১৯. আজ হাসান রাজা চৌধুরীর বিয়ে

আজ হাসান রাজা চৌধুরীর বিয়ে।

এক লাখ টাকা কাবিন। অর্ধেক গয়নাতে উসুল। বাকি অর্ধেক কনের হাতে নগদ দেওয়া হবে। ব্যাংক থেকে টাকা এনে রেশমি রুমালে বেঁধে সিন্দুকে তুলে রাখা হয়েছে।

কনের নাম রেশমা।

বিয়ে হবে জুমার নামাজের পর। বিয়ে পড়াবেন মৌলানা তাহের উদ্দিন জৈনপুরী। ধর্মপাশা থেকে এই উপলক্ষে তাকে আনা হয়েছে। তিনি এসেই মসজিদে চিল্লায় বসেছেন। বিশেষ বিশেষ বিবাহে মৌলানা তাহের উদ্দিন জৈনপুরী আলাদা কিছু কর্মকাণ্ড করেন। হাসান রাজা চৌধুরীর বিয়ে একটি বিশেষ ঘটনা।

বিয়েতে বড় কোনো উৎসব হচ্ছে না। নাইওরিদের আনা হয়নি। হাসান রাজা চৌধুরীর বাবা হাজি সাহেব পুত্রের বিয়ের উৎসব পরে করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তবে আজ রাতে অঞ্চলের বিশিষ্ট লোকজনদের জন্যে শাহি খানার ব্যবস্থা হচ্ছে। চারটা খাসি, একটা গরু জবেহ করা হয়েছে। পোলাও, খাসির মাংসের কোরমা, গরুর মাংস। বাবুর্চি নেত্রকোনা থেকে এসেছে। বাবুর্চির নাম মনা বাবুর্চি। মনা বাবুর্চিরও কিছু নিয়ম আছে। ডেগদ্ধি তার একটি। সে মন্ত্রপাঠ করে কাঁচা হলুদ, আদা এবং কাঁচা সরিষা দিয়ে ডেগ শুদ্ধি করে। এই প্রক্রিয়া মনা বাবুর্চি পেয়েছে তার ওস্তাদ হাজি গনি বাবুর্চির কাছ থেকে। হাজি গনি বাবুর্চি ময়মনসিংহ অঞ্চলের বিখ্যাত বাবুর্চি। জ্বিনের বাদশা নাকি তার মেয়ের বিয়ের খানা পাকানোর জন্যে গনি বাবুর্চিকে কোহকাফ নগরে নিয়ে গিয়েছিলেন। এই গল্প প্রচলিত আছে। অনেকেই এই গল্প বিশ্বাস করে। গনি বাবুর্চিকে গল্পের সত্যতা বিষয়ে প্রশ্ন করলে জবাব দেন না। মাথা নিচু করে হাসেন।

ডেগশুদ্ধি প্রক্রিয়া এরকম—একটা থালায় প্রদীপ জ্বালিয়ে ডেগের ভেতর নামিয়ে দেওয়া হয়। থালায় থাকে কাঁচা হলুদ, আদা এবং রাই সরিষা। মনা বাবুর্চি গোসল করে নতুন লুঙ্গি পরে মন্ত্রপাঠ করে ফুঁ দিয়ে প্রদীপ নেভায়। ডেগ শুদ্ধ হয়।

মন্ত্রটা নিম্নরূপ-

আলির ডেগ, কালীর ডেগ
রসুল বলে দেখে দেখ
কালী দেখি আলি দেখে
ভূত প্রেত চেখে দেখে
ভূতের মায়ের তিন পুত
ডেগের ভিতরে লাল সূত
লাল সূতে গিটু।
ইত্যাদি…

বিয়ের কনে রেশমা সকাল থেকেই তার মা’র সঙ্গে আছে। রেশমা যথেষ্ট হাসিখুশি। তার মা রাশেদা মূর্তির মতো মেয়ের পাশে আছেন। কিছুক্ষণ পরপর তার চোখ পানিতে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। তিনি শাড়ির আঁচলে চোখ মুছছেন। তারা দু’জন যে ঘরে আছে, তার দরজায় বড় একটা তালা ঝুলছে। রাশেদাকে বলা হয়েছে এজিন নেওয়ার জন্যে যখন সাক্ষীরা কাজি সাহেবকে নিয়ে আসবেন, তখনই তালা খোলা হবে; তার আগে না।

রাশেদা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, অনেক জালিম দেখেছি এমন জালিম দেখি নাই।

রেশমা বলল, কয়টা জালিম দেখেছ মা?

রাশেদা জবাব দিলেন না। রেশমা বলল, তুমি কোনো জালিমই দেখো নাই। কথার কথা বল।

চুপ থাক।

আমি চুপ থাকব। তুমি কান্দন থামাও।

এজিন নিতে যখন আসবে, তুই খবরদার এজিন দিবি না। দেখি বিয়া কীভাবে হয়।

রেশমা বলল, এজিন না দিলেও বিয়ে হয়ে যাবে। কীভাবে?

রেশমা বলল, সাক্ষীরা বলবে মেয়ে ফিসফিস করে কবুল বলেছে, আমরা শুনেছি। তারপর রাতে বাসরঘরে ঢুকিয়ে দিবে। বিয়ে না করেও পরপুরুষের সঙ্গে শুতে হবে। এরচেয়ে বিয়ে হওয়া ভালো না?

রাশেদা মেয়ের গালে সশব্দে চড় বসালেন। রেশমার কোনো ভাবান্তর হলো। তার হাসিমুখ হাসিহাসি থাকল। রাশেদা চাপা গলায় বললেন, ঠিক করে বল তুই খুনিটারে বিয়ে করতে চাস?

রেশমা তার মাকে চমকে দিয়ে বলল, চাই।

কী জন্যে চাস?

উনারে আমার ভালো লাগে।

মাকাল ফল দেখস নাই? মনে হয় কী সুন্দর, ভিতরে বিষ।

রেশমা বলল, একটা ভালো জিনিস কী জানো মা? উনি বাইরে সুন্দর ভিতরে বিষ এইটা আমরা জানি। অন্যের বিষয়ে জানব না। আগে থেকে জানা থাকা ভালো না মা?

রাশেদা চাপা গলায় মেয়েকে অতি কুৎসিত কিছু কথাবার্তা বললেন। যার সারকথা হচ্ছে রূপবান ছেলে দেখে রেশমার শরীর উজায়ে গেছে। শরীরে জ্বলুনি হচ্ছে। জ্বলুনি কমানোর জন্যে কাউকে দরকার। সেটা যদি পশু হয় তাতেও তার মেয়ের কোনো সমস্যা নাই। বরং পও হলেই সে খুশি।

রেশমা বলল, খুব খারাপ কথাও যে তুমি এত সুন্দর করে বলতে পারো আমি জানতাম না। তোমার কাছ থেকে খারাপ কথা শিখব মা। বিয়ের পর খারাপ কথা বলায় দোষ নাই। বিয়ের আগে দোষ।

বিয়ের জন্যে হাসান রাজাকে প্রস্তুত করা হচ্ছে। নাপিত এসে ভোরবেলায় তার চুল কেটে নতুন ধুতি নিয়ে গেছে। নিমপাতা এবং কাঁচা হলুদ দিয়ে তাকে গোসল দেওয়া হয়েছে। গোসলের পানিতে সোনা-রুপা রাখা হয়েছে। হাসানের গোসলের পর কনের গোসল দেওয়া হবে। কনের গোসলের নিয়মকানুন ভিন্ন। তাকে গোসল দিবে তিন সধবা। গোসলের দৃশ্য কোনো বিধবা দেখতে পারবে না। কাজেই রেশমার মা গোসলের সময় উপস্থিত থাকতে পারবেন না।

গোসলের পর হাসানকে হাজি সাহেব ডেকে পাঠিয়েছেন। হাসান বাবার সামনে জলচৌকিতে বসে আছে। হাজি সাহেব তামাক খাচ্ছেন। তাকে কিছুটা চিন্তিত মনে হচ্ছে।

হাজি সাহেব বললেন, তুমি কি আমার উপর অসন্তুষ্ট?

হাসান বলল, না।

তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিবাহের ব্যবস্থা করেছি, অসন্তুষ্ট হবার কথা। আমার কিছু যুক্তি আছে। যুক্তিগুলো শোনো।

হাসান বলল, আমি বিয়েতে রাজি হয়েছি এটাই যথেষ্ট। যুক্তি শোনার প্রয়োজন নাই।

প্রয়োজন আছে। মন দিয়ে শোনো। তুমি যে অপরাধ করেছ তার পাপ এই বিয়েতে কিছু কাটা যাবে।

হাসান বলল, পাপ কাটাকাটি তো আপনি করছেন না। আপনি কীভাবে জানেন পাপ কাটা যাবে? আরও পাপ যুক্ত হতে পারে।

কথার মাঝখানে কথা বলবা না। বেয়াদবি করবা না।

আর কথা বলব না। আপনার যা বলার বলুন।

তোমার মামলা যেভাবে অগ্রসর হওয়ার কথা ছিল সেভাবে অগ্রসর হয় নাই। আমি যথেষ্ট চিন্তায় আছি। উকিল সাহেব বলেছেন উচ্চ আদালতে ফরিদ ছাড়া পাবে।

ছাড়া পেলে ভালো। না পেলেও ক্ষতি নাই। আমি সুখে সংসার করব।

তোমার কথাবার্তার ধরন ভালো লাগল না। তুমি অস্থির আছ। অস্থির মানুষ এমন কথা বলে। বিবাহের পর তোমার অস্থিরতা কমবে ইনশাল্লাহ।

আপনার কথা শেষ হয়েছে, নাকি আরও কিছু বলবেন?

আরও কথা বলার ইচ্ছা ছিল। তোমার যে অবস্থা আমার কথা মন দিয়া শুনবা না।

আপনার কথা বলার কথা, আপনি কথা বলেন। আমার মতো আপনি নিজেও অস্থির। কথা বললে আপনার অস্থিরতাও কমবে।

স্ত্রী স্বামীর জন্যে সৌভাগ্য নিয়ে আসে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তোমার স্ত্রী তোমার জন্যে সৌভাগ্য নিয়ে আসবে! তোমার সৌভাগ্যের প্রয়োজন আছে।

হাসান রাজা হাসল।

আমাকে কদমবুসি করে দোয়া নাও। তোমার মায়ের কবর জিয়ারত করো। পিতামাতার দোয়া নাও। বিবাহ হয়ে যাক, একসঙ্গে খানা খাব।

 

কনের গোসল দেওয়া হচ্ছে।

তিনজন সধবা গোসল দিচ্ছেন। একটু দূরে বিয়ের গান হচ্ছে।

পিড়িতে বসিছে কন্যা
গোসল করিবায়
কইন্যার নানি দূরে বইসা
এইদিক ওইদিক চায়
জলে ভেজা কন্যার চোখে
তিন সাগরের পানি
চোখ মুছ সিনান কইন্যা
এখন নাও দৌড়ানি…

রাশেদ তার ঘরে তালাবদ্ধ অবস্থায় আছেন। কেঁদে তিনি চোখ ফুলিয়ে ফেলেছেন। তার ইচ্ছা করছে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়তে। দরজায় তালা লাগানো বলে তা সম্ভব হচ্ছে না।

বাদ জুমা বিয়ে পড়ানো হলো। তার পরপরই নৌকা নিয়ে প্রণব উপস্থিত হলেন। হাজি সাহেবের হাতে হাবীব খানের চিঠি দিলেন। হাজি সাহেব চিঠি পড়লেন। প্রণবকে বললেন, পরিশ্রান্ত হয়ে এসেছেন। সিনান করেন। আসেন একসঙ্গে খানা খাই। চিঠিতে কী লেখা আপনি কি জানেন?

প্রণব বললেন, জানি না। চিঠিটা জরুরি এটা শুধু জানি।

উকিল সাহেব তার কন্যার সঙ্গে আমার ছেলের বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। আমার জন্যে অত্যন্ত আনন্দের সংবাদ। একটু ঝামেলা আছে, সেটা বড় কিছু না। সামান্য ঝামেলা।

কী ঝামেলা?

কিছুক্ষণ আগে আমার ছেলের বিয়ে পড়ানো হয়েছে।

প্রণব অবাক হয়ে বললেন, এটা কোনো বড় ঝামেলা না? সামানা ঝামেলা? আপনি বলেন কী?

হাজি সাহেব বললেন, বিয়ে হয়েছে কিন্তু ছেলের সঙ্গে মেয়ের সাক্ষাৎ হয় নাই। দুজন আলাদা আছে। এই অবস্থায় তালাক হয়ে যাবে।

কী সর্বনাশ!

চমকায়ে উঠলেন কেন? চমকায়ে উঠার মতো কিছু বলি নাই। বাস্তব কথা বলেছি। আমি বাস্তব লোক।

প্রণব ইতস্তত করে বললেন, তালাক হওয়া পাত্রের সঙ্গে স্যার মেয়ে বিবাহ দিবেন এটা মনে হয় না। এটাও একটা বাস্তুব কথা। আমার সারও বাস্তুব লোক।

হাজি সাহেব বললেন, অবশ্যই বাস্তব কথা। হাবীব খান সাহেব সব ঘটনা জানার পর যদি মেয়েকে আমার ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেন আমি বলব, শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। আর যদি না দেন তাহলেও বলব, শুকুর আলহামদুলিল্লাহ।

সবকিছুতে শুকুর আলহামদুলিল্লাহ বললে তো ঝামেলাই শেষ।

হাজি সাহেব বললেন, আমি ঝামেলা শেষ করতে পছন্দ করি। ঝামেলা হলো মরা লাশ। মরা লাশ কবর দিতে হয়। পুষতে হয় না।

 

দুপুরে খাওয়ার পর হাজি সাহেব রাশেদাকে ডেকে পাঠালেন। রাশেদা কঠিন মুখ করে তার সামনে বসলেন। তার চোখ লাল। নাকের পাতা ফুলে ফুলে উঠছে। তিনি কান্না থামানোর চেষ্টা করছেন। হাজি সাহেব বললেন, জোর করে আমি তোমার মেয়ের সঙ্গে হাসানের বিয়ে দিয়েছি। আমি শরমিন্দা। এটা একটা বড় ভুল হয়েছে। তবে সব ভুলের সংশোধন আছে।

রাশেদা বললেন, এই ভুলের সংশোধন নাই।

হাজি সাহেব বললেন, তুমি ঠিক বলো নাই। এই ভুলেরও সংশোধন আছে।

কী সংশোধন।

বিবাহ বাতিলের ব্যবস্থা করলেই সংশোধন হয়। তালাকের ব্যবস্থা করা যায়।

রাশেদা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, তালাক!

হুঁ।

আপনি নতুন খেলা কী খেলতে চান আমি বুঝতে পারলাম না।

খেলা ভাবলে খেলা। আমি অনেক চিন্তাভাবনা করে যা পেয়েছি তা হলো, এই বিবাহ সুখের হবে না। কাজেই তালাকই ভালো।

চিন্তাভাবনা আগে করতে পারতেন।

তা পারতাম। এইখানে আমি ভুল করেছি। আরও বড় ভুল যেন না হয় তার জন্যেই তালাকের ব্যবস্থা। তুমি এখন মেয়ের কাছে যাও। মেয়েকে বলো তালাক দিতে। আমি আমার ছেলেকে চিনি। সে তালাকে রাজি হবে না।

আমার মেয়ে রাজি হবে?

হাজি সাহেব বললেন, তোমার মেয়েও সহজে রাজি হবে না। আমি অনুসন্ধানে পেয়েছি, তোমার মেয়ে হাসানকে পছন্দ করে। যাই হোক, তোমার দায়িত্ব মেয়ের হাতেপায়ে ধরে মেয়েকে রাজি করানো।

রাশিদা বললেন, তালাকের পিছনে অন্য কী ঘটনা আছে সেটা বলেন।

অন্য কোনো ঘটনা নাই। তবে দুপুরে কিছুক্ষণের জন্যে ঘুমায়ে পড়েছিলাম, তখন একটা খোয়াব দেখি। সেটাও একটা কারণ হতে পারে। কী খোয়াব দেখেছি শুনতে চাও?

শুনতে চাই না। আমার কাছে খোয়াবের কোনো দাম নাই।

আচানক কথা বললা। অনেক বড় বড় ঘটনার বিষয়ে খোয়াবের মাধ্যমে ইশারা আসে। মানুষকে সাবধান করার জন্যে আল্লাপাক খোয়াবের ব্যবস্থা করেন।

কী খোয়াব দেখেছেন?

দেখলাম হাসান আর তোমার মেয়ে ছাদে হাঁটছে। তোমার মেয়ে আনন্দে আছে। হঠাৎ হাসান তাকে ধাক্কা দিল। তোমার মেয়ে ছাদ থেকে পড়ে গেল। খোয়াব এই পর্যন্তই।

আপনার ছেলে একটা খুন করেছে। আপনার মাথায় আছে খুনের বিষয়। এই কারণে খোয়াকে আরেকটা খুন দেখেছেন।

তোমার জ্ঞান বেশি হয়েছে বিধায় জ্ঞানের কথা বলা শুরু করে। আমার জ্ঞান অল্প যে কারণে আমি খোয়াবকে দেখি আল্লাপাকের ইশারা হিসাবে। কথা বলে তুমি অনেক সময় নষ্ট করেছ, এখন যাও মেয়েকে রাজি করাও

রাশেদা বললেন, যা হওয়ার হয়েছে। তালাকের প্রয়োজন নাই। রেশমার কপালে যা আছে তা-ই ঘটবে।

হাজি সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, তোমাকে যা করতে বলেছি করো। পানশি প্রস্তুত আছে। তালাকের পরই তুমি মেয়ে নিয়ে চলে যাবে। কাবিনের টাকা তোমার মেয়ের থাকবে। গয়না যা দিয়েছি তাও থাকবে। গয়নার মধ্যে হাসানের মায়ের একটা চন্দ্রহার আছে। সেটা শুধু ফেরত দিবা। আরেকবার যখন হাসানের বিবাহ হবে তখন এই হারের প্রয়োজন হবে। এটা মায়ের একটা স্মৃতি।

 

সন্ধ্যাবেলা রাশেদা মেয়েকে নিয়ে নৌকায় উঠলেন। তালাকপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে।

প্রণবও ভিন্ন নৌকায় সন্ধ্যাবেলায় দু’টা প্রকাণ্ড চিতল মাছ নিয়ে রওনা হলেন। তাঁর সঙ্গে হাজি সাহেবের চিঠি। চিঠিতে লেখা–

জনাব হাবীব খান সাহেব,

আসসালামু আলায়কুম। পর সমাচার আপনার পত্র পাইয়া অতি সন্তোষ লাভ করিয়াছি। আপনার প্রস্তাব আমার পুত্রের প্রতি বিরাট দোয়াস্বরূপ। আপনার কন্যাকে পুত্রবধূ হিসাবে পাওয়াও আমার জন্যে মহাসৌভাগ্যের ব্যাপার। বাকি

আল্লাপাকের ইচ্ছা।

সামান্য ঝামেলা অবশ্য আছে। এই ঝামেলার বিষয়টা আপনি প্রণব বাবুর নিকট জানিবেন।

আমি প্রস্তুত আছি। আমার পুত্রও প্রস্তুত আছে।

ইতি
হাজি রহমত রাজা চৌধুরী

 

প্রণবের সঙ্গে আরেকটি চিঠি আছে। চিঠিটা নাদিয়ার জন্যে। পত্ৰলেখকের নাম হাসান রাজা চৌধুরী। হাসান লিখেছে—

নাদিয়া,

আপনি কেমন আছেন? আপনি বলেছিলেন, আমাদের কইতরবাড়ি দেখতে আসবেন। প্রণব বাবুকে হঠাৎ দেখে মনে হলো আপনিও এসেছেন। আমি আগ্রহ নিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, নাদিয়া কোথায়? আমি ভেবেছিলাম আপনি প্রণব বাবুকে নিয়ে আমার বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছেন।

অজি দুপুরে আমার বিয়ে হয়েছে। সন্ধ্যাবেলা বিয়ে ভেঙে গেছে। যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তার নাম রেশমা। মেয়েটা বালিকা স্বভাবের। এই ধরনের মেয়েরা বৃদ্ধা হওয়ার পরেও তাদের বালিকা স্বভাব থেকে যায়।

আপনাকে এই চিঠিটা লেখার উদ্দেশ্য একটা আশ্চর্য ঘটনা জানানো। ঘটনা ঠিক না, অভিজ্ঞতা। বিয়ে এবং বিয়ে ভাঙার অভিজ্ঞতা।

রেশমা (যে মেয়েটির সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তার নাম) এবং তার মা বিয়েতে রাজি ছিল না। তাদের রাজি না হওয়ার কঠিন কারণ ছিল। বিয়ে জোর করে দেওয়া হয়। আমি নিজে আপত্তি করতে পারতাম। আপত্তি করিনি। আমার মধ্যে গা ছেড়ে দেওয়া ভাব চলে এসেছে। যা হওয়ার হবে এই ভাব। ঘটনা প্রবাহে বাধা দেওয়ার কোনো ক্ষমতা কারও নেই এই বিষয়টা আমার মাথায় ঢুকে গেছে।

যাই হোক বিয়ে হলো। আয়নায় তাকে দেখানো হলো। দেখলাম মেয়েটা কাঁদছে কিন্তু তার ঠোট হাসিমাখা। হঠাৎ আমার মনে অদ্ভুত আনন্দ হলো। মনে হলো, এই মেয়ে আমার একটি অংশ। সে আমার সঙ্গে হাসবে, আমার সঙ্গে কাঁদবে। খুব ইচ্ছা করল বলি, এই মেয়ে, আর কঁদবে না। এখন থেকে শুধু হাসবে।

সন্ধ্যাবেলা, মাগরেবের আজানের পরপর আমাকে জানানো হলো—রেশমা আমাকে তালাক দিয়েছে। আমার কাছে মনে হলো, মেয়েটা ঠিক করেছে। ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে আমার বাবার ইচ্ছায় বিয়ে করেছে। আবার নিজের ইচ্ছায় বিয়ে বাতিল করেছে। সাহসী মেয়ে। কিন্তু আমার মনটা এতই খারাপ হলো, মনে হলো হঠাৎ আমার জগতটা ছোট হয়ে গেছে। আমার মস্তিষ্কের একটা অংশ মরে গেছে। বিরাট পৃথিবীতে আমি একা হয়ে গেছি।

কয়েক ঘণ্টার জন্যে একটা মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে পেয়েছিলাম। এই কয়েক ঘণ্টা তার সঙ্গে কোনো কথা বলতে পারিনি। তার চোখের দিকে তাকাতে পারিনি।

নাদিয়া, আপনাকে বিষদভাবে এত কথা কেন বলছি জানেন? একজন কাউকে আমার মনের কথাগুলি বলতে ইচ্ছা করছিল। চিঠি লেখার সময় মনে হচ্ছিল আপনি আমার সামনে বসে আছেন।

প্রণব বাবু বললেন, আপনার সঙ্গে আমার দেখা হবে। এই কথা তিনি কেন বললেন আমি জানি না। যদি দেখা হয় আমি এবার আপনার জন্যে একটা উপহার নিয়ে আসব, চোঙা দুরবিন। এই দুরবিনের কোনো স্ট্যান্ড থাকে না। হাতে নিয়ে আকাশের দিকে তাকাতে হয়। দুরবিনটা আমি পেয়েছি গুদামঘরে। দুরবিনের গায়ে লেখা–

Victorian Marine Telescope
Maker w. Ottway and co.
London 1915

আপনাকে এই টেলিস্কোপটি দিতে চাচ্ছি, কারণ আপনি আমাকে টেলিস্কোপ বিষয়ে একটি গল্প বলেছিলেন। গল্প বলার এক পর্যায়ে হঠাৎ দেখলাম, আপনার চোখ ছলছল করছে। গল্পটা মনে করিয়ে দেই। শেষজীবনে জ্যোতির্বিদ গ্যালিলিও খুবই আগ্রহ করে নিজেই একটা টেলিস্কোপ বানিয়ে যখন আকাশের দিকে ধরলেন, তখন তিনি কিছুই দেখলেন না। কারণ রাতের পর রাত তারা দেখে এবং দিনে সূর্যের দিকে তাকিয়ে তিনি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।

লম্বা একটা চিঠি আপনাকে লিখলাম। বানান ভুল করেছি কি না এই নিয়ে চিন্তা করছি। আপনি ভালো থাকবেন।

ইতি
হাসান রাজা চৌধুরী

রাত নয়টা। হাবীব বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। এখান থেকে নবজাত শিশুর কান্নার শব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। সফুরার পুত্রসন্তান হয়েছে। যে পৃথিবীতে এসেছে সে নিজেকে প্রবলভাবেই জানান দিচ্ছে।

 

হাজেরা বিবি তার ঘর থেকে ডাকলেন, হাবু কইরে! হাবু। ও হাবু।

হাবীব জবাব দিলেন না। হাজেরা বিবি ডেকেই যাচ্ছেন, হাবু রে ও হাবু, হাবু। বাধ্য হয়ে হাবীব বললেন, মা আমি বারান্দায়। জটিল একটা বিষয় নিয়া চিন্তায় আছি। এখন তোমার কথা শুনতে পারব না।

হাজেরা বিবি বললেন, অতি জটিল কথা আমার পেটে ঘুরপাক খাইতেছে। তাড়াতাড়ি কাছে আয়।

বিরক্ত মুখে হাবীব তার মা’র ঘরে ঢুকলেন। হাজেরা বিবি বললেন, খবর পাইছস তোর পুলা হইছে?

হাবীব কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। নিজেকে সামলাতে তার সময় লাগল। তিনি থমথমে গলায় বললেন, মা, যে কথাটা বলল, এই কথা যদি আর কোনোদিন বলো…

বললে কী করবি? গলা টিপ্যা মারবি? মারলে ভালো হয়। পুত্রের হাতে মায়ের মৃত্যু হইল সুখের মরণ। এখন যা বারান্দায় খাড়ায়া পুলার কান্দন হোন। তোর পুলার গলা দিয়া বুলন্দ’ আওয়াজ আসতাছে। মাশাল্লাহ্।

হাবীব বললেন, চুপ!

হাজেরা বিবি বললেন, আমারে চুপ বলবি না। যারার সাহস নাই তারা সবসময় অন্যরে বলে, চুপ। সাহসীরা বলে না। তুই সাহস দেখা, যা পুত্র কোলে নে। বাপ বইল্যা তার গালে ঠাশ কইরা চুমা দে।

মা, খবরদার!

হারামজাদা পুলা তুই খবরদার!

হাবীব মার সামনে থেকে সরে গেলেন। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামলেন। কিছুক্ষণ একা বাগানে হাঁটবেন একতলায় নামতেই রশিদের সঙ্গে দেখা হলো। রশিদ বলল, একটা খারাপ খবর আছে স্যার।

হাবীব বললেন, সন্তান প্রসব করতে গিয়ে সফুরা মেয়েটা কি মারা গেছে?

জি।

আমার জুনিয়র উকিল আব্দুল খালেকরে খবর দাও

সে মরা বাড়িতে তোলা খাবার পাঠাতে চেয়েছিল। সুযোগ পেয়ে গেল।

হাবীব বাগানের দিকে গেলেন। শিশুর কান্না এত দূর থেকেও শোনা যাচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *