খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ভ্যানটা পেরিয়ে এল সুদীপ। আনন্দ তৈরি ছিল। যদি সার্জেন্ট গাড়ি থামিয়ে চ্যালেঞ্জ করত তাহলে তাকে চার্জ করতে হতই। বিনা যুদ্ধে ধরা দেবে না তারা। সার্জেন্টটা ভাগ্যবান। কারণ সে শুধু গাড়ি থেকেই অন্য নাম্বার দেখে মুখ ফিরিয়ে নিল। সুদীপ আনন্দর সতর্কতা লক্ষ্য করেছিল। একটু সহজ হয়ে সে বলল, রাতদুপুরে যে কোন গাড়িতে পুলিশ ইচ্ছে করলে থামাতে পারে। যদি এর পরে কোন ভ্যান আসে তাহলে কি হবে কে জানে। এক রাত্রে বারংবার ভাগ্য পক্ষে থাকে না।
ভাগ্য পক্ষে না থাকলে এতক্ষণ আমরা বাঁচতাম না। পেছন থেকে জয়িতা মন্তব্য করল।
তা যা বলেছিস। সুদীপ হেসে ফেলল, সিনেমায় দেখলে বলতাম, ওয়ান প্লাস ওয়ান।
আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার?
সুদীপ রাসবিহারী পেরিয়ে ল্যান্সডাউনে পড়ে বলল, তুই যদি মোহনলালকে না দেখতিস তাহলে চণ্ডীগড় শব্দটা এবং বনবিহারীবাবুর অস্তিত্ব, সাত নম্বর মালের খবর জানতিস না। আর এইগুলোই হয়ে গেল ওদের কাবু করার মশলা। জয়িতা যদি মালটা না ড়ত তাহলে এতক্ষণ কল্যাণ হয়তো ছবি হয়ে যেত। এই গাড়ির মালিকের যদি পটেটোপটুত্ব না থাকতো তাহলে আমাদের চোরাই গাড়িটাকে পুলিশ এতক্ষণে ধরে ফেলত। বেশ হয়ে যাচ্ছে পর পর মাইরি।
আনন্দ বলল, বাজে কথা বলছিস। রাস্তায় হাঁটতে নেমে যদি গর্ত পড়ে তো সেটাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্যে পরিষ্কার জায়গাটাকে কাজে লাগানো কাকতালীয় ব্যাপার নয়। গর্তে হোঁচট খেয়ে পড়াটাই বোকামি বলে মনে করি। আচ্ছা এদিকে কোন টেলিফোন আছে?
জয়িতা জিজ্ঞেস করল, এত রাত্রে টেলিফোন করবি কাকে?
বলছি। আগে বল কোথায় পাবলিক ফোন আছে?
গড়িয়াহাটের মোড়ে একটা দেখেছিলাম। ওটা রাস্তায় পড়ে থাকে। বাড়িতে গিয়েও করতে পারিস।
জয়িতা কথাগুলো বলতেই সুদীপ মাথা নাড়ল, সেইটেই উচিত হবে। ভোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে এত রাত্রে টেলিফোন করলে পুলিশের নজর পড়বে। অবশ্য টেলিফোন এক্সচেঞ্জে গেলে ঘেরা ঘর পাবি। খুব জরুরি দরকার?
আনন্দ বলল, হ্যাঁ। বাড়ি থেকে করতে চাইছি না। কলকাতার চারটে কাগজের অফিসে ফোন করে আমাদের উদ্দেশ্যটা বলব। ব্রাবোর্ন রোডে এস পি অ্যান্ড কোম্পানির গুদামঘরটা এখনই সিল করে দেওয়া দরকার। চারটে কাগজে খবরটা ছাপা হলে আর চাপা থাকবে না।
শেষ পর্যন্ত ওদের বালিগঞ্জ পার্ক রোডেই চলে আসতে হল। টেলিফোন এক্সচেঞ্জের লোহার গেটটা ভেতর থেকে তালা দেওয়া। পাহারায় যিনি ছিলেন তিনি নিশ্চয়ই নানান প্রশ্ন করবেন। অথবা টেলিফোনের সংলাপ দাঁড়িয়ে শুনতেও পারেন। বিশাল ফ্ল্যাট-বাড়ির ভেতরের পার্কিং লটে গাড়িটা ঢুকিয়ে ওরা নিশ্চিন্ত হল। অন্তত এখানে কিছুক্ষণ পুলিশের ভয় নেই। কল্যাণ অবশ্য অনেকটা স্থির। তবে তার হাত ভেঙেছে, সামান্য নাড়াবার ক্ষমতা তার নেই। ওর ব্যাগটা আনন্দ নিয়ে নিল। এখন কেউ জেগে নেই কোথাও। শুধু অনেক ওপরের একটা ফ্ল্যাট থেকে বিদেশী বাজনা ভেসে আসছে। গেটে দারোয়ান ছিল। সে তাদের ঢুকতে দেখেছে। কিন্তু চত্বরে আর কাউকে চোখে পড়ল না। রাত্রে লিফটম্যান থাকে না। দরজা খুলে জয়িতা বন্ধুদের নিয়ে ঢুকল। অটোমেটিক লিফট ওদের ফ্লোরে পৌঁছে দিতে সে বলল, যা বলার আমি বলব। যদি কোন ঝামেলা না হয় তাহলে তোরা ঢুকবি। আর তেমন হলে আমরা মালগুলো নিয়ে বেরিয়ে যাব।
জয়িতা বেলের বোতামে চাপ দিল। সুদীপ বলল, কে খারাপ নাকি?
এই সময় দরজাটা খুলে গেল। রামানন্দ রায় রাতের পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছেন। মেয়ের দিকে তাকালেন তিনি। আনন্দরা একটু আড়ালে থাকায় তার নজরে পড়েনি। রামানন্দ বললেন, এসো।
জয়িতা ঘরে ঢুকল, মা কোথায়?
শুয়ে পড়েছে। ওর মনের অবস্থা ভাল নয়। এত রাত্রে কিভাবে এলে? রামানন্দকে খুব গম্ভীর দেখাচ্ছিল।
আমার বন্ধুরা সঙ্গে আছে। ওদের ভেতরে আসতে বলতে পারি?
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। রামানন্দ ফিরে গেলেন হলঘরের দিকে। জয়িতা ওদের ডেকে ভেতরে এসে দরজা বন্ধ করল। তারপর সুদীপ যে ঘরে ছিল সেইদিকে পা বাড়াল। দূর থেকে রামানন্দ বললেন, জয়, তোমার এবং তোমার বন্ধুদের সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই।
জয়িতা ঠোঁট কামড়াল, আমার সঙ্গে বললে চলবে না? আমিই তোমাকে বলব ভেবেছিলাম! রামানন্দ বললেন, ঠিক আছে। আমি পনেরো মিনিট বাদে আসছি। তোমরা রেস্ট নাও।
ঘরে ঢুকে কল্যাণ ধীরে ধীরে সোফায় হেলান দিয়ে বসল। এবার সুদীপ ওর হাতটা পরীক্ষা করতে করতে স্বস্তির শব্দ করল, নাঃ, সিম্পল ফ্যাকচার! ভয়ের কিছু নেই।
কল্যাণ মাথা নাড়ল, শুরুতেই আমি অকেজো হয়ে গেলাম। কি করি বল্ তো?
আনন্দ এগিয়ে এল কল্যাণের সামনে, অকেজো মানে? একটা হাত কিছুদিনের জন্যে ব্যবহার করতে না পারাটাকে কি অকেজো বলে? বাজে কথা না বলে রেস্ট নে।
কল্যাণ তবু মানছিল না, জয়িতা যদি না বাচাত! আমি তোদের বোঝা হয়ে গেলাম।
সুদীপ হেসে উঠল, এ ব্যাটার মাথায় শুধু একই চিন্তা। আমার যদি একটা পা উড়ে যেত তোরা কি করতিস? এসব চিন্তা করা মানে বন্ধুদের তোর সম্পর্কে সন্দেহগ্রস্ত করে দিচ্ছিস।
কল্যাণ আর কোন কথা বলল না। সুদীপ জয়িতাকে জিজ্ঞাসা করল, বিশ্বাস করা যায় এমন ডাক্তার আছে এখানে? কাল সকালের আগে তো ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যাবে না।
কল্যাণ মাথা নাড়ল, এখনও যন্ত্রণা হচ্ছে ওর, হাসপাতালে গেলে আমি ধরা পড়ে যাব।
জয়িতা বলল, নাঃ, আমি তো কারও ওপর রিলাই করার কথা ভাবতে পারছি না।
আনন্দ জয়িতার দিকে ফিরে তাকাল, তুই তোর বাবার সঙ্গে কি আমাদের ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলবি? এই ব্যাপারটা করার আগে আমাদের সঙ্গে তোর আলোচনা করা দরকার ছিল!
আমি এমন কিছু বলব না যা তোদের ক্ষতি করবে। ট্রাস্ট মি। জয়িতা হাসার চেষ্টা করল, তুই ফোন করবি বলছিলি, বাবা আসবার আগে সেটা করে নে।
জয়িতাকে অনুসরণ করে আনন্দ হলঘরটায় এল। রামানন্দ রায় এখানে নেই। শূন্য ঘরটায় আলো জ্বলছে। টেলিফোনের পাশের চেয়ারটায় বসে আনন্দ সর্বাধিক প্রচারিত কাগজটির নাম্বার গাইড থেকে খুঁজে বার করে জয়িতাকে বলল, বাকি তিনটে কাগজের নাম্বার বের করে রাখ।
জয়িতা আবার হাসল, গড়িয়াহাটার টেলিফোনটা পেয়ে কাজ হত না। তুই সেখানে গাইড পেতিস। তোর উচিত ছিল আগে থেকে নাম্বারটা নোট করে রাখা।
কলকাতায় রাত্রে সবকিছু ঠিকঠাক থাকে। একবারেই লাইন পেয়ে গেল। ওপাশ থেকে হ্যালো শুনে আনন্দ বলল, আমি একটা জরুরি খবর দেব। দায়িত্ববান কেউ কিংবা নিউজ এডিটার আছেন?
আপনি কে বলছেন?
আমার পরিচয় পরে দিচ্ছি, আপনি কে?
আমি এই কাগজের রিপোর্টার। নাইট ডিউটিতে আছি। বলতে পারেন যা বলবার।
শুনুন, খানিক আগে বড়বাজারের সত্যনারায়ণ পার্কের পাশে মোহনলালজীর বিরাট ওষুধের কারখানা উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ওটাতে আগুন লেগেছে। মোহনলাল দুটো জাল ওষুধের কারবার করতেন। যার একটা খেলে ক্ষতি হত না কাজও দিত না। দুটো খেলে প্রাণহানির সম্ভাবনা থাকত। আমরা মনে করেছি এই ধরনের মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার নেই। মোহনলাল অক্ষত আছেন, তার নিরীহ কর্মচারীরাও সম্ভব–, কিন্তু কারখানা ধসে গেছে।
আপনারা কারা?
আমরাই ডায়মন্ডহারবার রোডে প্যারাডাইস ধ্বংস করেছি। আইনের ফাঁক ব্যবহার করে যারা সাধারণ মানুষের সর্বনাশ করছে তাদের আমরা একে একে ধ্বংস করব। মোহনলালের জাল ওষুধ স্টক করা আছে ব্র্যাবোর্ন রোডের এস পি অ্যান্ড কোম্পানির স্টোর রুমে। ওখান থেকে ওটা সরিয়ে নেওয়ার আগেই আপনারা খবর নিন। আপনাদের কাগজের মাধ্যমে আমরা সেইসব মানুষকে সতর্ক করে দিচ্ছি, যাতে তারা হাত পোটায়, নইলে একটির পর একটি এই ধরনের অ্যাকশন নেব আমরা। আমরা চাই একটি সুষম সমাজব্যবস্থা। বর্তমান সংবিধানের আশ্রয়ে তা সম্ভব নয়। এই সব কাজগুলো সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করুক এটাই কাম্য।
রিসিভার নামিয়ে রেখে পর পর তিনটি কাগজে একই কথা বলল আনন্দ। শেষের কাগজের এডিটার স্বয়ং ফোন ধরেছিলেন। রাজনৈতিক রচনা লিখে তিনি খুব জনপ্রিয়। ফোন নামাবার আগে প্রশ্ন করলেন, আপনারা কি নকশালপন্থী?
আনন্দ বলল, না। আমাদের আগে কেউ এই পথে হাঁটেননি।
এডিটার প্রশ্ন করলেন, আপনাদের নেক্সট অ্যাকশন জানতে পারি?
রেসকোর্স। রিসিভার নামিয়ে রেখে আনন্দ বলল, এক গ্লাস জল খাওয়াবি জয়?
জয়িতা চাপা গলায় বলল, তোর কি মাথাখারাপ হয়ে গেছে? রেসকোর্সের কথাটা বলে দিলি? আনন্দ উঠে সুদীপদের ঘরের দিকে এগোতে এগোতে বলল, রবীনহুডের মত কায়দা আর কি। না , আমাদের সেই রঘু ডাকাতই তো এমন করত। আমরা এই মুহূর্তে রেসকোর্সকে কিছু করতে পারব। যত সহজে দুটো কাজ করেছি রেসকোর্সে তা সম্ভব হবে না। কাগজে যদি বের হয় খবরটা তাহলে তার নিশ্চয়ই প্রতিক্রিয়া হবে, সেটাই দেখার।
জল খেয়ে আনন্দ বন্ধুদের কাছে ফোনের কথা বলল। অন্তত কাল সকালে কাউকে আর অনুমানের মধ্যে থাকতে হবে না, কে বা কারা কেন এই কাজ করল। জনসাধারণের প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট বোঝা যাবে। রেসকোর্সের ব্যাপারটা সে খুলে বলল। সরকারের প্রত্যক্ষ মদত পাচ্ছেন রেসকোর্সের কর্মকর্তারা। কারণ প্রচুর ট্যাক্স আসছে ওখান থেকে। বোমা বা গ্রেনেড ছুঁড়ে রেসকোর্স উড়িয়ে দিলে কোন কাজ হবে না। আস্তাবল থেকে যে ঘোড়াগুলো রেস করতে মাঠে আসে তাদের ক্ষতি করে কি লাভ! কিন্তু একটা ভয়ের আবহাওয়া তৈরি করতে হবে। প্রথমেই তার শিকার হবে দামী ঘোড়ার মালিকরা। তারা যদি এখান থেকে বোড়া বোম্বে ব্যাঙ্গালোরে নিয়ে যায় তাহলে এখানকার রেসে ভিড় কমবে।
সুদীপ বলল, তাতে আমাদের কোন লাভ হচ্ছে না। শুনেছি বোম্বেতে ঘোড়া ছুটছে আর কলকাতা রেসকোর্সে তার রিলে শুনে লোকে টাকা লাগাচ্ছে। লাগাতার একটা প্যানিক তৈরি করতে পারলে ওখানকার ভিড় কমবে। কিন্তু কলকাতা না, হয় বন্ধ হল, বোষে-মাদ্রাজ-ব্যাঙ্গালোরে তো চলবে!
আনন্দ মাথা নাড়ল, কলকাতায় আমাদের দৃষ্টান্ত অন্যান্য শহরের ছেলেদের উদ্বুদ্ধ করবে, দেখিস।
কল্যাণ চোখ বন্ধ করে পড়েছিল। মাঝে মাঝে যন্ত্রণাটা যে পাক দিয়ে উঠছে তা ওকে দেখে বোঝ যাচ্ছিল। একটু সামলে নিয়ে সে বলল, কলকাতার রেস যদি ভয়ে বন্ধও হয়, পাড়ায় পাড়ায় যে স্লিপ খেলা চলে তা কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। সেটা বন্ধ করবি কি করে?
আনন্দ বলল, সেটা সরকারই বন্ধ করবে। কারণ তা থেকে কোন ট্যাক্স পাবে না।
জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, তুই তাহলে সরকারের ওপর এখনও আস্থা রাখিস, সিনেমা হলে যে টিকিট ব্ল্যাক হয় তা থেকে তো সরকার একটা পয়সাও ট্যাক্স পায় না, বন্ধ করছে?
কল্যাণ কিছু বলতে যাচ্ছিল এমন সময় বাইরে থেকে রামানন্দ রায়ের গলা শোনা গেল, জয়!
জয়িতা বন্ধুদের দিকে তাকাল। সুদীপ বলল, তুই ওঁকে এখানেই আসতে বল্ না।
জয়িতা মুখ ফেরাল, কেন?
সুদীপ কাঁধ ঝাঁকাল, উই ক্যান হেল্প ইউ। ঠিক মাঝরাত্তিরে লাগে ঘোর চিত্তিরে, কি বলতে কি বলে ফেলবি তার কোন ঠিক নেই। সবাই মিলে ম্যানেজ করব এই শেলটারটার জন্যে।
জয়িতা আনন্দকে বলল, আমি একথার প্রটেস্ট করছি। এতে আমার ওপর অনাস্থা প্রকাশ পাচ্ছে। ওয়েল, আমি বাবাকে ডাকছি। জয়িতা দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল, ডাকছ?
রামানন্দ রায় শান্ত গলায় বললেন, তুমি আমার সঙ্গে কথা বলতে চাও?
হ্যাঁ। এই ঘরে এসো। জয়িতা সরে দাঁড়াল। রামানন্দ বিস্মিত হলেন। তারপর ধীরপায়ে ভেতরে ঢুকলেন। তিনজনেই ওঁর দিকে কিছুটা সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে তাকাল। জয়িতা পরিচয় করিয়ে দিল, সুদীপকে তুমি দেখেছ, এ হল কল্যাণ আর ও আনন্দ।
আনন্দ ঠিক বুঝতে পারছিল না এই লোকটিকে উঠে দাঁড়িয়ে কতটা সম্ভম জানানো যায়। কিন্তু রামানন্দ রায় কোনদিকেই তাকাচ্ছিলেন না। তাকে বেশ চিন্তিত এবং কাহিল দেখাচ্ছিল। আনন্দ বলল, বসুন। সে উঠে সুদীপের পাশে বসে জায়গা খালি করে দিল।
রামানন্দ রায় বসলেন না। বললেন, কিছু মনে করো না, এত রাত্রে তোমরা যেভাবে ঘোরাফেরা করছ তাতে সন্দেহ হচ্ছে এমন কোন কাজ করছ যা খুব স্বাভাবিক নয়। আমি কোন মন্তব্য করছি না, কিন্তু জয়, তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি, যা করছ তা কি ঠিক মনে করছ?
নিশ্চয়ই। জয়িতা খুব দৃঢ়তার সঙ্গে জবাব দিল।
রামানন্দ রায় চোখ তুলে মেয়ের দিকে তাকাতেই কল্যাণকে দেখতে পেলেন। সেই মুহূর্তে আর একটা যন্ত্রণার ঢেউ পাক খেয়ে ওর হাত থেকে শরীরে গড়াচ্ছিল। দাঁতে দাঁত চেপে সামলাচ্ছিল সে। তিনি দ্রুত কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কি হয়েছে তোমার?
সেই অবস্থায় কল্যাণ একটু জোরে মাথা নাড়ল, কিছু না, কিছু হয়নি।
সুদীপ আনন্দর দিকে তাকাল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, একটু আগে ও আছাড় খেয়ে পড়ে গিয়েছিল। সিরিয়াস কিছু নয় বলে মনে হচ্ছে।
তুমি কি ডাক্তার? রামানন্দ রায় ধমকে উঠলেন, ও তো হাতটা নাড়তেই পারছে না! দেখি ঠিক কোন্খানে ব্যথা? জখম হাতটা ধরতেই ককিয়ে উঠল কল্যাণ। ভয় পেয়ে হাত ছেড়ে দিলেন রামানন্দ।
সুদীপ মন্তব্য না করে পারল না, আপনিও ডাক্তার নন।
সেটা আমি জানি। কিন্তু এই ছেলেটিকে এইভাবে রেখে দিয়েছ তোমরা? ওর হাতের হাড় ভেঙেছে বলে সন্দেহ হচ্ছে আমার। ইমিডিয়েটলি ডাক্তার ডাকা দরকার। কটা বাজে এখন? ওহহো, রাত দুটো বেজে গেছে! কাকে ডাকা যায়? নিজের সঙ্গে কথা বলছিলেন তিনি।
এবার আনন্দ বলল, এখন বোধ হয় কাউকে না ডাকাই উচিত। আপনার কাছে ঘুমের ওষুধ আছে? ও যদি ঘুমোতে পারে তাহলে সকালবেলায় আমি হাসপাতালে নিয়ে যাব।
রামানন্দ রায় কথা না বলে সোজা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। সুদীপ জয়িতাকে বলল, দ্যাখ উনি কোন ডাক্তারকে ফোন করছেন কিনা। ডাক্তার এসে যদি আমাদের ওর সঙ্গে দেখে, তাহলে কাল সকালে কাগজ পড়ার পর দুই-এ দুই-এ চার করতে দেরি হবে না। আচ্ছা লোক।
জয়িতাকে একটু অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল। সে বলল, তোদের হয়তো খারাপ লাগছে কিন্তু আমি খুশি। মানুষটা যে এত গুরুত্ব দিয়ে ব্যাপারটা দেখবেন তা কল্পনা করিনি। কখনও কেউ যখন কারও জন্যে কেয়ার নেয় তখন আমার ঈর্ষা হয়। আজ সেটা একটুও হচ্ছে না। ওই মানুষটি এভরিথিং অলরাইট ছাড়া কখনও আমার মনের কথা জানতে চাননি।
এমন একটা বিষণ্ণ সুর ছিল যে সুদীপ পর্যন্ত চুপ করে গেল। এই সময় রামানন্দ ফিরে এলেন, জয়, ওকে এক গ্লাস জল দাও। এই ট্যাবলেট দুটো খেয়ে নাও তুমি। পেনকিলার, ঘুমিয়ে পড়বে?
ট্যাবলেট! কল্যাণ আনন্দর দিকে তাকাল। তারপর বলল, আমাকে একটা ট্যাবলেট দিন।
কেন? দুটো খেলে সকালের আগে ব্যথাটা টের পাবে না—দুটোই খেয়ে নাও।
না, আমি কোন রিস্ক নেব না।
রিস্ক? এতে রিস্কের কি আছে। রামানন্দ বুঝতে পারছিলেন না।
আনন্দর হাসি পাচ্ছিল। কিন্তু এখন কিছু বলা ঠিক হবে না। কল্যাণের মত শিক্ষিত ছেলেও ওই ব্যাপারটা জানার পর থেকে যে কোন সরষের মধ্যেই ভূত দেখছে। জয়িতা কল্যাণকে একটি ট্যাবলেট খাইয়ে দিল। রামানন্দ রায় মাথা নাড়লেন, মনে হয় কোন কাজ হবে না। এরকম কথা কখনও শুনিনি, দুটো ট্যাবলেট খাওয়া মানে রিস্ক!
খালি সোফাটায় বসলেন রামানন্দ। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, জয়, তোমার কিছু বলার আছে?
জয়িতা মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।
এখন কেউ কোন শব্দ করছে না। অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ঘরে। রামানন্দ রায় মুখ তুলছিলেন না।
শেষ পর্যন্ত জয়িতা বলল, তুমি কি আমার কাছ থেকে কিছু আশা কর?
আমি রামানন্দ রায় মেয়ের দিকে তাকালেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, তুমি ভাল থাক, এইটুকু।
তুমি কি মনে কর ভারতবর্ষের এই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, এবং সামাজিক অবস্থায় কেউ ভাল আছে? যারা বলে আছে তারা চোখ বন্ধ করে ভাল থাকার ভান করে রয়েছে। বাবা, আমার পক্ষে চিরায়ত নিয়মগুলো মেনে জীবনযাপন করা সম্ভব নয়। সুতরাং আমি হয়তো, হয়তো কেন, নিশ্চয়ই যে কোন দিন এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে পারি। ডোন্ট আস্ক মি কোথায় যাচ্ছি। শুধু জেনো আমরা একটা কাজ করতে চাইছি, যা কেউ করে না। আমরা মানুষের বিবেকের অটল পাথরটাকে নাড়াতে চাইছি। প্রতিবাদ করলে, এক সময় সেই ভাষাটা সাধারণ মানুষের রপ্ত হয়ে গেলে, এই গণতন্ত্রের সুবিধেভোগী শক্তিগুলো ভয় পাবে বলে বিশ্বাস করি। না, কোন রাজনৈতিক দলের কার্যসূচী আমরা অনুসরণ করছি না। পণ্ডিতরা আমাদের আচরণকে পাগলামো বলবেন, ছেলেমানুষী কিংবা অশিক্ষাপ্রসূত বলে উড়িয়ে দেবেন। অনেক তো দেখলাম। বিখ্যাত বিখ্যাত তত্ত্ববিদ অনেক থিয়োরি শুনিয়েছেন, ময়দানের বক্তৃতায়, পার্টির বুলেটিনে কিংবা সাপ্তাহিকের পাতায়। আর এইসব শুনিয়েই তারা বৃদ্ধ হয়ে মরে যাবেন। ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষ যেখানে ছিল সেখানেই থাকবে। এই থিয়োরির ভাষা ওদের অজানা থাকবেই। কিন্তু ওরা চোখের সামনে দেখবে এই লোকগুলো অন্যায় করছিল, শাসকদলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে শোষণ করছিল আর কয়েকটা ছেলেমেয়ে সরাসরি তাদের আঘাত করছে। এই আঘাত করা যায়। নকশালবাড়ির আন্দোলনের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা আছে। কিন্তু তাদের পথ আমরা মানি না। আমাদের দুর্ভাগ্য যে ভারতবর্ষ আজ ব্রিটিশ রাশিয়া কিংবা আমেরিকার পরাধীন নয়। তাহলে দ্রুত আগুন জ্বলত। প্রতিটি মানুষের বুক ভিয়েৎনাম হয়ে যেত। আমাদের প্রতিপক্ষ যেহেতু আমরা তাই সময় লাগছে। আমরা কি করে ভাল থাকব, বল? জয়িতা বড় বড় নিঃশ্বাস নিল।
আনন্দ অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। জয়িতা যে এইভাবে মুখের ওপরে কথাগুলো বলতে পারবে তা সে ভাবতে পারেনি। সুদীপ খুব অস্বস্তি বোধ করছিল। উত্তেজিত হয়ে জয়িতা যে ভঙ্গিতে কথা বলছে। তা তার মোটেই ভাল লাগছে না। এই লোকটির কাছে সব কথা ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখনও কেউ কোন কথা বলল না। কল্যাণ চোখ বন্ধ করে সোফায় হেলান দিয়ে পড়ে ছিল, একইভাবে থাকলে বোধ হয় তার যন্ত্রণা কম হচ্ছিল। রামানন্দ পূর্ণ দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, আমি দুঃখিত। আমি তোমার বন্ধুদের সঙ্গে জড়িয়ে তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম। আমার সম্পর্কে তোমার বক্তব্য?
জয়িতা এক মুহূর্তের দ্বিধা কাটিয়ে উঠল, আমি তোমাকে আর মাকে একদিন চিল্কার করে বলেছিলাম, ঘেন্না করি, তোমরা কিছুই করোনি আমার জন্যে। নিজেদের পার্থিব আনন্দ আর শারীরিক তৃপ্তির জন্য টাকা রোজগার করে গেছ। তুমি যা মাইনে পাও তা দিয়ে এত পার্টি এত মদ আর মায়ের এত বিলাস মেটানো যায় না। এসব তোমাদের ব্যাপার। আমাকে পড়াশুনার সুযোগ আর খাওয়াপরার স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েই তোমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে গিয়েছে। তোমাদের মত এই দেশের সব বাবা-মা একই চিন্তা করে, কেউ ভাবে না পরবর্তী প্রজন্ম তৈরি করার দায়িত্ব তাদের। এই দেশের জন্যে আগামী প্রজন্মকে শিক্ষিত করতে তাদের সময় দিতে হবে। নিজেকে ভীষণ অবহেলিত মনে হত এক সময়। এখন আর কিছু মনে করি না। যার কাছে কোন আশা করার নেই তার সম্পর্কে কোন ভাবনাও থাকে না। তোমাদের সঙ্গে আমার যোগাযোগের সুতোটা কখন ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে।
জয়িতা চুপ করলে রামানন্দ কোন কথা বললেন না। হঠাৎ কল্যাণ চোখ খুলে ধীরে ধীরে বলল, ঠিক কথা। এ কথা আমারও। তবে তোর বাবা-মায়ের অর্থ ছিল আর আমার বাবা-মা ঠিক উলটো অবস্থায় থেকে একই আচরণ করেছিল।
শেষ পর্যন্ত রামানন্দ উঠে দাঁড়ালেন, আমি তোকে বুঝতে পারছি না। তুই কোথায় এইসব কথা শিবাল? এই মানসিকতা কি করে হল তোর? আমার অজান্তে কখন তুই এত দূরে পৌঁছে গেলি?
এ প্রশ্নের কোন উত্তর দিল না জয়িতা।
হঠাৎ রামানন্দ সুদীপের দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কি আজ রাত্রে কোন কিছু করেছ?
সুদীপ ঠোঁট কামড়াল, আপনার মেয়েকে জিজ্ঞাসা করুন। আপনি তো ওর সঙ্গেই কথা বলছেন।
রামানন্দ বললেন, তোমরা সবাই একই সঙ্গে পড়, না?
আনন্দ জবাব দিল, হ্যাঁ।
রামানন্দ বললেন, জয়, তোমার মা এইসব কথা জানেন না। আমার মনে হয় ওঁকে জানানোর দরকার নেই। উনি ঠিক মানতে পারবেন না। তবে জেনো তঁাকে দোষ দেওয়া ঠিক হবে না। কারণ সব মেয়ে একই ধরনের মা হতে পারে না। যে যার নিজের মত তা হয়ে থাকে। বাইরের জগতের ওপর ওঁর এই আকর্ষণের জন্যে আমারও দায়িত্ব ছিল। তোমরা এখন এই বাড়িতে এসেছ তাও তার জানা নেই। নীতিহীনতা যদি তোমাদের লক্ষ্যবস্তু হয় তাহলে তোমরা আমাদেরও খুন করতে পারো। পাশের ঘরে গিয়ে তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় পেয়ে যাবে, কিন্তু আমি বলছি এটাও সঠিক পথ নয়। কিন্তু নিজে যেহেতু কিছু করতে পারিনি তাই তোমাদের বাধা দেব না। দু হোয়াটএভার ইউ লাইক, আমি বাধা দেব না। কিন্তু একটা কথা বলব। একটি শিক্ষিত রাষ্ট্রের পুলিস এবং সংগঠিত সামরিক শক্তির চোখ এড়িয়ে বেশিদিন তোমরা এসব করতে পারবে না। অবশ্য তোমরা ঠিক কি করছ তা আমি জানি না। আমি সীতাকে বলব তোমাদের যেন বিরক্ত না করে। আর হ্যাঁ, ওই ছেলেটির ইমিডিয়েটলি ট্রিটমেন্ট হওয়া দরকার। কাল সকালে আমি আমার এক বন্ধুর নার্সিং হোমে নিয়ে যাব।
রামানন্দ রায় চলে গেলেন। হঠাৎ খুব বয়স্ক মনে হচ্ছিল তাকে। পিঠটা কুঁজো হয়ে গেছে। প্রায় নিঃশব্দে তিনি বেরিয়ে যাওয়ার পর সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, এবার কি হবে?
আনন্দ পা ছড়াল, আমার বিশ্বাস ভদ্রলোকের কাছ থেকে কোন ক্ষতির আশঙ্কা নেই।
সুদীপ প্রতিবাদ করার চেষ্টা করল, কিন্তু উনি যদি একটা টেলিফোন করেন তাহলে আমাদের কয়েক বছর জেল তো অবশ্যই, ফঁসিও হতে পারে। সেটা যেচে চাইছি কেন?
জয়িতার হঠাৎই নিজেকে খুব দুর্বল বলে মনে হচ্ছিল। সে মাথা নাড়ল, আনন্দ ঠিকই বলছে। রামানন্দ রায় আমাদের কোন ক্ষতি করবেন না। ভয় হচ্ছে আমার জননীকে।
আগামীকাল সেটা চিন্তা করা যাবে। আমার মনে হয় প্রোগ্রাম চেঞ্জ করা উচিত। এখন এই রাত্রে রাস্তায় কোন গাড়ি আছে বলে মনে হয় না। সেই লোকটা যদি থানায় জানায় তাহলে আমরা ঠাকুরপুকুরে যাওয়ার সময় সহজেই ধরা পড়তে পারি। ওয়েল, আমি ধরছি চান্স ফিফটি ফিফটি। তাছাড়া গাড়িটা রাখবি কোথায়? ভোরবেলা অবধি লোকটা যদি অপেক্ষাও করে তাহলে প্রিয়া সিনেমার কাছে না পেয়ে সোজা থানায় যাবে। আমরা গাড়িটা ঠাকুরপুকুরে নিয়ে গেলে আর দেখতে হবে না। দ্বিতীয়ত, কল্যাণকে ফেলে রেখে আমরা যেতে পারি না। ঠাকুরপুকুরে ওর ট্রিটমেন্ট কেমন হবে তা আমরা জানি না। এসব ঝুঁকি আমাদের হয়তো নিতেই হত কিন্তু জয়ের বাবাকে আমার এখন বিশ্বাস করা যায় বলে মনে হচ্ছে। ঝুঁকি নিবি কিনা ভেবে দ্যাখ। আনন্দ জানাল।
সুদীপ বলল; গাড়িটা আমি ঠাকুরপুকুরে নিয়ে যেতাম না। খুব ভোরে প্রিয়া সিনেমার আশপাশে পার্ক করে ওখান থেকেই ট্যাকসি নিতাম। ওয়েল, আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। তোরা দেখছি টায়ার্ডও হচ্ছিস। কিন্তু কোথায় ঘুমাব? যে যেখানে শোও আমি বিছানাটা নিচ্ছি। এনি বডি ক্যান শেয়ার উইথ মি।
জুতোটা খুলে টয়েলেটের দিকে এগোচ্ছিল কিন্তু জয়িতা বাধা দিল, তুই একটা ব্যাপার একদম ভুলে যাচ্ছিস।
কোন ব্যাপার? সুদীপ দাঁড়াল।
গাড়িটাকে নিচে রেখে এসেছিল। ওটাকে এখান থেকে অবিলম্বে বিদায় করা দরকার।
ওঃ গড। তোদের উচিত ছিল ড্রাইভিং শিখে নেওয়া। কাহাতক গাড়ি চালানো যায়! জয়, তুই ট্রাই করবি এখন? খুব ঘুম পাচ্ছে আমার। সুদীপ হাই তুলল।
আনন্দ বলল, না রে সুদীপ, ওর যাওয়া ঠিক হবে না। শেষ রাত্রে কলকাতার রাস্তায় কোন মেয়ে একা গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে এ-দৃশ্য অনেকের সহ্য হবে না। চল তোতে আমাতে এখনই বেরিয়ে পড়ি। প্রিয়া সিনেমার কাছাকাছি যেতে হলে আর দেরি করা ঠিক হবে না। কে জানে ভোরে আমাদের জন্যে কোন ট্র্যাপ পাতা থাকবে কিনা!
জয়িতা বলল, প্রিয়া সিনেমার কাছাকাছি যেতে হবে কেন? তোরা বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের কোথাও রেখে আয়। গাড়িটা দূরে থাকলেই তো হল।
সুদীপ মাথা নাড়ল, নোআই মাস্ট গো দেয়ার। লোকটা নির্ঘাত কাল সকাল পর্যন্ত মন স্থির করতে পারবে না। যদি এসে গাড়িটা পেয়ে যায় তাহলে স্রেফ চেপে যাবে। পুলিশ জানতেই পারবে না। ওরা ভাববে আমরা ইলিয়ট রোডের কাছাকাছি শেলটার নিয়েছি। তুই যেটা বলছিস আনন্দ সেটারও সম্ভাবনা আছে। ফঁদ পাতা থাকতে পারে। তবে তার সময় এখনও হয়নি। কিন্তু কথা হল এখন ওখানে পৌঁছে ফিরব কি করে?
হেঁটে। পায়ে পায়ে। পণ্ডিতিয়া দিয়ে শর্টকাট করে এলে মাইলখানেকও হবে না। লেটস গো।
আনন্দর সঙ্গে বের হবার আগে সুদীপ জয়িতার দিকে তাকিয়ে বলল, কল্যাণ ঘুমিয়ে পড়লে আপত্তি নেই। কিন্তু তুমি বিছানায় বডি ফেলল না। আমরা ফিরে আসা পর্যন্ত জেগে থাকবে। নইলে বেল বাজালে তোর মা হয়তো দরজা খুলে ডাকাত বলে চেঁচাবে।
কল্যাণের ঝিমুনি আসছিল। ওর কনুই-এর কাছটায় জখম হয়েছে। জয়িতা ওকে বিছানায় শুয়ে পড়তে বলল। তারপর আলো নিবিয়ে নিজের ঘরে চলে এল। আসবার সময় দেখল রামানন্দ এবং সীতা রায়ের ঘরের দরজা বন্ধ। এবং তখনই জয়িতার মনে হল তার স্নান করা দরকার। সন্ধ্যে থেকে একটার পর একটা টেনশনে শরীর আর বইছে না। দারুণভাবে টানছে বিছানা। অথচ ওরা যখন এত করার পরও আবার বের হতে বাধ্য হল তখন তার ঘুমানোটা অপরাধ। জানলার কাছে পৌঁছে পান্না দুটো খুলে দিতে ঠাণ্ডা বাতাস এল। ঝিম ধরে আছে কলকাতা। এত ওপর থেকে শেষ রাতের দিকে এগোনো শহরটার ঘুমন্ত চেহারাটা দেখে জয়িতার মনটা হঠাৎ নরম হয়ে এল। একটাও গাড়ির হেডলাইট নেই, হলদে আলোয় রাস্তাগুলো আরও নির্জন হয়ে গেছে। কাছে কিংবা দূরে কোন বাড়ির খোপে আলো জ্বলছে না। হঠাৎই দৃশ্যটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। কল্যাণ পড়ে গেছে এবং লোকগুলো ওকে জাপটে ধরেছে। সেই মুহূর্তে কি তার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল? নইলে হঠাৎ তার শরীরে কোন শক্তি ভর করেছিল? কল্যাণকে মুক্ত করতেই হবে—শুধু এই চিন্তাটাই তাকে উদ্দাম করে তুলেছিল। কিন্তু সে পেরেছিল। গ্রেনেডটা ছোড়ার কোনরকম মানসিক প্রস্তুতি ছাড়াই তার হাত সক্রিয় হয়েছিল। নইলে কল্যাণকে কোনদিন আর ফেরত পাওয়া যেত না। নিজেকে তার অন্য রকম লাগছিল। সেই জয়িতা, যে কেবল দুঃখ পেত, এত বড় ফ্ল্যাটে একা একা থেকে নিজেকে যে শুধু অবহেলিত ভাবত সে কোথায় হারিয়ে গেল। এখন আমার একটু স্নান চাই। জয়িতা বাথরুমে ঢুকে পড়ল।
মাথায় ঠাণ্ডা জলের ধারা, সারা শরীর বেয়ে তা গড়িয়ে পড়ছে, জয়িতার মনে হল এর চেয়ে শান্তি আর কোথাও নেই। রামানন্দ রায়ের মুখটা মনে পড়ল তার। এই প্রথম সে ওঁর মুখের ওপর কথাগুলো বলতে পারল। কিন্তু তার পর থেকেই একধরনের ক্ষরণ শুরু হয়েছে মনে। কিরকম কুঁকড়ে গেল রামানন্দ রায়ের মুখ। অমন অসহায় সে কোনদিন হতে দ্যাখেনি মানুষটাকে। যে কোনভাবে আসা অর্থের স্রোত এবং নিমেষে সমশ্রেণীর মানুষের দ্রুতগতির জীবন রামানন্দকে প্রলুব্ধ কবেছে যৌবনকে ধরে রাখতে। আজ যেন এক নিমেষেই মানুষটা অতিরিক্ত প্রৌঢ় হয়ে গেল।
পরিষ্কার হয়ে ঘরে ফিরে সেই জমকালো শাড়িটা বের করল সে। হঠাৎ তার ইচ্ছে করল শাড়ি পরতে। শেষবার প্যারাডাইসের কাণ্ডটা হবার পর সে গাড়িতে বসে শাছি খুলেছিল। ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য কিনা এখনই সন্দেহ হচ্ছে। কিন্তু খুলতে তত পেরেছিল আবু রেখ। কত কি না হাস্যকর ব্যাপার এক জীবনে মানুষকে করতে হয়। এমন কি সেই পরচুলাটা! জয়িতার মনে পড়ল সেটাকে কোথায় রেখেছে। না, ফেলে দিতে হবে। সুদীপের পরামর্শে কিনতে হয়েছিল কন্তু পরচুলা আর নকল দাড়ি তার কাছে একই ব্যাপার। শাড়ি ব্লাউজ পরে জয়িতা ঘড়ি দেখল। খদের ফিরতে চারটে তো বাজবেই। এবং এই সময়টা তাকে জেগে থাকতে হবে। কি করা যায়! সেফ থেকে একটা বই নিয়ে বসল সে। ঘাড়ে হাওয়া লাগায় বেশ আরামবোধ হচ্ছে। কয়েক লাইনে চোখ বুলিয়ে পড়তেই ইচ্ছে করল না বইটা। সে ওটাকে সেলফে রেখে আর একটা তুলে নিয়ে পাতা ওলট তে লাগল।
সারাদিন মিছে কেটে গেল,
সারারাত বড় খারাপ
নিরাশায় ব্যর্থতায় কাটবে; জীবন
দিনরাত দিনগত পাপ
ক্ষয় করবার মতো ব্যবহার শুধু
ফণীমনসার কাটা তবুও তো স্নিগ্ধ শিশিরে
মেখে আছে; একটিও শূন্যে নেই;
সব জ্ঞানপাপী পাখি ফিরে গেছে নীড়ে।
জীবনানন্দের কবিতার বইটি হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল জয়িতা। বুকের মধ্যে অদ্ভুত একটা কষ্ট থম ধরে আছে। এখন কলকাতার, এই কলকাতার সব জ্ঞানপাপী ফিরে গেছে নীড়ে। তারপরেই এক ঝটকায় সোজা হয়ে বসল সে। কবিতার বইটি রেখে দিল সেলফে। না, শুধু দিনগত পাপক্ষয় করার জন্যে সে বেঁচে থাকবে না। এই হতাশা তার জন্যে নয়। বরং যে সব জ্ঞানপাপী সুবিধেমত নীড়ে ফিরে যায় তাদের টেনেহিঁচড়ে বের করে না আনা পর্যন্ত শান্তি নেই। কবিতাটিকে ভোলবার চেষ্টা করতেই যেন সে উঠে দাঁড়াল।
এই বাড়ির কোথাও কোন শব্দ নেই। যে বিদেশী বাজনা বাজছিল কোন ফ্ল্যাটে সেটাও এখন বন্ধ হয়ে গেছে। রামানন্দ রায়ের মুখটা মনে পড়ল জয়িতার। এইরকম ভাবে তিনি কোনদিন তাকাননি। জয়িতার হঠাৎ খুব ইচ্ছে হল বাবার কাছে গিয়ে বসে। তার বক্তব্য বলার জন্যে হয়তো সে সঠিক শব্দ নির্বাচন করেনি। আমরা যখন কথা বলি তখন বেশির ভাগ সময়েই বক্তব্যটাই জানাবার চেষ্টা করি কিন্তু আপাতনিরীহ কোন শব্দ যে শ্রোতার কানে মারাত্মক অর্থবহ হয়ে দাঁড়ায় তা ভাবার প্রয়োজন বোধ করি না। মুখে কোন ক্ষমা চাইতে পারবে না সে। কারণ সে বিশ্বাস করে ক্ষমা চাইবার মত কোন অপরাধ সে করেনি। কিন্তু চুপচাপ কিছুক্ষণ পাশে বসে থাকলে এক ধরনের আন্তরিকতা পৌঁছে দেওয়া যায়। জয়িতার স্থির বিশ্বাস রামানন্দ এখনও ঘুমাননি। তাছাড়া সে অবশ্যই কৃতজ্ঞতা বোধ করছে। তিনি তাকে এবং তার বন্ধুদের এই ফ্ল্যাটে আশ্রয় দিয়েছেন। এখন নিশ্চয়ই তার পক্ষে অনুমান করতে বাধা নেই কিন্তু তা সত্ত্বেও পুলিস ডেকে তাদের ধরিয়ে দেননি। বরং তার ভঙ্গিতে প্রকাশ পেয়েছে তিনি পারলে উপকারই করবেন।
রামানন্দ রায়ের দরজায় নক করতে গিয়েও সামলে নিল সে। একটু দ্বিধাগ্রস্ত হল। তার পর সেটা কাটিয়ে উঠে দরজায় চাপ দিল। খোলাই ছিল ওটা, জয়িতা ভেতরে পা বাড়িয়ে অবাক হল। টানটান বিছানা দেখে বোঝা যায় কেউ সেটা ব্যবহার করেনি। ঘবে আলো জ্বলছে। বামানন্দ রায় তঁাব ঘরে নেই। ছাত করে উঠল জয়িতার বুক। এতরাত্রে কোথায় গেলেন তিনি! যেভাবে মানুষটা বেরিয়ে এসেছিলেন তাতে তাঁর পক্ষে কিছু একটা করে বসা অসম্ভব নয়। কিন্তু এই ফ্ল্যাটে তো আর যাওয়ার কোন জায়গা নেই। জয়িতা বাথরুমে মুখ বাড়াল। না, তিনি সেখানেও যাননি।
তাহলে কি রামানন্দ রায় বেরিয়ে গেছেন? তারা যখন ঘরে বসে কথা বলছিল তখন কি নিঃশব্দে বাইরের দরজা খুলে চলে গেছেন? এতক্ষণ যে ধারণা তৈরি হয়েছিল তা কি ভুল? বাড়ির টেলিফোন পর্যন্ত ব্যবহার না করে রামানন্দ এই নিশুতি রাতে বেরিয়ে গেছেন পুলিসকে খবর দিতে? জয়িতার মনে হল অবিলম্বে কল্যাণকে সতর্ক করে দেওয়া দরকার। সুদীপ আনন্দ ফিরে আসার আগেই রাস্তায় ওদের সঙ্গে দেখা করা দবকার। জয়িতা কিছুই ভাবতে পারছিল না। তার পরেই পাশের ঘরটার কথা মনে পড়ল ওর। সীতা রায় তো আজ সারাদিন প্রায় স্বেচ্ছাবন্দী হয়ে রয়েছেন। এমন কি বাড়িতে তিনটে অপরিচিত ছেলে এসেছে তা নিয়েও মাথা ঘামাননি। রামানন্দ তো ওই ঘরে যাননি? মনে হয় না। সীতা রায় রাত হলে স্বামীকে নিজের ঘরে ঢুকতে অনুমতি দেন না। বেশ কিছুদিন ধরে জয়িতা এই ব্যাপারটা লক্ষ্য করছে। একসঙ্গে পার্টিতে যাচ্ছেন ওঁরা, হেসে কথা বলছেন অন্য ফ্ল্যাটের লোকদের সঙ্গে, গেস্ট এলে আপ্যায়নও করছেন এবং তখন দেখলে বোঝা যাবে না এই স্বামী-স্ত্রী রাত্রে পরস্পরের মুখ দেখেন না। আজ কি করে রামানন্দ সীতা রায়ের ঘরে যাবেন? অন্তত এই শেষরাত্রে? সীতা রায়ের তত জেগে থাকার কথা নয়, শরীরের প্রতি তার অত্যন্ত সতর্কতা।
হঠাৎ জয়িতার মনে পড়ল বাথরুমটার কথা। পাশাপাশি দুটো ঘরের জন্যেই একটাই বাথরুম। দুটো দরজা দিয়ে ওটায় যাওয়া যায়। জয়িতা নিঃশব্দে বাথরুমে ঢুকল। এবং ঢুকতেই বুঝতে পারল পাশের ঘরের মানুষ জেগে আছে। দরজার ফাঁক দিয়ে আলো আসছে। একটু সঙ্কোচ হল তার। কিন্তু রামানন্দ রায় ওখানে আছেন কিনা তা জেনে নিশ্চিত হতে চায় সে। সে ঠিক করল অন্তত একবার সে দরজার কাছে কান পেতে শুনবে রামানন্দ কথা বলছেন কিনা। হয়তো এটা অন্যায়, রুচিতেও বাধছে তার। কিন্তু নিজের সন্দেহটা নিজেই মিথ্যে প্রমাণ করতে চাইল সে। ধীরে ধীরে পাশের ঘরের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই কান্না শুনতে পেল জয়িতা। সঙ্গে সঙ্গে স্থির হয়ে গেল—মা কাঁদছে।
রামানন্দ বললেন, কেঁদো না সীতা, প্লিজ শান্ত হও।
সীতা রায় বললেন, তুমি, তুমি আমাকে ক্ষমা করো। বল ক্ষমা করবে?
রামানন্দ বললেন, আমিও যে তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি।
সীতা রায় একটু থামলেন। তারপর করুণ গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, কিন্তু জয়ী? জয়ী?
রামানন্দ বললেন, ওকে ওর মত থাকতে দাও। কখনও ওকে বাধা দিও না। ও আর ঠিক আমাদের নেই। আমি ওর জন্যে গর্বিত সীতা।
আর দাঁড়াতে পারল না জয়িতা। যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি বাইরে ছুটে এল। এবং হঠাৎই তার কান্না পাচ্ছিল। শূন্য বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে কাঁদছিল। অথচ তার চোখ থেকে এক ফোঁটাও জল পড়ছিল না। আর তখনই দরজা খোলার জন্যে অনুরোধের বেল বাজল।