কাগজখানা যুগান্তর। তার প্রথমপাতায় বড় বড় করে ছাপা হয়েছে এক ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার সংবাদ—বিলাসপুরের কাছে মেল ট্রেন উলটে ছেষট্টিজন যাত্রীর মৃত্যু। তারপরে ছবিসহ বিপর্যয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা। ইঞ্জিনের ঠিক পরের দুটো বগিতে প্রায় কেউই রক্ষা পায়নি। ভারতীয় রেলের ইতিহাসে এতবড় দুর্ঘটনা ঘটেনি এর আগে।
বিধু নন্দ কাগজ থেকে মুখ তুলে বললেন—কুঞ্জদিদি ভাগ্যিস আটকেছিল খুড়োকে!
সুদর্শন বলল—কুঞ্জপিসি মাধবখুড়োকে আটকেছিল! কী রকম?
ধীরেন দলুই বলল—কী রকম তা তো জানি না, তবে যেতে দেয়নি। দাঁড়াও, ওই যে নিবারণ ঘরামি যাচ্ছে, ওর গাড়িতেই যাচ্ছিল খুড়ো। ওর কাছ থেকেই আমরা ব্যাপারটা প্রথমে জানতে পারি। ওহে ও নিবারণ, একবার এদিকে শোনো ত বাবা–
মাধবখুড়োর ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ায় ইদানীং গ্রামে নিবারণের খ্যাতি আর চাহিদা বেড়েছে খুব। নিস্তরঙ্গ গ্রামের জীবনে এমন মজার কাণ্ড কমই ঘটে। ফলে প্রায় রোজই বিভিন্ন আচ্ছায় আর গিন্নিদের মজলিশে তার ডাক পড়ে, সমস্ত বিবরণটা বারবার শোনাতে হয়। কাহিনীর মূল আদলটা ঠিক রেখে সে শ্রোতাদের আগ্রহ ক্রমবর্ধমান রাখার জন্য শ্রোতা যদি আপত্তি করেও নিবারণ, এ ঘটনা আবার কোথা থেকে এল? এটা তো আগে বলনি—’ অমনি নিবারণ হাতজোড় করে হেসে বলে—’বয়েস কি কম হল কর্তা? সব কথা একবারে মনে পড়ে না’–
নিবারণ কাছে আসতে ধীরেন দলুই বলল—এই যে নিবারণ, সুদর্শন আদক বাড়ি ছিল না, জানো তো? আজকে এই ফিরল। ওকে একবার মাধবখুডোর সেদিনের ঘটনাটা শুনিয়ে দাও তো—
পরম আহ্লাদিত হয়ে নিবারণ বলতে শুরু করল, এবং পুনরপি কিছু নতুন তথ্য ঢুকিয়ে কাহিনীর শেষে বলল—তারপর বাবু উঠোন পার হয়ে দরজার কাছে গিয়ে কুঞ্জপিসিমা বললেন—সাতষট্টি হত, কিন্তু ছেষট্টি হবে। এর মানে কিছু বুঝতে পারলাম না বাবু। মাধবখুড়োও চুপ করে রইলেন, কুঞ্জপিসিকে কে ঘাঁটাবে?
সুদর্শন আদক মনোযোগ দিয়ে নিবারণের গল্প শুনছিল, এর আগে সে এ কাহিনী শোনেনি, এবার আশ্চর্য হয়ে বলল—ছেষট্টিজনের কথা বললেন কুঞ্জপিসি? ঠিক বলছ?
–আমি ঠিক বলছি কর্তা। তবে জন-টন জানি না, সাতষট্টি হত, কিন্তু ছেষট্টি হবে’—এই কথা বলতে শুনেছি। এর মানে কী কর্তা? কিছু কি বুঝেছেন?
উত্তরে বিধু নন্দ বললেন—বোঝাবুঝির কিছু নেই, একেবারে জ্বলন্ত প্রমাণ ওই কাগজে ছাপা হয়েছে। তুমি তো পড়তে জানো না, শোনো তোমাকে বলি। ওই কাগজে ছাপা হয়েছে যে, যে রেলগাড়িতে মাধবখুডোর যাবার কথা ছিল সে গাড়ি মধ্যপ্রদেশের একজায়গায় লাইন থেকে উলটে পড়ে গিয়েছে। এই দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছে ছেষট্টিজন, যদি বারণ না শুনে মাধবখুড়ো যেতেন, তাহলে মৃতের সংখ্যা হত সাতষট্টিজন? বুঝলে? এই ঘটনাটা ঘটবার চার-পাঁচদিন আগেই কুঞ্জপিসি জানতে পেরে গিয়েছিলেন
শুনতে শুনতে নিবারণের চোখ ক্রমেই গোলগোল হয়ে উঠছিল। জিনিসটা এতক্ষণে তার মাথায় পুরোপুরি তাৎপর্যের সঙ্গে প্রবেশ করেছে। সে পেছন ফিরে হহ করে হাঁটা দিল গ্রামের ভেতরদিকে। বোঝা গেল অচিরাৎ এই নবতর সংযোজন গ্রামবাসীদের মধ্যে পরিব্যাপ্ত হবে। সুদর্শনও বসে পড়ল আড্ডায়। আবার আলোচনা জমে উঠলো।
এই হচ্ছেন কুঞ্জপিসি। কত গল্প আছে তাকে ঘিরে।
সিন্ধুলতাকে বাড়ির ভেতরে ফেরৎ পাঠিয়ে কুঞ্জপিসি বললেন—গোলোক, তোমাকে একটা কথা বলতে এলাম। তোমার মেয়ের বিয়ে তো সামনের বুধবার, তাই না?
—আজ্ঞে হ্যাঁ, আজ বুধবার, সামনের বুধবার বিয়ে। কেন দিদি?
—বিয়ের সময়ে একটু ছোটখাট অসুবিধে হতে পারে। তাই কথা বলতে এলাম—
জ্যাঠামশাইয়ের মুখ শুকিয়ে গেল। ভবিষ্যৎবাণী করার বিষয়ে কুঞ্জপিসির খ্যাতির কথা সবাই জানে। কী অসুবিধে হবে মেয়ের বিয়েতে? এদিকে সব ঠিকঠাক, নেমন্তন্ন করাও প্রায় সারা হয়ে গিয়েছে। এখন কিছু হলে তো সমাজে আর মুখ দেখানো যাবে না। বড়মানুষ কুটুম্ব হতে চলেছে, সবাই সন্ত্রস্ত হয়ে রয়েছে কিছু না একটা বাধা পড়ে।
জ্যাঠামশাই ভীতমুখে বললেন—কী অসুবিধে দিদি? বিয়েটা হবে তো?
কুঞ্জপিসি হেসে বললেন—সে-সব ভয় নয়। বিয়ে ঠিকই হবে, নইলে আমি জানতে পারতাম। গোলোক, তোমার যে বাদুলে মেয়ে তা জানো?
—আজ্ঞে, বাদুলে মানে-বাদুলে বলতে–
–ঝমঝম বৃষ্টির দিনে সিন্ধুলতার জন্ম হয়েছিল, মনে আছে?
—আছে। আপনি এই গাঁয়ের বৌ, আপনি তো সবই জানেন–
–ওর সারাজীবনের ভাগ্যস্থান জলবর্ষণযোগে আক্রান্ত। ঘন বর্ষায় জন্ম, অন্ন প্রাশনের দিনেও বৃষ্টি হয়েছিল—যতদূর আমার মনে পড়ছে। বিয়ের আগে-পরেও ভয়ানক বৃষ্টি হবে, একটু সাবধান থাকা দরকার।
জ্যাঠামশাই বললেন–তা বর্ষাকালে একটু-আধটু বৃষ্টি তো হবেই–
—একটু-আধটুর কথা বলছি না গোলোক। কাল কী পরশু থেকে এমন বর্ষা নামবে যে, শেয়াল-কুকুরও পথে বেরুতে পারবে না। শোলপাট্টা থেকে বর আর বরযাত্রী এসে পৌঁছবে কী করে? অমন বর্ষা হলে ছাঁদনাতলা ভেসে যাবে, রান্নার জায়গা ভেসে যাবে–
–কী করি তাহলে? তারিখ পেছোনোর উপায়ও তো নেই।
কুঞ্জপিসি বললেন–তারিখ পিছিয়ে লাভ নেই। যেদিন নতুন তারিখ ফেলবে, সেদিনই বৃষ্টিতে সব ভেসে যাবে। বাদুলে লগ্নে মেয়ের জন্ম, ওর জীবনের সমস্ত উৎসব আর বিশেষ দিনেই ভয়ানক বাদলা হবে। তবে ভয় নেই, দেখা যাক কী করা যায়–
জ্যাঠামশাই বললেন—কী করতে হবে বলুন, আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
—এখন কিছুই করতে হবে না। আগে বৃষ্টি নামুক, তারপর দেখা যাবে। আমার গণনা ভুলও হতে পারে
তখনকার মত কুঞ্জপিসিমা বিদায় নিলেন। বাবা-কাকাদের মধ্যে এ নিয়ে কথাবার্তাও হল। কিন্তু কুঞ্জপিসির আশ্চর্য ক্ষমতা জানা থাকা সত্ত্বেও তার এই সাবধানবাণীতে কেউ বিশেষ ভীত হয়েছে বলে মনে হল না। আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার, কড়া সূর্যের আলোয় চারদিক ভরে আছে। খটখটে শুকনো পথঘাট। হ্যাঁ, কুঞ্জপিসির ক্ষমতা আছে সেটা সবাই মানছে, তবে এবার বোধহয় তার কথা ফলল না।
কেবল জ্যাঠামশাই বারবার বলতে লাগলেন—মনটা ভাল লাগছে না, বুঝলে? কি যে হয়!
বাবা আর কাকারা তাকে সাহস দিতে লাগলেন। প্রয়োজনে বরকে কাঁধে করে নিয়ে আসা হবে।
সেদিন রাত্তিরে ভেতরের বারান্দায় লম্বা সারিতে সবাই খেতে বসেছেন, কাকিমারা পরিবেশন করছেন, হঠাৎ বাড়ির বাইরে কেমন একটা ঘূর্ণিহওয়ার মত উঠল। বাড়ির উত্তর দিকের পাঁচিলের গায়ে ছিল একটা কলাগাছের ঝাড়, সে গাছগুলো একেবারে নুয়ে পড়ল বাতাসের দাপটে। খেতে খেতে জ্যাঠামশাই চমকে উঠে মুখ তুলে তাকালেন। অন্যরাও এদিক-ওদিক চাইতে লাগল। ওপাশের আমকাঠালের বাগানের ডালপালা আর পাতা কাঁপিয়ে বাতাসের প্রবাহটা ক্ৰমে মিলিয়ে গেল।
আবার খাওয়া শুরু করে জ্যাঠামশাই বললেন–হঠাৎ এমন বাতাস এল কোথা থেকে!
কেউই উত্তর দিল না। কিন্তু প্রত্যেকের বুকের ভেতরেই একটা আশঙ্কা চাপ বেঁধে রইল।
মাঝরাত্তিরের পর থেকে বাতাসের দমক যেন একটু বেশি বাড়ল। ঘুম ভাল হল না কারো।
পরের দিন সকালে উঠে সকালে উঠে দেখা গেল আকাশ ঢেকে গিয়েছে ধূসর মেঘে। সূর্যের দেখা নেই। ঠাণ্ডা বাতাস বইছে, সঙ্গে মাঝে মাঝে ধোঁয়ার মত গুঁড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। গতিক ভাল ঠেকছে না।
তবু সকলে আশায় বুক বেঁধে আসন্ন উৎসবের কাজকর্ম করে চলেছিল। যেন ও কিছু নয়, অমন একটু-আধটু মেঘ করেই থাকে, ও কেটে যাবে এখন। কেবল জ্যাঠামশাই কৃষাণ দুজনকে ডেকে বললেন–তোরা হরেন জানার বাড়ি চলে যা দিকি, আমার নাম করে চার-পাঁচখানা বড় আর মোটা ত্রিপল চেয়ে আনবি। ওরা বড় জোতদার, ফসল ঢাকা দেবার জন্য ওদের অনেক ত্রিপল আছে। চাইলেই দেবে’খন। যা–
তখনকার মানুষ একে অপরের বিপদে পাশে দাঁড়াত। হরেন জানা চাইবামাত্র পাঁচখানা ত্রিপল পাঠিয়ে দিলেন। পাড়ার লোক এবং কৃষাণেরা মিলে সেগুলো বাড়ির বিরাট উঠোন আর পাশে রান্না করার জায়গায় খাটিয়েও ফেলল—–যাতে এই ক-দিন ধরে ক্রমাগত জল পড়ে পড়ে উঠোন পেছল আর কাদায় ভর্তি না হয়ে থাকে। আমাদের গ্রামের মাটি সাধারণভাবে এঁটেল ধরণের, একবার কাদা তৈরি হয়ে গেলে আর দেখতে হবে না। কিন্তু এই অগ্রিম সাবধানতা বিশেষ কাজে লাগল না। সারাদিন ধরেই হাওয়ার জোর বাড়তেই লাগল, বিকেলের দিকে মেঘের ছায়ায় চারদিক ঘোর কালো হয়ে গেল, বৃষ্টি নামল ঝমঝম করে। আকাশপাতাল ভাসিয়ে এই প্রলয়ের বৃষ্টি চলল সারারাত বাড়ির কারো রাত্তিরে ঘুম হল না। পরদিন ভোর হল বটে, কিন্তু আলো ফুটল না ভাল করে। সমস্ত গ্রাম একটা বিশাল কাদার দহ হয়ে আছে। ভয়ঙ্কর পেছল এঁটেল মাটির কাদা। এই কাদা থাকলে বাইরের অতিথি দূরের কথা, গ্রামের লোকের চলাচলই বন্ধ হয়ে যাবে।
জ্যাঠামশাই একটুও দেরি না করে কৃষাণ দুজনকে বললেন-রামু, চরণ, তোমরা এক্ষুণি কুঞ্জদিদির বাড়ি চলে যাও। দিদিকে তোমাদের সঙ্গে নিয়ে এস এখানে। লাঠি নিয়ে যাবে। দুজনে শক্ত করে লাঠির দুদিক ধরে থাকবে, কুঞ্জদিদিকে ধরতে বলবে মাঝখানটা। নইলে উনি এই পেছল পথে আসতে পারবেন না। যাও—
মাঝেমাঝে বৃষ্টি সামান্য ধরে আসছে, তারপরেই আবার মুষলধারে শুরু হচ্ছে। এরই মধ্যে দেখা গেল কৃষাণদের সঙ্গে কুঞ্জপিসিমা আসছেন! দশমিনিটও তো হয়নি, কী ব্যাপার! জ্যাঠামশাই এগিয়ে গিয়ে বললেন—আরে! এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে তোমরা! আসুন দিদি, আসুন—
চরণ বলল—আমাদের পুরো রাস্তা যেতে হয়নি কর্তা। মাঝপথে গিয়েই দেখি মা-ঠাকরুন আসছেন।
বোয়াকের ধারে কাদামাখা পা ধুয়ে কুঞ্জপিসি ভেতরের বারান্দায় এসে বসলেন, বললেন-গোলোক, বৃষ্টির বহর দেখে তোমার এখানে আসবার জন্য আমি নিজেই। বেরিয়ে পড়েছিলাম। এ বৃষ্টি চার-পাঁচদিনের আগে থামবে না। পাঁচদিনের দিনও যদি থামে, তাহলেও তোমার কাজ আটকে যাবে। বৃষ্টির পর ভাল করে রোদ্র উঠতে আরা। একটা দিন লাগে, কাজেই কাদা শুকোবে না পথে-ঘাটে–
মেজকাকা বললেন-কাদা কোনো কী বলছেন, আমি তো ভাবছি একটা বন্যা-টন্যা না য়ে যায়!
কুঞ্জপিসি বললেন–কাজেই এই বৃষ্টি যেভাবেই হোক কালকের ভেতর থামা দরকার–
তারপর চারদিকে ভিড় করে আসা বৌ-ঝিদের দিকে তাকিয়ে বললেন—বৌয়েরা আর মেয়েরা, তোমাদের বলি বাচ্চারা—আমি এখন দুদিন তোমাদের বাড়ি থাকব। একবেলা দুটি আলোচালের ভাতে-ভাত ফুটিয়ে দিলেই হবে। রাত্তিরে একটুখানি দুধ। কেমন? আর বড়বৌমা, তোমার মেয়ের নীলরঙের শাড়ি আছে কি? নিয়ে এসে তো–
অকস্মাৎ প্রসঙ্গ পরিবর্তনে বিস্মিত হয়ে জ্যাঠাইমা বললেন—আজ্ঞে, নীলশাড়ি-মানে কেমন নীল?
যে কোনো রকম নীল হলেই চলবে, তবে হালকা বা আকাশী নীল হলেই ভাল হয়–
—অন্য রঙ হলে হবে না দিদি?
—না, নীল চাই।
সে সময়ে গ্রাম্য কিশোরী মেয়ের কটাই বা শাড়ি থাকত? তার মধ্যে নীলরঙের কোনো শাড়ি নেই। পনেরো কি কুড়ি মিনিটের মধ্যে খোঁজা শেষ। ম্লানমুখে মেজকাকিমা এসে বললেন—সিন্ধুলতার কোনো নীলশাড়ি পাওয়া গেল না দিদি। আমাদের বা অন্য কারো কাপড় হলে চলবে?
দুর্মুখ বলে গ্রামে কুঞ্জপিসিমার অখ্যাতি ছিল। মেজকাকিমার কথা শুনে তিনি রেগে গিয়ে বললেন—কী করে হবে? বিয়েটা তোমার না সিন্ধুলতার?
‘এমাঃ!’ বলে কাকিমা থতমত খেয়ে থেমে গেলেন, যদিও তিনি বুঝতে পারলেন না যার বিয়ে তার সঙ্গে শাড়ির কী সম্বন্ধ। কুঞ্জপিসিমা চোখ বুজে একটুখানি ভাবলেন, যেন ধ্যান করছেন, তারপর তাকিয়ে বললেন—আছে।
জ্যাঠামশাই গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন—কী আছে দিদি?-নীল শাড়ি আছে। আস্ত আছে কিনা জানি না, তবে আমার হাতখানেক লম্বা একটা টুকরো হলেও চলবে। সিন্ধুর পুতুলের বাক্স খুঁজে দেখ— ‘ বছরদুয়েক হল দিদি আর সেভাবে পুতুল নিয়ে খেলে না। তার পুতুলের বাক্স কোথায় পড়ে রয়েছে কে জানে। কিন্তু সবাই মিলে তোলপাড় করে খুঁজে চিলেকোঠায় ভাঙাচোরা আসবাব রাখার জায়গা থেকে সেটা বের করে আনল। প্রথমে বাক্স খুলে দেখা গেল কিছু কাঁচের রঙ্গীন চুড়ি, কাঠের আর মাটির পুতুল, সোনালি আর রূপোলি রাংতা, তাছাড়া। বাচ্চাদের খেলবার কিছু টুকিটাকি জিনিস। এসব সরিয়ে তার নিচে পাওয়া গেল এতক্ষণ যা খোঁজা হচ্ছে তাই। বাক্সের একদম তলায় চারভাজ করে পাতা হালকা নীলরঙের একটুকরো কাপড়। জ্যাঠামশাই বললেন আরে! এটা তো সেই পাঁচবছর আগে পুজোয় খুকিকে কিনে দিয়েছিলাম। আমারই তো মনে নেই, দিদি কী করে জানলেন?
এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর হয় না, কেউ উত্তর আশাও করে না। কুঞ্জপিসিমা কাপড়ের টুকরোটা হাতে নিয়ে তার পাট খুলে বললেন—বাঃ, এই তত বেশ হয়েছে। এতেই কাজ চলে যাবে। হ্যাঁ, কে যেন জিজ্ঞেস করছিল নীল ছাড়া অন্য রঙে কাজ চলবে কিনা? না, তা চলবে না এই কারণে যে, আকাশের রঙ তো নীল, সেই রঙ মেঘে আর বর্ষায় ঢেকে গিয়েছে—আবার সেই নীল ফিরিয়ে আনতে হবে।
বাইরে তখনও ঝমঝম করে বৃষ্টি চলেছে। কুঞ্জপিসিমা বারান্দার ধারে এসে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির জলের ধারায় কাপড়টুকু ধরে ভাল করে ভিজিয়ে নিলেন। জলে ভিজে। কাপড়ের রঙ কেমন গাঢ় হয়ে এল। আটপৌরে একটু মোটা কাপড়, টপটপ করে জল ঝরে পড়ছে তার থেকে। কুঞ্জপিসিমা কিন্তু সেটা নিঙড়োলেন না, দু-আঙুলের টিপে ধরে থেকে বললেন—চট করে মাটির চারটে তাল বানিয়ে ফেল দিকি। তারপর তাতে শক্ত করে চারটে বাঁশের কঞ্চি পুঁতে দাও। এবার ওই চারটে কঞ্চিতে এই কাপড়টা টান টান করে বাঁধ। দেখতে হবে যেন ছোট্ট সামিয়ানা, বুঝেছ?
পাঁচমিনিটের ভেতর অন্দরমহলের দালানে নীল কাপড়ের খেলনা সামিয়ানা খাটানো হয়ে গেল। ঝি-চাকর-কৃষাণ সমেত বাড়ির সবাই এসে দাঁড়িয়েছে ভিড় করে। কুঞ্জপিসিমা সাধারণভাবে ভিড়টাকে উদ্দেশ করে বললেন–অর্ধেক কাজ শেষ। এই কাপড়টাকে তাড়াতাড়ি শুকিয়ে ফেলতে হবে, তাহলেই আবার বরাদুর আর নীল আকাশ বেরিয়ে পড়বে। নিড়োতে পারবে না, তবে প্রয়োজন হলে পাখা নিয়ে হাওয়া দিতে পারো। এই ঘোর বর্ষায় বাতাসে জল ভরে আছে, এমনিতে শুকোতে চাইবে না। তাতে আবার মোটা কাপড়
তাঁর কথা শেষ হতে না হতে দুদিক থেকে দুজন হাতপাখা নিয়ে হাওয়া করতে বসে গেল। কুঞ্জপিসিমা জ্যাঠামশাইকে বললেন—গোলোক, তোমার কৃষাণ দুজনের নাম যেন কী? রামু আর চরণ, তাই না? ওদের বল একটা বেশ বড় দেখে কোলাব্যাঙ ধরে আনতে–
এ হুকুম পালন করতে সামান্য সময় লাগল। রূদ্ধশ্বাসে ভিড়টা অপেক্ষা করছে। চরণ একটু বাদে একখানা মোটাসোটা কোলাব্যাঙ ঠ্যাঙ ধরে ঝুলিয়ে আনল। জ্যাঠামশাই সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে কুঞ্জপিসির দিকে তাকালেন, বললেন—এবার দিদি?
—তোমাদের বাড়ির পেছনে কচুগাছের ঝোপ আছে না?
—হ্যাঁ দিদি।
–সেখানে এটাকে নিয়ে খোলা আকাশের নিচে আবার চারটে কঞ্চি পুঁতে এটার চারপায়ে সুতুলি দিয়ে বেঁধে চিৎ করে শুইয়ে রাখ। সাবধান! যেন ব্যথা না পায় বা মরে না যায়। গায়ে বৃষ্টির জল পড়লে ভালই থাকবে।
কৃষাণ দুজন লাফিয়ে পড়ল উঠোনে। গোলার পিঁড়ির গায়ে কঞ্চির গোছ বেঁধে রাখা ছিল, সেখান থেকে সাইজমাফিক চারটে খুলে নিয়ে তারা ব্যাঙ হাতে কচুবনের দিকে চলে গেল। কুঞ্জপিসি পেছন থেকে হেঁকে বললেন–খুব শক্ত করে বেঁধো না কিন্তু, তাহলে ওর পা ভেঙে যাবে। কোন প্রাণীকে কষ্ট দেওয়া উচিত নয়। নিজের প্রয়োজনে তো নয়ই। আবার আলগা রাখলে খুলে পালিয়ে যাবে। বুঝে করো–
সারা দিনরাত পালা করে দুজন বসে নীল সামিয়ানায় হাওয়া করতে লাগল। কিন্তু। বর্ষণমুখর দিনে ওই ভারি কাপড় কি অত সহজে শুকোয়? টপটপ করে জল পড়া বন্ধ হয়ে গেল বটে, কিন্তু পুরো জিনিসটা’ ঝুপসি হয়ে ঝুলে রইল। আর সে ব্যাঙু তো চার পা বাঁধা হয়ে পড়ে রইল কচুতলায়। খুব একটা খারাপ আছে বলে মনে হল না। মাঝে মাঝে আমরা ছেলেপুলেরা তাকে দেখতে যাচ্ছিলাম, দেখছিলাম তার ফ্যাকাসে সাদা পেটের ওপর বৃষ্টির ফোটা ঝরে পড়ছে। আমাদের দেখলেই সে গলা ফুলিয়ে জাওকো, জাওকো’ করে ডাকছিল। সমস্ত বাড়িতে বেশ একটা উৎসব-উৎসব পরিবেশ। বড়রা নিশ্চয় খুব দুশ্চিন্তা করছিলেন। ছোটরা অত বোঝে না, তারা মজা পেয়ে ছটফট করে বেড়াচ্ছিল।
রাত আটটার মধ্যে বাড়ির সকলের খাওয়াদাওয়া হয়ে গেল। আটটা মানে পাড়াগাঁয়ের অনেক রাত, বিশেষ করে বর্ষাভেজা দিনে। কুঞ্জপিসিমা শুধু একটু দুধ খেলেন—আর ঘরে তৈরি সন্দেশ। বাড়ির গরুর দুধের ছানা থেকে মেজকাকিমা বানিয়ে দিলেন। পাথরের বাটিতে সন্দেশ আর পাথরের গেলাসে দুধ। খাওয়া হলে কুঞ্জপিসি বললেন–এবার শোয়ার আগে একটা ছোট্ট কাজ বাকি। একটা কাঠির আগায় কিছুটা ন্যাকড়া জড়িয়ে তাতে তেল ঢেলে আনো তো–
কাকিমা জিজ্ঞাসা করলেন-তেল? কী তেল দিদি?
–যা তোক আনো না। রেড়ির তেল হলে ভাল হয়—
সারাদিন নতুন কাণ্ড দেখার পর বাড়ির লোকজন কোনো কিছুতেই আর তেমন করে উত্তেজিত হচ্ছিল না। কে একজন একটা ন্যাকড়ার মশাল করে আনল। কুঞ্জপিসি সেটাকে হাতে নিয়ে বললেন-এটাতে আগুন ধরিয়ে দাও
ন্যাকড়াটা ভাল করে জ্বলে উঠলে বারান্দায় পুবমুখখা হয়ে দাঁড়িয়ে তিনি জ্বলন্ত আগুনের গোলাটা কাঠিসুদ্ধ তুলে ধরে ঘোরাতে লাগলেন, যেন অদৃশ্য কাকে কী ইঙ্গিত করছেন। বিড়বিড় করে কী বলতে লাগলেন। কী বলছেন ভালো বোঝা গেল না, কিন্তু মনে হল যেন কাউকে বকাবকি করছেন।
ঘোরানো শেষ হলে মশালটা বারান্দার নিচে জমা জলে ফেলে দিলেন কুঞ্জপিসি, তারপর সবার দিকে ফিরে বললেন–সূর্যকে ওঠার কথা মনে করিয়ে দিলাম। আগুন দেখে তার যদি জ্বলে ওঠবার কথা মনে পড়ে–
নীল সামিয়ানার দু’ধারে দুজন বসে সমানে পাখা দিয়ে বাতাস করে চলেছে। জ্যাঠামশাই নির্দেশ দিয়েছেন–রাত্তিরে ডিউটি বদল করে কাজ চলবে।
রাতভোর ঝমঝম বৃষ্টির আওয়াজ শুনলাম ঘুমের মধ্যে।
পরের দিন সকালে ঘুম ভেঙে প্রথমেই যা মনে হল, তা হল এই যে, পরিবেশটা কেমন যেন একটু অন্যরকম। গতকালকের চেয়ে আজ যেন কী একটা অদলবদল ঘটে গিয়েছে। ঘুমচোখে প্রথমটা ঠিক ধরতে পারছিলাম না। ঘুমের আবেশ কাটতেই বুঝতে পারলাম।
বৃষ্টির শব্দ থেমে গিয়েছে বাইরে।
বিছানা থেকে একলাফে নেমে বাইরে এসে দেখি বৃষ্টি একেবারে থেমে গিয়েছে। আকাশ থেকে মেঘ সম্পূর্ণ সরে যায়নি বটে, কিন্তু এই পাতলা ঘোলাটে আবরণ কেটে গেলেই নীল আকাশ বেরিয়ে পড়বে তা বোঝা গেল। কুঞ্জপিসিমা কম্বলের আসনের ওপর বসে আছেন, তার মুখে একগাল হাসি। তাকে ঘিরে বাড়ির কর্তারা আর মেয়েরা সবিস্ময় জিজ্ঞাসাবাদ করছে। কুঞ্জপিসিমা বললেন—আমি কিছু জানি না বাবা। ভগবানকে ডেকে বলেছিলাম বৃষ্টিটা থামিয়ে দাও, নইলে সিন্ধুলতার বিয়ের কাজে অসুবিধা হবে। সিন্ধু তো আমারই মেয়ের মত। তার জীবনের একটা আনন্দের দিনে কারো যেন কোন কষ্ট না হয় তার জন্য ভগবানকে ডেকেছিলাম। ভগবান শুনলেন, এইটুকুই বলতে পারি–
মেজোকাকা বললেন—কিন্তু দিদি, এইসব যা যা করলেন—
কুঞ্জপিসি হেসে বললেন—ওসব কিছু নয়। ওসব হল কিছুটা ভড়ং আর কিছুটা আমাদের দেশী তুক। বুড়োবুড়িরা অনেকেই জানে। কাজ হয়েছে প্রার্থনায়, তুকে নয়।
বলাবাহুল্য তার কথা কেউই বিশ্বাস করল না। কুঞ্জপিসিমা বললেন–কাপড়ের টুকরোটা নিয়ে এসে তো, দেখি কতদূর শুকোলো–
সারারাত পালা করে জেগে বাতাস করার জন্যই হোক, বা সত্যিসত্যিই কুঞ্জপিসিমার তুকের গুণে হোক, ঐ মোটা কাপড়ের টুকরো কিন্তু সত্যিই খটখটে শুকনো হয়ে গিয়েছে। কুঞ্জপিসিমার নির্দেশে চরণ গিয়ে কচুতলায় শুয়ে থাকা ব্যাঙের বাঁধন খুলে দিল। সেটা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল। একদিন একরাত আটকা থেকে ব্যাঙটা বিশেষ নির্জীব হয়ে পড়েনি।
কুঞ্জপিসিমা বললেন—সূর্যকে কেমন আলো দেখিয়েছিলাম বল তো? আসলে মেঘবৃষ্টির দিনে সূর্য মাঝে মাঝে উঠতে ভুলে যায়, ঘুমিয়েই থাকে। ন্যাকড়ার আগুন দিয়ে আমি যা করলাম তাকে বলে পোড়া দেখানো। পোড়া দেখলে সূর্যের ওঠবার কথা মনে পড়ে যায়—
আমি তখন ছোট, কী প্রশ্ন করা উচিত বা উচিত নয় সে বিষয়ে জ্ঞান ছিল না। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কিন্তু পিসিমা, আপনি যে পোড়া দেখানোর সময় কীসব বলছিলেন, তা কি কোনো মন্ত্র?
কুঞ্জপিসিমা ঠাণ্ডা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন তোমার সব অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্ন! বৃষ্টি থেমে গিয়েছে তো? ব্যস্, আর কী চাই?
একটু পরেই রোদ্র উঠল। প্রথমে স্নান, তারপর কড়া রোদুর। কালকের ওই প্রলয়ের বর্ষণের পর আজকেই এমন রোদুর উঠবে কেউ কল্পনা করতে পারে নি। কুঞ্জপিসিমা সম্বন্ধে গল্পের ঝুলিতে আর একটা ঘটনা যোগ হল। কাদা শুকিয়ে খটখটে হয়ে গেল দুদিনের মধ্যে। নির্বিঘ্নে মিটে গেল সিন্ধুদিদির বিয়ে।
গল্প শেষ করে অসিত বিশ্বাস একটু থামলেন। তাঁবুর পর্দার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে রইলেন বাইরে, যেখানে ভেজা ঝোপঝাড় আর গাছের গুঁড়ি মায়াময় দেখাচ্ছে বিষম আলোয়। তার চোখে স্মৃতিমেদুরতার নরম চাউনি।
মেজকর্তা বললেন—আপনি খামোকই ভয় পাচ্ছিলেন বিশ্বাসবাবু, আমরা যতই সভ্য আর আধুনিক হই না কেন, এসব গল্পের মার নেই
অসিতবাবু বললেন–কী জানি, তাই হবে হয়ত। আমার ছোটবেলার গল্প বলে আমার ভাল লাগে। কিন্তু অন্যদের—যা গে, ভাল লাগলেই ভাল।
একটু চুপ করে থেকে আবার বললেন—এ গল্পের একটা ছোট্ট উপসংহার আছে। সেটা বলি। আমার সেই জ্যাঠতুত দিদি সিন্ধুলতা বিবাহিতজীবনে খুব সুখী হয়েছিলেন। শিবের মত স্বামী, সুন্দর আর বাধ্য ছেলেমেয়ে। ভরভরন্ত সংসার রেখে সিন্ধুদিদি মাত্র চল্লিশ বছর বয়েসে সবাইকে কাঁদিয়ে মারা যান। এবারও তার সম্বন্ধে কুঞ্জপিসিমার ভবিষ্যৎবাণী ফলে গিয়েছিল। তিনি বলেছিলেন সিন্ধুদিদি বাদুলে মেয়ে, দিদির জীবনের সব প্রধান দিনগুলোতে বর্ষণযোগ আছে। দিদি যেদিন মারা যান সেদিনও আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছিল। জীবনের শেষ প্রধান দিনে। তখন আর কুঞ্জপিসিমা বেঁচে নেই, থাকার কথাও নয়। আমি তখন জীবিকার সন্ধানে বাইরে বেরিয়ে এসেছি, পরে একবার গ্রামে গিয়ে খবরটা পাই। শুনে কুঞ্জপিসির কথা মনে পড়েছিল। এর পরে আর কখনো দেশে যাইনি। যোগসূত্র একেবারেই ছিঁড়ে গিয়েছে।
সেদিন অন্ধকার নেমে এল ঝপ করে। সাধারণত দিন আর রাত্রির মাঝখানে যে সন্ধিপ্রহর থাকে, যা দিনকে সযত্ন ভালবাসায় শুইয়ে দেয় রাত্রির শয্যায়, আজ তার দেখা পাওয়া গেল না। ভেজা অন্ধকার একরাশ বিমর্ষতা নিয়ে জড়িয়ে ধরল আমাদের তাঁবুগুলো আর জানি না আমার সন্ত্রস্ত মনের নিজেরই তৈরি ভুল কিনা—আবছা অন্ধকার ক্রমে গাঢ় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাতাসে জেগে উঠল অপার্থিব এক ফিসফিসানি। খুব মৃদু, কী ভাষায় তাও বোঝা যায় না, কিন্তু অজানা আশঙ্কায় পরিবেশকে ভারি করে তোলে। বাকিরা কি শুনতে পাচ্ছে? পেলেও ভয়টা নিজেদের ভেতরেই লুকিয়ে রেখেছে, আবরণ খুলে গেলেই বিপদ।
ওয়ার্কিং টেন্টে বসে কাজের আলোচনা করতে করতে খেয়ে নিলাম। ঘি-মাখানো চাপাটি, চিনেবাদাম দিয়ে কুমড়ো-আলুর তরকারি, আর হালুয়া। বিশুয়া আমাদের সঙ্গেই তাঁবুর একপ্রান্তে মাটিতে বসে খেল। তার বিহুলভাব এখন একটু কেটেছে।
খাওয়ার পরে তাঁবুতে ফেরার জন্য বেরিয়ে দেখি বাতাসের বেগ বেশ বেড়েছে, বৃষ্টি এইমুহূর্তে ঝমঝম করে না হলেও হাল্কা মেঘের মত গা ভিজিয়ে দিচ্ছে। তাবুর। পেট্রোম্যাক্স আলোয় এতক্ষণ থাকার পর বাইরের অন্ধকারে জঙ্গলকে আরো নিবিড় কালো দেখাচ্ছে।
তাঁবুতে এসে অসিতবাবু একটা ছোট তেলের ল্যাম্প জ্বেলে লিখতে বসলেন। কীসের প্রেরণায় যে ভদ্রলোক নিয়মিত ডায়েরি লিখে চলেছেন কে জানে! এই ডায়েরি হয়ত কোনোদিনই বিখ্যাত মানুষের দিনলিপির মত ছেপে বার হবে না, হয়ত উপেক্ষার আড়ালেই থেকে যাবে চিরদিন। তবু মনে মনে অসিতবাবুর অবিচলিত নিষ্ঠার প্রশংসা না করে পারলাম না।
লেখনী চালনারত অসিতবাবুর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি কে জানে। যখন ঘুম ভাঙল তখন সম্ভবত অনেক রাত। অসিতবাবু লিখতে লিখতে ঘুমিয়ে পড়েছেন—কিন্তু আলো নিভিয়ে দিতে ভুলে গিয়েছেন। আমার বিছানার পাশে মোমবাতি আর দেশলাই আছে, বালিশের তলাতেও দু-ব্যাটারির টর্চ নিয়ে শুয়েছি। কাজেই খামোকা তেল না পুড়িয়ে আলোটা নিভিয়ে দেওয়াই ভাল। সেই উদ্দেশ্যে উঠে বসলাম।
একি! তাঁবুর মধ্যে এরকম আলো কেন! তেলের বাতি জ্বললে তো মৃদু হলেও সবকিছু আলোয় দেখতে পাবার কথা। এখন আমি দেখতে পাচ্ছি বটে, কিন্তু এ কেমন দেখতে পাওয়া! ডাক্তারের দোকানে একরকম ঘোলাটে খয়েরি মোটা কাচের বোতলে মি অফ ম্যাগনেশিয়া বিক্রি করে, আমি যেন ঠিক তেমনি কাচের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে রয়েছি। চাপা, লালচে-খয়েরি আলো চারদিকে। অনেকদিন আগে, তখন ইস্কুলে পড়ি, একটা ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মধ্যে এইরকম আলো দেখেছিলাম। এতদিন পরে সেকথা মনে পড়ে গেল। তারপরেই চোখ পড়ল বাতিটার দিকে।
সেটা থেকে কালো রঙের আলো বেরুচ্ছে!
খুব অবিশ্বাস্য আর অপ্রাকৃত ঘটনার সরল বিবরণ দেওয়াই ভাল, সেজন্য কোনো অতিরিক্ত অলঙ্কার ব্যবহার না করে সোজাসুজি বললাম। আলো আর রঙের অভাবকে কালো বলে, তাহলে কালোরঙের আলো বলে কিছু কল্পনা করা সম্ভব কি? কিন্তু তাই দেখতে পেলাম চোখের সামনে। দেখলাম গুঁড়ো গুঁড়ো অন্ধকার লণ্ঠন থেকে বেরিয়ে মিশে যাচ্ছে পরিবেশে। তাঁবুর মধ্যেকার যেটুকু অবকাশ, তা ভারি আর ঘন হয়ে উঠেছে কালোরঙের আলোর গুড়োতে। জগৎ সংসার প্রায়ান্ধকার ধূসরতায় মূৰ্ছিত। বালিশের তলা থেকে টর্চ বের করে জ্বাললাম। একই ব্যাপার। টর্চের বাল্ব জ্বলছে দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মকে উপেক্ষা করে সেই উৎস থেকে বেরিয়ে আসছে অন্ধকারের গুঁড়ো!
টর্চ নিভিয়ে দিলাম। ঝুঁকে পড়ে হাত বাড়িয়ে নিভিয়ে দিলাম তেলের বাতি। মুক্ত বাতাসে একটু নিঃশ্বাস না নিতে পারলে কেমন যেন দমবন্ধ হয়ে আসছে। পরপর অস্বাভাবিক ঘটনা আর অপার্থিব দৃশ্য আমার মনকে বিকল করে তুলেছে। টর্চ হাতে। করেই বাইরে এসে দাঁড়ালাম। এখানেও অন্ধকার, কিন্তু সে অন্ধকার সহজ প্রাকৃতিক, স্বাভাবিক। বুঝলাম এমন কী কালোও স্বস্তিদায়ক হতে পারে বিশেষ পরিস্থিতিতে। মনের ভার একটু হালকা হলে বোতাম টিপে টর্চ জ্বাললাম।
স্বচ্ছ, সুন্দর, পবিত্র আলো। দুঃস্বপ্ন কেটে গিয়েছে।
কিন্তু না, তা বোধহয় নয়। পাহাড়েরা আজ আরো অনেক কাছে এগিয়ে এসেছে। একি শুধুই আলো-আঁধারির জন্য দৃষ্টিবিভ্রম? সচেতনভাবে এতটা ভুল দেখা কি সম্ভব? এভাবে চললে তো আর দুদিনের মধ্যে তাঁবুকে ছুঁয়ে ফেলবে পাহাড়ের সারি।
এতদিন মনে ঠিক ভয় জাগেনি। বরং বেশ একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি শীতের দিনে। আরামদায়ক চাদরের মত চেতনাকে জড়িয়ে ছিল। সেই বিশাল বনস্পতির অন্তর্ধান, ক্রমাগ্রসরমান পাহাড়, পাসাংমারার গান, এই বনভূমির নির্জনতা সমস্ত কিছুতেই মন নিজের মত একটা ব্যাখ্যা খাড়া করে উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেছিল। স্পষ্ট চোখে দেখা গেলেও প্রকৃতির নিয়মবিরুদ্ধ যুক্তিহীন কিছুকে মন মেনে নিতে অস্বীকার করে। সুস্থ থাকবার জন্য মনের এটা একটা কায়দা।
এবার জেগে উঠল ভয়। কুলিরা চলে গিয়েছে, জলধর পণ্ডাও নেই, নতুন লোকজন নিয়ে ফিরতে তার আরো অন্ততঃ দু-তিন দিন লাগবে। তেমন প্রয়োজন হলে অবশ্য জিপ নিয়ে শহরে চলে যাওয়া যায়, কিন্তু তবু রসদ কাজের যন্ত্রপাতি ফেলে যাওয়া হবেই বা কী করে? মেজকর্তা বা সার্ভেয়ার সাহেব হয়ত যেতে চাইবেন না। ওঁরা কি ঘটনাটার রহস্যময় অলৌকিক দিকটা ঠিকঠাক ধরতে পেরেছেন? শুনতে পেয়েছেন বাতাসের ফিসফাস? পেয়েছেন হয়ত, কিন্তু বলছেন না।
হঠাৎ একটা কথা মনে হল। দেবদর্শনবাবুর গ্রাম ছেড়ে বিদায় নিয়ে আসবার সময় তারানাথ তাকে বলেছিল—যদি কখনো আমাকে প্রয়োজন হয়, নির্জনে কোথাও দাঁড়িয়ে। মধুসুন্দরী দেবীর নাম উচ্চারণ করে মনে মনে আমাকে ডাকবেন। আমি ঠিক জানতে পারব।
দেবদর্শন বলেছিলেন—আপনি কীভাবে জানবেন?
তারানাথ উত্তর দিয়েছিল—ও বুঝিয়ে বলা যাবে না। তবে খবর পৌঁছবে। এখন এই মধ্যরাত্রির বৃষ্টিসিক্ত অরণ্যে দাঁড়িয়ে ভাবলাম—তারানাথকে একবার ডাকলে হয় না? যদি সে শুনতে পায় তাহলে জিনিসটার সত্যি-মিথ্যে পরীক্ষা হয়ে যাবে, আর এই পরিস্থিতিতে তার পরামর্শও আমাদের কাজে লাগবে।
এখনই ডাকব? এই এখানে দাঁড়িয়ে ডাকা যাক, দেখা যাক কী হয়।
চোখ বুজে মনে মনে তিনবার মধুসুন্দরী দেবীর নাম উচ্চারণ করে তারানাথকে স্মরণ করলাম। তাকে আমাদের খুব প্রয়োজন। আমার এই ডাক সে কি শুনতে পাচ্ছে? পেলে কি সাড়া দিতে পারবে?
আমার ঠিক পেছনে মৃদু কাশির শব্দ হল। তারপরেই খুব পরিচিত একটা গলার আওয়াজ—কী হে, ব্যাপার কী?
জীবনে কখনো এমন চমকাই নি!
আমার পেছনে ঝোপজঙ্গল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে তারানাথ জ্যোতিষার্ণব।
বিংশ শতকের আধুনিক মানুষ আমি, কথায় কথায় বিজ্ঞান আর সভ্যতার বড়াই করে থাকি, স্মরণ করামাত্র চারশো মাইল দূর থেকে তারানাথ আবির্ভূত হয়ে আমার যুক্তি আর বিজ্ঞানের অহঙ্কারকে মুহূর্তে বিরাট আঘাত করল।
তারানাথের পরণে ধুতি। আর গায়ে ধুতিরই খুঁট চাদরের মত করে জড়ানো। তাকে এই অন্ধকারে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি না বটে, কিন্তু তার পরিচিত অবয়ব চিনতে একটুও অসুবিধে হল না।
তারানাথ আবার বলল—ব্যাপার কী? ডেকে এনে চুপ করে রইলে কেন?
বিস্মিত গলায় বললাম—কিন্তু আপনি—আপনি এখানে এলেন কী করে?
সে কথার উত্তর না দিয়ে তারানাথ বলল কাজের কথা বল। তুমি কলকাতায় ফিরে গেলে বাকি সব আলোচনা হবে। এখন আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারব না।
সংক্ষেপে তারানাথকে আমাদের সিমডেগা আসা, পাখির মড়ক, বড় গাছটার উধাও। হয়ে যাওয়া, পাসাংমারার গান, কালোরঙের আলো, পাহাড়শ্রেণীর কাছে এগিয়ে আসা—সব বললাম। শুনতে শুনতে তারানাথ চারদিকে তাকাচ্ছিল, আমার কথা শেষ হলে সে বলল—একটা সমস্যা আমি এখনই মিটিয়ে দিচ্ছি। পাহাড়েরা কাছে এগিয়ে আসছে বলেছিলে না?
—আজ্ঞে হ্যাঁ।
—চারদিকে তাকাও তো। কী দেখছ?
তাকালাম। পাহাড়েরা আবার দূরে দূরে স্বস্থানে ফিরে গিয়েছে।
বললাম—এ রকম তো আগেও হয়েছে। মাঝরাত্তিরে এগিয়ে এসে ভোরবেলা পিছিয়ে গিয়েছে। এতে কী হল?
—আর এগিয়ে আসবে না, ব্যবস্থা করে দিলাম—
—অন্য সমস্যাগুলো?
—তার জন্যও ব্যবস্থা হবে। কাল সকাল হোক, সমাধান এসে পৌঁছবে।
বুঝলাম না সকালে কী সমাধান পৌঁছবে। কিন্তু হঠাৎ একটা ব্যাপার খেয়াল করে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। খুব ঘরোয়া পোশাকে তারানাথ সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেটা না হয় মানলাম। কিন্তু তার হাতে একটা হুঁকো! এই জঙ্গলে সে হুঁকো পেল কী করে?
প্রায় চিৎকার করে উঠলাম—এ কী! আপনার হাতে হুঁকো কী করে এল?
নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে তারানাথ একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল—এহে, এটা তো একেবারে খেয়াল করিনি। তুমি দেখতে পাবার আগে নামিয়ে রাখা উচিত ছিল—
—কিন্তু এভাবে আপনি এলেন কী করে?
গোপন কিছু করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলে লোকের যেমন মুখভাব হয় তেমনি মুখ করে তারানাথ বলল—আমি তো এখানে আসিনি।
বলে কী তারানাথ! আমি পাগল হয়ে গিয়েছি, না সে? স্পষ্ট দেখছি জলজ্যান্ত মানুষটা সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তাহলে আসেনি মানে?
তারানাথ একটু হেসে বলল—আমি আসলে রয়েছি কলকাতায়, মটু লেনের বাড়িতে। রাত্তিরে ঘুম ভেঙে অভ্যেসমত একটু তামাক ধরিয়ে খাচ্ছিলাম, এমন সময় তোমার ডাক এসে পৌঁছল। আসবার সময় হুঁকোটা নামিয়ে রাখতে ভুলে গিয়েছি। এটা যে তোমার চোখে পড়বেই সেটা আর খেয়াল হয়নি। হাঃ হাঃ হাঃ!
একটা লোক এসেছে অথচ আসেনি—এ কেমন রহস্য! আমি এক পা এগিয়ে হাত বাড়িয়ে তারানাথকে ছুঁতে গেলাম। তারানাথ বাধা দিয়ে বলল—ওটি কোরো না, আমাকে
স্পর্শ কোরো না। আমারও ক্ষতি হবে, তোমারও।
-কেন? কী হবে ছুঁলে?
—তাহলে আমি আর থাকতে পারব না। পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের ছবি পুকুরের জলে পড়ে, কিন্তু জলে ঢিল ফেললে আর সে ছবি দেখা যায় কি? যাক ওসব। কথা। একটা কথা বলে যাই, এখানে তোমরা কাজ করতে পারবে না। কোনো না কোনো বাধা এসে উপস্থিত হবে। জোর করে কাজ চালাতে গেলে তার ফল খুব খারাপ হতে পারে।
—তাহলে? আমি কাজ বন্ধ করতে বললে কী কোম্পানী শুনবে?
–না। তোমার কর্তারাই বলবে। সেভাবেই রিপোর্ট লেখা হবে। তোমার পেছনে ও কী?
তারানাথ আমার পেছনে তাকিয়ে কী যেন দেখছে। আমি পেছনদিকে তাকালাম। কই, কিছু নেই তো! কীসের কথা বলছে তারানাথ?
এদিকে ফিরে দেখি ঝোপের পাশ থেকে তারানাথও অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। বুঝতে পারলাম তার অন্তর্ধানের দৃশ্য দেখলে আমার মনে ধাক্কা লাগতে পারে, তাই সে এই সহজ কায়দাটা করেছিল। সে এখন মটু লেনে বসে বাকি তামাকটুকু খাচ্ছে।
তাঁবুতে ফিরে এলাম। অসিতবাবু এখনো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আমিও টর্চ বালিশের নিচে রেখে আবার শুয়ে পড়লাম।
তারানাথ বলেছে কাল সমাধান আসবে। কী সে সমাধান? কোন্ রূপে আসবে?
গাছের পাতায় টিপটিপ বৃষ্টির শব্দে ঘুম এসে গেল।