জহুরের শার্টের পকেটে কিছু ভাঙতি পয়সা ছিল। সিগারেটের দাম দেবার সময় জহুরের মনে হল পয়সার সঙ্গে একটা কাগজের নোটও যেন রয়ে গেছে। সত্যি তাই। ছোটখাটো কোন নোট না, এক শ টাকার একটা নোট। দুলাতাই কোনো এক ফাঁকে পকেটে রেখে দিয়েছেন বলাই বাহুল্য। এর দরকার ছিল কি? ডেকে হাতে দিয়ে দিলেই হত। সম্ভবত দিতে লজ্জাবোধ করেছেন। জাবোধ করার কী আছে এর মধ্যে?
জহুর একটি সিগারেটের বদলে দু প্যাকেট সিগারেট কিনে ফেলল। তাতেও টাকার ভাঙতি হয় না। জহুর বলল, টাকাটা থাক তোমার কাছে। মাঝে মাঝে আমি সিগারেট নেব। এক সময় এক শ টাকার সিগারেট নেওয়া হবে।
পান-বিড়ির দোকানের ছেলেটির বয়স অল্প। সে এরকম অদ্ভুত প্রস্তাব এর আগে শোনে নি। জহুর বলল, ঠিক আছে?
জি আইচ্ছা।
সন্ধ্যা হয়-হয় অবস্থা। জহুর স্টেশনের দিকে যাবে বলে ঠিক করল। হেঁটে বেড়াবার জন্য জায়গাটা চমৎকার। সারি সারি কৃষ্ণচূড়ার গাছ আছে। ফুল ফুটেছে। নিশ্চয়ই।
মামা।
জহুর তাকিয়ে দেখল টুনী সেজগুজে যাচ্ছে যেন কোথায়।
যাস কোথায়?
গান গাইতে যাই মামা। গানের আসর হচ্ছে একটা।
দুলাভাই জানেন তো?
হুঁ, জানেন। বাবাই যেতে বলল।
একা-একা যাচ্ছি?
একা যাচ্ছি না। তুমিও যাচ্ছ আমার সাথে। তোমাকে ঘর থেকে দেখেই বের হয়েছি। নয়ত বাবার সঙ্গে যাওয়া লাগত। বাবার সঙ্গে যেতে ভালো লাগে না।
আসটা হবে কোথায়?
বলে তো তুমি আবার যেতে চাইবে না।
চৌধুরী সাহেবের বাড়ি?
হুঁ। তোমাকে গিয়ে বসে থাকতে হবে না। পৌছে দিয়ে চলে আসবে।
ঠিক আছে।
জহুর হাঁটতে শুরু করল। টুনী তরল গলায় বলল, শার্টের পকেটে টাকা পেয়েছ মামা?
পেয়েছি।
বাবা আমার হাতে দিয়ে বলেছেন তোমার পকেটে রাখতে।
জহুর চুপ করে রইল।
হাতে দিয়ে দিলেই হয়। তা দেবেন না। শুধুশুধু ঢং।
জহুর আড়চোখে কাল টুনীর দিকে। বড়োআপার সাথে টুনীর চেহারার খুব মিল। হঠাৎ হঠাৎ চমকে উঠতে হয়। কথাও বলে বড়োআপার মতো।
বাবার দোকানে আবার চুরি হয়েছে, জান নাকি মামা?
জহুর আশ্চর্য হয়ে বলল, কই, জানি না তো।
জানবে কোত্থেকে? সে কাউকে বললে তবে তো জানবে?
তুই জানলি কীভাবে?
ছোটমার সঙ্গে গুজগুজ করছিলেন। আড়াল থেকে শুনলাম।
কী চুরি হয়েছে?
তা জানি না। বাবার দিনকাল ভালো যাচ্ছে না। ডাল কিনে রেখেছিলেন, ইঁদুর নাকি বস্তা ফুটো করে কী সব করছে।
টুনী ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল।
আমি ভেবেছিলাম তুমি আসলে সব অন্য রকম হবে। কিন্তু তুমি আর আগের মতো নেই।
জহুর কথা বলল না।
তুমি তো দেখি দিনরাত বসেই থাক। কি ভাব বসেবসে?
কিছু ভাবিটাবি না।
কেন ভাব না? তোমাকে ভাবতে হবে।
ভাবতে হবে কেন?
টুনী চুপ করে গেল।
চৌধুরী সাহেবের বাড়ির সামনে বেশ ভিড়। স্থানীয় লোকজন সবাই মনে হয় এসে পড়েছে। গরমের জন্যেই হয়তো বারান্দায় চেয়ার সাজান হয়েছে। লোকজন বসে আছে চেয়ারে। জহুর ঘরের ভেতর ঢুকল না। টুনী মৃদু স্বরে বলল, তুমিও আস না মামা।
না, তুই যা।
জহুর স্টেশনের দিকে রওনা হল। বড়ো রাস্তার শেষ মাথায় এসে সে আরেকটি সিগারেট ধরাল। সাইফুল ইসলামকে এই সময় দেখা গেল দ্রুত পায়ে আসছে। তার হাতে তবলা এবং বাঁয়া। পোশাক-আশা আগের মতো ফিটফাট নয়। পাঞ্জাবিটাও ইস্ত্রি নেই। গা থেকে সেন্টের গন্ধও আসছে না। সাইফুল ইসলাম জহুরকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেল, জ ভাই, আপনার সঙ্গে একটা কথা বলতে চাই।
বলেন।
আজ তো সময় নাই। রাত্রে এক বার যার আপনার কাছে।
ঠিক আছে, আসবেন।
বিশেষ একটা জরুরী কথা।
ঠিক আছে।
আপনার কাছে একটা পরামর্শ চাই।
ঠিক আছে। এখন তাহলে যান, আপনার বোধহয় দেরি হয়ে যাচ্ছে।
জ্বি, দেরি হচ্ছে। তা ইয়ে, টুনী কি এসেছে চৌধুরী সাহেবের বাড়িতে?
এসেছে।
সাইফুল ইসলাম খানিক ইতস্তত করে বলল, আঙ্গুরীবালার মতো গলা টুনীর। আমি তাকে গান শিখাতে চাই জহুর ভাই। টাকাপয়সা কিছু দিতে হবে না।
সাইফুল ইসলাম বায়াটা নামিয়ে রেখে রুমাল দিয়ে ঘাড় মুছতে লাগল।
এইটাই কি আপনার জরুরী কথা নাকি?
জ্বি-না।
আপনার বোধহয় দেরি হয়ে যাবে।
না, দেরি আর কি?
সাইফুল ইসলাম একটা সিগারেট ধরাল। ক্লান্ত স্বরে বলল, দুই রাত ধরে আমার ঘুম হয় না।
জহুর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। অন্ধকার হয়ে গেছে, মুখ দেখা যাচ্ছে না।
আপনি বাসায় থাকবেন জহুর ভাই?
আমি থাকব।
এসপি সাহেব মৃদু গলায় বললেন, তুমি মা আরেকটি গান গাও।
আর কোন গান তো জানি না।
এসপি সাহেব বড়ই অবাক হলেন, একটি গানই জান?
জ্বি।
আশ্চর্য।
চৌধুরী সাহেব নিজেও খুব অবাক হয়েছেন। গান-বাজনা তিনি বিশেষ বোঝন না, তবু তাঁর মনে হল এই মেয়েটির মতো সুন্দর গলা তিনি বহু দিন শোনেন নি। এসপি সাহেব বললেন, গানটি তুমি আরেকবার গাও। নাম কি তোমার মা?
টুনী।
দবির মিয়া বলল, ওর ভালো নাম সুলতানা খানম।
আপনার মেয়ে বুঝি?
জ্বি স্যার।
এই মেয়ে খুব নাম করবে। আপনি দেখবেন, নাম করবে।
দবির মিয়া ঠাণ্ডা গলায় বলল, গৃহস্থ ঘরের মেয়ে গান-বাজনা আর কী করবে? এই সব আমাদের জন্যে না স্যার।
এসপি সাহেব রাগী চোখে তাকালেন। কঠিন ও তীক্ষ্ণ চাউনি।