১৯. আজিজুল প্যারিস ছেড়ে যাবার

আজিজুল প্যারিস ছেড়ে যাবার মাস দেড়েক পরে হঠাৎ অফিস থেকে অ্যাপার্টমেন্টে ফিরেই ডক্টর সরকারের চিঠি পেলাম।…

.

মা, আমি তোমার নেহাতই অপদার্থ সন্তান। তাই তো আজকাল তোমাকে বিশেষ চিঠিপত্রই লিখি না। তোমার চিঠি যে খুব নিয়মিত পাই, তা নয় কিন্তু তবুও তুমি সময় পেলেই আমাকে চিঠি লেখ। তাছাড়া কিছুদিন আগে আজিজুল নামে একটি ছেলে তোমার পাঠানো দুটি শার্ট, দুটি টাই আর কয়েক প্যাকেট ব্লেড দিয়ে গেল। ছেলেটির সঙ্গে কথাবার্তা বলে বুঝলাম, ও তোমার বিশেষ গুণগ্রাহী ও ভক্ত। ভেবেছিলাম, জিনিসগুলো পাবার প্রাপ্তি সংবাদ পাঠাবে, কিন্তু তা আর হল না। সপ্তাহখানেকের জ্বরে শরীর এমন কাহিল হল যে বহুদিন কোনো কাজকর্মই করিনি। অমিয় আর সুপর্ণা মাঝে মাঝেই আমাকে দেখতে আসে। মনে হয় জিনিসগুলির প্রাপ্তি সংবাদ ওদের চিঠিতেই জেনেছ।

এবার একটু কাজের কথায় আসি। আমার অধ্যাপনা জীবনের প্রথম ব্যাচের ছাত্র নবেন্দু এখন শিক্ষাজগতের একটি ধ্রুবতারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের চূড়ামণি। তার পাণ্ডিত্যের খ্যাতি স্বদেশে এবং বিদেশে। কতবার যে বিদেশ গেছে, তার ঠিকঠিকানা নেই। যাতায়াতের পথে প্যারিসে থেকেছে দু-একদিন কিন্তু এর বেশি নয়। এবার নবেন্দুকে প্যারিসেই থাকতে হবে তিন মাস। ওখানকার কর্তৃপক্ষই ওর সব ব্যবস্থা করবেন। তোমাকে দুটি অনুরোধ। আমার পরামর্শ মতো। নবেন্দু শনিবার (৭ই সেপ্টেম্বর) সকাল দশটায় এয়ার ফ্রান্স-এর ফ্লাইটে ওরলি এয়ারপোর্টে পৌঁছবে। সেদিন তো তোমার ছুটি। তাই তুমি যদি এয়ারপোর্ট থেকে ওকে তোমার ওখানে একদিনের জন্য নিয়ে যাও, তাহলে খুব ভালো হয়। রবিবার বিকেলের দিকে ওর নির্দিষ্ট আস্তানায় চলে যেতে একটু সাহায্য করবে। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, নবেন্দু ভোজনরসিক এবং আমাদের নিজস্ব খাবার ছাড়া অন্য কোনো দেশের কোনো খাবার খেয়েই নাকি ওর পেট ভরে না। তাই শনিবার-রবিবার তোমার অন্য কোনো প্রোগ্রাম না থাকলে ওকে মাঝে মাঝে তোমার ওখানে আসতে বল। নবেন্দু মহাপণ্ডিত লোক। মনে হয় ওর সান্নিধ্যে তোমার ভালোই লাগবে।…

পূজা আসছে। তাই নবেন্দুর সঙ্গে তোমার জন্য একটা শাড়ি পাঠাচ্ছি। এ ছাড়া চিড়ে-মুড়ি-বড়ি ইত্যাদি ধরনের কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়াও দু-তিনটে পত্রিকার শারদীয় সংখ্যা পাঠাব…

.

৭ই সেপ্টেম্বর সকালে গাড়ি নিয়ে ছুটলাম ওরলি এয়ারপোর্টে। ঠিক সময়েই প্লেন এলো। শাড়ি পরা আর কোনো মেয়ে ছিল না বলে আমাকে চিনতে নবেন্দুবাবুর একটুও কষ্ট হল না।…আই হোপ তুমিই কবিতা?

হেসে বললাম, হ্যাঁ।

তোমাকে অনেক কষ্ট করে আসতে হল।

না, না, কষ্ট কিছু না; বরং মাঝে মাঝে নিজের দেশের মানুষকে কাছে পেলে ভালোই লাগে।

তা ঠিক কিন্তু…

ডক্টর সরকার যখন বলেছেন তখন দ্বিধা করার কোনো কারণ নেই।

যাই হোক মালপত্র পিছনের সীটে বোঝাই করে ওকে সামনের দিকের ডানদিকে বসালাম। গাড়ি স্টার্ট দিলাম। ফার্স্ট গিয়ার, সেকেন্ড গিয়ার, থার্ড গিয়ার, ফোর্থ গিয়ার। প্রায় একশো কিলোমিটার স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছি। হঠাৎ নবেন্দুবাবু বললেন, তুমি তো দারুণ জোরে গাড়ি চালাও।

হেসে বললাম, এখানে চালাতেই হয়।

তা ঠিক। তবে লেফট্-হ্যান্ড ড্রাইভ গাড়ি চালাতে অসুবিধে হয় না?

আমি তো কলকাতায় গাড়ি চালাতাম না; তাই কোনো অসুবিধে হয় না।

তুমি বোধহয় অনেক দিন দেশে যাও না…

হ্যাঁ, দেশ ছাড়ার পর আর যাইনি।

যেতে ইচ্ছে করে না?

ইচ্ছে করে ঠিকই কিন্তু ঠিক নিজের কেউ নেই বলে আর এত খরচ করে যেতে মন চায় না।

ছুটিতে কোথাও যাও না?

গতবার এথেন্সে গিয়েছিলাম। এবার কোথায় যাব ঠিক করিনি।

কবে ছুটি পাবে?

ফার্স্ট অক্টোবর থেকেই আমার ছুটি।

আমার অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছেই নবেন্দুবাবু বললেন, অপূর্ব সাজিয়েছ তো।

আমি একটু হেসে বললাম, স্বামী-পুত্রের ঝামেলা তো নেই। তাই অফিস থেকে ফিরে এসে ঘর গুছিয়েই সময় কাটিয়ে দিই।

আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে কফি করতে গেলাম। কফি নিয়ে ঘরে ঢুকতেই নবেন্দুবাবু দুটো প্যাকেট এগিয়ে দিলেন। জিজ্ঞাসা করলাম, ডক্টর সরকার পাঠিয়েছেন বুঝি?

একটা উনি পাঠিয়েছেন, অন্যটা অমিয়।

খুলে দেখি, ওরা দুজনেই দুটি সুন্দর সিল্কের শাড়ি পাঠিয়েছেন। এছাড়াও আরো অনেক কিছু। এবার উনি দুতিনটে শারদীয় সংখ্যা এগিয়ে দিতেই বললাম, এগুলো দেখলেই কলকাতার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়।

সত্যি, এই শারদীয় সংখ্যা নিয়ে সারা বাংলাদেশে যে চাঞ্চল্য দেখা যায়, তেমন আর কোথাও হয় না।

কফি খেতে খেতেই বলি, বিদেশে এসে অনেক কিছু পেযেছি, কিন্তু কলকাতা ছাড়ার জন্য অনেক কিছু হারাতেও হয়েছে।

এবার উনি জিজ্ঞাসা করলেন, আর কত কাল বিদেশে থাকবে?

আমার কাছে দেশ-বিদেশ দুইই সমান।

ও কথা বোলো না কবিতা। হাজার হোক নিজের দেশ, নিজের পরিবেশ, নিজের ভাষা, বন্ধুবান্ধবের আকর্ষণ তো আলাদা।

তা ঠিক কিন্তু ওখানে আমার মতো মেয়ের পক্ষে একলা থাকা খুবই কঠিন।

যদি কলকাতায় থাকতে না চাও তাহলে দিল্লি বা বোম্বতে থাকো।

এবার একটু হেসে বললাম, দেখা যাক ভবিষ্যতে কি হয়?

নবেন্দুবাবুকে দেখেই বোঝা যায়, উনি বোদ্ধা। চোখে-মুখে একটা ঔজ্জ্বল্য। বয়স পঞ্চাশের ঘরে হলেও সারা চেহারায় যৌবনের দীপ্তি। কথাবার্তায় অত্যন্ত রুচিসম্পন্ন। মনে মনে বললাম, ডক্টর সরকার ঠিকই লিখেছেন।

কফি খাওয়া শেষ হলে উনি সুটকেশ থেকে একটা শাড়ি বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, দিস ইজ-এ টোকন প্রেজেনটেশন ফ্রম ইওর নিউ ফ্রেন্ড!

অত্যন্ত দামি কাঞ্চিপুরম সিল্কের শাড়ি দেখেই বললাম, এত দামি শাড়ি আনার কি দরকার ছিল?

নবেন্দুবাবু আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, তুমি পরলে কোনো শাড়িকেই দামি মনে হবে না। তোমার রূপ-গুণের কাছে আর সবকিছু ম্রিয়মান হয়ে যায়।

কথাটা শুনেই একটু বেসুরো মনে হল কিন্তু উনি সঙ্গে সঙ্গেই বললেন, ডক্টর সরকার যাকে মা বলেন সে তো সাধারণ মেয়ে হতে পারে না।

হেসে বললাম, সত্যি আমি অসাধারণ?

নো ডাউট অ্যাবাউট দ্যাট!

আমার আগের অ্যাপার্টমেন্টের চাইতে এটা একটু বড় হলেও শোবার ঘর একটাই। এই ঘরেই তমার সবকিছু। অন্য ঘরের একদিকে ছোট্ট একটা খাবার টেবিল। টেবিলের দুদিকে দুটো চেয়ার। অন্যদিকে বসার ব্যবস্থা। ছোট্ট একটা পান্ট্রি। ছোট্ট একটা বাথ-কাম-টয়লেট। কোনোমতে স্নানাদি সারা যায় কিন্তু কোনোমতেই কাপড়-চোপড় বদলানো যায় না। তাছাড়া বাথরুম হচ্ছে প্যান্ট্রির পাশে। কাপড়-চোপড় পরার জন্য আমাকে ড্রইংরুম পার হয়ে শোবার ঘরে যেতে হয়। একলা থাকি বলে এই ব্যবস্থায় কোনো অসুবিধে হয় না। আজ নবেন্দুবাবু আসায় একটু মুশকিলই হল।

আমি বললাম, আমার অ্যাপার্টমেন্ট নেহাতই ছোট। চটপট কিছু করা মুশকিল। নই এবার উঠুন।

নবেন্দুবাবু বললেন, অ্যাপার্টমেন্ট ছোট হলেও সবকিছুই তো আছে।

এবার আমি হাসতে হাসতে বললাম, আছে সবকিছুই; তবে আমি বাথরুম গেলে আপনাকে অ্যাপার্টমেন্টের বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।

উনি হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলেন, তার মানে?

বাথরুম খুবই ছোট। তাই এই ঘর হয়ে শোবার ঘরে গিয়ে জামাকাপড় পরতে হয়।

সর্বাঙ্গ আবরণকারী কিছু ব্যবহার কর না?

অ্যাপার্টমেণ্টের মধ্যে ওই তো একমাত্র পোশাক। তাশলে আর চিন্তার কি?

না না, চিন্তার কিছু নেই, কিন্তু চটপট কাজ করতে আপনার নিশ্চয়ই অসুবিধে হবে।

তোমার অসুবিধে না হলে আমারও হবে না।

আমি আগের দিন রাত্রেই সবকিছু রান্না করে রেখেছিলাম। তাই নবেন্দুবাবু বাথরুমে যেতেই আমি ভাত বসিয়ে দিলাম। অন্যান্য খাবার-দাবার গরম করতে না করতেই উনিও তৈরি হয়ে গেলেন।

খেতে বসে নবেন্দুবাবু বললেন, এত রান্না করেছ কেন?

রান্না করতে আমার ভালো লাগে। তাছাড়া শনি-রবিবারেই শুধু একটু বেশি রান্না করি। অন্যদিন তো যাহোক কিছু খেয়ে নিই।

উনি হেসে বলেন, তুমি রান্না করতে ভালোবাস আর আমি খেতে ভালোবাসি।

আমি জানি।

স্যার সে কথাও তোমাকে জানিয়েছেন?

আমরা দুজনেই হাসি।

খেয়ে নবেন্দুবাবু সত্যি তৃপ্তিলাভ করলেন। আমার রান্না খেয়ে তন্ময়ও এমনি তৃপ্তিলাভ করত। খাওয়া-দাওয়া শেষে উনি বললেন, ওবেলায় রান্না করো না।…

কেন?

প্যারিসে এসেও শনিবার সন্ধ্যা বাড়ির মধ্যে কাটাব?

না, সেদিন সন্ধ্যায় নবেন্দুবাবু আমার ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে বন্দী রইলেন না। বেরিয়ে পড়লেন। একলা নয়, আমাকে সঙ্গে নিয়েই বেরুলেন।

যেসব ভারতীয়রা নিজের স্ত্রীর হাত ধরে রাস্তায় চলাফেরা করতেও অভ্যস্ত নয়, যারা বেশি চা খাওয়া পর্যন্ত পছন্দ করেন না, তারাই প্যারিসে এসে বোতল বোতল শেরি-স্যাম্পেন বা ওয়াইন খান আর বিবস্ত্রা সুন্দরী যুবতীর নাচ দেখেন।

কলকাতার বিখ্যাত অধ্যাপক নবেন্দুবাবুও ব্যতিক্রম হলেন না। নাচ দেখতে দেখতে উনি আমাকে বললেন, যাই বল কবিতা, এরা প্রাণ খুলে আনন্দ করতে জানে। আর এরা প্রাণভরে আনন্দ করে বলেই প্রাণভরে কাজও করে।

আমি বললাম, বোধহয় প্রাণভরে কাজ করে বলেই এমন আনন্দ করতে পারে।

আরো এক বোতল ওয়াইন পেটে যাবার পর নবেন্দুবাবু হঠাৎ আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, কবিতা, আমরা খুব কাজও করব, খুব আনন্দও করব।

আমি বুঝলাম, উনি স্বাভাবিক নেই। তাই হেসে বললাম, নিশ্চয়ই আপনি কাজও করবেন, আনন্দও করবেন।

প্যারিসে এসে প্রথম সন্ধ্যা ওর ভালোই কাটল। নাচ-গান খানা-পিনা সেরে আমরা যখন অ্যাপার্টমেন্টে ফিরলাম, তখন রাত প্রায় দুটো।

অ্যাপার্টমেন্টের মধ্যে ঢুকতেই উনি আমার কোমর জড়িয়ে কাছে টান দিয়ে বললেন, কবিতা, তুমি বড় ভালো মেয়ে।

আমি হেসে বললাম, ধন্যবাদ। ওর হাতে টান দিয়ে বললাম, আমাকে ছেড়ে দিন। আমি শোবার ব্যবস্থা করি।

এই সন্ধেবেলায় শোবে?

এখন অনেক রাত হয়েছে।

সো হোয়াট? হ্যাভ ইউ গট এনি ড্রিক?

নো।

প্যারিসে থাকো আর বাড়িতে একটা বোতল রাখ না?

না। এবার আমি একটু জোর করেই ওর হাতটা সরিয়ে দিলাম। বললাম, আপনি অনেক ড্রিঙ্ক করেছেন। এবার আপনি জামাকাপড় পাল্টে শুয়ে পড়বেন।

নো ডার্লিং! আই মাস্ট নট শিপ টু নাইট।

তাহলে আপনি এ ঘরে বসে থাকুন; আমি ঘরে শুতে যাচ্ছি।

ঠিক আছে, চল, আমি তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিই।

আমার এমনিই ঘুম আসবে। আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না।

তোমার মতো সুন্দরীকে ঘুম পাড়াতে আবার কষ্ট হয় নাকি? বরং…

আঃ! কী যা তা বলছেন?

আই অ্যাম সরি কবিতা।

যাই হোক প্রায় জোর করেই ওকে শুইয়ে দিলাম। মাঝখানের দরজা লক করে আমিও শুয়ে পড়লাম। তখন প্রায় তিনটে বাজে।

পরের দিন ঘুম ভাঙল বেশ বেলায়। ও ঘরে নবেন্দুবাবু তখনো ঘুমোচ্ছেন। আমি বাথরুম থেকে ঘুরে এসে চা খেলাম। কাপড়-চোপড় বদলেই কিছু কেনাকাটার জন্য দরজা লক করে বেরিয়ে পড়লাম। কিছু সজি আর চিকেন কিনে ফিরে এসে দেখি, নবেন্দুবাবু ড্রইংরুমে বসে আছেন।

আমাকে দেখেই জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি সংসারের কাজকর্ম আরম্ভ করে দিয়েছ?

একটু কেনাকাটা করতে বেরিয়েছিলাম।

চা খাওয়াবে?

নিশ্চয়ই।

চা খেতে খেতেই নবেন্দুবাবু বললেন, কবিতা তুমি আমাকে ক্ষমা কর।

আমি হেসে জিজ্ঞাসা করলাম, কী অপরাধ করেছেন যে ক্ষমা চাইছেন?

কাল রাত্রে নিশ্চয়ই তোমার সঙ্গে খুব স্বাভাবিক ব্যবহার করিনি।

আমি হাসতে হাসতেই জিজ্ঞাসা করলাম, কী করে জানলেন আপনি খুব স্বাভাবিক ব্যবহার করেননি?

আমার লেখাপড়া-বিদ্যাবুদ্ধির পরিচয় বাইরের লোকজন জানতে পারে কিন্তু আমার আসল স্বভাব চরিত্রের খবর শুধু আমিই জানি।

এ কথা তো সবার বেলায় প্রযোজ্য।

তা ঠিক কিন্তু সবার স্বভাব-চরিত্রের তো তেমন কিছু উল্লেখযোগ্য খবর থাকে না-আমার আছে।

আমি আর প্রশ্ন করি না। চুপ করে থাকি। চা খাই। নবেন্দুবাবু বলেন, আমি বিশেষ ড্রিঙ্ক করি না। কাল ড্রিঙ্ক করলাম প্রায় বছর খানেক বাদে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ।

এবার একটু হেসে বললেন, গত বছর সিমলা ইনস্টিটিউট অব হায়ার স্ট্যাডিজে গিয়েছিলাম দেড় মাসের জন্য। অস্ট্রেলিয়ার এক অল্পবয়স্কা অধ্যাপিকাও তখন ওখানে এসেছিলেন। কদিনের ছুটিতে চাইল বেড়াতে গিয়ে হঠাৎ আমার হোটেলেই ওর সঙ্গে দেখা…

আমি বললাম, ওই ভদ্রমহিলার সঙ্গে তখন ড্রিঙ্ক করেছিলেন বুঝি?

নবেন্দুবাবু বললেন, শুধু ড্রিঙ্ক করিনি, তিনটে রাতও ওরই সঙ্গে কাটাই।

আমি পট থেকে ওর কাপে চা ঢেলে দিই। উনি চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে বললেন, আমাদের দেশে বদমাইসি করার চাইতে বদমাইসি করার খবর ছড়িয়ে পড়াকে সবাই ভয় করে। আমিও করি। তাই আমিও এসব কথা কখনও কাউকে বলি না।

তাহলে আমাকে বলছেন কেন?

ঠিক কী কারণে বলছি, তা বলতে পারব না; তবে তোমাকে বলতে ইচ্ছে করছে।

কেন?

উনি একটু হেসে বললেন, ডক্টর সরকার আর অমিয়র কাছে তোমার এত প্রশংসা শুনেছি যে মনে মনে তোমার সম্পর্কে অনেক কিছু ভেবেছিলাম।

কী ভেবেছিলেন?

সে আর শুনতে চেয়ো না। তোমাকে এয়ারপোর্টে দেখেই আমার রক্ত টগবগ করতে শুরু করে। তারপর সারাটা দিন অনেক কিছু ভেবেছি।

আমি হাসি। জিজ্ঞাসা করি, তারপর?

বদ মতলব মাথায় নিয়েই কাল সন্ধেবেলায় তোমাকে নিয়ে বেরিয়েছিলাম। কিন্তু তোমার সংযম দেখে বুঝলাম, তোমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবার ক্ষমতা আমার হবে না।

ওর কথা শুনে আমি একটু জোরেই হাসি। 

না, না, কবিতা, হাসির কথা নয়। যে মেয়ে ওয়াইন খেয়ে ওই রকম অশ্লীল ও উত্তেজনা পূর্ণ নাচ দেখতে দেখতেও নিজেকে সংযত রাখতে পারে, তাকে এদ্ধা করা যায়, ভালোবাসা যায় কিন্তু তাকে নিয়ে বদমাইসি করা যায় না।

বললাম, আমাকে শ্রদ্ধা করারও দরকার নেই, ভালোবাসাও দরকার নেই।

এবার নবেন্দুবাবু একটু হেসে বললেন, ওটা আমার মনের ব্যাপার। তারপর উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, যাই হোক, তোমাকে অনেক কিছু বলব।…

কী দরকার?

হাজার হোক তুমি একলা থাকো। তোমার জানা দরকার, তোমার আশেপাশে আমার মতো হিংস্র নেকড়েও ঘোরাঘুরি করছে।

সত্যি রিপোর্টার, নবেন্দুবাবু আমার এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। যে কালো মেয়েটির দুটি বড় বড় ঘন কালো চোখের আলোয় তুমি অন্ধকার পথ দেখতে পেয়েছ, সে আর তুমি আমার প্রাণভরা ভালোবাসা নিও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *