১৯৪৭: বিভাজনের দ্বিধা

১৯৪৭: বিভাজনের দ্বিধা

ইমামুদ্দীনের নেতৃত্বে কাশ্মীরিরা মহারাজার বাহিনীকে প্রতিরোধ করেছিল ১৮৪৬ সালে। কয়েক মাস কাশ্মীর ছিল স্বাধীন। কিন্তু, ব্রিটিশ সৈন্যের সহায়তায় মহারাজার বাহিনী হয়েছিল সফল। এরপর নিষ্ঠুর শোষণের বিরুদ্ধে বারবার বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল রাজ্যের নাগরিকরা। দ্বিতীয় দফায় মহারাজার সৈন্যবাহিনী থেকে মুসলিম সৈন্যদের নিরস্ত্রীকরণের এবং জম্মুতে মুসলিম হত্যার ঘটনায় পুঞ্চ এলাকায় বিদ্রোহ শুরু হয়। তৃতীয় প্রতিরোধ হয় শাল (চাদর) শ্রমিকদের দ্বারা। অতিরিক্ত কর আরোপের প্রতিবাদে ১৮৬৫ সালে শাল তাঁতিদের সেই বিদ্রোহে ২৮ জনের মৃত্যু হয়।

১৯২৫ সালে রেশম চাষিরা বিদ্রোহ করেন। এসব বিদ্রোহ ও প্রতিরোধ ছিল বিভিন্ন অঞ্চলে সীমিত। কিন্তু, এসব প্রতিরোধের চেতনা প্রজন্মান্তরে প্রবাহিত হয়, যা পরে দানা বাঁধে এক ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলনে। ১৯৩১ সালে রাজ্যব্যাপী গণআন্দোলন শুরু হয়। প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল জম্মুতে মহারাজার এক জওয়ানের হাতে কুরআন পোড়নোর ঘটনা থেকে। পরে, সেটা ছড়িয়ে পড়ে শ্রীনগরে। জনতা শুরুতে দাবি করে ওই জওয়ানের বিচার। কিন্তু, পরে আবদুল কাদির নামে এক ব্যক্তি মহারাজার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলেন। তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। জনতা মুক্তি চায়। পুলিশের গুলি চলে। অনেকের প্রাণ যায়। শ্রীনগর জামে মসজিদে লাশ কাঁধে নিয়ে হয় গণমিছিল।) লক্ষণীয়, আন্দোলনের এই পর্যন্ত চিত্র ছিল, হিন্দু কর্তৃত্ববাদী এক রাজার বিরুদ্ধে মুসলিম প্রজাদের বাঁচা-মরার লড়াই।

ধর্মীয় স্বাধীনতার, খাওয়া পরার, নিরাপত্তার জন্য লড়াই। আর প্রজাদের এই ন্যায্য দাবির সঙ্গে সুর মিলিয়েছিল অন্যান্য সম্প্রদায়েরও অনেকে। দ্বিতীয়ত, সেখানকার জনগণের আন্দোলন ছিল, নিজেদের নিপীড়ক শাসকের বিরুদ্ধে এক ন্যায্য শাসনের দাবিতে লড়াই। সেই শাসকও ছিলেন, রাজ্যের ভেতর থেকেই (জম্মু থেকে)। এখানে বহিরাগত ব্রিটিশরা ছিল কেবল সীমিত পরিসরেই দৃশ্যমান। এমনি গণআন্দোলনের পাশাপাশি বদলে যায় বিশ্বব্যবস্থা। ব্রিটিশরা লেজ গোটায় উপমহাদেশ থেকে। বিভাজনের বাদ্য বাজে। প্রশ্ন আসে কোথায় যাবে জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষ? ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্ট অ্যাক্ট, ১৯৪৭ অনুসারে ব্রিটিশ ভারতের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ৫৬২টি প্রিসলি স্টেটকে (আংশিক স্বায়ত্তশাসিত) হয় ভারত অথবা পাকিস্তানে যোগ দিতে হবে। ভারতীয় ভুখণ্ডের মধ্যে থাকা প্রায়

সব স্টেট ভারতে যোগ দেয়। পাকিস্তানের মধ্যে থাকা বেশ কিছু প্রিন্স যোগ দেন পাকিস্তানে। তিনটি স্টেট স্বাধীন থাকার ইচ্ছা পোষণ করে। হায়দারাবাদ, জুনগর এবং জেঅ্যান্ডকে। ভারতের দক্ষিণের হায়দারাবাদ এবং পশ্চিমের জুনগরের প্রিন্স ছিলেন মুসলিম। প্রজাদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল হিন্দুদের। উভয় এলাকায় হিন্দু জনগণ বিক্ষোভ করে ভারতে যুক্ত হওয়ার পক্ষে। ভারতীয় বাহিনী অ্যাকশনে যায়। ফলে উভয় প্রিন্সলি স্টেট ভারতের অংশ হয়। পরে, গণভোটের মাধ্যমে ভারতীয় অ্যাকশনের বৈধতা নিশ্চিত করা হয়।

বিপরীতক্রমে, জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীরের প্রিন্স ছিলেন হিন্দু, জনগণ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। ভৌগোলিকভাবে এর অবস্থান পাকিস্তান ও ভারতের উত্তর সীমান্তে। ভারতীয় আইনবিদ এজি নূরানী লিখেছেন, ‘গণভোট কাশ্মীরের কেবল একটি বিকল্প বা পছন্দের বিষয় নয়, এটা ছিল গণতান্ত্রিক প্রয়োজন। এটা ছিল নৈতিক দাবি। সকল মৌসুমে শ্রীনগরের সঙ্গে বাকি বিশ্বের যোগাযোগের একমাত্র রাস্তা ছিল পুরাতন রাওয়ালপিন্ডি রোড। এবং এখনও সেটি আছে (তবে অচল)। কাশ্মীরের নদীগুলো বয়ে চলে গেছে পাকিস্তানে। সকল ভৌগোলিক ব্যবস্থায় কাশ্মীর পাকিস্তানের সঙ্গে মেলে। গণতান্ত্রিক ফ্যাক্টরও তাই।

