১৯. চাকুরি হারাবার পর অন্য জীবনে

উনবিংশ অধ্যায় – চাকুরি হারাবার পর অন্য জীবনে

  • শেখ সাহেব নূর ও আমাকে দেখা করতে বলেছিলেন।
  • নতুন করে জীবিকার সংস্থানের চেষ্টায় SANS INTERNATIONAL গঠন।
  • কোন সম্পর্কই নীতি-আদর্শের উর্দ্ধে নয়।
  • সাপ্তাহিক জনমতকে দেয়া জেনারেল (অবঃ) শফিউল্লার সাক্ষাৎকার।
  • ’৭৪ এর মন্বন্তর। দুর্ভিক্ষের সময়ও ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে দুর্নীতি।
  • সোনার মুকুট পরে শেখ কামাল ও শেখ জামালের বিয়ে।
  • বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনকে ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে ঐক্য প্রচেষ্টা।
  • নতুন রাজনৈতিক দল ইউনাইটেড পিপলস পার্টির (উপিপি) আত্মপ্রকাশ।
  • ১৯৭৪ এর শেষের দিকে এসপি মাহবুব আমাকে সতর্ক করে দেয় বন্ধু হিসাবে।
  • আমার প্রাণনাশের দ্বিতীয় প্রচেষ্টা।
  • জনাব তাজুদ্দিন আহমদ ডেকে পাঠালেন।
  • সরকারি দলের আরো অনেক নেতাকর্মীদের সাথেও যোগাযোগ রক্ষা করে চলা হচ্ছিল।
  • আওয়ামী-বাকশালী শোচনীয় ব্যর্থতা সম্পর্কে আর্ন্তজাতিক প্রচার মাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত কয়েকটি প্রতিবেদন
  • আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মূল রূপকার ছিলেন পাকিস্তান নৌ বাহিনীর লেঃ কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন।
  • আমার প্রাণনাশের তৃতীয় প্রচেষ্টা।

শেখ সাহেব আমাকে এবং নূরকে দেখা করতে বলেছিলেন; কিন্তু তখন পর্যন্ত দেখা করতে যেতে পারিনি বিভিন্ন ব্যস্ততায়। ব্যাপারটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল না। শেখ সাহেব আবার খবর পাঠালেন দেখা করার জন্য। গেলাম আমি ও নূর ৩২নম্বরেই দেখা করতে। সালাম দোয়া বিনিময়ের পর শেখ সাহেবই শুরু করলেন,

— দেখ আমার কিছুই করার ছিল না। নেহায়েত অপারগ হয়েই তোদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে আমাকে। জানি আমার এই সিদ্ধান্তে মনঃক্ষুন্ন হইছস তোরা; হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমি তোদের জন্য কিছু একটা করতে চাই। বিদেশে দূতাবাসে চাকরি করতে চাইলে সেই ব্যবস্থা কইরা দিতে পারি। ব্যবসা করতে চাইলে নাসেররে কইয়া সে ব্যবস্থাও কইরা দিতে পারি; ওর অনেক ধরণের ব্যবসা আছে। তার সাথেও তোরা যোগ দিতে পারছ।

— চাচা আমরা সৈনিক মানুষ। সেনা বাহিনীর চাকরি স্বেচ্ছায় নিয়েছিলাম টাকা-পয়সার লোভে নয়; সম্মান এবং দেশের সেবা করার জন্যই। সেটাই যখন আপনার বিচারে হারাতে হয়েছে তখন আপনার কাছে আমাদের আর অন্য কিছুই চাওয়ার নাই। এরপরও আপনি আমাদের জন্য যদি কিছু করতে চান সেটা আপনার মহানুভবতা। আপনি আমাদের জন্য দোয়া করবেন সেটাই যথেষ্ট। রিজিকের মালিক আল্লাহ। খেয়ে-পড়ে বাচাঁর মত কিছু একটা করতে পারব আপনাদের দোয়ায় ইনশাল্লাহ। জানিনা আর দেখা হওয়ার সুযোগ হবে কিনা? বেয়াদবী নেবেন না চাচা, একটা কথা আপনাকে বলে যাই। আপনার আশেপাশে যারাই সর্বক্ষণ আপনাকে ঘিরে রাখছে তাদের বেশিরভাগই মতলববাজ। দেশের অবস্থা এবং জনগণ সম্পর্কে তারা আপনাকে সঠিক কথা বলে না। যা শুনলে আপনি খুশী হবেন চাটুকাররা সেটাই বলে থাকে মতলব হাসিল করার জন্য। খোদা না করুক তেমন দুর্দিন যদি কখনো আসে তবে এদের কেউই আপনার সাথে থাকবে না; চলে যাবে নতুন আশ্রয়ের সন্ধানে। তখন সেই অবস্থার জন্য সব দায়দায়িত্ব আপনার উপরই আরোপ করা হবে এবং অবস্থার মোকাবেলাও করতে হবে আপনাকেই। আপনি সবসময় বলে থাকেন যে দেশের জনগণকে আপনি ভালো করে চেনেন; কিন্তু আজ আমি বলে যাচ্ছি জনগণ থেকে বর্তমানে আপনি সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন কিংবা আপনাকে করা হচ্ছে। আপনি আমাদের স্নেহ করেন। আমাদের চাকুরিচ্যুত করে আপনার কতটুকু লাভ হয়েছে সেটা আপনিই ভালো বোঝেন; তবে আমরা কিন্তু বরাবরই আন্তরিকভাবে আপনার ভালোই চেয়েছি। আল্লাহ্পাক আপনাকে অনেক দিয়েছেন। আপনারতো আর চাওয়া-পাওয়ার কিছুই থাকতে পারে না। ‘চাটার দল’ ছেড়ে দেশ ও জাতির নেতা হওয়ার চেষ্টা করা উচিত আপনার। তারই মধ্যে রয়েছে আপনার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের ত্যাগ ও পরিশ্রমের সার্থকতা।

শেখ সাহেব আমার কথাগুলো চুপচাপ শুনছিলেন আর পাইপে মৃদুমৃদু টান দিচ্ছিলেন। তিনি কিছু বলছেন না দেখে আমি বললাম,

—আমরা তাহলে এবার আসি? তিনি অনুমতি দিলেন। আমরা বেরিয়ে এলাম ৩২ নম্বর থেকে। অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথেই কথাগুলি বলেছিলাম তাকে: ব্যক্তিগতভাবে শ্রদ্ধা করি বলেই। এর কতটুকু তিনি বুঝেছিলেন জানি না।

এরপর ব্যস্ত হয়ে পড়লাম জীবিকা সংস্থানের চেষ্টায়। আমার ছোট ভাই স্বপনের সাথেই ব্যবসা করব ঠিক করলাম। সে ব্যবসাতে অভিজ্ঞ। এমবিএ-তে ভালো রেজাল্ট করার পর থেকেই ব্যবসা করছে স্বপন। কর্নেল আকবর ও মেজর শাহরিয়ার ইতিমধ্যেই স্বেচ্ছায় চাকুরি ছেড়ে দিয়েছে আমরা চাকুরিচ্যুত হওয়ার পর। মেজর শাহরিয়ার ‘শ্যেরী এন্টারপ্রাইজ’ নামে কোম্পানী খুলে ব্যবসা শুরু করল। কর্নেল আকবর আমাদের সাথে যোগ দিবেন ঠিক করলেন। স্বপন, কর্নেল আকবর, মেজর নূর এবং আমার নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে গঠন করা হল SANS INTERNATIONAL”. চাকুরিচ্যুত হওয়ায় বাধ্যবাধকতার ঝামেলা অনেক কমে গেল। অবাধে সব জায়গায় ইচ্ছামত যোগাযোগের সুযোগ পেলাম আমরা। সরকার ও সরকারি দল আমাদের প্রতি বিরূপ থাকলেও অনেক হিতৈষী এবং সুজন ব্যবসায় আমাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন। ক্ষেত্র বিশেষে ঝুঁকি নিয়েও অনেকে আমাদের সাহায্য করেছেন। তাদের সেই সাহায্য ও আন্তরিক সহযোগিতার ঋণ কখনোই শোধ করার নয়। পরিচয় নেই এমন অনেকেও সেই দুর্দিনে নাম শুনেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সহানুভূতির সাথে। ছোটখাটো ইম্পোর্ট এবং সাপ্লাই এর ব্যবসা আমাদের অল্প সময়ের মধ্যেই বেশ জমে উঠল। টাকা-পয়সার আমদানি হচ্ছিল ভালোই। আইআরডিপিতে সাপ্লাই কন্ট্রাকটার হিসাবে দেশের প্রায় সব থানাতেই কাজ করার সুযোগ হয়েছিল আমাদের। এতে করে সব মহলের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার বিশেষ সুবিধা হয়েছিল আমাদের। শহর-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে সর্বস্তরের লোকজনদের সাথে মিশে বিভিন্ন বিষয়ে তাদের মনোভাব বোঝার সুযোগ হয়েছিল আমাদের। বুঝতে পারছিলাম সরকারের অপশাসন আর অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে উঠেছে দেশের সাধারণ মানুষ। যেখানেই গেছি পরিচয় জেনে লোকজন সম্মান দেখিয়েছেন; শ্রদ্ধার সাথে নিঃস্বার্থভাবে যতটুকু সম্ভব সাহায্য করেছেন আমাদের কাজে। এভাবেই কাটছিল আমাদের সময়।

একদিন বেশ রাত করে ধানমন্ডির এক বন্ধুর বাসার পার্টি থেকে ফিরছিলাম আমি ও নিম্মী। মশুলধারে বৃষ্টি পড়ছে। অল্পদূরেও কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ইন্টারকন ছেড়ে পুরনো গণভবন মানে বর্তমানের সুগন্ধার কাছাকাছি এসেছি; হঠাৎ বিপরীত দিক থেকে একটি গাড়ি অতি দ্রুতগতিতে আসছে দেখলাম। দূর থেকেই গাড়ির ভিতর থেকে হৈ-হুল্লোড়ের আওয়াজ শুনতে পেলাম। কিছু উশৃঙ্খল তরুন বেসামাল অবস্থায় হৈ-হুল্লোড় করছিল। গাড়িটিও এগিয়ে আসছিল ঠিক একই অবস্থায় একেবেকে। নিয়ন্ত্রণহীন গাড়ি থেকে নিজেদের বাঁচাবার জন্য গাড়ি একটু সাইড করতেই গাড়ি স্কিড় করে গিয়ে জোরে মুখোমুখি ধাক্কা খেল সামনের ল্যাম্পপোষ্টের সাথে। জোরে ধাক্কা লাগায় ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেল। সামনের বনেটটাও দুমড়ে-মুচড়ে ভিতরে ঢুকে গেছে। গাড়ি কিছুতেই আর স্টার্ট নিচ্ছে না। অন্য গাড়িটি আমাদের অবস্থা দেখে না থেমে আরো দ্রুতবেগে দৃষ্টির বাইরে চলে গেছে। বৃষ্টির প্রচন্ডতা ক্রমশঃ বেড়েই চলেছে। রাত অনেক হয়েছে তার উপর এমন বৃষ্টি তাই রাস্তাও একদম ফাঁকা ষ্টিয়ারিং এর সাথে মাথা লেগে মাথা ফেটে রক্ত ঝরে পরছে আমার কপাল বেয়ে। নিম্মীর অবশ্য কিছুই হয়নি। আমার রক্ত দেখে ঘাবড়ে গেছে বেচারী। কি করব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ইঞ্জিনটা একটু নেড়েচেড়ে দেখছিলাম যদি কোনমতে গাড়িটা স্টার্ট নেয়। না; কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। হঠাৎ সাইরেন বাজিয়ে রাষ্ট্রপতির কাফেলা এগিয়ে আসছে দেখতে পেলাম। আমি তখন অসহায় অবস্থায় দাড়িয়ে আছি গাড়ির পাশে। কাফেলা কাছে আসতেই রাষ্ট্রপতির গাড়ি দাড়িয়ে পড়ল। গাড়ির জানালার কাঁচ নামিয়ে স্বয়ং রাষ্ট্রপতি মুখ বের করে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন কি ব্যাপার? কপালের রক্তক্ষরণ দেখে বুঝতে পারলেন গাড়ির এ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। মুহূর্তে তিনি তার একজন সহযোগীকে নির্দেশ দিলেন অবিলম্বে গাড়িতে করে আমাদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে। তার হুকুমে আমি ও নিম্মী তার কাফেলারই একটি গাড়িতে করে CMH-এ পৌঁছালাম। চিকিৎসার পর তার গাড়িতেই বাসায় ফিরলাম। বাসায় ফিরে দেখি বাসার সবাই উৎকণ্ঠিত অবস্থায় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমার মাথায় ব্যান্ডেজ দেখে সবাই ভড়কে গিয়েছিল। রাষ্ট্রপতি বাড়ি ফিরেই মালিবাগে আমাদের দুর্ঘটনার খবরটা পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। ফোনে অবশ্য জানানো হয়েছিল accident তেমন একটা serious নয়; তাই ঘাবড়াবার কোন কারণ নেই। আব্বাকে আস্বস্ত করার জন্য বলা হয়েছিল দুর্ঘটনাস্থলের কাছ দিয়ে যাবার সময় আমাদের দেখতে পেয়ে স্বয়ং রাষ্ট্রপতিই আমাদের গাড়ি করে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেবার বন্দোবস্ত করেছেন। সবাইকে দুঃশ্চিন্তামুক্ত করার জন্য বলেছিলাম, “ Injury is not serious at all only three stitches that’s all. So nothing to worry about and Nimmi is absolutely unhurt.”

এ ঘটনার অবতারনা এখানে এর জন্য করা হল যা থেকে পাঠক বুঝতে পারবেন ব্যক্তি এবং পারিবারিক পর্যায়ে মুজিব পরিবারের সাথে আমাদের কি ধরণের ঘনিষ্ঠতা ছিল। কিন্তু কোন সম্পর্কই নীতি-আদর্শের উর্দ্ধে নয়। তাই আমিও পারিনি আপোষ করতে ব্যক্তি মুজিব নয়; গণবিরোধী পুতুল সরকার প্রধান, গণতন্ত্রের হত্যাকারী, বাকশালী স্বৈরশাসনের প্রবর্তক শেখ মুজিবর রহমানের সাথে।

সেনা বাহিনীতে চাকুরিরত অবস্থায় আমাদের তৎপরতা সম্পর্কে মেজর রফিক পিএসসি তার গ্রন্থ ‘বাংলাদেশ। সামরিক শাসন ও গণতন্ত্রের সঙ্কট’-এ লিখেছেন, “সমসাময়িক ইতিহাসে কম্বোডিয়া, গণচীন, কিউবা, ভিয়েতনাম তথা সর্বত্রই মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীন হবার পর ক্ষমতা দখল করেছে। শুধু বাংলাদেশেই ঘটেছে এর ব্যতিক্রম। মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশ মুক্ত হওয়ার পর অস্ত্র সমর্পন করেছে রাজনৈতিক নেতাদের হাতে; দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে কোন বাধার সৃষ্টি করেনি 1 মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণকারী অফিসার-সৈনিকেরা স্বাভাবিকভাবেই দেশের দারিদ্রতা, অর্থনৈতিক অবক্ষয় ও দুর্নীতি দেখে হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়ে। সেনা বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ও সৈনিকরা সরকার পরিচালনার মত একটি দূরহ রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতে থাকে। মেজর ডালিম, মেজর পাশা, মেজর বজলুল হুদা, মেজর শাহরিয়ার তখন কুমিল্লা সেনা নিবাসে চাকুরিরত ছিলেন। এরা প্রায়ই অবসর সময়ে মিলিত হতেন এবং দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আওয়ামী লীগের দুর্নীতিবাজ লোকদের নিয়ে সরকার পরিচালনা এবং দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে অসন্তোষ প্রকাশ করতেন। এভাবে অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে। ১৯৭২ সালে কুমিল্লা সেনা নিবাসে কর্নেল তাহের ও ঢাকা সেনা নিবাসে কর্নেল জিয়াউদ্দিন প্রতি সপ্তাহে ষ্টাডি পিরিয়ডের নামে অফিসারদের সমবেত করে দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা এবং দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যর্থতা সম্পর্কে তরুণ অফিসারদের সঙ্গে সমালোচনায় লিপ্ত হতেন।”

জনাব রফিক তার একই গ্রন্থে ঢাকা নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং রেডক্রস চেয়্যারম্যান গাজী গোলাম মোস্তফা লেডিস ক্লাবে বিয়ের অনুষ্ঠানে যে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটিয়েছিলেন সে সম্পর্কে লিখেছেন, “৩২নং ধানমন্ডিস্থ শেখ মুজিবের বাসভবনে শেখ মুজিবের সামনে ডালিম নিজের জামা খুলে মুক্তিযুদ্ধের সময় পিঠে এবং হাতে গুলির আঘাতের ক্ষত দেখান এবং বলেন, ‘আমরা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি আপনার এই গুন্ডারা সেদিন কোথায় ছিল?’ শেখ মুজিব দুই পক্ষকে শান্ত করে সুবিচারের আশ্বাস দিয়ে তাদের বিদায় করেন। এদিকে মেজর ডালিম ও তাঁর স্ত্রীকে হেস্তনেস্ত করায় ঢাকা সেনা নিবাসে উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এই অপ্রীতিকর ঘটনার প্রেক্ষিতে মেজর ডালিম ও মেজর নূরকে সেনা বাহিনীর চাকুরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। এই ঘটনাটি সামান্য হলেও সেনা বাহিনীর সকল স্তরে একটি চাপা অসন্তোষের সৃষ্টি করে। মেজর ডালিম সাধারণ সৈনিকদের কাছে খুবই প্রিয় ছিলেন।”

মুজিব সরকার এবং সেনা বাহিনীর সম্পর্ক, সেনা বাহিনীর প্রতি শেখ মুজিবর রহমানের দৃষ্টিভঙ্গি এবং রক্ষীবাহিনী সম্পর্কে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায় লন্ডন থেকে প্রকাশিত বাংলা সাপ্তাহিক ‘জনমত’-কে ২৮শে আগষ্ট দেয়া এবং ৩রা সেপ্টেম্বর ১৯৮৭ এর সংখ্যায় প্রকাশিত মেজর জেনারেল (অবঃ) কেএম শফিউল্লাহর সাক্ষাৎকার থেকে:-

প্রশ্ন: আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সম্পর্ক নাকি ততটা ভালো ছিল না। কথাটা কি সত্য বলে আপনি মনে করেন?

উত্তর: আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যক্তিগতভাবে আমার উপর আস্থা ছিল। কিন্তু পুরো সামরিক বাহিনীর উপর তাদের আস্থা ছিল কিনা তাতে সন্দেহ আছে।

প্রশ্ন: স্বাধীনতার পর আপনাকে কেন চীফ অফ স্টাফ নিযুক্ত করা হল?

উত্তর: এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। ওসমানী সাহেবের কোন সিদ্ধান্ত নয়।

প্রশ্নঃ রক্ষীবাহিনী গঠন করার আগে আওয়ামী লীগ সরকার এ ব্যাপারে কি আপনার সঙ্গে কোন আলাপ-আলোচনা করেছিল?

উত্তর: না। তবে গঠন করার পর আমাকে বলা হয়েছিল রক্ষীবাহিনী গঠন করা হয়েছে পুলিশ বাহিনীর সহযোগী শক্তি হিসাবে। তবে লোকমুখে আমি শুনেছি যে, রক্ষীবাহিনী গঠন করা হচ্ছে আর্মড ফোর্সের জায়গা পূরণের জন্য।

প্রশ্ন: সামরিক বাহিনীর সাথে রক্ষীবাহিনীর সম্পর্ক কেমন ছিল?

উত্তর: সম্পর্ক ভালো ছিল না। তার কতগুলো কারণ ছিল। তখন গুজব ছড়িয়েছিল যে, রক্ষীবাহিনীকে আর্মির জায়গায় বসানো হবে। নতুন বাহিনী হিসাবে রক্ষীবাহিনীকে তখন সবকিছুই নতুন জিনিষপত্র দিয়ে সাজানো হচ্ছিল। এদিকে আর্মি দেখছে তাদের সেই পুরাতন অবস্থা। এগুলো দেখে আর্মড ফোর্সের অনেকের মনে আঘাত লাগে। যার ফলে সম্পর্কটা খারাপ রূপ নেয়। তবে এ ব্যাপারে সরকার একটা ভুল করেছিলেন, তা হল রক্ষীবাহিনীকে “power of arrest and search দেওয়া। এতে সামরিক বাহিনীর অনেকেই ক্ষুব্ধ এবং চিন্তিত হন। শুধু তাই নয়; রক্ষীবাহিনী এই সময় সেনা বাহিনীর অনেক অফিসারকে লাঞ্ছনা পর্যন্ত করে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল রক্ষীবাহিনীর ক্ষমতা সেনা বাহিনীর চেয়েও বেশি।

প্রশ্ন: শেখ মুজিবর রহমান সামরিক বাহিনীর উন্নতির পক্ষে ছিলেন না, এ কথা কি সত্য?

উত্তর: হ্যাঁ। আমি বলবো একথা সত্য।

প্রশ্ন: গাজী গোলাম মোস্তফার সাথে লেডিস ক্লাবে মেজর ডালিমের অপ্রীতিকর ঘটনার পর সেনা বাহিনীর চীফ অফ স্টাফ হিসাবে কি কোন কিছু করার চেষ্টা করেছিলেন?

উত্তর: যখন গোলমালের খবর আমি জানতে পারি তখন ডালিমের পক্ষ হয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে যাই এর একটা বিচারের জন্য। বঙ্গবন্ধু আমার উপর রেগে গেলেন। তখন আমি বললাম, ‘বঙ্গবন্ধু আমি যদি আমার অফিসারদের জন্য না বলি তাহলে কে বলবে? গাজী গোলাম মোস্তফার এই ঘটনা আপনি তদন্ত করে দেখুন। আপনি যদি এ ব্যাপারে সাহায্য চান তাহলে আমি আপনাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত আছি। যেহেতু ওরা গাজীর বিরুদ্ধে এবং আমিও তাদের পক্ষে, তাই গাজীর বিরুদ্ধেই বলেছি। তাই তিনি খুব খুশী হননি। তিনি শুধু বললেন, শফিউল্লাহ, আপনি জানেন কি যে আপনি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলছেন? (ইংরেজি ভাষায়) আমি বললাম, ‘আমি জানি স্যার। আমি আমার জন্য কথা বলছি না; আমি কথা বলছি আপনার জন্য স্যার। মানুষ আপনাকে সত্য বলেনি। ঐ সময় জিয়া ও শাফায়াত জামিলও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

প্রশ্নঃ তারপর কি হল?

উত্তর: তারপর আমরা ওখান থেকে কোন বিচার না পেয়ে মনঃক্ষুন্ন হয়ে চলে আসি। পরে দেখা গেল সরকার মেজর ডালিমকে সেনা বাহিনী থেকে বরখাস্ত করলেন।

১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজুদ্দিন আহমদ ছিলেন সরাসরিভাবে ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের ছত্রছায়ায়। যুদ্ধের পরপরই চট্টগ্রাম বন্দরে পাক বাহিনীর পাতা মাইন অপসারন এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত ডুবে যাওয়া জাহাজ উদ্ধারের উছিলায় সোভিয়েত নৌ বাহিনী এবং ভারতীয় নৌ বাহিনীর মিলিত একটি বহর চট্টগ্রামে আসে। তারা বন্দরের একটা বিশাল এলাকা নিজেদের আয়ত্ত্বে নিয়ে সেই এলাকাকে ‘নিষিদ্ধ এলাকা’ ঘোষণা করে। বাংলাদেশ সেনা বাহিনী কিংবা নৌ বাহিনীর সদস্যরাও ঐ এলাকায় প্রবেশ করতে পারত না। নৌ বহরটি দীর্ঘ দুই বৎসরকাল সেখানে অবস্থান করে। শুধুমাত্র মাইন এবং ডুবে থাকা জাহাজগুলো উদ্ধার করা ছাড়াও তারা সন্দেহমূলক অনেক প্রকার জরিপ পরিচালনা করে উপকূল এবং সমুদ্রসীমার সব এলাকায়। তাদের এই দীর্ঘ সময় অবস্থান এবং সন্দেহমূলক পরীক্ষা-নিরীক্ষা সবকিছুই সম্ভব হয়েছিল শেখ মুজিবের অনুমতিক্রমে। সোভিয়েত-ভারতের প্রতি আওয়ামী লীগ সরকারের নতজানু নীতির একটি প্রকট উদাহরণ সোভিয়েত-ভারত নৌ বহরের চট্টগ্রামে এই ধরণের সন্দেহমূলক দীর্ঘকালীন উপস্থিতি। পরবর্তিকালে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, সোভিয়েত-ভারত নৌ বহর দীর্ঘ সময় চট্টগ্রামে অবস্থান করে সমগ্র উপকূলাঞ্চল এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ২০০ মাইল ইকোনমিক জোনে উদীয়মান বিশাল ভূখন্ড, তেল-গ্যাস এবং অন্যান্য মেরিন সম্পদ; সোভিয়েত এবং ভারতীয় নৌ বাহিনীর ব্যবহারের জন্য নৌঘাটির উপযুক্ত স্থান নির্নয় প্রভৃতি বিষয়েই গোপন জরিপের কাজ সম্পন্ন করেছিল তারা নিজেদের স্বার্থে: বাংলাদেশ সরকারকে উপেক্ষা করে। এসমস্ত খবর জানার পরও আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে কোন প্রতিবাদ করা সম্ভব হয়নি। টু শব্দটি পর্যন্ত করার ক্ষমতা ছিল না তাদের তথাকথিত মৈত্রীচুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে।

২৫-২৬শে মার্চ এর কালরাত্রি এবং আওয়ামী লীগের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি এবং ইন্দিরা গান্ধীর মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে মেজর রফিকুল ইসলাম তার বই ‘বাংলাদেশ। সামরিক শাসন ও গণতন্ত্রের সঙ্কট’-এ লিখেছেন, “পাক সামরিক জান্তার ২৫-২৬শে মার্চের হামলার পর একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করার কোন পূর্ব পরিকল্পনা এবং পূর্ব প্রস্তুতি না থাকায় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ জনগণকে কামানের গোলার মুখে ফেলে রেখে কোলকাতায় পাড়ি জমালেন। অখন্ড ভারতের স্বপ্নদ্রষ্টা পন্ডিত নেহেরুর সুযোগ্য কন্যা এবং উত্তরাধিকারিনী মিসেস গান্ধী এমন একটা মহেন্দ্রক্ষণকে যথাসময়েই কাজে লাগালেন। এ সময়ে দক্ষিন এশিয়ায় দিল্লীর পয়লা নম্বরের প্রতিদ্বন্ধী পাকিস্তানকে দ্বি-খন্ডিত করে দুর্বল করার পরিকল্পনা ছাড়াও ইন্দিরা সরকারের আরেকটি মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিম বাংলাসহ ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বামপন্থীদের (মার্কসবাদী/লেনিনবাদী) দ্বারা পরিচালিত বিকাশমান গণযুদ্ধকে শেষ করে নিঃক্রিয় করে দেওয়া। ইন্দিরা গান্ধী একই সাথে এ দু’টো কাজেই সফলকাম হন।

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের পর একদিন শেখ কামাল এবং শেখ রেহানা সত্যিই এল আমাদের মালিবাগের বাসায় বিয়ের নিমন্ত্রণ জানাতে। দুই ভাইয়ের একই সাথে বিয়ে। শেখ জামাল ইতিমধ্যে যুগোস্লাভিয়ায় গিয়েছিল সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে কিন্তু ওখানকার পরিবেশ ভালো না লাগায় পরে কিছুদিন স্যান্ডহার্টসে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে কমিশন্ড অফিসার হিসাবে যোগ দিয়েছে জেনারেল শফিউল্লাহর নিজস্ব ইউনিট ২য় ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে কিছুটা নিয়ম বর্হিঃভুতভাবেই। বিয়ে হয়েছিল নতুন গণভবনে। বিশাল আয়োজন। অগুনিত অতিথির ভীড়। মনে হচ্ছিল পুরো ঢাকা শহরটাই এসে উপস্থিত হয়েছে বিয়েতে। বর্নাঢ্য জাকজমক পরিবেশে বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। বিয়ের মন্ডপে কামাল-জামাল দুই ভাই সোনার মুকুট মাথায় দিয়ে বর সেজে বসেছিল। বিয়ের পরদিন প্রায় সবগুলো দৈনিক পত্রিকায় বড় করে ছাপানো হল প্রধানমন্ত্রীর দুই ছেলের সোনার মুকুট মাথায় পড়ে বিয়ের খবর। একই পাতায় ছাপানো হয়েছিল দুর্ভিক্ষপীড়িত, অনাহারক্লিষ্ট, হাড্ডিসার মুমুর্ষ মানুষ নামি কঙ্কালের ছবি এবং দুর্ভিক্ষের খবর। ১৯৭২ সালে কোন এক বিয়ের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, “কবে যে বাংলাদেশের মেয়েরা স্বর্নালঙ্কার বাদ দিয়ে বেলী ফুলের মালা পড়ে বিয়ে করবে।” তার এই খায়েশটাও বেশ ফলাও করে বেরিয়েছিল খবরের কাগজগুলোতে। কিন্তু রাজনীতিবিদদের কথা আর কাজের মধ্যে কত তফাৎ। বিয়ের ব্যাপারটা হয়তো বা ছোট কিন্তু এ বিষয়টি বেশ আলোচিত হয়েছিল সব মহলেই।

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন থাকাকালীন অবস্থায় রিলিফ সামগ্রী নিয়ে দুর্নীতির বর্ণনা দিতে গিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ১৩ই আগষ্ট ১৯৯২ সালে সংসদে তার বক্তৃতায় বলেছিলেন, “আওয়ামী লীগ আমলে রিলিফ চুরি এমন পর্যায়ে হয়েছিল যে, রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবকেও আক্ষেপ করে বলতে হয়েছে, ‘আমার কম্বল গেল কোথায়?’ (বিচিত্রা ২১শে আগষ্ট ১৯৯২) তার এ বক্তব্য রাখার সময় সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন কিন্তু তার পক্ষে খালেদা জিয়ার ঐ বক্তব্যের কোন প্রতিবাদ করা সম্ভব হয়নি।

মুক্তিযোদ্ধাদের প্রসঙ্গে জনাব বদরুদ্দিন আহমেদ তার বই ‘স্বাধীনতার নেপথ্য কাহিনী’-তে লিখেছেন, “মুক্তি বাহিনীর তরুণরা সারাদেশের মানুষের মন জয় করেছিল। তাদের আত্মত্যাগ ইতিহাস হয়ে আছে। তাদের দেশাত্মবোধ ভাস্বর হয়ে থাকবে। কেউ বলতে পারবে না মুক্তি বাহিনীর ছেলেরা লুট করেছে; ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধার করার জন্য মানুষকে হত্যা করেছে; কোন নারী অপমানিত হয়েছে তাদের হাতে। মুক্তিযোদ্ধাদের সেই ভাবমুর্তি নষ্ট করার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলেন যুব নেতারা। নিজেদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য অদ্ভুত খেয়ালে দেশটাকে যে তারা কোথায় নামিয়ে দিলেন সে কথা একবারও স্মরন হল না তাদের। রেডক্রস চেয়ারম্যান গাজী গোলাম মোস্তফার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করলেন শেখ মনি, তোফায়েল, রাজ্জাক। গাজী শেখ মুজিবের অত্যন্ত প্রিয় এবং তার পরিবারের একান্ত আস্থাভাজন ব্যক্তি হিসাবে সুপরিচিত ছিলেন। শুরু হল লুটের তান্ডব। রিলিফের মাল, অবাঙ্গালীদের দোকান, গোডাউন, বাড়ি-ঘর সব লুট করা হল গাজী ও তরুণ নেতাদের নির্দেশে সারা দেশময় দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ল লুটতোরাজ। ‘সিক্সটিনথ্ ডিভিশন’ ও মুজিব বাহিনীর সদস্যরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল এই প্রকাশ্য লুটপাটে। এই লুটপাটের তান্ডব বন্ধ করার কোন পদক্ষেপই নিলেন না শেখ মুজিব।

সরকারি দল ও তাদের পেটোয়া বাহিনীর নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলো তাদের সাধ্যমত প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। সর্বহারা পার্টি এবং জাসদের কর্মীরাই সরকার বিরোধিতায় মারাত্মকভাবে তৎপর। অন্যান্য বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো এবং প্রগতিশীল সংগঠনগুলো তাদের সাধ্য ও সামর্থ অনুযায়ী সরকারের নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়ছে। জনগণ সাধারণভাবে আওয়ামী ঐক্যজোটের বিরুদ্ধে। ঐক্যজোটের স্বৈরাচারী নির্যাতনে জীবন ও জীবিকার তাগিদে সবাই দিশেহারা। জাসদ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, লেনিনবাদী কম্যুনিষ্ট পার্টি, সর্বহারা পার্টি, জাতীয় লীগ ইত্যাদি দলগুলো নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এবং তাদের গোপন সংগঠনগুলোর মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে লড়ছে। তাদের মধ্যে সরকার বিরোধিতার ব্যাপারে কয়েকটি বিষয়ে ঐক্যমতও রয়েছে। জনগণও আজ পিছিয়ে নেই। তারাও আজ আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। কিন্তু এরপরও কোন একটি দলের পক্ষেই পর্যাপ্ত পরিমাণের শক্তি এবং প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব হচ্ছে না সরকারি নিষ্পেষণের কারণে। ফলে জনগণ কোন বিশেষ রাজনৈতিক দলের পেছনে দাড়াতে ভরসা পাচ্ছে না। তারা এটাও লক্ষ্য করছে যে, বিরোধী দলগুলো মোটামুটিভাবে সরকার বিরোধী একই রকমের বক্তব্য রাখছে; একইভাবে সরকারের বিরোধিতা করছে কিন্তু তারা ঐক্যবদ্ধভাবে সরকার বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছে না। দলগুলোর মধ্যে তেমন কোন মৌলিক পার্থক্য না থাকায় এবং তাদের বক্তব্য এবং মতামতের মধ্যে একটা মৌলিক সাদৃশ্য দেখতে পাওয়ায় তারা চাইছিল সব বিরোধী দল এবং সংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধ হোক। এ ব্যাপারে কিছু নির্দলীয়, রাজনৈতিকভাবে সচেতন, দেশপ্রেমিক ব্যক্তি নিজেরা উদ্যোগ নিয়েছিল ঐধরণের একটা ঐক্য প্রচেষ্টার। লেখকেরও এই ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা ছিল। বিরোধী দলগুলোর কোনটাই সরকারের নির্যাতন এবং দমন নীতির মুখে এককভাবে দাড়াতে পারবে না; এ ব্যাপারে কারো কোন দ্বিমত ছিল না। গণআন্দোলন এবং সরকার বিরোধী সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে যাবে পর্যায়ক্রমে; এ ব্যাপারেও ঐক্যমত ছিল। এই দু’টো মূল বিষয়ই ছিল ঐক্য প্রচেষ্টার ভিত্তি। বর্তমান পরিস্থিতিতে এবং আগামী দিনগুলোতে ঐক্যবদ্ধ হতে না পারলে কারো পক্ষেই শক্তি বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে না বরং দলগুলোর বিলুপ্তি ঘটারই সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে; এ বিষয়টিও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল। তাছাড়া সরকার যেভাবে দেশে প্রকাশ্য রাজনীতির পরিধি ক্রমান্বয়ে সঙ্কুচিত করে আনছে তাতে করে অচিরেই আগামীতে দেশে একদলীয় শাসনই প্রতিষ্ঠিত হবে। সেক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নভাবে সরকার বিরোধী কিছু করতে গেলে তাতে শক্তিক্ষয়ই ঘটবে কিন্তু তাতে কোন লাভ হবে না। গোপনে বৈঠকের পর বৈঠক চললো। আলোচনাকালে বোঝা গেল ঐক্যের পক্ষে যারা; তারা শীর্ষ নেতাদের জন্য তেমনভাবে তাদের মতামতও প্রকাশ করতে পারছিলেন না। সারকথা, বুঝতে পারা যাচ্ছিল ঐক্যের পথে মূল বাধা নেতারা। আবিষ্কার করতে পারলাম এর কারণও রয়েছে অনেক:- নেতৃত্বের কোন্দল, অতীতের তিক্ততা, অবিশ্বাস, নেতাদের বিভিন্ন দুর্বলতা এবং নীতিগত ভুলের জন্য অতীতের ব্যর্থতা। এসব জটিল সমস্যাগুলোর উর্ধ্বে উঠার মত মানসিকতা নেতাদের মাঝে নেই। তার উপর ঐক্যের ব্যাপারে সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা দিল ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হলে নেতৃত্বের কোন পদে কে থাকবেন: সেই প্রশ্নটি। নেতাদের সবাই যার যার হাতে সাড়ে তিন হাত। সবাই নিজেকে সবচেয়ে উপযুক্ত বলে মনে করছেন। এ ধরণের মনোভাব এবং পরিস্থিতিতে কোন ঐক্য গড়ে তোলা অসম্ভবই নয় অবাস্ত বও বটে। তাই আমরা সেই উদ্যোগ থেকে সরে দাড়াব ভেবেছিলাম এক সময়। কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত হল ভেঙ্গে পরলে চলবে না; ধৈর্য্য ধরে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। সব নেতাদের মধ্যে পারষ্পরিক বিভেদ থাকলেও তাদের প্রত্যেকেই আমাদের আন্ত রিকতার তারিফ করেছিলেন। পরিশেষে আমাদের সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে গেল। ইতিমধ্যে একদিন কর্নেল আকবর এসে বললেন যে, এদের নিয়ে কোন ঐক্য গড়ে তোলা কিছুতেই সম্ভব নয় বলেই তিনি, কাজী জাফর, মেনন এবং রনো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করার। এই দলে আমাকে একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে যোগদানের প্রস্তাব দিলেন তিনি। জবাবে আমি বলেছিলাম, “এত তাড়াতাড়ি হতাশ হলেতো চলবে না; ঐক্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। যেখানে পুরনো দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হতে না পারলে তাদের অস্তিত্বই বজিয়ে রাখতে পারবে না বলে মনে করা হচ্ছে সেখানে আর একটি নতুন দল করে লাভটা কি হবে? এরপরও আপনারা দল করতে চান ভালো কথা; তবে আমার জন্য এই মুহূর্তে নির্দলীয় থাকাটাই উচিত হবে বলে মনে করি। আপনাদের দলে যোগ না দিলেও সময়মত আমরা সবাই একত্রিত হব কোন বৃহত্তর স্বার্থে; সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।” এর অল্প কয়েকদিন পরেই United People’s Party (UPP) আত্মপ্রকাশ করে। কর্নেল আকবর সেই পার্টিতে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে যোগদান করেন। এরপরও আমাদের যোগাযোগ অবিচ্ছিন্ন থাকে।

১৯৭৪ সালের শেষের দিকে আমার ছোট ভাই স্বপনের বিয়ে ঠিক হল আমারই ফুপাতো বোন গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামালুদ্দিনের কন্যা- মুন্নির সাথে। এয়ারফোর্স মেসে রিসেন্সনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেইখানে এসপি মাহবুব এক ফাঁকে আমাকে একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলল,

— ডালিম বন্ধু হিসাবে একটা কথা বলছি কিছু মনে করিস না। ওর কথার ধরণ দেখে বললাম,

—ভনিতা ছেড়ে আসল ব্যাপারটা কি বলে ফেলতো।

–দেখ, আমি চাইনা তোর কোন বিপদ হোক। বন্ধু হিসাবে তোকে সাবধান হতে অনুরোধ করছি। Please be careful. কিছুদিনের মধ্যেই সিরাজ সিকদার ধরা পড়বে। This is certain. But I don’t care about it. what is bothering me is that during interrogation of one of his close associate your name has also come up. close comrade এর নোটবুকে তোর নাম পাওয়া গেছে।

–কারো নোটবুকে আমার নাম পাওয়া গেলে আমি কি করতে পারি? প্রশ্ন করলাম আমি।

— Well you are matured enough. আমি বলছি please be very very careful about your movements and be causcious about the people you meet that is what is needed. I am pretty serious, do you understand? আমাদের দু’জনকে একসাথে দেখতে পেয়ে একজন বেয়ারা এসে জানাল খাবার দেয়া হয়েছে। দু’জনেই খাবারের টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলাম। খাচ্ছিলাম আর মাহবুবের কথাগুলোর বিষয়ে ভাবছিলাম। যতটুকু সম্ভব স্পষ্ট ঈঙ্গিত দিয়ে দিয়েছে মাহবুব। আরো সতর্কভাবে চলাফেরা করতে হবে আমাকে। সরকারের বিশেষ মহলের সুনজরে পরে গেছি। অতএব সাবধান। খুব সাবধান হতে হবে আমাকে। খুব শীঘ্রই ধরা পড়বে সিরাজ সিকদার; এ কথাটা এত জোর দিয়ে কি করে বলতে পারলো মাহবুব? তবে সরকার নিশ্চয়ই কোন ফাঁদ পেতেছে; যে ফাঁদ বুঝতে না পেরে সিরাজ সিকদার ধরা পড়বে। নিশ্চয়ই তাই। তা না হলে মাহবুবের মত লোক এত দৃঢ়তার সাথে কথাটা বলতো না। সংবাদটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সংশ্লিষ্ট মহলে পৌঁছে দিতে হবে। সাবধানের মার নেই। পরদিনই খবরটা জায়গামত পৌঁছে দিয়ে সাবধান করে দেয়া হয়েছিল। জবাব পাওয়া গিয়েছিল তেমন কোন আশঙ্কার কারণ নেই।

মতিঝিল বানিজ্যিক এলাকায় টয়েনবি সার্কুলার রোডের উপর আমাদের SANS International এর অফিস। ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয়ে নিত্য নানা ধরণের লোক আসা-যাওয়া করছে। বিভিন্ন ধরণের লোকজন আসতো আমাদের অফিসে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরাও আসতো জনতার স্রোতে মিশে। সে অবস্থায় কোন রাজনৈতিক ব্যক্তির নোটবুকে আমার নাম পাওয়াটা বিচিত্র কিছু নয়। কিন্তু যেটা ভাবনার বিষয় সেটা হল, সর্বহারা পার্টির গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যক্তির নোটবুকে আমার নাম পাওয়া গেছে; সেটাই আশঙ্কার বিষয়। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সাথেও আমার যোগাযোগ রয়েছে সে বিষয়ে কিন্তু মাহবুব কিছুই বলল না। তবে কি বুঝে নিতে হবে সর্বহারা দলের সদস্যদের সাথে আমিও সরকারের priority target-তে পরিণত হয়েছি। বিষয়টি নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা হল। সবাই মত প্রকাশ করল মাহবুবের ঈঙ্গিতকে হালকাভাবে দেখা ঠিক হবে না। উপযুক্ত নিরাপত্তার সাথেই আমাকে চলাফেরা করতে হবে। তবে জীবনের স্বাভাবিকতাও বজিয়ে রাখতে হবে। যেকোন অস্বাভাবিক আচরণ সরকারি মহলকে আরো সন্দিহান করে তুলবে। ইতিমধ্যে পার্টির অর্ন্তদ্বন্দ্ব ও যুব নেতাদের প্রভাবে শেখ মুজিব বিদেশ সফর থেকে দেশে ফিরে জনাব তাজুদ্দিনকে তার মন্ত্রীসভা থেকে বাদ দিয়ে দিলেন। জনাব তাজুদ্দিনের নীতি এবং রাজনৈতিক কার্যক্রম সমর্থন করতে পারিনি আমরা সংগ্রামকালে; কিন্তু ব্যক্তি হিসাবে জনাব তাজুদ্দিনের অনেক চারিত্রিকগুন ছিল যার জন্য তাকে শ্রদ্ধা করতাম আমরা। তার ‘পদত্যাগের’ খবরটা পেয়ে সেই সন্ধ্যায়ই গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম তার মিন্টো রোডের সরকারি বাসভবনে। তিনি বাড়ি ছেড়ে দেবার জন্য গোছগাছ করছিলেন। বাড়ির লনে বসেই আলাপ হল। আলাপ শেষে বেরিয়ে আসছিলাম ঠিক তখন তিনি হঠাৎ করে জানতে চাইলেন, ভবিষ্যতে যোগাযোগ করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে আমি তাঁর সাথে দেখা করব কিনা? জবাবে বলেছিলাম, আমার তরফ থেকে কোন বাধা নেই। ঠিক হল যোগাযোগ হবে গোপনে।

সারিয়াকান্দী এবং ধুনটেতে তখন আমাদের প্রজেক্টের কাজ চলছে। একদিন আমার উপর দায়িত্ব পড়ল কিছু মেশিনপত্র নিয়ে প্রজেক্ট পরিদর্শনে যেতে হবে। স্বপন ব্যবসার কাজে দেশের বাইরে; নূরও বিশেষ একটা কাজে ঢাকাতেই আটকে পড়েছে; তাই বাধ্য হয়েই আমাকে ঐ দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। ট্রাকে মাল ভর্তি করে রওনা হলাম। আমি নিজের গাড়িতেই যাব কারণ আমাকে তাড়াতাড়ি আবার ঢাকায় ফিরতে হবে অন্য আরেকটি কাজে। আরিচা ঘাটে পৌঁছে দেখি ফেরি বিভ্রাট। নগরবাড়ি ঘাটে পৌঁছালাম বেশ রাত করে। রাতে ড্রাইভ করা সেই সময় ছিল বিপদজনক। তাই ঠিক করলাম ঘাটেই রাতটা কাটিয়ে ভোরে রওনা দেব গন্তব্যস্থলের উদ্দেশ্যে। প্রায়ই উত্তর এবং পশ্চিমাঞ্চলে যাওয়া-আসা করতে হয় নগরবাড়ি ঘাট দিয়ে। ঘাটের ছাপড়া বেড়ার একটা রেষ্টুরেন্ট বিশেষ পরিচিত। সবসময় এই রেষ্টুরেন্টেই খাওয়া-দাওয়া করে থাকি আমরা যাত্রাকালে। সেই সুবাদে মালিক হাজী সাহেবের সাথে বেশ হৃদ্যতা হয়ে গেছে। আমাদের সবসময় বিশেষ খাতির-যত্ন করে পছন্দমাফিক টাটকা মাছ রেধে খাওয়ান হাজী সাহেব। হাজী সাহেবকে সমস্যাটা বোঝাতে বললাম, “হাজী সাহেব রাতটাতো এখানেই কাটাতে হয় আজ।” হাসিমুখে হাজী সাহেব জবাব দিলেন, “কোন অসুবিধা নাই স্যার। চকি একটা পাইতা দিমু; বিছানাপত্র বাসা থাইকা আইনা দিমু; মশারীও একটা লাগাইয়া দিমু।” রাতের খাবারের পর বাইরে বেরিয়ে দেখি আমার ট্রাক ড্রাইভার এবং অন্য সবাই টুয়েন্টিনাইন খেলছে ট্রাকের পাশেই। ঘুম আসছিল না; ভাবলাম ওদের সাথে কিছুক্ষণ তাসই খেলা যাক। অল্প সময়েই খেলা জমে উঠল। খেলা ভীষণ জমেছে; কখন মধ্যরাত্রি পার হয়ে গেছে টেরও পাইনি। হঠাৎ করে ষ্টেনগানের ব্রাশ ফায়ারের শব্দ শুনতে পেলাম কাছেই। নিরাপত্তার জন্য সবাইকে ট্রাকের নিচে শুয়ে পড়তে বলে নিজেও কাভার নিলাম। ট্রাকের নিচে শোয়া অবস্থা থেকে দেখলাম হাজী সাহেবের রেষ্টুরেন্টকে টার্গেট করেই দু’জন লোক একনাগাড়ে গুলি ছুড়ে চলেছে। পাশে দাড়িয়ে আছে একটা জিপ। মিনিট খানেক গুলিবর্ষণ করে লোক দু’টো জিপে উঠার পর জিপটা উত্তর দিকে চলে গেল। হাজী সাহেবের বাসা দোকানের কাছেই। গোলাগুলির আওয়াজ থামতেই তিনি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে নিয়ে। আমরাও বেরিয়ে এলাম ট্রাকের নিচ থেকে। আমাকে অক্ষত অবস্থায় দেখতে পেয়ে হাজী সাহেব দৌড়ে এনে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বেচারা নিজেকে সামলাতে না পেরে বাচ্চাদের মত কাঁদছিলেন আর বলছিলেন, “আল্লাহ্ মেহেরবান, শুকুর আলহামদুলিল্লাহ্।” সত্যিই আল্লাহ্ মেহেরবান। অন্যরা বুঝতে না পারলেও আমি আর হাজী সাহেব ঠিকই বুঝতে পেরেছিলাম কি উদ্দেশ্যে গুলি ছোড়া হয়েছিল। পরদিন অতি প্রত্যুষে ট্রাক ড্রাইভার ও অন্যদের গন্তব্যস্থানে চলে যাবার নির্দেশ দিয়ে আমি ঢাকায় ফিরে এলাম। এই ঘটনার ব্যাপারে বিশেষ ঘনিষ্ঠমহল ছাড়া অন্য কারো সাথেই আলাপ করলাম না। এরপর থেকে নেহায়েত প্রয়োজন ছাড়া আমি ঢাকার বাইরে তেমন একটা যেতাম না। বাইরের কাজ দেখাশুনার দায়িত্ব নূর ও স্বপনকেই নিতে হয়।

একদিন অফিসে বসে আছি হঠাৎ আমার চাচা শ্বশুড় জনাব সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবি-লেখক-সাংবাদিক এবং পাকিস্তান আমলে দৈনিক পাকিস্তান বর্তমানে বাংলাদেশ টুডের মালিক) এসে হাজির। অপ্রত্যাশিতভাবে তাকে দেখে স্বসম্ভ্রমে উঠে দাড়িয়ে তাকে বসতে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

—কাক্কু, আপনি হঠাৎ কি মনে করে? খবর দিলেইতো পারতেন আমি নিজে গিয়ে দেখা করে আসতাম।

—বিশেষ প্রয়োজনে এসেছি। তাজুদ্দিন তোমার সাথে জরুরীভাবে দেখা করতে চায়। সম্পর্কে কাক্কু এবং তাজুদ্দিন সাহেব ভায়রা ভাই।

—কোথায়? জানতে চাইলাম।

—তাঁতিবাজারে।

—লাঞ্চের পর আগামীকাল আমি আর নূর আসব। তিনি চলে গেলেন। পরদিন সময়মত গিয়ে পৌঁছতেই দেখি জনাব তাজুদ্দিন অপেক্ষা করছেন। আমরা দুইজনই তার বিশেষ পরিচিত। দোতালার একটি নিভৃত কক্ষে আমাদের বৈঠক শুরু হল কুশলাদি বিনিময়ের পর

—দেশের অবস্থা সম্পর্কে কি মনে করছেন? প্রশ্ন করলেন তিনি।

—যে দেশ বানিয়েছেন তার সর্ম্পকে ভাবনার কি কোন অন্ত আছে?

—দেশতো আপনারাই স্বাধীন করেছেন।

—তাই কি? আমরাতো এভাবে দেশ স্বাধীন করতে চাইনি সেটা আপনার চেয়ে বেশি আর কারো জানার কথা নয়। চুপ করে ছিলেন তিনি। আমি বললাম,

—তাজুদ্দিন সাহেব ‘৭১ এর আমাদের যুক্তিগুলোর সত্যতাই কি ক্রমান্বয়ে এই বাংলাদেশে সত্যে পরিণত হচ্ছে না? যাক অতীত নিয়ে আলোচনা না করে বলেন কেন ডেকে পাঠিয়েছেন? সরাসরি প্রশ্ন করলাম তাকে।

—দেশটাকে বাচাতে হবে।

—অবশ্যই। তবে কি করে?

—জনগণের মুক্তি আনা সম্ভব সমাজতন্ত্রের মাধ্যমেই।

—এ বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে। সারাজীবন আপনারা বুর্জুয়া রাজনীতি করে এসে এখন সমাজতন্ত্র করবেন সেটা কি করে সম্ভব? আর জনগণই তা বিশ্বাস করবে কেন? আওয়ামী লীগতো একটা বুয়া সংগঠন। শেখ মুজিব কেন, কেউই এ দলের মাধ্যমে প্রকৃত সমাজতন্ত্র স্থাপন করতে পারবে না। আপনিও এ সত্য এতদিনে নিশ্চয়ই অনুধাবন করেছেন। আর সবচেয়ে বড় কথা হল বাংলাদেশের জনগণের সম্মুখে সমাজতন্ত্রের নামে আপনারা যে বিভীষিকা তুলে ধরেছেন তাতে আগামী ৫০ বৎসরেও সমাজতন্ত্রের কথা শুনলেই এদেশের লোক আতঁকে উঠবে। তাছাড়া গ্রামে-গঞ্জে সাধারণভাবে ঘুরে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তার আলোকে বলব আমাদের জনগণ সাম্প্রদায়ীক নয় এটা ঠিক; তবে তারা সমভাবেই ধর্মভীরু। আপনারা আপনাদের রাষ্ট্রীয় চার নীতির কোনটাই গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারেননি আপামর জনসাধারণের কাছে। বাংলাদেশ বলতে ঢাকা, চিটাগাং বোঝাচ্ছি না, বোঝাচ্ছি ৬৪ হাজার গ্রাম যেখানে বাস করে ৯৫% লোকজন। সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব এ দেশের গণমানুষের কতটুকু উপকার করবে তা জানি না তবে অল্প বিদ্যায় যতটুকু বুঝি এ দেশের লোকজনকে নজর আন্দাজ করার অবকাশ নেই। উপর থেকে তাদের উপর জোর করে কিছুই চাপিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া মানুষ রক্ত মাংসের গড়া। তার জৈবিক এবং বাচাঁর চাহিদার পাশাপাশি মনের এবং আত্মিক চাহিদাও রয়েছে। মানুষ মেশিন নয়। এ সত্য বাদ দিয়ে কিছু করলে সেটা হবে নেহায়েত ক্ষণস্থায়ী। থাক, তা আপনি বলুন আপনার রাজনৈতিক পরিকল্পনা কি? আপনি একজন সুশিক্ষিত সৎ ব্যক্তি। আপনার রাজনৈতিক দর্শনের সাথে একমত না হলেও এতটুকু আস্থা রাখতে পারেন, আমরা আপনাকে একজন ভাল মানুষ বলেই মনে করি। আর একটা কথা আপনাকে স্পষ্ট করে বলতে চাই- বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারত আমাদের জন্য যদি কিছু করে থাকে তবে সেটা তার স্বার্থেই সে করেছে। তবুও আমরা তাকে কৃতজ্ঞতা জানাব জাতি হিসাবে। কিন্তু ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন কি করে আমাদের সহায়ক শক্তি হতে পারে? সেটাতো তাদের নিজস্ব স্বার্থের পরিপন্থী। এদের প্রতি আপনি দুর্বল এ কথা সবাই জানে। এ ব্যাপারে আপনার কাছ থেকেই আপনার অভিমত আমরা জানতে চাই। আর সমাজতন্ত্রের দর্শন অনুযায়ী এটা কায়েম করা যায় শুধুমাত্র সর্বহারা দলের নেতৃত্বে। আপনার দল কোনটি সেটাও আমাদের জানা দরকার। গম্ভীরভাবে আমার বক্তব্য শুনে যাচ্ছিলেন জনাব তাজুদ্দিন। রাজনীতি নিয়ে এটাই ছিল আমাদের প্রথম বিশদ আলোচনা।

—রাজনৈতিকভাবে আপনারা সবাই কি এতটা সচেতন?

—সবাই বলতে আপনি কি বোঝাচ্ছেন সেটা জানি না, তবে সেনা বাহিনীর একটা বৃহৎ অংশ রাজনৈতিকভাবে অবশ্যই সচেতন।

—খুব খুশি হলাম জেনে। I can see some silver lining over the dark clouds. সমাজতন্ত্রের নীতিতে আমি বিশ্বাসী। তবে সমাজতন্ত্রের বাস্তবায়ন পদ্ধতি সব দেশেই সেদেশের বাস্তব পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করেই বের করতে হয়। ভারত একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ। তাদের দেশের অর্থনীতিতে সমাজতন্ত্রের যে প্রভাব রয়েছে সেটা অবশ্যই সোভিয়েত মডেলের নয়। গণতান্ত্রিক নীতিতে বিশ্বাসী দেশ ভারত নীতিগতভাবে আমাদের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে সাহায্য করেছে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বেলায়ও এ কথাই বলা চলে। সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশের মুক্তিসংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সোভিয়েত ইউনিয়ন সব রকম সাহায্য করে চলেছে। রুশ বিরোধিতার মূলে কাজ করছে সাম্প্রদায়ীকতা ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাদের এ চক্রান্ত কি দেশের জন্য কোন মঙ্গল বয়ে আনবে?

—দেখেন স্যার, আমি সে সমস্ত মানুষের মনোভাব আপনাকে জানিয়েছি যারা সাম্প্রদায়ীক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এ দু’টো শব্দ ঠিকমত উচ্চারণও করতে পারে না: বোঝাতো দূরের কথা। এ সমস্ত আলোচনাতো শহুরে তথাকথিত বুদ্ধিজীবি সমাজের মাঝেই সীমিত। তারা জনগণের ১ কিংবা ২%ও নন। আমরা মনে করি ভারত প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক দেশ নয়। গণতন্ত্রের নামাবলী গায়ে চড়িয়ে সেখানে গত ২৫বছর ধরে চলেছে এক পার্টির তথা এক পরিবারের শাসন। শ্রীমতি ইন্দীরা গান্ধী ‘অখন্ড ভারত’ নীতির বাস্তবায়নের জন্য পাকিস্তানকে দ্বি-খন্ডিত করার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেছেন। অনেকেই তাকে সমর্থন করেছেন। কিন্তু আজ কিছুতেই বাংলাদেশ একটি স্বাধীন স্বনির্ভর দেশ হিসাবে viable হয়ে উঠুক সেটা ভারতের কেন্দ্রিয় সরকার কোনমতেই সমর্থন করতে পারে না। পরিবর্তে তারা চেষ্টা করবে আমাদের অর্থনীতিকে ভারতের অর্থনীতির সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আমাদের উপর তাদের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে। মানে আমাদের অবস্থা হতে হবে ভুটান বা সিকিমের মত। এতে করে ভারতের অভ্যন্তরে কেন্দ্রিয় শোষণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অঞ্চলে যে সমস্ত জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অঙ্গার আজ জ্বলে উঠেছে তাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া যাবে যে, স্বাধীন সত্ত্বা হিসেবে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে উপমহাদেশের কোন জাতির পক্ষেই আজ স্বতন্ত্রভাবে বেঁচে থাকা সম্ভবপর নয়। ভারতের আজ্ঞাধীন হয়েই বেঁচে থাকতে হবে তাদের। বাংলাদেশকে সব ব্যাপারে তাদের উপর নির্ভরশীল করে তুলতে পারলে ঐ সমস্ত জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ভাটা পড়বে। আর আমরা যদি স্বয়ংসম্পূর্ণ জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে বিশ্বের বুকে দাড়াতে সক্ষম হই তবে সেই সমস্ত জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের অঙ্গার দাবানলে পরিণত হয়ে ভারতকে টুকর টুকর করে ফেলবে অল্প সময়ের মধ্যেই। ‘অখন্ড ভারতের’ স্বপ্ন কর্পূরের মত উড়ে যাবে। যেখানে বিভিন্ন অঞ্চলগুলো আজ ভারতীয় কেন্দ্রিয় দুঃশাসনের নিষ্পেষনে জর্জরিত সেখানে তাদের অঙ্গরাজ্যে পরিণত হলে আমাদের অবস্থা কি হবে? বরং অধুনাকালে ঔপনিবেশিক শক্তি দ্বারা তৈরি আজকের ভারত যদি সনাতন রূপ পরিগ্রহ করে তবেই আমাদের লাভ। শুধু আমাদেরই নয় এ ভূ-খন্ডের বিভিন্ন জাতিসত্ত্বারও লাভ। বহিঃশক্তির শোষণ টিকিয়ে রাখার জন্য উপমহাদেশের স্বাধীন রাজ্যগুলোকে একত্রিত করে অখন্ড ভারত সৃষ্টি করার ফলেই আজ বিকশিত হচ্ছে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলো। এই দ্বন্দ্বের অবসানের মাধ্যমেই একমাত্র সম্ভব এ অঞ্চলে সত্যিকারের স্থিতিশীলতা অর্জন করা। এর কোন বিকল্প নেই। ভারত একটি বহুজাতিক দেশ সেটাই বাস্তবতা। আমার বক্তব্য শুনে জনাব তাজুদ্দিন বললেন,

—ভবিষ্যতে এ বিষয়ে আরো আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।

তার রাজনৈতিক দল হিসাবে জাসদের প্রতি ঈঙ্গিত করলেন তিনি। জবাবে আমি বলেছিলাম,

—জাসদ অবশ্যই আজ সরকার বিরোধী সংগ্রামে একটি অগ্রণী ভূমিকায় আছে। তারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথাও বলছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ থেকে হঠাৎ করে বেরিয়ে আসা এ দল সৃষ্টিকারীরা সত্যিই কি সমাজতন্ত্রী? তাদের নেতৃত্বের প্রায় সবারই আগমন ঘটেছে বুর্জুয়া কিংবা পেটি বুর্জুয়া শ্রেণী থেকে। কতটুকু তারা নিজেদের De-class করতে সক্ষম হয়েছে সেটা ভবিষ্যতই বলতে পারবে। ঠিক এই মুহূর্তে জাসদকে একটি সর্বহারার দল হিসাবে চিহ্নিত করার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। এভাবেই সেদিনের বৈঠক শেষ হয়। ভবিষ্যতে আবার আলোচনায় বসবো ঠিক করে আমরা বেরিয়ে এসেছিলাম। তত্ত্বগত দিক থেকে জাসদের নেতৃবৃন্দেরও একটি অংশ সোভিয়েত ইউনিয়নকে একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ এবং ভারতকে একটি গণতান্ত্রিক দেশ বলে মনে করত। তাদের ধারণা অনেকটা জনাব তাজুদ্দিনের মতই। মানে রুশ এবং ভারত বাংলাদেশের গণমুক্তি এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহায়ক শক্তি। কিন্তু জাসদের সাধারণ সদস্যদের বৃহৎ অংশই ছিলেন ভারত বিরোধী। পরবর্তিকালে জাসদের অবক্ষয়ের জন্য অন্যান্য কারণের সাথে এই দ্বন্দ্বটিকেও একটি প্রধান কারণ বলে চিহ্নিত করা চলে। নেতৃবৃন্দের মধ্যেও ভারত নীতি নিয়ে দ্বিমত ছিল সেটাও আমরা জানতাম। সেদিন জাসদের সাথে জনাব তাজুদ্দিনের সম্পর্কের কথা জেনে আমাদের মনে একটি প্রশ্ন বিশেষভাবে দেখা দেয়। তবে কি জাসদ সত্যিই ভারতের ‘বি’ টিম? তাই যদি না হবে, তবে কোন যুক্তিতে জাসদ জনাব তাজুদ্দিনের নেতৃত্ব মেনে নেবে?

এ প্রশ্নের জবাব খুঁজে পেতে হবে। নারায়ণগঞ্জে কর্নেল তাহেরের ওখানে গিয়ে উপস্থিত হলাম একদিন। তার সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ করার ফাকে জেনে নেবার চেষ্টা করলাম জনাব তাজুদ্দিনের সাথে জাসদের সম্পর্ক কি? তিনি ব্যক্তিগতভাবে জানালেন যে, জনাব তাজুদ্দিনের সাথে জাসদের কোন সম্পর্ক নেই। এতে ঘটনা আরো ঘোলাটে হয়ে উঠল। হয়তো কর্নেল তাহের এ সম্পর্কে কিছুই জানেন না কিংবা জাসদের হাই কমান্ডের সাথে কোন গোপন বিশেষ মাধ্যমের সাহায্যে জনাব তাজুদ্দিন যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন যা জাসদ নেতৃবর্গের অনেকের কাছ থেকেই গোপন রাখা হয়েছে। আমাদেরই আর একজন জাসদের জনাব শাহজাহানের কাছে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল। জনাব শাহজাহানও একই জবাব দিয়েছিলেন, জাসদের সাথে জনাব তাজুদ্দিনের পার্টিগত কোন সম্পর্ক নেই।

কয়েকদিন পর জনাব তাজুদ্দিনের সাথে আমাদের দ্বিতীয় বৈঠক হয়। সে বৈঠকে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়েই আলোচনা হয়। আমি গত বৈঠকের জের টেনে বলেছিলাম,

—বাংলাদেশের তিনটি জিনিস ভারত কখনো মেনে নিতে পারবে না:-

(১) বাংলাদেশে স্বাধীন অর্থনীতি গড়ে উঠুক।

(২) বাংলাদেশে একটি ইসলামিক শাসন ব্যবস্থা কায়েম হোক।

(৩) পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা এক হয়ে একটা ভিন্ন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হোক। এ ব্যাপারে তার মতামত জানতে চাইলে জনাব তাজুদ্দিন বলেন,

—ভারত উপমহাদেশ তুলনামূলকভাবে একটা পরাশক্তি; এ সত্যকে পরিহার করলে বাংলাদেশের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে। আমাদের বেঁচে থাকার জন্যই ভারতের সাথে একটা সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক বজিয়ে চলতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ তিনি নেপালকে তুলে ধরেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,

—নেপালের সাথে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভারতের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। বহুলাংশে নেপাল অর্থনৈতিক বিষয়ে ভারতের উপর নির্ভরশীল তাই বলে নেপালের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের উপরতো ভারত হস্তক্ষেপ করেনি। জবাবে আমি বলেছিলাম,

—নেপাল একটি হিন্দু রাষ্ট্র। আমার জানামতে নেপালের আভ্যন্তরীন রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব অত্যন্ত প্রচন্ড। কিন্তু নেপাল ও বাংলাদেশ কি এক? বাংলাদেশ ১০কোটি মুসলমানের দেশ। এটাওতো একটা বাস্তব সত্য। এ জাতি সশস্ত্র সংগ্রাম করেছে পাকিস্তানের শোষকদের নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীনতা লাভ করার জন্য; দিল্লীর নিয়ন্ত্রণ মেনে নেয়ার জন্য নয়। অস্তিত্ব হবে সম্পূর্ণ এবং প্রকৃত অর্থে স্বাধীন স্বকীয়তায়। সেটাই এদেশের জনগণের আশা ও অঙ্গীকার। জনগণের এ চেতনাকে সাংগঠনিক রূপ দিতে পারলে ভারত যত বড় শক্তিধর হোক না কেন; ‘আমাদেরকে সিকিম বানাতে পারবে কি? ১০কোটি লোককে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে তুলে তাদের সংগঠিত করে যেকোন বর্হিশক্তির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে একটি দুর্ভেদ্য দূর্গে পরিণত করে গড়ে তোলা অবশ্যই সম্ভব এবং সে চেষ্টাই কি করা উচিত নয় প্রতিটি দেশপ্রেমিক সচেতন নাগরিকের?

এর জবাবে জনাব তাজুদ্দিন সাহেব কিছু বলেননি। তার সাথে দু’দিনের আলোচনায় একটা জিনিস পরিষ্কার বোঝা গেল ভারত সম্পর্কে তার একটা বিশেষ দুর্বলতা কিংবা বাধ্যবাধকতা রয়েছে যার বাইরে তিনি যেতে পারছেন না। এই দুর্বলতা কিংবা বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে তিনি কখনোই আমাদের কিছু বলেননি। পরবর্তী বৈঠকগুলোতে আমরাও তাকে আর বিব্রত করিনি ভারত সম্পর্ক উত্থাপন করে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুযোগ তৎকালীন ভারতীয় ইন্দিরা সরকার কিভাবে নিয়েছিলো এর এক চমৎকার বাস্তব বর্ণনা ভারতীয় লেখক সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কেলকাতার ইংরেজী সাপ্তাহিক ‘ফ্রন্টিয়ার’ পত্রিকা সম্পাদক সমর সেন তার লেখায় তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, “সেই ‘৭১ এর ১৬ই ডিসেম্বর বিশাল ভারতীয় সশস্ত্র সেনা বাহিনী পাকিস্তানী বাহিনীর উপর পূর্ব পাকিস্তানে বিজয় অর্জন করে এবং পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে পাকিস্তান থেকে শেখ মুজিবকে নিয়ে এসে ঢাকায় গদিতে বসিয়ে ভারতীয় সরকার নিজের ক্ষমতাকে সেখানে সুসংহত করেছিল।

জনাব তাজুদ্দিন ছাড়াও সরকারি দলের অনেক নেতা এবং কর্মীদের সাথেও যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিলাম আমরা। জনাব কামরুজ্জামান, জনাব খন্দোকার মোশতাক আহমদ, জনাব তাহের উদ্দিন ঠাকুর, জনাব মালেক উকিল, মনরঞ্জন ধর, ফনিভূষণ মজুমদার, আব্দুল মান্নান, এ আর মল্লিক, এম আর সিদ্দিকী, জনাব ফরিদ গাজী, জনাব নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, ভোলা মিঞা এরা সবাই শেখ সাহেবের দিক নির্দেশনায় হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আওয়ামী লীগের প্রবীণ ও অভিজ্ঞ নেতৃবর্গকে উপেক্ষা করে তরুণ নেতৃবৃন্দের উপর শেখ মুজিবের নির্ভরশীলতাকে তারা সরকার ও সরকারি দলের গণবিচ্ছিন্নতা ও ব্যর্থতার মূল কারণ বলে অভিহিত করেন কিন্তু তাদের এ অসন্তোষ কিংবা অভিপ্রায় সরাসরিভাবে শেখ সাহেবকে বলার মত সাহস এদের কারো ছিল না। বিশেষ করে জনাব তাজুদ্দিনকে সরিয়ে দেবার পর তারা সবাই নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হয়ে পড়েন। এদের সবাই ছিলেন গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। কিন্তু নিজেদের দুর্বলতার জন্য সর্বোপরিসরে গণতন্ত্রকে যখন খর্ব করা হচ্ছিল তখন তারা কিছুই করতে পেরে উঠেননি তরুণ নেতাদের দাপটে।

জাতি যখন মরনপন লড়াইয়ে লিপ্ত তখন পাকিস্তানীদের হাতে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পনকারী নেতাকে স্বাধীনতার স্থপতি হিসেবে বানোয়াট ভাবমুর্তি গড়ে তুলতে ভারতের ইন্দিরা সরকার কার্পণ্য করেনি। ক্ষমতা সুসংহত করার অন্যান্য প্রয়াসের সাথে তার হাতে তুলে দেয়া হয় মুজিববাদ ও বাকশালী দর্শন

যে কোন কারণেই হোক অনেককেই অবাক করে দিয়ে দেশের প্রবীণ লেখক সাংবাদিক খন্দোকার মোহাম্মদ ইলিয়াস তার ‘মুজিববাদ’ পুস্তকটিতে উদ্ভট সব কথা লিখলেন। তিনি দাবি করলেন যে, বিশ্ববিখ্যাত জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্কসের ক্যাপিটাল, মার্কস ও এঙ্গেলস লিখিত কম্যুনিষ্ট মেনিফেষ্টোর নির্যাস থেকেই নাকি মুজিববাদ নামের নবতম রাজনৈতিক দর্শন তৈরি করা হয়েছে। আদি অকৃত্রিম মার্কসবাদের আধুনিক উন্নতর সংস্করণ নাকি মুজিববাদ। তবে মুজিববাদ যে ফ্যাসিবাদী জার্মানীর হিটলারের ন্যাশনাল সোস্যালিজম তথা নাৎসী-বাদের এক নিকৃষ্ট অনুকরণ মাত্র সেটা উপরোক্ত ‘মুজিববাদ’ বইটি নাৎসী নেতা হিটলারের মেইন ক্যাম্ফ ( My struggle) শিরোনামের আত্মকথা রচনাটির সঙ্গে মিলিয়ে পাঠ করলে সুধী পাঠকদের বুঝতে আদৌ কষ্ট হবে না।

দেশপ্রেমিক বিভিন্ন মহলের ঐক্য প্রচেষ্টার ফলে ১৯৭৩ এর নির্বাচনের আগে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ৭টি রাজনৈতিক দল একত্রিত হয়ে ১৫ দফার ভিত্তিতে একটি এ্যাকশন কমিটি গঠন করে। কিন্তু নির্বাচনে সিট ভাগাভাগির প্রশ্নে এ ঐক্য ভেঙ্গে যায়। পরে ১৯৭৪ সালে মাওলানা ভাসানী ‘হুকুমতে রব্বানিয়া’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। একই সময়ে অনেক চেষ্টা ও আলোচনার ফলে ভাসানী ন্যাপ বাংলাদেশ জাতীয় লীগ (অলি আহাদ), বাংলাদেশ কম্যুনিষ্ট পার্টির (লেনিনবাদী) এবং বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক সাম্যবাদী দল মিলে ‘সর্বদলীয় ঐক্যফ্রন্ট’ গঠিত হয়। এ ফ্রন্টের প্রথম জনসভায় ৪ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়। দাবিগুলি ছিল :-

(১) সব রাজবন্দীদের মুক্তি।

(২) জীবনের শান্তি ও নিরাপত্তার পূর্ণ প্রতিষ্ঠা।

(৩) দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি রোধ এবং গ্রামে রেশন ব্যবস্থার প্রবর্তন।

(৪) অন্যায়ভাবে দখলকৃত সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা এবং ভারতের সাথে অসম চুক্তি বাতিল করা।

মাওলানা ভাসানী সরকারকে হুশিয়ার করে দিয়ে দাবি তোলেন, সাত দিনের মধ্যে এই ৪ দফা দাবি মেনে না নিলে তিনি দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তুলবেন। কিন্তু তার শারীরিক অসুস্থতা এবং নির্দিষ্ট প্রোগ্রামের অনুপস্থিতিতে দেশব্যাপী আন্দোলন তার পক্ষে গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। এরপর প্রবীণ নেতা জনাব আতাউর রহমান খান জাতীয়তাবাদী শক্তিসমূহকে একত্রিত করার লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক দল ও শক্তিসমূহের একটি জাতীয় সম্মেলন করার উদ্যোগ নেন কিন্তু সরকার কর্তৃক ২৮শে ডিসেম্বর ১৯৭৪ সালে জরুরী আইন ঘোষণা করার ফলে তার সে প্রচেষ্টা বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়নি। এভাবেই বিরোধী দলগুলো সরকার বিরোধী প্রচন্ড গণরোষের পরিপ্রেক্ষিতে ঐক্যবদ্ধ হবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। তার উপর সরকারি নির্যাতন, নিষ্পেষন, এবং সরকারি দলের বাহুবল এবং অর্থবলের দৌরাত্বে বিরোধী দলগুলোর অবস্থা অত্যন্ত সঙ্গীন হয়ে পড়ে। নেতৃত্বের দুর্বলতা, অর্ন্তদলীয় কোন্দল, সুস্পষ্ট প্রোগ্রাম এবং সঠিক দিক নির্দেশনার অভাব শুধু যে রাজনৈতিক বিরোধী দলগুলোর মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেই অন্তরায় সৃষ্টি করছিল তা নয়; জনগণও তাদের প্রতি আস্থা হারিয়ে হতাশ হয়ে নির্জীব হয়ে পড়ছিল ক্রমান্বয়ে। বামপন্থীদের ঐক্য প্রক্রিয়াও একইভাবে বাধাগ্রস্থ হচ্ছিল। এর মূলেও ছিল উল্লেখিত প্রায় একই কারণসমূহ। রাজনৈতিক শূন্যতা এবং উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে রাজনৈতিক দলগুলো যখন ক্রমশঃ দুর্বল হয়ে পড়ছিল তখন ১৯৭৪ সালে দেশের কিছু বুদ্ধিজীবি ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন ব্যক্তিবর্গের প্রচেষ্টায় গড়ে তোলা হয় ‘ Civil Liberties and Legal Aid Committee’। মৌলিক অধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার দাবিতে গঠিত হয়েছিল এই মোর্চা। বিরোধী দল ও প্রতিবাদী জনগণের উপর অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদেও সোচ্চার হয়ে উঠে এই কমিটি। জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত এই কমিটির প্রথম সভায় শিক্ষক, ছাত্র, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, লেখক, কবি, আইনজীবি, সাংবাদিক এবং সমাজের অন্যান্য পেশাজীবীদের প্রতিনিধিগণ দাবি জানান :-

(১) শাসনতন্ত্রের পরিপন্থী সমস্ত কালা-কানুন বাতিল এবং সরকার এর বিভিন্ন মহল কর্তৃক জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ অগণতান্ত্রিক ও আইন বিরোধী।

(২) জরুরী আইন এবং স্পেশাল পাওয়ার এ্যাক্ট অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।

(৩) রক্ষীবাহিনী আইন বাতিল করে অবিলম্বে তাদের নির্যাতন বন্ধ করতে হবে।

(৪) সকল রাজবন্দীদের অবিলম্বে শর্তহীনভাবে মুক্তি দিতে হবে।

(৫) সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিতে হবে এবং

(৬) যাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা এবং হুলিয়া রয়েছে সেগুলো সরকারকে অবিলম্বে তুলে নিতে হবে।

অল্পসময়েই এই কমিটির উপর নেমে আসে সরকারি শ্বেত সন্ত্রাস। উদ্যোক্তাদের অনেকেই নির্যাতিত হন সরকারের হাতে। সে সময়েই ঘটে বাংলাদেশের ইতিহাসের ন্যাক্কারজনক ঘটনাটি। বাংলাদেশের অগ্নিসন্তান সিরাজ সিকদারকে শেখ মুজিবের নির্দেশে বন্দী অবস্থায় হত্যা করা হয়। আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জনগণের মুক্তির জন্য সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে সর্বহারা পার্টি এবং জাসদ এ দু’টো বিরোধী দলই সরকারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি তৎপর হয়ে উঠে। সর্বহারা পার্টি বাংলার গ্রামাঞ্চলে তাদের সংগঠন গড়ে তুলতে সমর্থ হয়। অতি দ্রুতগতিতে দেশব্যাপী গোপন সংগঠন গড়ে তুলে সরকার মহলে ত্রাসের সঞ্চার করতে সমর্থ হয় সর্বহারা পার্টি এবং জাসদ। পার্টির গোপন সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তোলার দায়িত্বে ছিলেন কর্নেল জিয়াউদ্দিন জাসদের গণবাহিনী পরিচালিত হচ্ছিল কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে। আওয়ামী লীগ শাসনের ব্যর্থতার নজীর তখন দেশে-বিদেশে সংবাদ মাধ্যমগুলোতে বহুলভাবে প্রচারিত হচ্ছিল। লন্ডন থেকে প্রকাশিত নিউ স্টেটসম্যান পত্রিকায় ২৭শে সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ এ জনাথন ভিন্নাম্বলম্বী এক প্রতিবেদনে লেখেন, “এমন একদিন ছিল যখন শেখ মুজিব ঢাকার রাস্তায় বের হলে জনসাধারণ হাত তুলে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে মেতে উঠত। আর আজ যখন স্বীয় বাসভবন থেকে তিনি অফিসের দিকে যান তখন চতুর্দিকে থাকে পুলিশের কড়া পাহারা। পথচারীরা সজ্ঞানে তার যাতায়াত উপেক্ষা করে। জাতির পিতাও আর গাড়ির জানালা দিয়ে হাত আন্দোলিত করেন না। তার দৃষ্টি থাকে সামনের দিকে নিবদ্ধ। বাংলাদেশ আজ বিপজ্জনকভাবে অরাজকতার মুখোমুখি। লাখ লাখ লোক ক্ষুধার্ত। হাজার হাজার মানুষ আজ অনাহারে মরছে। মফস্বল এলাকার স্থানীয় কর্মচারীরা ভয় পাচ্ছে যে আগামী মাস খুব দুঃসময় হবে; ক্ষুধার্ত মানুষের ভীড়ে ঢাকায় দম বন্ধ হয়ে আসে। এখন আবার চলছে বন্যা উপদ্রুতদের ভীড়। আগত লোকজনরা এমন নোংরা অবস্থায় থাকে যার তুলনা দুনিয়ার কোথাও নাই। কোথাও বিনামূল্যে কিছু বিতরণ করা হলে শরনার্থীদের মধ্যে মারামারি লেগে যায়। বুদ্ধিজীবিরা বলেন, এই ক্ষুধার্ত জনতা ক্ষেপে গেলে তাদের রক্ষা নেই। বাংলাদেশ আজ দেউলিয়া। গত আঠারো মাসে চালের দাম ৪ গুন বেড়েছে। সরকারি কর্মচারীদের মাইনের সবটুকুই চলে যায় খাদ্যসামগ্রী কিনতে আর গরীবরা থাকে অনাহারে। কিন্তু যতই বিপদ ঘনিয়ে আসছে শেখ মুজিব ততই মনগড়া জগতে আশ্রয় নিচ্ছেন। ভাবছেন দেশের লোক এখনও তাকে ভালোবাসে। সমস্ত মুসিবতের জন্য পাকিস্তানই দায়ী আর বাইরের দুনিয়া তার সাহায্যে এখনো এগিয়ে আসবে এবং বাংলাদেশ উদ্ধার পাবে এ ধরণের ভাবনা তার নিছক দিবাস্বপ্ন। মুজিব সম্পর্কে বরাবরই সন্দেহ ছিল। নেতা হিসাবে আজো তার আকর্ষন রয়েছে। তিনি আবেগপ্রবণ বক্তা। তার অহংকার আছে, সাহস আছে। কিন্তু আজ দেশ যখন বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন তিনি দিনের অর্ধেক ভাগ আওয়ামী লীগের চাইদের সঙ্গে ঘরোয়া আলাপে কাটাচ্ছেন। যিনি বাংলাদেশের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বহু ছোট-খাটো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন: তিনি আজ আত্মম্ভরিতার মধ্যে কয়েদী হয়ে চাটুকার ও পরগাছা পরিবেষ্টিত হয়ে আছেন। বাইরের দুনিয়া বাংলাদেশের দুর্নীতির কথা ফলাও করে বলে থাকে। সমাজের নীচুতলায় যারা আছে তারা হয়তো আজ খেতে পেয়েছে কিন্তু কাল কি খাবে জানে না। এমন দেশে দুর্নীতি অপরিহার্য। তবে এমন লোকও আছে যাদের দুর্নীতিবাজ হবার কোন অযুহাত নেই। সদ্য ফুলে ফেঁপে উঠা তরুণ বাঙ্গালীরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের শরাবখানায় ভীড় জমায়। তারা বেশ ভালোই আছে। এরাই ছিল তথাকথিত ‘মুক্তিযোদ্ধা’। তাদের প্রাধান্য আজ অপরিসীম। রাজনৈতিক দালালী করে এবং ব্যবসায়ীদের পারমিট যোগাড় করে তারা আজ ধনাঢ্য জীবন যাপন করছে। সরকারি কর্মচারীদের ভয় দেখাচ্ছে। নেতাদের উপর প্রভাব বিস্তার করছে এবং প্রয়োজন হলে অস্ত্র প্রয়োগ করছে। এরাই হচ্ছে আওয়ামী লীগের বাছাই করা পোষ্য। আওয়ামী লীগের উপর তলায় যারা আছেন তারা আরো জঘণ্য। যারা দেশ মুক্ত করেছেন সেই জনসাধারণের মেরুদন্ড ভেঙ্গে তারা আজ ফুলে ফেঁপে উঠেছে। অবশ্য তাদের অসদুপায়ে অর্জিত অর্থ নিয়ে তারা আজ শুধু নিজেদের কথা ভেবেই শংকিত হয়ে উঠেছে। ভাবছে আগামীকাল তাদের কি হবে? শুনতে রূঢ় হলেও কিসিঞ্জার ঠিক কথাই বলেছেন, ‘বাংলাদেশ একটা তলাবিহীন ভিক্ষার ঝুলি।’ ত্রাসজনক পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষে বিপর্যয়ের মোকাবেলা করা অসম্ভব। আন্তর্জাতিক সমাজ বাংলাদেশের ‘পুতুল সরকার’ সম্পর্কে ধৈর্য্যহারা হয়ে পড়েছে। এই কঠোর সত্যের মুখোমুখি হয়ে রিলিফ কর্মী এবং কূটনৈতিক মিশন ও জাতিসংঘের অফিসাররা বাংলাদেশ সরকার ও সরকার দলীয় লোকজনদেরই দোষারোপ করছেন।”

লন্ডনের ডেইলি মেইল পত্রিকার ১৭ই সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ সালে জন পিনজার লেখেন, “পশ্চিম এশিয়ার এবং দুর্ভিক্ষের প্রাচীনতম বিচরণভূমি বাংলাদেশে মহা দুর্ভিক্ষের পূর্ণঃআবির্ভাব ঘটেছে। এত ব্যাপক দুর্ভিক্ষ সম্ভবতঃ অনেককাল দেখা যায়নি। মৃতের কোন নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। এক হিসাব মতে গত জুলাই মাসের বন্যায় সমস্ত ফসল এবং পরবর্তী মৌসুমে বীজ ধান বিনষ্ট হবার পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে এবং পার্শ্ববর্তী ভারতের পশ্চিমবঙ্গে কয়েক লাখ লোক মারা গেছে। ঢাকার ‘সেফ দি চিলড্রেন ফান্ড’ এর কো-অর্ডিনেটর মিঃ মাইকেল প্রোসার বলেন, “আমাদের চরম আশংকাই ফলে গেছে। আমরা এমন একটা বিপর্যয়ের সূচনাতে আছি যা আমি এই উপমহাদেশে গত ৩১ বছর দেখিনি। বসন্তের আগে নতুন ফসল উঠবে না। বাইরের দুনিয়া থেকে যদি বাংলাদেশ প্রতি সপ্তাহে ১লাখ টন খাদ্যশস্য ও তদসঙ্গে প্রয়োজনীয় মেডিক্যাল সাহায্য না পায় তবে আমার ভয় হচ্ছে বহু লোকের জীবন বিপন্ন হবে। বস্তুতঃ বাংলাদেশের একটি অবিশ্বাস্য পরিসংখ্যান হচ্ছে এই যে, দেশের সবগুলি হাসপাতাল মিলিয়ে শিশুদের জন্য সর্বমোট ৭৫টি বেড আছে। অর্থাৎ প্রতি ১০ লাখে একটি। মিরপুর শরনার্থী শিবিরের প্রকান্ড লৌহ কপাটের বাইরে বহু নারী ও শিশু ভীড় করে আছে। গেটের সামনে একজন সিপাই পুরনো ৩০৩ রাইফেল হাতে পাহারা দিচ্ছে। তার কাজ আশ্রয়প্রার্থীদের দূরে সরিয়ে রাখা এসব শরনার্থীদের বেশিরভাগ লোকই এসেছে উত্তরের রংপুর, দিনাজপুর জেলা থেকে। এরা দু’দিন পায়ে হেটে না খেয়ে এসেছে। দেখে মনে হল দু’টো শিশু ছাড়া প্রায় সবগুলো শিশুই বসন্তে আক্রান্ত। এরা এতটাই দূর্বল যে গা থেকে মাছিও তাড়াতে পারে না। এদিকে রিলিফ ক্যাম্পেও তিল ধারণের জায়গা নেই। বরাবর যেমন হয়ে থাকে আমার ক্ষেত্রেও তাই হল। একজন বিদেশী সাংবাদিককে দেখে ক্যাম্পের গেট খুলে দেয়া হল। সুপারিনটেন্ডেন্ট আব্দুস সালাম আমাদের ভিতরে প্রবেশ করার জন্য ঈঙ্গিত দিলেন। আর ওমনি ওরা প্রাণপন ছুটল ভিতর পানে। এ কথা আমি আক্ষরিক অর্থেই বলছি। জনাব সালাম বললেন, “এখানে তিন হাজার শরনার্থী আছে। শুক্রবার থেকে ওদের খিচুড়ি দেয়া সম্ভব হবে না। শনিবারে হয়তো আমেরিকান কিছু বিস্কুট পাওয়া যেতে পারে।’ এ দেশে একটি শিশুকে একটু গুঁড়ো দুধ ও একমুঠো দানা দিয়ে বাচিয়ে রাখতে মাত্র ২৫ পেন্স খরচ হয়। একটি তিন বছরের শিশু এতো শুকনো যে, মনে হল যেন মায়ের পেটে থাকাকালীন অবস্থায় ফিরে গেছে। আমি তার হাতটা ধরলাম, মনে হল তার চামড়া মোমের মত আমার হাতে লেগে গেল। এই দুর্ভিক্ষের আর একটি ভয়াবহ পরিসংখ্যান এই যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মত ৫০ লাখ মহিলা আজ নগ্ন দেহী। বাচার তাগিদে বস্ত্র বিক্রি করে তারা চাল কিনে খেয়েছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, আমার গাড়ি ইসলামিক মানবকল্যাণ সমিতি ‘আঞ্জুমান-এ-মফিদুল ইসলাম’ এর লরীর পেছনে পেছনে চলছে। এই সমিতি রোজ ঢাকার রাস্তা থেকে দুর্ভিক্ষের শেষ শিকারটিকে কুড়িয়ে তুলে নেয়। সমিতির ডাইরেক্টর ডঃ আবদুল ওয়াহিদ জানালেন, ‘স্বাভাবিক সময়ে আমরা হয়তো কয়েকজন ভিখারীর মৃতদেহ কুড়িয়ে থাকি কিন্তু এখন মাসে অন্ততঃ ৬০০ লাশ কুড়াচ্ছি। সবই অনাহারজনিত মৃত্যু।’ লরীটা যখন গোরস্থানে গিয়ে পৌঁছলো ততক্ষণে সাতটি লাশ কুড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে চারটি শিশুর। সব কয়টাই বেওয়ারিশ। লাশগুলো সাদা কাপড়ে মুড়ে সংক্ষিপ্ত ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পর গোরস্থানের একপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে গত মাসে দুর্ভিক্ষে যারা মারা গেছে তাদের কবর খুঁড়েই দাফনের জায়গা করা হয়। এ ধরণের দৃশ্য আমি আর কখনো দেখিনি। প্রকৃতি আর মানুষ মিলে যদি কখনো ‘বেলসেন আর অশ’ উৎসবের অসংখ্য কবর নতুন করে রচনা করার চেষ্টা করে থাকে তাহলে তারা এই গোরস্থানে সফল হয়েছে। যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু কংকাল আর কংকাল। বোধ করি হাজার হাজার। প্রথমে লক্ষ্য করিনি। পরে বুঝতে পারলাম অধিকাংশই শিশুদের কংকাল।”

‘ভারতীয় আধিপত্যের কবলে বাংলাদেশ’ শিরোনামে লস এঞ্জেলস টাইমস এ প্রকাশিত প্রতিবেদনটি ছিল নিম্নরূপ:-

“ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর বিপুল সহায়তায় স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির তিন বছরের মধ্যেই বাংলাদেশের জনমত ভারতের প্রতি বিরূপ হয়ে গেছে। ভারত ও বাংলাদেশের সরকারি কর্মচারীরা এখনো বলে যে, দু’দেশের মধ্যে সম্পর্ক খুবই আন্তরিক। কিন্তু বেসরকারি অধিকাংশ বাঙ্গালীর মনোভাবে তা প্রতিফলিত হয় না। কোন নির্দিষ্ট অভিযোগের চেয়ে বহু বাঙ্গালীর অভিযোগ হল এশিয়া মহাদেশে ভারত প্রাধান্য লাভ করার চেষ্টা করেছে এবং শুধু আয়তনের বিশালত্ব দ্বারাই ভারত বাংলাদেশের ঘটনাবলীকে নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাবিত করতে সক্ষম। এই কিছুদিন আগে একজন মাঝারী শ্রেণীর বাংলাদেশী সরকারি কর্মচারী জনৈক বিদেশীকে কৌতুকের ছলে বলেছিলেন, ‘ভারত বলছে পৃথিবীর মধ্যে সেই হচ্ছে বৃহত্তম গণতন্ত্র। তাই যদি হয় তাহলে বাংলাদেশ অবশ্যই পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম গণতন্ত্র। বেশ কিছু সংখ্যক বাংলাদেশী এখন এই ধারণা পোষণ করেন যে, ১৯৭১ সালের যে যুদ্ধের ফলে বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছে তাতে ভারতের প্রধান স্বার্থ ছিল পাকিস্তানকে ভেঙ্গে এই উপমহাদেশে স্বীয় স্বার্থ নিশ্চিত করা। হলিডে পত্রিকার সম্পাদক এনায়েত উল্লাহ খান বললেন, ‘বাংলাদেশ মূলতঃ একদিকে ভারতীয় সম্প্রসারনবাদ ও অপরদিকে বাঙ্গালীদের ইচ্ছার ফল। ভারত সম্পর্কে বাঙ্গালীদের মোহ কেটে গেছে সেটা বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান আভ্যন্তরীন সমস্যারই প্রতিফলন। কিছু বাংলাদেশী মনে করছেন যে, বাংলাদেশের সৃষ্টির জন্য ভারত যেমন প্রধানতঃ দায়ী তেমনি বাংলাদেশের বর্তমান দুদর্শার জন্যও ভারত দায়ী। অত্যন্ত উত্তেজনামূলক যে কয়টি সমস্যা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিরাজমান তার মধ্যে একটি হচ্ছে ভারত সীমান্তের ১২ মাইল অভ্যন্তরে গঙ্গা নদীর উপর ফারাক্কা বাঁধ। ডিসেম্বর মাসে যখন এই বাঁধ চালু হবে তখন গঙ্গার পানি কোলকাতার পাশ দিয়ে বহমান হুগলী নদী দিয়ে প্রবাহিত হবে। গঙ্গার পানির এই ধারা পরিবর্তনের উদ্দেশ্য হল কোলকাতা বন্দরকে তলানী মুক্ত করা। তলানীর জন্য কোলকাতা বন্দর প্রায় অনাব্য হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশীরা ভয় করছে যে এই পরিবর্তনের ফলে গঙ্গা নদীর নিম্নাংশ যা বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে সে অংশ গ্রীষ্মের মৌসুমে একদম শুকিয়ে যাবে। কিছু বাংলাদেশী এ অভিযোগও করে যে, ভারত সরকার বাংলাদেশ থেকে পাট ও চাল পাচারে উৎসাহ যোগাচ্ছে। ভারতীয় সরকারি কর্মচারীরা স্বীকার করেছেন যে, বাংলাদেশের পাট ও চাউল ভারতে পাঁচার হচ্ছে। বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদেরই উৎসাহ রয়েছে সীমান্তের ওপারে কাচা মাল পাচার করার; কেননা সরকারিভাবে বাংলাদেশ ও ভারতীয় মুদ্রার বিনিময় হার এক হলেও কালোবাজারে ভারতীয় মুদ্রার মূল্য বাংলাদেশী মুদ্রার দ্বিগুন। ফলে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা কাঁচামাল ভারতে পাচার করে যে অর্থ উপার্জন করে সে টাকায় বাংলাদেশে যে সমস্ত জিনিষের অভাব তা ভারত থেকে কিনে এনে দ্বিগুন মুনাফায় বিক্রি করে। ভারতের একটা উদ্বেগের কারণ হচ্ছে চীনের সাথে বাংলাদেশের ভবিষ্যত সম্পর্ক। চীন হচ্ছে ভারতের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। ভারত কখনো বাংলাদেশকে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে দেবে না : ভারত চায় বাংলাদেশ জোট নিরপেক্ষ থাকবে এবং এমন বৈদেশিক সম্পর্ক গড়ে তুলবে না যা হবে ভারতের স্বার্থের পরিপন্থী। অন্যান্য পর্যবেক্ষকরা আরো বলেন, ‘যদি বাংলাদেশের উপকূলে তেল পাওয়া যায় তবে ভারত সরাসরি বাংলাদেশের উপকূল দখল করবে।’ ব্যাঙ্গোক্তি করলেন একজন পদস্থ অফিসার, ‘বাংলাদেশর ভাগ্য বাংলাদেশের হাতে নাই’

১৯৭৫ সালের জানুয়ারী মাসের ১৮ তারিখে একদলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব যখন সংসদীয় দলের মিটিং এ উত্থাপন করা হয় তখন প্রস্তাবটির বিপক্ষে মত প্রকাশ করেন সংসদীয় দলের বেশিরভাগ সদস্য। এ অবস্থায় মিটিং এ বলা হয়- এই প্রস্তাব এর বিরোধিতা করা হলে শেখ মুজিব পদত্যাগ করবেন নতুবা একটি মেরুদন্ডহীন সংসদ সৃষ্টি করে এ প্রস্তাব পাশ করানো হবে। এই কথা শোনার পর মুজিবের ইচ্ছাকে অনেকটা বাধ্য হয়েই সবাইকে মেনে নিতে হয়। ১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারী জরুরী আইন ঘোষণার মাত্র ২৭দিন পর দেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা বাকশাল কায়েম করে গণতন্ত্রের কবর রচনা করে এক আদেশ জারি করলেন শেখ মুজিব। সারাজীবন যে শেখ মুজিব গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করে এসেছিলেন তিনিই বাংলাদেশে একদলীয় শাসনতন্ত্র কায়েম করে সর্বপ্রথম স্বৈরাতান্ত্রিক একনায়কত্ব কায়েম করেন। বাংলাদেশে একদলীয় শাসনতন্ত্র প্রবর্তনের ফলে দেশের সকল বিরোধী দল বাতিল বলে গন্য হয়।

পৃথিবীর ইতিহাসে ক’জন নেতা দেশের মানুষের এত ভালোবাসা পেয়েছেন? কিন্তু পরিবর্তে তিনি জনগণকে আপন করে নিতে পারেননি। দুষ্কৃতিকারী কর্মী ও নেতারা তার কাছে আশ্রয় ও প্রশ্রয় পেয়েছে। পরিবারের অনেকের বিরুদ্ধে দুঃষ্কর্মের রিপোর্ট পেয়েও তিনি তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেননি। কর্তৃত্বের প্রতি প্রবল আকর্ষণের জন্য তার চেয়ে অধিক রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিসম্পন্ন কাউকে তিনি বরদাস্ত করতে পারতেন না। তার চরিত্রে ধৈর্য্যের অভাবও ছিল যথেষ্ট ফলে তিনি পরীক্ষিত ও গুনবান যোগ্য সহযোগীদের কান কথায় বিভিন্ন দায়িত্ব থেকে অপসারন করেন। তিনি এক পর্যায়ে আপন-পর, বিশ্বস্ত সহযোগী এবং নির্ভরশীল বন্ধু বিবেচনার শক্তিও হারিয়ে ফেলেন। শেখ মুজিবের এই মানসিকতাকে তার রাজনৈতিক জীবনের চরম ব্যর্থতা ও পরিণতির জন্য একটি বিশেষ কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। যুব নেতাদের দৌরাত্ত্বে গোটা প্রশাসনযন্ত্র বিকল হয়ে যায়। দেশে দুর্ভিক্ষ। প্রতিদিন হত্যার খবর শুনতে হয় মানুষকে। প্রকাশ্য দিবালোকে নির্বিচারে হত্যাকান্ড প্রায় প্রতিদিন সংঘটিত হয়েছে তখন। বিরোধী দলগুলোকে নির্মূল করার জন্য রক্ষীবাহিনী ও অন্যান্য বাহিনীকে লেলিয়ে দেয়া ছাড়াও দলীয় কর্মীদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া হয়েছিল। পুরো দেশ এভাবেই একটা সীমাহীন নৈরাজ্যের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল। যে মানুষ একদিন মুজিবের কারামুক্তির জন্য রোজা রেখেছে: নফল নামাজ আদায় করেছে; সেই মানুষই আওয়ামী-বাকশালী শাসনামলে আল্লাহ্পাকের কাছে কেঁদে কেঁদে শেখ মুজিবের দুঃশাসন থেকে মুক্তি চেয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের অপশাসন শেখ মুজিবকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল। বাকশালী একনায়কত্ব সৃষ্টি করে তিনি তার দলের মধ্যেও অন্তঃবিরোধ তীব্র করে তোলেন। তার এই সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেননি দলের অনেকেই : শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবনের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় তিনি ছিলেন ভীষণভাবে স্বার্থপর ও সুযোগ সন্ধানী। নিজের ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও প্রভাব বজায়ে রাখার জন্য যে কোন সুযোগই গ্রহণ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেননি শেখ মুজিব। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কথাতেই সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। সারা বাংলাদেশের মানুষকে জানানো হল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তথা বাঙ্গালী জাতিকে পাঞ্জাবী শোষণের হাত থেকে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে মুক্ত করার স্বপ্নদ্রষ্টা নাকি ছিলেন শেখ মুজিবর রহমান। কিন্তু সেটা ঐতিহাসিক সত্য নয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শেখ মুজিবকে রাতারাতি কিংবদন্তীর নায়ক করে তুলেছিল এতে কোন সন্দেহ না থাকলেও এর মূল রূপকার ছিলেন লেঃ কমান্ডার মোয়াজ্জাম হোসেন। এই অখ্যাত তরুণ নেভ্যাল অফিসারই প্রথম স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের। পাঞ্জাবী শোষকদের কবল থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে হবে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে: এটাও তিনিই উপলব্ধি করেছিলেন পঞ্চাশের দশকে পাকিস্তান নৌ বাহিনীতে যোগদানের পরই। ১৯৫০ সালে তিনি মিডশিপম্যান হয়ে ইংল্যান্ডের রয়্যাল একাডেমীতে প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফেরার পর কাজ আরম্ভ করেন। সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য প্রথমে মাত্র ২জন সহচর নিয়ে শুরু হয় তার বিপ্লবী কর্মকান্ড। কাজে হাত দিয়েই তিনি উপলব্ধি করলেন সবচেয়ে আগে দরকার একজন রাজনৈতিক নেতার। কারণ একজন সামরিক অফিসার হিসেবে চাকুরিতে থেকে ব্যাপকভাবে কাজ করার সুযোগ হবে না তার।

তাছাড়া শুধুমাত্র সামরিক বাহিনীতে গোপন সংগঠন গড়ে তুললেই বিপ্লব করা সম্ভব হবে না। সংগঠন গড়ে তুলতে হবে দেশের জনগণের মধ্যে। তার জন্য প্রয়োজন বহুল পরিচিত একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের। সুপরিচিত নেতার ডাকেই অস্ত্র হাতে তুলে নেবে কর্মীরা। তিনি যোগাযোগ শুরু করলেন রাজনৈতিক দল ও নেতাদের সাথে। কিন্তু বেশিরভাগ নেতারাই তার প্রস্তাবে তেমন একটা গুরুত্ব দেয়নি। যারা দিয়েছেন তারা জুড়ে দিয়েছেন বিভিন্ন শর্ত। তাদের গদি দিতে হবে। অনেকে তাকে পাগলও বলেছেন প্রস্তাব শুনে। ভয়ে আতঁকে উঠেছেন অনেক নামিদামী নেতা। ১৯৬৪ সালে তিনি শেখ মুজিবর রহমানের সাথে এ ব্যাপারে আলাপ করেন। শেখ মুজিব তার প্রস্তাব শুনে বলেছিলেন, যতটুকু সম্ভব পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করবেন। এতটুকু পর্যন্তই এর বেশি কিছু নয়। ১৯৬৬ সালে কমান্ডার মোয়াজ্জেম চট্টগ্রামে বদলি হয়ে আসেন। এতে তার তৎপরতা আরো জোরদার করার সুযোগ পান তিনি। ১৯৬৭ সালের জুন/জুলাই মাসে তিনি তার দুই প্রতিনিধি জনাব স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমান এবং জনাব আলী রেজাকে আগরতলাতে পাঠান ভারতীয় সাহায্যের আশায়। তার প্রতিনিধিদের সাথে ভারতীয় সরকারের আলোচনা তেমন ফলপ্রসু হয়নি। বিপ্লবী জনাব স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমানকে স্বাধীনতার মাত্র একমাসের মধ্যে গুম করে ফেলা হয়। মুজিব সরকার কিংবা তার দল এ বিষয়ে বরাবরই এক রহস্যজনক নিরবতা অবলম্বন করে এসেছে। ১৯৬৭ সালের নভেম্বর মাসে কমান্ডার মোয়াজ্জেমকে রাওয়ালপিন্ডি পাঠানো হয়। সেখানে পৌঁছে বিভিন্ন সূত্রে তিনি জানতে পারেন, পাকিস্ত ান ইনটেলিজেন্স সন্দেহ করছে যে কমান্ডার মোয়াজ্জেম রাষ্ট্রদ্রোহী কর্মকান্ডের সাথে জড়িত। এই খবর জানতে পেরে ছদ্মনামে ৭ই ডিসেম্বর ১৯৬৭ ঢাকায় চলে এসে তার ছোট ভাই এর সিদ্ধেশ্বরীর বাড়িতে আত্মগোপন করে লুকিয়ে থাকেন। ৯তারিখ রাত প্রায় ১১টার দিকে তৎকালীন পাকিস্তান সেনা বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে চাকুরিরত ক্যাপ্টেন নুরুল ইসলাম শিশু (পরবর্তীতে ‘জেনারেল রাজপুটিন অফ বাংলাদেশ’) ও আরো কয়েকজন হঠাৎ করে বাড়িতে হানা দিয়ে কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনকে ধরে নিয়ে যায়। তিনি তখন শারীরিকভাবে অসুস্থ। নিয়ে যাবার সময় ক্যাপ্টেন নূরুল ইসলাম জনাব মোয়াজ্জেম হোসেনের স্ত্রী কোহিনূর হোসেনকে বলেছিলেন যে, বিশেষ প্রয়োজনে তাকে ঢাকা ক্লাবে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ঘন্টা খানেকের জন্য। কিন্তু তাকে মুক্তি দেয়া হয়েছিল ১৫ মাস পর। অকথ্য নির্যাতন করা হয়েছিল তার উপর। দীর্ঘ ১৫ মাস অকথ্য অত্যাচার করেও পাকিস্তান সেনা বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগ তার কাছ থেকে কোন কথাই বের করতে পারেনি। এর পরেই ১৯৬৮ সালের জুন মাসে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে শুরু হয় বিখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। ১নং আসামী কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন। পরবর্তিকালে পাকিস্তানের অধিকর্তারা বুঝতে পারেন, কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনকে প্রধান আসামী বানানোর ফলে সারা বিশ্বের কাছে মিলিটারী ইন্টেলিজেন্সের ভীষণ বদনাম হচ্ছে। তাই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, এক ঢিলে দুই পাখি মারার। জড়ানো হয় শেখ মুজিবর রহমানকে প্রধান আসামী হিসাবে। পাকিস্তান সরকার রাজনৈতিক মতলব হাসিলের লক্ষ্যে মামলা শুরু হওয়ার পর কমান্ডার মোয়াজ্জেমের নাম ১নং আসামী থেকে কেটে ২নং আসামীর জায়গায় সরিয়ে নেয়। আর এভাবেই ঐ মামলা সাপে বর হয়ে মুজিবকে গড়ে তুললো কিংবদন্তীর নায়ক হিসেবে। ‘৬৯ এর ১৫ই ফেব্রুয়ারী সার্জেন্ট জহুরুল হককে গুলি করে মেরে ফেল। হল মিথ্যে অপবাদ দিয়ে। তিনি নাকি বন্দী অবস্থায় পালাবার চেষ্টা করেছিলেন। এই ঘটনারই পূর্ণরাবৃত্তি ঘটেছিল মুজিব শাসনকালে বিপ্লবী নেতা সিরাজ সিকদারের হত্যার মাধ্যমে। শেখ মুজিব সর্ম্পকে কমান্ডার মোয়াজ্জেম তেমন আকর্ষণ বোধ করেননি কখনোই। শেখ মুজিবের দলের উপরও তার আস্থা ছিল না। কমান্ডার মোয়াজ্জেমের স্পষ্টবাদিতাকে শেখ মুজিব কখনই পছন্দ করেননি। ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে ভোর ৬টার দিকে হানাদার বাহিনী তাকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। বাড়ির সামনে গুলি করলেও তার লাশ নিয়ে যাওয়া হয় ক্যান্টনমেন্টে; যার হদিস আজ অব্দি তার পরিবার পরিজন পাননি। ধর্মপ্রাণ কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করতেন না। নির্ভীক এই মুক্তিযোদ্ধা মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসে ছিলেন তার দেশ ও জাতিকে। সঙ্গে দিয়ে গেলেন প্রাণ স্বাধীনতার জন্য। দেশ স্বাধীন হল। শেখ মুজিবর রহমান একচ্ছত্র নেতা বলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করলেন, কিন্তু কমান্ডার মোয়াজ্জেমের ত্যাগের প্রতি সম্মান দেখাতে পারেননি তিনি। কখনো সত্যকে তুলে ধরেননি জনগণের সম্মুখে। চুপটি মেরে থেকে সব কৃতিত্ব নিজেই হজম করে গেছেন নির্বিবাদে।

আপোষহীন প্রতিবাদী কন্ঠের অধিকারীদের চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্যই তাদের মেরে ফেলা হয় আর সুবিধাবাদী আপোষকামীদের সবসময় বাচিয়ে রাখা হয় স্বার্থ উদ্ধারের জন্য। সে হিসেবেই ২৬শে মার্চ প্রাণ দিতে হয়েছিল কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে আর শেখ মুজিবর রহমানকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পাকিস্তানে। এমনটি ঘটেছে সর্বদা, ঘটবে ভবিষ্যতেও। ইতিহাসও তাই বলে।

১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের প্রথম দিকে এক সন্ধ্যায় আমি, নিম্মী ও নূর গিয়েছিলাম সাজেদা চাচীর বাসায়। চাচীরা তখন থাকতেন ইন্দিরা রোডের একটা দোতালা বাসার উপর তলায়। নিচের তলায় থাকতেন রক্ষীবাহিনীর কর্নেল সাব্বিউদ্দিন। চাচা ও চাচী মানে জনাব গোলাম আকবর চৌধুরী ও সাজেদা চৌধুরী (আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক) দু’জনই বাড়িতে ছিলেন। পারিবারিক সূত্রে আমরা বিশেষভাবে ঘনিষ্ঠ। আমার শ্বাশুড়ী ও বেগম সাজেদা চৌধুরী পরম বান্ধবী। পুরো সংগ্রামের সময়টা তাদের পরিবার আমার শ্বশুড় মহাশয়ের কোলকাতার বাড়িতেই কাটিয়ে ছিলেন আশ্রয় গ্রহণ করে। কিছুতেই না খাইয়ে ছাড়লেন না চাচী খাওয়া-দাওয়া শেষ হতে প্রায় ১০টা/সাড়ে ১০টা বেজে গেল। বিদায় নিয়ে গাড়িতে এসে উঠলাম। বাড়ির গেট থেকে ইন্দিরা রোড পর্যন্ত একটি সরূপথ। নিচু জমিতে মাটি ফেলে রাস্তা বানানো হয়েছে। গেট দিয়ে বেরুতেই নূর হঠাৎ চিৎকার করে বলে উঠল, “স্যার, ওরা গুলি করছে।” সামনে চেয়ে দেখি দু’জন লোক চাদর মুরি দিয়ে রাস্তার একপাশে দাড়িয়ে। দু’জনারই হাতে ষ্টেনগান। গুলি করার প্রস্তুতি নিচ্ছে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ব্যাক গিয়ার দিয়ে তীব্র গতিতে গেটের ভেতরে চলে এলাম এক নিমিষে : আমাদের পিছু হটে যাওয়ায় লোক দু’টি বুঝতে পারলো আমরা ব্যাপারটা বুঝে ফেলেছি। মুহূর্তে তারাও হাওয়া হয়ে গেল। গাড়ি থেকে নেমে উপরে উঠে গেলাম দৌড়ে। বেচারী নিম্মীর হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। ছুটে গিয়ে চাচীকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল নিম্মী। বাসার সবাই হতভম্ব। কি ব্যাপার, কি হয়েছে? বাবলু, ছোটকা, লাবু, মানু সবাই ছুটে এল . চাচীকে ঘটনা খুলে বললাম। চাচী সব শুনে থ্ হয়ে গেলেন। চাচার অবস্থাও অনূরূপ। সাব্বিউদ্দিনের বাড়িতে সিভিল কাপড়ে আর্মড গার্ড থাকে। সে ক্ষেত্রে এ ধরণের ঘটনাতে ভীষণভাবে ঘাবড়ে গেলেন চাচী। আমাকে ও নূরকে নিয়ে নিচে গিয়ে সাব্বিউদ্দিনকে সব খুলে বললেন তিনি। সব শুনে কর্নেল সাব্বিউদ্দিন বেশ কিছুটা বিব্রত বোধ করলেন। তিনি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন, “দিনকাল ভালো না। কি করা যায় বলেনতো?” বুঝলাম ব্যাপারটা কোনমতে কাটিয়ে দিতে চাচ্ছেন তিনি। কিছুক্ষণ পর উপরে ফিরে এসে চাচী ৩২নং ধানমন্ডিতে ফোন করলেন শেখ সাহেবের বাড়িতে। কি কথা হল সেটা বলতে পারব না। তবে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে চাচী বললেন, “বাসায় ফোন করে দাও আজ রাতে তোমরা ফিরছো না। আমার এখানেই থাকবে। তার উপদেশ মেনে নিয়ে সে রাতটা তার বাসাতেই কাটিয়ে সকালে ফিরে এসেছিলাম। আল্লাহ্তা’য়ালা আর একবার জীবন রক্ষা করলেন। একেই বলে ‘রাখে আল্লাহ মারে কে?’ সিভিল ড্রেসে রক্ষীবাহিনীর গার্ডরা সর্বক্ষণ পাহারা দিচ্ছে এই বাড়ি। হঠাৎ খটকা লাগল মনে। আততায়ী দু’জন ছিলেন সিভিল ড্রেসে এবং তাদের হাতে ছিল ৯এমএম ইন্ডিয়ান ষ্টেনগান। হিসাব মিলে গেল। একই সাথে মনে পড়ে গিয়েছিল এসপি মাহবুবের সতর্কবাণী। আমাদের উপর থেকে ‘সুনজর’ এখনো যায়নি। আরো সাবধানে চলাফেরা করতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *