১৯৪২। বয়স ৪৩ বছর
১৯৪২-এর ২২ নভেম্বর, ৬ অগ্রহায়ণ রাসপূর্ণিমা, রবিবার। জীবনানন্দের পিতা সত্যানন্দ দাশ পরলোক গমন করেন। তখন সত্যানন্দের বয়স ৮০ বছর। বরিশালের বাড়িতেই তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পক্ষকাল পরে শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে জীবনানন্দ পিতা সত্যানন্দের সর্বাঙ্গীণ পরিচয় তুলে ধরে একটি নিবন্ধ পাঠ করেন। তার খণ্ডাংশ এ রকম—
‘আমার বাবা ছিলেন সত্যানন্দ দাশ। তাঁর সম্বন্ধে ভাবতে গেলেই মনে হয়, ভিতরের সঙ্গে বাইরের জীবনের যে বিরোধ একদিকে মানুষের ব্যক্তিমানস ও অন্যদিকে তার ব্যবহারিক ও জনমানস-আশ্রয়ী জীবনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায় তাঁর বেলায় তা তেমন নিঃশেষে ঘটে উঠতে পারেনি।’ [আমার মা-বাবা’, জীবনানন্দ দাশ, পৃ. ৪] বাবার মৃত্যুর পর সংসার-অনভিজ্ঞ, লাজুক, ঘরকুনো তেতাল্লিশ বছরের কবি-অধ্যাপক জীবনানন্দকে নিরুপায় হয়ে পারিবারিক দায়িত্ব গ্রহণ করতে হল।
বাবার মৃত্যুর অল্প কয়েকদিন পরে জীবনানন্দের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘বনলতা সেন’ প্রকাশিত হয়। বনলতা সেন : প্রথম প্রকাশ : পৌষ ১৩৪৯, ডিসেম্বর ১৯৪২। কবিতা ভবন (২০২ রাসবিহারী এভিনিউ, কলকাতা) প্রকাশিত। ‘এক পয়সার একটি’ গ্রন্থমালার অন্তর্ভুক্ত।
প্রকাশক : জীবনানন্দ দাশ, বরিশাল।
মুদ্রাকর : ব্রজেন্দ্রকিশোর সেন, মডার্ণ ইন্ডিয়া প্রেস, ৭ ওয়েলিংটন স্কোয়ার, কলিকাতা। কাগজের মলাট। প্রচ্ছদশিল্পী : শম্ভু সাহা। মূল্য : চার আনা। ডিমাই ৮ পেজি। পৃষ্ঠা : ১৬। কবিতার সংখ্যা : ১২।
কবিতাগুলোর শিরোনাম :
১. বনলতা সেন, ২. কুড়ি বছর পরে, ৩. ঘাস, ৪. হাওয়ার রাত, ৫. আমি যদি হতাম, ৬. হায় চিল, ৭. বুনো হাঁস, ৮. শঙ্খমালা, ৯. নগ্ন নির্জন হাত, ১০. শিকার, ১১. হরিণেরা, ১২. বিড়াল।
জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর দু’বছর আগে অর্থাৎ ১৯৫২ সালে ‘বনলতা সেন’ কাব্যের দ্বিতীয় সংস্করণ হয়।
‘বনলতা সেন : দ্বিতীয় সংস্করণ : [প্রথম সিগনেট সংস্করণ] শ্রাবণ ১৩৫৯ [১৯৫২]। প্রকাশক : দিলীপকুমার গুপ্ত, সিগনেট প্রেস ১০/২ এলগিন রোড, কলকাতা-২০। প্রথম প্রকাশের ১২টি কবিতা ছাড়া এ সংস্করণে আরো ১৮টি কবিতা গৃহীত হয়েছে। নতুনভাবে গৃহীত ১৮টি কবিতার শিরোনাম হল :
১. সুদর্শনা, ২. অন্ধকার, ৩. কমলালেবু, ৪. শ্যামলী, ৫. দু’জন, ৬. অবশেষে, ৭. স্বপ্নের ধ্বনিরা, ৮. আমাকে তুমি, ৯. তুমি, ১০. ধান কাটা হয়ে গেছে, ১১. শিরীষের ডালপালা, ১২. হাজার বছর শুধু খেলা করে, ১৩. সুরঞ্জনা, ১৪. মিতভাষণ, ১৫. সবিতা, ১৬ সুচেতনা, ১৭. অঘ্রান প্রান্তরে, ১৮. পথ হাঁটা।
‘বনলতা সেন’ কাব্য সম্পর্কে আলোচনা-সমালোচনা :
এ বছর ‘বনলতা সেন’ কাব্যের আলোচনা বেরোয় নিম্নলিখিত পত্রিকায়–
১. ‘কবিতা’: চৈত্র ১৩৪৯। আলোচক : বুদ্ধদেব বসু। ২. ‘চতুরঙ্গ’: চৈত্র ১৩৪৯। আলোচক : আবুল হোসেন।
১৯৪৩ সালে বুদ্ধদেব বসু ‘বনলতা সেন’-এর সমালোচনায় লেখেন—
‘আমাদের আধুনিক কবিদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ সবচেয়ে নির্জন, সবচেয়ে স্বতন্ত্র। বাংলা কাব্যের প্রধান ঐতিহ্য থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন এবং গেলো দশ বছরে যেসব আন্দোলনের ভাঙা-গড়া আমাদের কাব্য জগতে চলেছে, তাতেও তিনি কোনো অংশগ্রহণ করেননি। তিনি কবিতা লিখেন এবং কবিতা ছাড়া আর কিছু লিখেন না, তারচেয়ে তিনি স্বভাব-লাজুক ও মফস্বলবাসী; এইসব কারণে আমাদের সাহিত্যিক রঙ্গমঞ্চের পাদপ্রদীপ থেকে তিনি সম্প্রতি যেন খানিকটা দূরে সরে গিয়েছেন। আধুনিক বাংলা কাব্যের অনেক আলোচনা আমার চোখে পড়েছে যাতে জীবনানন্দ দাশের উল্লেখমাত্র নেই। অথচ তাঁকে বাদ দিয়ে ১৯৩০ পরবর্তী বাংলা কাব্যের কোনো সম্পূর্ণ আলোচনা হতেই পারে না। কেননা এই সময়কার তিনি একজন প্রধান কবিকর্মী, আমাদের পরিপূর্ণ অভিনিবেশ তাঁর প্রাপ্য।’ [জীবনানন্দ দাশ’, বুদ্ধদেব বসু]।
রটনা :
‘তাঁর আত্মীয়স্বজন একবার তাঁকে চেপে ধরেছিলেন বনলতা সেন কে জানবার জন্যে এবং তাঁর মতো বিবাহিত একজন পুরুষ অপর নারীর সঙ্গে সম্পর্কিত কেন এর জবাব দাবী করেছিলেন।’ [জীবনানন্দ দাশ : জন্মশত বার্ষিক স্মারক গ্রন্থ’, সম্পাদক : আবদুল মান্নান সৈয়দ, আবুল হাসনাত, পৃ. ২৫৩]
এ বছর নিহত হলেন সোমেন চন্দ, মারা গেলেন হীরেন্দ্র দত্ত।
৮ মার্চ সোমেন চন্দ নিহত হবার প্রতিবাদে কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয় ফ্যাসিস্টবিরোধী সম্মেলন। ২৮ মার্চ গঠিত হয় ‘ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘ’, সভাপতি অতুলচন্দ্র গুপ্ত, যুগ্ম সম্পাদক বিষ্ণু দে ও সুভাষ মুখোপাধ্যায়।
জন্মগ্রহণ করলেন দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, শান্তনু দাস, ফিরোজ চৌধুরী, শহীদ কাদরী, জাহাঙ্গীর তারেক, সিকদার আমিনুল হক।
কলকাতা বেতারকেন্দ্র প্রচারিত শিশুদের আসরে দশ মিনিটের একটি অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করার সময় অকস্মাৎ বাক রুদ্ধ হয়ে যায় নজরুলের। সেদিন তারিখ ছিল ৯ জুলাই। নজরুল প্রবলভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাকরুদ্ধ হওয়ার পরবর্তী এক সপ্তাহ ডা. বি.এল. সরকারের চিকিৎসাধীন ছিলেন নজরুল। পরবর্তী দু’মাস হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার জন্যে সপরিবারে মধুপুরে ছিলেন। ২১ সেপ্টেম্বর কলকাতা ফিরে আসেন। এর পরে কলকাতায় লুম্বিনী পার্ক মানসিক হাসপাতালে ডা. নগেন্দ্রনাথ দে ও ডা. গিরীন্দ্রশেখর বসুর অধীনে চার মাস চিকিৎসাধীন ছিলেন নজরুল।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি অস্থির ও উত্তাল হয়ে ওঠে।
প্রকাশিত গ্রন্থ : প্রকাশিত হয় অমিয় চক্রবর্তীর ‘মাটির দেয়াল’, অজিত দত্তের ‘নষ্টচন্দ্র’, বুদ্ধদেব বসুর ‘এক পয়সার একটি’, ‘বাইশে শ্রাবণ’, দিনেশ দাসের ‘কবিতা’, মনীন্দ্র রায়ের ‘একচক্ষু’, গোপাল হালদারের ‘সংস্কৃতির রূপান্তর’, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জলসাঘর’, ‘কবি’, ‘গণদেবতা’, সমর সেনের ‘নানা কথা’, সুকুমার সেনের ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, ১ম খণ্ড—অপরাধ’, হুমায়ুন কবিরের শরৎ সাহিত্যের মূলতত্ত্ব’, সঞ্জয় ভট্টাচার্যের উপন্যাস ‘বৃত্ত’, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ঘরোয়া’, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বাংলা সাময়িকপত্র’, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের ‘নীলাঙ্গুরীয়’। প্রকাশ পায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চতুষ্কোণ’। সেপ্টেম্বর মাসে শারদীয় ‘আনন্দবাজার’-এ বের হয় সম্পূর্ণ উপন্যাস ‘সহরবাসের ইতিকথা।