দুপুরবেলা জাহানারা ইমাম খেতে বসেছেন, এমন সময় বেজে উঠলো কলিংবেল। একটানা বেজেই চললো, কেউ সুইচে আঙুল টিপে রেখেছে। অসময়ে এরকম বেল শুনলেই বুক কেঁপে ওঠে, তার ওপর, যে-এসেছে সে যেন বিশেষ কোনো ক্ষমতা দেখাতে এসেছে। জাহানারা তবু বাড়ির কাজের লোকটিকে বললেন, দ্যাখ তো কোন বেয়াদপ এমনভাবে বেল বাজায়?
দরজা খোলার পর যে ভেতরে এলো, সকাল থেকে তার কথাই শুধু ভাবছিলেন জাহানারা, খেতে বসেও তার কথা মনে করে খাবার গিলতে পারছিলেন না, অথচ এখন তাকে চোখের সামনে দেখেও বিশ্বাস করতে পারলেন না। প্রায় ভয় পাওয়া গলায় চিৎকার করে উঠলেন, রুমী তুই?
সারা মুখে ঝলমলে হাসি, কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা এমনভাবে নামিয়ে রাখলো রুমী, যেন সে অন্য যে-কোনো দিনের মতই কলেজ থেকে ফিরছে। যদিও মাথার চুল উস্কো খুস্কো, চোখ দুটো কোটরে ঢোকা, গায়ের জামাটা তিন চারকার ঘামে ভিজেছে ও শুকিয়েছে। সে বললো, আম্মা, খিদে পেয়েছে, খেতে দাও!
টেবিলে বসে পড়ে সে মায়ের দিকে চোখের ইঙ্গিত করলো। অর্থাৎ এখন কোনো কথা জিজ্ঞেস করা চলবে না।
ডাল, ভাত, মাছের পাত্রগুলো টেবিলের ওপরেই রয়েছে, কাজের লোকটি এনে দিল একটি প্লেট, তারপর দাঁড়িয়ে রইলো কাছেই। আগে রুমী বাইরে থেকে এসে খেতে বসলেই মা বলতেন, এই হাত ধুলি না? যা, আগে হাত ধুয়ে আয়! আজ তাঁর মুখে কোনো কথা নেই। রুমী প্লেটে ভাত তুলে মাছের ঝোল দিয়ে মেখে তিন চার গেরাস খেয়ে নিল বুভুক্ষুর মতন। তারপর মায়ের দিকে তাকালো। ঠিক পটে আঁকা ছবির মতন জাহানারা খাওয়া বন্ধ করে, ছেলের দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে বসে আছেন। তাঁর বুকের মধ্যে যত আনন্দ, মুখে ততখানি ভয়ের ছাপ।
রুমী কাজের লোকটিকে বললো, বারেক, রান্নাঘর থেকে দুটো শুকনো মরিচ পুড়িয়ে আনতে। কোনো রান্নায় তো ঝাল দিসনি! দেখবি বেশী পুড়ে না যায় যেন পাবধানে অল্প আঁচে সেকবি আস্তে আস্তে, বুঝলি?
সে চলে যেতেই রুমী মাকে ছদ্ম ধমকের সুরে বললো, এক্ষুনি সব না শুনলে তো তোমার পেটে ভাত হজম হবে না, তাই না? এখন শুধু এইটুকু শুনে রাখো, আমাদের যে রাস্তা দিয়ে যাবার কথা হয়েছিল, সেখানে ঘাপলা হয়েছে। আর একটু হলে আর্মির হাতে ধরা পড়ে যাচ্ছিলাম। তাই আপাতত ফিরে আসতে হলো!
তারপর সে মন দিয়ে খেয়ে যেতে লাগলো। ভাত শেষ করার পর চুমুক দিয়ে শুধু ডাল খেলো অনেকখানি। বারেককে বললো, ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা পানি বার করে দে! উঃ, এবার যেন বেশী বেশী গরম পড়েছে!
আঁচাবার পর সে সেদিনকার খবরের কাগজ দু’খানা বগলে নিয়ে শিস দিতে দিতে ওপরে উঠে গেল!
জাহানারা প্রথমেই ভেতরের ঘরে গিয়ে স্বামীর অফিসে ফোন করে জানিয়ে দিলেন খবরটা। তারপর আপাতত শান্ত ভাব বজায় রেখে খাবার-দাবারগুলো গুছোলেন, বারেককে ছুটি দিলেন দুপুরের জন্য। তারপর দৌড়ে দোতলায় উঠে এসে রুমীর ঘরের দরজা বন্ধ করে, হেসে কেঁদে রুমীকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলেন, এবার বল রুমী, কী হলো সব খুলে বল!
ছেলেকে যুদ্ধে পাঠাবার জন্য যত না দুশ্চিন্তা হচ্ছিল, তার চেয়েও তাঁর নিজেরই একটি কথা তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছিল সর্বক্ষণ। রুমী যাবার দু’দিন আগে তিনি ঝোঁকের মাথায় বলে ফেলেছিলেন, যা, তোকে দেশের জন্য কোরবাণী করে দিলাম!
মায়ের বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে রুমী বললো, বসো আম্মা, শান্ত হয়ে বসো! সব বলছি। প্রথমে তো আমরা সদরঘাট থেকে বুড়িগঙ্গা পার হলাম।
জাহানারা জিজ্ঞেস করলেন, আমরা মানে কে কে? তোরা কয়জন ছিলি?
রুমী ভ্রূকুটি করে বললো, এই তো! তোমার বেশী বেশী কৌতূহল! তোমায় আগেই একদিন বলেছি না, অন্যদের নাম ধাম জানতে চাইবে না?
মা যেন বয়েসে অনেক ছোট, এইভাবে বকছে রুমী। মাত্র কিছুদিন আগেই যে ছিল সদ্য যৌবনে ওঠা একটি টগবগে ছেলে, তার মুখে এবমধ্যেই একটা অভিজ্ঞতার ছাপ পড়ে গেছে, তার হাসির আড়ালেও উঁকি মারে একটা গাম্ভীর্য!
কামাল লোহানী, প্রতাপ হাজরা, মনিরুল আর ইশরাক নামে দু’জন ছাত্র নেতা, একজন আহত হাবিলদার ও কয়েকটি হিন্দু পরিবার মিলে রওনা দিয়েছিল সীমান্তের দিকে। বুড়িগঙ্গা পার হবার পর সাত-আট মাইল হাঁটা পথ, সেই সময়ে আবার প্রবল ঝড় বৃষ্টি, হাবিলদারটির হাঁটার ক্ষমতা ছিল না, রুমী আর একজন কাঁধে করে বয়ে নিয়ে গিয়েছিল তাকে। জল-কাদার মধ্য দিয়ে ওরা সেই অতখানি রাস্তা হেঁটে পৌঁছোয় ধলেশ্বরীর পারে। হাবিলদারটিকে কাছাকাছি একটা গ্রামে লুকিয়ে রেখে ওরা ধলেশ্বরী পার হয়ে এলো সৈয়দপুরে। সেখান থেকে আরও আট মাইল দূরে শ্রীনগর। আগেই খবর পাওয়া গেছে যে শ্রীনগর থানা-অঞ্চল এখন মুক্তিবাহিনীর অধীনে। সেখানে অপেক্ষা করছে সিরাজুল আর কয়েকজন, তারা রুমীদের ত্রিপুরা বড়ারে পৌঁছে দেবে, এইরকমই ঠিক হয়ে আছে।
স্পীড বোটে পুরো দলটা সন্ধের অন্ধকারে পৌঁছোলো শ্রীনগর। রাতটা কাটানো হলো। কাছেই নাগরভাঙা গ্রামে ডাক্তার সুকুমার বর্ধনের বাড়িতে। কিন্তু পরদিন রওনা হওয়া গেল না, এরমধ্যেই ধলেশ্বরী পার হয়ে সৈদপুরে এসে গেছে আর্মি। তারা এগোচ্ছে বিক্রমপুরের দিকে। পুরো অঞ্চলটা তারা ঘিরে ফেলে বহিরাগতদের বেছে বেছে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। যারা ধরা পড়ছে, তারা কেউ আর ফিরে আসে না।
তখন একমাত্র উপায় কুমিল্লার শ্রীরামপুরের দিক দিয়ে বর্ডার ক্রশ করা। কয়েকটা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে ওরা যাত্রা করলো এক ভোর রাতে। তাও বেশী দূর যাওয়া গেল না, এর মধ্যে শ্রীরামপুরেও এসে গেছে পাকিস্তানী বাহিনী। এখন আর সামনে যাওয়া যাবে না, পেছন দিকে সৈদপুরেও ফেরা যাবে না।
বিবরণ থামিয়ে ফিক করে হেসে রুমী বললো, এরপর আমরা কয়েকজন কী করে ঢাকা এসে পৌঁছোলাম, তা আর জানতে চেও না আম্মা! কোনোরকমে, অনেক ঘুর পথে, এক একবার গুলি খেতে খেতেও বেঁচে গিয়ে শেষ পর্যন্ত এসেছি। তবে সবাই আসতে পারেনি। ঝড়ের সময় একটা নৌকা ডুবে গেল, তাদের সাহায্য করার জন্য আমাদের থামার উপায় ছিল না, আর একটা ছোট দলও সম্ভবত আর্মির হাতে ধরা পড়েছে। তাদের কী হয়েছে জানি না। আমি ঐ দলে থাকতে পারতাম!
প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুনতে শুনতে জাহানারা বললেন, তুই গুলি খেতে খেতে বেঁচে গেছিস? যারা ধরা পড়েছে, তুইও তাদের মধ্যে থাকতে পারতি?
অম্লান মুখে রুমী বললো, হ্যাঁ। বাই চান্স আমি অন্য নৌকায় ছিলাম!
জাহানারা ছেলের পিঠে হাত দিয়ে দেখলেন! এই কি তাঁর সেই রুমী না অন্য কেউ? দু’একদিন আগে যে মৃত্যুর মুখোমুখি গিয়েছিল, সে একটু আগে খাওয়া দাওয়ার পর শিস দিয়ে গান গাইছিল!
রুমী বললো, আম্মা, সাহস দেখলাম বটে সিরাজুলের! গুলি-গোলা কিছু মানে না। এর মধ্যে সে সাতজন খান সেনাকে খতম করেছে নিজের হাতে। আমাদের সাথে সে এলো না, যে দলটা ফিরতে পারে নাই, তাদের খোঁজে সে ফিরে গেল সৈদপুরে। একেবারে সিংহের গুহায়। যাকে বলে।
বার বার শুনেও আশ মেটে না জাহানারার, তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আরও জানতে চান। এক সময় তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁরে রুমী, তা হলে তোকে তো এখন আর যেতে হবে না? ঢাকাতেই থাকবি?
রুমী উষ্ণ গলায় বললো, যেতে হবে না মানে? দেশের জন্য যুদ্ধে যোগ দিয়ে যারা ডেজার্ট করে, তাদের দোজখেও স্থান হয় না, জানো না? আমি খালেদ মশারফের আন্ডারে সেক্টর টু-তে। যোগ দেবো, এই ঠিক হয়ে আছে।
জাহানারা মিন মিন করে বললেন, না, তুই যে বললি যাবার রাস্তা সব বন্ধ করে দিয়েছে!
রুমী বললো, রাস্তা নেই অন্য রাস্তা খুঁজে বার করতে হবে। তা ছাড়া কতদিন ওরা দখল করে রাখবে? ঐ দিক থেকে আমাদের বাহিনী এসে শুতে দেবে না? দু’একদিনের মধ্যেই আমার কাছে খবর আসবে, চলে যেতে হবে সঙ্গে সঙ্গে। আমি কি আরাম করার জন্য ঢাকায়। ফিরে এসেছি? তা ছাড়া শুনে রাখো, হানাদার বাহিনী ঢাকায় কোনো ইয়াং ছেলেকে বাইরে রাখবে না। যুদ্ধে যোগ দাও বা না দাও, একই কথা। বাঙালী হওয়াটাই এখন অপরাধ। কিছু ছেলে এখন আর্মির সাথে হাত মেলাচ্ছে, তারা আর বাঙালী না, তারা রাজাকার! তুমি কি আমাকে রাজাকার হতে বলো?
হঠাৎ থেমে গেল রুমী। মাকে বেশী বেশী বকুনি দেওয়া হয়ে যাচ্ছে ভেবে সে মায়ের কোলে মাথাটা রেখে বললো, আমি জানি, তুমি কখনো আমার কোনো ইচ্ছায় বাধা দেবে না। আমার আম্মা পৃথিবীর বেস্ট আম্মা! আমার কথা তো শুনলে, এবার তোমাদের কথা বলো। তো! কার কী খবর? মোতাহার চাচার খবর কী? মীরপুরের বিহারীরা নাকি রাস্তায় বাস-কোচ থামিয়ে বাঙালী যাত্রীদের খুন করছে?
জাহানারা বললেন, তোদের প্রফেসর বাবুল চৌধুরীর খবর শুনেছিস? তাকে ওরা গুলি। করে গেছে। সে বোধ হয় আর বাঁচবে না।
চোখ বুজিয়ে ফেলেছিল রুমী, চোখ না খুলেই বললো, বাবুল চৌধুরীকে মেরেছে? বেশ করেছে! আমাদেরই কোনো দল ওকে মেরেছে। দেশদ্রোহীদের চরম শাস্তি দেবার একটা প্ল্যান নিয়েছি আমরা। উনি আমাদের কাছে কত বড় বড় কথা বলতেন, অথচ নিজে সাপোর্ট করলেন এই ইয়াহিয়া রেজিমকে। আর্মির সঙ্গে দহরম-মহরম?
জাহানারা বললেন, কিন্তু আর্মির লোকই তো ওকে গুলি করেছে?
বড় বড় করে চোখ মেলে, ধড়ফড় করে উঠে বসে রুমী জিজ্ঞেস করলো, কী বললে? আর্মি। ওকে মেরেছে, তুমি ঠিক জানো?
–এক পাড়ার মধ্যে, জানবো না কেন? সিরাজুলের খোঁজে আর্মি এসেছিল ঐ বাড়ি সার্চ করতে, তারপর ওরা মনিরাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল, বাবুল চৌধুরী উপর থেকে নেমে এসে তাকে আটকাতে যেতেই…।
–মনিরাকে ধরে নিয়ে গেছে? কোথায় নিয়ে গেছে, জানো?
–কি কেউ বলতে পারে? আমি সেদিন বাসাতেই ছিলাম, মনিরাকে ওরা টানতে টানতে এনে গাড়িতে উঠালো, মেয়েটার কী বুক ফাটা চিৎকার, কিন্তু কেউ বাধা দিতে পারলো না। ঐ যমের দূত আর্মিগুলোর সামনে কে যাবে বল!
–ইস, আম্মা, এখন সিরাজুলের কী হবে? ঢাকায় আমাদের যে কন্টাক্ট আছে, তাদের বলা হয়েছিল মনিরাকে কোনো নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দিতে। আমি তো জানি মনিরা এর মধ্যে চলে গেছে!
–যাদের ওপর ভার ছিল, তারা দেরি করে ফেলেছে রে। আর কি মেয়েটাকে পাওয়া যাবে? অমন সরল, ভালো মেয়ে, ওরে রুমী, ভাবলেই আমার বুকটা মোচড়ায়। হায় আল্লা, যারা নিদোষ, যারা সৎ তাদের তুমি এমনভাবে শেষ হয়ে যেতে দেবে!
–আমি ভাবছি, সিরাজুলটা পাগল হয়ে না যায়। এর মধ্যে দু’বার সে সাঙ্ঘাতিক বিপদের ঝুঁকি নিয়ে মনিরাকে দেখতে এসেছিল। আমার বন্ধুরা ওকে জরু কা গোলাম বলে ক্ষ্যাপায়! নিয়তির কী আয়রনি দ্যাখো, আম্মা, বাবুল চৌধুরী এই ফ্যাসিস্ট রেজিমের সাথে গলাগলি করতে গিয়েছিল, টিক্কা খানের সাথেও নাকি তার ভাব, সেই টিক্কা খানের সৈন্যই তাকে শেষ করে দিয়ে গেল! ন্যাপের ভাসানী সাহেবও কলকাতায় গিয়ে চীনের কাছে আবেদন পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশকে সাপোর্ট করার জন্য, আমাদের কলেজে যে সব প্ৰােচাইনীজ নেতা ছিল সবাই মুক্তি যুদ্ধে জয়েন করেছে, শুধু বাবুল চৌধুরী আর দুই চারজন মোটে হার্ড কোর আলট্রা লেফট পুথিগত বিদ্যা নিয়ে এই আন্দোলনে যোগ দেয়নি। বাবুল চৌধুরীর মতন তারা সবাই একে একে শেষ হয়ে যাবে!
জাহানারা বেগম একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলেন, ছেলের শেষ কথাটি শুনে চমকে উঠে বললেন, ওরে বাবুল এখন মারা যায় নাই, তবে আয়ু আর কতটুক আছে কে জানে।
রুমী বিদ্রূপের সুরে বললো, এখনো মারা যায় নাই?
–অমন করে বলে না, রুমী! তোর শিক্ষক ছিলেন না এক সময়? তাঁর জন্য দোয়া কর। সেদিন কী হলো জানিস? আর্মির লোক তো ওকে গুলি করে ফেলে চলে গেল। ঐ বাসায় সেফু বলে ছোট একটা মেয়ে কাজ করে, মিলিটারি তারে দেখতে পায় নাই, সে রাস্তায় এসে চিৎকার করতে লাগলো, আমার সাহেবরে গুলি করছে, আমার সাহেবরে বাঁচান…। কিন্তু কেউ ভয়ে দরজা খোলে না। একটু পরেই আবার কারফিউ ডিক্লেয়ার হয়ে গেল, কে যাবে? কিন্তু। সেই মেয়েটার আর্তনাদ সহ্য করা যায় না। যেন তার নিজের বাপ মরতে বসেছে। শেষ পর্যন্ত তোর বাবা বললো, আমি একবার দেখে আসি, যা হয় হোক। আমিও গেলাম তার সাথে। গিয়ে দেখি সিঁড়ির শেষ ধাপে হাত পা ছড়িয়ে পড়ে আছে বাবুল, চতুর্দিকে রক্ত আর রক্ত, কিন্তু তখনও তার বুকটা ধুকপুক করছে। ঐ অবস্থায় ফেলে আসা যায়? ওদের চিনি কতদিন ধরে! কারফিউয়ের মধ্যে হাসপাতালে নিয়ে যেতে সাহস হলো না। আমাদের গাড়িতে তুলে ওকে নিয়ে গেলাম ডাঃ আজিজের পলি ক্লিনিকে।
–সেখানেই আছে এখনও?
–সব দায়িত্ব পড়ে গেছে আমাদের ওপর। বাবুলের বাপ মা আছেন টাঙ্গাইলে, তাদের খবর দেবার উপায় নাই। টেলিফোন পাওয়া যায় না। ওর বড় ভাই আলতাফ কোথায় জানি উধাও হয়ে গেছে। বাবুলের বউও তো ইন্ডিয়ায় চলে গেছে শুনেছি। শেষ পর্যন্ত যদি কিছু একটা হয়ে যায়, ওর নিকটজন কেউ জানতেই পারবে না!
একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়লো রুমী।
বিকেলবেলা সে কোথায় যেন বেরিয়ে গেল, বলে গেল রাত্তিরে নাও ফিরতে পারে! শরীফ আর জামীর সঙ্গে অল্প একটুক্ষণের জন্য দেখা হলো তার, কিন্তু বাবা ও ছোট ভাইয়ের সঙ্গে রুমীর গল্প করার সময় নেই। সে যে কোথায় যাচ্ছে, তা জিজ্ঞেস করা চলবে না।
জামীকে বাসায় রেখে এক সময় শরীফ আর জাহানারা গেলেন বাবুল চৌধুরীর খবর নিতে। আজ সন্ধেবেলা কারফিউ নেই, শুরু হবে রাত বারোটায়।
কাছেই মেইন রোডের ওপর ডঃ আজিজের পলি ক্লিনিক কাম নার্সিং হোম। পাশাপাশি দু’খানা বাড়ি ভাড়া দেওয়া হয়েছে, একটার দোতলায় স্বামী-স্ত্রীর কোয়াটার। আজিজের স্ত্রী সুলতানাও ডাক্তার। এই দুর্দিনে এরা দু’জনে গোপনে অনেকের চিকিৎসা করে যাচ্ছেন। টাকা পয়সার কথা চিন্তা করেন না। আজিজ একটু গম্ভীর প্রকৃতির হলেও সুলতানা সব সময় ছটফটে, হাসি খুশী। কোনো পেশেন্টকে ভেঙে পড়তে দেখলে সুলতানা তার গালে ছোট ছোট চাপড় মেরে বলেন, ও কী, অত মুখ গোমড়া করার কী আছে? হাসো, হাসো! হাসতে ভুলে গেলে বাঁচবে কী করে?
সুলতানা নিজে কখনো হাসতে কার্পণ্য করেন না। চরম দুঃখের কথাও তিনি দিব্যি রসিকতার ছলে বর্ণনা করতে জানেন, এই জন্য আড়ালে কেউ কেউ তাঁকে বলে, পাগলী!
শরীফ আর জাহানারাকে দেখে সুলতানা এক গাল হেসে বললেন, আজ ভালো খবর আছে। আপনাদের পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে পুরোপুরি! খানিক আগে তাকে গল্প বলে বলে আধ গেলাস হরলিকস খাইয়েছি!
জাহানারাও না হেসে পারলেন না। বাবুল চৌধুরী যেন একজন কট্টর বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক নয়, তিন বছরের শিশু। তাকে গল্প বলে হরিলিকস খাওয়াতে হয়!
সুলতানা আবার বললেন, অপারেশান করে ওর পেট থেকে দুটো বুলেট বার করেছি, আল্লর দয়ায় বেঁচে যাবে মনে হয় এ যাত্রায়। কিন্তু কিছুই যে খেতে চায় না। আপনারা দ্যাখেন তো যদি একটা হাফ বয়েল আণ্ডা অন্তত খাওয়াতে পারেন!
জাহানারার ইচ্ছে হলো রুমীর ফিরে আসার কথাটা সুলতানাকে জানাতে। কিন্তু কখন কাকে কী যে বলা উচিত তা-ই যে বুঝে ওঠা যায় না, এখন এমনই এক সন্দেহের সময়।
দোতলার একটি ক্যাবিনে রাখা হয়েছে বাবুলকে। তার পাশের ক্যাবিনেই আছে জাহানারাদের আর এক পরিচিত, তার নাম সালেহা। এই সালেহার স্বামী রসুল সাহেব একজন। ধর্মভীরু পারহেজগার মানুষ। মুখে কালো চাপ দাড়ি, মাথায় কালো জিন্না টুপী, প্রতিটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন তিনি। রসুল সাহেবের বদলির চাকরি। কিছুকাল আগে ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। পঁচিশে মার্চের পর কিছুদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছিল জয় বাংলা ধ্বনি দেওয়া লোকদের দখলে, তারপরেই সেখানে শুরু হলো পাকবাহিনীর বম্বিং। কোথাও কেউ যুদ্ধ। ঘোষণা করেনি তবু প্লেন থেকে বোমা পড়েছে গ্রামের পর গ্রামে। রসুল সাহেব কোনোরকমে সপরিবারে এক বস্ত্রে পালিয়েছেন, বহু জায়গা ঘুরে শেষ পর্যন্ত সর্বস্বান্ত হয়ে ঢাকায় এসে উঠেছেন ভূতের গলিতে এক আত্মীয়ের বাড়িতে। গ্রামের পথে দৌড়োদৌড়িতে তাঁর স্ত্রীর এক পায়ে একটা হাড় ফুটে গেছে কখনো, প্রথমে সেটা আমল দেননি। এখন সেটা সেপটিক হবার মতন অবস্থা, পা-টা বাদ দিতে হবে কি না ঠিক নেই।
রসুল সাহেব কোনোদিন রাজনীতির সাতে পাঁচে থাকেননি, পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ গড়ায় বিশ্বাস করেননি, তবু তাঁর এই অভাবিত দুভাগ্যে একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছেন। জাহানারাই উদ্যোগ করে তাঁর স্ত্রীকে ভর্তি করে দিয়েছেন এই নার্সিং হোমে।
সালেহা যন্ত্রণায় কোঁকাচ্ছে শুনে জাহানারা আর শরীফ আগে উঁকি দিলেন সেই ক্যাবিনে। তাঁদের দেখেই সালেহা হাউ হাউ করে কেঁদে উঠে বললো, বড় আপা গো, আমি আর বাঁচবে না। আমার ছেলে মেয়েগুলানের কী হবে? আমাদের যে সব গেছে। ওরা খাবে কী?
জাহানারা তার শিয়রের কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, অমন করে না! সব ঠিক হয়ে যাবে!
চোখের সামনে একটা বীভৎস দৃশ্য দেখার মতন ভঙ্গি করে সালেহা বললো, বড় আপা, খান সেনারা কি মানুষ না? এরা কি মুসলমান না? হিন্দু খুঁজে খুঁজে তো কতই মারলো, কলমা। জানা মুসলমানকে পর্যন্ত ওরা কাফের মনে করে মারলো? আল্লার একী বিধান!
জাহানারা মৃদু ধমক দিয়ে বললেন, নার্সিং হোমে অত জোরে চ্যাঁচায় না। তুমি তো ভাগ্যবতী। তোমার গায়ে আর্মির গুলি লাগেনি, পায়ে শুধু হাড় ফুটেছে। সুলতানা আমাকে বললো, অপারেশনে তোমার পা ভালো হয়ে যাবে!
সালেহাকে আরও একটুক্ষণ সান্ত্বনা দিয়ে ওরা এলেন বাবুল চৌধুরীর ক্যাবিনে।
হঠাৎ দেখল মনে হয় বাবুল সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষ। সারা গায়ে একটা সাদা চাঁদর ঢাকা, তার পেট জোড়া ব্যান্ডেজ সেই চাঁদরের তলায় ঢাকা পড়ে আছে। তার ফস, নারী সুলভ কমনীয় মুখোনি অনেকটাই রক্তশূন্য, কিন্তু ক্যাবিনের স্বল্প আলোকে তা টের পাওয়া যায় না। বই ছাড়া সে অন্য কিছু দিয়ে সময় কাটাতে জানে না, তাই জ্ঞান ফেরার পরেই সে চোখের সামনে মেলে ধরেছে একটা শক্ত অর্থনীতির বই। তার খাটের পাশেও একটি বইয়ের সারি, সম্ভবত আজই সেফুকে দিয়ে বাড়ি থেকে আনিয়েছে।
জাহানারা পর্দা সরিয়ে ঢুকেই বললেন, ওমা, বাবুল তো ভালো হয়ে উঠেছে দেখছি। ও বাবুল, আল্লা আমাদের ডাক শুনেছেন! তোমার জন্য আমরা দিনরাত দোয়া করেছি!
বইখানা সরিয়ে বাবুল নিঃশব্দ এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।
জাহানারার মনে হলো, আজ রুমী ফিরে এসেছে, আজ তিনি চতুর্দিকেই ভালো কিছু দেখবেন, ভালো শুনবেন। সালেহার পা ঠিক হয়ে যাবে, বাবুল আবার হাঁটা চলা করবে। যদি পাকিস্তানীদের মারণযজ্ঞটাও আজ শেষ হয়ে যেত।
শরীফ বললেন, বাবুল, টাঙ্গাইলে আমি একটা খবর পাঠিয়েছি, রাস্তা খোলা থাকলে ওনার দু’একদিনের মধ্যে এসে পড়বেন নিশ্চয়।
বাবুল এবারেও কোনো কথা বললো না।
জাহানারা বললেন, মঞ্জু ইন্ডিয়ার কোথায় আছে অ্যাড্রেস জানো? তাহলে তাকেও একটা খবর দেবার চেষ্টা করতাম। কাল একজন বললো, এখান থেকে লন্ডনে ফোন করে চেনা কোনো মানুষকে খবর দিলে, সে আবার লন্ডন থেকে কলকাতায় ফোন করে খবর জানাতে পারে। চিঠিও যেতে পারে সেইভাবে।
এবার, যেন কিছু একটা বলতে হয়, সেইভাবে বাবুল বললো, থাক, তাকে ব্যস্ত করার দরকার নাই।
শরীফ বললেন, তুমি কিছু খেতে চাচ্ছো না কেন, বাবুল? না খেলে গায়ের জোর হবে কী করে? একটা আণ্ডা সিদ্ধ খাবে?
বাবুল বললো, আজ না কাল খাবো। পাশের ঘরের মহিলার কী হয়েছে? এত চিৎকার করে কাঁদছেন কেন? ওনার কেউ মারা গেছে?
শরীফ বললেন, না, ওদের ফ্যামিলির কেউ মারা যায় নাই, তবে চোখের সামনে অন্যদের মরতে দেখেছে, আসলে বেশী আঘাত লেগেছে ওদের বিশ্বাসে। ধর্মভীরু মুসলমানকেও যে অন্য মুসলমান আঘাত হানতে পারে, সেটা ওঁরা কিছুতেই এখনও মেনে নিতে পারছেন না!
জাহানারা বললেন, এ তো ক্ষমতা দখলের হিংস্রতা, এখানে আবার ধর্ম কোথায়?
বাবুল উৰ্বনেত্র হয়ে ঘরের ছাদের দিকে তাকালো। তার আর কিছু জিজ্ঞাস্য নেই, কোনো প্রশ্নের উত্তর দেবার আগ্রহও নেই।
শরীফ ও জাহানারা বিদায় নিলেন একটু পরে।
বাবুল আবার চেষ্টা করলো বই পড়ার। তার মনের জোর যতই থাকুক, শরীর খুব দুর্বল হলে। মনকে বশে রাখা যায় না। যেবই সে পড়ছে, তার একবর্ণও আজ মাথায় ঢুকছে না। বইখানা খসে গেল হাত থেকে। আজ বারবার মনে পড়ছে মনিরার কথা ও নিজের ছেলে সুখুর কথা। ভালো করে জ্ঞান ফিরেছে দুপুরের দিকে, তারপর থেকেই মনে হচ্ছে, মনিরার কী হলো? এদেশের মেয়ের চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল এদেশেরই সৈন্য, এরপর মনিরার ওপর তারা বলাকার করবে? খুন করবে? দিলারার স্বামী কর্নেল সাহেবকে যদি একবার ফোন করা যেত!
সুখু এখন কোথায়? সে কি বাবার জন্য কাঁদে একবারও? কোথায় যেন একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সব সহ্য করতে পারে বাবুল, কিন্তু শিশুদের কান্নার শব্দ সে কিছুতেই সহ্য করতে পারে না।
বাবুল ঘুমিয়ে পড়েছিল, এক সময় কিসের যেন শব্দে তার চটকা ছুটে গেল। আবার বুঝি ঢাকা শহরের সব বাতি নিবে গেছে, ক্যাবিনের ভিতরটা একেবারে অন্ধকার। শিয়রের কাচের জানলা দিয়ে দিয়ে সামান্য ছাই রঙের জ্যোৎস্না এসে পড়েছে, অর্থাৎ বেশ রাত হয়েছে। ক্যাবিনের মধ্যে কে যেন ঢুকেছে একজন, দেখা যাচ্ছে তার ছায়া-ছায়া মূর্তি। আজিজ ডাক্তার এসেছে ইঞ্জেকশান দিতে?
ছায়ামূর্তিটি বাবুলের খাটের ওপরেই বসে পড়ে কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করলো, এই হারামজাদা, মনিরা কোথায়?
বাবুলের মনে হলো, ছায়া মূর্তিটি যেন তার নিজেরই বিবেক। কিংবা তার আত্মা তার শরীর থেকে বেরিয়ে এসে পৃথক সত্তা হয়ে গেছে।
বাবুল অনুতপ্ত কণ্ঠে ফিসফিস করে বললো, আমি জানি না, সে কোথায়! তুমি বলো, তুমি বলো। আমি জানতে চাই!
ছায়ামূর্তি আবার বললো, নছল্লা করোস আমার সাথে, শুয়ারের বাচ্চা! তারে কোথায় পাঠাইছোস বল আগে!
বাবুল বললো, আমি তাকে কোথাও পাঠাইনি, কে সিরাজুলের কাছে চলে যেতে বলেছিলাম। সে গেল না। আমি তাকে ধরে নিয়ে গেল!
–মিথ্য কথা! তুই-ই আর্মিরে খবর দিছিলি! তুই আর্মির হাতে তারে তুলে দিছিস। এখন নিজে সাধু সাজতেহোস!
–না, না, না, আমি তুলে দিইনি। তা হলে আর্মি আমাকে গুলি করে মেরে ফেলার চেষ্টা করবে কেন?
–কোনো একটা বোকা সোলজার ভুল করে গুলি করেছে। হয়তো সে উপরের অর্ডার জানতো না। কিংবা, সবটাই তোর সাজানো। তুই গুলি খাওয়ার ভড়ং কইরা এইখানে লুকাইয়া আছোস! দেখি তো, তোর সত্যিই গুলি লাগছে কি না!
ছায়ামূর্তি বাবুলের গা থেকে চাঁদর সরিয়ে ফেলে তার পেটের ব্যান্ডেজ খুলতে লাগলো।
বাবুলের কথা লাগছে, তার ঘুম ও ওষুধের ঘোর কেটে যাচ্ছে, সে বুঝতে পারলো, এই মাত্র যার সঙ্গে সে কথা বললো, সে তার বিবেক নয়, একজন জলজ্যান্ত মানুষ? নিশ্চয়ই ডাক্তার। আজিজ, এমনই দায়িত্বশীল তিনি যে এই অন্ধকারের মধ্যেও বাবুলের ড্রেসিং চেইঞ্জ করে দিতে এসেছেন। কিন্তু আজিজ ডাক্তার এত তাড়াহুড়ো করে টেনে ব্যথা লাগিয়ে দিচ্ছেন কেন?
যন্ত্রণায় বাবুল চেঁচিয়ে উঠলো, আঃ, আঃ, একটু আস্তে!
তখন সেই ছায়ামূর্তি বাবুলের পেটে একটা চাপড় মেরে বললো, চুপ।
এবারে বাবুলের পরিপূর্ণ বোধ ফিরে এসেছে। সে চিনতে পারলো ছায়ামূর্তির কণ্ঠস্বর। মনিরার স্বামী সিরাজুল।
বাবুল অনেকটা সস্নেহে বলতে চাইলো, সিরাজুল, সিরাজুল, তুমি এত দেরি করলে!
সিরাজুল বাবুলের পেটের ব্যান্ডেজ সবটা খুলে ফেলেছে। একটা টর্চ জ্বেলে সে ক্ষতস্থানটা দেখলো। তারপর বললো, দেরি হয়েছে বটে, কিন্তু তোমারে ছাড়ছি না। বেজম্মা, দালাল!
বাবুল ক্লিষ্ট কণ্ঠে বললো, ওরে সিরাজুল, আমার লাগছে! খুব কষ্ট হচ্ছে! ডান দিকের মিটসেফের উপরে দ্যাখ ওষুধ আছে।
সিরাজুল দাঁতে দাঁত চেপে বললো, তোর সব কষ্ট এখনি কি শেষ হবে রে! হারামজাদা! তোর পেটের সব শিলাই ছিঁড়ে নাড়িভুড়ি লন্ডভণ্ড করে দেবো! আর্মির পা-চাটা কুত্তা।
অসহ্য ব্যথায় প্রায় অবশ হয়ে গিয়ে বাবুল ফিসফিস করে বললো, আমাকে মারিস না, সিরাজুল! আমি মানিরাকে…।
বাবুলের গলা বন্ধ হয়ে আসছে, হাত তুলে সিরাজুলকে বাধা দেবারও ক্ষমতা নেই তার। সে উপুড় হতে চাইলো, পারলো না।
হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে সিরাজুল তার কাঁধের ঝোলা থেকে একটা ছুরি বার করলো। তারপর সে আবার বাবুলের উরুর ওপর বসে পড়ে, একহাতে বাবুলের দুটো হাত বন্দী করে অন্য হাতে সাবধানে সেলাই কাটতে লাগলো। ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এলো রক্ত।
তক্ষুনি ক্যাবিনে এসে ঢুকলো আরও দুটি ছায়া মূর্তি। একজন সিরাজুলের কাঁধ ধরে টেনে বললো, এই সিরাজুল, কী করছিস?
সিরাজুল এবারে প্রচণ্ড জোরে গর্জন করে উঠলো, ছাড়, ছাড় আমারে, এই কুত্তাডারে আমি শ্যাষ কইরা দেই আগে!
অন্য দু’জন টেনে হিঁচড়ে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করলো সিরাজুলকে। তিনজনে লেগে গেল ঝটাপটি। পাশের ক্যাবিন থেকে সালেহা চেঁচিয়ে উঠলো, আবার অরা আইছে, অরা আইছে, হায় আল্লা, বাঁচাও বাঁচাও!
চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে জেগে উঠেছে সবাই, ছুটে এলেন ডাক্তার আজিজ আর সুলতানা। ততক্ষণে সিরাজুলের হাত থেকে ছুরিটা কেড়ে নিয়ে রুমী আর ইশরাক তাকে মাটিতে শুইয়ে চেপে ধরেছে।
আলো জ্বেলে দিয়ে ডাক্তার আজিজ সবিস্ময়ে একবার রক্তাক্ত বাবুলের বিছানা ও একবার তিনজন আগন্তুককে দেখে নিয়ে বললেন, এ কী, রুমী, তোমরা? লোকটাকে মেরে ফেললে?
সুলতানা দ্রুত বাবুলের কাছে চলে এসে তার বুকে হাত রেখে বললো, এখনো বেঁচে আছে, শিগগির গরম পানি আনতে বলো, ইঞ্জেকশান রেডি করো।
তারপর রুমীদের দিকে তাকিয়ে হিংস্র কণ্ঠে বললেন, গেট আউট। ক্লিয়ার আউট! না হলে আমি পুলিশে খবর দেবো!
বাবুল চৌধুরী তবু বেঁচে গেল। বিনা অ্যানেসথেসিয়াতেই আবার সেলাই করা হলো তার পেট। দুদিন পরে সেখানে সামান্য একটু ঘায়ের মতন পুঁজ জমে উঠলেও সেপটিক হলো না। তবে এই অবস্থায় সে কিছুই খেতে পারে না, এমনকি সামান্য দুধও সহ্য হয় না। একবার বমি করতে গিয়ে সে এমন কষ্ট পেল যে তার চেয়ে না খাওয়া অনেক ভালো। তার শরীরটা চুপসে গিয়ে লেগে রইলো বিছানার সঙ্গে।
জাহানারা ইমাম ছাড়া কে আর কেউ দেখতে আসে না। আর থাকে সেফু। সে ছলছল চোখ করে চুপটি করে বসে থাকে। সেই রাতের ঘটনার পর সে সাহেবের ঘরে সর্বক্ষণ থাকার জন্য জেদ ধরেছিল, ডাক্তার দম্পতি তাকে অনুমতি দিয়েছেন। ঐটুকু মেয়ে এর মধ্যেই বেশ নার্সিং শিখে গেছে।
বাবুল আর বই পড়ে না, সর্বক্ষণ চুপ করে ওপরের দিকে চেয়ে থাকে। সেফু কথা বলার চেষ্টা করলে সে এক একবার দুর্বল হাতখানি তুলে সেফুর মাথায় রাখে। এই মেয়েটার বাপ-মা।
জাহানারা ইমাম এসে নানারকম খবরাখবর শোনান। তিনি দু’একদিন আগে শহিদ মিনারের দিকটা দেখতে গিয়েছিলেন। শহিদ মিনার ভেঙে চুরমার হয়ে আছে, সেখানে নাকি সরকার মসজিদ বানাবে। রমনার প্রাচীন কালীবাড়ি ভেঙে একেবারে উড়িয়ে দিয়েছে, সেখানে যে কোনোকালে মন্দির ছিল তা বোঝাই যায় না। বায়তুল মোকাররামের অনেক দোকানপাট লুঠ হয়েছে। নিউজ উইকে প্রবন্ধ বেরিয়েছে, পাকিস্তান প্লাঞ্জেস ইন টু সিভিল ওয়ার’। লিখেছে লোরেন জেংকিনস, সে নিজে ক্র্যাক ডাউনের সময় ঢাকায় উপস্থিত ছিল। এখন আর পাকিস্তান সরকার বিশ্ববাসীকে ধোঁকা দিতে পারবে না যে কিছু ভারতীয় চরের উস্কানিতে এখানে সেখানে ছোটখাটো গণ্ডগোল হচ্ছে।
কথাবার্তা প্রায় এক তরফাই হয়। বাবুল অধিকাংশ সময় চুপ করেই থাকে। একদিন সে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো, আপা, আমি যে মানিরাকে বাঁচাবার চেষ্টা করেছিলাম, তা ওরা বিশ্বাস করলো না। আপনিও কি অবিশ্বাস করেন?
জাহানারা বললেন, না, না, অবিশ্বাস করবো কেন? সেফু আমাদের সব বলেছে। বাবুল, তোমার মতন ভদ্র মানুষ কখনো মেয়েদের অপমান সহ্য করবে, এ কেউ ভাবতে পারে না। রুমীরাও তোমাকে বিশ্বাস করে। সিরাজুলের কথা বাদ দাও, ওর প্রায় মাথা খারাপ হয়ে। গেছে। জানোই তো মনিরাকে ও কত ভালোবাসতো!
–সিরাজুলকে একবার ডেকে আনতে পারেন?।
–সে তো এখানে নাই। আবার অ্যাকশানে যোগ দিতে চলে গেছে।
–কোথায় গেছে? কোন দিকে গেছে?
–তা তো জানি না। সে সব কথা কি আর আমাকে বলে!
–সিরাজুলের সাথে আমার আর একবার দেখা করা খুব দরকার!
অন্য রুগীদের স্থান দেওয়া যাচ্ছে না, তাই বাবুলকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হলো কয়েকদিন পরেই। এখন তার প্রয়োজন শুধু বিশ্রাম। এখনও তার বাবা-মা কোনো খবর পাননি বোধহয়।
শরীরে একটু জোর পাবার পর বাবুল প্রথম দুতিনদিন ঘরের মধ্যে পায়চারি করলো, সেফুকে ধরে ধরে। তারপর সে নিজে হাঁটতে শিখলো। দোতলা থেকে একতলায় নামতে পেটে ব্যথা বোধ হলো কিছুটা, কিন্তু ব্লিডিং হলো না।
সিঁড়ির ঠিক যেখানটায় খান সেনারা বাবুলকে গুলি করেছিল, সেখানে সে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। সে মরে যায়নি, সে একটা নতুন জীবন পেয়েছে।
সেইদিনই মঞ্জুর ভাই আপেল এসে উপস্থিত হলো।
শ্বশুর বাড়ির লোকেরা যে কেউ ঢাকায় নেই তা জানতো বাবুল। মঞ্জুর বাবা অনেকদিন অসুস্থ, তাঁকে রাখা হয়েছে গ্রামের বাড়িতে, তিনি প্রায় সব সময় বিড়বিড় করে আপন মনে হামদ, নাত, দরুদ, মিলাদ পাঠ করেন আর মাঝে মাঝে চেঁচিয়ে ওঠেন, ঐ আসছে, ঐ আসছে! মঞ্জুর মা পড়েছেন বিপদে, ছেলেগুলো কোনো কম্মের না, এই আপেলও ব্যবসা করতে গিয়ে অনেক টাকা খুইয়েছে। অন্য সবাই গ্রামে, শুধু আপেল সস্ত্রীক রয়ে গেছে ঢাকার বাড়িতে। মাত্র দুদিন আগে সে কানা ঘুমোয় শুনেছে যে দুলাভাই বাবুল চৌধুরী নাকি গুলি খেয়ে মরতে বসেছে।
এখন সে বাবুলকে সুস্থ দেখে চমকে গেল। ঢাকায় এখন কত রকম গুজবই যে ছড়াচ্ছে। রোজ। বাবুল ও তার কাছে সত্যি কথা ভাঙলো না। হেসে উড়িয়ে দিল গোলাগুলির কথা।
পরদিন বাবুল সিঁড়ি দিয়ে ওপর নীচ করলো দু’তিনবার। তেমন আর অসুবিধে হচ্ছে না। আর দেরি করা যায় না। সন্ধেবেলা সে সেফুকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, আমি যদি এই বাসা এখন তালা দিয়ে চলে যাই, তুই কী করবি? কোথায় যাবি?
হাতির পুলের কাছে সেফুর এক গ্রাম সম্পর্কে চাচা থাকে, সে একজন কসাই, সেখানে সেফু কিছুতেই যেতে চায় না। সে বাবুলের হাত জড়িয়ে ধরে ভয় পেয়ে বলে উঠলো, আমি কুথাও যামু না, কুথাও যামু না। ভাবী আমারে বলে গেছেন আপনের লগে লগে থাকতে।
বাবুল তার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বললো, শোন, আমারে যে কাজে যেতে হবে। এইখানে বসে থাকলে, আবার যদি মিলিটারি আসে? বুঝলি না? তুই প্রথমে জাহানারা আপার বাসায় যাবি, বলবি, সাহেব আমারে আপনের এখানে থাকতে বলেছেন। উনি খুব ভালো মানুষ, তোরে রাখবেন। আর যদি দেখিস, ওর বাসায় অনেক লোকজন, তোর থাকোনের জায়গা নাই। তাইলে তুই যাবি আপেল সাহেবের বাড়ি। সে বাড়ি চেনোস তো!
সেফু আবার বললো, সাহেব আমি কুথাও যামু না, আমি এই বাসাতেই থাকুম!
বাবুল বললো, দূর বোকা! আমি চলে গেলে তুই একা থাকবি কী করে, তোরে মিলিটারি ধরে নিয়ে যাবে না? শোন, তুই কিন্তু ঠিক জাহানারা আপা কিংবা আপেল সাহেবের বাসায়। থাকবি, অন্য কোনো বাসায় কাজ নিবি না। তাহলে আমি ফিরে এসে আবার তোরে খুঁজে পাবো কী করে?
সব ঘরের দরজা জানলা বন্ধ করে, সদর দরজায় তালা দিয়ে বাবুল বললো, সেফু, তুই এখানে কিছুক্ষণ বসে থাক। আমি চলে যাবার আধঘণ্টার মধ্যে কাউকে কিছু বলবি না। আমি একটা কাজে যাচ্ছি রে, সেফু। ফিরে আসলে আবার তোরে ডেকে নিয়ে আসবো। মন খারাপ করিস না, কেমন?
বাবুলের নিজেরই চোখ ছলছল করছে সেফুকে ছেড়ে যেতে। তবু সে একটা রিকশা ডেকে উঠে পড়লো। মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।