনেক খবর পেয়েও কানে তালা দিয়ে রাখলেন। স্লিদারিনের কীপার মাইলস ব্লেচলে। হেয়ার থিকেনিং চার্ম প্রয়োগ করে গ্রিফিন্ডরের অ্যালিসিয়া স্পিনেটের দুচোখের পাতা মোটা করে দিলো যাতে ভাল করে দেখতে না পায়। স্নেইপ খবরটার সাক্ষী সাবুদ পেয়েও চুপ করে রইলেন। কম করে চৌদ্দজন প্রত্যক্ষদর্শীর কথায় কান দিলেন না। অ্যালিসা যখন লাইব্রেরিতে একা একা পড়াশুনা করছিলো তখন দুষ্টুমিটা করেছে।
হ্যারি গ্রিফিন্ডরদের জেতার ব্যাপারে খুবই আশাবাদী। ওরা সাধারণত ম্যালফয়দের টিমের কাছে হারেনি। এ কথা ঠিকই রন এখনও পর্যন্ত উডাস স্ট্যান্ডার্ডে খেলতে পারছে না, তাহলেও খেলার উন্নতির জন্য দারুণ পরিশ্রম করে চলেছে। ওর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা–আত্মবিশ্বাস হারানো। খেলতে খেলতে একবার যদি ভুল করে বা পিছিয়ে পড়ে, একটা অব্যর্থ গোল যদি না দিতে পারে তাহলো মানসিক শক্তি এমনভাবে নষ্ট হয়ে যায় যে, বার বার অব্যর্থ গোল মিস করে। ফর্মে থাকলে রনকে আটকায় কার সাধ্য। ঝাড়ুতে বসে ঝড়ের বেগে কোয়াফিল নিয়ে মাঠের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে যায়। বিরোধীদল ওকে আটকাতে পারে না। ফ্রেড আর জর্জ জানে রন একদিন না একদিন কিডিচ খেলায় ওর দুই দাদাকে অনেক পেছনে ফেলে এগিয়ে যাবে।
স্লিদারিনের প্লেয়াররা রনকে দেখলেই ঠাট্টা করে। ও ছোটখাটো, স্লিদারিনরা বেশ লম্বা-চওড়া। করিডোরে দেখা হলে বলে, উইসলি তুমি হাসপাতালে বেড বুক করে রেখেছো তো? ড্রেকো ম্যালফয় দেখা হলেই রনকে ব্যঙ্গ করে। দেখায় রন কেমন করে কোয়াফিল হাত থেকে ফেলে দেয়। রনের তখন দুকান লাল হয়ে যায়। এমনভাবে কাঁপতে থাকে যে সেই সময় ওর হাতে যদি কিছু থাকে তাহলে পড়ে যাওয়ার প্রচুর চান্স থাকে।
অক্টোবর মাসকে প্রবল ঠাণ্ডা হাওয়া আর বৃষ্টিতে উড়িয়ে নিয়ে নভেম্বর এসে দাঁড়াল। জমাট লোহার মত ঠাণ্ডা, সকাল থেকেই শুরু হয় তুষারপাত, বরফের ঠাণ্ডা হাওয়া হাতে পায়ে মুখে লাগলে মনে হয় দাঁত বার করে কামড়াচ্ছে। আকাশ আর গ্রেটহলের সিলিং-এর রং হয়ে গেছে বিবর্ণ, মুক্তর মতো হোগার্টসের চারপাশে ঘিরে রাখা পর্বতমালা মনে হয় তুষার আবৃত সাদা চাঁদরে ঢাকা। ক্যাসেলের তাপমাত্রা এতো নেমে গেছে যে অনেক ছাত্র-ছাত্রী হাতে মোটা ড্রাগন স্কিনের দস্তানা পরে হাত গরম করে রাখার জন্য করিডোরে ঘোরাফেরা করে।
ম্যাচের দিন সকালের অবস্থা আরও মারাত্মক। হ্যারির ঘুম ভাঙলে দেখল রন বিছানায় হাঁটু মুড়ে মাথা নামিয়ে বসে রয়েছে। চোখের দৃষ্টি ওপরে।
–এই, তোমার শরীর ভাল আছে তো? হ্যারি বললো।
রন শুধু ঘাড় নাড়লো, কথা বললো না। হ্যারির মনে পড়ে গেলো রনের স্লাগ ভমিটিং চার্ম ভুল করে নিজের ওপোর প্রয়োগের কথা। ওর চোখ মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, মুখ খুলতে পারছিলো না, কথা বলা তো দূরের কথা।
–তোমার এখন দরকার হেভি ব্রেকফাস্ট। হ্যারি বলল, চলো।
ওরা যখন গ্রেটহলে পৌঁছালো, তখন সেখানে বেশ ভিড়। সকলেই হাসছে মস্করা করছে, জোরে জোরে কথা বলছে। স্নিদারিন টেবিলের পাস দিয়ে যাবার সময় ওরা অনাবশ্যক হো হো করে হেসে উঠল। হ্যারি লক্ষ্য করল ওরা সাধারণত যে পোশাক পরে তার ওপোর বুকে একটা রূপালী ব্যাজ আটকে রেখেছে, অনেকটা ক্লাউনের মত। অনেকেই হ্যারিকে দেখে হাত নেড়ে অট্টহাস্য করল। ব্যাজে কি লেখা আছে হ্যারি যেতে যেতে পড়বার চেষ্টা করল। কিন্তু রনকে দেখে ওরা আরও হাসাহাসি করবে, সেই পরিস্থিতি এড়াবার জন্য তাড়াতাড়ি ওদের টেবিল ছেড়ে এগিয়ে গেল।
গ্রিফিন্ডরের ছেলে মেয়েরা হ্যারিকে দেখে হৈ হৈ করে উঠল। ওরা প্রত্যেকেই লাল আর সোনালী রঙ-এর পোশাক পরেছে। রন সে সব দেখে আরও মুষড়ে পড়লো। একটা খালি চেয়ারে ধপাস করে বসে টেবিলে রাখা ব্রেকফাস্টের দিকে এমনভাবে চেয়ে রইলো যেন জীবনের শেষ ব্রেকফাস্ট খেতে এসেছে।
–আমার দারুণ নার্ভাস লাগছে, রন হ্যারিকে ফিস ফিস করে বললো, মানসিক অবসাদ!
হ্যারি বললো, ধ্যাৎ আজেবাজে কথা বলবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে। মাঝে মাঝে নার্ভাস হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার।
রন রুদ্ধকণ্ঠে বললো, আমি একটা জঞ্জাল, অপদার্থ, ঘোড়ার ডিম। জীবনে কিছুই করতে পারলাম না।
হ্যারি ওর দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললো, শক্ত হবার চেষ্টা করো, সেবার তোমার চমৎকার গোল বাঁচাবার দৃশ্যটা মনে করার চেষ্টা করো। জর্জ–ফ্রেড পর্যন্ত তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
রন দগ্ধ, ক্লান্ত মুখে হ্যারির দিকে তাকাল।
–ওটা একটা দুর্ঘটনা হিসেবে ধরে নাও, আমি ইচ্ছে করে করিনি; তোমরা সকলে অন্যদিকে তাকিয়েছিলে তখন আমার হাত থেকে ঝাড়ু পড়ে গিয়েছিলো, ওটাকে তুলে নেবার সময় আমার কি কোয়াফিলেতে লেগে গিয়েছিল।
–ঠিক আছে, ঠিক আছে, হ্যারি ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো–তাহলেও আমরা জিতেছি, তাই না?
হারমিওন আর জিনি ওদের বিপরীতে বসে ছিল। লাল-সোনালী স্কার্ফ গলায়, হাতে দস্তানা আর বুকে কৃত্রিম গোলাপ ফুল লাগিয়েছে।
রন ওর খাওয়া শেষ করে পরিত্যক্ত কাঁচের বাটির তলানি দুধের দিকে তাকিয়েছিলো। ভাবছে সেই দুধের মধ্যে ডুবে গেলে কেমন হয়!
হ্যারি বললো–সত্যি ও দারুণ নার্ভাস হয়ে রয়েছে।
হারমিওন বললো, নার্ভাস হওয়া ভাল, বিশেষ করে পরীক্ষার সময়। গুড সাইন, আমিতো দেখেছি তুমি নার্ভাস হলে পরীক্ষার খাতায় ঠিক ঠিক লেখ।
–হ্যালো! কানে এল অতিপরিচিত এক কণ্ঠস্বর, স্বরের মধ্যে ভাব বিহ্বলতা। হ্যারি দেখলো লুনা লাভগুড। র্যাভেন ক্ল গ্রুপ থেকে ওদের পেছনে দাঁড়িয়ে, দেখলো অনেকেই লুনার দিকে তাকিয়ে হাসাহাসি করছে। মাথায় ও একটা অদ্ভুত টুপি পরেছে বিরাট একটা সিংহের মাথার মতো। হ্যাটটা টেনে টুনে মাথায় এমনভাবে আটকিয়েছে যাতে খুলে না যায়।
লুনা বললো–আমি কিন্তু গ্রিফিন্ডারের সাপোর্টার। কথাটা বলে মাথার হ্যাটটায় আঙ্গুল লাগিয়ে বললো, এটা কেমন দেখতে? লুনা ওর ম্যাজিক ওয়ান্ডটা সিংহের মুখে ঠেকাতেই ওটা বিরাট মুখব্যাদন করে সিংহের মতো গর্জন করে উঠতেই আশপাশে যারা বসেছিলো তারা চমকে উঠলো। আমি এটার মুখে একটা সাপ রেখে দিারিনদের বোঝাতাম, দুঃখ এই যে হাতে সময় ছিলো না। এনিওয়ে তোমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হোক রোনাল্ড!
ও এরকম হেলতে দুলতে চলে গেলেও ওরা লুনার সিংহমুখী টুপির শক থেকে তখনও উৎরোতে পারেনি। অ্যাঞ্জেলিনা একরকম দৌড়াতে দৌড়াতে ওদের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল। ওর পাশে কেটি আর অ্যালিসা। ম্যাডাম পমফ্রে ওর চোখের পলক টেনে টুনে স্বাভাবিক করে দিয়েছেন।
অ্যাঞ্জেলিনা বললো, ওরা মাঠে গেলে আমরাও সোজা মাঠে যাবো, দেখতে হবে পিচের অবস্থা।
হ্যারি ওকে আশ্বস্ত করে বললো, যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি। রন এই মাত্র ব্রেকফাস্ট খতম করেছে।
দশ মিনিট অপেক্ষা করেও হ্যারি দেখলো রন কিছু মুখে তুলছে না। তাই ঠিক করলো ওকে ড্রেস চেঞ্জিং রুমে নিয়ে গেলে ভাল হবে। ওরা উঠছে ঠিক সেই সময়ে হারমিওন হ্যারির একটা হাত চেপে ধরে একধারে টেনে নিয়ে গেল।
ও হ্যারির কানের কাছে মুখ এনে ফিস ফিস করে বললো, শোনো রন যেন স্নিদারিনদের ব্যাজ না দেখে।
হ্যারি ওর দিকে জিজ্ঞাসুনেত্রে তাকাতেই হারমিওন চোখ টিপল। রন ভ্যাগাগঙ্গারামের মতো হ্যারি ও হারমিওনের মুখের দিকে তাকাল।
হারমিওন বললো, গুডলাক রন, তোমাকেও হ্যারি। হারমিওন দুজনের মুখে চুমু দিলো।
গ্রেট হল দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রন একটু ধাতস্থ হল। হারমিওন ওর যে গালে চুম্বন করেছে সেখানে হাত ছোঁয়াল। ও যেন বর্তমানের বাস্তব অবস্থাটা ঠিক বুঝতে পারছে না। ও কারও দিকে না তাকিয়ে সোজা চলল। হ্যারি যাবার সময় স্লিদারিন টেবিলের দিকে তাকালো, দেখলো ওদের বুকে আঁটা ক্রাউন শেপের তকমা (ব্যাজ) তাতে লেখা রয়েছে
উইসলি আমাদের রাজা।
এইসব আজেবাজে লিখে ওরা নিজেদের খেলো করছে। ও একরকম টানতে টানতে রনকে নিয়ে হল ছেড়ে বাইরে দাঁড়াল। বাইরে তখনও বরফের মতো ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে চলেছে।
ওরা স্টেডিয়ামের দিকে চলল। পায়ের তলায় তুষার আবৃত ঘাসগুলো ওদের হাঁটার সময় নুয়ে পড়তে লাগল। একটু একটু করে আকাশ অনেকটা পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। ঠাণ্ডা বাতাস নেই। হ্যারি হালকা সূর্য কিরণের দিকে তাকাল। খেলার সময় ভাবলো সূর্যের কিরণ চোখে পড়বে না। ভিজিবিলিটি ভালই হবে। হ্যারি রনকে চাঙ্গা করার জন্য আবহাওয়া পরিবর্তনের কথা বললো। বললেও ও বুঝতে পারলো ওর অর্ধেক কথা রনের কানে যাচ্ছে না।
ঘরে ঢুকে দেখল খেলতে যাবার জন্য অ্যাঞ্জেলিনা প্রস্তুত। টিমের ছেলে মেয়েদের সঙ্গে রন কৌশল নিয়ে আলোচনা করছে। রন, অ্যালিসিয়া ওকে সাহায্য করার আগেই রোবস খুলে হ্যারির পাশে বসে অ্যাঞ্জেলিনার কথা শুনতে লাগল। প্রায় শান্ত ঘর একটু একটু করে করে কলরবে মুখরিত হল। দলে দলে ছেলে মেয়েরা ক্যাসেল থেকে খেলা দেখতে আসছে।
–দাঁড়াও, আমি স্নিদারিনদের ফাইনাল লাইন আপ দেখে আসি। অ্যাঞ্জেলিনা হাতে একটা পার্চমেন্টের টুকরো নিয়ে বললো, গত বছরের বিটারস ডেরিক, এবার টিমে নেই, দেখছি মন্টাগু কিছু গেরিলা এনেছে। ক্র্যাব আর গোয়েলের খেলার ধারা আমি জানি, নতুনদের জানি না।
–আমরা জানি, রন-হ্যারি একসঙ্গে বলে উঠল।
অ্যাঞ্জেলিনা পকেটে পার্চমেন্টটা রেখে বললো, দেখেত ভাল মনে হয় না।
দুএকটা বিপক্ষ টিমের প্লেয়ারদের সম্বন্ধে কথাবার্তা বলার পর অ্যাঞ্জেলিনা ঘড়ি দেখে বললো, এসো মাঠে যাই। সকলকে গুডলাক।
টিমের ছেলেরা একটা লাইন করে খেলার মাঠে ঢুকলো। আকাশে তখন সূর্য উঠেছে, আবহাওয়া খুবই সুন্দর। সারা মাঠের দর্শক হর্ষধ্বনি করে উঠলো, হাততালি দিলো। মাঝে মাঝে শিসের শব্দ! স্লিদারিন টিম ওদের ক্যাপ্টেন মন্টের সঙ্গে লাইন করে দাঁড়িয়ে আছে বুকে ওদের রূপালী ক্রাউন শেপের ব্যাজ। নতুন ক্যাপ্টেন মন্টেগুকে দেখে হ্যারির মনে হল যেন ডাডলি ডার্সলি দাঁড়িয়ে রয়েছে। সুয়োরের মত মোটা মোটা হাতে নতুন বিটার ব্যাট দোলাচ্ছে। ওর পেছনে রয়েছে ক্র্যাবে আর গোয়েলে। ম্যালফয় এককোণে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওর সোনালী রঙ-এর চুলের ওপোর সূর্যের আলো এসে পড়েছে। ওর চোখ হ্যারির দিকে পড়তেই বোকা বোকা হেসে বুকের ব্যাজে হাত ছোঁয়াল।
–ক্যাপ্টেনস হ্যান্ড শেক করো, রেফারি ম্যাডাম হুচ বলতেই অ্যাঞ্জেলিনা আর মন্টেগু এগিয়ে এসে করমর্দন করল। হ্যারির মনে হলো বিরাট চেহারার মন্টেগু, অ্যাঞ্জেলিনার হাতের আঙুল চিড়ে চ্যাপটা করে দেবে। নাও এবার তোমরা সবাই যে যার ঝাড়ুতে বসে পড়ো, রেফরি ম্যাডাম হুচ বললো।
অ্যাঞ্জেলিনা রনের মুখের চেহারা দেখে হ্যারিকে চাপা গলায় বললো, রনকে ওদের দিকে তাকাতে মানা কর। বিশেষ করে ব্যাজের দিকে। হারমিওন রনের পিঠ চাপড়ে বললো, গুডলাক, লড়ে যাও।
যে গালে হারমিওন চুম্বন করেছিল সেখানে আবারও হাত ছোঁয়াল রন।
ওরা আকাশে উড়তে শুরু করলো।
প্রফেসর ম্যাকগোনাগল খুব জোরে জোরে বললেন, জোড়ান কমেন্ট্রি শুরু করো।
জোর্ডান বলতে শুরু করলো, ওয়ারিংটন পাস দিয়েছে মন্টেগুকে, ক্র্যাবি ওকে পেছন থেকে ধাক্কা মেরেছে, মন্টেগু কোয়াফিল ঠিক ধরে ফেলেছে। হ্যাঁ কেটি বেল গ্রিফিল্ডরের, অ্যালিসিয়াকে পেছনদিকে পাস দিয়েছে।
হ্যারির কানে আসছে লিজোর্ডানের কণ্ঠস্বর। দর্শকদের চিত্তার, হুইসেলের শব্দ, বুম বুম শব্দ, শিস আর গান।
ওয়ারিংটন ব্লজারকে এড়িয়ে ছুটেছে, অ্যালিস ওখানে পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে, ওরা সবাই কি গান করছে?
লি গান শোনার জন্য সামান্য সময় ধারাবিবরণী বন্ধ করল। স্লিদারিনরা স্ট্যান্ডে বসে গান করছে
উইসলি কিছু পারে না
বল নিয়ে এগোয় না
তাই স্নিদারিনরা গায় গান
উইসলি আমাদের রাজা।
উইসলি জন্মেছে একটা বিনে
তাই–কোয়াফিল ফেলে গুণে গুণে
উইসলি আমাদের জেতাবে
উইসলি আমাদের রাজা।
গান বন্ধ করে আবার ধারাবিবরণী শুরু হল
–হ্যাঁ অ্যালিসা, অ্যাঞ্জেলিনাকে পাস দিয়েছে, লি চিৎকার করে মাইকের কাছে মুখ এনে বললো। লি স্লিদারিনদের গান শুনেছে।
অ্যাঞ্জেলিনা… অ্যাঞ্জেলিনা এগিয়ে এসো। ওহ্ ও বল মেরেছে, আহাহা পারলো না। পারলো না।
দর্শকদের গান লির ধারা বিবরণী রুখে দিলো।
রাজা আমাদের উইসলি
রাজা আমাদের উইসলি
কোয়াফিল ধরে ফেলেও ঠিক
উইসলি আমাদের রাজা।
ওয়ারিংটন কোয়াফিল ধরেছে, গোলের দিকে ছুটছে
ও ক্লাজের থেকে অনেক দূরে, একেবারে কীপারের সামনে ও।
স্নিদারিন স্ট্যান্ড থেকে গান ভেসে এলো
উইসলি একটি ষাঁড়ের গোবর
পারে না কিছু
মাথায় ওর… ঘিচু।
–ওহহ, হো হো স্লিদারিন গোল দিয়েছে। দর্শকদের পাগলের মতো চিৎকার, হাততালি, শিসের শব্দে তলিয়ে যায় লির গলা।
স্নিদারিনরা আরো উচ্চস্বরে গাইছে।
উইসলি জন্মেছে একটা বিনে
তাই কোয়াফিল ফেলে গুণে গুণে
ও হো হো, দারুণ হৈ চৈ চিৎকার, জোর্ডান গম্ভীর কাঁপা কাঁপা উত্তেজিত স্বরে বললো গ্রিফিন্ডর জিতে গেছে।
একই রকম গান গেয়ে চলেছে স্নিদারিনরা।
হ্যারি ভাগ্যবশত খেলার মাঠ থেকে স্নিচটা ধরার জন্য ডাইভ দিয়ে পাঁচ ছমিনিট উঁচুতে ছিলো–ঠিক সেই সময় ওর পিঠে কে যেন ব্যাট দিয়ে আঘাত করতেই ও দড়াম করে বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে পড়ে গেল। হাত থেকে ঝাড়ুটা ছিটকে পড়লো। অতর্কিত আক্রমণে ও হকচকিয়ে গেল, শুনতে পেল ম্যাডাম হুচের তীব্র হুইসিল। শুধু তাই নয় স্টেডিয়াম থেকে দর্শকদের মাও মাও শব্দে ধিক্কার, তীব্র স্বরে চিৎকার, ধুপধাপ শব্দ, তারপর অ্যাঞ্জেলিনার ভয়ার্ত গলা, তুমি ঠিক আছো তো?
হ্যারি ম্যাডাম হুচের একটা হাত ধরে কোনওরকমে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, হ্যাঁ ম্যাডাম ঠিক আছি।
ম্যাডাম হুচ উপরে তাকিয়ে ধরবার চেষ্টা করলেন স্লিারিনের কোন্ ছেলেটা অন্যায়ভাবে হ্যারিকে পিঠে ব্যাট দিয়ে মারলো।
অ্যাঞ্জেলিনা রাগত স্বরে বললো–ওই ক্র্যাবি মেরেছে। পাজিটা যেই তোমাকে স্নিটা ধরতে দেখেছে ও ফট করে তোমাকে জোরে মারলো, যাকগে হ্যারি, আমরা জিতেছি, জিতেছি, জিতেছি।
হ্যারির পেছন থেকে কে যেন পি করল। হ্যারি স্নিচটা হাতে শক্ত করে ধরে পিছন দিকে তাকালো, দেখলো ড্রাকো ম্যালফয়! ওর চোখ মুখ রাগে ফেটে পড়ছে, বিশ্রী মুখ ভঙ্গি করে দড়িয়ে রয়েছে।
–খুব ভাল, উইসলির ঘাড় ভাঙেনি, তুমি বাঁচিয়েছ, ও হ্যারিকে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো। ওইরকম কীপার কোথা থেকে জোটালে হে? আমি তো জীবনে দেখিনি ওইরকম অপদার্থ কীপার। কিন্তু হায়! ওর জন্য যে ডাস্টবিনে, আমাদের লেখা গান তোমার মনের মতো হয়েছে পটার?
হ্যারি দেখলো এক এক করে ওদের দলের প্লেয়াররা মাঠে নামছে। নামেনি শুধু রন! গোলপোস্টের নিচে নেমে ধীরে ধীরে ওকে চেঞ্জিং রুমের দিকে যেতে দেখল। একাই যাচ্ছে।
কেটি, আর অ্যালেসিয়া হ্যারিকে জড়িয়ে ধরলে পেছন থেকে ম্যালফয় হেসে বললো, ওর মোটা, কুৎসিতের জন্য ছড়া লিখতে পারিনি, ওর মাকে নিয়ে লিখেছি, শুনবে?
ম্যালয়ের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে অ্যাঞ্জেলিনা বললো, সমঝে কথা বলবে।
–ওর বাবাকে নিয়েও লেখা হয়নি।
ফ্রেড আর জর্জ অদূরে হ্যারির সঙ্গে কথা বলছিলো। কথাটা ওদের কানে যেতেই ওরা ম্যালফয়ের দিকে তাকালো।
অ্যাঞ্জেলিনা, ফ্রেডের একটা হাত চেপে ধরে বললো, থাকগে যেতে দাও। হেরে গিয়ে উল্টোপাল্টা বকছে, আঙ্গুর ফল টক।
–পটার উইসলিরা তো তোমার খুব বন্ধু, পছন্দও কর তুমি তাদের? ম্যালফয় বললো, ওদের ওখানে ছুটির সময়ে থাকো, বেশ মজাসে থাকো তাই না? মাগলদের পচা গন্ধ নাকে লাগে না?
ফ্রেডকে ধরে রাখতে পারে না কেটি, অ্যালিসিয়া, অ্যাঞ্জেলিনা। হ্যারি অবশ্য জর্জকে ধরে রেখেছে। ম্যালফয় তখনও বিশ্রীভাবে হাসছে।
হ্যারি ম্যাডাম ইচের দিকে তাকাল, উনি তখন ক্র্যাবকে ওর বেআইনী ব্লাজার আক্রমণের জন্য ধমকাচ্ছেন।
জর্জ এগিয়ে গিয়ে ম্যালফয়ের পেটে একটার পর একটা প্রচণ্ডভাবে ঘুষি মারতে লাগল।
–হ্যারি! জর্জ! ওকে মেরো না, না না।
প্রচণ্ড মার খেয়ে ম্যালফয় কাতরাতে কাতরাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। হ্যারি সঙ্গে সঙ্গে জাদুদণ্ড দিয়ে ইমপেডিমেন্ট জিঙ্কস প্রয়োগ করেছে। ম্যাডাম হুচ ক্রমাগত হুইসিল বাজিয়ে যাচ্ছেন। ম্যালফয়ের নাক দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে, চোখ-নাক-মুখ ফুলে গেছে জর্জের মারের চোটে। ম্যাডাম হু বললেন তোমরা খুব অন্যায় কাজ করেছ। তোমরা দুজনেই ক্যাসেলে চলে যাও, সোজা তোমাদের হেডের অফিসে! যাও, এক সেকেন্ড দেরি করবে না।
জর্জ আর হ্যারি হাঁফাতে হাঁফাতে খেলার মাঠ ছেড়ে কোনও কথা না বলে চলে গেল। এনট্রেন্স হল পর্যন্ত গিয়ে আর ওরা গান শুনতে পেলো না। জর্জের হাতে, হাঁটুতে দারুণ ব্যথা, হাতে রয়েছে অর্ধ ভগ্ন স্নিচের ডানা। ও যেন হ্যারির আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে পালাবার চেষ্টা করছে।
ওরা ম্যাকগোনাগলের অফিসের দরজার কাছে পৌঁছবার আগেই পিছন ফিরে দেখলো প্রফেসর ম্যাকগোনাগল হন্তদন্ত হয়ে করিডোর দিয়ে আসছেন। ম্যাকগোনাগল গ্রিফিন্ডার হাউজের স্কাটা গলা থেকে কম্পিত হাতে খুলতে খুলতে ওদের দুজনের মুখের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকালেন। দারুণ রেগে গিয়ে বললেন–ভেতরে যাও। হ্যারি আর জর্জ ঘরের ভেতর গেল। ম্যাকগোনাগল তার টেবিলের পেছনে চলে গিয়ে ওদের দিকে তাকালেন। রাগে কাঁপতে কাঁপতে গলা থেকে স্কার্ফটা টেনে খুলে মেঝেতে ফেলে দিলেন।
–হ্যাঁ? ম্যাকগোনাগল বললেন–আমি জীবনে দুজনে মিলে একজনকে মারার জঘন্য কাণ্ড আজ পর্যন্ত দেখিনি। বলো, জবাব দাও কেন এমন জঘন্য কাজ করেছ?
হ্যারি বললো, ম্যালফয় আমাদের খারাপ কথা বলেছিল।
–তোমাদের খারাপ কথা বলেছিলো? প্রফেসর ম্যাকগোনাগল ভীষণ জোরে বললেন। ডেস্কের ওপোর একটা চাপড় দিলেন। ডেস্কের ওপোর রাখা চৌকো ফুলকাটা বাক্সটা মেঝেতে পড়ে তার মধ্যে থেকে আদার শুকনো টুকরোগুলো ছড়িয়ে পড়লো। হ্যাঁ, ওদের দল অবশ্য হেরে গেছে, তাই তোমাদের প্রোডোক করতে চেয়েছিলো। কিন্তু তোমরা দুজনে মিলে ওকে ওইরকমভাবে মারলে কেন?
জর্জ বললো, ও আমার মা-বাবা তুলে কথা বলেছে। হ্যারির মাকেও।
–খুব ভাল! তা তোমরা ম্যাডাম হুচের হাতে ব্যাপারটা ছেড়ে না দিয়ে মারামারি করলে কেন? মাগলরা ওইরকম করে সেটা জানো? তোমাদের অসভ্যতার…! কতোদূর অন্যায় করেছে জানো?
ছি! ছি! হেম হেম।
কথাটা শুনে হ্যারি আর জর্জ পিছন ফিরে তাকাল। দেখল ডোলোরেস আমব্রিজ দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ব্যাঙের মত ফুলো ফুলো শরীরে সবুজ টুইডের কোট তাকে আরও মোটা দেখাচ্ছে। বিশ্রীভাবে হাসছেন, হাসির মধ্যে দূরভিসন্ধির ছাপ! হ্যারি বুঝতে পারল তার কপালে অশেষ দূর্গতি আগত।
–আমি কি আপনার কোনও সাহায্যে আসতে পারি প্রফেসর ম্যাকগোনাগল? আমব্রিজ তার অতিখ্যাত বিষ্ময় হাসিতে বললেন।
ম্যাকগোনাগলের মুখ লাল হয়ে গেল।
–সাহায্য? ম্যাকগোনাগল বললেন, সাহায্য বলতে আপনি কি বলতে চাইছেন?
প্রফেসর ঠিক সেইরকম বদখতভাবে হাসতে হাসতে ম্যাকগোনাগলের ঘরে ধীর পদক্ষেপে ঢুকলেন।
–ভাবলাম আপনি হয়তো আমার সাহায্য পেলে খুশি হবেন।
হ্যারি দেখল আমব্রিজের নাকের চুলগুলো বেরিয়ে এসে যেন নাচছে।
ম্যাকগোনাগল আমব্রিজের দিকে তাকিয়ে সংযত স্বরে বললেন, খুব সম্ভব আপনি ব্যাপারটা ঠিক অনুধাবন করতে পারেননি। ও হ্যাঁ, তোমরা ভাল করে শোনো। ম্যালফয় তোমাদের কতোটা উস্কে দিয়েছিলো আমি সম্যক জানি না। তোমাদের পরিবারের প্রত্যেকের প্রতি কটাক্ষ, অপমান সূচক মন্তব্যের ব্যাপারে আমার কোনও মাথাব্যাথা নেই; কিন্তু তোমাদের অমার্জিত আচরণ আমার কাছে খুবই খারাপ লেগেছে। তাই এই অপরাধের জন্য আমি তোমাদের এক সপ্তাহ ডিটেনশনের শাস্তি দিলাম। পটার, তুমি ওইরকমভাবে আমার দিকে তাকাবে না। তোমার বর্বরোচিত অপরাধের জন্য এই শাস্তি প্রাপ্য এরপর যদি আর কখনও…।
হেম হেম।
প্রফেসর শাস্তির কথা বলে তার দুচোখ বন্ধ করলেন। যেনো ঈশ্বরকে ওদের ক্ষমা করতে প্রার্থনা করছেন। তারপর ধীরে ধীরে চোখ খুলে আমব্রিজের দিকে তাকালেন, কিছু বলবেন প্রফেসর আমব্রিজ?
আমব্রিজ গলা খাকাড়ি দিয়ে বলে আমার কিন্তু মনে হয় ওদের শাস্তি আপনি অপরাধের তুলনায় কমই দিলেন। আরও কঠিন শাস্তি ওদের প্রাপ্য, আমব্রিজের মুখে নোংরা হাসি!
–ডোলোরেস আমার মনে হয় ওদের আমি যথোচিত শাস্তি দিয়েছি। ওরা দুজনেই আমার হাউজের। হাউজের হেড হিসেবে আমি ওদের শাস্তি দেবার সম্পূর্ণ অধিকারী।
–ওয়েল মিনার্ভা, আপনি গ্রিফিল্ডর হাউসের হেড সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তবে আমার কথাটা শুনুন, সেটা মোটেই হালকাভাবে নেবেন না, যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কথাটা বলে আমব্রিজ তার হ্যান্ডব্যাগ খুলে হাতড়াতে লাগলেন। আহ কর্নেলিয়স ফাজের চিঠিটা কোথায় রাখলাম! এখানে আসার আগে তো ইস্য করলেন! ও হা এইতো পেয়েছি। আমব্রিজ একটা অফিসিয়াল পার্চমেন্ট বার করলেন।
পড়বার আগে গলা খাকাড়ি দিলেন।
–হেম হেম, এডুকেশনাল ডিক্রি নং পঁচিশ।
–আরও একটি? ম্যাকগোনাগল রাগে ফেটে পড়ে বললেন।
আমব্রিজের হাতে কাগজ, মুখে অমায়িক খচ্চরের হাসি!
–আসলে মিনার্ভা, আপনি চব্বিশ নং ডিক্রি অ্যামেন্ড করতে প্রকারন্তরে বাধ্য করেছেন। আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে, গ্রিফিল্ডরদের নতুন কিডিচ টিম গঠনের অনুমতি না দেওয়ার ব্যাপারে আপনি অহেতক আমার সঙ্গে কথা কাটাকাটি করেছিলেন, শুধু তাই নয়–ডাম্বলডোরকে হস্তক্ষেপ করতে অনুরোধ করেছিলেন। যাইহোক আপনার ব্যবহার আমার আদতেই ভাল লাগেনি, তাই সমগ্র ব্যাপারটা বাধ্য হয়ে মাননীয় মন্ত্রীর গোচরে এনেছিলাম। তিনি এই চিঠিতে বলেছেন, নতুন আইন অনুসারে ছাত্র-ছাত্রীদের কি সুবিধে দেওয়া যাবে বা যাবে না তা সবই উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্তকারীর এক্তিয়ারভুক্ত। তাহলে বুঝতে পারছেন মিনার্ভা, আমি গ্রিফিন্ডারদের টিম গঠনের অনুমোদন না দিতে চেয়ে কোনও অপরাধ করিনি। মান নীয় মন্ত্রী আরও কি লিখেছেন শুনুন। লিখেছেন, এরপর থেকে শিক্ষকদের কোনোরূপ প্রদত্ত শাস্তি, অনুমোদন ও স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের কোনোরূপ প্রিভিলেজ তুলে নেবার ব্যাপারে তদন্তকারীর পূর্ণ স্বাধীনতা আছে বা থাকবে। দস্তখত করেছেন কর্নেলিয়স ফাজ, ম্যাজিক মন্ত্রী অর্ডার মারলিন ফার্স্ট ক্লাস ইত্যাদি ইত্যাদি।
পড়া শেষ হলে আমব্রিজ পার্চমেন্টটা ভাজ করে হ্যান্ড ব্যাগে রেখেদিলেন। মুখে তখনও সেই অমায়িক হাসি।
–তো এদের দুজনকে চিরতরে কিডিচ খেলা থেকে নির্বাসন দিতে হয় কি বলুন মিনার্ভা? আমব্রিজ বললেন। তারপর মিটি মিটি হেসে হ্যারি আর জর্জের মুখের দিকে তাকালেন। হ্যারির হাতের স্নিচটা বেসামাল হয়ে উঠলো।
–আমাদের আর খেলতে দেবেন না? হ্যারি বললো, চিরকালের জন্য! ওর গলার স্বর কেপ কেঁপে উঠল।
–আমার মনে হয় অগত্যা মি. পটার সারাজীবনের জন্য ব্যান, বিশেষ কার্যকরী হবে। আমব্রিজের হাসি যেন থামতে চায় না–শুনুন মিনার্ভা এই দুই। দুইছেলের অপরাধের মাত্রা বেশি বলেই শাস্তির মাত্রা বেশি। সাতদিন ডিটেনসন থাকা মনে হয় খুবই লঘু, এরা দুজন ছাড়া আপনার গ্রিফিন্ডর টিমের অন্য ছেলের অবশ্যই খেলতে পারবে। আমি কিন্তু একটুও অযৌক্তিক কথা বলছি না। আসলে অন্য ছেলেমেয়েরা তো এদের মতো মারাত্মক রকমের হিংসাত্মক কিছু করেনি।
–যাকগে এবার চলি।
আমব্রিজ ঘর ছেড়ে অত্যন্ত খুশি মনে চলে গেলেন।
***
নিষিদ্ধ তোমাদের আর খেলতে দেওয়া হবে না? সন্ধ্যাবেলা হতাশ হয়ে কমনরুমে অ্যাঞ্জেলিনা বললো, সীকার নয়, বিটারস নয় তাহলে…?
অ্যালিসা বললো–অত্যান্ত অন্যায়, ব্লাজার দিয়ে হ্যারিকে পিঠে মেরেও ছাড়া পেয়ে গেল?
জিনি, হারমিওন বেজায় চটেছে। ফ্রেড কিছু করেনি তাও ওকে শাস্তি দিয়েছেন আমব্রিজ।
হারমিওন রাগের চোটে বার বার ওর হাঁটুতে চাপড় দিতে লাগল।
ফ্রেড বললো, আমি তো কোনও দোষ করিনি! তোমরা তিনজন যদি আমাকে ধরে না রাখতে তাহলে ম্যালফয়ের হাড় গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিতাম।
হ্যারির অসম্ভব মন খারাপ। ভাবতেই পারছে না ও আর এই স্কুল জীবনে কিডিচ ম্যাচ খেলতে পারবে না। ও কারও দিকে না তাকিয়ে অন্ধকার জানালার দিকে তাকিয়ে রইল। হাত থেকে স্নিচটা সরে গিয়ে সারা ঘরে বো বোঁ শব্দ করে উড়ছে। বাইরে অবিশ্রান্ত তুষারপাত হয়ে চলেছে। কুকশ্যাংক স্নিচটাকে ধরবার জন্য দাপাদাপি করতে লাগল ঘরে।
–আমি শুতে চললাম, অ্যাঞ্জেলিনা ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে বললো।
–হতে পারে ভাল করে ঘুমোতে পারবো না, দুঃস্বপ্ন দেখবো, হতে পারে সকালে বিছানা ছেড়ে উঠে মনে হবে আমাদের খেলা হয়নি।
অ্যালিসা, কেটি ও অ্যাঞ্জেলিনার সঙ্গে কমনরুম ছেড়ে ঘুমোতে চলে গেল। ওরা চলে যাবার পর ফ্রেড-জর্জও চলে গেল। জিনিও বেশিক্ষণ বসে রইলো না। শুধু হ্যারি আর হারমিওন আগুনের ধারে চুপ করে বসে রইল।
–রনকে দেখতে পাচ্ছি না, হারমিওন খুব চাপা গলায় বললো।
হ্যারি শুধু মাথা নাড়লো।
–মনে হয় ও আমাদের বসতে দিতে চাইছে না, হারমিওন বললো, কোথায় গেছে মনে হয়?
ঠিক সেই সময়ে ফ্যাট লেডি দরজা খুলতেই রন ঘরে ঢুকল। রন প্রোট্রেটের হোল দিয়ে ঘরে ঢুকেছে। ওকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। সারা শরীরে, মাথায় স্নো ভরে গেছে। হ্যারি আর হারমিওনকে দেখে ও ধপাস করে বসে পড়ল।
হারমিওন ওর দিকে তাকিয়ে বললো, আরে তুমি কোথায় ছিলে? আমরা ভেবে। অস্থির।
–ঘুরছিলাম, রন বললো। ও তখনও কিডিচের জার্সি পরে রয়েছে।
–তুমি তো দেখছি ঠাণ্ডায় জমে গেছ। এসো আগুনের ধারে বসো, হারমিওন ওকে ডাকলো।
রন হ্যারির দিকে না তাকিয়ে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে আগুনের সামনে বসে পড়ল।
চুরি করে আনা সিচটা ওদের মাথার ওপোরে বোঁ বোঁ শব্দ করে তখনও উড়ছে।
রন নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে বললো, আমি দুঃখিত।
হ্যারি বললো, কিসের জন্য?
–ভেবেছিলাম কিডিচ খেলতে পারি। রন বললো, কাল আমার প্রথম কাজ হবে টিম থেকে পদত্যাগ।
–তুমি যদি ছেড়ে দাও তাহলে টিমে মাত্র তিনজন বাঁচবে। রন ওর দিকে বোকার মতো তাকালে হ্যারি বললো, আমাকে আর ফ্রেড জর্জকে লাইফ টাইম ব্যান করেছেন প্রফেসর আমব্রিজ।
রন ভাঙা ভাঙা গলায় বললো–কী বললে? আবার বল।
হারমিওন রনকে ঘটনার আগাগোড়া সব বললো। রনের আর ঘটনার পুনরাবৃত্তি করতে মন চাইছিলো না। সব কথা শুনে রন আরও বিমর্ষ, হতাশ হয়ে গেল।
–সবই আমার দোষ।
হ্যারি রেগে গিয়ে বললো, বাজে কথা বলবে না রন, তুমি কী আমায় ঘুসি মেরেছিলে?
–আমার কিডিচ খেলা যদি অতো খারাপ না হতো।
–খেলার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই।
–ওদের সেই গান আমাকে…।
–তোমাকে শুধু নয়, আমাদের সবাইকে আঘাত করেছে।
হারমিওন সহসা আগুনের কাছ থেকে উঠে অন্ধকার জানালার কাছে দাঁড়ালো। ও তর্ক-বিতর্কের মধ্যে থাকতে চায় না। হ্যারি জোর গলায় বললো, অযথা নিজের গায়ে দোষ চাপাবে না রন।
রন কোনও কথা না বলে ওর রোবের ভিজে অংশের দিকে দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে তাকিয়ে রইল। বেশ খানিকটা সময় নীরব থেকে বিড় বিড় করে বললো, এটা আমার জীবনে সবচেয়ে দুঃখের ঘটনা।
হ্যারি তিক্ত স্বরে বললো, ক্লাবে যোগ দাও। ছাড়বে না।
হারমিওন জানালার দিকে পেছন করে হ্যারি আর রনের দিকে তাকিয়ে বললো, আমি একটা জিনিস জানি, শুনলে তোমাদের দুজনেরই হতাশা কেটে যাবে।
–হা হা, বলো বলল, হ্যারি বললো।
–জানো? হ্যাগ্রিড ফিরে এসেছেন।