জুন মাসের মাঝামাঝি অরুর চাকরি হয়ে গেল। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে পোস্টিং। একটি বিদেশী এনজিওর আস্থায়ী চাকরি। চাকরির মেয়াদ তিন থেকে চার মাস। একুশ’শ টাকা বেতন। খাওয়াথাকা ফ্রি। হালুয়াঘাটে গারো ছেলেমেয়েদের জন্যে স্কুল করা হয়েছে। সেই স্কুলে টিচার। অংক, বাংলা, ইংরেজির সঙ্গে সঙ্গে হাতের কাজ সেলাই এসব শেখাতে হবে।
টুকু বলল, আপা আজ দিনের মধ্যে ওদের জানাতে হবে তুমি যাবে কী যাবে না। যদি যাও তাহলে আজই ঢাকার হেড অফিসে জয়েন করবে। আজ থেকেই তোমার বেতন শুরু হবে। তুমি যাবে?
বুঝতে পারছি না।
টুকু বিরক্ত হয়ে বলল, সবই তো বুঝিয়ে বললাম, আর কী বুঝতে পারছি না?
চাকরি করতে পারব কী পারব না।–এইটাই বুঝছি না। আমাকে দিয়ে কী এইসব হবে?
অন্য মেয়েরা কিভাবে করে?
আমি কী অন্য মেয়েদের মত?
কেন, তুমি আলাদা কীভাবে?
তুই বুঝতে পারছিস না। বাসা থেকে ওরা ছাড়বে কেন? এত দূরে চাকরি, ঢাকায় হলেও একটা কথা ছিল।
তুমি তাহলে চাকরি নেবে না?
নেব না তো বলিনি, ভাবছি।
যা ভাবাভাবির ঘণ্টাখানিকের মধ্যে ভেবে নাও। বাসার কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। বাসার সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক।
টেম্পোরারি চাকরি। চার মাস পর ছাড়িয়ে দেবে।
চার মাসের অভিজ্ঞতা হল না, এই অভিজ্ঞতা তখন কাজে লাগবে। এটা দেখিয়ে অন্য চাকরি জোগাড় করব।
কাউকে কিছু বলব না?
না।
তুই বলছিস সত্যি সত্যি আমার চাকরি হয়ে গেছে? আমার কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছে না।
তুমি মনস্থির কর আপা। কী করবে ভেবে ফেল। অনেক কষ্টে এই চাকরি পাওয়া গেছে।
চল যাই। চাকরি করব কী করব না যেতে যেতে ঠিক করব।
অরু ভেবেছিল বিরাট কোনো অফিস হবে। দেখা গেল সে রকম কিছু না। ধানমণ্ডিতে একতলার ছোট্ট বাড়ি। বসার ঘর বেতের সোফা দিয়ে সাজানো। বসার ঘরে শিশুদের হাসিমুখের বড় বড় কিছু পোস্টার। প্রতিটি পোস্টারের নিচে লেখা–এই শিশুটি যুদ্ধ চায় না। সে আনন্দে বাঁচতে চায়। বসার ঘরে আরো কয়েকজন মহিলা বসে আছেন। টুকু অরুকে তাদের পাশে বসিয়ে রেখে চলে গেল। ভেতরে খবর দেয়া হয়েছে। যথাসময়ে ডাক পড়বে। যে ভদ্রলোক কথা বলবেন তার নাম ড. বরাট গোরিং। ফিলসফির অধ্যাপক ছিলেন। বর্তমানে এই সংস্থার প্রধান। অরু বলল, আমি তো ইংরেজি বলতে পারি না, উনার সঙ্গে কথা বলব কী করে?
উনি বাংলা জানেন। তোমার চেয়ে ভাল বাংলা বলেন।
অরু অস্বস্তি নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। ঘণ্টাখানিক বসে থাকার পরও তার ডাক পড়ল না। অরুর ধারণা হল ভদ্রলোক হয়ত তার কথা ভুলেই গেছেন। তার কী উচিত চলে যাওয়া? না-কি তার উচিত যাবার আগে ভদ্রলোকের সঙ্গে নিজেই যেচে গিয়ে কথা বলা?
মিস শাহানা বেগম কী আপনার নাম?
অরু, শূন্যদৃষ্টিতে ভদ্রলোকের দিকে তাকাল। শাহানা বেগম তারই নাম। এই নামে কেউ কখনো ডাকে না। সবাই অরু ডাকে। এই বিদেশীর মুখে শাহানা নামটা কি রকম অচেনা লাগছে। আর এ রকম একজন বিদেশী এত সুন্দর করে বাংলা বলছে কিভাবে?
আপনার নাম কী মিস শাহানা?
জি।
আমি এতক্ষণ আপনাকে বসিয়ে রেখেছি সেই কারণে আপনি কী আমার ওপর রাগ হয়েছেন?
জি-না। আমি রাগ করিনি। রাগ করব কেন?
আপনি কী আমার বাংলা বুঝতে পারছেন?
পারছি। আপনার খুব সুন্দর বাংলা।
আসুন আমার ঘরে আসুন।
অরু অবাক হয়ে লক্ষ্য করল শুরুর অস্বস্তির কিছুই এখন আর তার নেই। গাঢ় নীল রঙের চকচকে হাওয়াই শার্ট পরা এই বিদেশীকে তার ভাল লাগছে। দূরের কেউ বলে মনে হচ্ছে না। এ রকম মনে হবার কারণ কী? সে চমৎকার বাংলা বলছে–এটাই কি একমাত্র কারণ? ন-কী তার গলার স্বরের আন্তরিক ভাব অরুকে আকৃষ্ট করেছে? না-কি ভদ্রলোকের মাথাভর্তি সোনালি চুল? চুলগুলি হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করে।
মিস শাহানা।
জি।
আপনার তাহলে এই ধারণা হয়েছে যে আমি ভাল বাংলা বলি?
জি।
আপনার ধারণা যথাযথ নয়। প্রায়ই আমি ক্রিয়াপদগুলি এলোমেলো করে ফেলি। তাছাড়া আপনাদের বাংলা ভাষার কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যা আমি এখনো বুঝতে পারি না। আমার কাছে খুবই অদ্ভুত মনে হয়।
কী বৈশিষ্ট্য?
যেমন ধরুন দেখা শব্দটির মানে হচ্ছে To see, চোখ দিয়ে দেখা। অথচ আপনার নানানভাবে শব্দটি ব্যবহার করেন–গানটা শুনে দেখি। মিষ্টিটা খেয়ে দেখি। একটু বসে দেখি। গান শোনা, মিষ্টি খাওয়া বা বসার সঙ্গে চোখের কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ প্রতিটি ক্ষেত্রে আপনারা দেখা শব্দটা ব্যবহার করছেন।
অরু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। এভাবে সে কখনো ভাবেনি। সত্যি তো মজার ব্যাপার!
তারপর মিস শাহানা বেগম, বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণা এখন স্থগিত। অন্য বিষয় নিয়ে কথা বলি–চাকরিটি কী আপনার পছন্দ হয়েছে?
জি, হয়েছে।
পছন্দ হবার মত তেমন কিছু নয়। তবু খারাপ লাগবে না, জায়গাটা খুব সুন্দর। তাছাড়া যাদের সঙ্গে আপনি কাজ করবেন তাদের আপনার ভাল লাগবে। আপনি কাজ করবেন শিশুদের নিয়ে। শিশুদের মত সুন্দর আর কিছু তো হয় না। তাই না?
জি অবশ্যই।
এখন বাজছে একটা পাঁচ। চা খবর সময় নয়। তবু যদি আপনি আমার সঙ্গে চা খান আমি খুশি হব। লাঞ্চ করতে বলতে পারছি না। কারণ আমার লাঞ্চের একটি অ্যাপায়েন্টমেন্ট আছে।
অরু, চা খেল। পটে করে চা নিয়ে এসেছিল। ভদ্রলোক অরুকে লজ্জায় ফেলে নিজেই চা বানিয়ে এগিয়ে দিলেন। এটা হয়ত ওদের সাধারণ ভদ্রতা। অথচ কী সুন্দর এই ভদ্রতা।
আমি আপনার অতীত ইতিহাস সবই শুনেছি। আমরা আমাদের কাজের জন্যে আপনার মত মেয়েদের খুঁজে বের করি। আমার অভিজ্ঞতা থেকে দেখছি, আপনার মত মহিলারা সুযোগ পেলেই তাদের অসাধারণ কর্মদক্ষতা দেখানোর চেষ্টা করেন, প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন যে, তারা তুচ্ছ নন।
ভদ্রলোক গাড়ি করে অরুকে বাসায় পাঠালেন। গাড়িতে উঠবার সময়ও একটা কাণ্ড হল, তিনি নিজে এসে দরজা খুলে দিলেন। বললেন, আপনি ইচ্ছা করলে আমার সঙ্গে হালুয়াঘাট যেতে পারেন। আমি আগামী সপ্তাহে বাই রোডে যাব। আর বাই রোডে যেতে না চাইলে ট্রেনে করে চলে যাবেন। আপনার থাকা-খাওয়ার যাবতীয় ব্যবস্থা করে রাখবার জন্য আমি মেসেজ পাঠিয়ে দেব। অরু বলল, আমি আপনার সঙ্গেই যাব। বলেই তার মনে হল যে অন্যায় কোনো কথা বলছে। এরকম কথা তার বলা উচিত হয়নি। ভদ্রলোক কিছু মনে করলেন কি-না কে জানে। কিছু মনে করলে খুব লজ্জার ব্যাপার হবে।
অরু ভেবেছিল তার ঢাকার বাইরে চাকরি করতে যাওয়ার খবরে খুব হৈচৈ হবে। দেখা গেল কোনো রকম হৈচৈ হল না। মিনু বললেন, যা ইচ্ছা কর। আমি কাউকেই কিছু বলব না। জালালুদ্দিন বললেন, অধ্যাপনা অতি উত্তম ধর্ম। পৃথিবীর সবচে বড় দান হচ্ছে বিদ্যা দান। তাছাড়া বেতন ভাল। মনে হচ্ছে খ্রিস্টান করে ফেলবে। ঐ দিকে নজর রাখবি। এই বংশের কেউ খ্রিস্টান হয়ে গেলে লজ্জার সীমা থাকবে না। শুধু তিথি আপত্তি করল। নরম গলায় বলল, এদের সম্পর্কে নানান রকম গুজব আছে আপা। মেয়েদের নিয়ে ফষ্টিনষ্টি করে। ওদের সম্পর্কটা অনেক খোলামেলা, ওরা এটাকে বড় কিছুও মনে করে না।
তুই কী বলছিস আমি যাব না?
তা বলছি না। এখানে থেকেই বা তুমি কী করবে। শুধু বলছি যে, সাবধানে থাকবে।
নিতান্ত কাকতালীয় একটা ব্যাপার ঘটল অরুর হলুয়াঘাট রওনা হবার ঠিক আগের দিন–একটি রেজিস্ট্রি চিঠি এসে উপস্থিত। প্রাপক শাহানা বেগম। প্রেরক আব্দুল মতিন। খাম খুলে দেখা গেল বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্র। ধুপচাঁচা গ্রামের মৌলানা আবু বকর সাহেবের তৃতীয় কন্যা মোসাম্মত নূরুর নাহার বেগম (লাইলীর) সহিত কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের জনাব আব্দুল কুদ্দুস। সাহেবের প্রথম পুত্র আব্দুল মতিনের শুভ বিবাহ। বিবাহ অনুষ্ঠানে সবান্ধব উপস্থিত থাকার জন্যে অনুরোধ করা হয়েছে। অরুকে আহত করবার জন্যেই চিঠি পাঠানো। তবে অরু, আহত হল কি-না বোঝা গেল না। তার চেহারায় মনের অবস্থার কোনো ছাপ পড়ল না।
অরু, হালুয়াঘাট পৌঁছে কোনো খবর দিল না। তিথি পরপর দু’টি চিঠি লিখল–সেই চিঠিরও জবাব এল না। এক মাসের মাথায় টুকু চিন্তিত হয়ে ধানমণ্ডির বাসায় খোঁজ নিতে গেল। ড. গোরিং অফিসেই ছিলেন। তিনি সব শুনে চিন্তিত মুখে বললেন চিঠির জবাব দিচ্ছেন না কেন তা তো বুঝতে পারছি না। তার সঙ্গে গত সপ্তাহেই দেখা হয়েছে। সে বেশ ভাল আছে–এইটুকু বলতে পারি।
চিঠি কী হাতে পৌঁছোচ্ছে না?
না পৌঁছানোর কোনো কারণ নেই। তাছাড়া তোমাদের চিঠি না পেলেও তো সে তার খোঁজ দেবে। দেবে না?
আমার কী মনে হয় জানো–সে নিজেকে আড়াল করে ফেলতে চেষ্টা করছে। পরিচিত জগৎ থেকে লুকিয়ে পড়তে চাইছে। তোমাদের বাংলাদেশী মেয়েরা সামাজিক অমর্যাদার ব্যাপারে খুব সেনসেটিভ। তুমি বরং প্রিপেড টেলিগ্রাম করে দাও। তারপরে যদি জবাব না। আসে নিজেই চলে যাও। হালুয়াঘাট এমন কিছু দূরের জায়গা নয়।
প্রিপেড টেলিগ্রামের জবাব এল। অরু জানিয়েছে–সে ভাল আছে। তার কিছুদিন পর টুকুর কাছে দুই লাইনের চিঠি এল।
টুকু,
আমি ভাল আছি। কাজ শুরু করেছি। আমাকে নিয়ে শুধু শুধু কেউ যেন দুশ্চিন্তা না করে।
ইতি— অরু আপা।
অরুর সঙ্গে তার পরিবারের এই হচ্ছে শেষ যোগাযোগ। এই পরিবারের সদস্যরা অরুর আর কোনো খোঁজ পায়নি। টুকু এবং গ্রিন বয়েজ ক্লাবের সেক্রেটারি বজলুর রহমান খুঁজে বের করার অনেক চেষ্টা করল। তেমন কিছু জানা গেল না। এই এনজিও কাজকর্ম গুটিয়ে স্বদেশে চলে গেছে। এখানকার কেউ তেমন কিছু বলতে পারে না। ড. গোরিং একজন বাঙালি মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে দেশের বাইরে চলে গেছেন–এইটুকু জানা গেল। তবে সেই একজন অরু কী-না তা কেউ নিশ্চিত হয়ে বলতে পারল না। নিউইয়র্ক এনজিওর হেড অফিসে যোগাযোগ করেও কিছু জানা গেল না। হেড অফিস জানাল ড. গোরিং এখন আর তাদের সঙ্গে কর্মরত নয়। কাজেই তারা তার বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে কিছু বলতে পারছে না।
শুধু হীরুর পীর সাহেব হীরুর কান্নাকাটিতে গলে গিয়ে জ্বীনের মারফত খবর এনে দিলেন–অরু ভালই আছে। তার একটি কন্যাসন্তান হয়েছে। মাতা ও কন্যা সুখেই আছে। পীর সাহেবের কোনো কথাই হীরু অবিশ্বাস করে না। এইটা করল। ক্ষীণ স্বরে বলল, কী বললেন স্যার? কন্যাসন্তান হয়েছে?
হ্যাঁ বাবা হয়েছে। জ্বীনের মারফত খবর পেয়েছি।
জ্বীন কোনো ভুল করেনি তো? মানে মিসটেক। মানুষ যেমন ভুল করতে পারে জ্বীনও নিশ্চয়ই পারে।
তুমি এখন যাও হীরু।
অন্য একটা জ্বীনকে দিয়ে যদি স্যার একটু ট্রাই করেন মানে আমরা খুব কষ্টে আছি।
তুমি বিদেয় হও তো। হীরু মুখ কালো করে চলে এল। এই প্রথম পীরের আস্তানা থেকে বের হয়ে সে মনে মনে বলল—শালা ফটকাবাজ।