চিত্র ৬.১: মহারাজা হরি সিং জুনগর ও হায়দারাবাদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে যার মাধ্যমে সে অঞ্চলগুলো ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। কিন্তু, কাশ্মীরের ক্ষেত্রে গণভোটের সুযোগ জনগণকে কখনোই দেওয়া হয়নি। ফলে, কাশ্মীরের ভাগ্য নির্ধারণের প্রশ্নটি জুগনর ও হায়দারাবাদের মতো হলো না।

ঘটনাপ্রবাহ কাশ্মীরের হিন্দু শাসক মহারাজা হরি সিং শুরুতে স্বাধীন শাসক হিসেবে থাকার চেষ্টা করছিলেন। তিনি নেহরু এবং জিন্নাহর সঙ্গে দেনদরবারও করছিলেন। কাশ্মীরকে তার অধীনে পাওয়ার ব্যাপারে জিন্নাহ ছিলেন যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী। কাশ্মীর তার পকেটে রাখা ‘ব্ল্যাঙ্ক চেক’ বলে তিনি ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু, নেহরুর উদ্বেগ ছিল সীমাহীন। এ কারণেই স্বাধীনতার আগে আগে কাশ্মীরের বিষয়ে জিন্নাহর চেয়ে

নেহরুকে বেশি তৎপর দেখা যায়। মহারাজার ওপর নেহরুর আস্থা ছিল কম। তিনি শেখ আবদুল্লাহর মুক্তি (যিনি ছিলেন মহারাজার কারাগারে বন্দি) চাচ্ছিলেন। নেহরু কাশ্মীরে যাওয়ার জন্য উদ্যোগ নিলেন। ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেন নেহরুকে না পাঠিয়ে নিজেই গেলেন ১৮ই জুন। কিন্তু, মহারাজা মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে দেখা করেননি। সুতরাং, ভাইসরয় ফিরে গেলেন। নেহরুর উদ্বেগ আরও বাড়ল। মাউন্টব্যাটেনের মিশনের সদস্য ক্যাম্পবেল জনসনের মন্তব্য ছিল, ‘গান্ধী ও নেহরু উভয়ই উদ্বিগ্ন ছিলেন যে ফাঁকে মহারাজা আবার স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে না বসে’।

নেহরু নিজে কাশ্মীর যেতে চাইলেন। এবার সরদার প্যাটেল বাধা দিলেন। তিনি চাইলেন গান্ধীজিকে পাঠাতে। স্বাধীনতার ১৩ দিন আগে গান্ধীজির সঙ্গে হরি সিংয়ের দেখা হলো। পাক-ভারত স্বাধীনতার ৩/৪ দিন আগে ১২ই আগস্ট কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রীর (হরি সিংয়ের নিযুক্ত) পক্ষ থেকে একটি টেলিগ্রামে উভয় দেশকে স্ট্যান্ডস্টিল চুক্তি স্বাক্ষরের অনুরোধ জানানো হয়। এর মাধ্যমে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হওয়ার আগে জম্মু-কাশ্মীর দুই দেশের কারও অধীনে যাচ্ছে না এমনটি প্রস্তাব করা হয়। পাকিস্তান এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। কিন্তু, ভারত করেনি। অর্থাৎ, একদিকে ভারতের সক্রিয় তৎপরতা চলছিল, পাকিস্তান কিছুটা নিশ্চিন্ত ছিল যে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল হাতছাড়া হবে না। অন্যদিকে স্ট্যান্ডস্টিল চুক্তি স্বাক্ষর করার কারণে, পাকিস্তানের পক্ষে কাশ্মীরকে আক্রমণের সুযোগ থাকল না।

যে চুক্তিটি স্বাক্ষর না করে ভারত একটি সুযোগ বাকি রেখে দিল। স্পষ্টতই, এই ঘটনা জিন্নাহকে সংশয়াপন্ন করে থাকবে। এরই মধ্যে ১৪/১৫ আগস্ট দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। জম্মু-কাশ্মীরের সীমান্তবর্তী পাঞ্জাব জুড়ে চলছে সংঘাত। হিন্দু-শিখ-মুসলিম হত্যা-অরাজকতা। জম্মুর মুসলিম এলাকাগুলোও একইভাবে সাম্প্রদায়িক টার্গেটের শিকার হতে শুরু করেছে। যার কিছুটা বিবরণ এই অধ্যায়ের শেষে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এসব ঘটনার ধারাবাহিকতায়, ২২ অক্টোবর, ১৯৪৭ পাকিস্তানের নর্থ ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্স থেকে পাঠানরা কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ নিতে আসে।

অনেকেই ব্যাখ্যা করেন, যেহেতু পাকিস্তানের নিয়মিত সেনাবাহিনীর পক্ষে স্ট্যাভস্টিল চুক্তির কারণে সরাসরি কাশ্মীরে আক্রমণের সুযোগ ছিল না তাই তারা নন-স্টেট উপজাতীয় মুসলিম বাহিনীকে পাঠিয়েছে। পাকিস্তানের নিয়মিত সৈন্যবাহিনী তাদের সহযোগিতা করে। তারই প্রতিক্রিয়ায় মহারাজা ভারতের সহায়তা চান। সেই সময়ে মহারাজার জনসমর্থন ছিল সামান্যই। রাজ্যের ব্যাপক জনপ্রিয় নেতা তখন শেখ মুহম্মদ আবদুল্লাহ। সুতরাং, ভারত তার সমর্থন চায়। শেখের সমর্থন নিয়েই মহারাজা ভারতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার চুক্তি করেন। তারপরই ভারতীয় সৈন্যবাহিনী কাশ্মীরের ‘পুনরুদ্ধারে এগিয়ে যায়। ১৯৪৭ সালের ২৬শে অক্টোবর মহারাজা ও লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের স্বাক্ষরিত ইস্ট্রমেন্ট অব একসেশন থেকে এখানে কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করা জরুরি।

‘আমি শ্রীমান ইন্দ্র মাহেন্দ্র রাজরাজেশ্বর মহারাজাধীরাজ শ্রী হরি সিংজী, জম্মু-কাশ্মীর নরেশ তথা তিব্বত আদি দেশাধিপতি, Ruler of Jammu and Kashmir state do hereby execute this my Instrument of Accession and I hereby declare that I accede to the Dominion of India… Nothing in this instrument affects the continuance of my sovereignty in and over this state, or, save as provided by or under this instrument, the exercise of any powers, authority and rights now enjoyed by me as Ruler of this State or the validity of any law at present in force in the state.”)

অর্থাৎ, মহারাজা ভারতে যোগ দিয়েছেন শর্তসাপেক্ষে। অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্ব মহারাজা ভোগ করবেন এমনটিই কথা ছিল। ১৮৪৬ সালে ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে অমৃতসর চুক্তির আওতায় জম্মু-কাশ্মীরকে কিনে নেয়ার সময় তিনটি ক্ষেত্রে মহারাজা পরাধীন ছিলেন। যথা, প্রতিরক্ষা, বিদেশ নীতি ও যোগাযোগ। বাকি সকল অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে মহারাজার স্বায়ত্তশাসন (Residuary sovereignty) দেওয়া হয়েছিল। মূলত ওই তিনটি ক্ষেত্রের কর্তৃত্ব ব্রিটিশদের কাছ থেকে ভারতের কাছে স্থানান্তরিত হয়েছে এর মাধ্যমে। উল্লেখ্য, ১৮৪৬ সালেও মহারাজার এই মালিকানা মেনে নেয়নি জনগণ।

১৯৪৭-ও বলে একই কথা। ১৮৪৬ সালে মাইনুদ্দীনের নেতৃত্বে কিশতোয়ারে প্রতিরোধ মোকাবিলা করতে হয়েছিল মহারাজাকে। ১৯৪৭ সালে তেমন কাউকে মোকাবিলা করতে হয়নি ভারতীয় সৈন্যদের। কারণ, জননেতা শেখ আবদুল্লাহর অলিখিত সমর্থন আদায় করতে সমর্থ হয়েছিলেন নেহরু। স্পষ্টতই কাশ্মীর ভ্যালিতে শেখ আবদুল্লাহ ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী জনপ্রিয়। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এক জনপ্রিয় জননেতার সমর্থন পেয়েও কার্যত জনগণের মন জয় করতে পারেনি ভারত। গণঅনিচ্ছার কথা জওহরলাল নেহরুর অজানা ছিল না। তিনি চুক্তি স্বাক্ষরের আগের দিন ২৫শে অক্টোবর বলেছেন,

‘The question of aiding Kashmir in this emergency is not designed in any way to influence the state to accede to India (5)

এছাড়াও, ভারত সরকার আন্তর্জাতিক মহলকে আশ্বস্ত করেছে একাধিকবার যে, মহারাজার সঙ্গে করা ব্যবস্থা ক্ষণস্থায়ী। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে একটা মুক্ত গণভোটের পর। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে নেহরু গণভোটের প্রকাশ্য ওয়াদা করেছেন। ইতোমধ্যে মুজাফফারাবাদ (বর্তমান আজাদ কাশ্মীর) থেকে শুরু করে বারামুলাসহ জম্মু-কাশ্মীরের অনেক এলাকা মহারাজার হাতছাড়া হয়ে যায়। নর্থ ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টিয়ারের পাঠান গ্রুপগুলো প্রায় শ্রীনগরের কাছাকাছি চলে আসে। যখন অসংখ্য বিশৃঙ্খল মানুষ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র, বলুম-ইত্যাদি নিয়ে আক্রমণ শুরু করে তখন পুরো এলাকায় বিরাজ করে অরাজকতা।

মুজাফফারাবাদসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ পালাতে থাকে। কেউ কেউ আক্রমণকারীদের সমর্থন নিয়ে অবস্থান করে। তাদের মূল টার্গেট ছিল মহারাজার সরকারের উজির-আমলাসহ বিভিন্ন কর্মচারি। মহারাজার নির্দেশ ছিল, লোকদের মুজাফফারাবাদ ছাড়তে না দেওয়া। মুজাফফারাবাদের উজির সেই চেষ্টাই করেছিলেন। কিন্তু, তিনিই নিহত হন নিজের বাংলোতে আক্রমণকারিদের গুলিতে। সরকারি বাংলো পুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। মহারাজা তখন শ্রীনগরে ছিলেন। তিনি ও তার স্ত্রী সেখান থেকে আত্মরক্ষার জন্য জম্মু চলে যান। একই সময়ে জম্মুর বেশ কয়েকটি জেলায় ব্যাপক হারে মুসলিম নাগরিক হত্যা ও বিতাড়নের ঘটনা ঘটে।

স্পষ্টতই, মুজাফফারাবাদে মহারাজার প্রশাসনের অসহায়ত্ব বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না। মহারাজা প্রতিরক্ষার বিষয়ে সচেতন ছিলেন না বলেই মনে হয়। কারণ, তার রাজ্যের প্রতিরক্ষা ও বিদেশনীতিতে তার অধীনে ছিলই না। এর প্রমাণ মেলে কৃষ্ণা মেহতার বর্ণনায়। তিনি লিখেছেন, মুজাফফারাবাদ সীমান্তবর্তী এলাকা হলেও নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল খুবই নাজুক। মহারাজা ছিলেন অযত্নবান এ বিষয়ে। এমনকি মুজাফফারাবাদের উজিরের বাসায় জরুরি সময়ে কোনো খবর দেওয়ার জন্য একটি টেলিফোনও ছিল না। ওই উজির দুনি চাঁদ মেহতার স্ত্রী কৃষ্ণা মেহতা তার স্মৃতিকথায় তুলে ধরেছেন একজন রিফিউজি হিসেবে ওপাশের মুসলিম পরিবারগুলোর কাছ থেকে কেমন ব্যবহার পেয়েছেন।

সেখানে মানবতা আর পাশবিকতার যুগপৎ চিত্র ফুটে উঠেছে। একজন মসজিদের ইমাম জীবন ও পরিবারের নিরাপত্তার ঝুঁকি নিয়ে ওই হিন্দু মহিলাকে নিরাপত্তা দিয়েছেন, আশ্রয় দিয়েছেন। আবার, কেবল হিন্দু হওয়ার অপরাধে সশস্ত্র কোনো যুবকের ক্রোধের মুখোমুখি হয়েছেন ওই নারী। ওই মা রিফিউজি ক্যাম্পে তার কিশোরী কন্যাদের নিরাপত্তার আশঙ্কা করেছেন। একাধিকবার মেয়েদের কাছ থেকে কমিটমেন্ট নিয়েছেন যেন কেউ তাদের স্পর্শ করলে সঙ্গে সঙ্গে নদীতে ঝাঁপ দেয়। আবার, একজন পোশাকধারী মুসলিম জওয়ানের ঘরে কন্যাদের পাঠিয়ে দিয়ে নিরাপত্তা পেয়েছেন। ইস্ট্রমেমন্ট অব অ্যাকসেশনের পর ভারতীয় সেনাবাহিনী কাশ্মীরে পৌছে। শক্ত অবস্থান নেয়। পাঠানরা ক্রমে পিছু হটে। অনেকে নিহত হয়। সেনা আক্রমণে পাঠানদের পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দাদেরও অনেকে নিহত হয়।

১৯৪৭ সালে সেনাবাহিনী শ্রীগনর বিমানবন্দরে নামার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই পার্শ্ববর্তী গোগো গ্রামে সহিংসতায় প্রায় ১২ জন মানুষের প্রাণহানি হয়। যাকে কাশ্মীর ভ্যালিতে ভারতীয় বাহিনীর প্রথম রক্তপাত হিসেবে রিপোর্ট করা হয়েছে ২০১৫ সালে। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল জিন্নাহ তখন তার নিয়মিত সৈন্য পাঠান সহায়তার জন্য। ফলে স্বাধীনতার প্রথম বর্ষেই যমজ রাষ্ট্র দুটি জড়িয়ে পড়ে যুদ্ধে। ভারতীয় সেনাবাহিনী বারামুলা পুনর্দখল করে। মুজাফফারাবাদ রয়ে যায় পাকিস্তানের অধীনে। তবে, এই যোগদান চুক্তি নিয়েও বিতর্কের শেষ নেই।

ব্রিটিশ ভারতের সরকার নতুন স্বাধীন ভারত সরকারের কাছে জম্মু-কাশ্মীরের সার্বভৌমত্ব হস্তান্তরের জন্য একটি দলিল তৈরি করেছিল ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে। দিন ও স্বাক্ষরের জায়গা খালি রাখা হয়েছিল তাতে। ওই দলিলেরই আগস্ট কেটে দিয়ে অক্টোবর লিখে তাতে স্বাক্ষর করা হয়েছে বলে ভারতীয় এক শ্বেতপত্রের বরাতে উল্লেখ করেছেন আবদুল মাজীদ সিরাজ। প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়ার ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৫ এর নিউজের বরাতে তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, ওই চুক্তির দলিল রাষ্ট্রীয় আর্কাইভ থেকে খোয়া

গেছে। আমেরিকা, কিছু আরব ও ইউরোপীয় দেশের পক্ষ থেকে ওই দলিল দেখতে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু, তার খোঁজ মেলেনি। তবে, অনেকে এই অভিযোগকে মিথ্যা মনে করে। ভারতের জন্য এই ডকুমেন্টই সবচেয়ে বড় আইনি ডকুমেন্ট। কারণ, জম্মু ও কাশ্মীরের (ভারতের অধীনস্থ অংশ) প্রথম বিধানসভায় এটির বৈধতা দেওয়া হয়েছে। এবং এটিকে জেঅ্যাভকের সংবিধানের অংশ করা হয়েছে। অপরদিকে পাকিস্তানের অভিযোগ, মহারাজাকে চাপে ফেলে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করানো হয়েছে। তাছাড়া, চুক্তির স্বাক্ষরকারী মহারাজা হরি সিংয়ের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না বলেও একে নাকচ করেছে পাকিস্তান। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের শুনানিতে পাকিস্তানের প্রতিনিধি স্যার এম জাফরুল্লাহ খান উল্লেখ করেছেন,

The accession which Mahraja Hari singh signed with the government of India runs parallel to the accession between Maharaja of Junagadh and Govt. of Pakistan, which India has unilaterally set aside.)

অর্থাৎ, জুনগরের মুসলিম মহারাজা পাকিস্তানের সঙ্গে একই ধরনের একটি যোগদান চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু, ভারতীয় কব্জা থেকে জুনগরকে মুক্ত রাখতে তা কোনো কাজে আসেনি। উপরন্তু, জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ১৯৪৮ ও ১৯৪৯ সালে একাধিক রেজুলেশনে বলা হয়েছে,

“The question of the accession of the state of Jammu and Kashmir to India or Pakistan will be decided through the democratic method of a free and impartial plebiscite’.

যদিও জাতিসংঘ তার এই অবস্থানের পক্ষে শক্ত কোনো ভূমিকা নিতে পারেনি। বরং, ক্রমান্বয়ে জাতিসংঘের অবস্থান গুরুত্বহীন হয়েছে। সমস্যা সমাধানের জন্য জাতিসংঘে প্রথম নালিশ করেছিল ভারতীয় পক্ষ। পরে, সেই ভারতীয় পক্ষই জাতিসংঘের ভূমিকাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করেছে। পাকিস্তান এখনও আন্তর্জাতিকভাবে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সমাধানের কথা বলে। কিন্তু, শিমলাচুক্তির আওতায় ভারত সেই দাবি সর্বদাই নাকচ করে এসেছে। পক্ষান্তরে, নানা পটপরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক মহলকে ভারত এটা অনেকটাই বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে সমস্যাটা দ্বিপক্ষীয়। এখানে থার্ড পার্টি অপ্রত্যাশিত। এমনকি কাশ্মীরের বাসিন্দাদেরও বা তাদের কোনো প্রতিনিধিকেও ভারত কোনো পক্ষ হিসেবে মেনে নিতে বাহ্যত রাজি হয়নি।

১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে ব্রিটিশ কর্মকর্তা মাউন্টব্যাটেন লাহোরে জিন্নাহর সঙ্গে বৈঠক করেন। ৮ই ডিসেম্বর যৌথ প্রতিরক্ষা কাউন্সিলের সঙ্গে বৈঠকেও নেহরু এবং মাউন্টব্যাটেন উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু, কাশ্মীর ইস্যুর কোনো সমাধান তারা করতে পারেননি। ফলে, মাউন্টব্যাটেন ও নেহরু সমস্যাটি জাতিসংঘে উপস্থাপনের উদ্যোগ নেন। ১ জানুয়ারি, ১৯৪৮ সালে ভারতীয় প্রতিনিধি পি পি পিল্লাই জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের কাছে বিষয়টি উপস্থাপন করেন। ১৯৪৮ সালের ১৪ই মে ইন্দিরা গান্ধী তার বাবাকে কাশ্মীর থেকে এক চিঠি

লিখেছিলেন। তাতে তিনি বলেছিলেন, They say that, only Sheikh Saheb is confident of winning the plebiscite। ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে জেঅ্যান্ডকে চিফ মিনিস্টার মুফতি সাঈদ বিধানসভায় বলেছিলেন, কাশ্মীরিরা দ্বিজাতিতত্ত্ব প্রত্যাখ্যান করেছে। এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় একজন কলামনিস্টের মন্তব্য এখানে উল্লেখযোগ্য। তিনি লিখেছিলেন,

More than a six decade of accession never means Kashmiris – as a people – have endorsed an enforced marriage with Delhi. When the people have not been asked at all, where does the question of rejection rise?’

এজি নূরানীর মূল্যায়ন,

Nehru cared little for the people of Kashmir, still less did Mohammad Ali Zinnah and least of all, the British’

অনেক ঐতিহাসিকের দাবি, সরদার প্যাটেল জেঅ্যান্ডকে-এর ভারতে যুক্ত হওয়ার পক্ষে ছিলেন না। বরং, নেহরু ছিলেন অতি আবেগী। নাসিদ হাজারি মিড নাইটস ফিউরিস নামক বইয়েও দাবি করেছেন, নেহরু তার পূর্বপুরুষের ভূমিকে ভারতে যুক্ত করতে প্যাটেলের চেয়ে বেশি ডেসপারেট ছিলেন। নেহরুই প্যাটেলকে রাজ্যটির ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব তুলে ধরে একে ভারতে যুক্ত করার ব্যাপারে রাজি করিয়েছেন।

এমনকি, ১৯৪৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর নেহরু প্যাটেলকে এক চিঠিতে লিখেছেন যে, শেখ আবদুল্লাহ এবং তার দল কিভাবে ভারতের স্বার্থরক্ষায় অ্যাসেট হিসেবে ভূমিকা রেখে আসছে। ১৯৪৭ পরবর্তী জেঅ্যান্ডকে-এর প্রথম মনোনীত নারী লোকসভা সদস্য কৃষ্ণা মেহতা তার বইয়ে লিখেছেন, নেহরু তার প্রতি এতটাই আন্তরিক ছিলেন যে তাকে বোন সম্বোধন করেছিলেন। সব মিলিয়ে ১৯৪৭ এর আগস্ট থেকে অক্টোবর এর ঘটনাবলীর সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন করলে দেখা যায়

এক. ভারত এবং পাকিস্তান উভয় দেশই (বিশেষত নেহরু এবং জিন্নাহ) জম্মু-কাশ্মীরকে নিজ নিজ দেশে সম্পৃক্ত করতে মরিয়া ছিলেন।

দুই. মহারাজাও দুই পক্ষের সঙ্গে আলাপ চালিয়ে সময় পার করছিলেন। মহারাজা অনেকটা উপলব্ধি করেছিলেন যে স্বাধীন থাকা কঠিন। বস্তুত, তিনি কখনও স্বাধীন ছিলেন না। ছিলেন ব্রিটিশ প্রিন্স। তিনি হিসাব করছিলেন কোনো পাশে গেলে লাভ বেশি। তবে, অনেক সূত্র থেকেই মহারাজার পরিবারের সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী বিভিন্ন গোষ্ঠীর অন্তরঙ্গ সম্পর্কের প্রমাণ মেলে। তা থেকে ধারণা করা যায়, স্বাধীন থাকতে চাইলেও মহারাজা হিন্দুরাষ্ট্রের দিকেই ঝুঁকছিলেন। হিন্দুত্বের প্রতি মহারাজার এই ঝোকই হয়তো পাকিস্তানকে সন্দেহে ফেলে থাকবে। যা মুজাফফারাবাদ আক্রমণের একটি নেপথ্য কারণ।

তিন. মহারাজার বিরুদ্ধে আন্দোলন, কৃষকদের জন্য আশাব্যঞ্জক নয়া কাশ্মীর ম্যানিফেস্টোসহ বিভিন্ন কারণে শেখ আবদুল্লাহর প্রতি অনুগত ছিল (অধিকাংশই কাশ্মীর ভ্যালির) সহজ-সরল সাধারণ মানুষ। শেখ আবদুল্লাহ জনগণের ধর্মীয় আবেগ ও ভৌগোলিক বাস্তবতার চেয়ে নেহরুর সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি কমিটমেন্টকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাছাড়া রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে মহারাজার বিরুদ্ধে আন্দোলন করা সত্ত্বেও তার দলের সঙ্গে মহারাজার একধরনের সমঝোতার সম্পর্ক ছিল।

চার. অন্য মুসলিম নেতারা (বিশেষত মুসলিম কনফারেন্স) পাকিস্তানের প্রত্যাশা করলেও তেমন কোনো শক্ত রাজনৈতিক সমর্থন এ পাশ থেকে দিতে পারেননি। বিশেষত, মুসলিম কনফারেন্সের মূল প্রভাব ছিল জম্মু এলাকার মুসলমানদের মধ্যে। কিন্তু, সেখানকার জনপ্রিয়তা রাজ্যের সার্বিক রাজনীতিতে কোনো প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেনি।

পাঁচ. ব্রিটিশ ভাইসরয় মাউন্ট ব্যাটেন কার্যত নেহরুর দ্বারা কনভিন্সড হয়েছিলেন। জিন্নাহ তাকে কনভিন্সড করতে পারেননি। ধারণা করা যেতে পারে, শেষমেশ মহারাজা ভারতে যোগ দিতে বাধ্য হবেন এমন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কাগজপত্র প্রস্তুত রাখা হয়েছিল ভাইসরয়ের দপ্তরে।

ছয়. পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম ফ্রন্টিয়ারের লোকেরা কাশ্মীরের মুসলিমদের উদ্ধারের জন্য ছুটে আসে। কিন্তু, তাদের স্বাগত জানানোর জন্য কাশ্মীরের শান্ত-দ্র মুসলমানেরা প্রস্তুত ছিলেন না। বরং, অন্য এলাকার উপজাতীয় লোকদের কাশ্মীর উদ্ধার বা দখল করতে আসা মহারাজাকে ভীত করেছে। যা তাকে ভারতে যোগ দিতে একটি পুশ-ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে। এবং, এই ঘটনাই ভারতের দখলদারির বৈধতা দেওয়ার পেছনে একটা শক্ত যুক্তি হয়ে গেছে। এখনও যা আওড়ানো হয়।

তবে, শেষ পয়েন্টের একটু বিশদ বিবরণ আবশ্যক। সাধারণত, এটি ভারতীয় বয়ান। ভারতীয় অধিকাংশ বর্ণনাই নর্থ-ওয়েস্টার্ন ফ্রান্টিয়ারের লোকদের হামলার ঘটনাকে বিনা উসকানিতে দখল করতে আসা হিসেবে দেখানো হয়। লক্ষণীয়, মহারাজার শেষণের বিরুদ্ধে গোটা রাজ্যের লোকদের ক্ষোভ ছিল চরমে। শেখ আবদুল্লাহর জনপ্রিয়তার পেছনেও ছিল মূলত মহারাজার বিরুদ্ধে আন্দোলন। কিন্তু, ওই হামলার পেছনে কোনো ঘটনা কাজ করেছে কিনা তা খতিয়ে দেখা জরুরি ছিল। বিশেষজ্ঞরা বলেন, রাষ্ট্র সবসময়ই একই সঙ্গে দুটি চর্চা করে।

Act of remembrance and act of forgetting. রাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থে কিছু কিছু ঘটনাকে ভুলে যেতে চায় আর কিছু কিছু ঘটনাকে স্মরণ করতে চায়। সম্ভবত, ওই আক্রমণের পেছনের ঘটনাবলী ভুলে যাওয়া কর্মসূচির অংশ হিসেবেই অনুল্লিখিত রয়েছে। তবে, কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী পক্ষ এই ঘটনাগুলোকে স্মরণ রাখছে। কারণ, এটা তাদের পক্ষের জন্য জরুরি। এ সংক্রান্ত বেশ কিছু বর্ণনা বিভিন্ন বরাতে পাওয়া গেছে। খালিদ বশির আহমদের লেখা একটি বিস্তারিত রিপোর্ট থেকে কিছু তথ্য এখানে তুলে ধরা যাক। তিনি লিখেছেন, ১৯৪৭ সালের আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে জম্মুর পূর্বদিকের উদমপুর, রাসি, কাঠুয়া জেলায় মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ চলেছে। আয়ান স্টেফারসের বরাতে নিহতের সংখ্যা প্রায় অর্ধমিলিয়ন উল্লিখিত হয়েছে। ১০ই আগস্ট ১৯৪৮ এর টাইমস অব লন্ডনের বরাতে তার উল্লিখিত তথ্য এখানে সরাসরি উল্লেখ করা যাক,

“Forming 40 percent of the popultion of this whole area (Jammu Province), to the north and astride the Chenab Muslims were in a majority in the Reasi, Ramban and Kishtwar areas and nearly attained parity in Bhaderwah. In the remaining Dogra areas the 237,000 Muslims were

systematically exterminated – unless they escaped to Pakistan along the border – by all the forces of the Dogra State, headed by the Maharaja in person and aided by Hindus and Sikhs. This happened in October, 1947, five days before the first Pathan invasion and nine days before the Maharaja’s accession to India. This elimination of two-thirds of the Muslims last autumn has entirely changed the present composition of eastern Jammu Province.”

আহমদ ব্যাখ্যা করেছেন,

The anti-Muslim violence in Jammu had two contributory factors- external and internal. The external factor was the arrival of large number of Hindu and Sikh refugees uprooted from areas that went to Pakistan and the areas of Jammu Province that later formed part of Pakistan Administered Jammu & Kashmir. … Internally, the atmosphere against Muslims had been building up for some time. Arms were being distributed among Hindu communalist groups even as Muslims were ordered to deposit with the government all weapons they possessed. Muslim soldiers in the Maharaja’s army too were disarmed. Arms training camp for Hindus and Sikhs was established in Jammu City. Preparations appeared in full swing for organizing bloodbaths in the Province. The Muslims as disempowered subjects, although numerically quite large, were fear stricken as they had no answer to the state sponsored violence. The elite among them were migrating to Pakistan and their leadership was in jail.

এছাড়া ওই রিপোর্টে জম্মু-কাশ্মীরের প্রথম মুসলিম সরকারি কর্মকর্তা কুদরতুল্লাহ, রাজনীতিক করণ দেবী শেঠী, সমাজকর্মী বলরাজ পুরী, জেঅ্যান্ডকে সিনিয়র আইনজীবী সাবির আহমেদ সালাহরিয়া, পশ্চিমা গবেষক অ্যালিস্টার ল্যাম্ব, কাশ্মীরি সাংবাদিক জিকে রেডিসহ বিভিন্ন ব্যক্তির বরাতে উল্লেখ করা হয়, মহারাজার

সঙ্গে হিন্দু সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী আরএসএস এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সুতরাং, রাজ্যের জম্মু এলাকায় মুসলিম বিরোধী তৎপরতায় মহারাজার সক্রিয় ভূমিকা ছিল। ১৯৪৭ সালের ১৮ই ডিসেম্বর সিভিল অ্যান্ড মিলিটারি গেজেটে ক্রিস্টোফার স্যাডেন রিপোর্ট করেন,

October 20 near Kathua and Akhnoor Bridge, on October 22 at Samba, on October 23 at Maogaon, on November 5 and 6 at Jammu City and on November 9 near Suchetgarh. As many as 70,000 Muslims were reported to have been killed in these seven incidents alone.

কৃষ্ণা মেহতা তার স্মৃতিকথায় (প্রাগুক্ত) তুলে ধরেছেন, মুজাফফারাবাদে তার স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি যখন বিভিন্ন বাড়িতে ও ক্যাম্পে রিফিউজি হিসেবে ছিলেন তখন অনেকে তাকে বলেছেন, জম্মুতে মুসলমানরা গণহত্যার শিকার হয়েছে। তার প্রতিশোধ হিসেবে তারা হিন্দুদের বিরুদ্ধে ভূমিকা নিচ্ছেন। যদিও তিনি সেই সব তথ্যকে বিশ্বাস করেননি। স্রেফ পাকিস্তানি প্রোপাগান্ডা হিসেবে মনে করেছেন। স্বভাবতই, মহারাজার উজিরের স্ত্রী হিসেবে মহারাজার শাসনের প্রতি আস্থা ছিল তার। তার স্বামী নিহত হয়েছিলেন মহারাজার নির্দেশ মান্য করতে গিয়ে। অনেক কর্মকর্তা সেখান থেকে নিরাপদে সরে গিয়েছিল। কিন্তু, তিনি (দুনি চাদ মেহতা) দায়িত্ব পালনের জন্য মুজাফফারাবাদে অবস্থান করেছেন। অথচ, মহারাজা নিজেও শ্রীনগর থেকে জম্মুতে আশ্রয় নিয়েছিলেন সস্ত্রীক।

সে সময় মহারাজা কাশ্মীর থেকে ৮৫টি গাড়িতে করে জিনিসপত্র বহন করে জম্মুতে নিয়ে গিয়েছেন বলে একটি সূত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।) মোদ্দাকথা, সীমান্তের উভয় পাশে উত্তেজনা ও অস্থিরতা ছিল অবর্ণনীয়। জম্মুতে যেমন ছিল মুসলমানদের করুণ অবস্থা তেমন ছিল মুজাফফারাবাদে হিন্দুদের। সংখ্যাগত দিক থেকে মুজাফফারাবাদে হিন্দু ছিল কম। ফলে সেখানে বিরাট সংখ্যায় হত্যার খবর মেলে না। বিপরীত দিকে জম্মুর বিভিন্ন জেলায় হিন্দু-মুসলিম সংখ্যা ছিল প্রায় সমান।

ফলে, সেখান থেকে মুসলিমবিরোধী সহিংসতায় নেমে এসেছিল ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। অসংখ্য মুসলিম জম্মু থেকে মুজাফফারাবাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। অনেকে মুজাফফারাবাদ গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল বিভিন্ন ক্যাম্পে। বিভিন্ন রিপোর্ট অনুসারে দুই থেকে পাঁচ লাখ মুসলিম জম্মু প্রভিন্স থেকে মুজাফফারাবাদে রিফিউজি হয়েছে। হিন্দুরা আসছিল জম্মুতে ওপাশ থেকে। পাঞ্জাবের কুরুক্ষেত্র ক্যাম্পে প্রায় দুই লাখ রিফিউজি আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে কৃষ্ণা মেহতা উল্লেখ করেছেন (পৃ:১৬৫)। এরই মধ্যে অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে

পাকিস্তান জম্মু-মুজাফফারাবাদ ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। তার উদ্দ্যেশ্য ছিল মহারাজাকে পাকিস্তানে যোগদানের বিষয়ে চাপ প্রয়োগ করা। ফলে, অনেক মানুষ আক্রমণকারীদের হাতে নিহত হয়। অধ্যায়ের গোটা আলোচনায় উপলব্ধির বিষয় হলো, সীমান্ত, জমিন আর রাষ্ট্র মহাগুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছিল ভারত, পাকিস্তান ও মহারাজার কাছে। প্রত্যাশার কেন্দ্রে ছিল ক্ষমতা। মানুষ তাদের কাছে মৌলিক বিষয় ছিল না। উল্লেখ্য, গোটা ব্যাপারটাতে এক ধরনের পরস্পর বিরোধী বর্ণনা প্রচলিত। ভারত শাসিত অংশের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দেওয়া বর্ণনাগুলোতে মুজাফফারাবাদে উপজাতীয় লোকদের আক্রমণে হিন্দুদের হত্যা, নারীদের ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের কথা উল্লেখ করা হয়।

বিপরীত দিক থেকে জম্মুতে মুসলিম গণহত্যার বিবরণকে স্মরণ করা হয়। এই দ্বিমুখী বর্ণনাগুলো কেবল সম্মিলিত সহিংসতার চক্র (Cycle of collective violence) তৈরি করছে। স্পষ্টতই, পাকিস্তান অধিকৃত মুজাফফারাবাদ অংশকে হিন্দুমুক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। পক্ষান্তরে, জম্মুকে করা হয়েছে মুসলিমমুক্ত করার চেষ্টা। এখানে কোনো একটি পক্ষের বর্ণনার মাধ্যমে বিপরীত পক্ষের বর্ণনাকে মিথ্যা প্রমাণ করা যায় না। কোনো পক্ষের হামলা আগে সংঘটিত হয়েছে তা তুলে ধরে অন্যপক্ষের হামলাকে বৈধতা দেওয়াও যায় না। সহজভাবে মনে হয়, মুসলমানের বিরুদ্ধে হিন্দু আর হিন্দুর বিরুদ্ধে মুসলমানদের এক উন্মত্ত সংঘাতের দিকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর, একই সময় সদ্যভূমিষ্ঠ দুটি রাষ্ট্র একে অপরকে দেখতে শুরু করেছিল হুমকি হিসেবে।

নোট/সূত্র

১. Sheikh Showkat Hussain; Facts of Resurgent Kashmir, Srinagar (2008); Pp: 17-18

২. Sajad Padder; India-Pakistan: Composite Dialogue Process, Issues and Actions (2015); Kalpaz: New Delhi; P:17.

৩. AG Noorani; The Kashmir Dispute (2013); New Delhi: Tulika Books.

৪. Sajad Padder; India-Pakistan: Composite Dialogue Process (2015); P:18.

৫. Mahboob Makdoomi; Kashmir Life (Online), Nov 11; 2015; http://www.kashmirlife.net/1947-how-delhi provoked-tribal-invasion-in-kashmir-89544/

৬. Abdul Majid Siraj; Kashmir Case Law (2006), UK: Scottspress Publishers Ltd; P282.

৭. Krishna Mehta; Kashmir 1947: A survivor’s Story (2005); Penguin Books; Pp: 4-5.

৮. Khalid Bashir Ahmed; Circa-1947: A long story (2014); http://www.kashmirlife.net.

৯. কৃষ্ণা মেহতার স্বামী দুনি চাঁদ মেহতা ছিলেন মহারাজা হরি সিংয়ের অধীনে মুজাফফরাবাদ জেলার উজিরে ওয়াজারাত। ১৯৪৭ সালে উত্তর পশ্চিমের গিলগিত-বালতিস্তান থেকে আসা সশস্ত্র লোকেরা মুজাফফারাবাদ দখল করে। সে সময় ওই উজির তাদের গুলিতে নিহত হন। ৬/৭টি শিশু-কিশোর সন্তান। নিয়ে কৃষ্ণা মেহতা বিভিন্ন ক্যাম্পে ক্যাম্পে কাটিয়ে শেষমেশ ভারতে ফেরেন। Kashmir 1947: A survivor’s Story; Penguin Books, 2005.

১০. KL Handoo, The First Blood Shade in Kashmir, 1947; Kashmir Life; (November 1-7, 2015), P21

১১. Abdul Majid Siraj; Kashmir Case Law (2006); P281.

১২. Samir Ahmed; Contextualizing Mosharraf’s Four Point Formula; Journal of Kashmir Studies (2012); Pp: 87 105.

১৩. Ajaz-Ul-Haque; Right Hand: Secular and A half; Greater Kashmir, October 8, 2015; P: 8.

১৪. Z G Mahmud; Burden of Geography; Greater Kashmir, August 10, 2015; P: 8.

১৫. জিকে রেডি কাশ্মীর টাইমস নামে এক পত্রিকার সাংবাদিক ছিলেন। তার পত্রিকা বন্ধ করে তাকে জম্মু-কাশ্মীর থেকে বহিষ্কার করা হয় ১৯৪৭ সালে। তিনি পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন। পরে তিনি আজাদ কাশ্মীরে গিয়ে রিফিউজি ক্যাম্প পরিচালনা করেন। কৃষ্ণা মেহতা তার স্মৃতিকথায় ক্যাম্পে মি. রেডির বদান্যতার কথা উল্লেখ করেছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *