১৯৪১। বয়স ৪২ বছর
এ বছর সাহিত্যক্ষেত্রে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটি ঘটল। পরলোক গমন করলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; মৃত্যু-তারিখ ৭ আগস্ট ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ, ২২ শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ। কলকাতাতেই রবীন্দ্রনাথ প্রয়াত হলেন। জীবনানন্দ দাশ তখন বরিশালে। মৃত্যুর কয়েকদিন পরেই ছাত্রাবাসের উঁচু ক্লাসের কয়েকজন ছাত্র রবীন্দ্রনাথের স্মরণ সভায় আলোচনার জন্যে জীবনানন্দের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে আহ্বান জানান। মৃদুভাষী জীবনানন্দ এই সভায় অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছিলেন। এটি ছিল লিখিত ভাষণ। পরে সেটি ব্রজমোহন কলেজ পত্রিকা’য় ‘রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক বাংলা কবিতা’ নামে ছাপা হয়। ‘একাশি বৎসরে রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণ হল’ দিয়ে লেখাটি শুরু করেছেন জীবনানন্দ। এর পরে লিখেছেন—
‘রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্ব ও তাঁর প্রতিভার বিচিত্র দানের কথা অনেকদিন থেকে আমাদের দেশে ও সমস্ত পৃথিবীতে আলোচিত হয়ে আসছে। কিন্তু আমার মনে হয় আমরা এখনো রবীন্দ্রনাথের আনুপূর্বিক ভাস্বরতার এত বেশি নিকটে যে ইতিহাসের সেই স্থির পরিপ্রেক্ষিতের দরকার একজন মহাকবি ও মহামানবকে পরিষ্কারভাবে গ্রহণ করতে হলে, আমাদের আয়ত্তে তা নেই। তৎসত্ত্বেও আমরা অনুভব করি—রবীন্দ্রনাথ আমাদের ভাষা, সাহিত্য, জীবনদর্শন ও সময়ের ভিতর দিয়ে সময়ান্তরের গরিমার দিকে অগ্রসর হবার পথে যেরকম নিরঙ্কুশভাবে গঠন করে গেছেন পৃথিবীর আদিকালের মহাকবি ও মহাসুধীরাই তা পারতেন; ইদানীং বহুযুগ ধরে পৃথিবীর কোনো দেশই এরকম লোকোত্তর পুরুষকে ধারণ করেনি।’
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে জীবনানন্দ তিনটি কবিতা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মরণে। তিনটি কবিতারই শিরোনাম ছিল—’রবীন্দ্রনাথ’।
প্রকাশিত হয়েছিল যে তিনটি পত্রিকায়, তাদের নাম হল ‘পরিচয়’ (অগ্রহায়ণ ১৩৪৭), ‘পূৰ্ব্বাশা’ (রবীন্দ্র-স্মৃতি : ১৩৪৮) ও ‘পঁচিশে বৈশাখের সংকলন’-এ (শ্রাবণ ১৩৪৯)। এগুলো ছাড়াও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে জীবনানন্দের আরও ২টি কবিতা পাওয়া যায়। একটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘ঊষা’তে (জ্যৈষ্ঠ ১৩৬১)। অনেক পরে ‘রবীন্দ্রনাথ’ শিরোনামের আর একটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। এটি জীবনানন্দের ১৯৩১-৩২ চিহ্নিত পাণ্ডুলিপি খাতা থেকে সংগৃহীত হয়েছিল।
এ বছর যাঁরা মারা গেলেন তাঁরা হলেন বের্গস, জেমস্ জয়েস, ভার্জিনিয়া উলফ্, ব্যাডেন পাওয়েল।
জন্মগ্রহণ করলেন সুব্রত চক্রবর্তী, মানিক চক্রবর্তী, মুকুল গুহ, আবদুশ শাকুর, ওয়াকিল আহমদ।
রবীন্দ্রনাথের বয়স ৮০। ৮ মে ভারতব্যাপী রবীন্দ্র-জন্মোৎসব পালিত হয়। ত্রিপুরার রাজদরবার হতে প্রতিনিধিরা এসে কবিকে ‘ভারত ভাস্কর’ উপাধি প্রদান করে গেলেন। বুদ্ধদেব বসু সপরিবারে শান্তিনিকেতনে ভ্রমণে যান। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এই-ই ছিল তাঁর শেষ সাক্ষাৎ। বুদ্ধদেব বসু ‘কবিতা’ পত্রিকার ‘রবীন্দ্রসংখ্যা প্রকাশ করেন। মিস র্যাথবোর্নের ভারত ও বন্দি জওহরলালের নিন্দাসূচক রচনার উত্তর দিলেন কবি রোগশয্যা হতে। পীড়া বাড়লে কবিকে ডাক্তারদের পরামর্শে ২৫ জুলাই কলকাতায় স্থানান্তরিত করা হয়। এটাই কবির শেষবারের মতো শান্তিনিকেতন ত্যাগ। ৩০ জুলাই রবীন্দ্রনাথ জীবনের শেষবারের মতো মুখে মুখে রচনা করলেন—
‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি/বিচিত্র ছলনাজালে/ হে ছলনাময়ী।’
ওই দিনই বেলা ১১:২০ মিনিটে রবীন্দ্রনাথের অপারেশন হল। অপারেশন করলেন ডাক্তার ললিতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। বিধান রায় এ অপারেশনের পক্ষে ছিলেন, দ্বিমত পোষণ করেছিলেন ডাক্তার নীলরতন সরকার।
৭ আগস্ট ১২:৩০ মিনিটে রবীন্দ্রনাথ পরলোক গমন করলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর ৩ মাস।
বাংলা সাহিত্যের এক বহু বিস্তৃত, অতল গভীর, বৈভবময় যুগের অবসান হল। রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণে কাজী নজরুল ইসলাম তাৎক্ষণিকভাবে ‘রবিহারা কবিতাটি রচনা করেন এবং কলকাতা বেতারকেন্দ্রে স্বকণ্ঠে পাঠ করেন।
উল্লেখ্য, ১৯১৩ সালের ১৪ নভেম্বর রবীন্দ্রনাথের কাছে নোবেল পুরস্কারের খবরটি পৌঁছেছিল। ৯১ বছর পূর্বে কবিকে যে নোবেল পদকটি দেওয়া হয়েছিল, ২০০৪ সালের ২৫ মার্চের পূর্বরাত্রিতে সেটিসহ অন্যান্য দ্রব্য সামগ্রী চুরি হয়ে যায়। চুরি যাওয়া উল্লেখযোগ্য জিনিসগুলো হল—
১. রৌপ্য ফলক, ২. ওঁ লেখা সোনার আংটি, ৩. জামার সোনার বোতাম, ৪. কাফলিঙ্ক, ৫. মৃণালিনী দেবীর বালুচরী শাড়ি, ৬. সোনা বাঁধানো নোয়া, ৭. নোবেল পুরস্কারের পদক, ৮. রুপার কফি কাপ, ৯. কফি কাপ রাখার তেপায়া, ১০. রুপার রেকাবি, ১১. সামুরাই তরবারি, ১২. সোনার হাতল দেওয়া লাঠি, ১৩. সোনার পকেটঘড়ি, ১৪. চৈনিক চামচ, ১৫. পাউরুটি কাটার ছুরি, ১৬. রুপার চামচ, ১৭. ছোট রুপার চামচ (২টা), ১৮. রুপার কাঁটা, ১৯. রুপার গ্লাস, ২০. পাথরের কাপ (৩টি), ২১. পাথরের প্লেট, ২২. তাম্র ফলক, ২৩. রুপার ঝাঁপি, ২৪. রুপার কর্ণিকা, ২৫. রুপার পাত্র, ২৬. হাতির দাঁতের হাতল দেওয়া রুপার কর্ণিকা, ২৭. কোবে শহর থেকে পাওয়া হাতির দাঁতের ঝাঁপি, ২৮. রৌপ্যখচিত ঝাঁপি, ২৯. বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের স্বর্ণকমল, ৩০. লক্ষ্ণৌর রৌপ্যফলক, ৩১. দুটি তাম্রপদক, ৩২. ফ্লোরেন্সের রৌপ্যপদক, ৩৩. সুইজারল্যান্ডের রৌপ্যপদক, ৩৪. কমলা স্বর্ণপদক, ৩৫. স্বর্ণপদক, ৩৬. স্বর্ণফলক (৪৯২ গ্রাম), ৩৭. তাম্রপদক, ৩৮. হস্তীদন্তখচিত কাঠের ফলক, ৩৯. পিতলের চুরি, ৪০. পিতলের পিরিচ, ৪১. রুপার দানি, রুপার ফুলদানি, ৪২. রুপার শিকল।
সব মিলিয়ে ৫০টি বিভিন্ন ধরনের জিনিস খোয়া গেছে। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, কবির ৭০তম জন্মদিনে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর দেওয়া ৪৯২ গ্রামের স্বর্ণফলক-এর ডিজাইন করেছিলেন শিল্পী নন্দলাল বসু। লিখেছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আশুতোষ মুখার্জির মেয়ে কমলা দেবীর নামে স্বর্ণপদক। সামুরাই তরবারিটি রবীন্দ্রনাথের ভাইপো সুরেন্দ্রনাথ করকে দিয়েছিলেন জাপানি শিল্পী কাকুজাও কাকুরা।
নব পর্যায়ে প্রকাশিত ‘নবযুগ’-এ মাসিক ৩৫০ টাকা বেতনে এ. কে. ফজলুল হক কাজী নজরুল ইসলামকে নিযুক্তি দেন। ২৯ নভেম্বর কলেজ স্ট্রিটের Y.M.C.A হলে হাজী মুহম্মদ মহসীনের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত সভায় সভাপতিত্ব করেন নজরুল। এবং এটাই নজরুলের সুস্থ অবস্থায় শেষবারের মতো প্রকাশ্য সভায় অংশগ্রহণ।
স্বগৃহে অন্তরীণ অবস্থা থেকে অন্তর্ধান করলেন সুভাষচন্দ্র বসু। আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠিত হল। ‘জামায়াতে ইসলামী হিন্দ’-এর জন্ম। মুসলিম লীগ থেকে ফজলুল হক বহিষ্কৃত হলেন। শ্যামা-হক মন্ত্রিসভা গঠিত হল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বিতীয় বছর। জার্মান বাহিনী বুলগেরিয়া, যুগোশ্লাভিয়া, গ্রিস অধিকার করে। স্টালিন রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হলেন। অনাক্রমণ চুক্তি ভঙ্গ করে হিটলার রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। রাশিয়ার অধিকাংশ স্থান জার্মানির করতলগত হল। ইংল্যান্ডের ওপর জার্মানির বিমান আক্রমণ। জাপান মার্কিন-নৌঘাঁটি পার্ল হারবার ধ্বংস করে। আমেরিকা জার্মানি ও ইতালির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। জাপানি বাহিনীর আক্রমণের তীব্রতায় ব্রিটিশ বাহিনী রেঙ্গুন ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রিকা : প্রকাশ পায় রবীন্দ্রনাথের ‘আরোগ্য’, ‘জন্মদিনে’, ‘সভ্যতার সংকট’, ‘আশ্রমের রূপ ও বিকাশ’, ‘রবীন্দ্র রচনাবলী—৬ষ্ঠ, ৭ম ও ৮ম খণ্ড; ইংরেজিতে বের হল ‘দি ক্রাইসিস ইন সিভিলাইজেশন’।
প্রকাশিত হয় বিষ্ণু দে’র ‘পূর্বলেখ’, অন্নদাশঙ্কর রায়ের ‘উড়কি ধানের মুড়কি’, ‘জীবনশিল্পী’, দিনেশ দাসের ‘কবিতা : ১৩৪৩–৪৮’, সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়ের মডার্ণ কবিতা’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অহিংসা’, ‘ধরাবাঁধা জীবন’, বুদ্ধদেব বসুর ‘সব পেয়েছির দেশে’, সুকুমার সেনের ‘বাঙ্গালা সাহিত্যে গদ্য’, সুবোধ ঘোষের গল্পগ্রন্থ ‘ফসিল’, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী’।
বের হয় ব্রেখটের ‘মাদার কারেজ’, মোরাভিয়ার ‘ফ্যান্সি ড্রেস পার্টি 1 শুদ্ধসত্ত্ব বসু সম্পাদিত ‘একক’ পত্রিকা প্রকাশিত হয় এ বছর।