ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ
গুপ্তপথে
যখন চেতনা ফিরিয়া আসিল, তখন ময়ূখ দেখিলেন যে তিনি একটি সঙ্কীর্ণ কক্ষমধ্যে বহুমূল্য শয্যায় শয়ান আছেন। কক্ষটি দুই হস্তের অধিক প্রশস্ত নহে, কিন্তু দীর্ঘে অনন্ত। সেই অপ্রশস্ত গৃহে অস্পষ্ট আলোকে ময়ূখ দেখিতে পাইলেন যে তাঁহার শিয়রে এক ভয়ঙ্করী রমণীমূর্ত্তি বসিয়া আছে। তাহার নাসিকা নাই বলিলেই হয়, চক্ষু দুইটি ক্ষুদ্র, কোটরগত, বর্ণ হরিদ্রাভ। তাঁহার চেতনা ফিরিয়াছে দেখিয়া, রমণী শয্যার নিকটে আসিল, ময়ূখ দেখিতে পাইলেন যে তাহার কটিদেশে দীর্ঘ কৃপাণ আবদ্ধ রহিয়াছে। রমণী তাতারী, তখন ভিন্ন ভিন্ন জাতীয় তাতার রমণী ব্যতীত অন্য কোন জাতীয় স্ত্রীলোক মোগল বাদশাহের অন্তঃপুরে প্রতিহারীর পদ পাইত না। ময়ূখ কয়েক বৎসর আগ্রায় থাকিয়া তাতার চিনিয়াছিলেন। তিনি ভয়ে শিহরিয়া উঠিলেন। তিনি জানিতেন তাতারীর অসাধ্য কার্য্য নাই। তাতারী নিকটে আসিয়া বলিল, “জাগিয়াছিস? বড় জোর চোট লাগিয়াছিল, না? একটু সরাব পি।” রমণী বস্ত্রমধ্য হইতে চর্ম্মনির্ম্মিত আধার বাহির করিল, তাহার মুখে সুরার তীব্র গন্ধ, স্নানাভাবজনিত অঙ্গের দুর্গন্ধের সহিত মিশিয়া, তাহাকে অভিভূত করিয়া তুলিল; ময়ূখ মুখ ফিরাইয়া লইলেন। তাতারী হাসিয়া উঠিল এবং ময়ূখের মুখময় সুরা ছড়াইয়া দিল। তিনি তখন দুর্ব্বল, ধীরে ধীরে শয্যা ত্যাগ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। তখন রমণী আসিয়া তাঁহাকে আলিঙ্গন করিল, ময়ূখ মুক্ত হইবার চেষ্টা করিলেন কিন্তু পারিলেন না। পশ্চাতে পদশব্দ শুনিয়া তাতারী তাঁহাকে পরিত্যাগ করিল। ময়ূখ ফিরিয়া দেখিলেন যে শয্যাপার্শ্বে দুইটি সুন্দরী যুবতী দাঁড়াইয়া আছে। প্রথমা বিদেশিনী, তাহার বর্ণ গোলাপের ন্যায় হইলেও উগ্র, কেশ পিঙ্গল বর্ণ এবং চক্ষুর মণি পীতবর্ণ; দ্বিতীয়া, স্নিগ্ধ পদ্মরাগবর্ণা, তাহার কুঞ্চিত আর্দ্র কৃষ্ণ কেশরাশি ভূমিতে লুটাইয়া পড়িয়াছে এবং তাহার নীল নয়নদ্বয়ে চঞ্চল ভ্রমরবৎ কৃষ্ণ তারকা দুইটি সর্ব্বদাই যেন নৃত্য করিতেছে। ময়ূখ বিস্মিত হইয় তাঁহাদিগের দিকে চাহিয়া রহিলেন। তাঁহার মনে হইল দ্বিতীয়া তাহার পরিচিত। জীবনের কোন এক তমসাচ্ছন্নযুগে বিস্মৃতির অন্ধকার মধ্যে এই সুন্দর মুখখানি উজ্জ্বল আলোকের ন্যায় ফুটিয়া উঠিয়াছিল। সে কবে? সে কোথায়?
সহসা বীণানিন্দিত কণ্ঠে উচ্চারিত হইল, “শাহ্জাদী, উনি যে আমাকে চিনিতে পারিতেছেন না?” দ্বিতীয়া এই বলিয়া রেশমের রুমাল দিয়া চক্ষু মুছিল।
তখন প্রথমা কহিলেন, “সর্ওয়ার্ খাঁ, তুমি তোমার বিবাহিতা পত্নীকে চিনিতে পারিতেছ না?”
ময়ূখের মস্তক তখন ঘূর্ণিত হইতেছিল, তিনি কক্ষের প্রাচীর ধরিয়া দাঁড়াইলেন।
প্রথমা পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি জান আমি কে?”
ময়ূখ সভয়ে কহিলেন, “না।”
“আমি শাহ্জাদী জহানারা বেগম।”
ময়ূখ শিহরিয়া উঠিলেন এবং বাদশাহ্জাদীকে অভিবাদন করিলেন।
শাহ্জাদী পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কোথায় আসিয়াছ জান?”
“না”
“তুমি কেন এখানে আসিয়াছ তাহা জান?”
“না”
শাহ্জাদী দ্বিতীয় রমণীকে দেখাইয়া দিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “ইনি কে?”
ময়ূখ ধীরে ধীরে কহিলেন, “তাহাত বলিতে পারি না।”
“ইহাকে কখনও দেখিয়াছ?”
“স্মরণ হয় না।”
“মিথ্যা কথা, খোজা?”
সঙ্গে সঙ্গে দুইজন কাফ্রী ও দুইজন তাতারী প্রতিহারী ময়ূখের পশ্চাতে আসিয়া দাঁড়াইল। তিনি অভ্যাসবশতঃ কটিদেশে হস্তাপর্ণ করিলেন দেখিলেন, তরবারি নাই। খোজাদ্বয় তাঁহার হস্তধারণ করিল, শাহ্জাদী পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “দেখ, ইহাকে চিনিতে পার?”
“না।”
“তোমার নাম কি?”
“আমার নাম ময়ূখ।”
“মিথ্যা কথা, তোমার নাম সর্ওয়ার্ খাঁ।”
ময়ূখ বিস্মিত হইয়া কহিলেন, “শাহজাদী আপনি যে নাম উচ্চারণ করিলেন তাহা আমি কখনও শুনি নাই। আমি হিন্দু, আমার নিবাস বাঙ্গালা মুলুকে, আমার নাম ময়ূখ, আমার পিতার নাম দেবেন্দ্রনারায়ণ। আসদ্ খাঁ, শাহ্নওয়াজ খাঁ প্রভৃতি আমীরগণ আমার পরিচয় অবগত আছেন।”
তখন দ্বিতীয়া শাহজাদীর কর্ণমূলে কহিল, “বেগম সাহেব উনি পাগল হইয়া অবধি ও ঐরকম বলেন। বাঙ্গালা মুলুকে সরকার সাতগাঁয়ে পিতাকে প্রথমে ঐরূপ পরিচয় দিয়াছিলেন। সমস্তই অদৃষ্টের দোষ; আমি কি করিব বাদশাহ্জাদী।”
দ্বিতীয়া এই বলিয়া পুনরায় রুমাল দিয়া চক্ষু মুছিল। শাহজাদী তাহাকে শান্ত করিবার জন্য আলিঙ্গন করিয়া কহিলেন, “তুই কাঁদিতেছিস কেন, গুলরুখ্? আমি দুইদিনে খাঁ সাহেবের পাগলামী সারাইয়া দিব। সর্ওয়ার্ খাঁ, তুমি হিন্দু নহ, তুমি মুসলমান, তোমার নাম সর্ওয়ার্ খাঁ, তুমি এই বিবির খসম্।”
“বেগম সাহেব, আমি এক বর্ণও মিথ্যা বলি নাই।” গুলরুখ্ বেগম পুনরায় বাদশাহ্জাদীর কর্ণমূলে কহিলেন, “শাহজাদী ও বদ্ধপাগল, উহার সহিত তর্ক করিয়া কি হইবে?” শাহজাদী হাসিয়া কহিলেন, “আমি তর্ক করিব না, ভাল কথায় না বুঝিলে জোর করিয়া সম্ঝাইয়া দিব।” “উহাকে অন্য কথা বলুন।”
গুলরুখ্ কিয়ৎক্ষণ শাহজাদীর সহিত পরামর্শ করিলেন, তখন শাহজাদী ময়ূখকে পুনর্ব্বার কহিলেন, “তুমি হিন্দু হইলেও তোমাকে মুসলমান হইতে হইবে, আর আমার হুকুমে এই বিবিকে সাদী করিতে হইবে।”
ময়ূখ ভূমি স্পর্শ করিয়া অভিবাদন করিলেন এবং কহিলেন, “শাহজাদী, আপনি দীন ও দুনিয়ার মালিক, আমি ক্ষুদ্র ব্যক্তি, আপনি ইচ্ছা করিলে আমাকে জানে মারিতে পারেন; কিন্তু আমি হিন্দু, আমি ধর্ম্ম বিসর্জ্জন দিব না, অথবা যবনীকে বিবাহ করিব না।”
“বিবেচনা করিয়া দেখ।”
“শাহ্জাদীর বহুৎ মেহেরবাণী। আমার অন্য জবাব নাই।”
“খাঁ সাহেব, শাহ্জহান বাদশাহের মুলুকে মুসলমান যদি কাফের বলিয়া পরিচয় দেয় তাহা হইলে তাহার কি শাস্তি হয় জান?”
“জানি শাহ্জাদী, কিন্তু আমি ত মুসলমান নহি, সুতরাং কোরাণের দণ্ড আমার প্রাপ্য নহে।”
“তুমি ইচ্ছা করিয়া শূলে যাইবে?”
“যদি তাহাই আপনার অভিপ্রেত হয় সানন্দে যাইব।”
“তবে যাও।”
খোজাদ্বয় ময়ূখের চক্ষু বাঁধিয়া তাহাকে স্কন্ধে উঠাইল এবং দ্রুতপদে স্থানান্তরে লইয়া গেল। কক্ষ পরিত্যাগ কালে ময়ূখ শুনিতে পাইলেন সে গুলরুখ্ বলিতেছেন, “শাহ্জাদী গোশা করেন নাই ত?”
ময়ূখ কক্ষ হইতে নীত হইলে শাহ্জাদী প্রস্থান করিলেন। যে স্থানে ময়ূখ শয়ন করিয়াছিলেন সে স্থানটি কক্ষ নহে, আগ্রা দুর্গের অন্তঃপুরে বিশালকায় প্রাচীর মধ্যে একটি গুপ্ত পথ মাত্র। জাহানারা বেগম প্রস্থান করিলে গুলরুখ্ তাঁহার পশ্চাৎ অনুসরণ করিতেছিলেন, এমন সময়ে তাতারী সহসা তাঁহার হস্তধারণ করিল। গুলরুখ্ বিস্মিতা হইয়া তাহার মুখের দিকে চাহিলেন। সে কহিল, “বেগম সাহেব, একটা কথা রাখিবে?” গুলরুখ্ হাত ছাড়াইয়া লইয়া কহিলেন, “কি কথা?”
“আগে বল রাখিবে?”
“না জানিয়া শুনিয়া কেমন করিয়া প্রতিজ্ঞা করিব?”
“তোমার খসমটা তল্লাক দাও।”
“কেন বল্ দেখি?”
“অমন কড়া খসম তুমি পোষ মানাইতে পারিবে না।”
“আমি পারি না পারি তাহাতে তোর কিরে হারামজাদী?”
“খবরদার মুখ সামাল! বেগম, ও খসম্ তুমি ভোগ করিতে পারিবে না, অন্ততঃ আমি জীবিত থাকিতে নয়।”
“তোকে কুত্তা দিয়া খাওয়াইব।”
“এখান হইতে ফিরিয়া গেলে তবেত?”
তাতারী এই বলিয়া কটিদেশ হইতে সুদীর্ঘ কৃপাণ বাহির করিল এবং ক্ষুধিত ব্যাঘ্রের ন্যায় লম্ফ দিয়া গুলরুখ্ বেগমকে আক্রমণ করিল। গুলরুখ্ অস্ত্রহীনা, তাতারীর আক্রমণ হইতে আত্মরক্ষা করিবার তাহার কোন উপায়ই ছিল না। তাতারী বজ্র মুষ্টিতে তাঁহার কেশরাশি ধারণ করিয়া কৃপাণ উদ্ধে তুলিল। গুলরুখ্ যথাসাধ্য চীৎকার করিতে লাগিলেন। আগ্রা দুর্গের প্রাচীর এমন কৌশলে নির্ম্মিত যে গুপ্তপথে বন্দুকের আওয়াজ করিলেও তাহা বহির্দ্দেশ হইতে শুনা যাইত না। কৃপাণ গুলরুখের স্কন্ধ স্পর্শ করিবার পূর্ব্বে কে তাহা তাতারীর হস্ত হইতে ছিনাইয়া লইল, সঙ্গে সঙ্গে তাতার দশ হস্ত দূরে নিক্ষিপ্ত হইল। গুলরুখ্ উঠিয়া দাঁড়াইলেন এবং দেখিলেন যে তাতারীর গ্রীবা ধারণ করিয়া একজন কৃষ্ণবর্ণ খর্ব্বাকৃতি মনুষ্য তাহাকে ক্ষিপ্রহস্তে বন্ধন করিতেছে।
বন্ধন শেষ হইলে সে গুলরুখের নিকটে আসিয়া তাঁহাকে চলিয়া যাইতে ইঙ্গিত করিল। তাঁহাকে উপদেবতা ভাবিয়া গুলরুখ্ ভয়ে ও বিস্ময়ে অর্দ্ধমৃত হইয়াছিলেন, তিনি বাক্যব্যয় না করিয়া উর্দ্ধশ্বাসে পলায়ন করিলেন। অর্দ্ধদণ্ড পরে শত শত খোজা ও তাতারী প্রহরী আসিয়া পড়িল, তাহার রজ্জুবদ্ধ তাতারী প্রতিহারীকে দেখিতে পাইল; কিন্তু সেই কৃষ্ণবর্ণ খর্ব্বাকৃতি মনুষ্যকে খুঁজিয়া পাইল না।