কেন রবীন্দ্রনাথ?
কোনো দিন আমি ‘কবিগুরু’ অথবা ‘গুরুদেব’ রবীন্দ্রনাথ লিখিনি। বলিওনি। যারা লেখেন অথবা বলেন তাদের আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথের অতিভক্ত–এমন কি, কাউকে কাউকে মনে হয় রবীন্দ্রপূজারী। আমার ধারণা: এই অতিভক্তির ফলে সত্যিকারের রবীন্দ্রনাথকে আমরা দেখতে পাইনি অথবা এখনো দেখতে পাচ্ছি না। মানুষ রবীন্দ্রনাথ—‘যাহারে কাঁপায় স্তুতিনিন্দার জ্বরে’— সেই মানুষ রবীন্দ্রনাথ আমাদের আড়ালে থেকে গেছেন। তাঁর জায়গায় দেখা দিয়েছেন। একজন অতিমানব অথবা উপদেবতা। তাঁর রচনার আমরা তাই কদৰ্থ না-হলেও ভুল অৰ্থ করি। তা ছাড়া, তাঁর সৃষ্টির ওপরে ভিত্তি করে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে না-গিয়ে বরং তাকে কেন্দ্র করেই বারবার ঘুরপাক খেতে থাকি। এক কালে কথায় বলতো: কানু ছাড়া গীত নেই। আধুনিক বঙ্গে কৃষ্ণের জায়গা দখল করেছেন রবীন্দ্রনাথ। কখনো কখনো মনে হতে পারে: রবীন্দ্রনাথ ছাড়া গীত নেই।
কালিদাসের কালে তিনি জন্ম নেননি ঠিকই, কিন্তু তিনিও যথেষ্ট পুরোনো! জন্মেছিলেন এখন থেকে প্রায় দেড় শো বছর আগে। তারপর কবে তিনি বিগত হয়ে গেছেন!! বস্তুত, তার ভাষায় এখন নতুন কবি–নতুন কবিরা— আমাদের ঘরে গান করছেন। তারপরও তাকে নিয়ে নাম-কীৰ্তন করার প্রয়োজন আছে কি? ধর্মের বেলায় দেখা যায়: মানুষ একটা বিশ্বাসকে আঁকড়ে থাকে। সেখান থেকে আর সামনে যেতে পারে না। অন্ধবিশ্বাস স্বচ্ছদৃষ্টিকে আবৃত করে। রবীন্দ্রনাথ তেমন একটা অন্ধ বিশ্বাসে পরিণত হচ্ছেন বলে আশঙ্কা হয়। তা ছাড়া, অনেক সময় মনে হয়: তিনি নতুনদের আগমনের সব পথ রোধ করে আছেন। বাঙালি মুসলমানরা দীর্ঘদিন তাকে “নিজেদের লোক’ বলে গণ্য করতেন না। কিন্তু মুসলমান-প্রধান বাংলাদেশেও রবীন্দ্রচর্চা এখন অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে।
মোট কথা, নানা দিক থেকেই মনে হতে পারে: আর কতো রবীন্দ্রনাথ! এখনো কি তিনি প্রাসঙ্গিক?
এক কথায় এর উত্তর বোধ হয় দেওয়া যায় না। মরেই হারিয়ে যান বেশির ভাগ মানুষ। কিন্তু সবাই নন। আকাশে লক্ষ-কোটি তারা দিনের আলোতে হারিয়ে যায়। অপর পক্ষে, আকাশ থেকে সরে গেলেও মেরুমণ্ডলে সূর্য প্রায় সারা রাত আলো দেয়। সে জন্যেই ৬৫ বছর আগে বিদায় নিলেও বাংলার আকাশ থেকে রবির আলো নিভে যায়নি। আমরা এখনো বাস করছি তারই বলয়ে।
এর কারণ দুটি। প্রথমত তাঁর সর্বব্যাপী প্ৰতিভার জন্যে, দ্বিতীয়ত এখন তাঁর অবদান আজও নিঃশেষিত হয়নি বলে। তিনি ছিলেন বিশ্বের এক বিরল প্ৰতিভা। বিশেষ করে বৈচিত্র্যের কথা বিবেচনা করলে তার মতো প্ৰতিভা ইতিহাসে নজিরবিহীন। শেক্সপীয়র নাট্যকার এবং কবি ছিলেন, সুরকার ছিলেন না। মোৎসার্ট সুরকার ছিলেন, কিন্তু উপন্যাস লেখেননি। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি শিল্পী এবং বিজ্ঞানী ছিলেন, কিন্তু সুরকার ছিলেন না। নিউটন বিজ্ঞানী ছিলেন, কিন্তু কবি ছিলেন না। ভ্যান গখ। ছবি এঁকেছেন, কিন্তু গান রচনা করেননি। মনে রাখা দরকার যে, কবি হিশেবে পরিচিত হলেও রবীন্দ্ৰনাথ কেবল কবি ছিলেন না। তিনি একই সঙ্গে ছিলেন গীতিকার-সুরকার, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, ছোটোগল্প-লেখক এবং প্রবন্ধ-লেখক। যদি এখানেই শেষ হতো, তা হলেও তাকে কেবল সাহিত্যিক পরিচয় দিয়ে চালিয়ে দেওয়া যেতো। কিন্তু তাঁর আরও পরিচয় ছিলো। তিনি ছিলেন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক, ভাষাতাত্ত্বিক, পর্যটক, অভিনেতা, গায়ক এবং পল্লীপুনর্গঠক। বাংলা ভাষা, সাহিত্য এবং সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্ৰকে তিনি বিচিত্র এবং বর্ণাঢ্য অলঙ্কারে সাজিয়ে দিয়েছেন তাঁর সৃষ্টি দিয়ে। কিন্তু তাই বলে তাঁকে পূজো করার কারণ নেই। তিনি ফেরেশতা ছিলেন না–তারও ছিলো অনেক সীমাবদ্ধতা। সবচেয়ে বড়ো কথা, তিনি ভবিষ্যৎদ্রষ্টা কবি হলেও, আজকের বিশ্বে যে-সব জটিল সমস্যা দেখা দিয়েছে, তার সমাধানের দাওয়াই দিয়ে যেতে পারেননি। ধর্মপ্রচারকদের উপদশেকে চিরকালীন বিবেচনা করা যেমন ভ্ৰান্ত, রবীন্দ্রনাথের বাণী মহান হলেও, মনে রাখা দরকার—তার ওপরও কালের ছাপ রয়েছে।
এই সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তাঁর উপযোগিতা নিঃশেষ হয়নি। রাজনীতির দিক দিয়ে, এমন কি, সাংস্কৃতিক অনেক দিক দিয়েও বাঙালি এখন দু ভাগে বিভক্ত। কিন্তু বাংলার আকাশে এখনও একই রবি। নতুন বছর বরণ করতে, গ্ৰীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত–সব ঋতুকে স্বাগত জানাতে, জন্মদিনে, মৃত্যুবার্ষিকীতে, পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয় অনুষ্ঠানে— বস্তুত সব কিছুতেই তাঁর গান চাই, চাই তাঁর কবিতা। তার চেয়েও যা গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো: উৎসবে, আনন্দে, শোকে, সাত্ত্বনায়, প্রেমে, বিরহে–তাঁর গান, তাঁর কবিতা আমাদের সঙ্গী হয়। তাঁর ভাষা দিয়েই বলতে পারি: অনমনা পথ চলতে গিয়ে আমরা যেমন পথের দু ধারের ফুলদের ভুলে যাই, আকাশের তারাদের ভুলে যাই, অথচ আমাদের প্রাণের নিশ্বাসবায়ু তারা সমধুর করে, তেমনি রবীন্দ্রনাথের কথা সজ্ঞানে মনে না-করলেও তিনি প্রতি নিয়ত আমাদের চেতনায় মিশে আছেন এবং আমাদের অস্তিত্বকে সমৃদ্ধ করছেন।
আমাদের ওপর তার সবচেয়ে বড়ো প্রভাব তার ভাষার। আমাদের ভাষাকে তিনি ঐশ্বৰ্যমণ্ডিত করেছেন। আমরা অজান্তেই তাঁর ভাষা ধার করে কথা বলি, তার ভাষায় চিন্তা করি। তার হাতের লেখা মক্স করি। তার আগে পর্যন্ত যে-বাংলা ভাষা ছিলো, তা ছিলো অনেকাংশে কৃত্রিম, তার প্রকাশ-ক্ষমতা ছিলো সীমিত এবং তা ছিলো আমাদের মুখের ভাষা থেকে অনেকটা দূরে অবস্থিত। সেই ভাষাকে সহজ সরল করে তিনি নিয়ে আসেন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের কাছাকাছি। কেবল তাই নয়, সে ভাষাকে তিনি সৌন্দর্যমণ্ডিত করেন; প্রকাশ-ক্ষমতা দান করে নানা ভাবের বাহন করে তোলেন। কবিতা, গল্প এবং প্রবন্ধ–সব রীতির ভাষাকেই তিনি সমৃদ্ধ করেছিলেন। ভাষাতত্ত্ব, বিজ্ঞান, দর্শন, শিক্ষা–সব ধরনের পরিভাষাকেও এগিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। বস্তুত, তাঁর ভাষার ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে বিশ শতকের বাংলা গদ্য। কিন্তু ঘরে-ঘরে শিক্ষা ছড়িয়ে পড়লেও, শিক্ষার মান এখন নিচে নেমে যাওয়ায় আমাদের ভাষা তার সৌন্দর্য এবং প্রকাশ-ক্ষমতা উভয়ই যথেষ্ট পরিমাণে হারিয়ে ফেলেছে। এই অবক্ষয়ের পরিবেশে তাঁর রচনা বারবার আমাদের হীনতা থেকে মুক্তি দিয়ে ওপরে তুলে আনতে পারে। তিনি যে-ঐশ্বৰ্য দিয়েছিলেন, তা বিসর্জন দিলে সেটা হবে আত্মহননের মতো।
কেবল তাই নয়, রবীন্দ্রনাথ আর বিদগ্ধ রুচি গত এক শো বছরে সমার্থক হয়ে গেছে। তাঁর আগে পর্যন্ত ভাষা-সাহিত্যে এক ধরনের স্থূলতা ছিলো। কিন্তু তিনি তাতে এমন একটা পরিশীলন এবং বৈদগ্ধ্য নিয়ে আসেন, যা আগেকার বাংলায় লক্ষ্য করা যায়নি। হয়তো প্ৰথম যৌবনে তিনি এই রুচির দেখা পেয়েছিলেন ইউরোপে। তার কৌতূকবোধ, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, তার চলাফেরা, আচার-আচরণ, তাঁর বাকভঙ্গিসবকিছুতেই এই রুচির দেখা মেলে। তার ভাষার বক্রপ্রয়োগের মাধ্যমে রসিকতা সৃষ্টির একটি প্রমাণ দিতে পারি প্রসঙ্গত। যার কণ্ঠ বেশ কর্কশ তার সম্পর্কে তিনি হয়তো লিখতে পারেন যে, অমুকের কণ্ঠ খুব মধুর তা বলা যায় না। এ জাতীয় প্রয়োগ বাংলা ভাষায় তাঁর আগে পর্যন্ত ছিলো না। বস্তুত, আমাদের কথায়, আমাদের আচার-আচারণে, মধ্যবিত্তের বসার ঘরের শিল্পকর্মে, গানের চর্চায়, নাচের যৎকিঞ্চিৎ আয়ােজনে, এমন কি, সংস্কৃতিবান বলে পরিচিত হওয়ার যে-প্ৰয়াস প্রকাশ পায় তাদের জীবনে–তার সবকিছুতেই রয়েছে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব।
বাঙালির রুচি গঠনে তার প্রভাব যে কতো গভীর তার আর-একটা প্ৰমাণ মেলে তাদের রোম্যান্টিক প্রেমের চেতনা থেকে। তার আগে বঙ্কিমচন্দ্রের হাত ধরে ইউরোপ থেকে এই চেতনা বাঙালির জীবনে আসতে আরম্ভ করলেও ভালোবাসার ভাষা এবং প্রকাশভঙ্গি, অঙ্গবিহীন আলিঙ্গনের সূক্ষ্ম মাধুর্য এবং রোম্যান্টিকতা আমরা রবীন্দ্রনাথেই বিশেষ করে লক্ষ্য করি। প্রেমিক অথবা প্রেমিকার কানে কানে শোনানোর কবিতা অথবা গান বঙ্কিমচন্দ্র আমাদের জন্যে রেখে যাননি। অপর পক্ষে, রবীন্দ্রনাথের কবিতা এবং গান ছাড়া কপোত-কপোতীর প্রেমের কুজন কল্পনা করা যায় না। নাটকে, সিনেমায় তাঁর গান ছাড়া প্রেমের দৃশ্য অপূৰ্ণ থেকে যায়। এমন কি, যারা আধুনিক প্রেমের গান লেখেন, তারা অকাতরে তাদের শব্দ এবং এক্সপ্রেশন সংগ্রহ করেন। তাঁরই গীতবিতানের বিশাল ভাণ্ডার থেকে।
কেবল মানবিক প্রেম নয়, তার ঈশ্বরপ্রেমও বাঙালির, বিশেষ করে বিদগ্ধ এবং ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালির অনুকরণের বস্তু। তিনি নিজে একেশ্বরে গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন। তাঁর চেতনায় এই বিশ্বাস। এতো নিবিড়ভাবে মিশে ছিলো যে, তিনি প্ৰেম, প্রকৃতি, মানুষ–যে-বিষয় নিয়েই লিখে থাকুন না কেন, তার মধ্যে সেই বিশ্বাসের দুৰ্গতি বিছুরিত হয়েছে। বিশেষ করে তাঁর গান সম্পর্কে এ কথা জোর দিয়ে বলা যায়। অথচ রবীন্দ্রনাথের সেই সৌন্দর্যময় মঙ্গলময় ঈশ্বর কোনো আনুষ্ঠানিক ধর্মের অথবা সম্প্রদায়ের ঈশ্বর নন। তিনি প্রায় এক সেকুলার ঈশ্বর। সেই ঈশ্বর মানবতারই পরম প্রতীক। রবীন্দ্রনাথ জীবন শুরু করেছিলেন ব্ৰাহ্ম পরিচয় দিয়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি যে-ধর্মকে স্বীকরণ করেছিলেন, তা মানুষের ধর্ম। তাতে কেবল উপনিষদ নয়, তাতে মিশে গিয়েছিলো গ্রাম-বাংলার দেবতা-বর্জিত আনুষ্ঠানিকা-বর্জিত বাউলের সহজ ভক্তি। কিন্তু বাউলের ভক্তিকেই তিনি নিয়েছিলেন, স্কুল দেহতত্ত্বকে নয়। মুক্ত-মনা বাঙালিদের তিনি অনুপ্রেরণা দিয়েছেন সেই মানুষের ধর্ম, সেই সেকুলার ঈশ্বরকে নিজেদের হৃদয়ে স্থাপন করতে। আজ বিশ্বে যখন ধর্মকেন্দ্রিক সাম্প্রদায়িক সহিংসতা একটা বিশাল দৈত্যের মতো মাথা তুলে সমগ্র মানবতাকে গ্রাস করতে উদ্যত, তখন রবীন্দ্রনাথের সেই ধর্ম এবং ঈশ্বরকে বড়ো প্রয়োজন।
বাঙালিরা এক হোক বলে আজ থেকে ১০১ বছর আগে ঈশ্বরের কাছে তিনি প্রার্থনা জানিয়েছিলেন। তিনি আশঙ্কা করেছিলেন যে, ধর্মের ভিত্তিতে বঙ্গদেশ বিভক্ত হলে কালে-কালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য-সহ পুরো বাঙালি সংস্কৃতিই দু ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়বে। রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে তার সেই আশঙ্কা এখন দাঁত মেলে দেখা দিয়েছে। একই ভাষায় কথা বললেও, পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের বাঙালিদের আত্মপরিচয় এখন আর অভিন্ন নেই। এখন সেই বাঙালিদের একাংশ ক্রমবর্ধমান মাত্রায় ভারতীয় হচ্ছেন; আর-এক অংশ ইতিমধ্যে বাংলাদেশীতে পরিণত হয়েছেন। এই বিভেদের যুগে দু পারের বাঙালিদের মধ্যে যে-দুজন মিলন সেতু হিশেবে কাজ করতে পারতেন, তাদের একজন রবীন্দ্রনাথ, অন্যজন নজরুল।
এই কলুষিত পরিবেশে রবীন্দ্রনাথের নাম এখনও অসাম্প্রদায়িকতার আন্দোলনে সবচেয়ে বড়ো অনুপ্রেরণা হিশেবে বিবেচিত হচ্ছে। অসাম্প্রদায়িকতা আর রবীন্দ্রনাথকে এখন সমার্থক বলে গণ্য করা হয়। বস্তুত, বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যে-বিতর্ক তার একদিকে আছে সাম্প্রদায়িক অশুভ শক্তি, অন্যদিকে অসাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী। নয়তো সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। মুসলিম জাতীয়তাবাদীরাও পয়লা বৈশাখ রবীন্দ্রনাথেরই গান দিয়েই পুরোনো বৎসরের আবর্জনা দূর করেন, তাঁর গানের সঙ্গেই নাচেন।
আধুনিক কালে জাতিসজা গড়ে উঠেছে, গড়ে উঠেছে বহু আন্তজাতিক প্রতিষ্ঠান। বিশ্বায়ন এখন সবচেয়ে ধরতাই ধুয়ো। সত্যি সত্যি যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে গোটা বিশ্ব ছোটো হয়ে এসেছে। কিন্তু তারই মধ্যে প্রবল হয়ে উঠেছে। অন্ধ জাতীয়তাবাদ। নয়া-সাম্রাজ্যবাদ, ধর্মীয় সাম্রাজ্যবাদ, জাতীয় স্বাৰ্থ এবং ধর্মীয় উন্মাদনার নামে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আজ যে হানাহানি, মানুষের জীবন নিয়ে যেতাণ্ডবনৃত্য, তার পেছনে সবচেয়ে বড়ো কারণ জাতীয়তাবাদের বিস্ফোরণ। এখন থেকে নব্ববুই বছর আগে রবীন্দ্রনাথ এর বিরুদ্ধে হাঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন। এর ফলে পাশ্চাত্যে তাঁর জনপ্রিয়তাও রাতারাতি হ্রাস পেয়েছিলো। কিন্তু তাতে তিনি পিছুপা হননি। তাকে অগ্রাহ্য করেই সত্য এবং মঙ্গলের বাণী শুনিয়েছিলেন জাপান, ইউরোপ এবং অ্যামেরিকায়। জনপ্রিয়তার প্রলোভনে একটুও সরে যাননি। তিনি নিজের কক্ষপথ থেকে। কারণ, প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে তিনি জাতীয়তাবাদের ধ্বংসাত্মক এবং মানবতা-বিরোধী ভূমিকা দেখে বিচলিত হয়েছিলেন। তারপর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগেও তিনি জাপান এবং জার্মেনিতে দেখেছিলেন সেই জাতীয়তাবাদকে আরও প্রবল হয়ে উঠতে। এমন কি, খোদ ভারতবর্ষের সহিংস স্বাধীনতা আন্দোলনও তার বিশ্বাসে আঘাত দিয়েছিলো।
যে-জাতীয়তাবাদ একটি জাতিকে অন্য জাতির শক্রতে পরিণত করে, অন্য জাতির মানুষের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতে প্রেরণা জোগায়, যে-জাতীয়তাবাদ মনুষত্ত্বের চেয়েও দেশপ্রেমকে বড়ো করে দেখে, তাকে তিনি অকুণ্ঠভাবে নিন্দা করেছিলেন। তিনি নিজে অসাধারণ দেশপ্রেমিক ছিলেন। কিন্তু ভূমি নয়, সেই ভূমিতে যারা বাস করে–সেই মানুষকেই তিনি বড়ো করে দেখেছিলেন। সত্যিকার অর্থেই তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক মানুষ। তিনি বলেছিলেন: দেশে দেশে তাঁর ঘর আছে। তিনি সেই ঘরেরই খোজ করেছেন। তার কাছে রাষ্ট্র, ধর্ম, সমাজ–সবই মানুষের জন্যে। রাষ্ট্র, ধর্ম অথবা সমাজের জন্যে মানুষ নয়। আজ যখন সভ্যতার তীব্ৰ সংকট দেখা দিয়েছে, তখন তাঁর সেই আন্তর্জাতিকতার বাণী বন্ধুর পথে চলতে আমাদের সম্বল হতে পারে।
সত্যি বলতে কি, রবীন্দ্রনাথ যখন লিখেছিলেন হিংসায় উন্মত্ত পৃথী অথবা লিখেছিলেন সভ্যতার সংকট, আজকের অবস্থা তার চেয়ে অনেক শোচনীয়। তিনি যখন লিখেছিলেন, বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাদে–তখনও অন্যায়ের প্রতিকার হতো। কিন্তু আজ সত্যি সত্যি মানবতা এক গভীর সংকটের সম্মুখীন। এক ক্রান্তিকালে উপনীত। হিটলারের, মুসোলিনীর, স্তালিনের সূচনা দেখেছিলেন তিনি। কিন্তু ষাটের দশকের তৃতীয় বিশ্বের অসংখ্য ফৌজী শাসকদের দেখেননি, পল পটদের দেখেননি। সাদাম, বুশ এবং লাদেনদের দেখেননি। ধর্ম এবং সম্প্রদায়ের নামে বিপন্ন রোয়াণ্ডা, বসনিয়া, গুজরাট, ইরাক, ফিলিস্তিন এবং আফগানিস্তানের মানুষকে দেখেননি। এই সংকটের নীরন্ধ অন্ধকারে তার গান, তাঁর কবিতা, তার চিন্তা আজও প্রাসঙ্গিক, আজও তা আমাদের উদ্বুদ্ধ করতে পারে; একলা পথে চলার অনুপ্রেরণা জোগাতে পারে।
(যুগান্তর, রবীন্দ্রজয়ন্তী সংখ্যা, ২০০৬)