১৯. আবার অগাধ জলে

উনবিংশ পরিচ্ছেদ
আবার অগাধ জলে

পরদিন প্রাতঃকালে যথারীতি প্রাতরাশ শেষ করিয়া গৌরী একাকী তাহার খাস তাম্বুতে একটা কৌচে ঠেসান দিয়া বসিয়া ছিল। তাম্বুটি বিস্তৃত ও চতুষ্কোণ, মেঝেয় গালিচা বিছানো। মাথার উপর ঝাড় ঝুলিতেছে, দেয়ালে আয়না ছবি প্রভৃতি বিলম্বিত। দরজা জানালাও পাকা বাড়ির মত, ইহা যে বস্ত্রাবাস মাত্র তাহার কক্ষের আভ্যন্তরিক চেহারা দেখিয়া অনুমান করাও যায় না। ভোলা বাতায়ন পথে নিকটবর্তী অন্য তাম্বুগুলি দেখা যাইতেছে— প্রশান্ত প্রভাত রৌদ্রে বাহিরের দৃশ্যটা যেন চিত্রার্পিতবৎ মনে হয়।

গতরাত্রে গৌরী ঘুমাইতে পারে নাই। কাঁধের আঘাতটা যদিও সামান্যই তবু নিদ্রার যথেষ্ট ব্যাঘাত করিয়াছে। তাহার উপর চিন্তা। বিনিদ্র রজনীর সমস্ত প্রহর ব্যাপিয়া তাহার মনে চিন্তার আলোড়ন চলিয়াছে।

অবশেষে এই দুশ্চিন্তা-সমুদ্র মন্থন করিয়া মনে একটা সঙ্কল্প জাগিয়াছে। সেই অপরিণত সঙ্কল্পটাকেই কার্যে পরিণত করিবার উপায় সে আজ একাকী বসিয়া চিন্তা করিতেছিল, এমন সময় ধনঞ্জয় এত্তালা পাঠাইয়া কক্ষে প্রবেশ করিলেন। তাঁহার হাতে একখানা খোলা চিঠি।

অভিবাদন করিয়া ধনঞ্জয় জিজ্ঞাসা করিলেন– আজ কেমন বোধ করছেন? কাঁধটা–?

গৌরী বলিল— ভালই। একটু টাটিয়েছে—তা ছাড়া আর কিছু নয়।

ধনঞ্জয় বলিলেন— আঘাত ভগবানের কৃপায় অল্পই, ব্যাণ্ডেজও যথাসাধ্য ভাল করে বাঁধা হয়েছে; তবু গঙ্গানাথকে খবর পাঠালে হত না? সে বৈকাল নাগাদ এসে পড়তে পারত।

গৌরী বলিল— অনর্থক হাঙ্গামা করো না সর্দার। গঙ্গানাথের আসবার কোনো দরকার নেই। তোমার হাতে ওটা কি?

ঈষৎ হাসিয়া চিঠিখানা ধনঞ্জয় গৌরীর হাতে দিলেন উদিতের চিঠি। আমরা নাকি কাল রাত্রে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাঁর বন্ধু ময়ূরবাহনকে মেরে ফেলেছি; তাই আজ আর তিনি শিকারে আসবেন না।

চিঠি পড়িয়া গৌরী মুখ তুলিল–ময়ূরবাহন কি সত্যিই মরেছে নাকি?

ধনঞ্জয় মাথা নাড়িলেন–ময়ূরবাহন এত সহজে মরবে বলে তো মনে হয় না। আমার বিশ্বাস, এই চিঠি লিখে উদিত আমাদের চোখে ধুলো দিতে চায়; ময়ূরবাহন দুর্গে ফিরে গেছে। যদিও ফিরল কি করে, সেটা বোঝা যাচ্ছে না। দুর্গের মুখে রুদ্ররূপ পাহারায় ছিল, সুতরাং সেদিক দিয়ে ঢুকতে পারেনি। তবে ঢুকলো কোথা দিয়ে?

কিস্তার টানে সত্যিই ভেসে যেতে পারে না কি?

একেবারে অসম্ভব বলছি না। কিন্তু ভেবে দেখুন, সে আপনাকে খুন করে জলে লাফিয়ে পড়বে বলে কৃতসঙ্কল্প হয়ে এসেছিল। যদি তার দুর্গে ফেরবার কোনো পথই না থাকবে, তবে সে অতবড় দুঃসাহসিক কাজ করবে কেন? …

গৌরী ভাবিয়া বলিল— তা বটে। হয়তো জলের পথে দুর্গে ঢোকবার কোনো গুপ্তপথ আছে।

সেই কথা আমিও ভাবছি। ময়ূরবাহন যদি কিস্তার প্রপাতের মুখে পড়ে গুঁড়ো হয়ে না গিয়ে থাকে, তাহলে নিশ্চয় সে কোনো গুপ্তপথ দিয়ে দুর্গে ঢুকছে। কিন্তু কোথায় সে গুপ্তপথ?

গুপ্তপথ কোথায়, তা যখন আমরা জানি না তখন বৃথা জল্পনা করে লাভ নেই। উদিত আমাদের বোঝাতে চায় যে ময়ূরবাহন মরে গেছে— যাতে আমরা কতকটা নিশ্চিন্ত হতে পারি। তার মানে ওরা একটা নূতন শয়তানী মতলব আঁটছে। এখন কথা হচ্ছে, আমাদের কর্তব্য কি?

সদর বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়িলেন কিছুই তো ভেবে পাচ্ছি না। দাবা খেলিতে বসিয়া বাজি এমন অবস্থায় আসিয়া পৌঁছিয়াছে যে, কোনো পক্ষই নূতন চাল দিতে সাহস করিতেছে না, পাছে একটা অচিন্তিত বিপর্যয় ঘটিয়া যায়।

কিছুক্ষণ নীরব থাকিবার পর গৌরী হঠাৎ বলিল— সর্দার, শঙ্কর সিংয়ের সঙ্গে দেখা করতে না পারলে কোনো কাজই হবে না। আমি ঠিক করেছি, যে করে হোক তাঁর সঙ্গে দেখা করতে হবে।

ভ্রূ তুলিয়া ধনঞ্জয় বলিলেন– কিন্তু কি করে দেখা করবেন?

ঐ জানালা দিয়ে। তাঁর অবস্থাটা জানা দরকার। বুঝছ না, আমরা যে তাঁর উদ্ধারের চেষ্টা করছি, একথা তিনি হয়তো জানেনই না। তাঁকে যদি খবর দিতে পারা যায়, তাহলে তিনিও তৈরি থাকতে পারেন। তাছাড়া আমরাও তাঁর কাছ থেকে এমন খবর পেতে পারি যাতে উদ্ধার করা সহজ হবে। আমার মাথায় একটা মতলব এসেছে–

কি মতলব?

এই সময় রুদ্ররূপ প্রবেশ করিয়া জানাইল যে কিস্তার পরপার হইতে অধিক্রম সিং মহারাজের দর্শনপ্রার্থী হইয়া আসিয়াছেন।

আলোচনা অসমাপ্ত রহিয়া গেল। অধিক্রম সিং আসিয়া প্রণামপূর্বক কৃতাঞ্জলিপুটে দাঁড়াইলেন। তাঁহার হস্তে একটি সুবর্ণ থালির উপর কয়েকটি হরিদ্রারঞ্জিত সুপারি। তিনি কন্যার বিবাহে ঝিন্দের মহারাজকে নিমন্ত্রণ করিতে আসিয়াছেন।

ধনঞ্জয় তাঁহাকে সমাদর করিয়া বসাইলেন। কিছুক্ষণ ধরিয়া শিষ্টাচারসম্মত অত্যুক্তি ও বিনয়বচনের বিনিময় চলিল। তারপর অধিক্রম সিং আর্জি পেশ করিলেন। কন্যার বিবাহে দীনের ভবনে দেবপাদ মহারাজের পদধুলি পড়িলে গৃহ পবিত্র হইবে। অদ্য রাত্রেই বিবাহ। কন্যার সখী মহামহিমময়ী ঝড়োয়ার মহারানী স্বয়ং আসিয়াছেন; এরূপক্ষেত্রে দেবপাদ মহারাজও যদি বিবাহমণ্ডপে দেখা দেন তাহা হইলে বরকন্যার ইহজগতে প্রার্থনীয় আর কিছুই থাকিবে না ইত্যাদি।

আদবকায়দা-দুরস্ত বাক্যোম্মসের মধ্য হইতেও স্পষ্ট প্রতীয়মান হইল যে মহারাজ নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে পারিলে অধিক্রম সত্যই কৃতার্থ হইবেন। মহারাজ কিন্তু তাঁহার বাকৃবিন্যাস শুনিতে শুনিতে ঈষৎ বিমনা হইয়া পড়িয়াছিলেন, অধিক্রম থামিলে তিনি সজাগ হইয়া বলিলেন,—সর্দারজী, আপনার নিমন্ত্রণ পেয়ে খুবই আপ্যায়িত হলাম। কৃষ্ণাবাঈ আর বিজয়লাল দুজনেই আমার প্রিয়পাত্র। কিন্তু দুঃখের বিষয় তাদের বিবাহে আমি উপস্থিত থাকতে পারব না। আজ রাত্রে আমার অন্য কাজ আছে।

অধিক্রম নিরাশ হইলেন, তাহা তাঁহার মুখের ভাবেই প্রকাশ পাইল। গৌরী বলিল— আপনি দুঃখিত হবেন না! নবদম্পতিকে আমি এখান থেকেই আশীবাদ করছি। তাছাড়া, স্বয়ং মহারানী যেখানে উপস্থিত, সেখানে আমার যাওয়া না-যাওয়া সমান।

অধিক্রম জোড়হস্তে নিবেদন করিলেন— মহারাজ, আপনার অনুপস্থিতিতে শুধু যে আমরাই মর্মাহত হব তা নয়, মহারানীও বড় নিরাশ হবেন। আমি কৃষ্ণার মুখে শুনেছি, তিনি আপনার প্রতীক্ষায় কুণ্ঠিতভাবে অধিক্রম কথাটা অসমাপ্ত রাখিয়া দিলেন। রাজারানীর অনুরাগের কথা, মধুর হইলেও প্রকাশ্যে আলোচনীয় নয়।

তবু অধিক্রম যেটুকু ইঙ্গিত দিলেন তাহাতেই গৌরীর মুখ উত্তপ্ত হইয়া উঠিল। সে উঠিয়া জানালার সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল; কিছুক্ষণ দৃষ্টিহীন চক্ষে বাহিরের দিকে তাকাইয়া রহিল। তারপর ধীরে ধীরে ফিরিয়া বলিল— অধিক্রম সিং, আজ আপনার নিমন্ত্রণ রক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। হয়তো অন্য কখনো আপনারা বোধ হয় জানেন না, কৃষ্ণার কাছে আমি অনেক বিষয়ে ঋণী। কিন্তু এবার সে ঋণ শোধ করতে পারলাম না। যাহোক, আশা রইল, কখনো না কখনো শোধ করব। আপনি দুঃখ করবেন না, বর-কন্যাকে আমি সর্বান্তঃকরণে আশীবাদ করছি, তারা সুখী হবে।

অগত্যা অধিক্রম ব্যর্থমনোরথ হইয়া বিদায় লইলেন। গৌরী আবার জানালার দিকে ফিরিয়া দাঁড়াইল; কিছুক্ষণ কোনো কথা হইল না। তারপর গৌরী ধনঞ্জয়ের দিকে ফিরিয়া দেখিল তিনি তাহার দিকেই তাকাইয়া আছেন; তাঁহার মুখে একটা নিতান্তই অপরিচিত কোমলভাব। এই লৌহকঠিন যোদ্ধার মুখে এমন ভাব গৌরী আর কখনো দেখে নাই।

ধনঞ্জয় নরমসুরে বলিলেন— আপনি নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান না করলেই পারতেন। অধিক্রম দুঃখিত হল।

গৌরীর মুখে একটা ব্যঙ্গহাসি ফুটিয়া উঠিল; সে বলিল— নিমন্ত্রণ রক্ষা করলে তুমি খুশি হতে?

নিশ্চয়।

কিন্তু ঝড়োয়ার কস্তুরীবাঈয়ের সঙ্গে আমার দেখা হত যে! তাতেও কি তুমি খুশি হতে সর্দার?

ধনঞ্জয় কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন; তারপর একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন–কিছুদিন আগে খুশি হতাম না বরং বাধা দেবার চেষ্টা করতাম। কিন্তু আশ্চর্য মানুষের মন! আজ আপনাকে আর কস্তুরীবাঈকে একত্র কল্পনা করে মনে কোনো রকম অশান্তি বোধ করছি না; বরঞ্চ— আপনি না হয়ে যদি শঙ্কর সিং— সহসা দুই হস্ত আবেগভরে উৎক্ষিপ্ত করিয়া তিনি বলিয়া উঠিলেন— ভগবানের কি অবিচার! কেন আপনি শঙ্কর সিং হয়ে জন্মালেন না?

বিধাতার বিধানের বিরুদ্ধে সদারের এই ক্ষুদ্র বিদ্রোহ গৌরীরও বহুতুলব্ধ চিত্তের দৃঢ়তা যেন ভাঙিয়া ফেলিবার উপক্রম করিল। তাহার মনটা দ্রবীভূত হইয়া একরাশ অঞর মত টলটল করিতে লাগিল। ধনঞ্জয় পুনরায় বলিয়া উঠিলেন—কী ক্ষতি হত পৃথিবীর যদি আপনি শঙ্কর সিং হতেন? আমি শঙ্কর সিংয়ের বাপদাদার নিমক খেয়েছি, কিন্তু তাই বলে মিথ্যে মোহ আমার নেই শঙ্কর সিং আপনার পায়ের নখের যোগ্য নয়। অথচ যখন মনে হয়, আপনি একদিন ঝি ছেড়ে চলে যাবেন, আর শঙ্কর সিং ঝড়োয়ার রানীকে বিবাহ করে গদীতে বসবেন—

এবার গৌরী প্রায় রূঢ়স্বরে বাধা দিল, বলিল— ব্যস! সর্দার, আর নয়, যা হবার নয় তা নিয়ে আক্ষেপ কোরো না। এস এখন পরামর্শ করি। আমার প্রস্তাবটা তোমাকে বলা হয়নি।

ধনঞ্জয় যেন হোঁচট খাইয়া থামিয়া গেলেন। তারপর চোখের উপর দিয়া একবার হাত চালাইয়া নীরস কঠোরস্বরে বলিল—বলুন।

মধ্যরাত্রির ঘড়ি বাজিয়া যাইবার পর গৌরী, রুদ্ররূপ ও ধনঞ্জয় চুপিচুপি শিবির হইতে বাহির হইলেন। ছাউনি নিস্তব্ধ-শিবির-বেষ্টনীর দ্বারমুখে বন্দুকধারী প্রহরী নিঃশব্দে পথ ছাড়িয়া দিল।

পূর্বরাত্রে যেখানে ময়ূরবাহন কিস্তার জলে লাফাইয়া পড়িয়াছিল সেইস্থানে আবার তিনজনে গিয়া দাঁড়াইলেন। কোনো কথা হইল না, অন্ধকারে গৌরী নিজের গাত্রবস্ত্র খুলিতে লাগিল।

বহু আলোচনার পর কর্তব্য স্থির হইয়াছিল। রাত্রির অন্ধকারে গা ঢাকিয়া গৌরী সন্তরণে দুর্গের নিকটে যাইবে। সে সন্তরণে পটু, কিস্তার স্রোত তাহাকে ভাসাইয়া লইয়া যাইতে পারিবে না। দুর্গের সন্নিধানে উপস্থিত হইয়া যে-জানালার কথা প্রহ্লাদ বলিয়াছিল, সে সেই জানালার নিকটবর্তী হইবে। রাত্রে জানালায় সাধারণত দীপ জ্বলে, সুতরাং লক্ষ্য হারাইবার ভয় নাই। জানালা জল হইতে দুই-তিন হাত উর্ধ্বে, বাহির হইতে কক্ষের অভ্যন্তর একটু উঁচু হইলেই দেখা যাইবে। শব্দ হইবার আশঙ্কাও নাই, কিস্তার গর্জনে অন্য শব্দ চাপা পড়িয়া যাইবে। গৌরী জানালা দিয়া কক্ষের অভ্যন্তর দেখিবে। রাজা সেখানে বন্দী আছেন কিনা এবং রাজার সহিত কোনো প্রহরী আছে কিনা তাহা লক্ষ্য করিবে। যদি না থাকে তাহা হইলে রাজার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া তাঁহার সহিত বাক্যালাপ করিবে। তারপর দুর্গের আভ্যন্তরিক অবস্থা বুঝিয়া রাজাকে উদ্ধারের আশ্বাস দিয়া ফিরিয়া আসিবে।

গৌরীকে এই সঙ্কটময় কার্যে একাকী পাঠাইতে সর্দার ধনঞ্জয় প্রথমে সম্মত হন নাই; কিন্তু সে ক্রুদ্ধ ও অধীর হইয়া উঠিতেছে দেখিয়া শেষ পর্যন্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও সম্মতি দিয়াছিলেন। তিনি বুঝিয়াছিলেন, গৌরীর মনের অবস্থা এমন একস্থানে আসিয়া পৌঁছিয়াছে যে তাহাকে বাধা দিলে সে আরও দুর্নিবার হইয়া উঠিবে।

রুদ্ররূপ তাঁহাদের পরামর্শে যোগ দিয়াছিল, কিন্তু প্রস্তাবিত বিষয়ে হাঁ-না কোনো মন্তব্যই প্রকাশ করে নাই।

গৌরী কাপড়-চোপড় খুলিয়া ফেলিল। ভিতরে কালো রংয়ের হাঁটু পর্যন্ত হাফ-প্যান্ট ছিল; আর কোনো আবরণ নাই, ঊধ্বাঙ্গ উন্মুক্ত। কারণ সাঁতারের সময় গায়ে বস্ত্রাদি যত কম থাকে ততই সুবিধা। অস্ত্রও কিছু সঙ্গে লওয়া আবশ্যক বিবেচিত হয় নাই; তবু ধনঞ্জয় একেবারে নিরস্ত্র অবস্থায় শত্ৰুপুরীর নিকটস্থ হওয়া অনুমোদন করেন নাই। অনিশ্চিতের রাজ্যে অভিযান; কখন কি প্রয়োজন হইবে স্থির নাই–এই ভাবিয়া গৌরী তাহার দাদার দেওয়া ছোরাটা কোমরে খুঁজিয়া লইয়াছিল। ইহা যে সত্যই কোনো কাজে লাগিবে তাহা সে কল্পনা করে নাই; একটা সুদুর সম্ভাবনার কথা চিন্তা করিয়া অনাবশ্যক, বুঝিয়াও লইয়াছিল। নিয়তির করাঙ্কচিহ্নিত ঐ ছোরা যে আজ নিয়তির ইঙ্গিতেই তাহার সঙ্গী হইয়াছে তাহা সে কি করিয়া জানিবে?

বস্ত্রাদি বর্জনপূর্বক প্রস্তুত হইয়া গৌরী অন্ধকারের মধ্যে ঠাহর করিয়া দেখিল, রুদ্ররূপও ইতিমধ্যে গাত্রাবরণ খুলিয়া তাহারি মত কেবল জাঙিয়া পরিয়া দাঁড়াইয়াছে। গৌরী বিস্মিত হইয়া বলিল—এ কি রুদ্ররূপ!

রুদ্ররূপ বলিল— আমিও আপনার সঙ্গে যাচ্ছি।

গৌরী কিছুক্ষণ নিবা হইয়া রহিল। রুদ্ররূপ নিজ অভিপ্রায় পূর্বাহ্বে কিছুই প্রকাশ করে নাই। সে অল্পভাষী, তাই তাহার মনের কথা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বোঝা যায় না। গৌরীর প্রতি তাহার আনুরক্তি যে কতখানি তাহা অবশ্য গৌরী জানিত, কিন্তু এই বিপদসঙ্কুল যাত্রায় সে যে সহসা কোনো কথা না বলিয়া তাহার পাশে আসিয়া দাঁড়াইবে তাহা গৌরী ভাবিতে পারে নাই; তাহার বুকে একটা অনির্দিষ্ট ভার চাপানো ছিল, তাহা যেন হঠাৎ হাল্কা হইয়া গেল। তবু সে বলিল—কিন্তু তুমি আমার সঙ্গে গেলে কি সুবিধে হবে—

রুদ্ররূপ দৃঢ়স্বরে বলিল— মহারাজ, আমাকে বারণ করবেন না। সুবিধা অসুবিধা জানি না, কিন্তু আজ আমি আপনার সঙ্গ ছাড়ব না।

গৌরী তাহার পাশে গিয়া তাহার কাঁধে হাত রাখিয়া একটু চাপ দিল, অস্ফুটস্বরে বলিল— বেশ, চল। তোমাতে আমাতে যে কাজে বেরিয়েছি তা কখনো নিস্ফল হয়নি। কিন্তু তুমি ভাল সাঁতার জানো তো?

জানি মহারাজ।

বেশ। এস তাহলে।

কিস্তার পরপারে অধিক্রম সিংয়ের বাগানবাড়িতে তখন সহস্র দীপ জ্বলিতেছে; মিঠা মৃদু শানায়ের আওয়াজ ভাসিয়া আসিতেছে। কৃষ্ণার আজ বিবাহ। রানী কস্তুরী ঐ দীপোজ্জল ভবনের কোথাও আছেন, হয়তো তিনি আজিকার রাত্রে গৌরীর কথাই ভাবিতেছেন। তোহে ন বিসরি দিন রাতি। এদিকে শক্তিগড়ের কৃষ্ণমূর্তি কিস্তার বুকের উপর দুস্তর ব্যবধানের মত দাঁড়াইয়া আছে; তাহারই একটি ক্ষুদ্র গবাক্ষ পথে একটিমাত্র আলোকের ক্ষীণ শিখা দেখা যাইতেছে। শঙ্কর সিং হয়তো ঐ কক্ষে বন্দী। আর ময়ূরবাহন? সে কোথায়? সে কি সত্যই বাঁচিয়া আছে?

ধনঞ্জয় তীরে দাঁড়াইয়া রহিলেন; গৌরী ও রুদ্ররূপ সন্তর্পণে জলে নামিয়া নিঃশব্দে দুর্গের দিকে সাঁতার কাটিয়া চলিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *