১৯. একই নামের দুই লেখক

একই নামের দুই লেখক মাঝে-মাঝে বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হয়ে পাঠকদের কিরকম বিভ্রান্ত করে তোলে তার পরিচয় সকলেরই কিছু-কিছু জানা আছে। বিশেষ করে যিনি অগ্রজ-সাহিত্যিক, বয়সের হিসাবে নয়, সাহিত্যরচনায় যিনি আগে আবির্ভূত হয়েছেন এবং প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন, তার দুর্ভাগ্যটা একবার অনুমান করে দেখুন। তাঁর উপন্যাসের যখন বাজারে প্রচুর কাটতি তখন সেই একই নামে আরেক নকল লেখক একখানি উপন্যাস নিয়ে দেখা দিলেন। নকল লেখকের লেখার সুখ্যতি এবং কুখ্যাতি দুই-ই আসল লেখকের উপর গিয়ে বর্তায়। অকারণে অন্যের বোঝা কে বহন করতে চায়। কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েই হোক বা পুস্তক বিক্রেতাদের দোকানেদোকানে ঘুরেই হোক নকল লেখকের, স্বরূপ উদঘাটন করবার আগেই নামভক্ত পাঠকদের বোকা বানিয়ে দু-এক এডিশন বই বিক্রি করে কিছু টাকা নিজের ঘরে তুলে, কিছু অপযশ আসল লেখকের ঘাড়ে চাপিয়ে সাহিত্য থেকে চিরকালের মত বিদায় নেন। সাহিত্যে এ ধরনের অসাধুতা মাঝেমাঝেই ঘটে থাকে এবং এরও পিছনে কোন-কোন পুস্তক প্রকাশকের প্রচ্ছন্ন হাত নিশ্চয় থাকে। তা না হলে জেনে শুনে তারা একই নামের আরেক অখ্যাত লেখকের বই প্রকাশ বা বিক্রি করবেন কেন। এখানেও সেই অসাধু উপায়ে মুনাফা শিকারের লোভ।

বিখ্যাত ঔপন্যাসিক আরোগ্য নিকেতন-এর লেখক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে বেশ কিছুকাল এক নকল তারাশঙ্করের অবির্ভাবে অতিষ্ঠ হয়ে তার যাবতীয় নৃতন বই আর পুরনো বইয়ের পুনর্মুদ্রণকালে এক দীর্ঘ ভূমিকা জুড়ে দিয়ে দুঃখের সঙ্গে ঘোষণা করতে হল—শ্রীময়ীর লেখক শ্ৰীতারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় শ্রীময় থাকুন, আমি এখন হইতে শ্রীহীন হইলাম। সেই থেকে অদ্যাবধি তিনি তার নামের আগে শ্রী ব্যবহার করেন না।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ঐ বর্জন করে এই সমস্যার একটা সমাধান করেছিলেন বটে কিন্তু শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এত সহজে রেহাই পান নি, তাঁকে দাড়ি বর্জন করতে হয়েছিল। এই ঘটনা নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত আছে, সেইটিই আজ আপনাদের কাছে বলতে বসেছি।

 

শরৎবাবুর তখন চরিত্রহীন উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। নিন্দা ও প্রশংসায় বাংলা সাহিত্যে আলোড়ন দেখা দিয়েছে, পাঠকদের মুখে মুখে শরৎবাবুর নাম। এই সময়ে হঠাৎ আরেক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এসে দেখা দিলেন গল্পলহরী নামে ছোট গল্পের এক মাসিক পত্রিকার সম্পাদক রূপে। তখনকার দিনে নবীন লেখকদের গল্পলহরী ছিল আত্মপ্রকাশের একমাত্র পত্রিকা এবং আজকের দিনের একাধিক খ্যাতিমান লেখক সেদিন গল্পলহরীতে ছোটগল্প লিখে হাত পাকিয়েছিলেন। এই সুযোগে আপনাদের কাছে চুপিচুপি একটা কথা কবুল করে নিচ্ছি-সম্পাদকের বৈঠকের লেখকেরও দুর্মতি হয়েছিল। তার কৈশোর-যৌবনের সন্ধিকালে মফস্বল থেকে একটি ছোটগল্প লিখে গল্পলহরীতে পাঠিয়েছিলেন এবং তা প্রকাশিতও হয়েছিল। সুখের বিষয় সেইটিই প্রথম ও শেষ। গল্পলহরীর তখন মুম্ষু অবস্থা, পরের মাস থেকেই পত্রিকা চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়।

গল্পলহরীর সম্পাদক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শুধু পত্রিকা-সম্পাদনা নিয়েই সন্তুষ্ট রইলেন না, উপন্যাস লিখতে শুরু করলেন এবং পর পর তিনটি উপন্যাস বাজারে ছাড়লেন, চাঁদমুখ, হীরক দুল ও শুভলগ্ন।

আসল শরৎবাবু প্রথমে ব্যাপারটা কানেই তুললেন না। প্রকাশক হরিদাস চাটুজ্যে এসে একদিন শরৎবাবুকে বললেন–

ওহে শরৎ, এর একটা কিছু বিহিত কর। তোমার নাম ভাড়িয়ে আরেক শরৎ চাটুজ্যে যে বাজারে বই ভালই কাটিয়ে দিল।

এসব নিয়ে ঝাট করা শরৎবাবুর প্রকৃতিই নয়। উনি শুধু বললেন–আমার পাঠকরা ভাল করেই জানে যে, আমার কলম দিয়ে ওরকম ধোয়া তুলসী পাতা উপন্যাস বেরোবে না। ওরা বই পড়ে বুঝে নেবে কে খাঁটি আর কে ভেজাল।

শরৎবাবুর এ-যুক্তি হরিদাস বাবুর মনঃপুত হল না। উনি পাকা ব্যবসাদার মানুষ। বললেন–

সেই খাঁটি আর ভেজাল ধরা পড়বার আগেই যে বাজারে দু-তিন হাজার ভেজাল মাল কেটে যাবে। সেটা তো তোমারই লোকসান।

লাভ কোকসানের কথাটায় কোন গুরুত্ব না দিয়ে শরৎবাবু বললেন–ওসব ব্যাপারে মাথা ঘামানো আমার কাজ নয়, ওটা আপনাদের কাজ। আপনারাই করুন।

মাস খানেক যেতে-না-যেতেই শরৎবাবুকে মাথা ঘামাতেই হল। একদিন সকালে বাতায়ন পত্রিকার সম্পাদক অবিনাশ ঘোষাল শরৎচন্দ্রের বাড়িতে ছুটে গিয়ে বললেন–দাদা আপনি তো এখানে বেশ নির্বিকার চিত্তে বসে আছেন। ওদিকে যে সর্বনাশ হয়ে গেল।

বাতায়ন সম্পাদক অবিনাশদার এখানে একটু পরিচয় দিয়ে রাখতে চাই। অবিনাশদা ছিলেন শরৎচন্দ্রের অনুজপ্রতিম স্নেহের পাত্র। শুধু তাই নয়, শরৎচন্দ্রের নিঃসঙ্গ জীবনে অবিনাশদা ছিলেন অন্যতম বিশ্বস্ত হিতাকাঙ্ক্ষী বন্ধু ও সখা। একমাত্র অবিনাশদার কাছেই শরৎবাবু নিজের ব্যাক্তিগত জীবনের সুখ-দুঃখের কথা অকপটে বলতেন। অবিনাশদার সঙ্গে শরৎচন্দ্রের এই অন্তরঙ্গতা অনেকের কাছে ঈর্যার কারণও হয়েছিল, অনেকে আবার ঠাট্টা বিদ্রুপও করতেন। এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনা বলার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না, পূর্বাহ্নেই আমি তার জন্য অবিনাশদার কাছে মার্জনা চেয়ে নিচ্ছি।

শরৎচন্দ্রের একটি অত্যন্ত প্রিয় দেশী কুকুর ছিল, তার নাম দিয়েছিলেন ভেলি। বড় আদরের কুকুর। হাওড়ায় শিবপুরের বাড়িতে একা থাকতেন, ভেলি ছিল ওঁর নিত্য সহচর। ভেলির প্রতি শরৎবাবুর এই সন্তানবৎ স্নেহ ও দুর্বলতার কথা কলকাতার সাহিত্যিক সমাজে অজানা ছিল না। ভেলিকে তাই অনেকেই শরৎবাবুর পোয্যপুত্র বলে অভিহিত করতেন।

সেই ভেলি কয়েকদিনে অসুখে ভুগেই হঠাৎ মারা গেল। শরৎবাবু সন্তান বিয়োগসদৃশ ব্যাথায় মুহ্যমান। খবর পেয়ে কলকাতা থেকে অনেকেই এই নিদারুণ শোকে সান্ত্বনা দেবার জন্য শিবপুর গেলেন, অনেকে চিঠি লিখলেন। শুধু আমাদের বিখ্যাত শিবরাম চক্রবর্তী, যাকে শনিবারের চিঠি তারই অস্ত্রে চিরকাল শিবRAM লিখে আঘাত দিয়ে এসেছে, পানোন্মত্ত হয়ে (মাতাল অর্থে নয়, শব্দের pun পেলে যিনি উন্মত্ত হয়ে ওঠেন) দু-লাইনের এক ছড়ায় শরৎচন্দ্রকে এই সান্ত্বনাবাণী পাঠালেন—

ভেলির বিনাশ নাই,
ভেলি অবিনাশ।

সেই অবিনাশ ঘোষাল শরৎবাবুকে বললেন—দাদা আপনি করছেন কি। আপনার অনুরাগী পাঠকরা আপনার লেখা বই মনে করেই দোকান থেকে চাঁদমুখ কিনে নিয়ে পড়ছে এবং পড়ার পর চারিদিকে বলে বেড়াচ্ছে—এরই মধ্যে শরৎ চাটুজ্যে একেবারে গেঁজে গিয়েছে। এসব কথা শুনতে কি আমাদের ভালো লাগে?

শরৎবাবু এবার সত্যিই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। লোকের মুখে-মুখে এরকম যদি একটা কথা রাষ্ট্র হয়ে যায়, সাহিত্যিকের পক্ষে তার চেয়ে বড় ক্ষতি ও অপমান আর কিছু নেই। শরৎবাবু ভাল করেই জানেন যে, জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বহু মানবচরিত্র তিনি দেখেছেন। সমাজ নিপীড়িত সেই-সব মানুষের নীরব চোখের জলে যে অভিশাপ এতকাল বষিত হয়ে এসেছে, তার কতটুকুই বা তিনি তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন, এখনও যে অনেক বাকি রয়েছে বলবার। সুতরাং অবিনাশদার কথাকে সহজে উড়িয়ে দিতে পারলেন না। বললেন–তুমিই বল অবিনাশ, এ ক্ষেত্রে আমার কি করণীয়।

অবিনাশদা গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন। তাই তো, কী করণীয়। কাগজে একটা বিবৃতি দিলে কেমন হয়। তাতেও বিপদ, বিনা খরচায় নকল শরৎ চাটুজ্যের পাবলিসিটি হয়ে যাবে, ফলে ওর বইয়ের বিক্রি যাবে বেড়ে। পাঠকদের কৌতূহলের তো মাথামুণ্ডু নেই, দেখাই যাক নকল শরৎচন্দ্র আসলের উপর টেক্কা মারতে পেরেছে কি না। অতএব কেনো বই।

অনেক চিন্তা ভাবনার পর অবিনাশদা বললেন–দাদা, সব চেয়ে ভাল হয় আপনি নিজে একবার ওঁর সঙ্গে দেখা করে ওঁকে বুঝিয়ে বলুন একটা ছদ্মনাম নিয়ে বই লিখতে।

চোখ বড় করে শরৎবাবু অবিনাশদার দিকে তাকিয়ে বললেন–বল কি হে, আমি যাব ওর কাছে? তাহলে তো ও যা চেয়েছিল তাই হবে। যাওয়া মাত্রই উল্লসিত হয়ে বলবে-পথে আসুন। গল্পলহরীতে লেখা দিলেই নাম পালটে ফেলব। আমার উপর ওর রাগ, আমি বাতায়ন পত্রিকায় মাঝে-সাঝে লিখি অথচ ওর কাগজে একেবারেই লিখি না।

কথাটা শুনে সরলমতি অবিনাশদা অবাক হয়ে গেলেন। এও কি কখনও সম্ভব? কোন দায়িত্বসম্পন্ন সম্পাদক এমন কাজ করতে পারে? শরৎবাবুর অবিশ্বাস্য কথাটা হেসে উড়িয়ে দিয়ে অবিনাশদা বললেন–এ কি বলছেন দাদা। আপনার এই অনুমান ঠিক নয়। আপনি একবার ওঁর সঙ্গে দেখা করে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলুন, আপনার কথা উনি ফেলতে পারবেন না।

এবার শরৎবাবু একটু গম্ভীর হয়ে বললেন–দ্যাখো অবিনাশ, মানবচরিত্র আমি তোমার চেয়ে কিছু বেশি দেখেছি জেনেছি চিনেছি। ও যা করেছে তা জেনেশুনে ইচ্ছা করেই করেছে, আমাকে জব্দ করবার জন্যই করেছে।

অবিনাশদা অনুরোধের সুরে বললেন—তবু আপনার উচিত একবার দেখা করে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলা। কারণ এতে লোকসানটা তো আপনারই হচ্ছে।

শরৎবাবুর মুখে এবার যেন কৌতুকের হাসি খেলে গেল। শুধু বললেন–দ্যাখো অবিনাশ, তুমি তো আমাকে দেখা করতে বলছ। তার পরিণামটা

একবার ভেবে দেখেছ কি?

অবিনাশদা সরল মানুষ, তাই বললেন–তা একটা লেখা যদি চায় তো লিখে দেবেন।

সঙ্গে সঙ্গে শরৎবাবু বললেন–লেখার কথা হচ্ছে না। কথাটা হচ্ছে, চঁদমুখো শরৎচন্দ্রের কাছে চরিত্রহীন শরৎচন্দ্রের যাওয়া কি সমীচীন হবে?

অবিনাশদা এবার বেশ গম্ভীর হয়ে বললেন—একটা সিরিয়াস বিষয় নিয়ে পরামর্শ করতে এলাম, আপনি ঠাট্টা ইয়ার্কি করে হালকা করে ফেলছেন।

শরৎবাবু বললেন–আমরা আমাদের জীবনটাকে বড় বেশি সিরিয়াস করে ফেলেছি। একটু হাল্কা না করতে পারলে এ-বোঝ বেশী দিন বইব কি করে।

আবিনাশদা বললেন—ও সব তত্ত্বকথা রেখে এখন কাজের কথায় আসুন। আপনি তো যাবেন না বুঝতেই পারছি। আমিই না-হয় আপনার দুত হয়ে যাই। কিন্তু কি বলব?

–মধ্যপদলোপী হয়ে যেতে বল।

–মধ্যপদলোপী? সে আবার কি?

–কেন, চারু বন্দ্যোপাধ্যায় যা হয়েছেন। তুমি গিয়ে ওকে বল। চটা বর্জন করতে। উনি যখন পরে এসেছেন উনি শরৎ চট্টোপাধ্যায় থাকুন। আমি আদি ও অকৃত্রিম শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে গেলাম।

–আপনার এই প্রস্তাবে কোন কাজ হবে না। নামের এই সামান্য পার্থক্যে দুই ব্যক্তির স্বাতন্ত্র পাঠকদের কাছে মোটেই প্রকট হবে না।

—তাহলে এক কাজ কর। ওকে মারপিটের ভয় দেখাও।

অবিনাশদা এবার বেশ খানিকটা হকচকিয়ে গিয়ে বললেন–সে কি দাদা, শেষকালে গুণ্ডা লাগিয়ে মারপিট করবেন নাকি! ফৌজদারী মামলায় পড়ে যাবেন যে।

শরৎবাবু এবার হেসে ফেললেন। অবিনাশদাকে নিশ্চিন্ত করবার জন্যে বললেন–না হে না, আমি গুণ্ডা লাগাতে যাব কেন? তুমি শুধু ওকে বলবে যে, চরিত্রহীন বই বেরোনোর পর শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নামে বাজারে খুব দুর্নাম, লোকে অকথ্য কুকথ্য গালিগালাজ করছে। এতেই শেষ নয়। সিটি কলেজের ছেলেরা মারমুখখা হয়ে বলছে যে, সমাজে সাহিত্যের নামে দুর্নীতি প্রচারকারী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাপের নাম ভুলিয়ে দেবে। আসল শরৎচন্দ্রকে তো ওরা হাতের কাছে পাবে না, তার কোন চালচুলো নেই। কখন কোথায় থাকে তার হদিস পাওয়া ভার। নকল শরৎ চন্দ্র খাস কলকাতার পুরনো বাসিন্দা, ওকে পেতে কতক্ষণ। পৈত্রিক নামটার চেয়ে পৈত্রিক প্রাণটার দাম অনেক বেশি–এই কথাটাই ওকে ভাল করে বুঝিয়ে বল।

অবিনাশদা বুঝে গেলেন শরৎবাবুর কাছে এ-বিষয়ে পরামর্শ নিতে আসাই ভুল হয়েছে। লেখক শরৎচন্দ্র আর ব্যক্তি শরৎচন্দ্র দুই ভিন্ন সত্তার মানুষ। সাহিত্যকর্মে শরৎবাবুর নিষ্ঠা, সততা ও সংগ্রামী-চিত্ত সদাজাগ্রত কিন্তু ব্যক্তিজীবনে মানুষটি মুখচোরা, লাজুক ও নিস্পৃহ ঔদার্যের প্রতীক। অবিনাশদা হাল ছেড়ে দিলেন। নিজেই দেখা করে এ-বিষয়ে একটা ব্যবস্থা করার সংকল্প নিয়ে শরৎবাবুর কাছ থেকে সেদিন বিদায় নিলেন।

সাতদিন বাদেই অবিনাশদা আবার শরৎবাবুর কাছে এসে হাজির, মুখে হাসি আর ধরে না।

শরৎবাবু বললেন–কি হে অবিনাশ, খুব যে খুশি-খুশি ভাব। কিছু একটা সুখবর আছে নিশ্চয়।

অবিনাশদা বললেন–তা আছে বইকি। চাঁদমুখ শরৎচন্দ্রকে রাজী করিয়েছি।

—কি রাজী করালে? নাম পালটে ফেলবে তো?

–পৈত্রিক নাম কি কেউ পালটাতে চায়? ও-প্রস্তাবে একেবারেই রাজী হল না। শেষকালে আপনার পরামর্শ টা প্রকারান্তরে বলতেই কাজ হল।

অবাক হয়ে শরৎবাবু বললেন–আমি আবার তোমাকে কোন্ পরামর্শ দিলাম।

–ওই যে মারপিটের পরামর্শ। কথাটা ওভাবে না বলে একটু ঘুরিয়ে বললাম। চরিত্রহীন বই লেখার পর লেখকের সম্পর্কে চারিদিকে যে দুর্নাম বটছে তাতে কান পাতা যাচ্ছে না এবং চঁদমুখ বিদূষক-এর মত ভাল-ভাল উপন্যাস লেখা সত্ত্বেও কেন উনি এই দুর্নামের ভাগী হতে যাবেন।

শরৎবাবু হাসতে হাসতে বললেন–মোক্ষম দিয়েছ। দুর্নামের ভয় কার বা নেই। যাক, তা চাঁদমুখ চাটুজ্যে কি বললেন।

–বলবেন আবার কি, একেবারে জল। এতক্ষণ যে-প্রস্তাব দিই, এক উত্তর–না, ওসব হবে না। আর কি মেজাজ, যেন উনি বই লেখার আগে আপনি বই লিখে মস্ত অপরাধ করে ফেলেছেন। অবশেষে, যেই দুর্নামের কথাটি বলা অমনি কেঁচোটি হয়ে গেলেন।

শরৎবাবু এতক্ষণ আরামকেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে আপনমনে গড়গড়া টানছিলেন। নলটা মুখ থেকে সরিয়ে কেদারায় টান হয়ে উঠে বসেই বললেন–প্রস্তাবটা কি দিলে শুনি?

প্রস্তাব আমাকে আর দিতে হয় নি, নিজেই দিলেন। অনুনয়ের সুরে বললেন–পৈত্রিক নামে কয়েকটা উপন্যাস লিখে ফেলেছি, বিক্রিও মন্দ হচ্ছে না। এখন নাম বদলে নতুন বই লিখলে তো আর লোকে ছেলেই না। চাঁদমুখ উপন্যাসটাই আমার বেশী বিক্রি হয়েছে। আমি তাই ভাবছি আমার নামের আগে চাঁদমুখ কথাটা বসিয়ে দিলে পাঠকদের বুঝতে অসুবিধা হবে না।

শরৎবাবু শুনে বললেন–বাঃ, বেড়ে উপায় বাতলেছেন। তার মানে আমাকেও আমার নামের আগে চরিত্রহীন বসাতে হবে নাকি?

অবিনাশদা অভয় দিয়ে বললেন—সে ভয় আপনার নেই। যেই উনি নামের আগে চাঁদমুখ বসাবার প্রস্তাব করলেন সঙ্গে সঙ্গে আমি বললাম—সেটা কি ভাল দেখাবে? আমার কথাটা শুনেই একটু থমকে থেমে বললেন–ঠিকই বলেছেন অবিনাশবাবু। এক গাল দাড়িভর্তি এই মুখকে চাঁদমুখ বললে লোকে পরিহাস করবে। তার চেয়ে আমার সদ্য প্রকাশিত বই বিদূষক নামটা বরঞ্চ দেওয়া যাক। আমার চেহারার সঙ্গে ওনামটা মানাবে ভালো। এ-প্রস্তাবটা তারিফ করে আমি বললাম—তা হলে আরেকটা কাজ করুন। উপন্যাসের টাইটেল পেজ-এর আগে আর্ট পেপারে আপনার একটা ফটো ছেপে দিন। তাহলে আর কোনও পাঠকের ভুল বোঝার কোন অবকাশ থাকবে না।

শরৎবাবু খুশী হয়ে বললেন–হে অবিনাশ, যতটা ভাল মানুষ সেজে থাক ততটা তুমি নও। শয়তানী বুদ্ধিটা তো সময় বিশেষে ঠিক মাথায় খেলে যায়।

অবিনাশদা বললেন—এতকাল আপনার শাগরেদি করছি, একেবারে কিছুই কি পাই নি মনে করছেন?

শরৎবাবু গড়গড়ায় নলটা মুখে তুলে নিয়ে বেশ কয়েকটা টান দিলেন, কঙ্কের টিকে গনগনে হয়ে উঠল। এক গাল ধোঁয়া ছেড়ে বললেন–তাহলে তোমার কথাটায় রাজী হয়ে গেলেন, কি বল অবিনাশ।

অবিনাশদা বললেন–বইয়ের গোড়ায় ফটো ছাপার প্রস্তাবটা ওঁর খুবই মনঃপূত কিন্তু একটা সর্তে। আপনারও ফটো ছাপতে হবে। ওঁর বক্তব্য হচ্ছে চাদমুখের লেখক শরৎচন্দ্র ও চরিত্রহীনের লেখক শরৎচন্দ্র যে দুই ভিন্ন ব্যক্তি তা পাঠকদের ভাল করেই জানিয়ে দেওয়া প্রয়োজন।

কথাটা শুনেই শরৎবাবুর মুখ থেকে গড়গড়ার নলটা খসে পড়ল। বিস্ফারিত চোখে শরৎবাবু বললেন–বল কি অবিনাশ! ওঁর কথায় আমার ফটোগ্রাফ ছাপতে হবে? আর তুমি এ-কথায় সায় দিয়ে এলে?

অবিনাশদা বললেন–না, বইয়ে ছাপার কথায় আমি রাজী হই নি। তবে বলেছি, বাতায়ন পত্রিকায় আর্ট পেপারে আপনার ছবি ছেপে জানিয়ে দেব যে, আপনি চরিত্রহীন উপন্যাসের লেখক শরৎচন্দ্র।

কথাটা শুনে শরৎবাবু খানিকটা আশ্বস্ত হলেন। কিন্তু তার পরেই অবিনাশদা যে-কথা বললেন–তা শুনে শরৎবাবু স্তম্ভিত।

অবিনাশদা বললেন–আপনার এই ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি বর্জন করতে হবে।

গুম হয়ে বসে রইলেন শরৎবাবু। চিন্তিত মুখে গড়গড়ার নলটা তুলে নিয়ে দুটো টান দিলেন, ধোঁয়া বেরলো না। কল্কের আগুন নিবে কখন ছাই হয়ে গেছে। শরৎবাবু তখন ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি রাখতেন, তার একটা কারণও ছিল। শরৎবাবু ছিলেন মনেপ্রাণে ফরাসী মেজাজের মানুষ। ওঁর জীবনচর্যায় ফরাসী বোহেমিয়নিজম-এর মিল ছিল। ফরাসী লেখক এমিল জোলা ছিলেন ওঁর গুরু। রবীন্দ্রনাথের চোখের বালি যতবার উনি পড়েছেন, ততবারই পড়েছেন জোলার বিখ্যাত উপন্যাস মাদাম রাক্ট। শোনা যায়, এমিল জোলা ওঁর সাহিত্যিক-জীবনে এত বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিল যে, জোলার অনুকরণে ফেঞ্চ-কাট দাড়ি পর্যন্ত রেখেছিলেন। বহুদিনের সযত্ন সেই শখের দাড়ি আজ বর্জন করতে হবে? শরৎবাবু সেই যে মুখ বুজলেন আর খুললেন না। দূর অকাশের দিকে উদাস দৃষ্টি মেলে চুপচাপ বসে রইলেন। কোন প্রতিবাদ যখন নেই তখন অবিনাশদা বুঝে গেলেন যে, এতে ওঁর সম্মতি একেবারে নেই তা নয়। বেদনাসিঞ্চিত নীরবতাই সম্মতি জানাচ্ছে। আর কোন কথার অবতারণা না করেই অবিনাশদা নিঃশব্দে চলে এলেন।

 

এই ঘটনার মাসখানেক বাদেই চঁাদমুখের লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নতুন উপন্যাস প্রকাশিত হল কণকাঞ্জলি। টাইটেল-পেজ-এর সামনে আর্ট পেপারে পূর্ণ পৃষ্ঠা ফটোগ্রাফি ছাপা হয়েছে, তলায় লেখা আছে—শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। (জুনিয়র)।

সেই সপ্তাহেই বাতায়ন পত্রিকায় আর্ট পেপারে শরৎচন্দ্রের ছবি ছাপা হল, তলায় লেখা ছিল চরিত্রহীন উপন্যাসের লেখক শ্ৰীশরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বলাই বাহুল্য, ফ্রেঞ্চ-কাট দাড়ি বর্জিত ছবিই ছাপা হয়েছিল।

 

চাঁদমুখ উপন্যাসের লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম অজি বাংলা সাহিত্য থেকে চিরকালের জন্যে হারিয়ে গিয়েছে। মাঝে মাঝে ওঁর নাম উচ্চারিত হয় গল্পলহরী পত্রিকার সম্পাদকরূপে, আর একই নামে দুই সাহিত্যিকের প্রসঙ্গ উঠলে। আজকের বৈঠকের আলোচনায় আমাকে যা করতে হল। কিন্তু আমি জানি, উঁদমুখ উপন্যাস রচয়িতা শরৎচন্দ্র জাত-লেখক ছিলেন। উপন্যাস রচনায় তিনি পাকা হাতের পরিচয় দিয়েছিলেন, কিন্তু এমনই দুর্ভাগ্য যে, পাঠকদের কাছে অজ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (জুনিয়র) সম্পূর্ণ বিস্মৃত লেখক। কোন দোকানে ওঁর বই পাওয়া যায় না, লাইব্রেরীতেও নয়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-লেখকরা তাদের কোন গ্রন্থের এক কোণায় এতটুকু ঠাঁই ওঁকে দেন নি। জাতীয় গ্রন্থাগারে চাঁদমুখ বইখানি বহুবার ই হয়েছে দেখা যায়। তার কারণ বইটি বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে, পাঠকরা আসল শরৎচন্দ্রের বই মনে করেই ইসু করান। চাদ মুখের লেখকের উপন্যাস রচনার শক্তি ছিল, শক্তির পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু এক আকাশে দুই চন্দ্র কখনও ওঠে না। চরিত্রহীনের লেখক যখন বাংলা সাহিত্যের আকাশে পূর্ণ জ্যোতি নিয়ে উদ্ভাসিত, তখন সেই আকাশেরই এক প্রান্তে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্করূপে ক্ষণকালের জন্য দেখা দিয়েই চাঁদমুখের লেখক শরৎচন্দ্র ম্লান হয়ে মিলিয়ে গেলেন। এ ট্র্যাজেডী লেখনীর অক্ষমতার জন্য নয়। এক নামের যশ খ্যাতি ক্ষমতা আরেক নামকে ম্লান নিষ্প্রভ করে দেবার এ-এক নির্মম দৃষ্টান্ত। ট্র্যাজেডী এই খানেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *