গলার টাইটা কয়েক ইঞ্চি ঢিলে করে নটবর মিত্তির নিজের অফিসে বসেছিলেন।
সোমনাথকে দেখেই একগাল হেসে নটবর মিত্তির বললেন, “আসন মিস্টার ব্যানার্জি। মুখ দেখেই বুঝতে পারছি কিছু হচ্ছে না। কতকগুলো হরিয়ানী পাঞ্জাবী রাজস্থানী সিন্ধি ডাকাত বিজনেসের নাম করে সোনার বাংলাকে লুটেপটে খেলে। আমরা তো শুধু আঙুল চুষেচুষেই দিন কাটিয়ে দিলাম।”
সোমনাথ জিজ্ঞেস করলো, “আপনি মিস্টার গোয়েঙ্কাকে চেনেন?”
“বিজনেসে রয়েছি, এই কলকাতায় অন্তত দেড়শ’ গোয়েঙ্কাকে চিনি। আপনি কার কথা বলছেন?”
সোমনাথ পরিচয় দিলো। নটবর একগাল হেসে বললেন, ‘মহাত্মা মিলস-এর সদশন গোয়েঙ্কার কথা বলছেন? লাল, জামাইবাবুর মতো চেহারা তো?”
হো-হো করে হাসলেন নটবর মিত্তির। “আপনি বুঝি ওখানেও মাল বেচবাবু চেষ্টা করছেন?”
“কেন পাটি খারাপ নাকি?” নটবর মিত্রের কথার ধরনে সোমনাথ চিতায় পড়ে গেলো।
“পাটি খারাপ হতে যাবে কোন দুঃখে? তবে বড় শক্ত ঘাঁটি।” টাই-এর ফাঁসটা আরও আলগা করে নটবর মিত্তির বললেন, “আমার এক পাটি ওখানে ফেসে গিয়েছিল। কিছুতেই সুবিধে করতে পারে না। শেষ পর্যন্ত পাঁচশ’ টাকা ফরনে আমাকে পাঠালো। আমি অনেক কষ্ট করে দু-তিনবার ট্রাই নিয়ে একদিন ড্রিংকসের টেবিলে গোয়েঙ্কাকে ফেললাম। তবে কাজ হাসিল হলো।”
“তবে যে উনি বললেন, মদ-টদে আগ্রহ নেই ওঁর। সোমনাথ একটু আশ্চর্য হলো।
“আপনি অচেনা-অজানা লোক, তাছাড়া আপনাকে কী বলবে? যা দিনকাল পড়েছে, যাকে-তাকে বলা যায় না—আমার বিনা পয়সায় মাল খেতে ভালো লাগে। আপনি সত্যিই হাসালেন সোমনাথবাব।”
নটবরবাবু সামনের দিকে একটু ঝকে পড়ে ফিসফিস করে বললেন, “এ-লাইনে আমার চোখ ডাক্তার বি সি রায়ের মতো। পাটির হাঁচি শুনলেই বলতে পারি মনে কী রোগ হয়েছে। আপনার ঐ গোয়েঙ্কাকেও বুঝে নিয়েছি। এক ডোজ ওষুধেই বনের হাতি পোষ মেনেছে! মিস্টার গোয়েঙ্কা এখন আমার ফ্রেন্ডের মতো হয়ে গেছেন।”
“তাই তো বললেন, মিস্টার গোয়েঙ্কা। আপনার খুব প্রশংসা করলেন।” সোমনাথ জানালো।
বেশ সন্তুষ্ট হলেন নটবর মিটার। গর্বের সঙ্গে বললেন, “অথচ দেখুন, মোটে তিন্ন টাকা মালের বিল হয়েছিল। আপনাদের বাড়ির মিস্টার মেহতা তো হিন্দুস্থান হোটেলে নিয়ে গিয়ে ওই গোয়েঙ্কার পিছনে সাড়ে তিনশ’ টাকার ফরেন হইস্কি ঢেলেছিল—কিন্তু পারলো কিছু করতে?”
চুপ করে রইলো সোমনাথ। নটবর বললেন, “অত ঘাবড়াচ্ছেন কেন মশাই? সেল করতে গেলেই কিছু, ট্যাক্সো গুণতে হয়—এসব খরচকে সেলস ট্যাক্স মনে করে এ লাইনের লোকেরা।”
সোমনাথের ব্যবসা সম্পর্কে নটবর মিটার এবার আরও কিছু প্রশ্ন করলেন। তারপর বললেন, “খুব দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি আপনার কেসটা খুব শক্ত। কিছু কাঁচা টাকা ঢেলে আপনি গোয়েঙ্কাকে মাল গছাতে পারবেন না। কারণটা অ-আ-ক-খর মতো সিম্পল। ওই যে অপথালমিক হোয়াইটনার এবং একটা কেমিক্যাল আপনি বেচতে চাইছেন তার জন্যে আমারই এক জানাশোনা, পার্টির কাছ থেকে গত তিন বছর ধরে গোয়েঙ্কা একশ’ টাকায় তিন টাকা করে নমস্কার পেয়ে আসছে। আপনি নিজেই তো আড়াই পারসেন্টের বেশি কমিশন পাবেন না। তাহলে নিজের পকেট থেকে আরও আধ পারসেন্ট দিতে হয়। মাওজীর হাতে-পায়ে ধরে আপনি সমান রেট দিলেও ফল হবে না। কোন দুঃখে গোয়েঙ্কা নিজের দেশওয়ালী ভাই ছেড়ে আপনার কাছে আসবে?”
উঠতে যাচ্ছিল সোমনাথ। নটবর বললেন, “আপনি একেবারে হতাশ হবেন না। বাবারও বাবা আছে—হাইকোর্টের ওপরে যেমন রয়েছে সুপ্রীম কোর্ট। গোয়েঙ্কাকে অন্যপথে নরম করতে হবে। আমি তো কাল সকালেই অন্য একটা কাজে গোয়েঙ্কার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। দেখি আপনার জন্যে কোনো পথ বার করতে পারি কিনা।”
সোমনাথ বললো, “মনে হলো, আপনার ওপর ভদ্রলোকের খুব বিশ্বাস আছে। যদি আমার সম্বন্ধে একটু বলে দেন। আমি যে বিশ্বাসযোগ্য লোক সেটাও যদি উনি জানেন।”
নটবর একগাল হেসে বললেন, “অত ছটফট করছেন কেন? বসুন। চা খান। যখন এ-লাইনে প্রথম এলেন তখন বর্ষার পইডগার মতো তাজা কচি মখখানা ছিল। এই কদিনেই শকিয়ে গেলো কেন?”
সোমনাথ বললো, “কিছুতেই কিছু লাগাতে পারছি না, নটবরদা। মিস্টার মাওজী একটা সুযোগ দিলেন—সেটাও যদি হাতছাড়া হয়ে যায়।”
নটবর মিটার লোকটার অন্তর আছে। সোমনাথের কথা শুনে জলে উঠলেন। বললেন, “আপনি কিছুই ভাববেন না। আমার উপর বিশ্বাস করে ছেড়ে দিন, মহাত্মা মিলের গোয়েঙ্কাকে আমি কজা করে দিচ্ছি। আপনার কোনো চিন্তার কারণ নেই—আপনার কাছ থেকে আমি এই কেসে কোনো চাজ করবো না।”
নটবর মিত্তির কী করতে কী করে ফেলবেন কেউ জানে না। তবু সোমনাথ.. আপত্তি করলো না। তার মধ্যে হতাশা আসছে। মনে হচ্ছে এসপার-ওসপার একটা কিছু হয়ে যাক।