১৯. উচ্চ বৃক্ষচূড়ে
ফেব্রুয়ারি মাসের এক মধুর রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে কনস্টিটিউশন হাউসের ৯৩ নম্বর ঘর ছেড়ে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের দিকে রওনা হলাম। ভারতবর্ষীয় কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজে যোগ দেওয়া মাত্রই প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব কোনও বাসভবনে জায়গা হবে এমন দুরাশা আমার ছিল না। ভেবেছিলাম কটা দিন গেস্ট হাউসে জায়গা হবে। তার মধ্যে সুবিধেমতো বাড়ি খুঁজে নেব। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ দেখি স্নাতকোত্তর বিভাগের ছাত্রদের হস্টেল জুবিলি হলে থাকবার ব্যবস্থা করেছেন। আমার সঙ্গে একই দিনে কাজে যোগ দিয়েছেন আলিগড়ের খালেক নাকভি। ক্লাসিক অর্থনৈতিক চিন্তার ইতিহাসের রিডার। তারও ওই জায়গায়ই থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে। উত্তর ভারতের যুবকদের বাঙালির তুলনায় স্বাস্থ্য ভাল, তেজবীর্যও কিছু বেশি। ফলে তারা কিঞ্চিৎ গোলমালপরায়ণ। স্লোগান এবং বিতর্কে সিদ্ধকণ্ঠ হলেও বাঙালি ছেলেমেয়েদের কণ্ঠস্বর অত ডেসিবেল অবধি ওঠে না। ডালভাত রোটিগোশতের তুলনায় কম পুষ্টিকর। ফলে রাতের ঘুমের ব্যাঘাত হত। দিনের বেলায়ও ঘরে বসে কাজ করা অসম্ভব না হলেও রীতিমতো কষ্টসাধ্য। এ সমস্যার সমাধান আশু প্রয়োজন মনে হল। নতুন সহকর্মী নাকভি সাহেবও দেখলাম একই মত পোষণ করেন। তবে তিনি জাতে পাঠান। তেজবীর্য ধমনীতে টগবগ করে ফুটছে। পূর্বপুরুষ হেলায় ভারত জয় করেছিলেন। আর আমাদের পূর্বপুরুষ লক্ষ্মণবাবু কী করেছিলেন তা নিয়ে পুনরালোচনায় কোনও ফায়দা নেই। ফলকথা, নাকভি সাহেবের যাহা চিন্তা তাহাই কর্ম। বাড়ি খোঁজার জন্য বজ্রমুষ্টিতে আমার কবজি চেপে ধরে রাস্তায় নামালেন। পড়েছি মোগল হলেও পাঠানের হাতে। পালাইতে পথ নাই।
নাকভি সাহেবের বক্তব্য সরল এবং সম্পূর্ণ যুক্তিসঙ্গত। আমি অকৃতদার এবং তিনি যাকে ইংরেজিতে বলে তৃণবিপত্নীক। অর্থাৎ ওঁর স্ত্রী জুবায়দা আলিগড়ে উদ্ভিদবিদ্যা পড়ান। যতদিন তাঁর দিল্লিতে একটা চাকরি না জুটছে ততদিন তিনি আলিগড়েই থাকবেন। এদিকে আমাদের মাসিক আটশো টাকা মাইনেয় ভদ্রজনের বাসযোগ্য বাসস্থান ভাড়া পাওয়া কঠিন। অতএব নাকভির প্রস্তাব—এসো আমরা দুজনে খরচা ভাগাভাগি করে সংসার পাতি। পরস্পরের একুনে তিন দিনের পরিচয়ে এই রকম প্রস্তাবে আর কেউ বোধ হয় রাজি হত না। কিন্তু খালেক নাকভি নামক অত্যন্ত স্পষ্টভাষী প্রবলচরিত্র মানুষটিকে প্রথম পরিচয়েই ভাল লেগেছিল এবং তাঁর সঙ্গে ভাগে সংসার পাতলে কোনও অসুবিধে হতে পারে এ কথা একবারও মনে হয়নি। আমাদের এই প্রস্তাবিত যৌথ সংসার দু’ বছরেরও বেশি চালু ছিল। ইতিমধ্যে জুবায়দা দিল্লিতে চাকরি পেয়ে এসে গেছেন। উনিশশো ষাটের জুলাই মাসে আমিও উদ্বাহ সংস্কার সম্পন্ন করে সাগ্নিক হয়েছি। আমার মা বাবা শ্বশুর-শাশুড়ি একাধিকবার আমাদের কাছে এসে থেকে গেছেন। কিন্তু আমাদের যৌথ সংসার ব্যবস্থায় কখনও কোনও খিটিমিটি হয়নি, এক মুহূর্তের জন্যও মনোমালিন্যের ছায়া পড়েনি। খালেক এবং আমি প্রায় বিপরীত চরিত্রের মানুষ। তবু এই প্রায়-অসম্ভব ঘটনা কী করে সম্ভব হয়েছিল আমি তার আজও সঠিক ব্যাখ্যা খুঁজে পাইনি। মনে হয় মানুষের মূল্যবোধে মৌলিক সামঞ্জস্য থাকলে একত্র বাস কিছু কঠিন কাজ না। আর আমাদের ফ্যাক্টোটাম ইসমাইলের অসাধারণ রন্ধনপ্রতিভা জীবনযাত্রার যাবতীয় বন্ধুরতা সরলীকৃত করার মোক্ষম দাওয়াই হিসাবে কাজ করত।
বাড়ি খোঁজার ব্যাপারে আমার ভাগ্যদেবতা আর একবার খেল দেখালেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তরে মডেল টাউন নামে এক পঞ্জাবি উদ্বাস্তু অধ্যুষিত পাড়ায় স্বল্পবিত্ত কিছু শিক্ষক-অধ্যাপকও আশ্রয় নিয়েছিলেন। অন্য অঞ্চলের তুলনায় এ জায়গায় ভাড়া কিছু কম। প্রসঙ্গত বলি—আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ যখন দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিকসে পড়াতে এলেন তখন তিনিও ওই মডেল টাউনেই প্রথম বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন। কিন্তু ওই পাড়ার শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। আমরা ও-পাড়ায় বাসা বাঁধার বছর দেড়েক পরে একদিন শুনি নাকভি আমাদের একজন সহকর্মীকে মডেল টাউনে বাড়ি ভাড়া নিতে উৎসাহ দিচ্ছেন। আমি মৃদু আপত্তি জানিয়ে বললাম, ‘খালেক, পুরো অবস্থাটা বলো।’ খালেক একটু উষ্ণ হয়ে বললেন, ‘কেন, তুমি অসুবিধেটা কোথায় দেখলে?’ উত্তরে বললাম, ‘না, তেমন কিছু না। শুধু গতকালই তলাওর পাড়ে একটি মেয়ে খুন হয়েছে’। অত্যন্ত অচ্ছিল্যের সুরে খালেক বললেন, ‘আরে সে তো একজন গণিকা।‘ মানে খালেকের বক্তব্য, গণিকাদের দুঃসহ জীবনে আততায়ীর হাতে খুন হওয়া একটা নিত্যকার ব্যাপার, তাতে কোনও জায়গার বাসযোগ্যতা হ্রাস হবে কেন? মানে যে পাড়ায় ভদ্র বসতির মাঝখানে মাঝে মাঝে গণিকা খুন হয়, সেখানে থাকায় নাকভি সাহেব বিন্দুমাত্র অসুবিধার কোনও কারণ খুঁজে পেলেন না।
সে কথা যাক। ভাগ্যদেবতার লীলাখেলার প্রসঙ্গে ফিরে যাই। মডেল টাউনে কিছু দূর ঢুকেই একটি ছোট তলাও অর্থাৎ মানুষের তৈরি নাতিবৃহৎ পুষ্করিণী দেখতে পেলাম। তার পাড়েই একটি সুন্দর দোতলা বাড়ি। নিতান্তই কথাচ্ছলে বললাম, ‘এখানে থাকতে পারলে বেশ হত’। ও বাড়ি যে আমাদের আয়ত্তের বাইরে এ বিষয়ে আমার সন্দেহ ছিল না। কিন্তু খালেক একটুও না ঘাবড়িয়ে এক পথচারীর কাছে বাড়িওয়ালার খোঁজ নিলেন। শুনলাম ভদ্রলোক ওই বাড়িতেই থাকেন। শ্রীযুক্ত নাগপাল বললেন, উনি ওপরতলাটা ভাড়া দেবেন ভাবছেন। নাগপালের একটু পরিচয় দেওয়া ভাল। জালিয়ানওয়ালাবাগে ডায়ার সাহেব যখন বীরত্ব প্রদর্শন করেন তখন কংগ্রেসি পরিবারের ছেলে নাগপালের বয়স দশ। ওঁরা সপরিবার মিটিংয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে মৃত বা আহতের তালিকায় ওঁদের কেউ ছিল না। কিন্তু ডায়ার সাহেব ভারতীয় জনতাকে সুশিক্ষা দিয়ে বিদায় নেওয়ার পর যারা স্ট্রেচার বেয়ারারের কাজ করে বালক নাগপাল তাদের অন্যতম।
মাসিক আড়াইশো টাকা ভাড়ায় রফা হল। দুদিন পরে আমাদের নিতান্ত অকিঞ্চন মালপত্র নিয়ে তলাওর পাড়ের বাড়িতে এসে উঠলাম। পরের বছর ওই বাড়িতেই আমার নববিবাহিতা পত্নীকে নিয়ে এসে উঠি এবং আমার একমাত্র সন্তান—যার জন্ম হয় লন্ডনে তাকে নিয়ে দেশে ফিরেও ওই বাড়িতেই ছিলাম। তলাওপাড়ের বাড়ির ব্যাপারে আমার ভাগ্যদেবতা কোনও প্রবঞ্চনা করেননি। জলের কিনারায় থাকতে পেয়ে আমি শৈশবের সুখের দিনে ফিরে গিয়েছিলাম।
দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিকসের তখন রীতিমতো চোখধাঁধানো ঔজ্জ্বল্যের দিন। তখন শিক্ষকমণ্ডলীতে অষ্টবসম্মেলন ঘটেছে। আমি এবং খালেক কাজে যোগ দেওয়ার কিছু দিন পরে অর্থনীতির তিন অধিরথ মাত্র সাতাশ বছর বয়সে অধ্যাপকের পদে নিযুক্ত হন। অমর্ত্য সেন, জগদীশ ভগবতী, সুখময় চক্রবর্তী ওই বয়সেই জগদ্বিখ্যাত। অর্থনীতির ব্যাপারে সরকারি সব বড়-মেজ কর্তারা পরামর্শ চেয়ে সর্বদা ওঁদের দ্বারস্থ। প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রীও মাঝে মাঝেই ওঁদের শরণাপন্ন। বেশ কয়েকবার তাদের দফতরে ওঁদের ডাক পড়ে। সমাজতত্ত্ব বিভাগে ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ সমাজতাত্ত্বিক শ্রীনিবাস অধ্যাপক এবং বিভাগপ্রধান। ওই বিষয়ে উদীয়মান প্রতিভা তরুণ পণ্ডিত আঁদ্রে বেতেই প্রথমে লেকচারার এবং পরে রিডারের পদ অলংকৃত করছেন। এই নামগুলি এখন সর্বজনবিদিত। কিন্তু আরও অনেকে ছিলেন যারা নিজের নিজের বিষয়ে অসাধারণ খ্যাতিসম্পন্ন। আমাদের এক বন্ধু একবার দিল্লি স্কুলে এসে বলেছিলেন, মনে হচ্ছে যেন একটা ইনটেলেকচুয়াল পাওয়ার হাউসে ঢুকেছি। এর উত্তাপ সহ্য করা কঠিন। ডক্টর অশোক মিত্র একবার আমাকে বলেন যে, তিনজন অল্পবয়সি বাঘা বাঘা পণ্ডিতকে একই সময়ে অধ্যাপক নিযুক্ত করে ডক্টর ভি, কে. আর. ভি. রাও এক বিরাট ঝুঁকি নিয়েছেন। টেনশন হতে বাধ্য। টেনশন হয়তো সত্যিতে কিছুটা হয়েছিল, কিন্তু তা কখনও ভদ্রতার সীমা ছাড়ায়নি এবং প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব কখনও বিপন্ন হয়নি।
সেই অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা ছিল সম্পূর্ণ অন্য কারণে। এ কথা বলেছিলেন প্রয়াত পুণ্যশ্লোক রায়—অন্নদাশঙ্কর রায়ের অত্যন্ত প্রতিভাবান এবং ভাগ্যহীন বড় ছেলে। সিমলার ইনস্টিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডির উনি তখন ফেলল। আমি কোনও কনফারেন্স উপলক্ষে গিয়েছিলাম। সেই ভূতপূর্ব বড়লাটের গ্রীষ্মবাসের লনে বসে ভারতবর্ষে উচ্চশিক্ষার হালচাল নিয়ে কথা হচ্ছিল। আমার মতে দেশে কয়েকটি এলিট প্রতিষ্ঠান বাদ দিলে (এলিট কথাটা তখনও গালাগালি বলে ধরা হত না। কোথাও আর উচ্চশিক্ষার কোনও নির্দিষ্ট মান নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে যে-শিক্ষা বিতরণ হচ্ছে তা প্রতিষ্ঠানগুলির কোনাকাচিতে কোথাও কোথাও উচ্চাঙ্গের হতেও পারে, কিন্তু সম্পূর্ণ নিচুস্তরের হলেও কারও কোনও মাথাব্যথা নেই—যদিও মাথাব্যথার ভড়ং সর্বত্র। পুণ্যশ্লোক বললেন, ‘আমাদের সামাজিক পরিবেশে উঁচু মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেঁচে থাকা শক্ত। মিডিওক্রিটির সমুদ্রে একসেলেন্সের ছোট ছোট দ্বীপগুলি বেশি দিন ভেসে থাকতে পারে না’। বলে তিনি এইচ. জি. ওয়েলসের ‘কান্ট্রি অফ দা ব্লাইন্ড’ গল্পটি উল্লেখ করলেন। অন্ধের দেশে এক চক্ষুম্মান ব্যক্তি কীভাবে যেন উপস্থিত হয়েছিলেন। আগকে তাদের থেকে পৃথক একথা বুঝতে পেরে অন্ধরা পাথর ছুঁড়ে তাকে তাড়ায়। মানে, অন্ধের দেশে যার একটি মাত্র চোখ আছে সেই রাজাকথাটা ঠিক না। অন্ধেরা অন্ধত্ব থেকে মুক্তি চায় না।
মিডিওক্রিটির প্লাবনে দিল্লি স্কুল ভেসে যায়নি। তার প্রাথমিক ঔজ্জ্বল্য হারিয়েছিল সম্পূর্ণ অন্য কারণে। কিন্তু ভাসানোর চেষ্টা যে হয়েছিল তার দুটি মোক্ষম প্রমাণ আমি দিচ্ছি। দিল্লি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা আদর্শবাদী শিক্ষাবিদ ডক্টর ভি. কে. আর. ভি. রাও। মানুষটি আত্মকেন্দ্রিক ছিলেন সন্দেহ নেই, কিন্তু ওঁর দেশপ্রেমে কোনও খাদ ছিল না বলেই আমার বিশ্বাস। সেই ভালবাসার প্রকাশ দুনিয়ার বাজারে টেক্কা দিতে পারে এমন সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায়। দিল্লি স্কুল ওঁর স্থায়ী কীর্তি। উনি যখন দিল্লির ভাইস চ্যান্সেলর তখন ডক্টর বীরেন গাঙ্গুলি স্কুলের ডিরেক্টর। কিন্তু ডক্টর রাও আর ইকনমিকস বিভাগের প্রধান কে. এন. রাজ এঁরা দু’জনে মিলেই তরুণ পণ্ডিতদের বয়সের তুলনায় একটু বেশি উঁচু পদে নিয়োগের নীতি অবলম্বন করেন। ব্যাপারটা সকলের সহ্য হয়নি। অমর্ত্য যখন অধ্যাপক নিযুক্ত হলেন, তখন দিল্লির কোনও কলেজের এক অধ্যাপক নিয়োগটা বে-আইনি হয়েছে এই অজুহাতে এক মামলা রুজু করেন। ব্যাপারটা নিষ্পত্তির জন্য হাইকোর্ট থেকে বিচারপতি গজেন্দ্রগড়কে ‘ওয়ান ম্যান কমিশন’ নিযুক্ত করেন এবং তিনি নির্দ্বিধায় অমর্ত্যকে অধ্যাপক নিয়োগের সপক্ষে রায় দেন। একই ব্যক্তি জগদীশ ভগবতীর নিয়োগের বিরুদ্ধেও মামলা করেছিলেন। টেকেনি। এই ধর্মধ্বজ কেন সুখময়কেও আক্রমণ করেননি তা আমার জানা নেই। বোধ হয় দম ফুরিয়ে গিয়েছিল। জগদীশের বিরুদ্ধে মামলার অজুহাত ছিল সে শুধু কেমব্রিজের বি.এ পাশ। প্রসঙ্গত বলিযখন এই মাত্র বি.এ পাস ছেলেটিকে তিন-চার বছর পরে এম.আই.টি অধ্যাপক পদে বরণ করল তখন তারা ওর প্রকাশিত পেপারগুলি একত্র করে তার মূল্য হিসাবে ওকে ডক্টরেট দিয়ে অধ্যাপক নিয়োগ করে। ওদেরও নিয়ম আছে কিনা ডক্টরেটে অধ্যাপক করা যায় না। তবে যোগ্য তোক পেলে বিনা মামলায় এ সমস্যা সমাধানের পথ তাদের জানা ছিল।
এ প্রসঙ্গে একটা কথা ভোলা ঠিক হবে না। শিক্ষিত (তথাকথিত?) ভারতীয়রা যখন বজ্জাতি করেন তখন জনস্বার্থ ছাড়া আর কোনও উদ্দেশ্য তাদের থাকে না। সম্ভবত এই মারাত্মক মিথ্যে কথাটা তারা নিজেরাও বিশ্বাস করেন। শিক্ষার ক্ষেত্রে অতি শিক্ষিত দলবাজমণ্ডলী স্বজনপোষণ, নিজ ক্রোড়ে ঝোল টানায়ন ইত্যাদি বিবিধ কুকার্যে যখন রত ছিলেন তখন দেখেছি যে ওঁদের স্থির বিশ্বাস যাবতীয় নীতিবোধের ডিম ভেঙে ওঁরা যে ওমলেট বানাচ্ছিলেন তা নিতান্তই জনগণের স্বার্থে। দই মারার ব্যাপারে ওই নেলোমণ্ডলীর যে স্বার্থ ছিল, এমন কথা সত্যিই বোধ হয় ওঁদের চিন্তায়ও আসত না। ভূদেব লেখেন যে, স্বার্থসিদ্ধির ব্যাপারে ইংরেজরা শিশুর মতো সরল। ওরা সত্যিই ভাবে যে ওদের যাতে স্বার্থসিদ্ধি, তামাম দুনিয়ার তাতেই মঙ্গল। ইংরেজি শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে অনুরূপ সরলতা ভারতীয় এলিট চরিত্রেও প্রবেশ করেছে। যে কলেজ শিক্ষকটি অমর্ত্য আর জগদীশের নিয়োগের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন, অমর্ত্যর সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে তিনি অম্লানবদনে বলেন যে, ওঁর বিরুদ্ধে মহাশয়ের কোনও অভিযোগ ছিল না। দুর্নীতিপরায়ণ কর্তাব্যক্তিরা নিয়োগের ব্যাপারে একবার নিয়ম ভাঙতে শুরু করলে আর তাদের রোখা যাবে না শুধু এই কথা চিন্তা করেই তার জেহাদ। খুরানা যখন নোবেল প্রাইজ পেলেন তখন তাকে সাম্মানিক ডি.লিট উপাধি দেওয়ার প্রস্তাব হলেও দিল্লির কয়েকজন অধ্যাপক আপত্তি করেন কারণ মার্কিন নাগরিক বনে গিয়ে উনি নাকি মাতৃভূমির প্রতি আনুগত্যের অভাব প্রকাশ করেছেন। দেশদ্রোহী লোকটি কিন্তু আমেরিকা চলে যাবার আগে দিল্লিতেই লেকচারারের পদপ্রার্থী হয়ে বিফলমনোরথ হয়েছিলেন। যাদের কথা বললাম, তাদের তুলনায় আমি সামান্য মানুষ। কিন্তু বিদেশে কাজ করতে গিয়ে যে আমি দেশদ্রোহিতা করেছি এবং ফলে যে-কোনও ব্যাপারে আমাকে ডাকবার কথা হলেই ‘উনি তো চলে গেছেন’ সুতরাং অস্পৃশ্য, এরকম কথা এখনও মাঝে মাঝেই শুনতে হয়। এই শ্রেণির দেশপ্রেমিকদের অনেকেই কিন্তু বিদেশে চাকরি পাওয়ার জন্য পিতামহীর কণ্ঠচ্ছেদ করতেও প্রস্তুত ছিলেন। একটু আগে পুণ্যশ্লোক রায়ের যে উক্তিটি উল্লেখ করেছি তার বাস্তব ভিত্তি বোঝানোর জন্য এতগুলি কথা বললাম। মিডিওক্রিটির সমুদ্রে একসেলেন্স-এর ছোট ছোট দ্বীপগুলি অতি কষ্টে আত্মরক্ষা করে। তাদের বাঁচবার চেষ্টা সব সময়ে সফল হয় না। উচ্চকোটির সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ধ্বংসাবশেষ ভারতের সর্বত্র ছড়ানো।
আমি যখন দিল্লি স্কুলে যোগ দিই তখন স্কুলের ডিরেক্টর ছিলেন ডক্টর বি. এন. গাঙ্গুলি। নিতান্ত ভদ্রলোক এই মানুষটি ভাইস চ্যান্সেলর হওয়ার পর রাজ ডিরেক্টর হন। ডক্টর গাঙ্গুলি যখন ভাইস চ্যান্সেলর তখন শুধু দিল্লি না, সর্বভারতীয় শিক্ষাজগতে কিছু অশুভ লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে। সাংবাদিকদের তোলা এক কুখ্যাত ফোটোগ্রাফে সেই কুলক্ষণের এক বাস্তব ছবি আছে। পরীক্ষা পেছানো বা ওই জাতীয় কোনও দাবি নিয়ে ছাত্ররা আন্দোলন করছিল। কিন্তু এই আন্দোলনের গতিপ্রকৃতিতে কিছু নতুনত্ব দেখা দেয়। আন্দোলনকারীরা ভাইস চ্যান্সেলরের অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে অকথ্য গালিগালাজ করে। ডক্টর গাঙ্গুলি বের হয়ে এসে তার স্বভাবসিদ্ধ বিনীত ভঙ্গিতে অনুরোধ করছিলেন যে, ছাত্রদের কয়েকজন তার অফিসে এসে তাদের বক্তব্য জানাক। এতে আন্দোলনকারীদের উৎসাহ আরও বেড়ে গেল। ধ্বনি উঠল, হাম সে যো টকরায়েগা চুরচুর হো যায়েগা। ফোটোতে দেখি ভাইস চ্যান্সেলরকে ঘিরে নর্তনকুর্দনশীল কিছু ইয়াহু। আর জোড়হস্ত ভাইস চ্যান্সেলরের মুখে চুরচুর হয়ে যাওয়া একটি মানুষের অভিব্যক্তি। পরে রাজ যখন ভাইস চ্যান্সেলর, তখন ছাত্র আন্দোলনের সুর আরও উন্নত হয়েছে। সম্মানিত মানুষটিকে লক্ষ্য করে ধ্বনি উঠল ‘কালা কুত্তা হায় হায়’। যে বর্বররা উক্ত ধ্বনি তুলেছিল পরে তাদের কেউ কেউ দিল্লির বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপকের পদ অলংকৃত করেছে। এবং আমার বিশ্বাস ওইসব অশালীন আন্দোলনের পিছনে কিছু কিছু শিক্ষকের মদত বা উস্কানি ছিল।
১৯৪৮ থেকে ১৯৭২ অবধি মাঝে কয়েক বছর বাদ দিয়ে প্রায় বিশ-পঁচিশ বছর আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষার সঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম। নানা স্তরে শিক্ষক, পরীক্ষক, প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ, ইউজিসির বিভিন্ন কমিটির সভ্য হিসেবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার নানা দিক ঘনিষ্ঠভাবে দেখার সুযোগ আমি পেয়েছি। সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কয়েকটি নেতিবাচক কথা এখানে বলতে চাই।
সত্তরের দশকে অল ইন্ডিয়া রেডিওর অনুরোধে দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে একটি বক্তৃতা করি। বক্তৃতাটির শিরোনাম ছিল ‘হায়ার এডুকেশন ইন ইন্ডিয়া অ্যাজ এ ফর্ম অফ অ্যান্টিসোশ্যাল অ্যাক্টিভিটি’। আমার মূল বক্তব্য ছিল যে, উচ্চশিক্ষার খাতে সরকার যে টাকা ঢালেন তার বিরাট একটা অংশ নিছক অপচয় ছাড়া কিছু নয়। উদাহরণ স্বরূপ বিএ পাসকোর্সে পঠন-পাঠনের কথা উল্লেখ করি। একথা সুবিদিত যে, ওই কোর্স যারা পড়েন তাদের অধিকাংশই কোনও পাঠ্যপুস্তক চোখেও দেখেন না। কোনও নোট বই, মাস্টারমশাইদের দেওয়া নোট বা পরীক্ষার অল্পদিন আগে প্রকাশিত ‘শিওর গেস’ই তাদের জ্ঞানের সীমানা নির্দেশ করে। সাধারণত পেপার-প্রতি পনেরো-কুড়িটা প্রশ্নের উত্তর (সংখ্যাটা সম্ভবত একটু বাড়িয়েই বলছি) মুখস্থ করেই তাদের দু’ বছর কলেজে অধ্যয়ন বিদ্যার্জনের সমাপ্তি ঘটে। আমি হিসেব করে দেখিয়েছিলাম যে, পেপার প্রতি কুড়ি পাতা নোট মুখস্থ করে অর্থাৎ পাঁচটা বিষয়ে একুনে দশ পেপারে দু’শো পৃষ্ঠা গলাধঃকরণ এবং তার ভূক্তাবশেষ পরীক্ষার খাতায় বমন করে দিব্যি বিএ পাস ডিগ্রি পাওয়া যায় এবং যাঁরা এই স্তরের বিদ্যা অর্জন করে জীবিকা অর্জনের জন্য দরকারি ন্যুনতম ছাপ সংগ্রহ করেন তাঁদের অধিকাংশ মাতৃভাষা বা ইংরেজি কোনওটাই শুদ্ধভাবে লিখতে শেখেন না। বিষয়বস্তু একটু কঠিন হলে এঁদের কাছে বইয়ের অর্থবোধ হয় না এমন প্রমাণ বহুবার পেয়েছি। অথচ উচ্চশিক্ষার খাতে মোট খরচের বড় একটা অংশ, সম্ভবত সিংহভাগ, এই স্তরের শিক্ষার জন্য ব্যয়িত হয়।
ষাটের দশকে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পাস কলেজের গভর্নিং বডিতে আমি ছিলাম। দেখলাম ইউজিসি সুশিক্ষার জন্য নানা রকম সুব্যবস্থা করেছেন। কলেজ বিল্ডিংয়ের জন্য বরাদ্দ সাতাশ লক্ষ টাকা। ছাত্রসংখ্যা অনুযায়ী ঘরের মাপ কী হবে তাও নির্দিষ্ট আছে। ওই ব্যয়ে সে সময়ে ছোটখাটো একটি হাসপাতাল তৈরি হয়ে যেত। সাতাশটা গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা হতে পারত। ছাত্ররা যাতে যথেষ্ট সংখ্যায় পাস করে সে বিষয়েও স্পষ্ট নির্দেশ ছিল। কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা কিছু শিখল কি না অথবা যা শিখল তার মান কী সে বিষয়ে পর্বতের নীরবতা। ধরে নেওয়া হয়েছে পাস করা মানেই লেখাপড়া শেখা। এটা যে কত বড় মিথ্যা কথা তা সম্ভবত কারও অজানা নেই। এই জাতীয় কথা বলা এখন রাজনৈতিক বিশুদ্ধতার বিরোধী বলে ধরা হয়। দরিদ্র মানুষের সামান্য পুঁজি তছনছ করে যারা ওই বিশুদ্ধতা রক্ষায় যত্নবান তাদের খুরে আমি নিশ্চিন্ত দূরত্ব থেকে নমস্কার জানাতে চাই।
স্বাধীনতা-পরবর্তী যুগে ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার বেশ কিছু চোখধাঁধানো কীর্তি আছে। ভারতীয় বৈজ্ঞানিক এবং টেকনিশিয়ানরা সংখ্যায় এবং বিদ্যাবত্তায় দুনিয়ার প্রায় যে-কোনও দেশের সঙ্গেই টেক্কা দিতে পারে। দেশে-বিদেশে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা সকলের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করছে। বিজ্ঞান বা সমাজবিজ্ঞানের পত্রপত্রিকা খুললেই ভারতীয় নাম চোখে পড়ে। আজকের ইংরেজি সাহিত্যে ভারতীয় লেখকরা এক বিরাট এবং সম্মানিত অংশ জুড়ে আছে। কিন্তু এই উজ্জ্বল প্রদীপের নীচেই ঘন অন্ধকার।
ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় ছাদ খুব উঁচু কিন্তু মেঝে প্রায় নেই বললেই চলে। এই অসম প্রগতির কারণ যা বুঝেছি এখানেই সে বিষয়ে কিছু বলি। আমার বক্তব্যর সঙ্গে সম্ভবত অধিকাংশ শিক্ষাজীবীর মত মিলবে না। দেশ যখন স্বাধীনতা পেল তখন কয়েকটি শ্রেণির মানুষের রাজনৈতিক শক্তি অন্যদের তুলনায় বেশি। শহরে এবং গ্রামে অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন কিছু মানুষের আর্থিক ও সামাজিক উচ্চাশা তখন তুঙ্গে। উচ্চশিক্ষা বা বরং বললে ঠিক হবে ডিগ্রি তাদের আশা পূরণের জন্য বিশেষ প্রয়োজন। ফলে উচ্চশিক্ষার প্রসার বা ডিগ্রি বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাবৃদ্ধি ক্ষমতাশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণির (আমি শব্দজোটটা নিতান্তই আর্থিক ক্ষমতার অর্থে ব্যবহার করছি, অর্থনৈতিক শ্রেণিবিশেষ অর্থে নয়) অন্যতম প্রধান দাবি হয়ে দাঁড়াল। ইংরেজরা যখন বিদায় নেয় তখন উপমহাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল সতেরো, কলেজের সংখ্যা দুশশার মতো। কয়েক দশকের মধ্যে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে দেড়শো এবং দু’ হাজারের উপরে। শুনলাম এই সংখ্যা বর্তমান। ভারতবর্ষে আরও দুগুণ ও তিনগুণের ওপর বেড়েছে। এই সংখ্যাবৃদ্ধি কোনও পরিকল্পনামাফিক হয়নি। যাদের দাবি মেটাতে এই সংখ্যাবৃদ্ধি তাদের অধিকাংশের শিক্ষার মান নিয়ে কোনও মাথাব্যথা ছিল না। তারা চাইছিল অনায়াসে তাদের ছেলেমেয়েরা ডিগ্রি এবং তার জোরে ভাল চাকরি পাক অথবা/এবং বিয়ের বাজারে দর বাড়ঙ্ক। ভিলওয়ারার ডুঙ্গারপুর কলেজে সেখানকার শাণিতবুদ্ধি ছেলেমেয়েদের জিগ্যেস করেছিলাম, ‘কলেজে পড়তে এসে তোমরা কী শিখলে?’ দ্বিধাহীন উত্তর পেলাম, ‘কুছ ভি নেহি’। ‘তবে আসো কেন?’ উত্তর, ‘মা বাপ পাঠায় ইজ্জত বাড়বে বলে। আমাদেরও স্বার্থ আছে। দহেজটা কিছু বেশি পাওয়া যায়’।
ফলে ভারতীয় শিক্ষায় দুই মেরুর উৎপত্তি হয়েছে। উত্তর মেরুর বাসিন্দারা ফরফর করে ইংরেজি বলে, ইংল্যান্ড-আমেরিকায় পড়তে এসে হয় বিদেশেই থেকে যায় নয়তো দেশে ফিরে মোটা মাইনের চাকরি পায়। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের প্রচণ্ড প্রভাব সত্ত্বেও এঁদের সামাজিক মতামত অনেকটাই ধর্মমতনিরপেক্ষ। কারণ সংখ্যাগুরুত্ব ভাঙিয়ে চাকরি জোটানোর তাদের প্রয়োজন নেই। মণ্ডল কমিশনের অনুমোদিত নীতি তাদের মাথাব্যথার কারণ হয় না। উচ্চশিক্ষা আর দেশ-বিদেশের হালচালের সঙ্গে পরিচয় থাকায় তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছু উদারতাও থাকার সম্ভাবনা। (তবে মনে রাখা ভাল যে, এই শ্রেণির ভারতীয়রাও এখন বিপুল সংখ্যায় বিশ্ব হিন্দু পরিষদের অনুগামী হয়েছে যার কারণ পরে আলোচনা করব।) আর ইংরেজি ভাষাভাষী উচ্চশিক্ষিত চটপটে বড় চাকরিওয়ালাদের স্বর্গের পথের পাশেই অর্ধশিক্ষিত বা সম্পূর্ণ অশিক্ষিত ডিগ্রিধারীদের বিষাদলোক। অবহেলিত হেরে যাওয়া এইসব মানুষ উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতির দল পুষ্ট করে। এদের কীর্তিকলাপ সত্তরের দশকে দিল্লি ক্যাম্পাসে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে।
যে-শিক্ষা ডিগ্রি বিতরণ করে, কিন্তু কিছু জানতে বা বুঝতে শেখায় না তার দাম আমাদের নানাভাবে দিতে হয়। আমরা অমিত সম্পদের অধিকারী নই। তথাকথিত উচ্চশিক্ষার খাতে ব্যয় অতিরিক্ত হওয়ায় প্রাথমিক শিক্ষা এবং নিরক্ষরতা দূরীকরণের খাতে অর্থের অসঙ্কুলান হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় ষাট বছর পরেও তাই আজ শতকরা চল্লিশজন ভারতীয় নিরক্ষর। এটা সরকারি হিসেব। সত্যিকার হিসেব আরও ঘন কৃষ্ণবর্ণ। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কিছু খরচা কমালে মধ্যবিত্ত প্রগতিশীলরা ‘শিক্ষাসঙ্কোচ’-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামেন। ‘নেহি চলেগা’ ‘নেহি চলেগা’ ধ্বনিতে আকাশবাতাস মুখরিত হয়। ব্যাপক নিরক্ষরতা অথবা ডিগ্রিধারীর অশিক্ষার বিরুদ্ধে অনুরূপ কোনও আন্দোলন আমার জীবদ্দশায় নজরে পড়েনি।
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও পরিকল্পনাবিহীন শিক্ষাবিস্তারের কুফল সর্বত্র চোখে পড়ে। আমাদের দেশে ডিগ্রিধারী প্রায়-অশিক্ষিত লোক সংখ্যায় খুব বেশি। এর এক কারণ—এক দিকে যেমন ইংরেজিমাধ্যম স্কুলের কৃপায় মাতৃভাষা প্রায় ভুলে যাওয়া, ফরফর করে ‘আরে ইয়ার’-মাকা চিটি ইংরেজি বলা স্নাতকের সংখ্যা খুব বেড়েছে, অন্য দিকে স্নাতকদের একটা বিরাট অংশ ইংরেজি বই পড়ে বুঝতে পারে না। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে মাতৃভাষায় ক্লাসে পড়ানো হয়। তাতে আপত্তি করার কিছু নেই। কিন্তু সন্তাপের বিষয় এই যে, কোনও ভারতীয় ভাষায়ই পাঠ্য বিষয়গুলি সম্বন্ধে গ্রহণযোগ্য বই যথেষ্ট সংখ্যায় লেখা হয়নি। কোনও প্রধানস্থানীয় ইউরোপীয় ভাষা না জানা থাকলে পৃথিবীর জ্ঞানের জগতের দরজা বন্ধ থাকে। ফলে আমাদের বিএ, এমএ ডিগ্রিধারী অনেকেরই বিদ্যার দৌড় ক্লাসে শোনা শিক্ষকের বক্তৃতা বা তাদের দেওয়া নোট ছাড়িয়ে আর এগোয় না।
প্রধানত দিল্লি স্কুলে কিঞ্চিদধিক বারো বছর এবং ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ইতিহাস বিভাগে দু’বছর পড়ানোর সময়কার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে উপরে লিখিত কথাগুলি বললাম। আমার ধারণা আমার এই বিশ্লেষণ ভুল না। কিন্তু আমার বক্তব্য বা তার ভিত্তিতে অন্য পথের নির্দেশ মাঝে মাঝে দেওয়ার চেষ্টা করে প্রবন্ধাদি যখন যা লিখেছি, কর্তাব্যক্তিদের তা পড়াবার চেষ্টা করেছি। কখনও তাদের মধ্যে দু-একজন পিঠ চাপড়ে বলেছেন, ‘বেশ লিখেছ হে’। আমার মতামত আমাদের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার উপর এর বেশি কোনও প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়নি। যুগবিশেষে ইতিহাসের ধারা আমাদের যেদিকে নিয়ে যায় তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ক্ষেত্রবিশেষে মোড় ঘোরানোর চেষ্টা সাধারণত সফল হয় না। যারা এ কাজে সফল হন তারা নানা অর্থেই অনন্যসাধারণ।
দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিকসে আমার জগদ্বিখ্যাত সহকর্মীদের কাছ থেকে আশাতিরিক্ত এবং আমার যোগ্যতার তুলনায় অনেক বেশি সম্মান এবং সহযোগিতা পেয়েছি। এদের মধ্যে এক অমর্ত্যকেই আগে থেকে চিনতাম। দিল্লি স্কুলে আসবার পর তিনি সাফল্যের যে-স্তরে পোঁছে গেলেন এবং তার সময়ের উপর এত বিচিত্র এবং অসংখ্য দাবি শুরু হল যে তার আবর্তে আমার চেনা পুরনো মানুষটির আর নাগাল পেলাম না। যদিও তার এবং তার পরিবারের সঙ্গে সামাজিক বা বন্ধুত্বের সম্পর্কে কখনওই ছেদ পড়েনি এবং প্রয়োজনে বা সঙ্কটের মুহূর্তে বারে বারেই তার সাহায্য পেয়েছি, কিন্তু একদা অতি পরিচিত সেই তরুণ যেন অনেক দূরের লোক হয়ে গেলেন।
নতুন পরিচিতদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হল জগদীশ ভগবতী এবং পরবর্তীকালে তাঁর পত্নী পদ্মা দেশাইয়ের সঙ্গে। আরও পরে যোগ দিলেন অর্জুন সেনগুপ্ত, পরবর্তীকালে ইন্দিরা গাঁধীর অর্থনীতি বিষয়ে উপদেষ্টা এবং ইউরোপের অর্থনৈতিক জোটে আমাদের রাষ্ট্রদূত। বয়সে অনেক ছোট আঁদ্রে বেতেই-র সঙ্গে আড্ডার সম্পর্ক জমল। তার অন্যতর অনুষঙ্গ ছিল রাত ন’টার শোয়ে অখাদ্য বলিউডি ফিলম দেখা এবং রাস্তার ধারের দোকান থেকে দোক্তা বা কিমাম দিয়ে পান খেয়ে অনেক রাতে বাড়ি ফেরা। আঁদ্রে এর আগে কখনও কিমাম খাননি। কিমামের প্রথম অভিজ্ঞতার পর তিনি নাকি বলেন, ‘তপনদা, আর খাবেন না, আপনি ঝাঁপসা হয়ে যাচ্ছেন’। এ রকম একটা গল্প স্কুলে চালু ছিল। দুঃখের কথা, এই মুখরোচক গল্পটা সত্যি না। অত্যন্ত সংযতবাক অথচ রসিক মানুষ এম. এন. শ্রীনিবাস ওরফে চামুর সঙ্গেও বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়। আর এই দুই ডাকসাইটে সমাজতাত্ত্বিকের কাছে ওই বিষয়ে পাঠ নিয়ে বিশেষ উপকৃত হয়েছিলাম।
একটি মানুষকে বিশেষ শ্রদ্ধার চোখে দেখতাম, শুধু আমি না অনেকেই। আমি প্রয়াত সুখময় চক্রবর্তীর কথা বলছি। এত বিচিত্র বিষয়ে গভীর জ্ঞান আমি আর কোনও মানুষের মধ্যে দেখিনি—দেশে বা বিদেশে। দিল্লি স্কুলের লঘু আড্ডায়ও অর্থনীতিচর্চার ছায়া পড়ত। এমনকী রসিকতাগুলিও যেন অর্থনীতি ঘেঁষা, ফলে আমার কাছে দুর্বোধ্য। সেখানে সুখময়ের সর্বব্যাপী বিদ্যা কথাবার্তা আদানপ্রদানে অন্য এক সুর নিয়ে আসত। তার বিদ্যার সঙ্গে আমার সামান্য পড়াশোনার কোনও তুলনা হয় না। কিন্তু বহু বিষয় নিয়ে ওঁর আলোচনা আমার শুনতে ভাল লাগত। বেশ কয়েক বছর আমরা নিকট প্রতিবেশী ছিলাম। জ্ঞানচর্চায় নিবেদিতপ্রাণ সম্পূর্ণ শুদ্ধচিত্ত এই মানুষটির কাছ থেকে পরোক্ষভাবে অনেক কিছু শিখেছি। জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের এই সুযোগ্য বংশধরটি সম্পর্কে আমার বারে বারেই একটি কথা মনে হত। মনে হত ইনি আদর্শ ব্রাহ্মণ। সত্যিকার ব্রাহ্মণ্য আদর্শ সম্পূর্ণ আধুনিকমনা লোকটির জীবনে রূপায়িত হয়েছে। ব্রাহ্মণের পক্ষে সভাপণ্ডিত হওয়া স্বাভাবিক পরিণতি। কিন্তু সুখময় যখন প্ল্যানিং কমিশনে গেলেন, তখন ব্যাপারটা ওঁর পক্ষে মঙ্গলকর হয়নি বলেই আমার বিশ্বাস। ওঁর নীতিবোধ ওঁকে শ্ৰীমতী গাঁধীকে সমর্থনের পথ থেকে বিচ্যুত হতে দেয়নি। এবং তার ফলে শুদ্ধচরিত্র মানুষটি অনেক নিন্দা গালিগালাজ মুখ বুজে সহ্য করেছেন।
দিল্লি স্কুলের সভ্য মার্জিত আবহাওয়ায় আমার সব দিক থেকেই তৃপ্ত থাকা উচিত ছিল। ওই দশবারো বছরেই আমার যা-কিছু প্রতিষ্ঠা এবং অল্পবিস্তর খ্যাতি হয়েছিল। সহকর্মীদের ব্যবহারে নালিশ করা যায় এমন কিছু ছিল না। বরং তারা আমার কর্ম এবং ব্যক্তিগত জীবন যথাসাধ্য সহজ করার জন্য সম্ভব-অসম্ভব সব কিছুই করেছেন। এত সত্বেও ওই প্রতিষ্ঠানে থাকাকালীন আমি কোনও অর্থেই সুখী ছিলাম না। পশ্চাদৃষ্টির আলোয় কারণটা এখন বুঝতে পারি। ওই প্রতিষ্ঠানে পড়াতে যাওয়া আমার মারাত্মক ভুল হয়েছিল।
দিল্লি স্কুলের কেন্দ্রে ছিল অতি উচ্চাঙ্গের অর্থনীতিচর্চা। ওইখানে প্রথম থেকেই নিজেকে মনে হত হংস মধ্যে বকো যথা। প্রতি শীতে সারা দুনিয়ার জগদ্বিখ্যাত সব অর্থনীতিবিদ দিলি আসতেন—ভারতের আর্থিক উন্নয়ন প্রচেষ্টায় সাহায্য করতে অথবা স্বচক্ষে কী ঘটছে দেখতে। মিসেস জোন রবিনসন এই নিয়মিত অতিথিদের অন্যতম। তিনি কে, এন, রাজের অতিথি হতেন এবং তাকে ঘিরে একটি গোষ্ঠী তথা আলোচনাচক্র গড়ে উঠেছিল। এই গোষ্ঠীটিকে আমি দুর থেকে দেখতাম। আমি যে ওই গোষ্ঠীর কেউ নই এই সত্যটা আমার সহকর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব নিজের চোখে প্রকট করে তুলত।
মিসেস রবিনসনের দিল্লিবাস সম্পর্কে দু-একটি কাহিনি উল্লেখযোগ্য। উনি প্রগতিবাদী পণ্ডিত হিসাবে বিপ্লবী চিনের শতকরা একশো ভাগ সমর্থক ছিলেন। দিল্লি যাওয়া বা আসার পথে প্রতি বছর উনি চিনেও যেতেন। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ভয়াবহতাও ওঁর এই চিনপ্রীতি কমাতে পারেনি। শোনা গেল কেমব্রিজ থেকে পাস করা ওঁর কিছু ছাত্র, যাঁরা চিনের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন, তারা সংস্কৃতি বিপ্লবের ফলে পদচ্যুত হয়ে ভূমিহীন কৃষকের কাজ করছেন। এদের কথা উল্লেখ করে মিসেস রবিনসন বলেন, জানি তোমরা কথাটা বিশ্বাস করবে না। কিন্তু টেক ইট ফ্রম মি, তারা আগের চেয়ে অনেক বেশি সুখী, মাচ মাচ হ্যাপিয়ার। দক্ষিণ ভারতে প্রথা আছে—পিতার নামের আদ্যাক্ষরগুলি পুত্রের নামের আগে লাগিয়ে দেওয়া হয়। তাই ওই অঞ্চলের এক অর্থনীতিবিদ মিসেস রবিনসনকে এক বিচিত্র পত্রাঘাত করেন। আপনি কি জে. আর. হিকসের পিতা?কারণ মিসেস রবিনসনের নাম ও পদবির আদ্যাক্ষর জে এবং আর। ভদ্রমহিলা উত্তর দেন, জীবনে অনেক পাপ করেছি। কিন্তু এটি আমার উপর চাপিয়ো না।
দিল্লি স্কুলে আমার বিষয়গত একাকিত্বের কারণ আমার স্বাভাবিক পেশা। আমি ছিলাম ঐতিহাসিক, যদিও অর্থনৈতিক ইতিহাস আমার গবেষণার অন্যতম ক্ষেত্র এবং আমি ওই বিষয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে রিডার এবং পরে অধ্যাপক। তখন অর্থনৈতিক ইতিহাস সম্পূর্ণ দু’ ভাগ হয়ে গেছে। তার এক দিক ইতিহাসমুখীন। অন্যটির ভিত্তি কঠিন তাত্ত্বিক অর্থনীতি আর সংখ্যাতত্ত্বে। আমি আশৈশব সংখ্যাবিমুখ। আমার অর্থনীতির জ্ঞান খুব সামান্য। এসব বাধা কাটিয়ে ওঠা অসম্ভব না। সে চেষ্টা আমি অল্পবিস্তর করিনি এমন নয়। কিন্তু সত্যিতে আমার বুদ্ধিগত এবং বিষয়গত উৎসাহ ছিল ভিন্নমুখী। আমি জীবনের শেষ অধ্যায়ে এসে বুঝেছি যে, ইতিহাসে আবাল্য আমাকে যা আকর্ষণ করেছিল তা হচ্ছে বিষয়টির সাহিত্যরস অচেনা যুগে অজানা দেশে অপরিচিত মানুষের অধত হৃৎস্পন্দন শোনার চেষ্টা। তাই দিল্লি স্কুলের প্রচণ্ড বুদ্ধি ও বিদ্যাগত ডায়নামোর অংশীদার হতে আমি পারিনি। তাম আমার শিক্ষক হিসাবে খ্যাতি হয়েছে। ছাত্ররা আমার পড়ানো শুনতে ভালবাসে। কিন্তু অঙ্কভিত্তিক অর্থনীতির প্রচণ্ড দাবি মিটিয়ে আমার ক্লাস করা ওদের কাছে একটু বিশ্রামের চেহারা নিত। এক অর্থে অর্থনীতি বিভাগে আমার অবস্থা ছিল স্কুলে ফারসির মৌলভির মতো। থাকলেও হয়, না থাকলেও ক্ষতি নেই।
আমি যে নিজেকে অবান্তর মনে করছি, আমার সহকর্মীরা সে বিষয়ে সচেতন ছিলেন এবং প্রধানত খালেক এবং অমর্ত্যর উৎসাহে ওঁরা নানাভাবে আমার নিজের চোখে আমার জীবন ও কর্ম অর্থবহ করার চেষ্টা করতেন। আমাকে যথাশীঘ্র সম্ভব রিডার থেকে অধ্যাপকের পদে উন্নীত করা হয়। রাজ ডিরেক্টরের পদ ছেড়ে দিলে আমাকে স্কুলের ডিরেক্টর করা হল। অর্থনীতি বিভাগ যখন সেন্টার অফ এক্সেলেন্স বলে স্বীকৃতি পেল, তখন বিভাগটির নতুন নাম হল সেন্টার ফর দা স্টাডি অফ ইকনমিক হিষ্ট্রি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট। ইচ্ছামতো নতুন পদ সৃষ্টি করার স্বাধীনতা পেলাম। অর্থনৈতিক ইতিহাসের রিডার হয়ে ধর্মা কুমার এলেন। তার সহযোগিতায় পত্রিকা প্রকাশ করলাম ইন্ডিয়ান সোস্যাল অ্যান্ড ইকনমিক হিস্ট্রি রিভিউ। আন্তর্জাতিক অধ্যাপক-গবেষক বিনিময় ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে ইংল্যান্ড, আমেরিকা, জাপান থেকে অর্থনৈতিক ইতিহাসের সব ডাকসাইটে পণ্ডিতদের দিল্লি নিয়ে এলাম। এ ব্যাপারে আমার সহকর্মীরা নিঃসন্দেহে আমাকে প্যাম্পার করতেন অর্থাৎ অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা দিতেন সন্দেহ নেই। ১৯৬২ সনে আমার অক্সফোর্ডের থিসিসটি হল্যান্ডের এক নামি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত হল, ‘ইয়ান কম্পানি ইন করমণ্ডল, ১৬০৫-১৬৯০’। ইংল্যান্ড এবং আমেরিকা থেকে আমন্ত্রিত হয়ে তিনবার বিদেশে পড়াতে গেলাম। মার্কিন মুলুকে যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছি হার্ভার্ড, ক্যালিফোর্নিয়া (বার্কলে), পেনসিলভেনিয়া তাদের অন্যতর।
‘তবু কেন প্রাণ কাঁদে রে!’ আমার গভীর শূন্যতাবোধ কিছুতেই কাটল না। মানসিক কষ্ট শারীরিক ব্যাধির রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করল। প্রচণ্ড মাথাধরা আর প্যালপিটিশনে ভুগতে শুরু করলাম। সবাই ভাবত হাইপোকন্ড্রিয়া এবং এ নিয়ে হাসাহাসিও হত। কিন্তু সত্যিতে আমার যা হয়েছিল তা গভীর ব্যর্থতাবোধ এবং তজ্জনিত ডিপ্রেশনের ফলে সাইকোসোম্যাটিক সিম্পটম। ফলে আমার দৈনন্দিন রুটিনের বাইরে অন্য কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।
দিল্লি ইউনিভার্সিটিতে পনেরো বছর পড়াবার সময় আমার হাত দিয়ে নতুন কাজ বের হয় খুবই সামান্য। কয়েকটি প্রবন্ধ ছাড়া ওই সময়ে আমার উল্লেখযোগ্য কাজ ‘বেঙ্গল আর আকবর অ্যান্ড জাহাঙ্গির’-এর নৃতত্ত্বভিত্তিক নতুন ভূমিকা সহ নয়া সংস্করণ। ওই ৪০ পৃষ্ঠার নতুন ভূমিকা সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ইতিহাসে নৃতত্ত্বের প্রভাব আনার যাঁরা পথিকৃৎ, তাঁদের নেতৃস্থানীয় কিথ টমাস (বর্তমানে প্রফেসর স্যার কিথ টমাস) ‘পাস্ট অ্যান্ড প্রেজেন্ট’ পত্রিকায় লেখাটির দিকে ঐতিহাসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এই লেখাটির প্রস্তুতি হিসাবে আঁদ্রে এবং অধ্যাপক শ্রীনিবাসের কাছে সমাজতন্ত্রের পাঠ নিই।
এ ছাড়া উনিশ শতকের ভারতীয় অর্থনীতি বিষয়ে একটি বিতর্কে আমার লেখাটি অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। লন্ডনে স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ-এ এক বছর রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট ছিলাম ১৯৬১-৬২ সনে। ওই সময় ভারতীয় অর্থনৈতিক ইতিহাসের বিশেষজ্ঞ মার্কিন পণ্ডিত মরিস ডি. মরিসের সঙ্গে পরিচয় এবং বন্ধুত্ব হয়। তিন বছর পর বার্কলেতে পড়াবার সময় মরিসের লেখা জার্নাল অফ ইকনমিক হিস্ট্রিতে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধকে কেন্দ্র করে এক সেমিনার হয়। মরিসের মূল বক্তব্য ছিল–ইংরেজ আমলে বিশ্ববাণিজ্যের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপিত হওয়ায় এবং সেই যোগাযোগ সহজ করার জন্য ইংরেজরা যানবাহন আর সংবাদ চলাচল ব্যবস্থার বিশেষ উন্নতি করায় ভারতবর্ষে সর্বাঙ্গীণ অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছিল। তবুও যে শিল্পবিপ্লব ঘটেনি তার কারণ প্রাক-ঔপনিবেশিক যুগে ভারতীয় অর্থনীতির নেহাতই অনুন্নত অবস্থা। এই মতের ভুলভ্রান্তি দেখিয়ে আমি বক্তৃতা করি। মরিস সাম্রাজ্যবাদী ঐতিহাসিক নন। অর্থনীতির তত্ত্বগত চিন্তার আলোকে ওঁর যা সত্যি মনে হয়েছিল তাই লিখেছিলেন। সুতরাং আমাদের মতের মিল না হলেও বন্ধুত্বে চিড় ধরেনি। পরে যখন মরিস দিল্লি এলেন, আমি তখন স্কুলের ডিরেক্টর এবং আমাদের নবপ্রকাশিত পত্রিকাটির কার্যকরী সম্পাদক। মরিস প্রস্তাব করলেন—ওঁর প্রবন্ধটি নিয়ে আমাদের পত্রিকায় আলোচনা হোক। সেই অনুযায়ী আমাকে নিয়ে তিনজন ওঁর বক্তব্যর সমালোচনা করি এবং মরিস তার উত্তর দেন। পরে সমস্ত আলোচনাটি বইয়ের আকারে প্রকাশিত হয়। এই বিতর্ক সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে ও বিপক্ষে মতামতের এক উল্লেখযোগ্য সংলাপ হিসেবে বেশ কিছুদিন ঐতিহাসিকদের আলোচ্য ছিল। দুঃখের বিষয়, যদিও এই আলোচনা মরিসের উৎসাহেই হয়েছিল তবুও তার ফলে আমার আর মরিসের সম্পর্কে চিড় ধরে। এই ঘটনা আজও আমার দুঃখের কারণ হয়ে আছে। ওই বিতর্কের বছর দশক পরে এক ইংরেজতনয় এক কলেজপাঠ্য পুস্তকে বিতর্কটি উল্লেখ করে লেখেন যে, ইংরেজ শাসনের সপক্ষে কিছু বলায় এক না, তিন তিনজন লোক মরিসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে—’জাম্পড অন হিম’। বেচারা ইংরেজ শাসন, বেচারা মরিস। আমার এই লম্ফঝম্পে পটুত্ব সাধারণ্যে প্রকাশ পাওয়ায় বড় আনন্দ হয়েছিল। আর এক ইংরেজ সহকর্মী এক আলোচনাচক্রে বলেন যে, আমার ওই প্রবন্ধ স্মরণ করে এখনও নাকি তিনি ভয়ে কম্পমান—কোয়েক ইন মাই শুজ। ভারতে ইংরেজদের বিবিধ বজ্জাতির কৈফিয়তপটু ঐতিহাসিকদের এক-আধজনকে যদি সত্যিই ভয়ে কাঁপাতে পেরে থাকি তবে তো আমার ঐতিহাসিক জন্ম সার্থক হয়েছে। প্রসঙ্গত বলি, ছাঁচড়ামি ভারতীয় সংস্কৃতির একচেটিয়া সম্পত্তি না। সাহেবি ছ্যাঁচড়ামি বহুবর্ণ এবং বিচিত্র।
সে কথা যাক। আমার মূল বক্তব্যে ফিরে গিয়ে বলি—দিল্লিতে দীর্ঘ পনেরো বছর পঠন পাঠনের সময়টায় গবেষণার ক্ষেত্রে আমার অবদান প্রায় শূন্যের কোঠায়। জ্ঞানার্জন কিছু হয়েছিল, তার কিছুটা পড়াতে গিয়ে, কিছুটা গবেষণার ক্ষেত্রে নতুন পথের সন্ধানে হাতড়ে বেড়ানোর চেষ্টায়। ইতিমধ্যে এক বছর লন্ডনে এবং হল্যান্ডে কাটানোর সুযোগ পেয়েছিলাম। ওলন্দাজ কোম্পানির দলিলপত্র আর একবার ঘাঁটাঘাঁটির সুযোগ পেলাম। সেই গবেষণার ফল অল্পবিস্তর পরে কেমব্রিজ ইকনমিক হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়ায় ব্যবহার করি।
ওই প্রকল্পটির জন্ম হয় কেমব্রিজ এবং কিছুকাল অক্সফোর্ডের অধ্যাপক জন গ্যালাঘারের চেষ্টায়। ধর্মা কুমার ওঁর ছাত্রী এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। জ্যাক তাঁর কাছে প্রস্তাবটা দেন। ধর্মাই একা কাজটা পেরে উঠবেন না ভেবে আমাকে সহ-সম্পাদক হতে বলেন। আমি প্রথম খণ্ডের জন্য সহ-সম্পাদক হতে ইরফান হাবিবকে অনুরোধ করি। উনি রাজি হন। সবই ভাল। শুধু এই প্রস্তাব মঞ্জুর হয় যত দূর মনে পড়ে ১৯৬৭ সনে। কিন্তু দুই খণ্ডের বিষয়তালিকা তৈরি এবং এক আন্তর্জাতিক ঐতিহাসিক গোষ্ঠীকে লিখতে রাজি করানো ছাড়া ১৯৭৩ সনে যখন আমি অক্সফোর্ড গেলাম তখন অবধি বই লেখার কাজ এক পা-ও এগোয়নি। ধর্মা ছিলেন চটপটে ছটফটে মানুষ। কোনও একটা কাজ হাতে নিলে সেটাকে যেনতেনপ্রকারেণ শেষ করা ওঁর স্বভাবগত ছিল। এর জন্য কাজের গুণগত ক্ষতি হলে উনি খুব মাথা ঘামাতেন না। আমার প্রকৃতি ঠিক উলটো। তার অন্যতম কারণ স্বভাবজাত আলস্য। কিন্তু শেষ অবধি আমাদের যৌথ প্রচেষ্টাগুলি মোটামুটি সফল হয়। এটা সত্যিই অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার।
গোলাকার গর্তে বসানো চতুষ্কোণ খুটির অবস্থা থেকে ত্রাণ পাওয়ার জন্য আমি এক দ্বিমুখী চেষ্টা শুরু করি। দেশে-বিদেশে কিছু কিছু চাকরির জন্য দরখাস্ত করতে আরম্ভ করি। এবং ঐতিহাসিক গবেষণার ক্ষেত্রে আমার সত্যিকার যাতে উৎসাহ, সেই বিষয় নিয়ে চিন্তা এবং পড়াশোনা আরম্ভ করি। বাহ্য ঘটনা বা বিগত যুগের জীবনযাত্রার পিছনে রয়েছে মানুষের মনোজগৎযা কিনা যুগে যুগে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতিতে বিভিন্ন। ইংরেজ ঐতিহাসিক ইয়াং বলেছিলেন—অতীত কখনওই বর্তমানের সঙ্গে মেলে না আর ইতিহাসের এক মূল প্রশ্ন হচ্ছে ভিন্ন যুগে বাস করার অভিজ্ঞতার প্রকৃত স্বরূপ কী? চল্লিশের দশকে ফরাসি ঐতিহাসিক লুসিয়া ফের মানুষের আবেগ, অনুভূতি, মনোভঙ্গির ইতিহাস নিয়ে গবেষণার প্রয়োজনীয়তা ঘোষণা করেন। তারও আগে ডাচ ঐতিহাসিকদের গুরুস্থানীয় হইসিংগা তাঁর মধ্যযুগের হেমন্তকাল শীর্ষক বইয়ে যুগে যুগে মানুষের অনুভূতির জগৎ কীভাবে আদ্যোপান্ত বদলে যায় তার আলেখ্য এঁকেছেন। তাঁর একটি উদাহরণ বিশেষ করে আমার মনকে নাড়া দিয়েছিল। চতুর্দশ শতকে নেদারল্যান্ডসের কোনও শহরের বাইরে তিনটি ডাকাতকে ফাঁসি দেওয়া হয়। দৃশ্যটি দেখে সবাই খুব হেসেছিল, কারণ লোক তিনটে ছিল নিতান্তই গরিব। পড়ে অবাক হয়ে ভেবেছিলাম, আজও প্রকাশ্যে ফাঁসি হলে ব্যাপারটা দেখতে ভিড় হওয়ার সম্ভাবনা খুবই, কিন্তু দৃশ্যটা দেখে কারও কি হাসি পাবে? আর দারিদ্র কি এখনও কারও কাছে কৌতুকের বস্তু? ফরাসি আনাল স্কুলের ঐতিহাসিকরা মানুষের ইন্দ্রিয়ানুভূতি নিয়েও গবেষণা শুরু করলেন। হোমার লিখেছেন মদিরাবর্ণ সমুদ্র—তার কারণ এই নয় যে, সমুদ্র তখন সত্যিতেই মদিরাবর্ণ ছিল। গ্রিকদের চেতনায় এবং অভিধানে মাত্র তিনটি রঙেরই উপস্থিতি চোখে পড়ে। মানুষের ঘ্রাণেন্দ্রিয়ও কোন গন্ধ কীভাবে পাবে তাও নির্ধারিত হয় সামাজিক সংস্কৃতির আলোকে। চতুর্দশ লুইয়ের রাজত্বে অভিজাতরা অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করতেন কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করবেন এবং সেই অনুযায়ী লক্ষ্যব্যক্তিকে লিখিত প্রস্তাব পাঠাতেন। (বিংশ শতাব্দীর দিল্লিতে বন্ধুত্ব করার ব্যাপারে অনুরূপ প্রবণতা চোখে পড়েছে, যদিও কথাটা লিখিতভাবে কেউ স্বীকার করবে না।)।
আমাদের নিজেদের সংস্কৃতিতেও কি তুলনীয় পরিবর্তন ঘটেছে? যোড়শ বা উনিশ শতকের বাঙালির জীবনানুভূতি কি আমাদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল? ইতিহাসের নজির থেকে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজব ঠিক করলাম। মনস্তত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, পরিবারের ইতিহাস, নারীবাদী তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, সভ্যতার বিকাশ নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা—দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তী যুগে আমার জিজ্ঞাস্য প্রশ্নের উত্তরগুলি নানা দেশের পরিপ্রেক্ষিতে নানা দিক থেকে আলোচনা হয়েছে। সেই বহুব্যাপী গবেষণার ফলগুলি নিয়ে আমি সত্তরের দশকে পড়াশোনা শুরু করি। বাঙালি জীবনের ইতিহাসে তার প্রত্যক্ষ প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে সত্যিকার কাজ শুরু করি আরও প্রায় দশ বছর পরে। শুধু ১৯৭২ সনে হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঙালির ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে এক আলোচনাচক্রে ঘোড়শ শতক থেকে উনিশ শতক অবধি বাঙালির পারিবারিক জীবনাদর্শ এবং নীতিবোধ নিয়ে একটি প্রবন্ধ পাঠ করি। লেখাটি র্যাচেল ফান বাউমার সম্পাদিত একটি সংকলনে প্রকাশিত হয়। ওই অকিঞ্চিৎকর লেখাটি সম্পূর্ণ অবহেলিত হয়নি। এটা আমার কৃতিত্ব নয়, সৌভাগ্য।
ষাটের দশকে শিক্ষক/গবেষক হিসেবে ইংল্যান্ড এবং আমেরিকার নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার যাতায়াত শুরু হয়। তার সূচনা রকফেলার ফাউন্ডেশনের একটি অনুদানের ফলে। ওই প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি চ্যাডবোর্ন গিলপ্যাট্রিক দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ দিনের জন্য এসে ঘাঁটি গাড়েন। তখন ভারতীয় প্রগতিবাদীরা মার্কিন প্রভাব সম্পর্কে অত্যন্ত স্পর্শকাতর, যে কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কেই মাঝে মাঝে সি.আই.এ-সি.আই.এ রব উঠত। চ্যাড সত্যিতেই এক সময় সি.আই.এ-র হয়ে কাজ করেছেন। তিনি দিল্লিতে প্রথম বক্তৃতায়ই আত্মপরিচয় দিতে গিয়ে কথাটা বলেন। যুদ্ধের সময় নিজের দেশের হয়ে গোয়েন্দাগিরি করা কিছু দোষের ব্যাপার ছিল না। কিন্তু ওই পরিচয়টি ওঁর নামের সঙ্গে লেগে রইল। প্রগতিবাদীরা রকফেলারের টাকা নিতে কুণ্ঠা করতেন না। কিন্তু নেওয়ার আগে বেশ ভাল করে শুকে দেখতেন—অনুদানে সি.আই.এর গন্ধ আছে কি না। আঁশটে গন্ধটা শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল রকফেলার ফাউন্ডেশনে না, এশিয়া ফাউন্ডেশনে, যার টাকা বিভিন্ন সময়ে আমরা সবাই নিয়েছি। দেখা গেল কমিউনিস্ট বিরোধী বৌদ্ধিক আন্দোলনগুলি এই পাপে ভীষণভাবে পাপী, কখনও সজ্ঞানে কখনও অজ্ঞানে। ভারত সরকার ফতোয়া দিলেন–যেসব প্রতিষ্ঠান এই দূষিত অর্থ গ্রহণ করেছেন, তাঁদের ওই টাকা আর নেওয়া চলবে না। তবে ঘাটতিটা ভারত সরকার পূরণ করবেন। কলকাতার একটি ঐতিহাসিক গবেষণাকেন্দ্র বিশেষ মার খেল। প্রগতিশীল ঐতিহাসিকরা হইহই করতে লাগলেন কারণ প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক প্রগতিশীল ছিলেন না, শুধুমাত্র ঐতিহাসিকই ছিলেন। ছোটখাটো নির্বিরোধী মানুষটি যে সি.আই.এ-এর লোক এ বিষয়ে কারও কোনও সন্দেহ রইল না।
এই প্রসঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কমনরুমে বসে সুনীতিবাবু একটি গল্প বলেন, সেটি প্রণিধানযোগ্য। এক ব্রাহ্মণপত্নী পাড়ার ছকু খানসামার সঙ্গে পলাতক। সন্ধ্যাবেলা ছকু প্রেয়সীকে চুম্বন করতে উদ্যত। শুদ্ধাচারিণী ব্রাহ্মণী আঁতকে উঠলেন। বললেন, ‘গেরন নেগেচে। খেতে নেই’। আমেরিকার আলিঙ্গন-চুম্বনে দীর্ঘদিন অভ্যস্ত ভারতীয় প্রগতিপন্থী বুদ্ধিজীবীরা হঠাৎ শুচিবায়ুগ্রস্ত হয়ে পড়ায় এই কাহিনির উত্থাপন। মিসেস রবিনসন আমাদের উপদেশ দিলেন, ‘পয়সার কোনও জাত নেই। যেখান থেকে পাবে সেখান থেকে নেবে। আদর্শের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা তো করছ না’। ছিঃ, এ কী কথা। আমরা আদর্শের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করব? শত্রুর কাছ থেকে টাকা নেওয়ার ব্যাপারে আমরা যেসব মহান প্রগতিবাদী ঐতিহাসিক আদর্শ আছে তার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হব। আর দিশি সরকার যদি অনুদান দেন, যেখানে প্রতিদানের কোনও প্রশ্ন নেই? আরে প্রতিক্রিয়াশীল হলেও ওরা তো আমাদের ঘরের লোক। সুযোগ পেলেই পুত্র কলত্র-আত্মীয়বন্ধু তুফায়লি গুফায়লি সব নিয়ে পাত পেতে বসে যাব। পাতাটি পরিষ্কার করে চেটেপুটে খেয়ে বড় বড় ছাঁদা বেঁধে নিয়ে বাড়ি ফিরব। এ ব্যাপারে বারেন্দ্র রাঢ়ী বৈদ্য কায়স্থ কারও কোনও দ্বিমত নেই। ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় যুগ যুগ জিও। ওই যে দাদু তুমি লিখেছিলে, না হয় ভারত স্বাধীন হোক, লুটে পুটে খাই। সেই ভবিষ্যদ্বাণী আমরা অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণ করছি। তুমি বেঁচে থাকলে আজ কত খুশি হতে।
ভারত-মার্কিন সাংস্কৃতিক সম্পর্কের কথায় ফিরে যাই। যেসব মার্কিন অনুদান সংস্থা আমাদের অনুদান দিত তারা সম্ভবত সবাই সি.আই.এ-এর হাতধরা ছিল না। তবে ভারতে প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে মার্কিনবিরোধী মনোভাব তখন বেশ প্রবল—বিশেষত ভিয়েতনামে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর। মার্কিন সংস্থাগুলি যে এই মনোভাবের প্রাবল্য কমাতে উৎসুক ছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এই নীতি অনুসরণ করে রকফেলার ফাউন্ডেশন কিছু ভারতীয় ঐতিহাসিককে বেছে নেয় এবং লন্ডনে স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ আর কতগুলি মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের দিয়ে গবেষণা আর পড়ানোর ব্যবস্থা করে। এই ব্যাপারে প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন চ্যাড গিলপ্যাট্রিক। এই অনুগৃহীত ঐতিহাসিকদের মধ্যে আমি একজন। কয়েকজন অতি সোচ্চার বামপন্থীও ওই তালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
এই পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি ১৯৬১ সনে এক বছরের জন্য লন্ডন যাই—স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ ( সোয়াস)-এ রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট হিসাবে। ওই বছরটি আমার জীবনে নানা কারণে স্মরণীয়। লন্ডনে ১৯৬১-র জুন মাসে আমার একমাত্র সন্তান সুকন্যা জন্মগ্রহণ করে। হল্যান্ড গিয়ে ওখানকার রাজকীয় নৃতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব এবং ভৌগোলিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে আমার অক্সফোর্ড থিসিসটি বই হিসেবে ছাপার ব্যবস্থা করি। ছাপান ওদেশের সবচেয়ে বিখ্যাত প্রকাশন সংস্থা মার্টিনুস নেইহফ। সোয়াস-এ তখন দোর্দণ্ডপ্রতাপ সি. এইচ. ফিলিপসের রাজত্ব। ওইখানে পরিচয় হল পরবর্তী কালের বিখ্যাত ঐতিহাসিক কীর্তিনারায়ণ চৌধুরীর সঙ্গে। কীর্তি নীরদ সি.র দ্বিতীয় পুত্র। আর কলকাতার পূর্বপরিচিত রণজিৎদা তখন ম্যাঞ্চেস্টারে একটি নামি ফেলোশিপ নিয়ে এসেছেন। লন্ডনে গবেষণা করতে এসে উনি আমার সঙ্গে একত্র ফ্ল্যাট ভাড়া নিলেন। যে রাত্রে মিডলসেক্স হাসপাতালে আমার কন্যা ভূমিষ্ঠ হয়, সেই রাতটা আমরা দুজনে হাসপাতালের বাইরে ফুটপাথে পায়চারি করে কাটাই। স্কুলে ব্যাশাম সাহেবের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়। উনি তখন বেশ বাংলা পড়তে ও বলতে শিখে গেছেন। বহু ভাষাভিজ্ঞ এই পণ্ডিত মানুষটির আকাশচুম্বী পাণ্ডিত্য এবং ভারতীয় ইতিহাসে গভীর সাহিত্যধর্মী অবদানের যে-সমাদর হওয়া উচিত ছিল তা হয়নি। যদি ভারতবর্ষ সম্পর্কে দশটি শ্রেষ্ঠ রচনার তালিকা করা হয় তবে সেই তালিকায় ব্যাশাম সাহেবের দা ওয়ান্ডার দ্যাট ওয়াজ ইন্ডিয়া উঁচুর দিকেই থাকবে। অন্তত আমার তাই ধারণা। মানুষটি ব্যক্তিগত জীবনেও সুখী ছিলেন না। ওঁর জীবনের একটি ইচ্ছা পূর্ণ হয়েছিল। কলকাতায় ওঁর মৃত্যু হয় এবং ওঁর ইচ্ছানুযায়ী উইলিয়াম জোনসের সমাধির পাশেই ওঁর দেহ কবরস্থ করা হয়।
সোয়াসে কাজ করার সময় একটি ঘটনা মনে পড়ে। এক সেমিনারে কীর্তি ভারত মহাসাগরে ইউরো-এশীয় বাণিজ্য নিয়ে তাঁর বিশাল গবেষণার পরিকল্পনা উন্মোচন করেন। কীর্তির তখনও ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করা হয়নি। ফিলিপস সাহেব মন্তব্য করলেন—এর থেকে ছোটখাটো সময়ের দিক থেকে সীমিত কোনও বিষয় ধরো। রণজিৎদা প্রতিবাদ করে বললেন—যে ব্যক্তি এত বড় পরিকল্পনা করার সাহস দেখিয়েছে তাকে উৎসাহ না দেওয়া অকর্তব্য হবে। শেষে রণজিৎদার মতটাই ঠিক প্রমাণ হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে একটা একদা গোপনীয় কথা বলি। অনেক বছর পরে কীর্তি ভারত মহাসাগরে নয় শতাব্দীব্যাপী ব্যবসার ইতিহাস লেখার এক প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবটা সম্পর্কে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস আমার মতামত জানতে চায়। আমি উত্তরে লিখি—যদি অন্য কেউ এই প্রস্তাব করত আমি বলতাম এটা মেগালোম্যানিয়াকের অলীক কল্পনা। কিন্তু প্রস্তাবক যেহেতু কীর্তি চৌধুরী, আমার মতে আপনারা চোখ বুজে ওটি মঞ্জুর করতে পারেন।
১৯৬১-৬২ সনে লন্ডনবাসের অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে আর একটি ঘটনার বিবরণ দিয়ে প্রসঙ্গান্তরে যাব। কয়েকদিন এক বন্ধুর ভাড়া করা ফ্ল্যাটে থেকে বাকি সময়টার জন্য ফ্ল্যাট খুঁজতে থাকি। লন্ডনের সবচেয়ে বড় হাউসিং এজেন্সির দ্বারস্থ হয়ে আমাদের সাধ্যে কুলায় এ রকম ফ্ল্যাটের একটি তালিকা পেলাম। সেই লিস্টে আটশো ফ্ল্যাটের বর্ণনা এবং ঠিকানা ছিল। খুঁটিয়ে পড়ে দেখলাম আটশোর মধ্যে মাত্র দুটি ফ্ল্যাটে সন্তানসন্ততি সহ অশ্বেত মানুষদের বাড়িওয়ালা ভাড়াটে হিসাবে নিতে প্রস্তুত। তার একটিতে গিয়ে দেখলাম ফ্ল্যাটটি কষ্টেসৃষ্টে ভূমিপৃষ্ঠে দাঁড়িয়ে আছে। কড়ি আগে পড়ে কিংবা দড়ি আগে হেঁড়ে অবস্থা। দ্বিতীয়টির মালিক জনৈক ভারতীয়। সেটি আরও সরেস। দিনের বেলায়ই বোঝা যায় ওটি গণিকালয়। তখনও রেস রিলেশনস আইন বিধিবদ্ধ হয়নি। তাই বাড়ি ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারে জাতিবৈর বিনা দ্বিধায় প্রকাশ করা যেত। শেষ অবধি লিস্টি দেখে বাড়ি জোগাড় করার চেষ্টা ছেড়ে দিই এবং বন্ধুদের সাহায্যে উত্তর ইলিংয়ে একটি বাড়ি জোটে। মালিক যুগোস্লাভ। তাঁর স্ত্রী ইংরেজ। বোধহয় বিদেশি বিয়ে করে ভদ্রমহিলার বিশ্বাস হয় যে ইংরেজ ছাড়া অন্য লোমহীন দ্বিপদরাও মনুষ্য নামক প্রজাতির অংশ। আজ যাঁরা বিলাতে জাতিবৈর নিয়ে চিন্তিত তাঁরা সম্ভবত ষাটের দশক অবধি মা কী ছিলেন সে কথা হয় জানেন না, নয়তো স্বেচ্ছায় বিস্মৃত হয়েছেন।
রকফেলারেরই কৃপায় ১৯৬৪ সনে আবার বিদেশমুখী হলাম। এবার গন্তব্য আমেরিকা। প্রথমে উত্তর ক্যারোলাইনার ডিউক বিশ্ববিদ্যালয় এবং তারপর বার্কলে। ডিউকের ইতিহাস বেশ বিচিত্র। স্থানীয় এক গরিব ছেলে তামাকু, বিশেষত সিগারেটের ব্যবসায় অনেক পয়সা করে নিজের নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা মনস্থ করে। অবশ্যি বিশ্ববিদ্যালয়টি নতুনই হতে হবে এমন না। শোনা যায় ভদ্রলোক প্রথম হার্ভার্ড এবং ইয়েলকে টাকাটা দিতে চান। শুধু সামান্য একটি শর্ত ছিল। গ্রহীতার নিজের নাম বদলে ডিউক নাম নিতে হবে। এই সামান্য শর্তটি কেউ মানতে রাজি না হওয়ায় ভদ্রলোক শেষটায় নিজের জন্মস্থান ডারহাম শহরেই নিজনামে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করলেন।
ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের তখন নানা কারণে রীতিমতো রমরমা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাড়িগুলি প্রতিষ্ঠাতার খ্রিস্ট ধর্মপ্রীতি বোঝানোর জন্য একটি বৃহৎ ক্রুশের আকারে সাজানো। আর তিনি যে সংস্কৃতিবান তার প্রমাণ বাড়িগুলি অক্সব্রিজের সব কলেজ যে-জাতীয় পাথরে তৈরি সেই ধরনের পাথরেই নির্মিত। কুলোকে বলত—পাথরগুলি এমনভাবে বাছা হয়েছে যে তাড়াতাড়ি ক্ষয়ে যাবে, যাতে প্রতিষ্ঠানটি রীতিমতো ভব্যিযুক্ত এবং বনেদি বলে লোকের ধারণা জন্মায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠাতার মূর্তি। তাঁর এক হাতে বাইবেল, অন্য হাতে সিগারেট—যথাক্রমে মহাপুরুষের আত্মিক ও বৈষয়িক মহিমার প্রতীক। যুদ্ধোত্তর যুগে আমেরিকায় ভারতীয় ইতিহাস ও রাজনীতি নিয়ে গবেষণার যাঁরা পথিকৃৎ, তাঁদের অন্যতম রবার্ট ক্রেন তখন ডিউকে দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের পরিচালক। উনি ভারতীয় বিপ্লবীদের নিয়ে গবেষণা করেছিলেন, কিন্তু সেই নিবন্ধ কখনও ছাপাননি। ওঁকে ঘিরে ভারতের ইতিহাস, সমাজ, রাজনীতি, ভাষা ইত্যাদি নানা বিষয়ে লব্ধপ্রতিষ্ঠ কিছু পণ্ডিত জড়ো হয়েছিলেন। কয়েক বছর পরে উনি সদলে সিরাকুস বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান।
ডিউকে পড়াতে ভাল লেগেছিল। তার প্রধান কারণ দেখলাম মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার ব্যাপারে স্নাতক হওয়ার আগেই তালিম শুরু হয়ে যায়। ছাত্রছাত্রীরা যেসব টার্ম পেপার লিখত অনেক সময়ই তা প্রকাশযোগ্য হত। এদের লেখা বেশ কয়েকটি টার্ম পেপার আমাদের পত্রিকায় ছাপিয়েছিলাম। বিলাতি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করার শিক্ষা হয়তো ওদেশে দুর্লভ। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে গবেষণাযোগ্য একটি বিষয় খুঁজে নেওয়া, তার জন্য গ্রন্থপঞ্জি তৈরি করা এবং বিষয় সম্পর্কে নতুন প্রশ্ন তোলার ব্যাপারে মার্কিনি শিক্ষার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া কঠিন।
মার্কিন সমাজ সম্বন্ধে আর একটি কথা বলা প্রয়োজন মনে করি। ইউরোপে অনেক সময়েই শুনি যে মার্কিনদের বন্ধুত্বে কোনও গভীরতা নেই, চোখের আড়াল হলেই সৌহার্দের সমাপ্তি। বিদেশে গিয়ে কেউ অন্তহীন গভীর বন্ধুত্বের খোঁজ করে কি না জানি না, কিন্তু মানুষে মানুষে যে সহজ সম্পর্ক শুধু ইংল্যান্ড না, ইউরোপের সংস্কৃতিগর্বী অনেক দেশেই দুর্লভ, আমেরিকায় তা বারেবারেই অপর্যাপ্ত পরিমাণে পেয়েছি। ডিউকে এক অধ্যাপকের বাড়ি আমরা ভাড়া নিয়েছিলাম। ভদ্রলোক ওই সময়টা ছুটিতে। বিকেলবেলা পাইনবনের ভিতর ওঁর সুন্দর বাড়িটিতে ঢুকে প্রথমেই চোখে পড়ল—টেবিলের উপর আমার তিন বছর বয়স্কা মেয়ের জন্য একটি খেলনা আর গৃহকর্তীর তৈরি একটি কেক রাখা। এই মার্কিন দম্পতির সঙ্গে আমাদের কখনও সাক্ষাৎ হয়নি। হলে ওদের সঙ্গে আমরা অচ্ছেদ্য বন্ধুত্বসূত্রে আবদ্ধ হতাম এমন মনে হয় না। কিন্তু অচেনা এক বিদেশি পরিবারের জন্য ওঁরা সামান্য যে-অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন তার সুখস্মৃতি এখনও আমাদের মনে সজীব আছে। প্রায় চার দশক ইংল্যান্ডে বাস করে এর সঙ্গে তুলনীয় শুভেচ্ছার দ্যোতক ব্যবহার আমাদের অভিজ্ঞতায় অল্পই পেয়েছি।
ডিউকে আমার ব্যবহারের জন্য যে-ঘরটি দেওয়া হয়েছিল তার এক দিকে বিরাট এক আয়না। পরে বুঝতে পারি ওই আয়নার ভিতর দিয়ে অন্য দিক থেকে ঘরের ভিতরকার সব কিছুই দেখা যায়। এই ঘরটি ফলিত মনস্তত্ত্ব বিভাগের গবেষণার জন্য ব্যবহার হত। যত দূর জানি আমি ওই গবেষণায় গিনিপিগ হিসাবে ব্যবহৃত হইনি। হলেও চিন্তার কারণ ছিল না। কারণ ওখানে বসবাসের সময় লজ্জাজনক কিছু করিনি।
ডিউকে আর একটি উল্লেখযোগ্য বিভাগ ছিল প্রেততত্ত্ব এবং মানুষের ইন্দ্রিয়াতীত সব অনুভূতি নিয়ে গবেষণার জন্য। এই আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে এক পণ্ডিত ব্যক্তি ভারতের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেতচর্চা বিভাগ খুলেছিলেন। তাঁর অন্যতম কীর্তি ভারতীয় ভূতের পরিসংখ্যান : আ সেন্সাস অফ ইন্ডিয়ান ভূতস। সে চার দশক আগের কথা। আমার ধারণা এত দিনে ভারতীয় ভূতের সংখ্যা বেশ কিছু বেড়েছে। দিনেদুপুরেও তাদের উৎপাতে আমাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত।
ডিউকে যখন পড়াচ্ছি তখন কাছাকাছি ল্যান্ড গ্রান্ট কলেজের এক অধ্যাপকের সঙ্গে পরিচয় হয়। বললেন, তিনি ওখানকার প্রফেসর আঁফ হর্স জাজিং। কী পড়ান এই প্রশ্নের উত্তরে বললেন, হর্স জাজিং ইয়ান্ড ইয়্যাডভান্সড হর্স জাজিং। অতি যুক্তিসম্মত উত্তর। শুনলাম ভদ্রলোক সে যুগেই বছরে আশি হাজার ডলার রোজগার করেন। অন্য অধ্যাপকদের তখনও মাইনে ত্রিশ হাজার সাধারণত ছাড়ায় না। শুনলাম ওঁর ছাত্রদের বাজারে বেজায় চাহিদা। হবেই তো! ঘোড়াতত্ত্ব বলে কথা।
ডিউকে এক সেমেস্টার পড়ানো শেষ হলে বার্কলেতে পড়াতে গেলাম। আমি দরিদ্র মানুষ। দেশে গাড়ি কেনার মতো রেস্ত ছিল না। কিন্তু আমেরিকার ছোট শহরে গাড়ি ছাড়া বাস করা কঠিন। তাই গাড়ি চালানো শিখতে এবং অল্প দামে দশ মালিকের হাত পার হওয়া এক ঢাউস গাড়ি কিনতে বাধ্য হলাম। আমার শকটচালনা-শিক্ষয়িত্ৰী সম্ভবত পরলোকে বিশ্বাসী ছিলেন। মোড় ঘুরবার আগে সব সময়ই সাবধানবাণী উচ্চারণ করতেন, থিংক অফ হোয়াট ইজ বিয়ন্ড। ফলে আমার আধ্যাত্মিক উন্নতি যথেষ্ট হয়েছিল সন্দেহ নেই কিন্তু গাড়ি চালানোর ব্যাপারটা কিছুটা কাঁচা থেকে যায়। আমার ধারণা ভদ্রমহিলার পুলিশের সঙ্গে কিছু যোগসাজস ছিল। তাঁরা এক চক্কর ঘুরিয়ে আমাকে লাইসেন্স দিয়ে দিলেন। যখন লাইসেন্স পেলাম তখন আমি গাড়ি চালাতে শিখেছি বললে খুবই অতিরঞ্জন হবে। ওই বিদ্যে নিয়ে আমেরিকায় গাড়ি চালিয়ে যে সপরিবারে বেঁচে ফিরেছি তা নিতান্তই গুরুকৃপায়।
শোনা যায় মায়ার বন্ধন এড়াবার জন্য শুকদেব মায়াধিষ্ঠিতে জগতি মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হতে চাইছিলেন না। অনেক বাবা-বাছা করে তাঁকে নামাতে হয়। তবে উনি পড়ুয়া ছেলে। মাতৃগর্ভে সময়টা নষ্ট করেননি। ক’বছরে বেদ-বেদান্ত ইত্যাদি ভারতীয় সংস্কৃতির থান থান কেতাবগুলি পিতার পাঠ শুনে মুখস্থ করে নিয়েছিলেন। আমেরিকানদের দেখে আমার ওই কাহিনিটি সম্পর্কে সন্দেহ নিরসন হয়। কারণ দেখলাম ওরা গাড়ি চালানো শিখে তারপর ভূমিষ্ঠ হয়। এবং তাদের ধারণা মনুষ্যমাত্রই জন্মসূত্রে ওই জ্ঞান নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, পাখির উড়তে জানার মতো। তাই যখন আমার মার্কিন বন্ধুদের জিজ্ঞেস করলাম আমার স্তরের পটুত্ব নিয়ে আমেরিকার পুব কুল থেকে পশ্চিম কূল পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা হঠকারিতা হবে কি না, তাঁরা সবাই এক বাক্যে বললেন, ‘আরে তুমি তো দিব্বি চালাচ্ছ। এতে ঘাবড়াবার কী আছে?’ বলে ম্যাপট্যাপ সব জোগাড় করে তার উপর সব লাল-নীল। দাগ কেটে পথটা যে সোজা আর সওয়া ঘণ্টার চেয়ে সামান্যই বেশি সময়সাপেক্ষ তা বেশ সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন। আর অজ্ঞানতিমিরান্ধ আমি সে কথা বেশ সোনামুখ করে মেনে নিলাম।
ডারহাম থেকে নিউ ইয়র্ক, নিউ ইয়র্ক থেকে বাফেলো, তারপর দক্ষিণমুখি গোঁত্তা মেরে পেনসিলভেনিয়ার একটি ছোট শহর ইন্ডিয়ানা (ইয়ার-সওগাতের উদ্দেশে), তারপর আরও দক্ষিণমুখি হয়ে আরিজোনার মরুভূমি, মনুমেন্ট ভ্যালি, গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ইত্যাদি দেখে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া হয়ে বার্কলে শহরে পৌঁছলাম। পথে বার তিনেক মৃত্যু কান ঘেঁষে বের হয়ে গেছে। একবার সত্তর মাইল স্পিডে চলতে চলতে উলটো দিক থেকে একই স্পিডে চলা গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা এড়াতে কষে ব্রেক দিই। গাড়ি এক লাফে পাশের খানায় পড়ল। কিন্তু খানাটি কাদা আর আগাছায় ভর্তি থাকায় গাড়ি ওলটাল না। আমার কন্যা ভাবলেন আমি স্বেচ্ছায় ভেলকি দেখিয়েছি। বলতে শুরু করল, ‘বাবা, আবার করো। আর একবার ঠিক দুপুরবেলা মরুভূমির ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য এক মোটেল থেকে আর এক মোটেল পর্যন্ত যাওয়া স্থির করি। পথটা পার হয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু ততক্ষণে ফ্লাস্কের জল টগবগ করে ফুটছে দেখলাম। আর আমার কন্যা গরমে প্রায় নেতিয়ে পড়েছে। আমারও নাভিশ্বাস উঠেছে। বাইরে তাপমান কী জানবার আর চেষ্টা করিনি।
গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন পৌঁছে এক অপ্রত্যাশিত মানবিক অভিজ্ঞতা হল। ক্যানিয়নে ট্যুরিস্টদের সুবিধের জন্য রীতিমতো এক গ্রাম বানিয়ে ফেলেছে। ছোট ছোট সব কাঠের তৈরি কুটির বা লগ কেবিন। আর খাওয়ার জন্য বিরাট ক্যান্টিন। আমাদের পাশের কুটিরে একটি মার্কিন পরিবার ঘাঁটি গেড়েছেন। আমেরিকার গভীর দক্ষিণ বা ডিপ সাউথের লোক এঁরা। মা আর দুটি দশ-বারো বছর বয়সের মেয়ে। মেয়েদের মাতৃভূমির স্বরূপ দেখাতে একটি বিশাল গাড়ি নিয়ে মা এক মাস ধরে ঘুরছেন। সঙ্গে পোষা ল্যাব্রাডরটিও আছে। সরল প্রকৃতির মহিলাটির সঙ্গে সহজেই খুব ভাব হয়ে গেল। মা-মেয়েরা আমার স্ত্রীর শাড়ি গায়ে জড়িয়ে মহা ফুর্তিতে ছবি তোলালেন। সারা সময়টাই প্রায় এক সঙ্গে কাটল। যাবার দিন মহিলার চোখে জল। বললেন, এই এক মাস পর তোমাদের সঙ্গে কথা বলে বাঁচলাম। তোমাদের সঙ্গে সাক্ষাতের আগে এবার বেড়াতে বের হয়ে একটিও প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়নি। কথা বলার লোক খালি এই দুটো বাচ্চা, কুকুরটা আর যত সব নিগার।—দা ওনলি পিপল আই কুড় টক টু ওয়্যার দা কি, দা ডগি অ্যান্ড নিগারস। নট ওয়ান অ্যাডালট হিউম্যান বিয়িং।শুনে বড় আহ্লাদ হল–আমরা মনুষ্য প্রজাতির অংশ, দেহবর্ণ কালো না, বাদামি, তাই নিগার বা অ-মানুষ না।
ওই তিন সপ্তাহের ভ্রমণের সময় আমার আর একটি মূল্যবান অভিজ্ঞতা হয়। মনুমেন্ট ভ্যালিতে যখন পৌঁছলাম, মনে হল চন্দ্রলোক বা অন্য কোনও গ্রহান্তরে এসেছি। এই বিশাল বিশ্বপ্রকৃতিতে আমাদের অকিঞ্চনতা হঠাৎ যেন বুদ্ধি দিয়ে বোঝর স্তর ছাড়িয়ে গভীরভাবে উপলব্ধি করলাম। চেতনায় আরও একটি ছোট বিপ্লব ঘটল। আমরা যে নভোস্থিত কোনও করুণাময় ঈশ্বরের আশ্রয়ে নেই, মানুষ এবং জীবলোকের অন্তহীন জ্বালা-যন্ত্রণা দেখে এই বিশ্বাস অনেকদিন আগেই জন্মেছে। কিন্তু সৃষ্টিকর্মের পিছনে কি কোনও বুদ্ধিপ্রণোদিত পরিকল্পনা আছে? যে-পরিকল্পনায় এই ক্ষুদ্র গ্রহটির মুষ্টিমেয় স্বল্পপ্রাণ জীবের ভালমন্দ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি? মনুমেন্ট ভ্যালিতে দেখলাম লক্ষ লক্ষ বছরের অবক্ষয়ের ফলে এক একটি পাহাড় মানুষের হাতে তৈরি মূর্তি বা সৌধের রূপ নিয়েছে। কোনওটার চেহারা হিন্দু মন্দিরের, কোনওটা ঠিক হাতির মতো দেখতে। মনে হল—এই অবিশ্বাস্য ঘটনা যদি নেহাতই প্রকৃতির খামখেয়ালে হতে পারে, কোনও ইন্টেলিজেন্ট প্ল্যানিংয়ের অপেক্ষা না করে, তবে বিশ্বপ্রকৃতিও একই ভাবে জন্ম এবং পরিবর্তনের পথে গিয়ে ধ্বংসের দিকে অনিবার্য বেগে চলতে পারে। কোনও স্রষ্টা কল্পনার প্রয়োজন নেই। বুদ্ধি না, উপলব্ধির স্তরে যেন একটা সমস্যার সমাধান পেলাম। চেতনার গভীরে স্রষ্টাহীন ব্রহ্মাণ্ডকাণ্ডের সংবাদ পৌঁছনোয় এক গভীর ভাষাতীত শান্তি অনুভব করলাম। সহায়হীন সান্ত্বনাহীন জীবজীবনের আমি অংশীদার, অসীম বিশ্বপ্রকৃতির একটি বালুকণা, জন্মমুহূর্তে মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে দুঃখসুখ অনির্বচনীয় আনন্দের অভিজ্ঞতায় চেতনার পাত্র পূর্ণ করে অনিবার্যবেগে সেই চেতনারই বিনষ্টির দিকে এগিয়ে চলেছি। কিন্তু বহু রত্নখচিত সেই চেতনা। স্বল্পায়ু এই মূল্যাতীত উত্তরাধিকারের পূর্ণতায়ই মানবজীবনের সার্থকতা। তার বাইরে অর্থ খুঁজে বেড়ানো নিতান্তই অর্থহীন। কীসে ভয় আমার, কাকে ভয়? প্রকৃতি আমার ললাটে ভয়হীনতার জয়মালা, গলায় প্রসূন হার পরিয়ে দিয়েছে। আমি মনুর সন্তান। সেই অসামান্য সৌভাগ্যের উদ্ধত গর্বে জীবন উত্তরণ করে চেতনাহীনতার রাজ্যে চলে যাব। এই নিষ্করুণ মরুপ্রকৃতি আমাকে সাহসের মন্ত্রে দীক্ষা দিল। কোন ভীরুকে ভয় দেখাবি? আঁধার তোমার সবই মিছে।
বার্কলে পৌঁছনোর পর আমেরিকায় আর গাড়ি চালাইনি। দু-তিনবার প্রাণঘাতী অ্যাকসিডেন্টের হাত থেকে নেহাতই গুরুকৃপায় বেঁচে যাই। তারপর আর স্টিয়ারিং হুইলে হাত দিতে উৎসাহ পাইনি।
১৯৬৪ সন আমেরিকার জনজীবনে গৌরবের বছর। সিভিল রাইটস আন্দোলনের মাহেন্দ্রক্ষণ। আমরা যখন ডারহামে তখন ওই শহরেরই এক বর্ণবৈষম্যবাদী ব্যবসায়ী এক তরুণ অহিংস সত্যাগ্রহীকে গলায় ব্লিচিং পাউডার ঢেলে দেওয়ায় ছেলেটির মৃত্যু হয়। অপরাধীর কোনও শাস্তি হয়েছে বলে শুনিনি। বার্কলে তো প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের রাজধানী বললেই চলে। জোন বায়েজ তখন ওখানকার ছাত্রী। একদিন দেখলাম ক্যাম্পাসের চত্বরে গিটার বাজিয়ে গাইছেন, উই শ্যাল ওভারকাম-সাম ডে। মনে হল যেন সুর, ভাষা আর আবেগের স্রোতে মেয়েটি আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে গেল। ভাবলাম তোমার কথা সত্যি হোক। সারা দুনিয়ার অত্যাচারিত মানুষের মুক্তির পথ তোমরা যেন খুলে দিতে পার।
স্বাধীনতার লড়াই সব দেশেই মাঝে মাঝে বিচিত্র রূপ নেয়। শুনেছি ভারতবর্ষে কিছু দেশপ্রেমিক ত্রিশের দশকে রাস্তায় সার দিয়ে বসে পাঁচ আইন অমান্য আন্দোলন করেছিলেন। এই বিদ্রোহে আইনের সুদীর্ঘ হস্তও নাকি মাঝপথে থমকে থেমে গিয়েছিল। পঞ্চাশজন প্রস্রাব-সত্যাগ্রহীকে গ্রেফতার করে সরকার সকলের হাস্যাস্পদ হতে চাননি। সম্ভবত কাহিনিটি কল্পিত। বার্কলে ক্যাম্পাসে তখন রাখ-ঢাক না রেখে কথা বলার আন্দোলন প্রবলভাবে চলছে। এক দিন ক্লাস থেকে বের হচ্ছি, একটি মেয়ে মুখের সামনে একটা প্ল্যাকার্ড তুলে ধরল। তাতে প্রজননঘটিত ইংরেজি চার অক্ষরের কথাটি লেখা আছে। মেয়েটিকে বললাম, দ্যাখো বাছা, কথাটা আমার অজানা না। কর্মটিও সম্পূর্ণ অপরিচিত বললে মিথ্যাচার হবে। একটা কথা বলি শোনো। ডি এইচ লরেন্স পড়ে দ্যাখো। ব্যাপারটা পবিত্র, জীবজীবনের মূল্যাতীত আনন্দের আধার। খিস্তিখেউড়ের বিষয় নয়। ওতে–মন নোংরা না হলে, ডার্টি কিছু নেই। ওটাকে নর্দমায় নামিয়ে অকারণে নোংরা কোরো না। মেয়েটি কিছু না বলে চলে গেল। কী বুঝল সেই জানে!
তখন গ্রীষ্মকাল। কিছু কিছু ছেলেমেয়ে স্নানের পোশাক পরে সার্ফ বোর্ড হাতে ক্লাসে আসত। মানে বক্তৃতা শেষ হলেই সমুদ্রস্নানে যাবে। যদি বলি বিকিনি পরিহিতা সুন্দরীদের উপস্থিতি হৃদয়ে কখনও কোনও চাঞ্চল্য ঘটায়নি তা হলে সত্যের অপলাপ হবে। কিন্তু যে দৃশ্যে সত্যিতে পড়ানোর ব্যাঘাত ঘটে সে অন্য স্তরের জিনিস। এক দিন ক্লাসে ঢুকে দেখি বেঞ্চিগুলির সামনে চিত হয়ে শুয়ে দুই বালক কটা গ্যাসের বেলুন নিয়ে খেলছে। বেলুনগুলি এক একবার সিলিং অবধি উঠে যাচ্ছে, আবার সুতো টেনে তাদের আমার নাকের সামনে নামানো হচ্ছে। মাস্টার খ্যাপানোর নানা ফিকির কলকাতার ছেলেদের জানা আছে। ক্যালিফোর্নিয়ায় ও বস্তুর সাক্ষাৎ পাব ভাবিনি। সাহস করে প্রশ্ন করলাম, ‘হচ্ছেটা কী?’ সহজ সরল উত্তর, উই আর ডুয়িং আওয়ার ওন থিং।মানে ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রশ্ন আর কি। বললাম, দ্যাখো বাছারা, আমারও যে এখানে একটা ‘ওন থিং’ করার আছে। তোমাদের ওন থিং আর আমার ওন থিং তো একসঙ্গে চলা মুশকিল। বিস্মিত প্রশ্ন, ‘ও! তোমার বুঝি অসুবিধে হচ্ছে?’ ঘাড় চুলকে বললাম, তা অল্পবিস্তর…। দেখলাম ছোঁড়ারা পরশুরামের বাটলোর মতোই বিনয়ী। সেই যে বন্ধুর বাবাকে বলেছিল, আমরা কী করি না করি তাহাতে আপনার পিতার কী? না, এরা শুধু নিজের না, সকলের ব্যক্তিস্বাধীনতাই শ্রদ্ধার চোখে দ্যাখে। বেলুন গুটিয়ে নিয়ে ‘সরি’ বলে তারা নিষ্ক্রান্ত হল। বোধ হয় অন্যত্র কোথাও গিয়ে ওদের ওন থিংয়ের অকুস্থল বসাল।
আর একদিন একটি স্নাতকোত্তর ছাত্রর সঙ্গে কফি হাউসে সাক্ষাতের কথা ছিল। ছেলেটি যথা সময়েই এল। মুখ একটু বিবর্ণ। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার কি শরীর খারাপ?’ একটু মুখ ভেটকে বলল, ‘না, তা ঠিক না। দশ ডলার বাজি ধরে একটা জ্যান্ত টিকটিকি গিলে খেয়েছি। ওটা পেটের ভিতর লাফালাফি করছে।’ শৈশবে শুনেছি কাশীধাম ভূমণ্ডলের অন্তর্গত নয়। শিবের ত্রিশুলের উপর দাঁড়িয়ে আছে। বার্কলেতে তিন মাস পড়িয়ে আমার ধারণা হল যে ক্যালিফোর্নিয়াও ভূমণ্ডলের বাইরে, তবে কার কোন আয়ুধের উপর কীভাবে ভারসাম্য রক্ষা করছে, বলতে পারব না। যত দূর জানি, পৃথিবীর আর কোনও অঞ্চলের মানুষ বাজি ধরে টিকটিকি গেলে না। আর একদিন এক বন্ধুর খোঁজে এক অ্যাপার্টমেন্ট হাউসে গিয়েছি। ফ্ল্যাটটা খুঁজে না পেয়ে এক অচেনা লোকের দরজায় কড়া নাড়লাম। দরজা খুললেন এক সম্পূর্ণ উদোম নাঙ্গাবাবা। কোনওমতে তাঁর হাত থেকে পরিত্রাণ পেয়ে দরজায় আঁটা নেমপ্লেটটা পড়লাম—জিম স্মিথ, ওয়ারলক। মানে বাবাজি জাতে ডান, এবং ডান বা ডাকিনীরা দিগম্বর থাকেন। এ তথ্যও ক্যালিফোর্নিয়ার বাইরে কোথায় আমার চেতনাগোচর হত?
বার্কলেতে ভারতীয় ইতিহাসের ক্ষেত্রে গবেষণারত আরও কিছু মার্কিন সহকর্মীর সঙ্গে পরিচয় ঘটল। টম মেটকাফ এবং তখন তাঁর ছাত্রী, পরে পত্নী, বারবারা তখন বার্কলেতে যথাক্রমে মাস্টার ও ছাত্রী। পরে বারবারার খ্যাতি উর্দু সাহিত্য এবং দেওবন্দ আন্দোলন নিয়ে গবেষণায়। ওঁরা বিয়ে করেন দিল্লি এসে। আমাকে কন্যা সম্প্রদান করতে অনুরোধ করায় সানন্দে রাজি হয়েছিলাম। টমকে আমার কন্যা ডাকতেন আঙ্কল টমেস। তখন লীলা রায়ের একটি গল্প ওর খুব মনে ধরেছিল। তার অন্যতম বক্তব্য মোটাদের বলা হয় বিশকম্বল আর রোগাদের কানাই। কন্যা বলতেন, ‘আঙ্কল টমস কানাই আর অর্জুনকাকা বিশকম্বল’। অর্জুন অত কিছু বিশকম্বল ছিলেন না, তবে টমেস নিতান্তই কানাই।
দক্ষিণ ভারতের ঐতিহাসিক বার্ট স্টাইন, গুন্টুর জেলার বিখ্যাত ইতিহাসের রচয়িতা ফ্রিকেনবার্গ—এঁদের সকলের সঙ্গে এক সেমিনার উপলক্ষে পরিচয় হয়। বিষয় ল্যান্ড কন্ট্রোল ইন ইন্ডিয়া। আমি জমিদারিপ্রথা সম্বন্ধে বাল্যস্মৃতির ভিত্তিতে একটি প্রবন্ধ পড়ি। রণজিৎদা প্রবন্ধটি পড়ে খুব ঠাট্টা করেছিলেন। আমার লেখাটা ঠিক অতটা হাস্যকর লাগেনি। স্মৃতিভিত্তিক অনুরূপ লেখা ইংরেজি ভাষায় আর চোখে পড়েনি। তখন ভারতীয় ইতিহাসে জমিদারিপ্রথা নিয়ে আলোচনা খুব সরগরম। ফলে লেখাটি অকিঞ্চিৎকর বলে অবহেলিত হয়নি।
আনুষ্ঠানিকভাবে পড়াবার নেমন্তন্ন পেয়ে আবার আমেরিকা যাই ১৯৬৯-৭০ সনে। এবার গন্তব্য পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং হার্ভার্ড। ফলে আমি বেশ উত্তেজিত। পেনসিলভেনিয়ায় আমাকে যে ঘরটি দেওয়া হল সে ঘরটি আদতে বিখ্যাত ঐতিহাসিক হোল্ডেন ফার্বারের। তখন ঘোর শীত। ফলে জুতার উপর অধিজুতা মানে ওভার শু পরতে হত। কথাটা মনে পড়ল এই জন্য যে ওই ঢাউস জুতাজোড়া গাফিলতি করে ফার্বারের ঘরের এক কোনায় ফেলে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম ওটা কারও আর নজরে পড়বে না। কিন্তু ফার্বার ছিলেন সেকেলে মানুষ, সর্ব ব্যাপারে নিয়মনিষ্ঠ। আমি যখন হার্ভার্ডে পড়াচ্ছি, তখন একদিন কৌশলী হাতে সুন্দরভাবে প্যাক করা সেই জীর্ণ জুতাজোড়া আমার দফতরে পৌঁছল। বেয়াদবির জন্য ফার্বারকে ফোন করে অনেক ক্ষমাপ্রার্থনা করলাম। সদাশিব মানুষটি ব্যাপারটায় আমার দোষের কিছু পেয়েছেন এমন মনে হল না।
পেনসিলভেনিয়ায় ফিলাডেলফিয়া শহরের বাইরে একটি সুন্দর সাবার্ব অর্থাৎ শহরতলি, মফস্বল শহরে থাকতাম। নাম সোয়াৰ্থমোর। ট্রেনে আসাযাওয়া করতে হত। এ যাত্রা আর গাড়ি কিনিনি। বাড়ি থেকে স্টেশন পর্যন্ত পায়ে হেঁটে যেতাম। আমেরিকায় এমন কাজ হতদরিদ্র লোকেও করে না। আসলে ওই জাতীয় সমৃদ্ধ ছোট শহরে হতদরিদ্র লোক অল্পই থাকে। আমাদের বাড়ির ঝাড়পোঁছ করতে যে কালো মেয়েটি আসত, তারও একখানা গাড়ি ছিল। প্রায় প্রতি পরিবারেই এক বা একাধিক গাড়ি থাকায় রাস্তাঘাটে পদচারীর জন্য সুযোগ-সুবিধে প্রায় নেই বললেই চলে। রাস্তার পাশে ফুটপাত বলতে কিছুই ছিল না। কিন্তু ওই সমৃদ্ধ দেশের মফস্বল শহরে যে-বিদেশি পায়ে হেঁটে যায়, তার প্রতি সকলের অন্তহীন করুণা। ফলে রাস্তায় পা দিলেই কেউ-না-কেউ গাড়িতে তুলে নিত।
পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়টি ফিলাডেলফিয়া শহরের মাঝখানে অর্থাৎ দারিদ্রপীড়িত কালো মানুষ-অধ্যুষিত সিটি সেন্টারে। পৃথিবীর সমৃদ্ধতম দেশে দারিদ্রর চেহারা যে কী ভয়াবহ হতে পারে, বিশ্ববিদ্যালয় যেতে-আসতে তার কিছু আঁচ পেতাম। দারিদ্র আর অপরাধপ্রবণতার সহজ সমীকরণ করা চলে না। কিন্তু পেনসিলভেনিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চলে নৃশংস অপরাধ প্রায়ই ঘটত। আমরা ওখানে থাকাকালীনই ক্যাম্পাস অঞ্চলে একটি খুন এবং একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। আমার নিজের একটি মারাত্মক অভিজ্ঞতার মর্মার্থ ঘটনাটি ঘটার সময় আমি বুঝতে পারিনি। ট্রেনে চেপে শহরে আসছি, মাঝপথে দশ বারো বছর বয়সের একটি কালো ছেলে ট্রেনে উঠল। তার সর্বশরীর থেকে তীব্র মদের গন্ধ আসছে। আর তার কোমরের বেল্টে ধারালো একটি ছুরি গোঁজা। ট্রেনের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কী যেন বিড়বিড় করে বলতে লাগল। দেখলাম যাত্রীরা সবাই তটস্থ। এবং অনেকেই মাঝে মাঝে আড়চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে। হঠাৎ একটা স্টেশনে গাড়ি থামতে ছেলেটা নেমে গেল। আমার পাশের যাত্রীটি আমাকে বললেন, খুব বেঁচে গেছ। কেন জানি না, তুমি ছেলেটার বিরক্তির কারণ হয়েছিলে। ও দাঁত কিড়মিড় করছিল আর খালিই বলছিল যে তোমাকে খুন করবে। আমরা সবাই আশঙ্কা করছিলাম, যে-কোনও মূহুর্তে ও তোমাকে ছুরি মারবে। খুবই বেঁচে গেছ। এরকম কিছু ঘটলে আজকাল কেউ আর কাউকে বাঁচাবার চেষ্টা করে না। নির্বাক বিস্ময়ে শুনে গেলাম।
পেনসিলভেনিয়ায় আমাকে ডাকার পেছনে একটা উদ্দেশ্য ছিল। হোন্ডেন ফার্বার তার দু-এক বছরের মধ্যেই অবসর নেবেন। তাঁর শূন্য আসনে কে বসবে তার জন্য খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে গিয়েছিল। ভাল লোক না বসাতে পারলে দক্ষিণ এশিয়া বিভাগটি তুলে দেওয়ার আশঙ্কা। ভিয়েতনাম যুদ্ধে খরচার চাপে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে অত্যাবশ্যক বিষয় ছাড়া সব বিভাগেই কাটছাঁট শুরু হয়েছে। প্রসঙ্গত বলি, পেনসিলভেনিয়ায় পড়াতে গিয়ে বেশ কটি ভিয়েতনাম ভেটেরান মানে যেসব যুবক ওখানে লড়াই করে এসেছে তাদের সঙ্গে পরিচয় হয়। একটি আমার ছাত্র ছিল। ওদের বড় ভাল লাগত। জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে এদের দৃষ্টি স্বচ্ছ, প্রায় আবেগমুক্ত। যেটুকু আবেগ অবশিষ্ট আছে, তা কিন্তু গভীর করুণায় সমৃদ্ধ। মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখে এরা মানুষকে ভালবাসতে শিখেছে। যে গভীর ভণ্ডামির ভিত্তিতে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি মুক্তিকামীর ভূমিকায় যুদ্ধে নামে, তার প্রতি এদের অবজ্ঞার শেষ নেই। এরাই গণ-আন্দোলন করে মার্কিন সরকারকে শেষ অবধি ভিয়েতনাম থেকে সরে আসতে বাধ্য করে। আমার ভিয়েতনাম ভেটেরান ছাত্রটি দক্ষিণ এশিয়া সম্পর্কে পড়াশোনা করে বেশ উঁচুমানের ডিগ্রি নিয়েই পাস করে বের হয়। কিন্তু ভারতবিদ্যার বাজারদর তখন প্রায় শূন্যের কোঠায়। শুনলাম ছেলেটি ট্যাক্সি চালিয়ে পয়সা রোজগার করছে।
মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে সরকারি-বেসরকারি অনুদান অন্তত সেই সময়ে রাষ্ট্রের তাৎক্ষণিক স্বার্থের অনুগামী ছিল। সেই কারণেই যুদ্ধের পর বেশ কিছু বছর ভারত-পাকিস্তান উপমহাদেশ নিয়ে পঠন-পাঠনে বেশ ভোলা হাতে টাকা ঢালা হয়। কিন্তু নেহরুর নিরপেক্ষতা এবং উন্নয়ন নীতি মার্কিন কর্তাদের মন-পসন্দ ছিল না। ফলে ওদের দক্ষিণ এশিয়া সংক্রান্ত বৈদেশিক নীতির এবং সঙ্গে সঙ্গে ওই বিষয়ে পড়াশোনার ক্ষেত্রে অনুদানের মোড়ও ঘুরতে থাকে। পঁচিশ-ছাব্বিশটা বড়-মেজ মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতচর্চা হত। তারা সবাই বেশ সন্ত্রস্ত। পেনসিলভেনিয়ায় আমার আমন্ত্রণ কতকটা এইসব কারণে। যাবার দিন কাছে এলে ওদেশে ভারতচর্চার অন্যতর পথিকৃৎ, এক সময়ে এশিয়া ফাউন্ডেশনের অধিকর্তা, রিচার্ড পার্ক আমার জন্য এক পার্টি দিলেন। সেই পার্টিতে চায়ের কাপ হাতে উনি এক সময় আমাকে আড়ালে নিয়ে গেলেন। বললেন, ‘বছর দুই পরে হোভেনের জায়গায় আমরা লোক নেব। ইন্টারেস্টেড?’আমি উত্তরে বললাম, ‘হ্যাঁ, খুবই।’ পার্কস বললেন, তোমার বক্তব্য শুনলাম। লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার। মনে রাখব। এখনই এটাকে চাকরির অফার বলে ধরে নিয়ো না। সার্চ কমিটি বসবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে যদিও দশ বাঁও জল, তুমি রাজি থাকলে তোমাকে আনতে আমাদের অসুবিধে হবে না বলেই আমাদের বিশ্বাস। বছর দুই পরে সত্যিই পেনসিলভেনিয়া থেকে চিঠি পাই। কিন্তু তার অল্প আগেই আমি অক্সফোর্ডের চাকরিটি পেয়েছি। মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর লোভ ছিল। তাই ওদের লিখি—তোমরা যদি বছরের কিছুটা সময় পেনসিলভেনিয়ায় পড়াই আর বাকি সময়টা অক্সফোর্ডে–এরকম ব্যবস্থায় রাজি থাকো, তাহলে অক্সফোর্ডকে বলে দেখতে পারি। এ প্রস্তাবে ওঁরা রাজি হলেন না। জানলাম–বিভাগটিকে বাঁচাতে হলে সারা বছরের লোক ওদের একান্ত প্রয়োজন। আমার ধারণা—অক্সফোর্ডে রিডারশিপকে ওদের চেয়ারের চেয়ে বেশি মূল্য দেওয়ায়, ওঁরা একটু ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন। কিন্তু ব্যাপারটা দোষের হয়ে থাকলে, এ দোষে অনেকেই দোষী, সে কথা কারও অজানা না।
১৯৭০ সনের গোড়ায় এক সেমেস্টারের জন্য হার্ভার্ডে পড়াতে যাই। ওদের বিখ্যাত ওয়াইডনার লাইব্রেরি ভবনে একটি ঘর অফিস হিসাবে আমাকে দেওয়া হয়। এই বাড়িতে ঘর পাওয়ার সুবিধে হল, লাইব্রেরির স্ট্যাকে সর্বত্র ইচ্ছেমতো চরে বেড়ানো যায়। এটা কোনও গবেষকের পক্ষে যে কী অবিশ্বাস্য সুযোগ তা যার অভিজ্ঞতা হয়নি তাকে বোঝানো প্রায় অসম্ভব। হার্ভার্ডে আরও একটি ব্যাপারে কপাল খুলল। গিয়ে শুনলাম ঘরটা আমার আর একজন ভিজিটিং স্কলারের সঙ্গে ভাগে ব্যবহার করতে হবে। শুনে বিরক্তই লেগেছিল। যখন ভাগীদার ভদ্রলোকের নাম শুনলাম, তখন আমার প্রায় উলটে যাবার অবস্থা। কারণ তিনি আর কেউ নন—অক্সফোর্ডের সেন্ট অ্যান্টনি কলেজের ফেলো উনিশ এবং বিশ শতকে ফ্রান্সের সামাজিক ইতিহাস বিষয়ে জগজ্জয়ী পণ্ডিত থিওডর জেলডিন। শুনেছি পাণিনি-বিশারদ মহাপণ্ডিত সকলনারায়ণ শাস্ত্রীকে চাকরি দেওয়ার আগে স্যার আশুতোষ তাঁর পাণ্ডিত্যের প্রমাণ জানতে চেয়েছিলেন। শাস্ত্রীমশায় সরল ভাষায় জানান, মুদ্রিত সকলই পড়িয়াছি। অমুদ্রিত্ যাহা পাইয়াছি তাহা পড়িয়াছি। থিওডরের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর মনে হল-এই ব্যক্তিও মুদ্রিত সকলই পড়িয়াছেন।
ইতিহাসচর্চার ব্যাপারে জেলডিন কোনও বাঁধা পথের পথিক নন। ওঁর বিখ্যাত ফ্রান্সের ইতিহাসের প্রথম খণ্ডের সাব-টাইটেল— ‘লাভ, পলিটিক্স, অ্যামবিশন’। অর্থাৎ ওঁর ধারণা—ফ্রান্সের সমাজজীবনে ওই তিনটি কাম্য বস্তুতেই মূল সূত্রের সন্ধান পাওয়া যাবে এবং সেই সূত্র ধরেই উনি ওঁর বিশ্লেষণ এবং ধারাবিবরণী বিস্তার করেছেন। ওঁর পরবর্তী কাজ আরও বিস্ময়কর। একটি কাল্পনিক চরিত্রকে ঘিরে উনি মানুষের সুখের সন্ধানের ইতিহাস লিখেছেন। তাঁর পরবর্তী বই ‘ইন্টিমেট হিষ্ট্রি অফ ম্যানকাইন্ড’। নানা দেশের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মানুষের অন্তরঙ্গ জীবনের ইতিহাস, মানুষে মানুষে সম্পর্কের তথা আদানপ্রদানের ইতিহাস লেখার চেষ্টা করেছেন এই বইয়ে। এক ঘরে দু’জনের দফতর হওয়ায় মানুষটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় হল। ১৯৭৩ সনে যখন অক্সফোর্ডে পড়াতে গেলাম, তখন আমার ফেলোশিপটা হয় সেন্ট অ্যান্টনিস কলেজে। জেলডিনও ওখানকার ফেলো। অক্সফোর্ডে যে-অল্পসংখ্যক সহকর্মীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়, জেলডিন তাঁদের অন্যতম। ওঁর কাজের প্রভাব আমার চিন্তায় পড়েছে। তবে খুব প্রত্যক্ষভাবে না। ওঁর কাজ এতই বাঁধা রাস্তার বাইরে যে ওঁকে অনুকরণ করার প্রশ্ন ওঠে না।
হার্ভার্ডে তিন মাস পড়িয়ে একটা কথাই মনে হয়েছিল। আমেরিকার বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেও স্নাতকোত্তর স্তরে পৌঁছবার আগের অর্থাৎ আন্ডারগ্র্যাজুয়েট শিক্ষার যে ব্যবস্থা তার নির্দিষ্ট মান কিছু আছে কি না বোঝা মুশকিল। এমনকী ডক্টরেট করার আগে যে কতকগুলি বিষয় পড়ে লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষা দিতে হয়, তারও খুব বাঁধাধরা মান নেই। ভারতবর্ষের ইতিহাস নিয়ে কাজ করছেন এমন এক ছাত্রীর মৌখিক পরীক্ষা নিয়েছিলাম—পরীক্ষক বোর্ডের অন্যতর সভ্য হিসেবে। প্রশ্নের উত্তর শুনে মনে হল–মেয়েটি বুদ্ধিমতী বটে, কিন্তু পড়াশোনা কিছুই করেনি। কি( ওখানকার পরীক্ষকদের নির্বন্ধাতিশয্যে তাকে উঁচু নম্বরই দিতে হল। আন্ডারগ্র্যাজুয়েট স্তরে ইচ্ছে করলে অনেক কিছুই শেখা যায়। এমনকী অখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়েও। কিন্তু কিছু না শিখলেও ডিগ্রি পেতে খুব অসুবিধে হয় না। তবে বেশ কিছু পড়াশোনা না শিখে ডক্টরেট পাওয়ার উপায় নেই। সাধারণভাবে বলা চলে ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় ওখানে শিক্ষাব্যবস্থায় স্বাধীনতা অনেক বেশি। হার্ভার্ডের সঙ্গে অন্য মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ব্যাপারেই বেশ তফাত দেখলাম। এর আগে যেসব জায়গায় পড়িয়েছি, সেখানে দেখেছি সামাজিক আবহাওয়া বেশ সহজ, খোলামেলা। এখানে বিখ্যাত অধ্যাপকরা সব আমির-ওমরাহ স্থানীয়। অর্ধেক সময় সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ওয়াশিংটনে তাঁদের অহরহ ডাক পড়ে। তাঁরা কোনও বিষয়ে একটা উক্তি করলে পরের দিন তা কাগজে হেডলাইন হয়ে ছাপা হয়। মনে হয় সব সময়ই যেন একটা হইহই রইরই ব্যাপার। মহা-অধ্যাপকরা কেউ কেউ এতই ব্যস্ত যে ছাত্র পড়ানোর মতো সামান্য কাজে নষ্ট করার সময় তাঁদের নেই। বিশ্বের সমস্যা সমাধান করতে ব্যস্ত। মহাপণ্ডিতরা টিচিং অ্যাসিস্টেন্ট দিয়ে পড়ানোর কাজটা চালিয়ে নেন। ১৯৬৮ সনের পশ্চিম দুনিয়াব্যাপী ছাত্র আন্দোলনের ফলে শেষোক্ত অনাচারটি বন্ধ হয়। মহামহোপাধ্যায়দের বাণীও মাঝে মাঝে ছাত্রদের কর্ণগোচর হতে লাগল। সত্যিতেই সাঙ্ঘাতিক জায়গা। মানে ক্যাম্পাসে এলোপাথাড়ি ঢিল ছুঁড়লে যে-কোনও সময় দশটা নোবেল লরিয়েট মারা পড়ার সম্ভাবনা। অন্য সব জায়গায় দেখেছিলাঞ্চের সময় সবাই সহকর্মীদের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ চুটিয়ে আড্ডা দেয়। এখানে সবাই যেন ঘোড়ায় চড়ে আসে, খাওয়া শেষ হতে না-হতে অশ্বপৃষ্ঠে বিদায় নেয়। আর সর্বত্রই অধ্যাপকরা সহকর্মীদের পরস্পর ভোজে নিমন্ত্রণ করেন। সেখানেই নবাগতদের সঙ্গে স্থায়ী শিক্ষকদের আলাপ-পরিচয় হয়। এখানে দেখলাম–সেসব বালাই নেই। আমিই আগুয়ান হয়ে বিখ্যাত সহকর্মীদের বাড়িতে খেতে বলতাম। প্রায়ই দেখতাম তাঁরা কেউ কখনও পরস্পরের বাড়িতে যাননি। অনেক সময় তাঁদের পরস্পরের ব্যক্তিগত পরিচয় নেই বললেই চলে। আর একটা ব্যাপারে ইংল্যান্ডের সঙ্গে এ জায়গার বিরাট তফাত। বিলাতে দেখেছি খাওয়াদাওয়া জাতীয় সামাজিক অনুষ্ঠানে কেউ বড় একটা পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা শুরু করে দেয় না। আর শিক্ষা বা বিদ্যাজীবী নন, এমন কোনও মহিলা উপস্থিত থাকলে তিনি যাতে কোণঠাসা হয়ে না পড়েন সেদিকে সকলের নজর থাকে। হার্ভার্ডের পণ্ডিতগোষ্ঠীর দেখলাম এসব বালাই নেই। এক ডিনার পার্টিতে আমার স্ত্রী দুই তরুণ পণ্ডিতের মাঝখানে বসেছিলেন। পাক্কা আড়াই ঘণ্টা তাঁরা আমার স্ত্রীর উপস্থিতি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে শাস্ত্রচর্চা করে গেলেন। এ জাতীয় অভিজ্ঞতা অনেকবার হয়েছে। একমাত্র বয়স্ক অধ্যাপকরা দেখেছি এ ব্যাপারে শিষ্টাচার মেনে চলেন।
মার্কিন সমাজে শ্রেণিসচেতনতা অন্য পাঁচটা দেশের তুলনায় সত্যিই কম। হার্ভার্ডে এই সামাজিক প্রবণতার এক সুন্দর অভিব্যক্তি দেখেছি। যে-কোনও অধ্যাপককে, তা তিনি যতই খ্যাতিমান হোন না কেন–নির্দ্বিধায় টেলিফোন করে দেখা করা চলে। তুলনীয় মাপের বিলেতি পণ্ডিতদের ফোন করার আগে দশবার ভাবতে হয় আর ফোন করা মাত্রই বিলেতি পণ্ডিত বলবেন—চলে এসো, আজ আমরা এক সঙ্গে লাঞ্চ খাই, এমন সম্ভাবনা কম। তবে হার্ভার্ডে মহাপণ্ডিতের সঙ্গে ওই যে লাঞ্চ খেলে, সেইখানে সম্পর্কের ইতি। আর যে কখনও দেখা হবে এমন সম্ভাবনা কম। অন্যান্য মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে মানুষে মানুষে সম্পর্ক আর একটু সহজ, সাবলীল। অন্তত আমার তাই ধারণা হয়েছে।
পেনসিলভেনিয়া এবং হার্ভার্ডে পড়াতে গিয়েছিলাম একটু ঘোরা পথে—অস্ট্রেলিয়ার দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক মাস পড়িয়ে। পশ্চিমে পার্থ আর পুবে সিডনি শহরে। পার্থ বাকি পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক কোণে যেন ঝুলে আছে। কিন্তু বড় সুন্দর শহর। দুটি সুন্দর নদী আর এক দিকে সমুদ্র। সোয়ান নদীর পাড়ে ক্যাম্পাস। নদীর জল প্রকৃতই ঘন নীল। ওই দেশের বাসিন্দাদের খোলামেলা সহজ ভাবটা আমার খুব ভাল লেগেছিল। মনে হত ওদের সংস্কৃতিতে বিলেতের শ্রমিকশ্রেণির আচার-ব্যবহারের ছাপ পড়েছে, অথচ সবাই বেশ সম্পন্ন, এক আদিবাসীরা ছাড়া। তবে এক সময় তাদের পশুর মতো শিকার করা হত। এখন উদারপন্থীদের চাপে তাদের কিছু অধিকার দেওয়া হয়েছে, তাদের ধর্মকর্ম আচার ব্যবহার সভ্য মানুষের অধ্যয়ন-বিশ্লেষণের বিষয় হয়েছে। অস্ট্রেলিয়াবাসীদের একটি অভ্যাস কিছুটা শ্রুতিকটু লেগেছে। ওরা সব কথাই সংক্ষিপ্তকরণের তালে থাকে। ইউনিভার্সিটি হয়ে যায় ইউনি, বিউটিফুল বিউট এবং সবচেয়ে বেদনাদায়ক—ডার্লিং ডার্ল-এ পর্যবসিত হয়। এমন প্রিয় সম্ভাষণের পরও কি অনুরাগ বেঁচে থাকে? পার্থে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন পরে বিশেষ খ্যাতিমান ব্যক্তি শ্রমিক দলের নেতা কিম বিসলি।
পার্থের পরে সিডনি। পৃথিবীর সুন্দরতম শহরগুলির একটি। নানা দিক থেকে সানফ্রানসিসকোর সঙ্গে তুলনীয়। কিন্তু মহাসাগরের পাঁচ আঙুল শহরের ভিতরে অনুপ্রবেশ করে সিডনিকে যেন আরও মনোরম করে তুলেছে। আর ১৯৬৯ সনে সিডনি অসহ্য রকমের জনাকীর্ণ ছিল না। এখন গাড়ির ভিড়ে দিনের অনেকটা সময়ই ওখানে নাকি যাতায়াত অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
অস্ট্রেলিয়া থেকে আমেরিকা যাওয়ার পথে জীবনের এক অতি মূল্যবান অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম। তিন-চারটে দিন তাহিতিতে কাটাবার সুযোগ পেলাম। গগ্যাঁর আবিষ্কৃত তাহিতি আর নেই। তবে তেমনিই কুষ্ঠ রোগ হওয়ার সম্ভাবনাও কম। তাহিতি দ্বীপটি জনাকীর্ণ হয়ে তৃতীয় জগতের একটি ভাঙাচোরা শহরের রূপ নিয়েছে। আমরা ওখানে না থেকে মোরিয়া বলে অন্য একটি দ্বীপে চলে যাই। এও এখন গগ্যাঁর রোমান্টিক দক্ষিণ সাগরের দ্বীপ আর নেই। কিন্তু ফরাসি সরকার জনবসতি এবং বহুতল বাড়ি তৈরি করা নিয়ন্ত্রিত করে দ্বীপটির আদিম রূপ বজায় রাখার চেষ্টা করেছে। হোটেলগুলি ছোট ছোট কুটিরের সমষ্টি। ভিতরে অবশ্যি আধুনিক কালের যাবতীয় আরামের ব্যবস্থাই আছে। আগাগোড়াই ব্যবসাবাণিজ্যের ব্যাপার। কিন্তু শত চেষ্টাতেও বেনে সভ্যতা প্রকৃতির মহামূল্য রত্নগুলিকে ধ্বংস করতে পারে না। তাহিতির ছোট ছোট দ্বীপগুলিও মুনাফালোভীর খপ্পরে পড়ে ধ্বংস হয়নি। সমুদ্র এখনও ঘন নীল, মনে হয় জলে হাত দিলে হাতে রং লাগবে। পাড়ে দাঁড়িয়েই বহুবর্ণ মাছ চোখে পড়ে। ট্যুরিস্টদের তৃপ্তিসাধনের জন্যই নৌকোর মাঝিরা গান ধরে। কিন্তু সে গানের সুরে বহু প্রাচীন সুখদুঃখের অনুরণন। সব সত্ত্বেও তাহিতি রোমান্টিক। বেনে সভ্যতা তাকে ধ্বংস করতে পারেনি। শুধু একশো বছর আগে যে আনন্দ পাওয়ার জন্য অনেক ঝড়ঝঞ্ঝা মাথায় নিতে হত আজ তা কিছু ডলারের বিনিময়ে সহজলভ্য। তাতে যদি কেউ বা কিছু খেলো হয়ে থাকে তবে তা আমরা ট্যুরিস্টরা, তূরীয় আনন্দের হাটে ড্যাঞ্চিবাবুর দল। তাহিতির বর্ণনাতীত সৌন্দর্য ম্লান হয়নি।
১৯৭০ সনের মাঝামাঝি দিল্লি ফিরে আসার পর অল্পদিনই দিল্লি স্কুলে ছিলাম। কিন্তু তার আগের কিছু ঘটনা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করি। যখন পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসকে নির্বাচনে হারিয়ে বামপন্থী দলগুলির সঙ্গে জোট বেঁধে অকংগ্রেসি সরকার গঠন করা হয় তখন আমি দিল্লি স্কুলের ডিরেক্টর। বোধহয় কয়েক মাসের মধ্যেই এই জোটে ভাঙন ধরতে শুরু করে এবং গণতন্ত্রের সব নিয়ম ভেঙে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর নির্দেশে গভর্নর ধরমবীর বামপন্থী মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করেন। দিল্লি স্কুলের সুখময় চক্রবর্তী, অমর্ত্য সেন প্রমুখ ডাকসাইটে অধ্যাপকরা প্রতিবাদের উদ্দেশ্যে সভা ডাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। এ ব্যাপারে আমারও সম্পূর্ণ সমর্থন ছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য তাদেরই অর্থে পরিপুষ্ট প্রতিষ্ঠানে সভা করা চলে কি না এ বিষয়ে আমার সন্দেহ ছিল। কিন্তু সুখময় এবং অমর্ত্য নানা যুক্তি দিয়ে দেখালেন যে, স্কুলের প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে এ অধিকার আমার আছে এবং তার জোরে সভা ডাকার জন্য ওঁরা আমার উপর চাপ দিলেন। ফলে উপাচার্য বীরেন গাঙ্গুলির অনুমতি না চেয়ে আমরা সভা করলাম। এবং ওই সভায় কেন্দ্রীয় সরকার এবং শ্রীমতী গাঁধীর কঠোর সমালোচনা করা হয়। আমরা ভেবেছিলাম পশ্চিমবঙ্গে এই গণতন্ত্রবিরোধী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন আন্দোলন চলবে। কিন্তু দেখলাম লাঠির জোরে আন্দোলন বন্ধ করতে বেশি সময় লাগল না। ডিরেক্টরের পদে দু’ বছর থাকার পর হঠাৎ উপাচার্যের চিঠি পেলাম—আমার জায়গায় দু’ বছরের জন্য অধ্যাপক শ্রীনিবাসকে নিয়োগ করা হয়েছে। এবং এখন থেকে ডিরেক্টরের পদে দু’বছর অন্তর নতুন লোক বসানো হবে—এই নিয়মই চালু হল। খুবই যুক্তিযুক্ত কথা। শ্রীনিবাস ডিরেক্টর হতে অস্বীকার করায় অরুণ দাশগুপ্তকে গদিয়ান করা হল। কিন্তু সবাই বুঝল যে, কাজগুলি নেহাত রুটিনমাফিক করা হয়নি। পরে শুনি দিল্লির ভাজপা নেতারা আমাদের বামঘেঁষা কার্যকলাপে বিরূপ হয়ে উপাধ্যক্ষর উপর চাপ দেন। আমাকে ডিরেক্টরের পদ থেকে সরানোর আসল কারণ তাই।
আমাদের বামঘেঁষা ভাবমূর্তি অন্য কারণেও প্রচার হয়েছিল। ষাটের দশকে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে মার্কিন প্রভাব গ্রহণযোগ্যতার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। সেই ঢেউ যখন শীর্ষে পৌঁছেছে তখন ইঙ্গ-মার্কিন সাংস্কৃতিক চুক্তির প্রস্তাব এল। আমরা ভয় পেলাম যে, এই চুক্তি বহাল হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি আমেরিকানদের কুক্ষিগত হবে। ফলে আমরা যৌথভাবে ওই প্রস্তাবের বিরোধিতা করি। এর অল্পদিন পরেই ওই চুক্তিরই অনুরূপ চুক্তি সোভিয়েট রাষ্ট্রপুঞ্জের সঙ্গে হওয়ার প্রস্তাব এল। এ বিষয়ে আমরা চুপ করে থাকায় দক্ষিণপন্থী কিছু খবরের কাগজ আমাদের কুৎসা গাইতে শুরু করেন। স্টেটসম্যানের এক রিপোর্টার আমার সঙ্গে তাঁর ইন্টারভিউয়ের অত্যন্ত বিকৃত বয়ান ওঁদের কাগজে ছাপালেন। তার প্রতিবাদে আমি যে চিঠি দিই তা ছাপা হয় প্রায় এক সপ্তাহ পরে। এরপর থেকে খবরের কাগজে কোনও বিবৃতি দেওয়ার ব্যাপারে আমি সাবধান হয়ে যাই। সত্যিতে ষাটের দশকে ক্রুশ্চেভ সাহেবের বিখ্যাত বিবৃতির পর সোভিয়েট রাষ্ট্রের গণতন্ত্রবিহীনতা সম্পর্কে আমাদের কোনও সন্দেহ ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওদের স্টালিনপন্থী অতীতে যাই থাক, ভবিষ্যতের মানুষের পক্ষে আধিপত্যর বিপদ রাশিয়ার চেয়ে আমেরিকার দিক থেকে আসবারই সম্ভাবনা বেশি এটা আমাদের অনেকেরই দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। পৃথিবীর সাম্প্রতিক ইতিহাস আমাদের সেই বিশ্বাসের সত্যতা প্রমাণ করেছে। তাছাড়া মার্কিন অনুদান ভারতবর্ষের নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেশ শিকড় গেড়ে বসেছিল। ওদের সঙ্গে আমাদের আদানপ্রদান যথেষ্টই ছিল। কিন্তু তা বলে আমরা বিক্রি হতে বসিনি। অনুদাতা হঠাৎ কর্তা হয়ে না বসে, সে বিষয়ে আমরা বিশেষ সচেতন ছিলাম। এবং মাঝে মাঝে ওই কর্তালির প্রচেষ্টা বেশ প্রকট হয়েই পড়ত—এ কথা নিঃসন্দেহে বলা চলে। রাশিয়ার সঙ্গে সাংস্কৃতিক চুক্তিতে এই রকম আশঙ্কার কোনও কারণ আমরা দেখিনি। তার অন্যতম কারণ ওদের অত রেস্ত ছিল না। ফলে ওই চুক্তিপ্রস্তাবে আমরা ভয়ের কিছু দেখিনি। এত সব কথা তখন খুলে বলার সুযোগ ছিল না। ফলে গোলাপি বর্ণের পাতি কমিউনিস্ট হওয়ার কলঙ্ক আমাদের গায়ে লেগেই রইল।
আগেই বলেছি—দিল্লি স্কুলের কাজ আমার পক্ষে সুখশয্যা হয়নি। আমি নিক্রমণের পথ খুঁজছিলাম। হঠাৎ সুযোগ জুটে গেল। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে একটি অধ্যাপকের পদ খালি হল। আমি এই পদের জন্য প্রার্থী হয়ে যথারীতি দরখাস্ত দিলাম। ১৯৭০ সনে আমি দিল্লি স্কুলের ছত্রচ্ছায়া ছেড়ে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্টস বিল্ডিংয়ের ছোট একটি ঘরে গিয়ে ঘাঁটি গাড়লাম। জানতাম না যে ভাগ্যবিধাতা কত ধানে কত চাল সে কথা আমাকে শেখাবার ব্যবস্থা করছেন।