১৯. অবন্তিকে লেখা হাফেজ জাহাঙ্গীরের চিঠি

অবন্তিকে লেখা হাফেজ জাহাঙ্গীরের চিঠি–

পত্নী মায়মুনা,

আসসালামু আলায়কুম।

পর সমাচার এই যে, আমি বাতেনি পদ্ধতিতে সংবাদ পেয়েছি যে, তোমার দাদাজান ইন্তেকাল করেছেন। আল্লাহপাক তাঁর উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন বিধায় উনি সম্মানিত স্থানে অবস্থান করছেন।

আমার এই জাতীয় কথাবার্তায় তোমার বিশ্বাস নাই, তা আমি জানি। তোমার বিশ্বাস আনার চেষ্টাও আমি করব না। তবে একটি বিষয় তোমাকে জানাতে চাই—আমি নবি-একরিমের (দঃ) একটি সুন্নত সারা জীবন পালন করেছি। তা হলো মিথ্যা না বলা। আমার একার চেষ্টায় তা সম্ভব হয় নাই। আল্লাহপাকের অসীম করুণায় সম্ভব হয়েছে।

কাতল মাছে বিষ মিশানোর বিষয়ে তুমি আমাকে কঠিন অভিযোগে অভিযুক্ত করেছিলে। তোমার অভিযোগ ছিল বিষ মিশানোর বিষয়টি মিথ্যা। আমি দরবারশরিফের ভাব উজ্জ্বল করার জন্যে মিথ্যাচার করেছি। মায়মুনা! তোমার অভিযোগ শুনে আমি মনে কষ্ট পেয়েছিলাম, কিন্তু তর্কে যাই নাই। আমি তর্ক-বিতর্ক পছন্দ করি না।

আল্লাহপাক আমাকে অভিযোগ থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করেছেন। ভৈরবের যে বাবুর্চি এই কাজ করেছিল সে অপরাধ স্বীকার করে তওবা করার জন্যে আমার কাছে এসেছিল। আমি দরবারশরিফের বাবুর্চি হিসাবে তাকে নিয়োগ দিয়েছি। কোনো-একদিন তার সঙ্গে তোমার নিশ্চয়ই দেখা হবে। তুমি ঘটনা বিস্তারিত জানবে।

মায়মুনা! তোমাকে নিয়ে একটি স্বপ্ন দেখে মন অস্থির হয়ে ছিল। স্বপ্নের তাবীর’ বের করার পর অস্থিরতা কমেছে। আগে স্বপ্নটা বলি, তারপর তার তাবীর বলব।

শুক্লপক্ষের রাতে ফজরের আজানের আগে আগে স্বপ্নটা দেখি। স্বপ্নে তুমি হুজরাখানায় মুসুল্লিদের উদ্দেশে কী যেন বলছ। মুসুল্লিরা আগ্রহ নিয়ে তোমার কথা শুনছেন। মুসুল্লিদের মধ্যে আমিও আছি। আমি অবাক হয়ে দেখছি, তুমি সম্পূর্ণ নগ্নগাত্র। শরীরে একটা সুতাও নাই।

এই ধরনের স্বপ্ন দেখলে অস্থির হওয়াটা স্বাভাবিক। আমি অল্প সময়ে স্বপ্নের তাবীর বের করে মনে প্রভূত শান্তি পেয়েছি।

স্বপ্নের তাবীর হলো—পোশাক মানুষের আবরণ। পোশাক মানুষকে ঢেকে রাখে। পোশাক হলো পর্দা। তুমি সবার সামনে উপস্থিত হয়েছ পর্দা ছাড়া। অর্থাৎ তুমি কোনোরকম ভনিতা ছাড়া নিজেকে প্রকাশ করেছ। আলহামদুলিল্লাহ।

বাতেনি জগতে সংবাদ আদানপ্রদান হয় প্রতীকের মাধ্যমে। এইসব প্রতীকের ব্যাখ্যা জটিল হয়ে থাকে। আমার জানামতে একমাত্র বড় পীর সাহেবই প্রতীকের নির্ভুল ব্যাখ্যা করতে পারতেন।

মায়মুনা! বাতেনি জগতের নানান বিষয় নিয়ে তোমার সঙ্গে আলাপ করার আমার শখ ছিল। যেমন, মানুষের বেলায়েতি ক্ষমতা। যা আমার পিতার ছিল, আমার নাই। তোমাকে আমার সঙ্গে জোর করে বিবাহ দিবার কারণে তুমি উনার প্রতি নারাজ। মুখে তুমি কোনোদিন কিছু না বললেও আমি তা বুঝতে পারি।

মায়মুনা! আমার পিতার উপর থেকে তুমি নারাজি ভাব দূর করো। উনার মতো জ্ঞানী মানুষ আমি দেখি নাই। উনি হাদিস, তফছির, ফেকাহ, মন্তেক, হেকমত, বালাগত, উছুল, আকায়েদ এবং ফরায়েজ জ্ঞানে জ্ঞানী ছিলেন। উনি চোখের সামনে ভবিষ্যৎ দেখতে পেতেন। তোমার ভবিষ্যতও উনি নিশ্চয়ই দেখেছিলেন।

দরবারশরিফে জ্বিনের আগমন এবং জ্বিন কর্তৃক দোয়াপাঠের কার্যক্রম তিনি শুরু করেছিলেন। আমি জানি এই বিষয়ে অনেকের মতো তোমার মনেও সন্দেহ আছে। এই বিষয়ে আমার পিতার কী বক্তব্য তা তোমাকে জানাতে ইচ্ছা করি। উনাকে জ্বিন-বিষয়ক কোনো প্রশ্ন করা হলে উনি মহাকবি খসরুর একটি শায়ের পাঠ করতেন। শায়েরটি হলো—

‘খল্ক মি গোয়েদ কে খসরু ভুল পুরস্তি মিকুনদ আরে আরে মিকুম বা খলকে আলম কার নিস্ত।’

এর অর্থ ‘লোকে বলে খসরু ভূতের পূজা করে। সত্যই। আমি তা-ই করি। ইহা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।‘

প্রিয় মায়মুনা! আমার ধারণা আমার পিতারও কিছু ব্যক্তিগত ব্যাপার ছিল। যেমন, হুজরাখানায় জ্বিনের আগমন। জ্বিন কর্তৃক মিলাদ পাঠ। জ্বিনের আগমন এবং মিলাদ পাঠ যে ভুয়া তা আমি অল্পবয়সেই ধরতে পারি। আকিকুন্নিসা নামের এক খর্বাকৃতি কুদর্শন তরুণী (মহিলা হাফেজিয়া মাদ্রাসার ছাত্রী) পাঞ্জাবি পরিধান করে জ্বিন সেজে লাফালাফি করত। শূন্যে লাফ দেওয়ার তার অস্বাভাবিক ক্ষমতা ছিল। দূর থেকে দেখলে মনে হতো সে শূন্যে ভাসছে।

পিতার মৃত্যুর পর আমি জ্বিন আনা খেলা বন্ধ করেছি। তবে মায়মুনা, জ্বিন অস্বীকার করবে না। পবিত্র কোরানশরিফে অনেকবার জ্বিনের কথা বলা হয়েছে। পবিত্র কোরানশরিফে জ্বিন নামে একটি সূরাও আছে। আমি আমার জীবনে দুইবার জ্বিনের সাক্ষাৎ পেয়েছি। জাত হিসাবে এরা উগ্র এবং খানিকটা নির্বোধ। তোমার সঙ্গে যদি কখনো দেখা হয় তাহলে এই বিষয়ে বলব ইনশাল্লাহ।

তোমাকে অতি দীর্ঘ পত্র লিখলাম, কারণ আমার মন দুর্বল। মন দুর্বল অবস্থায় মানুষ বাচাল হয়। চিঠিপত্রেও বাচালতা প্রকাশ পায়। আমার দুর্বল মনের কারণ হলো—আমি অসুস্থ। প্রচণ্ড কাশি হয়। কাশির সঙ্গে মাঝে মাঝে রক্ত যায়। আমার ধারণা যক্ষা। আমি কোনো চিকিৎসা নিচ্ছি না। আল্লাহপাকের কাছে নিজেকে সোপর্দ করেছি। আল্লাহ শাফি। আল্লাহ কাফি।

ইতি
হাফেজ জাহাঙ্গীর।

 

দীর্ঘ চিঠির অতি সংক্ষিপ্ত জবাব অবন্তি পাঠাল। তার চিঠি–

হাফেজ সাহেব,

আমার বাবা ঘোর নাস্তিক। তিনি কোনোকিছুই বিশ্বাস করেন না। তবে মানুষের ক্ষমতায় বিশ্বাস করেন। চিকিৎসাবিজ্ঞান মানুষের বিশাল অর্জন। আপনি চিকিৎসা নেবেন, আপনার প্রতি এই আমার অনুরোধ। আরেকটা কথা, মায়মুনা সম্বােধনে কখনোই আমাকে চিঠি লিখবেন না। আমি মায়মুনা না, আমি অবন্তি।

ইতি
অবন্তি।

 

হাফেজ জাহাঙ্গীরের চিঠি পোস্ট করার এক ঘন্টার মধ্যে অবন্তি তার ঘোর নাস্তিক বাবার এক আস্তিক পত্র পেল। তার চিঠিটি এই–

মা অবন্তি
কুটকুট, ভুটভুট, মুটমুট।

তোমার মায়ের সেবাযত্ন এবং মুখের কঠিন বাক্যবাণে আমার শরীর অনেকখানি সেরেছে। ডাক্তার বলেছে, লিভার ফাংশন প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। ডাক্তার অবাক, আমিও অবাক। আমি ভেবেছিলাম শেষটায় লিভার সিরোসিস হবে। তারপর মহান মৃত্যু। বন্ধু খালেদ মোশাররফ গিয়েছে যেই পথে, আমিও যাব সেই পথে। তার মৃত্যু হয়েছে গুলি খেয়ে। আমার মৃত্যু হবে সিরোসিস খেয়ে।

কয়েকদিন আগে শুনলাম কর্নেল তাহেরও বন্দি। ব্যাপারটা কী? কর্নেল তাহেরের পরিবারের কাছে বাংলাদেশ ঋণী। এই পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। তবে আমার মনে করায় কিছু আসে যায় না। দেশের আমজনতা কী ভাবছে তাতেও কিছু যায় আসে না। শুধু যায় আসে রাষ্ট্রচালকেরা কী ভাবছেন। তবে তাদের ভাবনা রাজনৈতিক ভাবনা। এই ভাবনার সঙ্গে আমরা কেউ যুক্ত না। যাক রাজনীতি, অন্য বিষয় নিয়ে কথা বলি।

গত বুধবার সকালে তোমার মা প্লেটে করে আমাকে সাত রকমের ফল কেটে দিল। সে নিউট্রিশনের কোনো-এক ম্যাগাজিনে পড়েছে যে প্রতিদিন সাত রকমের ফল খায় তাকে কোনো রোগব্যাধি স্পর্শ করে না। যে সাত রকমের ফল আমাকে দেওয়া হলো তার তালিকা

একটি আপেল।

পাঁচটা লাল আঙুর।

একটি কমলা।

একটি কিউই।

একটি পীচ।

এক ফালি আনারস।

এক ফালি গুয়ানা বানা (গুয়েতেমালার ফল)।

ফলগুলির দিকে তাকিয়ে তোমার নাস্তিক বাবার মাথায় আস্তিক এক চিন্তা এসেছে। সেই চিন্তাটা তোমার সঙ্গে শেয়ার করি।

এই সুমিষ্ট ফলগুলি ফলদায়িনী গাছের বংশবিস্তার ছাড়া কোনো কাজে আসছে না। ফলগুলির লক্ষ্য মানুষ এবং পাখি। পশুরা ফল পছন্দ করে না। গাছেরা কি জানে এই ফল সে কেন দিচ্ছে? অবশ্যই জানে না। তাহলে অন্য কেউ জানে। যার ইশারায় ঘটনা ঘটছে। পৃথিবীতে পাখি ও মানুষের আসার আগেই ফলদায়িনী বৃক্ষরাজি এসেছে। অর্থাৎ কেউ একজন পাখি ও মানুষের আহারের ব্যবস্থা করে রেখেছেন।

মা শোনো, এখন আমার মাথায় বই লেখার এক চিন্তা এসেছে। বইয়ের নাম An Atheist’s God। বইয়ের প্রথম লাইন লিখে ফেলেছি। যে-কোনো গ্রন্থের প্রথম লাইন লেখাটাই সবচেয়ে দুরূহ কর্ম। প্রথম লাইনটি হলো—Every creation started from zero, is it so?

ইতি তোমার বাবা
নাস্তিক নাম্বার ওয়ান
আস্তিক নাম্বার ওয়ান।

 

হাফেজ জাহাঙ্গীর অবন্তির চিঠির নির্দেশের কারণেই ময়মনসিংহে ডাক্তার দেখাতে গেলেন। অল্পবয়সী ডাক্তার নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বললেন, মওলানা সাহেব, আপনার জন্যে একটি দুঃসংবাদ আছে।

হাফেজ জাহাঙ্গীর বললেন, আমার কি টিবি হয়েছে?

ডাক্তার বললেন, টিবি হওয়া কোনো দুঃসংবাদ না। টিবির চিকিৎসা আছে। আমার ধারণা আপনার ফুসফুসে ক্যানসার হয়েছে।

হাফেজ জাহাঙ্গীর বললেন, ক্যানসারের কি চিকিৎসা নাই?

ডাক্তার বললেন, আছে। সেই চিকিৎসা ফুসফুস ক্যানসারে প্রায়শই কাজ করে না। আপনি ঢাকায় যান, ক্যানসার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যান।

হাফেজ জাহাঙ্গীর ঢাকায় গেলেন না। হুজরাখানায় ফিরে এলেন। তাকে খুব বিচলিত মনে হলো না। হুজরাখানার কাজকর্ম আগের মতোই চলতে লাগল। প্রতি ওয়াক্ত নামাজের শেষে বিশেষ এক দোয়ায় তিনি বলতে লাগলেন, হে আল্লাহপাক, তুমি আমার জন্যে যা নির্ধারণ করে রেখেছ তা-ই আমার জন্যে যথেষ্ট।

এই সময়ে হাফেজ জাহাঙ্গীরকে নিয়ে কিছু গল্প গাঁয়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। একটি গল্প উল্লেখ করা যেতে পারে।

কার্তিক নামের মধ্যবয়স্ক মানুষ। পেশায় স্বর্ণকার। সে ঢাকায় যায় স্বর্ণ কিনতে। তার সঙ্গে আঠার হাজার টাকা। সে পড়ে ছিনতাইকারীদের হাতে। তার সর্বস্ব খোয়া যায়। ছিনতাইকারীরা তার তলপেটে ছোরা মেরে তাকে রাস্তার পাশে নর্দমায় ফেলে যায়।

কার্তিক তলপেটে হাত রেখে বলতে থাকে, বাবা হাফেজ জাহাঙ্গীর, আমাকে বাঁচান। এই সময় সে দেখে হাফেজ জাহাঙ্গীর তার পাশে দাঁড়ানো। হাফেজ জাহাঙ্গীর বললেন, চোখ বন্ধ করে আমার হাত ধরেন। কার্তিক তা-ই করল। একসময় হাফেজ জাহাঙ্গীর বললেন, চোখ মেলুন।

কার্তিক চোখ মেলে দেখে সে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ইমার্জেন্সির বারান্দায় শোয়া। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার চিকিৎসা শুরু হয়। এগার দিনের মাথায় সে সুস্থ হয়ে গ্রামে ফিরে এই গল্প জনে জনে বলতে শুরু করে।

 

এক বিষুদবার রাতে হাফেজ জাহাঙ্গীর কার্তিককে ডেকে পাঠালেন।

কার্তিক এসে ষষ্ঠাঙ্গে প্রণাম করল। হাফেজ জাহাঙ্গীর বললেন, আপনি যে গল্পটা জনে জনে বলে বেড়াচ্ছেন, গল্পটা কি সত্যি?

কার্তিক বলল, যদি সত্যি না হয় তাহলে যেন আমার মাথায় বজ্রাঘাত হয়। আমি যেন নির্বংশ হই।

হাফেজ জাহাঙ্গীর বললেন, এমন কঠিন শপথে যাবেন না। আপনার গল্প সত্যি না। সত্যি হলে আমি জানতাম। আপনি প্রবল ঘোরের মধ্যে আমাকে দেখেছেন। অন্য কেউ আপনাকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছে। আমি না।

কার্তিক বলল, আপনি আমাকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছেন। আমার যে হাত আপনি ধরেছিলেন সেই হাতে এখনো আতরের গন্ধ। বাবা! আপনি আমার হাত তাঁকে দেখেন।

হাফেজ জাহাঙ্গীর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, মানবজাতির স্বভাব হচ্ছে সে সত্যের চেয়ে মিথ্যার আশ্রয়ে নিজেকে নিরাপদ মনে করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *