১৯. দোস্ত মুহম্মদ

দিন দশেক পরে একদিন জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখি, দোস্ত মুহম্মদ। ছুটে গিয়ে দরজা খুলে কাবুলী কায়দায় ভালো আছেন তো, মঙ্গল তো, সব ঠিক তো, বলতে আরম্ভ করলুম। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলুম, দোস্ত মুহম্মদ কোনো সাড়া-শব্দ না দিয়ে আপন মনে কি সব বিড়বিড় করে বলে যাচ্ছেন। কাছে এসে কান পেতে যা শুনলুম, তাতে আমার দম বন্ধ হবার উপক্রম। বলছেন, কমরত ব শিকনদ, খুদা তোরা কোর সাজদ, ব পূন্দী, ব তরকী ইত্যাদি।

সরল বাঙলায় তর্জমা করলে অর্থ দাঁড়ায়, তোর কোমর ভেঙে দুটুকরো হোক, খুদা তোর দুচোখ কানা করে দিন, তুই ফুলে উঠে ঢাকের মত হয়ে যা, তারপর টুকরো টুকরো হয়ে ফেটে যা।

আমি কোনো গতিকে সামলে নিয়ে বললুম, দোস্ত মুহম্মদ, কি সব আবোল-তাবোল বকছেন?

দোস্ত মুহম্মদ আমাকে আলিঙ্গন করে দুগালে দুটো বশেল চমো লাগালেন। বললেন, আমি কক্ষনো আবোল-তাবোল বকিনে।

আমি বললুম, তবে এসব কি?

বললেন, এসব তোর বালাই কাটাবার জন্য। লক্ষ্য করিসনি, এদেশে বাচ্চাদের সাজিয়ে-গুজিয়ে কপালের একপাশে খানিকটে ভুসস মাখিয়ে দেয়। তোর কপালে তো আর ভুসো মাখাতে পারিনে তাই কথা দিয়ে সেরে নিলুম। যাকে এত গালাগাল দিচ্ছি, যম তাকে নেবে কেন? পরমায়ু বেড়ে যাবে। বুঝলি?

লক্ষ্য করলুম গেল বার দোস্ত মুহম্মদ আমাকে তুমি বলে সম্বোধন করেছিলেন এবারে সেটা তুইয়ে এসে দাঁড়িয়েছে।

ফার্সী ভাষায় আপনি, তুমি, তুই তিন বাক্য নেই। আছে শুধু শোমা আর তো। কিন্তু ঐ তো দিয়ে তুমি, তুই দুই-ই বোঝানো যায় যে রকম ইংরিজীতে যখন বলি, ড্যাম ইউ, তখন তার অর্থ আপনি চুলোয় যান, নয়, অর্থ তখন তুই চুলোয় যা। খাঁটি পাঠান আবার শোমা কথাটাও ব্যবহার করে না, ইংরেজের মত শুধু ঐ এক ইউই জানে। বেদুইনের আরবীতেও মাত্র এক আনতা। বোধ হয় পাঠান, ইংরেজ, বেদুইনের ডিমোক্র্যাসি তার সম্বোধনের সময় প্রকাশ পেয়েছে।

দোস্ত মুহম্মদ স্মরণ করিয়ে দিলেন প্যারিসফের্তা সইফুল আলমের ছোট ভাইয়ের বিয়ের নেমন্তন্ন। সইফুল আলম তাকে পাঠিয়েছেন আমাকে নিয়ে যেতে। গাড়ি তৈরী।

সিগরেট দিয়ে বললুম, খান।

বললেন, না। আবদুর রহমানকে বলল তামাক দিতে।

আমি বললুম, আবদুর রহমানকে চেনেন তা হলে।

বললেন, তোমাকে কে চেনে বাপু, তুমি তো দুদিনের চিড়িয়া আমাকে কে চেনে বাপু, আমিও তিন দিনের পাখি— যে-পাহাড় থেকে নেমে এসেছি, সে-পাহাড়ের গর্ভে আবার ঢুকে যাব, আগা আহমদের টাকাটা মেয়ে। আমি কে? মকতবে আমানিয়ার অধ্যাপক অবশ্যি বটি, কিন্তু কটা লোক জানে। অথচ বাজারে গিয়ে পুছছ, দেখবে সবাই জানে, আমি হচ্ছি সেই মূর্খ, যার কাঁধে বন্দুক রেখে আগা আহমদ শিকার করে; অর্থাৎ আগা আহমদের মনিব। তুমি কে? যার কাধে আবদুর রহমান বন্দুক রেখেছে–শিকার করে কি না-করে পরে দেখা যাবে। চাকর দিয়ে মনিব চিনতে হয়।

আমি বললুম, বেশ, বেশ। তারপর বাঙলায় বললুম, গোঁপের আমি, গোঁপের তুমি, তাই দিয়ে যায় চেনা।

বললেন, বুঝিয়ে বল।

তর্জমা শুনে দোস্ত মুহম্মদ আনন্দে আত্মহারা। শুধু বলেন আফরীন, আফরীন, সাবাস, সাবাস, উদা কবিতা, জরির কলম। তারপর মুখে মুখে শেষ লাইনের একটা অনুবাদও করে ফেললেন,

মনে বুরুৎ, তনে বুরুৎ, বুরুৎ সনাক্তদার।। তারপর বললেন, আমি আরবী, ফার্সী, আর তুর্কী নিয়ে কিছু কিছু নাড়াচাড়া করেছি, কিন্তু ভাল রসিকতা কোথাও বিশেষ দেখিনি। পদ্যে তো প্রায় নেই-ই। বাঙলায় বুঝি এরকম অনেক মাল আছে?

আমি বললুম, না, মাত্র দুখানা কি আড়াইখানা বই।

দোস্ত মুহম্মদ নিরাশ হয়ে বললেন, তাহলে আর বাঙলা শিখে কি হবে।

পেশাওয়ারের আহমদ আলী আর কাবুলের দোস্ত মুহম্মদে একটা মিল দেখতে পেলুম— দুজনই অল্প রসিকতায় খুব মুগ্ধ হন। তফাতের মধ্যে এইটুকু যে, আহমদ আলীর জীবনের ধারা বয়ে চলেছে আর পাঁচজনের মত, আর দোস্ত মুহম্মদের জীবন যেন নিঝরের স্বপ্নভঙ্গ। এক পাথর থেকে আরেক পাথরে লাফ দিয়ে দিয়ে এগিয়ে চলেছে, মাঝখানে রসিকতার সূর্যকিরণ পড়লেই রামধনুর রঙ মেখে নিচ্ছে। দু-একবার মামুলি দুঃখকষ্টের কথা বলতে গিয়ে দেখলুম, সে সব কথা তার কানে যেন পৌচচ্ছেই না। বিলাসব্যসনেও শখ নেই। তিনি যেন সমস্তক্ষণ বোম্বাগড়ের সন্ধানে যেখানে রাজার পিসি পাঁউরুটিতে পেরেক ঠোকেন, যেখানে পণ্ডিতেরা টাকের উপর ডাকের টিকিট আঁটেন।

তাই যখন আমরা বিয়ের মজলিসে গিয়ে কাবুল শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মাঝখানে আসন পেলুম, তখন দোস্ত মুহম্মদের জন্য দুঃখ হল। খানিকক্ষণ পরে দেখি, তিনি চোখ বন্ধ করে বিড় বিড় করে কি যেন আপন মনে বলে যাচ্ছেন। তাঁর দিকে একটু ঝুকতেই তিনি বললেন, ফয়েজ মুহম্মদের গুণে শিক্ষামন্ত্রীর নাম,

শিক্ষামন্ত্রীর পদের জোরে ফয়েজ মুহম্মদের নাম–মুহম্মদ তজীর গুণে বিদেশী সচিবের নাম, না বিদেশী সচিবের পদের জোরে মুহম্মদ তজীর নাম? বাঙালী কবি লাখ কথার এক কথা বলেছে,

গোঁপের আমি, গোঁপের তুমি তাই দিয়ে যায় চেনা।

আমি বললুম, চুপ, মন্ত্রীরা সব আপনার দিকে তাকিয়ে। আছেন, শুনতে পেলে আপনাকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবেন।

বললেন, হ্যাঁ তা বটে, বিশেষ করে ঐ ফয়েজটা।

আমি জিজ্ঞাসা করলুম, ফয়েজ মুহম্মদ খান, মিনিস্টার অব পাবলিক-ইনস্ট্রাকশন?

উত্তর দিলেন, না, সিনিস্টার অব পাবলিক ডিস্টাকশন। কত ছেলের মগজ ডেস্ট্রয় করছে। আমাকে মারবে তার আর নূতন কি?

আমি ভয় পেয়ে চুপ চুপ বলে উজীর সায়েবদের জ্ঞানগর্ভ কথাবার্তায় কান দেবার চেষ্টা করলুম।

দোস্ত মুহম্মদকে দোষ দেওয়া অন্যায়। অনেক ভেবেও কুল কিনারা পাওয়া যায় না যে, এরা সব কোন্ গুণে মন্ত্রী হয়েছেন। লেখাপড়ায় এক-একজন যেন বিদ্যাসাগর। দুনিয়ার কোনো খবর রাখার চাড়ও কারো নেই। বেশীর ভাগই একবার দুবার ইয়োরোপ হয়ে এসেছেন, কিন্তু সেখান থেকে দু-একটা শক্ত ব্যাধি ছাড়া যে কিছু সঙ্গে এনেছেন, তা তো কথাবার্তা থেকে ধরা পড়ে না। ছোকরাদের মধ্যে যারা গালগল্পে যোগ দিল, তারা তবু দু-একটা পাশ দিয়ে এসেছে, বুড়োদের যারা অবজ্ঞা অবহেলা সত্ত্বেও মুখ খুললেন, তাদের কথাবার্তা থেকে ধরা পড়ে যে, আর কিছু না হোক তাঁদের অভিজ্ঞতা আছে কিন্তু এই উজীরদের দল না পারে উড়তে,

পারে সাঁতার কাটতে চলন যেন ব্যাঙের মত, এলোপাতাড়ি, থপথপ। কাবুলের বহু জিনিস, বহু প্রতিষ্ঠান দেখে মনে দুঃখ হয়, কিন্তু এই মন্ত্রিমণ্ডলীকে দেখে কনফুসিয়সের মত বলতে হয়,

আমি লইলাম ভিক্ষাপাত্র, সংসারে প্রণিপাত।

সইফুল আলম এসে কানে কানে বললেন, একটু বাদে দক্ষিণের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসবেন; আমি দোরের গোড়ায় আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। দোস্ত মুহম্মদ না শুনেও মাথা নাড়িয়ে প্রকাশ করলেন যে, তিনিও আসছেন।

মজলিস থেকে বেরিয়ে যেন দম ফেলে বাঁচলুম। দোস্ত মুহম্মদ বললেন, তা ব গুলুয়েম রসীদ গলা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে, গরগরা শুদম আমার ফাসি হয়ে গিয়েছে।

সত্যিকার বিয়ের মজলিসে তখন প্রবেশ পেলুম। সেখানে দেখি, জনবিশেক ছোকরা, কেউ বসে, কেউ শুয়ে, কেউ গড়াগড়ি দিয়ে আড্ডা জমাচ্ছে। একজন গামছা দিয়ে গ্রামোফোনটার মুখ গুঁজে সাউণ্ড-বক্সের পাশে কান পেতে গান শুনছে। জনতিনেক তাস খেলছে। বিদগ্ধ মোল্লা মীর আলম এক কোণে কি একখানা বই পড়ছেন। আরেক কোণে এক বুড়ো দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছেন, অথবা ঘুমচ্ছেন—মাথায় প্রকাণ্ড সাদা পাগড়ি, বরফের মত সাদা দাড়ি আর কালো মিশমিশে জোব্বা। শান্ত মুখচ্ছবি— একপাশে ছোট একখানা সেতার। সব ছেলে-ছোকরার পাল, ঐ মীর আসলম আর সেতারওয়ালা বৃদ্ধ ছাড়া। মজলিসে আসবাবপত্র কিছু নেই, শুধু দামী গালচে আর রঙীন তাকিয়া।

কেউ কেউ বফরমাইদ, আসতে আজ্ঞা হোক বলে অভ্যর্থনা করলেন।

আমি দোস্ত মুহম্মদকে জিজ্ঞাসা করলুম, এইখানে সোজা এলেই তো হত।

তিনি বললেন, সেটি হবার জো নেই, আসল মজলিসে বসে নাভিশ্বাস না হওয়া পর্যন্ত এখানে মোেশন নারদ। তা তুমি তো বাপু বেশ চাঁদপানা মুখ করে বসেছিলে। তোমাকে সেখানে উসখুস না করে বসে থাকতে দেখে আমার মনে তোমার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে বড় ভয় জেগেছে। এদেশে উজীর হবার আসল গুণ তোমার আছে–To sit among bores without being bored. কিন্তু খবরদার, সাবধানে পা ফেলে চলল দাদা, নইলে রক্ষে নেইদেখবে একদিন বলা নেই কওয়া নেই কাঁক করে ধরে নিয়ে উজীর বানিয়ে দিয়েছে।

সইফুল আলম আমাকে আদর করে বসালেন।

তরুণদের আড্ডা যে উজীরদের মজলিসের চেয়ে অনেক বেশী মনোরঞ্জক তা নয়, তবে এখানে লৌকিকতার তর্জনী নেই বলে যাখুশী করার অনুমতি আছে। এরা নির্ভয়ে পলিটিক্স পর্যন্ত আলোচনা করে এবং যৌবনের প্রধান ধর্ম সম্বন্ধে কথা বলতে গেলে কারো মুখে আর কোনো লাগাম থাকে না। কথাবার্তায় ভারতীয় তরুণদের সঙ্গে এদের আসল তফাত এই যে, এদের জীবনে নৈরাশ্যের কোনো চিহ্ন নেই, বর্তমান থেকে পালিয়ে গিয়ে অতীতে আশ্রয় তো এরা খোঁজেই না, ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে যা আশা-ভরসা, তাও স্বপ্নেগড়া পরীস্থান নয়। শারীরিক ক্লেশ সম্বন্ধে অচেতন এরকম জোয়ান আমি আর কোথাও দেখিনি। এদেরই একজন আর বসন্তে কি করে ট্রান্সফার হয়ে বখশান থেকে হিন্দুকুশ পার হয়ে কাবুল এসেছিল তার বর্ণনা দিচ্ছিল। সমস্ত দিন হেঁটে মাত্র তিন মাইল রাস্তা এগোতে পেরেছিল, কারণ একই নদীকে ছবার পার হতে হয়েছিল, কিছুটা সাঁতরে, কিছুটা পাথর আঁকড়ে ধরে ধরে। দুটো খচ্চর ভেসে গেল জলের তোড়ে, সঙ্গে নিয়ে গেল খাবার-দাবার সবকিছু। দলের সাতজনের মধ্যে দুজন অনাহারে মারা যান।

এসব বর্ণনা আমি যে জীবনে প্রথম শুনলুম তা নয়, কিন্তু এর বর্ণনাতে কোনো রোমান্স মাখানো ছিল না, পর্যটকদের গতানুগতিক দম্ভ ছিল না আর আফগান সরকারের নিরর্থক অসময়ে ট্রান্সফার করার বাতিকের বিরুদ্ধে কণামাত্র নালিশ-ফরিয়াদ ছিল না। ভাবখানা অনেকটা ছাতা ছিল না তাই বিষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফিরলুম। কাল আবার বেরতে পারি দরকার হলে ছাতা যে সঙ্গে নেবই সে রকম কথাও দিচ্ছিনে। অর্থাৎ আগামী বসন্তে যদি তাকে ফের বদখশান যেতে হয় তবে সে আপত্তি জানাবে না।

অথচ যখন বার্লিনে পড়াশুনা করত তখন তিন বছর ধরে মাসে চার শ মার্ক খর্চা করে আরামে দিন কাটিয়েছে।

অনেক রাতে খাবার ডাক পড়ল। গরম বাঙলা দেশেই যখন বিয়ের রান্না ঠাণ্ডা হয় তখন ঠাণ্ডা কাবুলে যে বেশীর ভাগ জিনিসই হিম হবে তাতে আর আশ্চর্য কি?

মীর আসলম তাই খানিকটে মাংস এগিয়ে দিয়ে বললেন, কিঞ্চিৎ শূল্যপক অজমাংস ভক্ষণ কর। আভ্যন্তরিক উত্মার জন্য ইহাই প্রশস্ততম।

তারপর দোস্ত মুহম্মদকে জিজ্ঞেস করলেন, কোনো জিনিসের অপ্রাচুর্য হয় নাই তো? দোস্ত মুহম্মদ বললেন, তা ব্‌ গুলুয়েম রসীদ–গলা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে— গরগরা শুদম আমার ফাঁসি হয়ে গিয়েছে।

কোনো জিনিসে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হওয়ার এই হল ফার্সী সংস্করণ।

আফগান বিয়ের ভোঙ্গে যে বিস্তর লোক প্রচুর পরিমাণে খাবে সে কথা কাবুলে না এসেও বলা যায়, কিন্তু তারো চেয়ে বড় তত্ত্ব কথা এই যে, যত খাবে তার চেয়ে বেশী ফেলবে, বাঙলা দেশের এই সুসভ্য বর্বরতার সন্ধান আফগানরা এখনো পায়নি।

খাওয়া-দাওয়ার পর গালগল্প জমলো ভালো করে। শুধু দোস্ত মুহম্মদ কাউকে কিছু না বলে তিনটে কুশনে মাথা দিয়ে দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। আমার বাড়ি ফিরবার ইচ্ছে করছিল, কিন্তু আবহাওয়া থেকে অনুমান করলুম যে, রেওয়াজ হচ্ছে, হয় মজলিসের পাঁচজনের সঙ্গে গুষ্ঠিসুখ অনুভব করা, নয় নির্বিকারচিত্তে অকাতরে ঘুমিয়ে পড়া। বিয়ে বাড়ির হৈ-হল্লা, কড়া বিজলি বাতি আফগানের ঘুমের কোনো ব্যাঘাত জন্মাতে পারে না।

রাত ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে একজন একজন করে প্রায় সবাই ঘুমিয়ে পড়লেন। সইফুল আলম আমাদের আরেকপ্রস্থ চা দিয়ে গেলেন। মীর আলমের ভাষা বিদগ্ধ হতে বিদগ্ধতর হয়ে যখন প্রায় যজ্ঞভস্মের মত পূতপবিত্র হবার উপক্রম করেছে, তখন তিনি হঠাৎ চুপ করে গেলেন। চেয়ে দেখি, সেই বৃদ্ধ সেতার খানা কোলে তুলে নিয়েছেন।

মীর আসলম আমাকে কানে কানে বললেন, তোমার অদৃষ্ট অদ্য রজনীর তৃতীয় যামে সুপ্রসন্ন হইল।

সমস্ত সন্ধ্যা বৃদ্ধ কারো সঙ্গে একটি কথাও বলেননি। পিড়িং করে প্রথম আওয়াজ বেরতেই মনে হল, এর কিন্তু বলবার মত অনেক কিছু আছে।

প্রথম মৃদু টঙ্কারের সঙ্গে সঙ্গেই দোস্ত মুহম্মদও সোজা হয়ে উঠে বসলেন–যেন এতক্ষণ তারই অপেক্ষায় শুয়ে শুয়ে প্রহর গুনছিলেন।

সেতারের আওয়াজ মিলিয়ে যাবার পূর্বেই বুড়ার গলা থেকে গুঞ্জরন ধ্বনি বেরল কিন্তু ভুল বললুম— গলা থেকে নয়, বুক, কলিজা থেকে, তার প্রতি লোমকূপ ছিন্ন করে যেন সে শব্দ বেরল। সেতার বাঁধা হয়েছিল কোন্ সন্ধ্যায় জানিনে কিন্তু তার গলার আওয়াজ শুনে মনে হল, এর সর্বশরীর যেন আর কোনো ওস্তাদের ওস্তাদ বহুকাল ধরে বেঁধে বেঁধে আজ যামিনীর শেষমে এই প্রথম পরিপূর্ণতায় পৌঁছালেন।

ওস্তাদী বাজনা নয়–বুড়ার গলা থেকে যে পরী হঠাৎ ডানা মেলে বেরল, সেতারের আওয়াজ যেন তার ছায়া হয়ে গিয়ে তারই নাচে যোগ দিল।

ফার্সী গজল। বুড়ার চোখ বন্ধ; শান্ত-প্রশান্ত মুখচ্ছবি, চোখের পাতাটি পর্যন্ত কঁপছে না, ওষ্ঠ অধরের মৃদু স্ফুরণের ভিতর দিয়ে বেরিয়ে আসছে গম্ভীর নিষ্কম্প গুঞ্জরন। বাতাসের সঙ্গে মিশে গিয়ে সে আওয়াজ যেন বন্ধনমুক্ত আতরের মত সভাস্থল ভরে দিল।

গানের কথা শুনব কি, সেতারে গলায় মিশে গিয়েছে, যেন সন্ধ্যা বেলাকার নীল আকাশ সূর্যাস্তের লাল আবির মেখে নিয়ে ঘন বেগুনী থেকে আস্তে আস্তে গোলাপীর দিকে এগিয়ে চলেছে। আর পাঁচজনের কথা বলতে পারিনে–এরকমের অভিজ্ঞতা আমার জীবনে এই প্রথম। জন্মান্ধ যেন চোখ মেলল সূর্যাস্তের মাঝখানে। আমি তখন রঙের মাঝখানে ডুবে গিয়েছি— সমুদ্র, বেলাভূমি, তরুপল্লব কিছুই চোখে পড়ছে না।

ধ্বনির ইন্দ্রজালে মোহাচ্ছন্ন করে বৃদ্ধ যেন একমাত্র আমারই কানে কানে তার গোপন মন্ত্র পড়তে লাগলেন,

শবি আগর, শবি আগর, শবি আগর—

যদি এক রাত্রের তরে, মাত্র এক রাত্রের তরে, একবারের তরে—

আমি যেন চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছি, কি? কি? কি? এক রাতের তরে, একবারের তরে কি? কিন্তু বলার উপায় নেইদরকারও নেই, গুণী কি জানেন না?

আজ লবে ইয়ার বোসয়ে তলবম্‌
প্রিয়ার অধর থেকে একটি চুম্বন পাই

প্রথমবার বললেন অতি শান্তকণ্ঠে, কিন্তু যেন নৈরাশ্য-ভরা সুরে, তারপর নৈরাশ্য যেন কেটে যেতে লাগল, আশা-নিরাশার দ্বন্দ্ব আরম্ভ হল, সাহস বাড়তে লাগল, সবশেষে রইল দৃঢ় আত্ম বিশ্বাসের ভাষা, পাবোই পাবো, নিশ্চয় পাব।

গুণী গাইছেন লবে ইয়ার, প্রিয়ার অধর আর আমার বন্ধ চোখের সামনে কালোর মাঝখানে ফুটে ওঠে টকটকে লাল দুটি ঠোঁট, যখন শুনি বিেসয়ে তলব, যদি একটি চুম্বন পাই, তখন চোখের সামনে থেকে সব কিছু মুছে যায়, বুকের মাঝখানে যেন তখন শুনতে পাই সেই আশানিরাশার দ্বন্দ্ব, আতুর হিয়ার আকুলিবিকুলি, আত্মবিশ্বাসের দৃঢ় প্রত্যয়।

হুঙ্কার দিয়ে গেয়ে উঠলেন, জোয়ান শওম

তাহলে আমি জোয়ান হব— একটি মাত্র চুম্বন পেলে লুপ্ত যৌবন ফিরে পাব।

সভাস্থল যেন তাণ্ডব নৃত্যে ভরে উঠল— দেখি শঙ্কর যেন তপস্যা শেষে পার্বতীকে নিয়ে উন্মত্ত নৃত্যে মেতে উঠেছেন। হুঙ্কারের পর হুঙ্কার জোয়ান শওম, জোয়ান শওম। কোথায় বৃদ্ধ সেতারের ওস্তাদ–দেখি সেই জোয়ান মঙ্গোল। লাফ দিয়ে তিন হাত উপরে উঠে শূন্যে দুপা দিয়ে ঘন ঘন ঢেরা কাটছে, আর দু-হাত মেলে বুক চেতিয়ে মাথা পিছনে ছুঁড়ে কালো বাবরী চুলের আবর্তের ঘূর্ণি লাগিয়েছে।

দেখি তাজমহলের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলেন শাহজাহান আর মমতাজ। হাত ধরাধরি করে। নবীন প্রাণ, নূতন যৌবন ফিরে পেয়েছেন, শতাব্দীর বিচ্ছেদ শেষ হয়েছে।

শুনি সঙ্গীত তরঙ্গের কলকল্লোল জাহ্নবী। সগররাজের সহস্র সন্তান নবীন প্রাণ নবীন যৌবন ফিরে পেয়ে উল্লাসধ্বনি করে উঠেছে।

কিন্তু গুণী, যৌবন পেয়েছে, প্রিয়ার প্রসাদ পেয়েছে, চূড়ান্তে পৌছে গিয়েছে অথচ কবিতার পদ যে এখনো অগ্রগামী

শবি আগর, আজ লবে ইয়ার বোসয়ে তলবম্‌
জোয়ান শওম—

আজি এ নিশীথে প্রিয়া অধরেতে চুম্বন যদি পাই
জোয়ান হইব

তারপর, তারপর কি?

শুনি অবিচল দৃঢ়কণ্ঠে অদ্ভুত শপথ গ্রহণ,–

জসেরো জিন্দেগী দুবারা কুনম

এই জীবন তাহলে আবার দোহরাতে, দুবার করতে রাজী আছি। একটি চুম্বন দাও, তাহলে আবার সেই অসীম বিরহের তপ্ত দীর্ঘ অন্তবিহীন পথ ক্ষতবিক্ষত রক্তসিক্ত পদে অতিক্রম করবার শক্তি পাব। আসুক না আবার সেই দীর্ঘ বিচ্ছেদ, তোমার অবহেলার কঠোর কঠিন দাহ!

আমি প্রস্তুত, আমি শপথ করছি,

–জসেরো জিন্দেগী দুবারা কুনম!

গোড়া হতে তবে এ-জীবন দোহরাই।

আমি মনে মনে মাথা নিচু করে বললুম, ক্ষমা করো গুণী, ক্ষমা করো কবি। শিখরে পৌঁছে উদ্ধত প্রশ্ন করেছিলুম, পদ এখনো অগ্রগামী, যাবো কোথায়। তুমি যে আমাকে হঠাৎ সেখান থেকে শূন্যে তুলে নিতে পারো, তোমার গানের পরী যে আমাকেও নীলাম্বরের মর্মমাঝে উধাও করে নিয়ে যেতে পারে, তার কল্পনাও যে করতে পারিনি।

বারে বারে ঘুরে ফিরে গুণীর আকুতি-কাকুতি শবি আগর, যদি এক রাতের তরে আর সেই দৃঢ় শপথ জিন্দেগী দুবারা কুনম, এ-জীবন দোহরাই–গানের বাদ বাকি এই দুই বাক্যেই বারে বারে সম্পূর্ণ রূপ নিয়ে স্বপ্রকাশ হচ্ছে। কখনো শুনি শবি আগর কখনো শুধু দুবারা কুনম শবি আগর, দুবারা কুনম।

পশ্চিমের সূর্য ডুবে যাওয়ার পরও পুবের আকাশ অনেকক্ষণ ধরে লাল রঙ ছাড়ে না কখন গান বন্ধ হয়েছিল বলতে পারিনে। হঠাৎ ভোরের আজান কানে গেল, আল্লাহু আকবর, খুদাতালা মহান মাভৈ, মাভৈ, ভয় নেই, ভয় নেই, তোমার সব কামনা পূর্ণ হবে।

ওয়া লাল আখিরাতু খাইরুন লাকা মিনাল উলা।
অতীতের চেয়ে নিশ্চয় ভালো হবে তো ভবিষ্যৎ।*

চোখ মেলে দেখি কবি নেই। মোল্লা মীর আসলম পাথরের মত বসে আছেন, আর দোস্ত মুহম্মদ দু-হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলেছেন।

——————-

* কুরান শরীফ ৯৩, ৪।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *