একটি অবহেলিত অধ্যায়
এক
আমরা যে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি, সেখানে যে আধুনিক সমাজ গঠিত হয়েছে, তা নির্মাণের পেছনে কত মানুষের অবদান ও শ্ৰম কাজ করেছে, তা পরিমাপ করা সম্ভব নয়। দীর্ঘদিন ধরে বহু খ্যাত-অখ্যাত মানুষ কোনো কিছু প্রাপ্তির আশা না করে নীরবে কাজ করে গেছেন একটি বসবাসযোগ্য সমাজ নির্মাণের জন্য। আজ বেগম রোকেয়ার নাম প্রতিদিন উচ্চারিত। তাঁর নামে রাস্তাঘাট, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অবশ্যই তাঁর অবদান বড়। তবে তাঁর যে নারীবাদী আন্দোলন, তা উচ্চমধ্যবিত্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আজ আমাদের দেশে নারীদের বিভিন্ন সংগঠন, পরিষদ, সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নারীদের জন্য রয়েছে বহু বড় বড় এনজিও। তাতে বিদেশি অর্থায়নও প্রচুর। কিন্তু কোনো নারীবাদী সংগঠন কি কখনো স্মরণ করে ডাক্তার লুঙ্কর রহমানের নামটি? যিনি ১৯২০-এর দশকে, রোকেয়ার জীবদ্দশায়ই কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘নারী-তীর্থ’ নামের সেবাশ্রম এবং নারী-শক্তি নামে পত্রিকা।
যশোর জেলার অধিবাসী এবং পেশায় হোমিওপ্যাথ ডাক্তার, লুৎফর রহমান প্রথম জীবনে কিছুকাল স্কুলে শিক্ষকতা করেন। তিনি ছিলেন আদর্শবাদী ও যুক্তিবাদী মানুষ। শিক্ষকতায় গিয়েছিলেন জীবিকার জন্য নয়, মানুষ তৈরি করার ব্রত নিয়ে। তাঁর জীবনের লক্ষ্য ছিল উঁচু, কিন্তু সংগতি ছিল কম। বিত্তবান তিনি ছিলেন না, ছিল না তার কোনো বিত্তবান হিতৈষী। সীমিত শক্তি নিয়ে একটি উন্নত সমাজ গঠনের জন্য তিনি আমৃত্যু কাজ করেছেন। কোনো আনুকূল্য পাননি কোনো দিক থেকে। মাত্র ৪৭ বছর বয়সে তিনি ১৯৩৬ সালে কলকাতায় মারা যান। তিনি তাঁর ঘরে দরিদ্র যক্ষ্মা রোগীদের রেখে চিকিৎসা করাতেন এবং একপর্যায়ে নিজেই যক্ষ্মায় সংক্রমিত হয়ে মারা যান। সুমহান আদর্শবাদিতা।
রোকেয়া ছিলেন উচ্চমধ্যশ্রেণির প্রতিনিধি, সাধারণ দরিদ্র, নির্যাতিত-নিপীড়িত নারীদের ব্যাপারে তাঁর বিশেষ দুশ্চিন্তা ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশে নির্যাতিত-নিপীড়িত নারীর সংখ্যাই বেশি। শুধু পেটের দায়ে বহু যুবতী ও অসহায় নারী পতিতালয়ে গিয়ে আশ্রয় নিত। লুত্ফর রহমান তাদের খোঁজ নিতেন। তাদের নিঃশব্দ কান্না তার বুকে বাজত। তিনি তাদের অনেককে পতিতালয় থেকে বের করে এনে সমাজে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। একবার যে নারী দেহব্যবসা করেছে, আমাদের সমাজ তাকে আর ঠাই দেবে না। একপর্যায়ে লুৎফর রহমান তার নিজের ঘরেই তাদের। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। কাজটি ছিল অত্যন্ত কঠিন। আশপাশের মানুষ তার ওপর ক্ষুব্ধ হয়। তিনি তাঁর কর্মসূচির নাম দেন ‘নারী-তীর্থ’। সেখানে রোকেয়া একদিনও যাননি, কবি গোলাম মোস্তফা, নজরুল ইসলাম গেছেন। নজরুল ছাড়া তিনি আর কারও থেকে কোনো সমর্থন পাননি। লুৎফর রহমান পত্রিকা বের করেন নারী-শক্তি নামে। বাঙালি মুসলমানসমাজ উন্নত ও মহৎ কিছু কখনো দেখেনি। তাই কলকাতার কোনো বিত্তবান মুসলমান তাঁর মহৎ কর্মে এগিয়ে আসেননি।
লুৎফর রহমানের উপদেশমূলক রচনাবলি বহুপঠিত। বাংলা একাডেমিও তার রচনাবলি প্রকাশ করেছে। তা ছাড়া পাইরেট সংস্করণ হয়েছে তার প্রবন্ধগ্রন্থ উচ্চ জীবন, মহৎ জীবন, উন্নত জীবন, মানব জীবন, সত্য জীবন প্রভৃতি। ছেলেদের মহৎ কথা তার একটি চমৎকার বই। লুৎফর রহমান একজন সৃষ্টিশীল লেখকও ছিলেন। তাঁর উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে পথহারা, প্রীতি উপহার, বাসর উপহার, রায়হান প্রভৃতি। একজন সৃষ্টিশীল লেখক, সংস্কারক ও সমাজকর্মী হিসেবে লুৎফর রহমান সমাজের মূলধারা থেকে যে স্বীকৃতি ও মর্যাদা দাবি করেন, তা তিনি পাননি। ফলে তাঁর বইপত্র বাজারে রয়ে গেলেও ব্যক্তি লুৎফর রহমান হারিয়ে যান। আমরা প্রভাবশালী ও বিত্তবানের পায়ে অর্ঘ্য দিতে অভ্যস্ত– তাঁর অবদান যত সামান্যই হোক।
অশেষ অভাব ও অজ্ঞতার অন্ধকারে পড়ে থাকা বাঙালি মুসলমানকে অশিক্ষিত কাঠমোল্লা ও ভণ্ড ধর্ম ব্যবসায়ীরা শতাব্দীর পর শতাব্দী প্রতারণা করে আসছিল। ইসলামের মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে, বিচিত্রভাবে প্রতারণা করে একটি শ্রেণি বৈষয়িকভাবে উঠেছিল ফুলে-ফেঁপে। তারা সুবিধাবাদী রাজনৈতিক নেতাদের থেকেও আনুকূল্য পেত। ওই ভণ্ড ধর্ম ব্যবসায়ী ও সুবিধাবাদী রাজনীতিকদের সরাসরি আঘাত করা কঠিন ছিল। নজরুল তাঁর জনপ্রিয়তা ও হিমালয়তুল্য ব্যক্তিত্বের জন্য খানিকটা পেরেছিলেন। অন্য কারও পক্ষে তা সহজ ছিল না। আবুল মনসুর আহমদ সেই ঝুঁকি নেন। তিনি পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন সাংবাদিকতা ও আইন ব্যবসাকে। নেশা হিসেবে বা সামাজিক দায়িত্ব পালনের জন্য সাহিত্য ও রাজনীতি। আবুল মনসুরের ব্যঙ্গগল্প বা রম্যরচনা আয়না (১৯৩৫) বাংলা সাহিত্যের এক অসামান্য কাজ। তাঁর আরেকটি রসরচনা ফুড কনফারেন্স (১৯৪৪)। দুটি গ্রন্থে যে বিষয় দুটিকে তিনি আঘাত করেছিলেন, সেই ধর্ম ব্যবসা ও সুবিধাবাদী নষ্ট রাজনীতি আজও আমাদের দেশ ও সমাজকে পেছনের দিকে টানছে।
আয়না সম্পর্কে নজরুল লিখেছিলেন, ‘এমনি আয়নায় শুধু মানুষের বাইরের প্রতিচ্ছবিই দেখা যায়, কিন্তু আমার বন্ধু [কথা] শিল্পী আবুল মনসুর যে আয়না তৈরি করেছেন, তাতে মানুষের অন্তরের রূপ ধরা পড়েছে। যে-সমস্ত মানুষ হরেক রকম মুখোশ পরে আমাদের সমাজে অবাধে বিচরণ করছে, আবুল মনসুরের আয়নার ভেতরে তাদের স্বরূপমূর্তি– বন্য ভীষণতা নিয়ে ফুটে উঠেছে। মানুষের মুশোখপরা এই বহুরূপী বনমানুষগুলোর সবাইকে মন্দিরে, মসজিদে, বক্তৃতার মঞ্চে, পলিটিক্সের আখড়ায়, সাহিত্যসমাজে যেন বহুবার দেখেছি বলে মনে হচ্ছে।’
নজরুল আরও বলেছিলেন, ‘বন্ধুবরের রসাঘাত কশাঘাতেরই মত তীব্র ও ঝাঝালো।’
আবুল মনসুর আহমদ ছিলেন বহুমুখী ব্যক্তিত্ব। তিরিশের দশক থেকে তিনি বাঙালি মুসলমানসমাজে একজন প্রতিনিধি-পুরুষ। সাংবাদিকতা করেছেন, সাহিত্যচর্চা করেছেন, রাজনীতিতে ভূমিকা রেখেছেন এবং সমাজের –বিশেষ করে মুসলমানসমাজের –দোষ ও দুর্বলতাগুলো দূর করতে কিছুটা সংস্কারের কাজও করেছেন। সমাজের অন্যায়-অসংগতি তাঁকে পীড়া দিয়েছে। সেসবের বিরুদ্ধে তিনি লিখেছেন। তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের প্রগতিশীল মানুষ।
মুসলমানসমাজের আধুনিক সাংবাদিকতার যারা পথিকৃৎ, আবুল মনসুর তাঁদের মধ্যে প্রধান। ১৯২০ এবং ‘৩০-এর দশকে বিভিন্ন কাগজে তিনি কাজ করলেও ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বরে নিখিল বঙ্গ প্রজা পার্টির মুখপত্র দৈনিক কৃষক এর সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। একটি অসাম্প্রদায়িক কাগজ হিসেবে সেটি প্রশংসিত হয়েছিল। তবে খুব বেশি সময় তিনি সেখানে ছিলেন না। ১৯৪১ সালে শেরেবাংলা ফজলুল হকের দৈনিক নবযুগে যোগ দেন। প্রধান সম্পাদক ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম, কিন্তু সম্পাদনার মূল দায়িত্ব পালন করতেন আবুল মনসুর। নজরুল তখন শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে ভেঙে পড়ছিলেন। নবযুগে থাকাকালেই তিনি বাক্ ও স্মৃতিশক্তি হারান।
সাংবাদিকতায় আবুল মনসুরের গুরুত্বপূর্ণ অবদান দৈনিক ইত্তেহাদ, প্রকাশিত হয় ১৯৪৭-এর জানুয়ারিতে, মালিকানা ছিল অখণ্ড বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর। কাগজ হিসেবে ইত্তেহাদ ছিল আধুনিক ও প্রগতিশীল এবং অসাম্প্রদায়িক। যদিও মুসলমানসমাজের আশা-আকাঙ্ক্ষা তাতে প্রাধান্য দিয়ে তুলে ধরা হতো। ১৯৫০ সালে ইত্তেহাদ বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের বাড়িতে ইত্তেহাদ আসত কলকাতা থেকে। মওলানা আকরম খাঁর আজাদ ছিল মুসলিম জাতীয়তাবাদী এবং ইত্তেহাদ ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী। চল্লিশের দশকের শেষ দিকে ইত্তেহাদ বহু মুসলমান তরুণকে সাংবাদিকতা শিখিয়েছে, পরে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তাঁরা খ্যাতিমান হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মোহাম্মদ মোদাব্বের, কে জি মুস্তফা, খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, খোন্দকার আবদুল হামিদ, কাজী মোহাম্মদ ইদ্রীস, কথাশিল্পী রশীদ করীম, সিরাজুদ্দীন হোসেন প্রমুখ। আমাদের বাড়িতে ইত্তেহাদ-এর বহু পুরোনো কপি ছিল। তার সাহিত্য বিভাগ, মহিলা বিভাগ, শিশু কিশোরদের পাতা, সিনেমার পাতা, খেলাধুলার পাতা প্রভৃতি ছিল মানসম্মত। তার চেয়েও বড় কথা, মুসলমান সমাজ তখন জেগে উঠেছে। সে আত্মপ্রকাশ করতে চাইছে সব ক্ষেত্রে। সে চাইছে আত্মপ্রতিষ্ঠা করতে এবং নিজেদের বিকশিত করতে। বাঙালি মুসলমান পুরুষ শুধু নয়, বাঙালি নারীও ঘরের বাইরে এসে নিজের শক্তির স্বাক্ষর রাখতে চাইছে। বাঙালি মুসলমান খেলাধুলায় আগ্রহ দেখাচ্ছে। অগ্রগামী হিন্দুদের সঙ্গে খেলার মাঠে ও জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। সিনেমার মতো নতুন শিল্পমাধ্যমে তার আগ্রহ দেখা যায়। মুসলমান শিশু কিশোরদের সুপ্ত প্রতিভা অঙ্কুরিত করার প্রয়াস দেখা দিয়েছে চল্লিশের দশকে। মুসলিম লীগ চাইছে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে স্বশাসন। মুসলমানসমাজ তাতে গভীরভাবে সাড়া দিচ্ছে।
আবুল মনসুর আহমদ একজন বিশিষ্ট সৃষ্টিশীল লেখক, বরং তার অন্যান্য পরিচয়ের মধ্যে লেখক পরিচয়ই প্রধান। আয়না ও ফুড কনফারেন্স-এর রম্য ছোটগল্পগুলো সাহিত্যকর্ম হিসেবে অসামান্য। তিনি কয়েকটি উপন্যাসও লিখেছেন। শিল্পকর্ম হিসেবে সেসব উপন্যাস কতটা উত্তীর্ণ, তার চেয়ে বড় কথা, তাতে তিনি আঁকতে চেয়েছেন একটি সময়ের বাঙালি মুসলমানের বাইরের ও ভেতরের চিত্র। তাঁর উপন্যাস তিনটি– সত্যমিথ্যা, জীবনক্ষুধা ও আবেহায়াত। তিনি সমাজের সমস্যার কথা বলতে চেয়েছেন। জীবনক্ষুধায় চল্লিশের শেষের বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্তের মনোজগৎকে তুলে ধরতে পেরেছেন। বাংলা উপন্যাস নিয়ে যখন আলোচনা হয়, যেখানে আবুল মনসুর আহমদ বিশেষ গুরুত্ব পান না। বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের দুর্বলতা সেখানে।
আবুল মনসুর আহমদ পূর্ব বাংলার গ্রামীণ মুসলমানদের জীবনের রূপকার। তাঁর গদ্য পরিশীলিত নয়, তিনি বিষয়বস্তুর ওপর বা বক্তব্যের ওপর জোর দিয়েছেন। বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও ঢাকা অঞ্চলের গ্রাম্য শব্দ তিনি বেশি ব্যবহার করেছেন, শুধু সংলাপে নয়, ন্যারেশনেও। তবে সব ক্ষেত্রে সে ব্যবহার যথোপযুক্ত হয়নি। ভাষার প্রশ্নে তাঁর নিজস্ব বক্তব্য ছিল। তাঁর সঙ্গে অনেকেই একমত নন। অবশ্য তাতে তার গুরুত্ব কমে না। যে থিসিস তিনি দেবার চেষ্টা করেছেন তা বিবেচনার বিষয়। বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্য আর পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সাহিত্যের ভাষা কখনোই হুবহু এক হবে না।
আবুল মনসুরের চিন্তাধারার সঙ্গে আমরা ভিন্নমত পোষণ করতে পারি, কিন্তু এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে বাঙালি মুসলমানসমাজের অনেক চিহ্নিত প্রগতিশীলদের চিন্তায় যে অসংগতি লক্ষ করা যায় তার মধ্যে তা অনুপস্থিত। তিনি গা বাঁচিয়ে অথবা চাতুর্যের আশ্রয় নিয়ে কথা বলতেন না। যা ভাবতেন একান্তে তাই ব্যক্ত করতেন প্রকাশ্যে সকলের মধ্যে। পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সম্মেলন ১৩৫১-তে (১৯৪৪) মূল সভাপতির অভিভাষণে তিনি বলেন :
‘ধর্ম ভূগোলের সীমা ছাপিয়ে উঠতে পারে, কিন্তু তমদ্দুন ভূগোলের সীমা এড়াতে পারে না, বরঞ্চ সে-সীমাকে আশ্রয় করেই সংস্কৃতির পয়দায়েশ; এখানেই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সরহদ্দ। এখানেই পূর্ব পাকিস্তান একটি ভৌগোলিক সত্তা। এই জন্যেই পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দারা ভারতের অন্যান্য জাত থেকে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ধর্মীয় ভ্রাতাদের থেকে একটা স্বতন্ত্র আলহিদা জাত।’
অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ববঙ্গ যে পাকিস্তানের একটি অবিচ্ছেদ্য নয় বিচ্ছিন্ন অংশ তা স্বীকার করে নিয়েই এই অঞ্চলের বাঙালি জাতির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তিনি আলোচনায় ব্রতী হন।
পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য মাহফিল আয়োজিত চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন’-এ তিনি ‘পাক-বাংলার কালচার ও ভাষা’ শীর্ষক প্রবন্ধে অধিকাংশ আলোচকের সঙ্গে অভিন্ন মত পোষণ করেননি বলেই ‘ইসলামকেই পূর্ব বাংলার সংস্কৃ তির একমাত্র নিয়ন্ত্রণী শক্তি হিসেবে গণ্য করেননি। পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব বাংলার কৃ ষ্টি ও ভাষার পার্থক্য স্বীকার করে নিয়ে, ভৌগোলিক-ঐতিহাসিক-সামাজিক ঐতিহ্যের ভিত্তিতে নিজস্ব সংস্কৃতি ও ভাষা পুনর্গঠনের ওপর তিনি জোর দেন।
মাসিক মোহাম্মদীতে (কার্তিক ১৩৫০/১৯৪৩) ‘পূর্ব পাকিস্তানের জবান’ শীর্ষক এক নিবন্ধে আবুল মনসুর পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি এবং তার পরিচালকদ্বয় আবুল কালাম শামসুদ্দীন এবং মুজীবুর রহমান খাঁর প্রশংসা করে লিখেছিলেন :
‘পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষাগত রূপায়ণের ভাবী রূপ নিয়ে মুসলিম বাংলার চিন্তানায়কদের মধ্যে এখন থেকেই আন্দোলন আলোচনা খুব স্বাভাবিকভাবেই শুরু হয়েছে। এই বিষয়ে পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি যে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ভূমিকায় অভিনয় করেছে, সে সম্বন্ধে বাঙলার মুসলমান এমনকি, এদের সীমিতাংশও, আজো পুরোপুরি সচেতন হননি।… বস্তুত পাকিস্তান দাবিকে একটা রাজনৈতিক, এমনকি নির্বাচনী শ্লোগান থেকে একটা ইনটেলেকচুয়াল আইডিয়্যালিজমে রূপান্তরিত করেছে প্রধানতঃ এই দুই ব্যক্তির মনীষা। আমি একাধিকবার স্বীকার করেছি, প্রধানতঃ এদের প্রেরণায় আমি পাকিস্তানের আদর্শবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছি। কায়েদ-ই-আজমের মনে যাই থাক, বাংলায় পাকিস্তানবাদ নিশ্চয় পার্লামেন্টারি কচকচিতে খেই হারিয়ে ফেলতো যদি না এই দুই ব্যক্তি নানা বিপদ ও অপ্রীতি অগ্রাহ্য করে নিশিদিন কলম চালিয়ে পাকিস্তানবাদকে এই ইনটেলেকচুয়াল রূপ দিতেন…।
এই পাকিস্তানবাদের ইনটেলেকচুয়াল রূপটি সেকালের প্রধান বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে কেমন ছিল তা সংক্ষেপে আলোচনা করা সম্ভব নয়। তবে আবুল মনসুরের ধারণায় মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলার যে চরিত্র গ্রহণের কথা ছিল ১৯৪৭ এর পর তারা দেখলেন এ এক অন্য পূর্ববঙ্গ। মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক নেতারা ততদিনে পূর্ব বাংলা দখল করে নিয়েছেন। এবং তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন একদল ভাড়াটে কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক। প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা পূর্ব বাংলার দুর্দশা দেখে প্রথম দিকেই মর্মাহত ও হতাশ হন। আবুল মনসুরও হতাশ হন। তিনি সেই শ্রেণির বুদ্ধিজীবী যিনি দিল্লির শাসকদের মনোভাবের সঙ্গেও একমত নন, অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানি পাঞ্জাবি শাসক-শোষকদের সঙ্গে গাটছড়া বাধারও বিরুদ্ধে। তবে তিনি মোটেই উগ্র নন, যা বলার নিচু কণ্ঠে শান্তভাবেই বলেন। তাঁর ভাষায়, গোটা পাকিস্তান অর্থ ছিল কার্যতঃ ‘পশ্চিম পাকিস্তান।’ তিনি আর পরিষ্কার করে বলেন : ‘আমাদের রাষ্ট্রীয় রূপ “পূর্ব পাকিস্তান” বা ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ যাই হোক ভাষা-সাহিত্য-কালচার-সংস্কৃতিতে যে আমরা একদিকে পশ্চিম পাকিস্তান ও অপরদিকে ভারত হইতে সম্পূর্ণ পৃথক, এসব ব্যাপারেই যে আমাদের নিজস্বতা ও স্বকীয়তা আছে, এটা আমার অনড় দৃঢ় মত।’ [আত্মকথা] ।
আবুল মনসুর আহমদ ছিলেন প্রথমত পূর্ব বাংলার একজন খাঁটি বাঙালি, তারপর একজন মুসলমান এবং এই দুইয়ের সমন্বয়ে হয়ে উঠেছিলেন একজন খাঁটি বাঙালি মুসলমান। ওই বাঙালি মুসলমান হওয়াটাই তার জন্যে হয়েছিল সমস্যা। তাঁর লেখা পড়ে এবং জীবন পর্যালোচনা করে মনে হয় না তিনি কিছুমাত্র সাম্প্রদায়িক ছিলেন। অনেক বাঙালি মুসলমান নেতার মতো একেবারেই ভারতবিদ্বেষী ছিলেন না, হিন্দুবিদ্বেষী তো ননই। তাঁর ব্যবহৃত কিছু কিছু শব্দ ও শব্দ বন্ধ তাঁকে ভুল বোঝার পথ করে দেয়। তার মধ্যে পূর্ববঙ্গীয়তা ছিল পুরোপুরি; কিন্তু হিন্দু-বিরূপতা ছিল না একেবারেই। যেমন তিনি পূর্ব বাংলাকে বলেছেন ‘মুসলিম বাংলা’, কথাটিতে আমরা শঙ্কিত হতে পারি কারণ পদ দুটিতে ধ্বনিত হয় যেন সাম্প্রদায়িক চেতনা। কারণ পাকিস্তানি রাষ্ট্রপতি ভুট্টোর মুখেও শোনা গেছে কথাটি ‘৭০-এর দশকে। ভারতের প্রতিরক্ষমন্ত্রী জগজীবন রাম ১৯৭২-এর জানুয়ারিতে বাংলাদেশকে অখ্যায়িত করেছেন ‘দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র’ বলে। এ সব কথায় সাম্প্রদায়িকতার প্রকাশ ঘটে না। আবুল মনসুরকে সমর্থন করার জন্য বলছি না, বস্তুত তাঁর লেখা পাঠ করে সহজেই বোঝা যায় যে কথাটিতে তিনি বোঝাতে চাইতেন ‘মুসলমানপ্রধান পূর্ববঙ্গ’। অবহেলিত পূর্ব বাংলাই ছিল তাঁর চিন্তা-চেতনার কেন্দ্রবিন্দু। সেটা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ভেদবুদ্ধি থেকে নয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অনগ্রসরতার চেতনাপ্রসূত।
যে ভৌগোলিক অবস্থানে আজকের বাংলাদেশ, যার রাজনৈতিক রূপ গ্রহণ করতে শুরু করে ১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গের সময় থেকে, তারপর ১৯৪৭-এ এক চরিত্র গ্রহণ করে এবং ১৯৭১-এ যে স্বয়ংসম্পূর্ণ সার্বভৌম রাষ্ট্রের রূপ গ্রহণ করে, তার প্রতিষ্ঠাতাদের একজন আবুল মনসুর আহমদ : ছোট এবং বড়, প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ, দু’রকম ভূমিকাই তিনি পালন করেছেন। আমি প্রত্যয়ের সঙ্গে বলতে চাই, যদি ১৯৪৭-এর পর খাজা নাজিমুদ্দিনদের হাতে ক্ষমতা না থেকে আবুল মনসুর ও তার সমধর্মীদের হাতে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হতো, অন্তত তাঁদের পরামর্শ গৃহীত হতো, তাহলে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতো– সমাজ হতো সাম্প্রদায়িকতামুক্ত। অনুরূপভাবে ১৯৭১-এর পর যদি তাদের পরামর্শে বাংলাদেশ শাসিত হতো তাহলে ‘সোনার বাংলা না হোক অন্তত শান্তিতে বসবাসযোগ্য এক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হতো। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রায় একটি দশক জীবিত ছিলেন তিনি, কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ তাকে ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাকে শ্রদ্ধা করেছেন কিন্তু তার পরামর্শ গ্রহণ করার প্রয়োজন মনে করেননি তাঁর পুত্রপ্রতিম শেখ মুজিব। আবুল মনসুরের মতো মধ্যপন্থী মানুষ প্রগতির জন্য কখনোই বাধা নন, কারণ তাঁরা রক্ষণশীল হতে পারেন কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল নন –তাঁরা মুখর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে ও সকল রকম অন্যায়-অবিচার ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে।
সুতরাং তাদের চিন্তা, মেধা, প্রজ্ঞা ও মানবপ্রেম একটি জাতি গঠনে অত্যন্ত প্রয়োজন। পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা চেয়েছিলাম গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থা। আবুল মনসুর আহমদ এই নীতিগুলোর কোনোটারই বিরুদ্ধে ছিলেন না। সমাজতন্ত্রী তিনি ছিলেন না, কিন্তু সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কোনো কর্মসূচির তিনি বিরোধিতা করতেন না। আর গণতন্ত্রী ও ধর্মনিরপেক্ষ তিনি ছিলেন পুরোপুরি।
দুই
যে স্বাধীন বাংলাদেশের ১৯৭১-এ অভ্যুদয় ঘটে, তা একদিনে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এই জাতিরাষ্ট্র নির্মাণের প্রস্তুতি অনেক দিনের এবং সেই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ ছিল জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বহু মানুষের। নিজস্ব ভূখণ্ডে স্বশাসিত হওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা, তা এই অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মধ্যে সুপ্ত ছিল, তাকে জাগিয়ে তোলার জন্য অসংখ্য মানুষ বিচিত্রভাবে কাজ করেছেন। সেই ভূমিকা সবচেয়ে বেশি পালিত হয়েছে সাহিত্যচর্চা ও সাংবাদিকতার মাধ্যমে।
ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের অধিবাসী আবুল কালাম শামসুদ্দীন ১৯২০ ২১ সালে গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন এবং তার পরপরই ক্ষণজীবী মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ সম্পাদিত দৈনিক মোহাম্মদীতে সাংবাদিকতা শুরু করেন। পিছিয়ে থাকা মুসলমানসমাজকে কীভাবে সচেতন করে তোলা যায়, সে জন্য তিনি সাংবাদিকতা ও সাহিত্যচর্চাকে বেছে নেন। প্রচারণামূলক ও মননশীল রচনা শুধু নয়, বিদেশি ক্ল্যাসিক সাহিত্য, বিশেষ করে রুশ লেখক তুর্গেনিভের অনেক রচনা তিনি বাংলায় অনুবাদ করেন। তাতে তাঁর অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। তবে সাংবাদিকতাকেই জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করেন এবং তিনি বাস্তবিক পক্ষে বাংলাদেশে আধুনিক সাংবাদিকতার অন্যতম জনক। দৈনিক ছোলতান, দৈনিক আজাদসহ কয়েকটি কাগজে তিনি সম্পাদক ছিলেন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ষাটের দশকের শুরুতে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় দৈনিক জেহাদ। দৈনিক জেহাদ ছিল আইয়ুব-মোনায়েম সরকারের সমর্থক কাগজ, তাতে আবদুল গাফফার চৌধুরী, নির্মল সেন প্রমুখ নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকেরা চাকরি করতেন। সেটি ছিল একটি আধুনিক দৈনিক। পাঠকপ্রিয়তাও পেয়েছিল অল্প দিনে, কিন্তু বছর দেড়েকের মধ্যে দৈনিক জেহাদ বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৬৪ সালে আইয়ুব সরকার প্রতিষ্ঠিত প্রেস ট্রাস্ট অব পাকিস্তান প্রকাশ করে দৈনিক পাকিস্তান– বাংলা ভাষার একটি সর্বাধুনিক কাগজ। আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, সানাউল্লাহ নূরী, ফজল শাহাবুদ্দিনসহ আধুনিক বহু কবি-সাহিত্যিক ও সাংবাদিক দৈনিক পাকিস্তানে যোগ দেন, যাদের প্রায় সবাই ছিলেন কমবেশি প্রগতিশীল ঘরানার মানুষ। আবুল কালাম শামসুদ্দীন ১৯৭১-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত দৈনিক পাকিস্তান-এর সম্পাদক ছিলেন। দৈনিক পাকিস্তান-এর সাংবাদিকতার মান ছিল খুবই উন্নত। ছাপা হতো আধুনিক যন্ত্রে। পৃষ্ঠাও ছিল উপমহাদেশে বাংলা ভাষার যেকোনো দৈনিকের চেয়ে বেশি।
দৈনিক পাকিস্তান-এর মহিলা বিভাগটি ছিল উঁচুমানের। সেটি সম্পাদনা করতেন মাফরুহা চৌধুরী। তিনি একজন ছোটগল্পকার হিসেবে ষাটের দশকে খ্যাতিমান ছিলেন। তাঁর গল্পগ্রন্থগুলোর মধ্যে অরণ্য গাঁথা ও অন্যান্য গল্প, কোথাও ঝড়, স্থলিত নক্ষত্র, বিদীর্ণ প্রহর প্রভৃতি নাম করেছিল। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন কবি তালিম হোসেনের স্ত্রী। তিনি এবং কবি আহসান হাবীব এক কামরায় বসতেন। কবি-লেখকেরা লেখা নিয়ে তাদের কাছে যেতেন। সাহিত্য নিয়ে কথাবার্তা হতো। নতুন লেখকদের তারা পরামর্শ দিতেন। একটি চমৎকার সাহিত্যিক পরিবেশ ছিল। দৈনিক পাকিস্তান-এর মহিলামহল অনেক নতুন লেখিকা তৈরি করেছে।
দৈনিক পাকিস্তানে নারী সাংবাদিকেরাও কাজ করেছেন। তাঁদের মধ্যে রিপোর্টিংয়ে হাসিনা আশরাফ খুব নাম করেছিলেন। তিনি ছিলেন দৈনিক পাকিস্তান-এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আলী আশরাফের স্ত্রী। আবুল কালাম শামসুদ্দীনের নেতৃত্বে দৈনিক পাকিস্তান উপমহাদেশের একটি প্রথম শ্রেণির দৈনিকে পরিণত হয়।
সাংবাদিকতার অবসরে আবুল কালাম শামসুদ্দীন সাহিত্যচর্চা করেছেন। তাঁর সাহিত্যচর্চা মধ্যপ্রাচ্যপন্থী ছিল না। তবে আদর্শের দিক থেকে তিনি ছিলেন মুসলিম প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী। তাঁর দৃষ্টিকোণ প্রবন্ধগ্রন্থটি ১৯৬০-এ প্রকাশ করেছিল ইস্ট বেঙ্গল পাবলিশার্স, পঞ্চাশের দশকের খ্যাতিমান সাহিত্যের বইয়ের প্রকাশক। বইটি সেকালে খুবই পঠিত ছিল। তুর্গেনিভের অনুবাদ হলেও গল্পগ্রন্থ ত্রিস্রোতা এবং উপন্যাস খরতরঙ্গ চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে খ্যাতি অর্জন করেছিল।
ইস্ট বেঙ্গল পাবলিশার্সে আব্বার সঙ্গে বইপত্র কিনতে যেতাম পঞ্চাশের শেষ দিকে। ষাটের শুরু থেকে যেতাম আমি নিজেই। ভালো ভালো বই পাওয়া যেত। মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের ভাষা ও সাহিত্য, আবুল ফজলের সাহিত্য ও সংস্কৃতি সাধনা, রণেশ দাশগুপ্তের উপন্যাসের শিল্পরূপ, ইবনে ইমামের জলেস্থলে ও চিত্রবিচিত্র সেখান থেকেই কিনেছিলাম। সেকালে বইয়ের দোকানের ম্যানেজারের সঙ্গেও কথা বলতে ভালো লাগত। কাপড়চোপড় বা সোনার দোকানের সেলসম্যান আর বইয়ের দোকানের সেলসম্যানকে একরকম মনে হয়নি। সেকালে অনেক সেলসম্যানকে দেখতাম ক্রেতা না থাকলে তারা বসে বসে বই পড়ছেন। খুবই অল্প বেতনের ওই কর্মচারীদের বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে ভালো জ্ঞান ছিল।
ভাষাবিজ্ঞানী ও ধ্বনিতত্ত্ববিদ মুহম্মদ আবদুল হাই যে অতসী নামে একটি ছোটগল্পের বই লিখেছিলেন, তা মানুষ ভুলেই গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অত্যন্ত যোগ্য শিক্ষক ছিলেন প্রফেসর হাই, মানুষ হিসেবেও ছিলেন সৎ ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। তিনি ছিলেন বিভাগীয় চেয়ারম্যান। তাঁর স্বার্থান্বেষী সহকর্মীরা কিছু টাকাপয়সা-সংক্রান্ত মিথ্যা অপবাদ রটান তাঁর সম্পর্কে। তা তাঁর কানে যাওয়ায় তিনি খুবই বিব্রত ও মর্মাহত হন। সম্ভবত দুশ্চিন্তা নিয়ে অন্যমনস্কভাবে রেললাইনের পাশ দিয়ে হাঁটছিলেন। ট্রেনের ধাক্কায় ১৯৬৯ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যু ছিল বাংলা বিভাগের জন্য শুধু নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যই অপূরণীয় ক্ষতি।
চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে কাজী আবুল হোসেন ছিলেন একজন জনপ্রিয় উপন্যাস লেখক। বহু উপন্যাস তিনি লিখেছেন, যা অনেকেই বলবেন ‘সস্তা, কিন্তু সেকালে ছিল বহুপঠিত। তাঁর উপন্যাসগুলোর বেশির ভাগই বেরিয়েছিল ইসলামিয়া লাইব্রেরি থেকে। তিনি বসতেনও সেখানে। আমি আব্বার সঙ্গে গিয়ে সেখানে তাঁকে দেখেছি। তিনি যে কোনো প্রভাবশালী লেখক নন, সে বোধ তাঁর ছিল এবং ছিলেন অমায়িক ও সজ্জন। ইস্ট বেঙ্গল প্রকাশ করেছিল কাজী আবুল হোসেনের উপন্যাস বনজ্যোৎস্না, চমৎকার লেখা, নামটিও তেমন সুন্দর। তার সতীনের ঘর কিনেছিলাম ইসলামিয়া লাইব্রেরি থেকে।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে আবদুর রশীদ ওয়াসেকপুরী নামের একজন কবি ও কথাশিল্পী ছিলেন। তাঁর বেশ কয়েকটি গল্প ও কবিতার সংকলন ছিল। বাণ নামে তার একটি উপন্যাস প্রকাশ করেছিল ইস্ট বেঙ্গল। তার আরেকটি উপন্যাস প্রেম পরিণয়। ইস্ট বেঙ্গলই বের করেছিল শাহেদ আলীর ছোটগল্পের সংকলন কৃষ্ণপক্ষ, যদিও তিনি বিখ্যাত তার জিব্রাইলের ডানার জন্য। জিব্রাইলের ডানা পড়ে সত্যজিৎ রায় প্রশংসা করেছিলেন এবং এই গল্পের অবলম্বনে ছবি করা যায়, সে মন্তব্যও নাকি করেছিলেন। শাহেদ আলীর আরেকটি গল্প সংকলন একই সমতলে। শাহেদ আলী ইসলামপন্থী ছিলেন, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে কোনো রকম গোঁড়ামি ছিল না, সংস্কারও নয়। তাঁর সম্পাদনায় ইসলামিক একাডেমি (বর্তমানে বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন) থেকে প্রকাশিত হতো শিশু-কিশোর মাসিক পত্রিকা সবুজ পাতা ষাটের দশকে এবং স্বাধীনতার পরেও। সেটি ছিল একটি পরিচ্ছন্ন চমৎকার সাময়িকী। সবুজ পাতা তৈরি করেছে বহু লেখককে। সেটি যে একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পত্রিকা, তা মনে হতো না। সত্তরের দশক পর্যন্ত সবকিছুতেই উন্নতমানকে গুরুত্ব দেওয়া হতো। বই ও পত্রপত্রিকায় ছাপার ভুল সেকালে খুব কমই হতো।
চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে মুসলমানদের অনেকেই গল্প, উপন্যাস ও নাটক রচনায় মনোযোগ দেন। চট্টগ্রামের মাহবুব-উল আলম নজরুলের সঙ্গে প্রথম মহাযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ছিলেন। তাঁর মোমেনের জবানবন্দী একটি আত্মজৈবনিক রচনা। বইটি একসময় খুবই পরিচিত ছিল এবং পঠিত হতো। আমি আমার কৈশোরে বইটি পড়েছি এবং কিছুকাল আগেও পড়ে দেখেছি, সাহিত্যকর্ম হিসেবে তার মূল্য রয়েছে। ছোটগল্পও তিনি লিখেছেন। তবে উপন্যাস বা উপন্যাসধর্মী ‘মফিজন’ প্রশংসিত হয়েছিল।
চিন্তাশীল লেখক হিসেবেই আবুল ফজলের খ্যাতি। ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলনের তিনি একজন। তবে তিনিও অনেক গল্প-উপন্যাস লিখেছেন। তাঁর উপন্যাস চৌচির ও জীবন পথের যাত্রী বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজের সমস্যা নিয়ে রচিত। আবুল ফজল ছিলেন আমার খুবই শ্রদ্ধাভাজন। তিনি আমাকে বলেছেন, মধ্য পঞ্চাশে প্রকাশিত রাঙা প্রভাত উপন্যাসটি তাঁর সেরা রচনা। তিনি সমাজসচেতন ও বক্তব্যপ্রধান লেখক, ভাষার দিকে মনোযোগ দেননি। তাঁর চিন্তাশীল প্রবন্ধগুলো গুরুত্বপূর্ণ, গল্প-উপন্যাস পাঠকপ্রিয় হয়নি।
নানা কারণে অনেকেই হারিয়ে যান, যদিও একসময় তারা খ্যাতি অর্জন করেন। ছোটবেলায় কাজী দীন মোহাম্মদ নামের একজন লেখককে জানতাম। তাঁর বাড়ি ছিল গোপালগঞ্জে। তাঁর একটি বই গোলকচন্দ্রের আত্মকথা ছোটোবেলায়
আমাদের বাড়িতে দেখেছি। তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্তের দপ্তরকে অনুসরণ করতে চেয়েছিলেন। লেখার হাত ছিল, কিন্তু নিষ্ঠা নিয়ে বেশি দূর যাননি। তাঁর একটি ছোটগল্প ‘জাঁদরেল উকিলের জীবনালেখ্য’। শিল্পকর্ম হিসেবে বাংলা সাহিত্যের সেরা লেখকদের বহু গল্পের সঙ্গেই তুলনীয়। আমি গল্পটি থেকে সামান্য অংশ উদ্ধৃত করছি :
‘আমার এ পরম উপভোগ্য জীবনালেখ্য শঙ্কাহীন চিত্তে দর্শকের সম্মুখে হাজির করিতে আমি নিজে কেন প্রবৃত্ত হইলাম, প্রথমেই তাহার জবাবদিহি করা জরুরি মনে করিতেছি। …আমি রামা, শ্যামা বা করিম, রহিম নহি, আমি প্রভাময় রত্নবিশেষ, নিভৃত স্থানের কুসুম।
‘এ পোড়া দেশের সাহিত্যিকেরা ইদানীং প্রেমিক-প্রেমিকার ট্র্যাজেডি বা কমেডিপূর্ণ জীবনী লিখিয়াই তাহাদের কর্তব্য সমাধা করিতেছেন। সুতরাং আমার জীবনালেখ্য অঙ্কনে যে সাহিত্যিকেরা কেহ হাত বা মন দিবেন সে ভরসা কম। এই কারণেই এই বিংশ শতাব্দীর বাংলার সংস্কারপ্রয়াসী শ্ৰীমুকুন্দ দাস তাহার বাউল যাত্রার সুরে গাহিয়া বেড়াইতেন–
‘এ দেশের এডিটর খবর রাখে ক’জনার?
রামা আজ দিল্লী যাবেন, শ্যামা যাবেন কাছাড়,
স্টারে নাচবেন কুসুমসুন্দরী, বাহ্বা খবরের বাহার!
‘আমি উকিল। উকিলদের বৃত্তিটা সুযোগসন্ধানী। ইহারা যথাসময়ে যথারীতি “হয়”কে নয় এবং “নয়”কে “হয়” করাতে পারেন।
‘…আমি উকিল। আমি হিন্দু না মুসলমান, সে প্রশ্ন কেহ করিবেন না। কবি নজরুলের ভাষার অনুকরণে আপনাদিগকে ভাবিতে হইবে–
‘হিন্দু না মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কাণ্ডারী! বল জাদরেল উকিল, সন্তান মোর মার।
‘ভূমিষ্ঠ হইবার পর মুহূর্তে বাবা আমাকের আঁতুড়ঘরে দেখিতে আসিয়া নাক সিটকাইয়াছিলেন। এ কথা পরে আমি মায়ের কাছে শুনিয়াছি। বাপের নাক সিটকানো আঁতুড়ঘরের আশীর্বাদ। সুতরাং আঁতুড়ঘর হইতে বাবা বাহির হইতে না হইতেই নাকি একজন ভ্রাম্যমাণ জ্যোতিষী আসিয়া হাজির হইলেন। উঠানে পা দিয়াই তিনি নাকি বকিতে আরম্ভ করিলেন, “এ বাড়িতে একটি পুত্রসন্তান জন্মেছে। বড়-কপালে। সিংহলগ্নে ভূমিষ্ঠ হয়েছে-লগ্নের দশম স্থানে তার পাঁচটি গ্রহের সমাবেশ হয়েছে। এ ছেলে একটা জাদরেল কিছু না হয়ে যায় না। ছয়টা গ্রহের সমাবেশ হলে তো গ্রহের ঠেলার চোটে একেবারে পাগল হয়ে যেত। পাঁচটা গ্রহ জীবন-ভর একে খুঁচিয়ে নিয়ে বেড়াবে, একেবারে কাজ পাগলা করে তুলবে।” জ্যোতিষীকে আমার বাবার মা দুইটি টাকা দিয়া বিদায় করিয়াছিলেন। জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাস আছে দেখিয়া কেহ যেন মনে না করেন যে আমি হিন্দু। কারণ এমন শুভমুহূর্তে মুসলমানেরাও জ্যোতিষীর গণনার মর্যাদা রক্ষা করিয়া থাকেন।
‘বাবার নাক সিঁটকানো আমার বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দাঁতখিচুনিতে পরিবর্তিত হইল। আমার নিজের যখন দাঁত উঠে নাই সেই বয়স হইতে এক প্রকার দাঁতখিচুনি খাইতে শুরু করিয়াছি। এখন দাঁতখিচুনি প্রুফ হইয়া গিয়াছে। ওটা আর এখন গায়ে বিদ্ধ হয় না।
[জাঁদরেল উকিলের জীবনালেখ্য]
কাজী দীন মোহাম্মদ ছিলেন দুজন। আমি প্রথমে মনে করতাম তাঁরা একই ব্যক্তি। কিন্তু দুই কাজীর নামের বানানে সামান্য পার্থক্য ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার প্রফেসর লিখতেন কাজী দীন মুহম্মদ। কথাশিল্পীর নামের বানান কাজী দীন মোহাম্মদ। ইনি সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। সাহিত্যসমাজের বাইরে নিজের জগতে নিভৃতে থাকতেই পছন্দ করতেন। দু-একবার তাঁকে কবি জসীমউদ্দীনের বাসভবন কমলাপুরের ‘পলাশ বাড়ী’তে দেখেছি। তার লেখার হাত ছিল। কিন্তু বাঙালি মুসলমান অনেকের যা হয়, সাধনা অব্যাহত রাখতে পারেন না। তিনি সাহিত্যচর্চা করেছেন চল্লিশের দশক পর্যন্ত। তার আরেকটি বই, সম্ভবত কিশোর উপন্যাস কেনাই ডাকু।
শৈশব-কৈশোরে যাদের লেখা পড়ে বড় হয়েছি, তাঁরা অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল, জসীমউদ্দীন নন; কিন্তু একটি শূন্যতা পূরণের কাজ তারা করেছেন। তাঁরা যে খুব বড় কিছু, সে রকম ধারণা তাঁরাও পোষণ করতেন না।