১৯. উমা বলেছিল, নিশানাথের সঙ্গে কলকাতায় আসবে

উমা বলেছিল, নিশানাথের সঙ্গে কলকাতায় আসবে। শহরে কিছু কেনাকাটা করার আছে, তা ছাড়া ভবানীপুরে তার এক ননদের বাড়ি, সেখানে থেকে আসবে কয়েক দিন। কিন্তু সকাল বেলা সে মত বদলে ফেলল। জীবন ডাক্তার বারবার বললেন, যা না, ঘুরে আয় এক সপ্তাহের জন্য, ভালো লাগবে। নিশানাথও পীড়াপীড়ি করলেন অনেকবার, কিন্তু উমা বলল, থাক, এখন না। হঠাৎ তার এই মত পরিবর্তনের কারণ নিশানাথ বুঝতে পারলেন না। আগের রাত্রে সে নিজেই কত উৎসাহ দেখিয়েছিল।

একদিন অফিস কামাই হয়েছে, আজ নিশানাথকে ফিরতেই হবে। সুব্রতর বেশ জ্বর জ্বর ভাব, জীবন ডাক্তার তাকে পরীক্ষা করে ওষুধ দিয়েছেন। তিনি নিশানাথকে বললেন, আয়, তোর ব্লাড প্রেসারটাও চেক করে দিই। নিশানাথ রাজি হলেন না। কথাটা উড়িয়ে দিয়ে বললেন, ওসব দেখলেই মনের মধ্যে ভয় ঢোকে। আমি ঠিক আছি।

তারপর হেসে বললেন, আমি হঠাৎ মরলে চলবে কেন? তাহলে এসব দেখবে কে? দেখ না, আমি শিগগিরই এখানে পাকাপাকি চলে আসছি!

ফেরিঘাট মাইল খানেকের রাস্তা। জীবনময় আর উমা ওদের এগিয়ে দিতে এল খানিকটা। উমার পায়ের একটা আঙুলের নখ অনেকখানি উড়ে গেছে আগের রাত্রে হোঁচট খেয়ে, অসহ্য ব্যথা, কিন্তু সে-কথা কারুকে বুঝতে দেয় নি। শুধু রবারের চটি পরেছে আজ।

জীবনময় আর নিশানাথ আগে আগে যাচ্ছেন, পেছনে উমা আর সুব্রত। উমা গল্প জমাবার চেষ্টা করলেও সুব্রত সংক্ষেপে একটা-আধটা উত্তর দেয়। মেয়েদের সামনে সে বেশি লাজুক হয়ে পড়ে।

দূরে আন্দাজগড় এখন স্পষ্ট দেখা যায়, জীবনময় ওইটার বিষয়েই বলছেন নিশানাথকে। নিশানাথ বললেন, সত্যি, এতদিন আসছি, ওটার মধ্যে তো কখনো যাওয়া হয়নি। সামনের সপ্তাহে এসে ঠিকই যাব। ওটা একটু সারিয়ে-টারিয়ে আমরাই যদি দখল করে নিই, তা হলে কী হয়?

জীবনময় বললেন, দখল নেওয়া হয়তো সোজা। কিন্তু দখল টিকিয়ে রাখা শক্ত।

কেন?

দেখাশুনো করবে কে? এমনি এমনি দখল নিলেই তো হল না। ওষুধ ছড়িয়ে সাপ তাড়ানো যায়, কিন্তু ফাঁকাবাড়িতে মানুষ আসবেই।

নিশানাথ উৎসাহের সঙ্গে বলল, আমি যখন এখানে পাকাপাকি চলে আসব তখন আমি ওই দুৰ্গটাতে থাকব।

জীবনময় হেসে বললেন, তা মন্দ হবে না। তোমাকে দুর্গের অধিপতি হিসেবেই মানায়!

আমি মন ঠিক করে ফেলেছি। আমি এ-রকম খোলা আকাশের নীচে এসেই থাকব।

আমি বেঁচে থাকতে থাকতে আসিস।

নিশানাথ বন্ধুর হাত চেপে ধরে বললেন, জীবন, তুই আর কটা দিন অপেক্ষা কর। আমি এসে পড়লে তোর কাজ অনেক হালকা করে দেব। তোকে আরও অনেকদিন বাঁচতে হবে।

পরিষ্কার আকাশ আজ। বিকেলের পাকা ধানের মতন রোদ লকলক করছে। একটা সরষের খেতের পাশ দিয়ে হেঁটে আসছে ওরা। বাতাসে একটা পাতলা গন্ধ।

ভাটার সময়, জল কমে গেছে। খাড়া নদীর পাড় থেকে ফেরিঘাট অনেক নীচুতে। এখান থেকেই বিদায় নিতে হবে। উমা সুব্রতকে বলল, আমাদের মনে থাকবে তো? আবার আসবে তো?

সুব্রত আলগাভাবে ঘাড় হেলালো। নদী দেখেই তার আবার একটু ভয় ভয় করছে। এবার ফিরে গিয়েই সাঁতারটা শিখে নিতে হবে।

নিশানাথ উমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি গেলে না তাহলে? এখনও বলো—

না। পরের সপ্তাহে যাব। আপনি সামনের রবিবার আসছেন তো?

কোন রবিবার না আসি? বছরে ক-টা রবিবার বাদ যায়?

উমা পাশের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, কী জানি, তবু প্রত্যেকবারই মনে হয়, আবার ক দিন পর আসবেন, তার যেন ঠিক নেই। নদী পেরিয়ে আসা তো!

আমি এবার একেবারেই চলে আসব। নদী পেরোতে হবে না আর।

কথাটা বলতে বলতে নিশানাথ বক্রভাবে ছেলের দিকে তাকালেন। তারপর আবার বললেন, আর যেই আসুক আর না আসুক–

নৌকো এখুনি ছাড়বে, আর কিছু বলা হল না। নিশানাথ ছেলেকে নিয়ে নৌকোয় উঠলেন। এটা বেশ বড়োনৌকো, আরও আট-দশ জন যাত্রী রয়েছে। অনেকক্ষণ পর্যন্ত জীবনময় আর উমাকে দেখা গেল। জীবনময়ের রোগা লম্বা চেহারা। তার পাশে উমা হাত দিয়ে চুল সামলাচ্ছে। নিশানাথ একটা তৃপ্তির নিশ্বাস ফেললেন।

খানিক দূরে আসার পর সুব্রতর ভয় অনেক কমে গেল। বাতাস খুব মনোরম। নদীর জল শান্ত গম্ভীর। এখন গঙ্গাকে এয়ারপোর্টের রানওয়ের মতন মসৃণ মনে হয়। সঙ্গে এত লোকজন থাকলে বেশি ভরসা পাওয়া যায়।

নিশানাথ নৌকোয় মাঝিদের কাছে নাসিরুদ্দিনের খোঁজ করছেন। কেউ তার খবর বলতে পারে না। এপারে পৌঁছেও তিনি নাসিরুদ্দিনের নৌকোটা খুঁজে বার করার চেষ্টা করলেন। সন্ধান পাওয়া গেল না। তিনি ঠিক করলেন, পরের সপ্তাহে এসে ঠিক খুঁজে বার করবেন, আজ আর বেশি দেরি করা যায় না, সন্ধ্যের আগে বড়োরাস্তায় পৌঁছোতে না পারলে ডায়মণ্ড হারবারের বাস বন্ধ হয়ে যাবে।

দু-জনে হাঁটাপথ ধরলেন। সুব্রতর ইচ্ছে ছিল একটু চা খাওয়ার। কাল থেকে একটাও সিগারেট খায়নি। কতক্ষণে কলকাতার পোঁছোবে, এইজন্য তার ভেতরটাতে আকুলবিকুলি করছে।

সরু কাঁচা রাস্তা, তবু এরমধ্যেই উলটো দিক থেকে একটা লরি ছুটে এল। অবিশ্বাস্যরকম দ্রুতগতিতে। আর একটু অন্যমনস্ক থাকলেই লরিটা পিতা-পুত্রকে একসঙ্গে চাপা দিয়ে চলে যেত। শেষমুহূর্তেও লরিটা গতি কমাল না বলে ওরা দুজনেই দৌড়ে একেবারে পাশের মাঠের মধ্যে নেমে পড়লেন। নিশানাথ চিৎকার করে বললেন, বেকুব? হারামজাদা!

তারপর ফের ওপরে এসে এমন আস্ফালন করতে লাগলেন যেন আর একটু সময় পেলেই তিনি লরিটাকে টেনে থামাতেন।

লরির আওয়াজটা মিলিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আর একটা বিকট আওয়াজ শোনা গেল সামনের দিক থেকে। কোনো একটা পশুর মোটা চিৎকারে আকাশ খানখান হয়ে যাচ্ছে।

নিশানাথ বিস্মিতভাবে ছেলের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, চল তো দেখি কী হয়েছে–

দু-জনে দৌড়ে এসে সামনের বাঁকটা ঘুরতেই একটা বীভৎস দৃশ্য দেখতে পেলেন। একটা বাঁশবোঝাই গোরুর গাড়ি উলটে পড়ে গেছে রাস্তার পাশে। পলাতক লরিটা হয় এটাকে ধাক্কা দিয়েছে কিংবা এটার হাত থেকে বাঁচাবার জন্য নীচের দিকে নামতে গিয়ে গাড়িটা উলটে গেছে।

গাড়িটা কাঁচা বাঁশে বোঝাই, এমনভাবে উলটে গেছে যে একটা গোরু চাপা পড়েছে তার নীচে। এই অবস্থায় অন্য গোরুটার শূন্যে ঝুলে থাকা উচিত ছিল, কিন্তু কোনোক্রমে দড়ি ছিঁড়ে সেটা বেঁচে গেছে। গাড়ির চালক বোধ হয় আগেই লাফিয়ে পড়েছিল, সে লোকটা হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে গালাগাল দিচ্ছে অশ্রাব্য ভাষায়। তার সঙ্গী একটা ছোটো ছেলে দাঁড়িয়ে আছে বোকার মতন।

চাপাপড়া গোরুটা আঁ আঁ শব্দে এত জোরে চেঁচাচ্ছে যে মনে হয় সিংহের গলার জোর এরচেয়ে বেশি-না।

নিশানাথ লাফিয়ে সেখানে নেমে পড়ে গাড়োয়ানটাকে ধমক দিয়ে বললেন, আগে গোরুটাকে তোলো!

নিজেই তিনি চাড় দিয়ে গাড়িটাকে তোলবার চেষ্টা করলেন। একটুও নড়াতে পারলেন না। কাঁচা বাঁশ সাংঘাতিক ভারি হয়। তিনি হাঁক দিলেন, খোকন, এদিকে ধরবি আয়। ও কত্তা, তুমি ওই দিকটা ধরো।

তিনজনের চেষ্টাতেও গাড়িটাকে ভোলা গেল না। অন্তত আট-দশজন লোক দরকার। গাড়োয়ানটা রাস্তার ওপর উঠে গিয়ে লোক জড়ো করার জন্য চেঁচাতে লাগল।

গোরুটার মৃত্যু-চিৎকার সহ্য করা যায় না। সেটাকে কোনোক্রমে মুক্ত করার জন্য নিশানাথ মাটিতে শুয়ে পড়লেন। গোরুটার একটা পা সাংঘাতিক খিচোচ্ছে, একবার লাগলে আর রক্ষা নেই। সাবধানে তিনি চাকার কাছটাতে চলে এলেন। মাথার ওপরে খোঁচা খোঁচা বাঁশের আগা। হঠাৎ তাঁর একটা কথা মনে পড়ে গেল। উমা বলেছিল, একটা গোরুর গাড়ি খানায় পড়ে যেতে দেখে তার মনে পড়েছিল নিশানাথের কথা। এইটাই তো তাঁর কাজ। গাড়িটাকে একটু উঁচু করতে পারলে গোরুটা বোধ হয় এখনও বেরিয়ে যেতে পারে।

বাঁশের ডগাগুলো বাঁচিয়ে তিনি কাঁধের চাড় দিলেন। তবু নড়ে না। নিশানাথ নিজের শরীরের সমস্ত শক্তির সঙ্গে আর অনেকগুলি মানুষের শক্তি যোগ দিতে চাইলেন। মুখে সমস্ত রক্ত এসে গেছে। কারা যেন বাইরে চেঁচাচ্ছে! নিশানাথকে এখন ছাড়লে চলবে না। দাঁতে দাঁত ঘসে যাচ্ছে। আর একটু, হে ভগবান, আর একটু জোর দাও!

গাড়োয়ানের চেঁচামেচিতে কিছু লোক জড়ো হয়ে গেছে। তারা এসে প্রথমে হা-হুতাশের শোরগোল তোলে। সাধারণ ভারতীয়দের মতনই তারা সিদ্ধান্ত নিতে নিতে খানিকটা সময় নষ্ট করে। বাঁশের বোঝার নীচে নিশানাথ ঢুকে গেছেন শুনে তারা গোরুটাকে বাঁচাবার আগে চেঁচাতে থাকে, ও বাবু বেরিয়ে আসেন। আগে আপনি বেরিয়ে আসেন–

নিশানাথ শেষ ঝাঁকুনিটা দিতেই কীসে যেন মট করে একটা শব্দ হল। গাড়িটা উঁচু হয়ে উঠল একসঙ্গে অনেকখানি—এবং বুকের মাঝখানে একটা বাঁশের ডগায় ধাক্কা খেয়ে নিশানাথ ছিটকে পড়লেন মাঠের মধ্যে।

সেখান থেকে তক্ষুনি উঠতে পারলেন না। সুব্রত পাশে এসে ডাকছে, বাবা, বাবা! নিশানাথের চোখ দু-টি স্থির। তিনি ভাবছেন, বাঁশের ডগাটা ভাগ্যিস বুকে লেগেছিল। চোখে মুখে লাগলে কী হত কে জানে! উমা এখানে থাকলে খুশি হত না।

অন্য লোকরা গোরুটাকে টেনে বার করছে। সেটা এখনও চিৎকার করে চলেছে বলেই বোঝা যায় হয়তো বেঁচেই যাবে। নিশানাথ ভাবলেন, তিনিও জীবন ডাক্তারের মতন করে হাসবেন। একটা গোরুর প্রাণ বাঁচানোও কম কথা কী! গোরু তো সাক্ষাৎ ভগবতী!

কিন্তু তিনি হাসতে পারলেন না। তাঁর চোয়াল আটকে গেছে। বুকে যেন অসহ্য ব্যথা।

সুব্রত বাবাকে আস্তে আস্তে তুলে বসালো। ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞেস করল, আপনার লেগেছে? কোথায় লেগেছে?

নিশানাথ দু-দিকে ঘাড় নাড়লেন। অন্য লোকরাও তাকে নানা প্রশ্ন করছে। তিনি কথা বলতে পারছেন না। নিশ্বাস বন্ধ করে ব্যথাটাকে দমাবার চেষ্টা করছেন। তোক ব্যথা, তবু এর তৃপ্তি আছে।

নিশানাথ উঠে দাঁড়াতে পারছেন না। একসঙ্গে তিনি শরীরে অসম্ভব শক্তি কেন্দ্রীভূত করেছিলেন, এখন সব শক্তিই যেন তাঁকে হঠাৎ ছেড়ে চলে গেছে। কাজ শেষ হয়ে গেছে।

তো। কয়েকজন লোক ধরাধরি করে নিশানাথকে দাঁড় করালো।

অদূরে বোরাস্তায় হেডলাইট জ্বালিয়ে এসে একটা বাস দাঁড়াল, নিশানাথ হঠাৎ গা-ঝাড়া দিয়ে সোজা হয়ে বললেন, সব ঠিক হয়ে গেছে। চল এইটাই বোধ হয় লাস্ট বাস।

কেউ কেউ পরামর্শ দিল নিশানাথকে একটু বিশ্রাম করে যেতে। তিনি এবার স্বাভাবিকভাবে বললেন, না, না, এখন ঠিক আছি। হঠাৎ বুকে লেগে গিয়েছিল কিনা! খোকন, বাসটা থামা।

নিজেই তিনি হেঁটে এসে বাসে উঠলেন। সৌভাগ্যবশত জায়গা খালি ছিল, তিনি বসলেন জানলার পাশে। তারপর বাহুতে মাথা গুঁজে বললেন, খোকন, আমি একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছি।

ডায়মণ্ড হারবারে বাস এসে পৌঁছোবার পর সুব্রত বাবাকে ডেকে দিল। নিশানাথ মুখ তুলে বললেন, এসে গেছি? চল—

বাস থেকে নামতে গিয়ে নিশানাথ হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন মাটিতে। হা-হা করে লোকজনেরা ঘিরে ধরল তাঁকে। সুব্রত খুব ঘাবড়ে গেল। তার বাবার দায়িত্ব তো তাকে কখনো নিতে হয় নি। কী করবে, বুঝতে পারছে না। বাবা আবার কীসে রাগ করবেন তারও তো ঠিক নেই।

নিশানাথ আবার নিজেই উঠে বসলেন। এখন তার মুখটা ঘোর-লাগা মানুষের মতন। নিজের এই দুর্বলতায় তিনি নিজেই সবচেয়ে বেশি অবাক হয়ে গেছেন। তিনি ফিসফিস করে সুব্রতকে বললেন, একবার জীবনকে খবর দিতে পারিস?

সুব্রত আরও ঘাবড়ে গেল। এখন জীবন ডাক্তারকে খবর দেওয়া কী করে সম্ভব? কাকদ্বীপের দিকে যাওয়ার কি আর বাস আছে? যদি থাকেও, অতদূর গিয়ে আবার নৌকোয় গঙ্গা পেরিয়ে সেখানে পৌঁছোতে তো অনেক সময় লেগে যাবে। এতক্ষণ বাবাকে কোথায় রেখে যাবে সে?

এখানকার কোনো ডাক্তার দরকার নেই। জীবনকে খবর দিতে পারিস না?

সে তো অনেক দূর!

ও!

কাছাকাছি একটা ডাক্তারখানায় ডাক্তারবাবু আজ উপস্থিত ছিলেন না, অন্যদের মুখে খবর পেয়ে কম্পাউণ্ডারবাবুই এলেন খবর নিতে। চারদিকে ভিড় জমে যাওয়া রাস্তার মধ্যে বসে থাকা নিশানাথকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে? মাথা ঘুরে গেছে?

নিশানাথের শরীরের চেয়ে মনের জোর অনেক বেশি। তিনি ধমক দিয়ে বললেন, কিছু হয়নি। এত লোক কেন?

সুব্রতর কাঁধে ভর দিয়ে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। একটা পায়ে জোর নেই, অন্য পা-টা ঠিক আছে। বুকের ওপর বাঁ-হাতটা জোর করে চেপে তিনি ব্যথাটা চাপা দিতে চাইছেন।

সুব্রত বাবাকে সাইকেল-রিকশায় তুলল। স্টেশনে এসে দু-গেলাস জল খেয়ে নিশানাথ অনেকটা সুস্থ বোধ করলেন। রাত্তিরটা ঘুমিয়ে নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কাল আবার বাড়িভাড়ার মামলা আছে। হঠাৎ তাঁর মনে হল, বাড়িওয়ালা ওই মামলায় জিতে গেলেই এখন ভালো হয়। তাহলে নিশানাথ সব ছেড়েছুড়ে জীবনময়ের আশ্রমে চলে আসতে পারবেন অনেক সহজে। এবার আসতে হবেই, আর সংসারে মন বসবে না।

শিয়ালদহ স্টেশনে যখন পৌঁছোলেন, তখন নিশানাথ খুবই দুর্বল বোধ করছেন। শরীরের মধ্যে কোথায় কী যেন একটা কিছু ছিঁড়ে গেছে। একটা পায়ে একদম জোর নেই। এ-রকম হল কেন? তাঁর খুব ইচ্ছে করছে এক্ষুনি একবার জীবনকে দেখাতে। জীবন একবার দেখলেই সব ঠিক হয়ে যেত।

তিনি নিজেই সুব্রতকে বললেন, একটা ট্যাক্সি ডাক। এতে সে অবাক হলেও বাবার শান্ত মুখ দেখে ভাবল, শরীর নিশ্চয়ই এখন ঠিক হয়ে গেছে। জীবন ডাক্তারের কাছে আবার ফিরে যেতে হলেই হয়েছিল আর কী! বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার জন্য সুব্রত ছটফট করছে। রাত মাত্র সোয়া ন-টা, বাড়ি পৌঁছে এখনও বন্ধুদের কাছে আবার যাওয়া যায়। আজই না শিখার জন্মদিন? গতবছর এইদিন শিখা নেমন্তন্ন করেছিল।

বাড়ির সামনে ট্যাক্সি থেকে নেমে নিশানাথ দেখলেন, একটা পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে। সদর দরজা খুলেই দেখলেন দু-জন পুলিশ ইনস্পেকটরের সঙ্গে কথা বলছে সঞ্জয়।

নিশানাথ ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার?

সঞ্জয় তাড়াতাড়ি শ্বশুরকে ঢিপ করে প্রণাম করে বলল, কিছু না, এঁরা এমনি আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। চলুন, আমরা একটু বাইরে গিয়ে কথা বলি।

নিশানাথ বাঁ-পা-টা ঘষটাতে ঘষটাতে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগলেন। সব ঠিক হয়ে যাবে, কাল সব ঠিক হয়ে যাবে।

পা-টা ভীষণ ভারী লাগছে। তবু ওপরে উঠতেই হবে। আরও ওপরে। কতদিন আর নীচে পড়ে থাকবেন? এবার সময় হয়েছে, উঠতেই হবে ওপরে। আর কত দূর? আর কত দূর?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *