১৯. ছোট সাব কোনদিকে যাব

ড্রাইভার বলল, ছোট সাব কোনদিকে যাব?

শুভ্র বলল, ফার ফ্রম দ্য মেডিং ক্রাউন্ড।

ড্রাইভার এমন ভঙ্গিতে গাড়ি স্টার্ট দিল যেন ফার ফ্রম দ্য মেডিং ক্রাউন্ড জায়গাটা সে চেনে। আগেও অনেকবার গিয়েছে।

আসমানী খুব হাসছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে খুব মজা পাচ্ছে। শুভ্র বলল, আমার অবশ্যি রিকশা করে ঘুরতে ইচ্ছা করছে। গাড়িতে উঠলেই আমার দমবন্ধ লাগে। আসমানী তোমার লাগে না? মনে হয় না— লোহার একটা খাঁচায় তোমাকে আটকে ফেলা হয়েছে?

উত্তর না দিয়ে আসমানী পান মুখে দিল। সে কৌটা ভৰ্তি করে পান নিয়ে এসেছে। শুভ্ৰর দিকে পানের কোটা এগিয়ে দিয়ে বলল, পান খান।

শুভ্ৰ বলল, আমি তো পান খাই না। আচ্ছা দাও খেয়ে দেখি। জর্দা নেই তো?

ওমা, জর্দা ছাড়া পান হয়! জর্দা আছে।

আচ্ছা ঠিক আছে, জর্দা দিয়েই খেয়ে দেখি।

শুভ্ৰ পান মুখে দিল। আসমানী শাড়ির আঁচল মাথায় তুলতে তুলতে বলল, বলুন দেখি কোন জিনিস একবার হারালে পাওয়া যায়। কিন্তু দ্বিতীয়বার হারালে পাওয়া যায় না।

এটা কি কোনো ধাঁধা?

হুঁ খুব সহজ ধাঁধা। একবার হারালে পাওয়া যায়। দ্বিতীয়বার হারালে আর পাওয়া যায় না।

সম্মান।

সম্মান যতবার হারাবেন ততবারই ফিরত পাবেন। এটা সম্মান না।

আমি পারছি না।

দাঁত। দাত প্ৰথমবার হারালে পাওয়া যায়। দাঁত উঠে। দ্বিতীয়বার হারালে আর পাওয়া যায় না।

শুভ্ৰ বিস্মিত হয়ে বলল, আসলেই তো তাই! আচ্ছা দেখি আরেকটা ধাঁধা ধর তো।

আসমানী বলল, আপনি চোখ বন্ধ করুন। এই ধাঁধাটা চোখ বন্ধ করে জবাব দিতে হয়।

শুভ্ৰ চোখ বন্ধ করল। আসমানী বলল, এখন বলুন—আমি কী রঙের শাড়ি পরেছি? আমার ধারণ আপনি বলতে পারবেন না।

শুভ্ৰ থিতামত খেয়ে গেল। আসলেই সে বলতে পারছে না। এতক্ষণ ধরে যে মেয়েটির সঙ্গে সে আছে সে কী রঙের শাড়ি পরেছে এটা সে কেন বলতে পারবে না?

কী আশ্চর্য! এত দেরি করছেন কেন? বলুন।

চকলেট রঙের।

কী রঙের বল্লেন?

চকলেট রঙের। হয়েছে?

আসমানী কিছু বলছে না। তার চাপা হাসি শোনা যাচ্ছে। জবাবটা যে সঠিক হয় নি। শুভ্র তা বুঝতে পারছে। চকলেট রঙটা হঠাৎ তার মাথায় এসেছে বলেই সে বলেছে। না ভুল হল, চকলেট রঙের ব্যাপারটা হঠাৎ তার মাথায় আসে নি। চকলেট রঙ মীরার খুব পছন্দ। মীরা যখন তখন বলে উঠবে, চকলেট আমি খেতে পছন্দ করি। চকলেট রঙের শাড়ি পরতে পছন্দ করি এবং কোনো একদিন আমি চকলেটের দোকান দেব। যেখানে পৃথিবীর সব দেশের চকলেট পাওয়া যাবে।

আপনি এখনো চোখ বন্ধ করে আছেন কেন? চোখ মেলুন।

শুভ্ৰ চোখ মেলে ধাক্কার মত খেল। প্রথমত আসমানী কোনো শাড়িই পরে নি–সাদা রঙের সালোয়ার কামিজ পরেছে। ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে রেখেছে। সেই ওড়নার রঙটাও সাদা।

অথচ কিছুক্ষণ আগেও তার মনে হচ্ছিল আসমানী শাড়ি পরেছে। গাড়িতে উঠেই সে ঘোমটা দিয়েছে। আসলে সে ঘোমটা দেয় নি। মাথায় ওড়না উঠিয়ে দিয়েছে।

আসমানী খিলখিল করে হাসছে। শুভ্ৰ বলল, তুমি হাসছ কেন?

আপনি খুব অবাক হয়ে আমার কাপড় দেখছেন তো, এই জন্যে হাসছি।

তুমি কী রঙের কাপড় পরেছ তা বলতে পারি নি। এর সহজ অর্থ আমি তোমাকে ভালমত লক্ষ করি না। এটা তোমার জন্যে কষ্টের ব্যাপার হওয়া উচিত। কিন্তু তুমি হাসছ।

আসমানী আরেকটা পান মুখে দিতে দিতে বলল, আমি যদি আপনার প্রেমে পড়তাম তাহলে কষ্ট পেতাম। আমি তো আপনার প্রেমে পড়ি নাই। আপনি আমাকে লক্ষ করলেও কিছু না, লক্ষ না করলেও কিছু না।

ও।

কেউ যদি আমাকে লক্ষ না করে তাহলেই আমার বেশি ভাল লাগে।

তোমার কথা বুঝতে পারছি না।

ও আল্লা, আমি তো জটিল কথা বলতেছি না। জটিল মানুষদের সঙ্গে থাকলে জটিল কথা বলা যায়। আমি সব সময় থাকি সহজ মানুষদের সঙ্গে। আমাদের কাছে জটিল মানুষরা আসে না।

 

শুভ্ৰ আগ্রহের সঙ্গে বলল, আমি কেমন মানুষ?

আসমানী সঙ্গে সঙ্গে বলল, আপনি বোকা মানুষ।

তুমি সত্যি আমাকে বোকা বলছি, না ঠাট্টা করছি?

সত্যি বোকা বলছি। ঠাট্টা করব কেন? আপনার সঙ্গে তো আমার ঠাট্টার সম্পর্ক না। আপনেতো আমার নানা না।

আমার নিজেরও ধারণা আমি বোকা। তবে পড়াশোনার বুদ্ধি আমার আছে। আমি সারাজীবন ফার্স্ট-সেকেন্ড হয়েছি। তবে পরীক্ষায় ফার্স্ট সেকেন্ড হবার সাথে বুদ্ধির কোনো সম্পর্ক নেই।

সম্পর্ক না থাকলে তো ভালই।

শুভ্র বলল, দেখি আরেকটা পান দাও তো। পান খেতে বেশ ভাল লাগছে। পান খেতে এত ভাল লাগবে জানলে রোজ পান খেতাম।

আসমানী পানের কোটা বাড়িয়ে দিল। শুভ্ৰ পানের খিলি হাতে নিতে নিতে আগ্রহের সঙ্গে বলল, মানুষের বুদ্ধি কেমন এটা মাপার চেষ্টা অনেকদিন থেকেই করা হচ্ছে। পারা যাচ্ছে না। এমন কোনো পদ্ধতি নেই। যা থেকে চট করে বলে দেয়া যায়- এই মানুষটার বুদ্ধি বেশি বা এর কম। আইকিউ টেষ্ট বলে এক ধরনের টেস্ট আছে। মজার ব্যাপার কী জান পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত মানুষ এই টেটেষ্ট ফেল করেছেন।

আপনি পাশ করেছেন?

আমি এই টেস্ট কখনো দেই নি। দিলেও আমার ধারণা আমি পাশ করতে পারব না। তবে মীরা খুব হাই নাম্বার পেয়েছে।

মীরা কে?

আমার সঙ্গে এম.এসসি পাশ করেছে। অসম্ভব ভাল ছাত্রী।

দেখতে কেমন?

দেখতে কেমনের সঙ্গে তো বুদ্ধির সম্পর্ক নেই।

অবশ্যই আছে। একটা মানুষ বোকা না বুদ্ধিমান তা বলার জন্যে কোনো পরীক্ষা লাগে না। চেহারা দেখে বলে দেয়া যায়।

তুমি বলতে পার?

অবশ্যই পারি। আপনাকে দেখে বলেছিলাম না- আপনি একটু বোকা?

শুভ্ৰ চুপ করে গেল। জর্দার কারণে তার মাথা ঘুরছে। তার জন্যে অবশ্যি খারাপ লাগছে না। বরং ভালই লাগছে। সে মনে মনে ঠিক করে ফেলল, মুখের পানটা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা পান খাবে। বাড়তি জর্দা দিয়ে খাবে।

গাড়ি ময়মনসিংহ রোড ধরে চলেছে। রাস্তায় খুব ট্রাফিক। একেকবার গাড়ি থামিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে হচ্ছে। শুভ্ৰ লক্ষ করল— আশেপাশের গাড়ি থেকে অনেকেই কৌতূহলী হয়ে তাকে এবং আসমানীকে দেখছে। এ রকম ঘটনা কি আগেও ঘটেছে? মনে হয় না। মীরাকে নিয়েও সে আগে অনেকবার গাড়িতে করে ঘুরেছে। তখন তো লোকজন এমন কৌতূহলী হয়ে তাকায় নি! এখন তাকাচ্ছে কেন?

আসমানী।

জ্বি।

তুমি কি লক্ষ করেছ লোকজন আমাদের দেখছে?

হুঁ।

তোমার কী ধারণা— কেন সবাই এমন করে তাকাচ্ছে?

আপনি বুঝতে পারছেন না?

না বুঝতে পারছি না।

খুব ভাল করে আমার মুখের দিকে তাকান তাহলেই বুঝতে পারবেন।

শুভ্ৰ ভাল করেই তাকাল। পান খাওয়ার জন্যে আসমানীর ঠোঁট হয়েছে টকটকে লাল। এর বেশি কিছু তো না। সে নিজেও পান খেয়েছে। তার ঠোঁটও নিশ্চয়ই লাল হয়েছে। একটা ছেলে এবং একটা মেয়ে বসে আছে। দুজনের ঠোঁটই টকটকে লাল- এটাই কি লোকজনের কৌতূহলের কারণ?

বুঝতে পারছেন কিছু?

না,

কেন লোকজন কৌতূহলী হয়ে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে বলব?

বল।

আপনি কিন্তু লজ্জা পাবেন।

লজ্জা পাব কেন?

আমাদের দেখে সবাই ভাবছে আমরা বিয়ে করেছি। বিয়ের পর আমি যাচ্ছি স্বামীর ঘরে।

শুভ্ৰ বিস্মিত হয়ে বলল, এ রকম ভাববে কেন?

আসমানী হাসিমুখে বলল, এরকম ভাববে। কারণ আপনি পরেছেন পায়জামাপাঞ্জাবি। বরদের পোশাক। আর আমি মুখে চন্দনের ফোঁটা দিয়েছি। এই জন্যেই তো আপনাকে বললাম। আমার মুখের দিকে তাকাতে। মেয়েরা মুখে চন্দনের ফোঁটা দেয় শুধুই বিয়ের দিন।

মুখে চন্দনের ফোটা কেন দিয়েছ?

আমি যখনই কারো সঙ্গে বাইরে বের হই মোটামুটি বউ সেজে বের হই। মুখে চন্দনের ফোটা দেই। চোখে কাজল দেই।

তুমি কি প্রায়ই লোকজনের সঙ্গে বের হও?

প্রায়ই না হলেও মাঝে মাঝে বের হই।

বের হয়ে কোথায় যাও? রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াও?

যারা আমাকে নিয়ে বের হয় তারা রাস্তায় ঘোরার জন্যে বের হয় না। তারা আমাকে বাগান বাড়িতে নিয়ে যায়।

বাগান বাড়িতে নিয়ে যায় মানে কী? বাগান বাড়িটা কী?

ঢাকা শহরের কিছু ধনী মানুষ আছে যাদের শহরে বাড়ি আছে, আবার জঙ্গলের দিকে নির্জনে জায়গা আছে। সেখানে সুন্দর বাড়ি ঘর আছে। বন্ধুবান্ধব নিয়ে সেইসব বাড়িতে নানান ধরনের ফূর্তি হয়। গান বাজনা হয়। মদ খেয়ে নানান রকম হুল্লোড় হয়।

তুমি যাও সে সব জায়গায়?

যাব না কেন? টাকা দিলেই আমি যাব। বাগান বাড়িতে যাবার জন্যে আমরা অনেক বেশি টাকা পাই। একেক রাতের জন্যে পাঁচ হাজার টাকা। আপনার কাছে যদি পাঁচ হাজার টাকা থাকে তাহলে আপনি আমাকে কোনো বাগান বাড়িতে নিয়ে যেতে পারেন।

আমার তো কোনো বাগান বাড়ি নেই।

পরিচিত এমন কেউ নাই যার বাগান বাড়ি আছে?

না।

আমি একটা বাগানবাড়ি খুব ভাল করে চিনি। আপনাকে নিয়ে গেলে কোনো সমস্যা হবে না। দারোয়ান হাসিমুখে ঘর খুলে দেবে। যাবেন?

শুভ্ৰ জবাব দিল না। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আসমানী বলল, আরেকটা পান খান। দানে দানে তিন দান। যে-কোনো জিনিস তিনবার করতে হয়। বিয়ের সময় যে কবুল বলে- একবার কিন্তু বলে না। তিনবার বলে। দেই আরেকটা পান?

দাও।

শুভ্ৰ পান মুখে দিল। তাকে হঠাৎ খুব অস্থির মনে হল। যেন সে খুবই দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেছে। সে চোখ থেকে চশমা খুলে আবার চোখে দিল। জানালার কাচ নামিয়ে আবারও কাচ উঠিয়ে দিল।

আসমানী বলল, আপনার কি শরীর খারাপ করেছে?

শুভ্ৰ বলল, না।

আপনার কপাল ঘামছে। দেখি কাছে আসুন তো, আমি কপালটা মুছে দেই।

শুভ্ৰ নড়ল না। যেখানে বসে ছিল সেখানেই বসে রইল। আসমানী নিজেই এগিয়ে এসে গায়ের ওড়না দিয়ে শুভ্রর কপালের ঘাম মুছিয়ে দিল। শুভ্ৰ অস্পষ্ট গলায় বলল, আসমানী তোমাকে একটা কথা বলতে চাচ্ছি।

আসমানী বলল, বলুন। কথা বলুন।

শুভ্ৰ এক দৃষ্টিতে আসমানীর দিকে তাকিয়ে আছে। আসমানীর ঠোঁটের কোণায় অস্পষ্ট হাসি। সে শুভ্রর চোখের ওপর থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সে তাকিয়ে আছে, আবার তাকিয়েও নেই।

চুপ কইরা আছেন কেন? বলেন কী বলবেন।

কীভাবে বলব গুছাতে পারছি না।

এই রকম হয়। অনেক কথা আছে গলা পর্যন্ত আসে। কিন্তু গলা দিয়া বাইর হয় না। তারও ওষুধ আছে।

কী অষুধ?

তখন মাল খাইতে হয়। মাল কী জানেন–মদ। মদরে লোকে মাল বলে আবার মেয়ে মানুষরেও বলে মাল। চলেন যাই কোনোখানে গিয়া বসি। আপনে মাল খান। তারপরে নিশ্চিন্তে কথা বলেন।

আসমানী তোমার সঙ্গে আমি কেন ঘুরছি জান?

না জানি না।

তোমার মনে এ ধরনের কোনো চিন্তা আসেনিতো যে আমি তোমার প্রেমে পাগল হয়ে গেছি। ব্যাপারটা সে রকম না।

ব্যাপার তা হইলে কী?

আমি তোমাদের কষ্টটা বুঝতে চেষ্টা করছিলাম। কারো খুব কাছাকাছি না গেলে কষ্ট বোঝা যায় না। আমি কাছাকাছি যাবার চেষ্টা করেছি।

কষ্ট বুঝতে পারছেন?

মনে হয় কিছুটা পেরেছি।

ছোট সাহেব, আপনেরে একটা কথা বলি মন দিয়া শুনেন। যারা পয়সা দিয়া আমরার কাছে আসে আপনে তারার চেয়েও অনেক খারাপ।

এটা কেন বলছ?

জানি না কেন বললাম। নেন আরেকটা পান খান।

শুভ্ৰ হাত বাড়িয়ে পান নিল। আসমানী হাসিমুখে জানোলা দিয়ে তাকিয়ে আছে। বাইরের দৃশ্য মনে হয় তার খুব ভাল লাগছে। তারও মুখ ভর্তি পান। জানালা দিয়ে মাথা বের করে পানের পিক ফেলতে গিয়ে সে তার সালোয়ার মাখামাখি করে ফেলল। এতে মনে হয় তার আনন্দ আরো বাড়ল। সে শুভ্ৰর দিকে তাকিয়ে বলল- ছোট সাহেব, আপনে একটা কাজ করেন। আমার হাত ধইরা বসেন। হাত ধইরা বসলে— আমরার কষ্ট আরো তাড়াতাড়ি বুঝবেন। হিহিহিহি।

আসমানী হাসছে। তার হাসি থামছেই না। রেকর্ড করা হাসির সঙ্গে এই হাসি মিল খাচ্ছে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *